ছোটগল্পঃ লালরঙা শাড়ি

কাঁধে স্পর্শ পেয়ে আরিফ ঘুরে তাকালো।
পেছনে জবা।

– এই পাগলা, আমার সাথে এক জায়গায় যাবি?

আরিফের দূর সম্পর্কে চাচাতো বোন সে। বছর পাঁচেকের বড়।

আসলে আরিফ তখন বৈরাগীর ঘাটে দাঁড়িয়ে একমনে পানির ঘূর্ণিপাক দেখছিল। এটাতে তার অস্বাভাবিক আগ্রহ রয়েছে। এর পেছনে অবশ্য একটা উল্লেখযোগ্য কারণ আছে।

আড়াই বছর আগে আরিফের বাবা মারা গেছে। তখন ওর বয়স সাড়ে ছয় বছর ছিল। মৃত্যুর বছর দেড়েক পরে সে তার বাবার অনুপস্থিতি অনুভব করে। দিন যায় তার এই কষ্টানুভূতি বাড়তে থাকে। সে এমনও ভাবে, নদির গভীর থেকে একটা জাহাজে করে ওর বাবা ভেসে ওঠবে। বৈরাগীর ঘাটে দাঁড়িয়ে পানির ঘূর্ণিপাক দেখতে দেখতে আরিফ আজ যখন এই একই বিষয় নিয়ে ভাবছিল জবা তখনই তার পেছনে এসে দাঁড়ায়।

-কোথায় যাবা বুবু?
কাঁধ থেকে জবার হাত নামিয়ে আরিফ জানতে চাইলো।

-পূঘলদীঘা বিলে। শামুক কুড়াব। ট্রেনও দেখব। যাবিনা?
-একটু দাঁড়াও। এক দৌঁড়ে মারে কইয়া আসি

বাড়ির কাছে তেমাথায় এসে সে একটু দাঁড়ায়। বিপরীত দিক থেকে একটা যাত্রার দল আসছিল। সারি বেঁধে কোথাও যাচ্ছে।
-এই নাগর, কই যাও?
যাত্রাদলের এক কম বয়সী মহিলা আরিফের চিবুক ধরে প্রশ্ন করে। বাকিরা হিহি করে হেসে ওঠে

-এইডা আমাদের বাড়ি;
কিছুটা বোকার মতে করে আরিফ জবাব দেয়।

পথে যাত্রাদল দেখে আরিফ যে আনন্দ পেয়েছিল বাড়িতে নানীকে দেখে তা মুহূর্তেই উবে গেল। সে তার বিধবা মেয়েকে আবার বিয়ে দিতে চায়। এইজন্য মাঝে মধ্যে এই বাড়িতে আসে এবং মা মেয়ে ঝগড়া করে। কিন্তু সে আরিফের কথা ভাবেনা। ওর কাছে নানীকে তাই রুপকথার ডাইনী মনে হয়।

কাউকে কিছু না বলেই সে জবার সাথে পূঘলদীঘার পথ ধরলো। কী হবে কাউকে বলে? তার কথা তো কেউ শুনেনা। বুকের ভিতরে তার কেমন যেন লাগে! কারো সাথে তাই সে মন খুলে মিশেনা। দূর সম্পর্কের জবা বু ছাড়া।

খেয়া পার হয়ে ওরা দুজন কিছুক্ষণ নদির তীর বরাবর দক্ষিণ দিকে হাঁটলো। এরপর সোজা পশ্চিম দিকে আরো আধা ঘণ্টা। বিলের আগে আগে একটা মাদ্রাসা। পাশেই বিশাল বটগাছ। বর্ষাকালে বিলের পানি গাছটার কাছাকছি চলে আসে। তখন নাকি প্রায়ই মাঝরাতে এক বুড়িকে গাছটার উচু ডালে রান্না করতে দেখা যায়।

এরকম কতো কিছুই তো হয়!

ফকির বাড়ি কালো পুকুরের গভীর থেকে অমাবশ্যা রাতে নাকি সোনার কলসি ভেসে ওঠে। তাইলে নদিতে কেন নিচ থেকে জাহাজ ভেসে ওঠবেনা? আরিফ নিজেকে প্রশ্ন করে। উত্তর না পেলেও প্রশ্নটা নিজের মধ্যেই রেখে দেয়।

একসময় ওরা দুজন বিলে নামে। বিলটা বেশি বড় নয়। শামুক কুড়াতে কুড়াতে রেল লাইনের ধারে চলে যায়। আরও কয়েকজন ছেলে মেয়ে শামুক কুড়াচ্ছে। দূরে কেউ কেউ জলে নেমে পদ্মফুল তুলছে। লাল টুকটুক ফুল। অন্যসময় হলে আরিফ ওর মায়ের জন্য বেছে বেছে কিছু ফুল নিতো। আগে কোন অনুষ্ঠান হলে লালরঙ শাড়ি পরে ওর মা খোঁপায় ফুল গুজে নিতো; তাতে কী দারুণ যে লাগতো! বিধবা হবার পর থেকে লাল পেড়ে শাড়িও পরেনা।

পদ্মফুল বা শামুক নয়; পূঘলদীঘায় আরিফের আসার মূল উদ্দেশ্য ট্রেন দেখা। নানান কারণে আজ সে অস্থির।

-বুবু, ট্রেন কখন আসবে?
-জানিনা রে; বলেই জবা রেল লাইনে কান রাখলো।
তুইও কান পাইতা শুন; জবা যোগ করলো।

কিছুক্ষণের মধ্যে একটা লালরঙ ট্রেন এলো। আরিফ দেখছে, ট্রেনটা যেন কালো চুল উড়িয়ে যাচ্ছে; পরনে লাল শাড়ী। আরিফ মুগ্ধ চোখে ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে রইলো; যতক্ষণ দৃষ্টির মধ্য রইলো ততোক্ষণ।

-ট্রেনটা আমার;
ছোট বেলায় লাল শাড়ির মাকে স্মরণ করে আরিফ কথাটা বললো।

শিশু-মনোজগতে অদ্ভুত কিছু বিষয় খেলা করে। আরিফেরও করছে। মৃত্যুর দেড় বছর পর থেকে বাবার জন্য সারাক্ষণ কষ্ট পেলেও তা একা বয়ে বেড়ানো, মায়ের প্রিয় পোশাকের রঙের সাথে মিল পেয়ে একটা ট্রেনকে নিজের ভাবা; ইত্যাদি।

-না পাগলা। ট্রেনটা এইমাত্র চোখের বাইরে চইলা গেলো। ওইডা এখন আর তোর নাই; অন্যকারো।

জবা বুঝে না বুঝে মন্তব্য করলো।
বুঝেও বলতে পারে। গত বছর ওর বিয়ে হয়েছিল। ছয়মাস না যেতেই ডিভোর্স হয়েছে। ইতোমধ্যে সে তো জীবনের অনেক কিছুই জেনে গেছে। জবা তার নিজের অবস্থান থেকে একজন দার্শনিক। শিশু আরিফও। কে না?

এরপর আরিফ জবা ফির বাড়ির পথে হাঁটা ধরল। সামান্য এগিয়েই জবা বটগাছটার ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার প্রস্তাব করলো। আরিফের অসম্মতি জানানোর কোন কারণ ছিলোনা। মাদ্রাসার সামনে টিউবওয়েল থেকে জল খেয়ে ওরা ছায়ায় বসলো।

-ট্রেনটা যখন কাছ দিয়া যাইতাছিল আমি ভয় পাইছিলাম;
জবা বললো

-আমিও;
-এই দেখ, বুকটা এখনো কেমন ধড়পড় করতাছে;
আরিফের একটা হাত টেনে নিয়ে জবা তার বুকে চেপে ধরলো। কিন্তু আরিফ কিছু টের পেলনা; কোন কিছুই না।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা নদির পাড়ে চলে এসেছে। খেয়া নৌকায় কিছু লোক বলাবলি করছে, উজান থেকে অনেক বড় একটা জাহাজ আসছে। ভিতরে অদ্ভুত পোশাকের লোকজন। এই গায়েই নাকি ভিড়বে। খবরটা শুনে আরিফ শিহরিত হলো।

জাহাজে করে বাবা আসছেন- আরিফের এই বিশ্বাস ক্রমান্বয়ে শক্তি পাচ্ছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আজ মাকে নিজের ভিতরের সব কষ্টের কথা খুলে বলবে। জাহাজটির খবরও। বাবা ফিরে এলে আর কোন কষ্ট থাকবেনা। মা লাল শাড়ি পরে আবার চুল উড়িয়ে তাকে নিয়ে হাঁটবে। তিনজন মিলে একদিন যাত্রা দেখতে যাবে। কী সুন্দর যাত্রা দলের মেয়েগুলি! এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথে আরিফ দ্রুত পা ফেলতে লাগলো।

কিন্তু সদর দরজায় এসে আরিফ থমকে দাঁড়ালো। ওঠোন ভরা লোকজন। ওর নানীও আছে। মায়ের পরনে আরিফের পছন্দের পুরনো লাল শাড়িটা; হাতে একটা ব্যাগ। মা তার ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিলো। আরিফকে এক পলক দেখে সে তার নিজের মাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করতে লাগলো। আড়াই বছর আগে আরিফ তার বাবার জন্য কাঁদেনি; আজ মায়ের জন্যও চোখের জল ফেললোনা।

ঘণ্টাখানেক আগেই লাল শাড়ির ট্রেনটা দেখে আরিফ জেনেছে, দৃষ্টির বাইরে গেলে নিজের কোন কিছুই আর নিজের থাকেনা।

7 thoughts on “ছোটগল্পঃ লালরঙা শাড়ি

  1. কখনও কোন গল্প অথবা জীবন কাহিনীর শেষ কথাটি অমোঘ সত্যে রুপান্তরিত হয়ে যায়। ধরুন না আপনার এই লিখার সমাপ্তি বাণী। "দৃষ্টির বাইরে গেলে নিজের কোন কিছুই আর নিজের থাকেনা। এই আমাদের প্রত্যেকের জীবনের পরম বাস্তবতা। আমরা ক্ষয়িষ্ণু।

    1. দারুণ বলেছেন। 

      নানীর কাছে যা সত্য, নাতির কাছে তা উল্টো।  কিন্তু সত্যের উল্টো তো আরেকটা সত্য হতে পারেনা! 

      জীবনটা আসলে এমনই। যা কিছু ভুল জানি তার সব ভুল নয়; যা সত্য জানি তার সবও সত্য নয়। 

  2. * অন্তর ছুঁয়ে গেলো সুপ্রিয়…

    শুভরাত্রি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    1. আপনার মন্তব্যে আনন্দিত হয়েছি !

      অশেষ ধন্যবাদ !

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।