বালকগুলি মহিলাটার পেছনে পেছনে এমন ভাবে হাঁটছিল যে মনে হচ্ছিল, ওরা হ্যামিলনের এক মহিলা বাঁশীওলাকে অনুসরণ করছে। ওদের হৈ হল্লোর শুনে মোত্তালেব মিয়া এক পলক তাকিয়ে আবার কাজে মন দেয়। মূল রাস্তা থেকে পঞ্চাশ ষাট গজ দূরে মাঠে সে নিড়ানির কাজ করছিল। কি জানি কী মনে করে কয়েক সেকন্ড পরে সে আবার তাকায়। চশমাহীন চোখে আবছা দেখলেও মহিলাটিকে সে খুব সহজেই চিনতে পারে। নিড়ানি বন্ধ করে দ্রুত পায়ে মহিলার দিকে সে এগিয়ে যায়।
-এই পোলাপান, যাহ্ যাহ্। মোত্তালেব মিয়া ধমক দিয়ে বালকগুলিকে দূরে সরিয়ে দেয়।
সে মহিলার খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পারলে যেন গায়ে গা লাগিয়ে দেয়। তার “ছুঁক ছুঁক” ভাব দেখে মহিলাটি মুচকি হেসে শরীর এগিয়ে দিয়ে বলে,
-ছুঁইবেন? নেন। ম্যালা দিন হইলো আমার ঘরে আহেন না যে?
মোত্তালেব মিয়া অবশ্য সুচতুরভাবে প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়;
-এই ভর-দুপুরে কই যাও মোছাম্মত সিতারা বেগম?
-উপজেলা হাসপাতালে যামু মাতব্বর সাব। পাড়ার এক মাসী অসুস্থ হইয়া ওইখানে ভর্তি আছে।
-হাসপাতাল থেইকা ফিরবা কখন? নাকি আজ ফিরবানা?
-ফিরমু। রাত নয়টা দশটা বাইজা যাইতে পারে
-ঐ সময় আমি স্কুলটার ওইখানে থাকমুনি; তুমি আইসো। আসবা তো সিতারা বেগম? মোত্তালেব মিয়া ফিস ফিস করে জানতে চায়।
-পুরা সাতশ টাকা লাগবো! ঠোঁটের কোণে হাসি মেখে সিতারা বেগম জবাব দেয়।
অল্প দূরে থাকা ছেলেগুলোর দলনেতা খুব নিচুস্বরে বলে,
-জানস তোরা ওই বেটি কেডা?
-তিন নাম্বার দাদি? ছেলেগুলির একজন উল্টা প্রশ্ন করে।
-ওই রকমই। আগের মরা দাদিটা লাল পরী হইয়া ফিরা আইছে। দাদারে আদরও করতে পারে; আবার ঘাড় মটকাইয়াও দিতে পারে।
দলনেতার শেষ মন্তব্যে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে এবং একসাথে উল্টা পথে দৌড় দেয়।
মোত্তালেব মিয়া; সাতান্ন পেরিয়ে আটান্ন চলছে তাও প্রায় চার মাস হয়ে গেলো। সে শিমুলিয়া গ্রামের মত-মাতব্বর এবং সিতারার নিয়মিত খদ্দের। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু এবং পরে এক কিশোরীকে দ্বিতীয় স্ত্রী করে ঘরে আনা- সব কথাই আবেগের সময় সিতারাকে সে বলে দিয়েছে। “এমন বুড়ো পুরুষকে কোন বাচ্চা মেয়ের ভালো লাগবে?” সিতারা বেগম ভাবে। অতঃপর মোত্তালেব মিয়ার হাতে এক খিলি পান গুজে দিয়ে সে উপজেলার পথে হাঁটা ধরে।
অল্প কিছুক্ষণ পরে পেছনে তাকিয়ে সিতারা বেগম শব্দ করে হেসে ওঠে। কারণ শিমুলিয়া স্কুলের কাছে আজ রাতেই দেখা করার কথা ঠিক হলেও মোত্তালেব মিয়া এখন তার পিছু নিয়েছে। তার শাড়ির ভিতরের সম্ভাব্য যে অংশে মোত্তালেব মিয়ার চোখ আটকে আছে সেখানে মৃদু ঢেউ তুলে সে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। হাসপাতালে পৌঁছার আগেই বড় একটা কবরস্থান। সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে তার বিকেল হয়ে যায়। ডানে বামে সামনে পেছনে সে তাকিয়ে দেখে, সাড়ে তিন হাত মাপের ঘরগুলি এবং শূন্যপথটা ছাড়া কোথাও কিছু নেই।
তবে সিতারা বেগম বেশ অনুভব করে, যতদিন শরীর আছে তার নিজের ভিতর হেমিলনের বাঁশিওলার একটা অস্তিত্ব আছে যা মোত্তালিব মিয়ার রক্তস্বল্পতায় ভোগা কিশোরী বউটার মধ্যেও নাই! তাই তার পেছনে শিমুলিয়া গ্রামের এই মধ্যবয়সী পুরুষটা দৌড়াচ্ছে আর হাঁফাচ্ছে; হাঁফাচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে!
অণুগল্পের এই একটা বৈশিষ্ট্য পড়ার পরেও একটা রেশ থেকে যায়। ভালো লাগল খুব
মন্তব্যে মুগ্ধ হয়েছি।
অশেষ ধন্যবাদ !
লিখাটিকে ইউনিক বলা যেতে পারে। পড়তে সময় লেগেছে বড় জোড় চার মিনিট। মনে হলো পনেরো মিনিটের একটি দৃশ্য মনের ভেতর আটকে গেলো। এই হচ্ছে সার্থক রূপায়ণ। গুড।
মন্তব্যে/কপ্লিমেন্টে মন ভরে গেল।
অশেষ ধন্যবাদ মিঃ মুরুব্বি!
স্বাগতম মি. মিড ডে।
অল্প কথায় অনেক কথা যাও যে বলে, মিষ্টি ভরা মধুর সুরে।।
এটা ধরেই নেই কমেন্টে মজার কিছু লিখবেন! 😀
অশেষ ধন্যবাদ খালিদ ভাই !
একেই বলে অণুগল্প। অভিনন্দন মিড দা।
মন্তব্যে খুব মুগ্ধ হয়েছি!
অশেষ ধন্যবাদ দিদি !
ফাইভ স্টার ডেজারট ভাই। অসাধারণ উপস্থাপন। এপার বাংলায় অনণুগল্প হয়; তবে বাংলাদেশের মত না।
আপনার কমপ্লিমেন্টে/মন্তব্যে ভীষণ আনন্দিত হয়েছি কবি।
ফাইভ স্টার ধন্যবাদ গ্রহণ করুন !
* সুপ্রিয়, আপনার অনুগল্পের আর্ট অসাধারণ। রেশ থাকে বহুক্ষণ …


আপনার মন্তব্যে খুব আনন্দিত হয়েছি কবি।
অশেষ ধন্যবাদ !
ভালো লাগলো গল্প । ভালো থাকবেন
অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে !