বসন্ত এলো আজি…….. নব বসন্তের গান গীতি কবিতা – ১০ দশম পর্ব সমাপ্তি পর্ব

বসন্ত এলো আজি…….. নব বসন্তের গান
গীতি কবিতা – ১০ দশম পর্ব (সমাপ্তি পর্ব)

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

পৃথিবীজুড়ে এখন তুমুল বসন্ত। দেশে দেশে চলছে বসন্তবরণ। চীন দেশে শীত শেষে যেমন বসন্ত আসে, তেমনি আসে চীনা নববর্ষ! বসন্ত আর নতুন বছরের আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় চীনাদের জীবনে। এই উৎসবকে স্থানীয় ভাষায় পিনয়নি কিংবা চুনয়িন বলা হয়। জাপানে বসন্ত খুব সহজেই নজর কাড়ে। পুরো দেশটাই যেন ছেয়ে যায় চেরি ফুলে। এই ফুল ফোটার উৎসবে গা ভাসানো শুরু করে জাপানিরা। এই উৎসবকে বলা হয় হানামি। ইউরোপে সবচেয়ে জমজমাটভাবে বসন্ত উদযাপিত হয় স্পেনে। উৎসবটির নাম লাস ফালেস। এ ছাড়া, আয়ারল্যাণ্ড, রোমানিয়া, ইতালি ও ক্রোয়েশিয়ায় সাজসাজ রবে উদযাপন করা হয় এই উৎসব। কিন্তু অন্যান্য দেশের তুলনায় যে দেশে সবচেয়ে উৎসবমুখর বসন্তবন্দনা হয় তার নাম বাংলাদেশ। ১লা ফাল্গুন সারাদেশ যেভাবে হলুদ পোশাক ও বিভিন্ন ফুলের সজ্জায় নিজেকে সাজিয়ে এই উৎসবের সূচনা করে তা অভিনব।

এই উৎসবের সঙ্গে ১৯৫২ সালের ৮ই ফাল্গুন বা একুশে ফেব্রুয়ারির পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ার যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। সেদিন বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রাঙিয়ে মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষা করেছিলেন সালাম-বরকত-শফিক-জব্বারের মতো অমর ভাষাশহীদরা। তখন থেকেই পূর্ব-বাংলার বাঙালিরা পাকিস্তানী শাসকদের চোখ-রাঙানিকে উপেক্ষা করে আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে আগ্রহী হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বসন্তে প্রভাবিত হয়েছেন। বসন্তকে বুকে ধারণ করে তিনি বসন্তের ভাষায় আবেগায়িত হয়ে কথা বলেছেন। বলা যায় তিনি বাংলার এ ঋতুটি নিয়ে ভেবেছেন অনেক। তিনি বসন্তকে জানিয়েছেন :

অযুতবৎসর আগে, হে বসন্ত, প্রথম ফাল্গুনে/ মত্ত কুতুহলী/ প্রথম যেদিন খুলি নন্দনের দক্ষিণদুয়ার/ মর্তে এলি চলি/ অকস্মাৎ দাঁড়াইলে মানবের কুটির প্রাঙ্গণে/ পিতাম্বর পরি, / উতলা উত্তরী হতে উড়াইয়া উন্মাদ পবনে/ মন্দার মঞ্জুরি/ দলে দলে নর-নারী ছুটে এলো গৃহদ্বার খুলি/ লয়ে বীণা বেণু,/ মাতিয়া পাগল নৃত্যে হাসিয়া করিল হানাহানি/ ছুড়ি পুষ্পরেণু।। [বসন্ত : কল্পনা]

প্রেমিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভালোবেসেছিলেন এক নারীকে। এই বসন্তেই তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছিল। কিন্তু নয়ন সমক্ষে আর সেই নারী নেই। কবি এতদিনে প্রায় ভুলেও গিয়েছিলেন এই প্রেয়সীকে। কিন্তু বাদ সাধে আবার সেই চিরচেনা বসন্ত। বসন্তের গুঞ্জরণে কবির মনে পড়ে সেই হারানো মানবীকে যার সঙ্গে বসন্তে প্রথম দেখা হয়েছিল :

বইছে আবার চৈতি হাওয়া গুমরে ওঠে মন,/ পেয়েছিলাম এমনি হাওয়ায় তোমার পরশন।/ তেমনি আবার মহুয়া-মউ/ মৌমাছিদের কৃষ্ণা-বউ/ পান ক’রে ওই ঢুলছে নেশায়, দুলছে মহুল বন,/ ফুল-শৌখিন দখিন হাওয়ায় কানন উচাটন!/ [চৈতি হাওয়া : ছায়ানট]

বসন্তের পঙক্তিমালা সৃষ্টি করে যে কবি সবচেয়ে অধিক স্মরণীয় হয়েছেন তিনি পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। বলা যায়, অনেকটা সাধ্যাতীত ভাষায় এই মহান কবি অলঙ্কৃত করেছেন বসন্তের ভেতর-বাহিরের রূপরস। তার কলমের ছোঁয়ায় বসন্ত পেয়েছে ভিন্নতর মহিমা :
ফুল ফুটুক না ফুটুক/ আজ বসন্ত/ সান-বাঁধানো ফুটপাতে/ পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাটখোট্টা গাছ/ কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে/ হাসছে।/ ফুল ফুটুক না ফুটুক/ আজ বসন্ত। [ফুল ফুটুক না ফুটুক : ফুল ফুটুক]

শামসুর রাহমান স্বীকৃত নাগরিক কবি হলেও বসন্তের রঙ হৃদয়ে নাড়া দিয়ে গেছে তাকেও। বসন্ত বাতাস তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। বসন্ত সবাইকে সমানভাবে রাঙায়। ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বসন্তের আগমনে আপ্লুত হয়। কেননা বসন্তের সৌন্দর্য সর্বজনীন :
অকস্মাৎ প্রিয়মিলনের মতো রঙিন শাড়ির/ ঝলক ছড়িয়ে আমাদের/ দুঃখের ধূসর গুঁড়োগুলো বিস্মৃতির/ অন্ধকারে ডুবিয়ে দাঁড়ায়/ বসন্তের জ্বলজ্বলে আলো নিয়ে ধনীর প্রাসাদে,/ দরিদ্রের বিরান আঙিনা আর ক্ষুধার্ত সংসারে। [বসন্তের মায়া : না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন]

বাংলা ভাষার আরেক কবি নির্মলেন্দু গুণ। বসন্তকে তিনি আগ্রাসী ঋতু বলেছেন। তার সবকিছু গ্রাস করে নেয় এ ঋতু। এ ঋতুর সৌন্দর্যে তিনি এতটাই মোহিত যে, তিনি একে অতিক্রম করতে পারেন না। খল এক-নারীর মতো তাকে গ্রাস করে রাখে :
এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতই ফেরাই চোখ,/ যতই এড়াতে চাই তাকে দেখি সে অনতিক্রম্য।/ বসন্ত কবির মতো রচে তার রম্য কাব্যখান/ নবীন পল্লবে, ফুলে ফুলে। বুঝি আমাকেও শেষে/ গিলেছে এ খল-নারী আপাদমস্তক ভালোবেসে। [বসন্ত বন্দনা : অচল পদাবলি]

রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী ঠাকুরবাড়ির বসন্ত উৎসব সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এই উৎসবের একটি বিশেষ সাজ ছিল। সে হল হালকা মসলিনের শাড়ি, ফুলের গয়না আর আতর গোলাপের গন্ধমাখা মালা। দোলের দিন সাদা মসলিন পরার উদ্দেশ্য ছিল যে, আবিরের লাল রঙ সাদা ফুরফুরে শাড়িতে রঙিন বুটি ছড়িয়ে দেবে।’ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে ‘বসন্তোৎসব’ এক অসাধারণ ও অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। সেদিন শান্তিনিকেতনে মেয়েরা হলুদ শাড়িতে, চুলে লাল পলাশ ফুল দিয়ে নিজেদের সাজিয়ে তোলে। শাল শিমুল পলাশে ঘেরা শান্তিনিকেতনের অনন্যসাধারণ প্রকৃতিতে সংগীত আর আবিরের ছোঁয়া লেগে রঙিন হয়ে ওঠে চতুর্দিক।

পৃথিবীতে প্রেমের এই আক্রার দিনে প্রেমের এই উৎসব রঙিন হয়ে আমাদের মন মাতিয়ে তোলে। গুলাল ছড়ায় মনে। তাই আমাদের শানানো কলমে ছুটে যায় গোপন চিঠি, বলি, কলম শানাই সূক্ষ্ম করে, থমকে দাঁড়াই অর্ধপথে,/ দেখা করো সন্ধ্যে বেলায়, চিঠি দিলাম বসন্তকে।
নব বসন্ত সবাইকে নিজের মায়ামন্ত্রে আচ্ছন্ন করে রাখে। নব বসন্ত বাঙালির প্রাণে নতুনত্বে প্রাণ সঞ্চার করুক এটাই হোক বসন্ত বরণের অভিপ্রায়। আসুন, আমরা সবাই নব বসন্তের রঙে রাঙিয়ে তুলি নিজেদের। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু! জয়গুরু! জয়গুরু!

নব বসন্তের গান- ১০
কবি- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

বসন্ত এলো আজি বসন্ত আসিলো।
কাননের কলি যত সকলি ফুটিলো।
তরুশাখে পত্রবৃন্তে
রং লাগে বসন্তে
পুষ্পরাশি ছন্দে ছন্দে প্রস্ফুটিত হলো,
মধু আহরণ লাগি অলিরা আসিলো।

বসন্ত এলো আজি বসন্ত আসিলো,
কাননের কলি যত সকলি ফুটিলো।
বসন্তের কিশলয়,
পত্রে পল্লবিত হয়
আজি তাই মনে হয়, ফাগুন আসিলো,
বসন্ত এলো আজি বসন্ত আসিলো ।

বসন্ত এলো আজি বসন্ত আসিলো,
কাননের কলি যত সকলি ফুটিলো।
দিবসের অবসানে
হেরি পশ্চিমের পানে
রঙীন আবীর মাখি, অরুণ ডুবিলো,
ঘরে ঘরে জ্বলে দীপ আঁধার নামিলো।

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

4 thoughts on “বসন্ত এলো আজি…….. নব বসন্তের গান গীতি কবিতা – ১০ দশম পর্ব সমাপ্তি পর্ব

  1. সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম।
    সাথে থাকবেন।
    জয়গুরু

  2. অসাধারণ আয়োজন কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী। অভিনন্দন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।