এই কোরবানির ঈদে ছুটি একেবারেই নেই। নেই বললে ভুল হবে ছিলই না। যারা সরকারি চাকরি করেন তারা ভালো বুঝেছেন নিশ্চয়। প্রথমত, ঈদ পড়েছে সরকারি ছুটির দিন শনিবার। মাঝে রবিবার ছুটি, সোম থেকে আবার শুরু অফিস, আদালতের দাপ্তরিক সকল ব্যস্ততা। এই যে, আমি দু-এক লাইন লেখতে বসেছি এটার মূল কারণ কিন্তু ঈদের ছুটি নিয়ে নয়। আসল কারণ হল এই ঈদে আমি কি করেছি বা কি দেখেছি মূলত সেটা। ভাবছিলাম আমাদের বাংলা সিনেমায় যার একছত্র আধিপত্য। সেই নায়ক রাজ রাজ্জাকের অভিনীত সেরা কিছু সিনেমা দেখে এইবারকার ঈদ কাটাবো। যেই ভাবা সেই কাজ।
শুরু হল রংবাজ দিয়ে আর শেষ হল ছুটির ঘণ্টা দিয়ে। কিন্তু শেষ হয়েও যে হল না শেষ। এই শেষ না হওয়ার কারণ কিন্তু নায়ক রাজ রাজ্জাক নয়। ইউটুবে কোন সিনেমা সার্চ দিলে প্রাসঙ্গিক আরও কিছু সিনেমার লিস্ট দেখা যায়। চোখ ঘুরতে ঘুরতে আটকে গেল ভারতীয় একটি সিনেমার দিকে। ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ফড়িঙের পোষ্টার। অভিনয় করেছেন ছবিটির মূল চরিত্রে চৌদ্দ বছরের এক বালক যার নাম আকাশ অধিকারী। অভিনেত্রী সহনী সরকার, অভিনেতা শঙ্কর দেবনাথ। ছবির শুরুতে দেখা যায় এক স্বল্পবসনা শিক্ষিকা ক্লাসরুমে। ফড়িং একা তার সামনে। শিক্ষিকা জানায় ফড়িং পরীক্ষায় সব বিষয়ে ফেল করেছে। শিক্ষিকা ফড়িংকে ডাকে কাছে আয়। ফড়িঙের দৃষ্টিতে শিক্ষিকার উন্মুক্ত শরীর। ঘুম ভেঙ্গে যায় ফড়িঙের। প্যান্টের ভিতরে হাত দিয়ে টের পায় যে তার স্বপ্নদোষ হয়েছে। ছুটে যায় বাথরুমে। এক চৌদ্দ বছরের কিশোরের বয়ঃসন্ধিকালের নানা ঘটনা এবং কিশোরের স্কুল শিক্ষিকার সাথে সম্পর্ককে ঘিরে আবদ্ধ হয়েছে এই কাহিনীচিত্রের। যদিও কেউ কেউ এটিকে যৌনতা বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা চালিয়েছেন। আমি এখানে অবশ্য যৌনতার কোন বালাই দেখিনি। যদিও কিশোর মনে ছেলেটি শিক্ষিকাকে ঘিরে যৌনতার কিছু দৃশ্য দেখা যায় যার একটিতে দেখা যায় সে তার শিক্ষিকার বাথরুমে গিয়ে শিক্ষিকার প্যানটি এবং সে ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করে। আবার একটিতে দেখা যায় সে শিক্ষিকাকে কল্পনার কামুক চোখে দেখে হস্ত মৈথুন করে।
কিশোর মনের কৌতূহল, শিক্ষিকার উদার মানসিকতার মধ্যে দিয়ে ছাত্রকে গড়ে তোলার এক অনুপম চিত্র হিসেবেই দেখতে চাই আমি। কিশোর আকাশ অধিকারী ক্লাস পরীক্ষায় দুটো বিষয়ে ফেল করেছে। এতে খেপেছে তার বাবা। তার সহপাঠী, শিক্ষকরা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছেন এই ফেল করাকে। আর সেই শিক্ষিকা দেখেছেন যে পাশের মধ্যে বাহাদুরি নেই ফেল করা ছাত্রের মাঝেও লুকিয়ে থাকে অন্য এক ছাত্র। যে ন্যাশনাল জিওগ্রাফী, ডিসকভারি, এনিমেল প্ল্যানেট দেখে জীবজগৎ থেকে বা এই বিচিত্র পৃথিবীর অনেক কিছু জানা যায়। যা অন্য অনেক ছাত্র জানে না। কারণ তারা শুধু পাঠ্য বইয়ে নিজেদের সীমাবদ্ধ করে রাখে। ধীরে ধীরে শিক্ষিকার সাথে গড়ে ওঠে মধুর এক সম্পর্ক। যা কিশোর মনকে সঙ্গত কারণেই নাড়া দিয়ে যায়। শত কৌতূহল। শত প্রশ্ন, হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খায় কিশোরের মনে। কিশোরের জন্মদিন উপলক্ষে শিক্ষিকা একটি মোবাইল গিফট করে ছেলেটাকে। ঘটনার সূত্রপাত মূলত এখান থেকেই । মোবাইল হাতে পেয়ে সে একের পর এক ছবি তুলতে থাকে শিক্ষিকার। সেই সাথে শিক্ষিকার অগোচরে করে ভিডিও।যেখানে দেখা যায় কোকাকোলা খেয়ে শিক্ষিকা ঘরের মাঝে আপন মনে নেচে চলছে। এই ভিডিও কিশোরের অগোচরে লুকিয়ে দেখে ফেলে তার এক সহপাঠী যার নাম লাড্ডু। সেখান থেকে সে মোবাইল কৌশলে নিজের মোবাইল নিয়ে নেয়। এভাবেই এক মোবাইল থেকে অন্য মোবাইলে অতঃপর স্কুল, পারা প্রতিবেশী অবিভাবক, থেকে এক কান দুকান অতঃপর ছড়িয়ে পড়ে অপবাদ। চাকরি যায় শিক্ষিকার। ছাত্রকে স্কুল ছাড়তে দেওয়া হয় কতিপয় শর্ত। এরই মাঝে সেই শিক্ষিকার বন্ধুর লুকিয়ে রাখা কিছু অবৈধ অস্ত্র, সরঞ্জাম দেখে ফেলে সেই লাড্ডু আর কিশোর অভিনেতা আকাশ অধিকারী। এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় সেই শিক্ষিকা আর তার বন্ধু অভিনেতা শঙ্কর দেবনাথ। পুলিশ এসে উদ্ধার করে অবৈধ অস্ত্র। ছাত্রটি খোঁজতে থাকে তার শিক্ষিকাকে। যার কাছে সে পেয়েছে মায়াময় স্নেহ আর অগাধ ভালোবাসা। সেই অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা আবার প্রচারিত হয় সংবাদ চ্যানেল। যেখানে শিক্ষিকাকেও বলা হয় যে স্মাগ্লার। অথচ সেই শিক্ষিকা এর কিছুই জানত না। ছেলেটি শিক্ষিকার সন্ধানে একলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরে। ছুটে যায় কোলকাতায়। এখানে সেখানে ঘুরে ফেরে। কাজ নেয় এক হোটেলে। চলতে থাকে অমানসিক সংগ্রাম। কাজের ফাঁকে ফাঁকে খোঁজতে থাকে তার প্রিয় শিক্ষিকাকে।
একদিন সেই হোটেলের মালিক খবরের কাগজ পড়তে থাকে পত্রিকার পাতায় চোখ আটকে যায় কিশোরের। জানতে পারে সেই শিক্ষিকা আর তার বন্ধু আটক হয়েছে কোলকাতার পুলিশ তাদের আদালতে তুলবে। কিশোরটি ছুটে যায় আদালত প্রাঙ্গণে। দেখে প্রিয় শিক্ষিকার সেই চিরচেনা মুখ। যাকে সে হন্য হয়ে খোঁজে চলছে অবিরাম। চলছে বেঁচে থাকার জীবন সংগ্রাম। ছুটে যায় পুলিশের কাছে আবদার করে তার সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দিতে। অনেক চেষ্টার পরে সে সফলকাম হয়। সাক্ষাৎ হয় দুজনের, কথা হয়। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে শিক্ষিকা। একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে। কিভাবে সে এখানে, কেন, বাবা-মাকে ছেড়ে এসেছে কেন। সুবোধ বালক সব প্রশ্নের উত্তর দেয় তার স্বাভাবিক ভঙ্গীতে। শিক্ষিকার জন্য নিয়ে আসে টিস্যু। যা সে দিতে চায় শিক্ষিকাকে কিন্তু জেলে তা নেওয়া যাবে না বলে প্রথমে সে ফেরত দিতে চায় কিন্তু ছেলেটি একটি টিস্যু মুড়িয়ে জেলের রডের ছিদ্র দিয়ে দিয়ে দেয়। শিক্ষিকা প্রশান্ত মনে মুছে চলে চোখ মুখ। এবং কিশোরকে বলে গ্রামে ফেরত যেতে অঙ্গিকার করে যে প্রতিনিয়ত সে চিঠি লিখে সে জানাবে তার অবস্থা এবং সে নিজেও চিঠি পাবে বলে আশা করে ছেলেটির কাছে। ছেলে যথারীতি ফিরে যায় গ্রামে। সেই স্কুল বন্ধু লাড্ডু। বাবা মা, বাজারের দোকানদার পাড়া প্রতিবেশী সবাই খুশি হয় ছেলেটি ফেরত আসায়।
শেষ হয় সিনেমা। থেকে যায় পরিচালকের এক অনুপম হাতের কাহিনীচিত্র। দুটি প্রাণের সরল সম্পর্কের মাঝে সামাজিকতার সকল দেয়াল হয়ে উঠে অবান্তর। বাস্তবতার দারুণ চিত্র এঁকেছেন অভিনেতা,অভিনেত্রীসহ সকল কলাকুশলী। যা আমার দেখা এই পর্যন্ত সেরা ছবি।
(চলবে)
সুদীপ্ত প্রকাশ।
ভালোবাসা নিবেন আমার প্রিয়।
অসাধারণ একটি রিভিউ হয়েছে বলে মনে হলো আমার কাছে।
ফড়িং চলচ্চিত্রটি আমি দেখেছি। এককথায় আমি বাকরুদ্ধ।
আপনার উপস্থিতি নিয়মিত হোক এমনটাই চাই।
ভালবাসা ও প্রীতি নিবেন আমার শ্রদ্ধাভাজন।