ভালবাসা শুধু ভালবাসা (তৃতীয় পর্ব)

শ্মশানে কাঁদছে ভালবাসা
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

বকুলের প্রাণহীন নিথর দেহটাকে শ্মশানের চিতায় শুইয়ে দেওয়া হল। চিতায় আগুন জ্বলছে। চিতার আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হচ্ছে বকুলের নিষ্প্রাণ দেহটা। টপ্ টপ্ করে দু’ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো বিবেকের দু’চোখ বেয়ে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বিবেক জ্বলন্ত চিতার দিকে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো চিতা। বিবেকের হৃদয়েও আগুন জ্বলছে। সবকিছু পেয়েও না পাওয়ার ব্যথা বুকে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে জ্বলন্ত চিতার সামনে।

তার বাল্যকালের পরিচিত এক বন্ধু তাকে বলে, “দুঃখ করিস না বিবেক, তুই আবার বিয়ে করবি।” বিয়ের কথায় বিবেকের মানসপটে ভেসে ওঠে পুরানো স্মৃতি। সেই সুমধুর বিয়ের রাত। বিবাহ বাসর, মিলন মধুর ফুলশষ্যা। বিয়ের পরদিন বিদায় বেলায় বকুলের সেই বুকফাটা কান্না।

বিবেকের মনে পড়ে- বেনারসী শাড়ির আঁচলে বাঁধা সাদা খইগুলোকে মুঠো মুঠো করে ঘরের চালের দিকে ছুঁড়ে বকুল বলেছিলো- “বাবা-মায়ের ঋণ কোনদিন শোধ করা যায় না। এতদিন পর্যন্ত যা খেয়েছি, যা নিয়েছি সেই খাওয়া পরার ঋণ আমি খই দিয়েই শোধ করলাম।”

এরপর আর কোনদিন বকুল বাপের বাড়িতে পা রাখে নি। বিয়ের একমাস পেরোতে না পেরোতেই এমনি একটা অঘটন ঘটে গেল।

বিবেক স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি তার বকুল বিষ খেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে। বিবেক আজ ভালো করেই বুঝতে পারছে শুধু বকুল নয়, বকুলের মত শত সহস্র নিষ্পাপ ফুলগুলো অভিশপ্ত পনপ্রথার বলি হচ্ছে। বকুল ভালভাবেই জানতো তার বাবার সাধ্য নেই পনের বাকী টাকা শোধ করার। তাই তাকে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করলো নিঠুর নিয়তি।

বকুল লিখে রেখে গেছে তার শেষ চিঠি। “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। আমি ভালবাসা দিতে চেয়েছিলাম, নিতে চেয়েছিলাম। সেই ভালবাসা পেলাম না বলেই আমি নীরব অভিমান ভরে প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিচ্ছি। আমার মৃত্যুতে কেউ এক ফোঁটা চোখের জল ফেলো না। তাহলে আমি বড় কষ্ট পাব।”

জোছনারাতে আকাশে তারা ফুটেছে। আকাশের তারাগুলো মিট মিট করে জ্বলছে। তারপর একখণ্ড কালো মেঘ এসে গোটা চাঁদটাকে ঘিরে ফেললো। আঁধার ভরা আবছায় শ্মশানে চিতার আগুন ধীরে ধীরে নিভে গেল। হারিয়ে গেল বকুলের স্মৃতি পৃথিবীর বুক থেকে।

এরপর বিবেক কি আবার বিয়ে করবে? বকুলের নিবিড় ভালবাসার অটুট বন্ধন তার ব্যথিত হৃদয়কে তোলপাড় করে। পবিত্র ভালবাসার মৃত্যু নেই। তাই বিবেকের ভালবাসা আজও সারা শ্মশানময় কেঁদে বেড়ায়।

গল্প এখানেই শেষ। কিন্তু এটা তো গল্প নয়, পবিত্র ভালবাসার অপমৃত্যু। অভিশপ্ত পনপ্রথার বলি। পনপ্রথা আমাদের সমাজ জীবনে অভিশাপ। আসুন, প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াই। আমরা সবাই একযোগে সংকল্প করি- পন দেবো না। পন নেবো না।

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

5 thoughts on “ভালবাসা শুধু ভালবাসা (তৃতীয় পর্ব)

  1. আজকের গল্পটি বেশ ব্যাতিক্রম। এখানে আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থার প্রতি বার্তা আছে। অবশ্যই একমত যে, একযোগে সংকল্প করি- পণ দেবো না, পণ নেবো না। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. গল্প শেষ হলেও গল্পের অনুরণন মনের মধ্যে গেঁথে রইলো। ভালবাসার গল্প।

  3. পণপ্রথাকে না বলি। পণপ্রথা হল হৃদয়হীন সমাজের নির্লজ্জ নারীপীড়নের অন্যতম হাতিয়ার।

  4. বকুলের মত শত সহস্র নিষ্পাপ ফুলগুলো অভিশপ্ত পণপ্রথার বলি হচ্ছে। :(

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।