মাঠে মাঠে সোনা ধান……. হেমন্তের গান (দ্বিতীয় পর্ব)

মাঠে মাঠে সোনা ধান……. হেমন্তের গান (দ্বিতীয় পর্ব)
কার্তিকের ঐ ধানের খেতে (পৌরাণিক লোকগাঁথা)

তথ্য-সংগ্রহ, সম্পাদনা ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

প্রতি বছর দুর্গাপুজোয় কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী-সহ দেবী দুর্গা পূজিত হন। আবার কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে কার্তিক একাই পুজো পেয়ে থাকেন। সন্তান কামনায় কার্তিক পুজোর প্রচলনই সবচেয়ে গুরুত্ববাহী। বিশেষত বন্ধ্যা নারীগণ কার্তিকের মতো সুন্দর ও বীর পুত্রের কামনায় কার্তিক পুজো করে থাকেন। কার্তিক বীরত্বের প্রতীক, দেবকুলের সেনাপতি। আবার অপরূপ সৌন্দর্যেরও প্রতীক তিনি। তিনি যেন অশুভ শক্তির নিধনকারী, স্কন্দকুমার।
কাল ও কালের ধারাপাতে কার্তিক পুজোর প্রচলন বঙ্গদেশ জুড়ে। তিনি মহাবীর, মহাধনুর্ধর, দেবকুলের সেনাপতি। কার্তিকের সম্পর্কে বলা চলে, তিনি মহাভাগ, ময়ুরাসন, কাঞ্চনকান্তি, শক্তির বাহক, বরদ, শত্রুনিধনকারী, প্রসন্ন, সন্তানদাতা, সালংকার ও ষড়ানন।

কার্তিক সম্পর্কে নানারকম কথকথা চালু আছে। এক সময় কার্তিক নাকি দেবকুলে ধর্ষণ করে অনেকের সতীত্ব হরণ করেছিলেন। তা ক্রমে চরম আকার ধারণ করে। নারীগণ অতিষ্ট হয়ে দুর্গার কাছে গিয়ে কার্তিকের অপকীর্তির কথা জানান। দুর্গা তাদের এই সঙ্কট থেকে রক্ষা করবেন, কথা দেন। তারপর থেকে কার্তিক কোনও নারীর কাছে গেলেই দুর্গার রূপ দেখতে পেতেন। তারপর থেকে কার্তিক আর কোনও নারীর কাছে যাননি, আর বিবাহও করেননি।
প্রচলিত লোককথা থেকে পাওয়া যায় যে, দানবদের পরাজিত করে কার্তিক যখন ঘরে ফিরছিলেন, তখন এক রূপবতী দেবকন্যার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তাঁর নাম ঊষা। কার্তিক তাঁকে বিয়ে করতে চাইলে তিনি রাজি হন। তাঁকে নিয়ে কৈলাশের কাছে পৌঁছে কার্তিকের মনে হল সরাসরি বাড়িতে বধূ বেশে ঊষাকে নিয়ে যাওয়ার আগে মায়ের অনুমতি নেওয়া উচিত। ঊষাকে তাই এক বীজক্ষেত্রে দাঁড় করিয়ে কার্তিক গেলেন মায়ের কাছে। ঊষা ওদিকে দাঁড়িয়েই আছেন। দুর্গা মৌখিক অনুমতি দিলেন বটে তবে তা আন্তরিক কি না তা ভেবে দেখেননি কার্তিক। খুব তাড়াতাড়ি বর সেজে ঊষাকে আনতে যাওয়ার আগে হঠাৎ কার্তিকের মনে হল মাকে প্রণাম করবার কথা। সবদিক খুঁজে দুর্গাকে পেলেন শেষ পর্যন্ত রান্নাঘরে। কিন্তু এ কী কাণ্ড। মা দুর্গা একটি সদ্য নিহত মহিষ কাঁচাই খাচ্ছেন গোগ্রাসে।

এই ভয়ঙ্কর ও বীভৎস দৃশ্য দেখে কার্তিক বললেন, “এ তুমি কী করছ মা?” দুর্গা বললেন, “বাবা, এখন তো বউ ঘরে আসবে, কোনও দিন খেতে দেবে, কোনও দিন খেতেই দেবে না। তাই সাধ মিটিয়ে শেষ খাওয়া খেয়ে নিচ্ছি।” কার্তিক বুঝলেন দুর্গার মত নেই বিয়েতে। প্রতিজ্ঞা করলেন, জীবনে আর বিয়েই করবেন না। ওদিকে ঊষা বীজক্ষেত্রে অপেক্ষা করেই চললেন, কিন্তু কার্তিক আর ফেরেন না। শেষ পর্যন্ত ঊষা জানতে পারলেন সব, শুনলেন কার্তিকের প্রতিজ্ঞার কথা। লজ্জায় ঊষাও পণ করলেন তিনিও আর কাউকে এই প্রত্যাখ্যাত মুখ দেখাবেন না। চিরকাল ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকবেন। এই কারণেই কার্তিক চিরকুমার হয়ে থেকে গেলেন। আর ঊষা রয়ে গেলেন ধানক্ষেতে। কার্তিক মাসেই আমন ধানের শীষ বের হয়। বলা হয়, এই আমন ধানের শীষই ঊষা।

এখন মাঠে মাঠে কার্তিকের শেষের ধান। সবুজ লকলকে শিষ ধা ধা করে বেড়ে উঠছে শীত জমে আসার সঙ্গে সঙ্গে। দিনের হাওয়াতেও এখন একটা মিঠেভাব। গাঁ-দেশে এই কার্তিকের শেষে সন্ধের দিকে হিম পড়তে শুরু করে। বাংলার সকল চাষী। ধান মাড়াতে ব্যস্ত গাঁয়ের. কৃষাণ-কৃষাণীর দল. হেমন্তের জোসনা মাখা রাত. আনন্দ কোলাহল। কৃষাণীরা রান্নার ফাঁকে. কুলাতে ঝাড়ে ধান. ধাপুর ধুপুর ঢেঁকি নাচে. গেয়ে হেমন্ত গান। এমন সময় কুটুম এলো. পিঠা-পুলি খেতে. নবান্নে গ্রাম বাংলার মানুষ. উৎসবে যায় মেতে। হেমন্তের বাতাসে. শিশির ভেজা নরম ঘাসে। জোছনা রাতে জোছনা ঝরে মাটির উঠানে। দূরে কোথাও বা বেজে ওঠে সাঁঝের সানাই।

মাঠে মাঠে সোনা ধান….. হেমন্তের গান
গীতি কবিতা-২ (দ্বিতীয় পর্ব)

কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

কার্তিকের ধানের খেতে
বনটিয়ারা ঝাঁকে ঝাঁকে,
কভুবা বসে আলের পরে
উড়ে রাঙা পথের বাঁকে।

গাঁয়ের মাঠে সোনার ধান
দোলে ধানের শীষ মাঠে,
কৃষক আনে ধানের বোঝা
কৃষাণী তার ধান কাটে।

দিনের শেষে পড়েছে বেলা
সাঙ্গ হলো দিনের খেলা,
সাঁঝের বেলায় নদীর চরে
বসে আছি আমি একেলা।

সাঁঝের সানাই বাজে দূরে,
বড়ই মধুর ও করুণ সুরে,
লোহার কড়াই উনুনে বসা
খেজুরের রস নলেন গুড়ে।

মাটির ঘরে জোছনা ঝরে
শুনি আমি হেমন্তের গান,
চাষীর হাসি উপছে পড়ে
গোলায় ভরা সোনা ধান।

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

7 thoughts on “মাঠে মাঠে সোনা ধান……. হেমন্তের গান (দ্বিতীয় পর্ব)

  1. হেমন্তের এই পদ্য শব্দ সুর সবই যেন চির চেনা। পার্থক্য শুধু অনেকদিন দেখা হয় না। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. অসম্ভব আপনার শব্দ সৃষ্টির স্পৃহা কবি মি, ভাণ্ডারী। অভিনন্দন। :)

  3. মাটির ঘরে জোছনা ঝরে
    শুনি আমি হেমন্তের গান,
    চাষীর হাসি উপছে পড়ে
    গোলায় ভরা সোনা ধান। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  4. হেমন্তের সুর। অভিনন্দন শুভেচ্ছা প্রিয় কবি দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।