গল্পঃ তিরিশ বছর পর

একঃ

বেশ আগেই সুতপা ঘুমের বড়ি খেয়েছে; ঘুম আসছেনা। বাইরে বৃষ্টি। শোয়া অবস্থা থেকে ওঠে বসে সে হাটুতে থুতনি রেখে কিছুক্ষণ এটাসেটা ভাবলো। তারপর বিছানা থেকে নেমে কি জানি কী মনে করে বারান্দায় গেলো। বৃষ্টির ঝাপটায় তার গা ভিজে গেছে। কাপড় বদলিয়ে সুতপা আবার বিছানায় গেলো।

নাভিদের কথা মনে পড়েছে।
-এই মাঝরাতে তোমার মেয়ের যন্ত্রণা আমি কেন সইবো?

“আমি” এবং “কেন”র ওপর সুতপা এমন জোর দিয়ে উচ্চারণ করেছে যে, মনে হবে চান সত্যি সত্যি নাভিদের মেয়ে; সুতপার কেউ না। ফোনে সুতপার এই রকম কথায় নাভিদ আগে খুব লজ্জা পেতো। এখন সে উল্টো তাল মিলায়।

-আমার মেয়ে কার পাকা ধানে মই দিয়েছে শুনি? নাভিদ পাল্টা প্রশ্ন করে।
-কাল সার্জারি। ঘুমাতে হবে; ওষুধ খেয়ে শুয়েছি। চোখ লেগেও এসেছিলো; তোমার মেয়ে বিছানায় বসে আমার পা দুটো কোলে নিয়েছে। কেন নিয়েছে সেটা বলতে পারবে?
-না। প্রশ্ন কমন পড়েনাই!
-ওই মাথা নিয়ে কেমনে যে ডাক্তার হয়েছিলে ?! এমন বৃষ্টির রাতে আমাকে ওর সাজাতে ইচ্ছে হয়েছে। চান এখন আমার পায়ে আলতা পরায়।

দুইঃ

বেশ আগের কথা! তাও প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেছে !
ওদের প্রথম কথা হয় চিঠিতে। দুজনই তখন প্রথমবর্ষ উচ্চ মাধ্যমিকের স্টুডেন্ট; দুটি ভিন্ন শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তারপর উচ্চ শিক্ষার জন্য দুজনই নিজ নিজ শহরের বাইরে চলে যায়। নাভিদ মেডিসিনে এবং সুতপা ইকোনমিক্সে। প্রতিদিন বিকেলে দুজনই চিঠির অপেক্ষায় থাকতো। চিঠিতে চিঠিতে প্রায় সাত বছর কেটে যায়; ওরা একবারও দেখা করেনি! দেখা করা অতোটা সহজও ছিলনা।

নাভিদ যখন পঞ্চম বর্ষে ওঠে; সুতপা মাস্টার্স ফাইনাল দিচ্ছিলো। পরীক্ষার মাঝামাঝি সময় সুতপা লিখেছিলে, “কিছুদিন পর থেকে এই ক্যাম্পাস আর সেইভাবে আমার ক্যাম্পাস থাকবেনা। যদি আসতে; তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখতাম!” সুতপার কথাগুলি সেদিন নাভিদের বুকের ভিতর ঝড় তুলেছিল। কিন্তু জবাব দেয়নি। এরপর যখন বিয়ের কথা পাকা হয় সুতপা তখনও নাভিদকে লিখেছিলো। সেবারও নাভিদ জবাব দেয়নি। অসহায়ত্ববোধ থেকে নাভিদের এক ধরণের অভিমান ছিল; আত্ম-অভিমান! তাই জবাব দেয়নি। তারপর অনিবার্যভাবে সুতপার বিয়ে হয়ে যায়। অচেনা একজনের সাথে।

বিয়ের প্রথম রাতে অনেক হাজবেন্ডের মনের মধ্যে কিছু স্টেরিয়োটিপিক্যাল ভাবনা প্রবল প্রতাপ চালায়। সেজন্য তাদের কমন কিছু প্রশ্ন থাকে; সেই রকম কিছুর মুখোমুখি সুতপাও হয়েছিল। “প্রেম করোনি?” এর উত্তরে স্ট্রেইট “না” বলে স্বামীকে সুতপা নাভিদ সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছিল। কোন রাখঢাক করেনি।

তবুও সুতপার সংসার-জীবন ভালো যায়নি। নাভিদকে নিয়ে স্বামীর সাথে টানাপোড়েন চলে এবং এক সময় সে বাবার বাড়ি চলে যায়। তারপর সংসারটা আর জোড়া লাগেনি। ওদিকে নাভিদ বিয়ে “করে করবে” করে আর করেনি। এরই মধ্যে সুতপা যখন তার স্বামী থেকে আলাদা থাকা শুরু করে তখন ওরা দুজন আরও একটু ঘনিষ্ট হয়। দূর থেকে প্রতিদিন দুজন কথা বলে। তবে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, ওদের কেউ কখনোই একান্ত ব্যাক্তিগত কিছু নিয়ে প্রশ্ন করেনাই। বৈষয়িক কোন কথা ওদের মধ্যে হয়না বললেই চলে। নাভিদ সম্প্রতি একটা স্পেশালাইজড হাসপাতালের শেয়ার কিনেছে-এটাও সুতপা জানেনা। বেশ কবছর ধরে দুজনের ঠিকানা একই শহরে হলেও সামনা সামনি হওয়াকে সুতপা তার হাবভাবের মাধ্যমে নিষিদ্ধ রেখেছে। যে মিষ্টি সময়ে দেখা হতে পারতো সেটার আক্ষেপ তার ভিতর এখনো তীব্রভাবে রয়েছে।

তিনঃ

চান সুতপার একমাত্র সন্তান। ওকে নিয়ে নাভিদের সাথে প্রায়ই সে ফান করে। আজ এখন এই মাঝরাতে যেমন করছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সুতপা আসলে একা; চানের পায়ে আলতা পরানোর কাহিনিটাও সত্য নয়! নিজের অস্থিরতা কাটানোর জন্য নাভিদের সাথে কথা বলার বাহানা ছিল ওটা।

-হ্যালো সুতপা
সুতপার প্রান্ত থেকে জবাব আসেনা। চানকে নিয়ে কথা বলার পর দুজনই কিছুক্ষণ চুপ ছিল। হয়ত সেই ফাঁকে সে ঘুমিয়ে পড়েছে।

রাত বাড়ছিল। শহর জুড়ে তখনো বৃষ্টি। নাভিদ ভাবছিল, ঘুমের বড়ি আর বৃষ্টির ছন্দ এই দুয়ের মিশেলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই সুতপার ঘুম গভীর হয়েছে। টিভি অন করে পরক্ষণেই সে অফ করে দিল। ঘুমের পোশাক পরেছে; বিছানায় যাবে। ঠিক তখনই সুতপা আবার কল দিলো।

-ঘুমের বড়িটা কাজ শুরু করেছে। একটা পুস্তকীয় কথার উত্তর দাও। শুনেই ঘুমিয়ে পড়বো
-বল
-এই মধ্য জীবনকে কিভাবে দেখো? সেখানে আমার অবস্থান কি? অনেস্ট জবাব দিয়ো প্লিজ

এ্যাজ ইউজুয়াল নাভিদ কোন জবাব দেয়না। কোনদিনই সে এমন প্রশ্নের জবাব দেয়নি।
অতঃপর “শুভরাত্রি” বলে সুতপা ঘুমিয়ে পড়ে।

চারঃ

সকালে ওঠে সুতপা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নেয়। হাসপাতালে যেতে হবে। সে নাস্তা করেনা। “নাথিং বাই মাউথ” থাকার চিকিৎসা পরামর্শ রয়েছে।

সুতপা যখন হাসপাতালে পৌঁছে তখন সকাল নয়টা।প্রেপারেশন চলছে। বিকেল তিনটা থেকে সার্জারি হবে। গলব্লাডার স্টোন অপারেশন। ফরটির পর ফেয়ার ফ্যাটি ফিমেলদের নাকি এই রোগ তুলনামূলক বেশি হয়। সুতপা অবশ্য ফ্যাটি নয়! স্বর্ণলতার মতো দারুণ দেখতে! নাভিদের চোখে সাত আসমানের সবচে বেশি সুন্দর!

মধ্যদুপুরে এক ফাঁকে সুতপা নাভিদের ইনবক্সে নক করে;
-আছো?
পাঁচ মিনিট পর নাভিদ রেস্পন্স করে
-হ্যাঁ। কেমন আছো এখন?
-মনটা কেমন করছে!
-স্থির হও। তুমি খুব ভালো থাকবে। এক কুড়ি আয়ু তোমার বুকের বামে আমি জমা রেখেছি; যদি আমার আগে তোমার সন্ধ্যা নামে—-!

নাভিদের কথায় সুতপা নিজের অন্তরে একটা গভীর সমুদ্রের অস্তিত্ব টের পায়। সেখান থেকে কিছু নোনা ঢেউ এসে তাঁর চোখের দুই দীঘিতে আছড়ে পড়ে।

– জীবনে আজ প্রথম অজ্ঞান হবো। তারপর কি হবে জানিনা। নাভিদ, তোমার আমার তিরিশ বছর মনে রেখো!

জবাবে নাভিদ একটা স্যাড ইমো দেয়।
সুতপা লগ আউট হয়।

পাঁচঃ

আত্মীয় স্বজনদের কেউ কেউ হাসপাতালে এসেছে। হাতে বেশি সময় নাই। মুরুব্বীরা দোয়া পড়ে “ফু” দিচ্ছে। বন্ধুরা কেউ কেউ হাত ধরে বসে আছে।
নাভিদের কথা তাঁর খুব মনে পড়ছে।ওয়ার্ডবয় ট্রলি নিয়ে এসেছে। এখনি যেতে হবে। তার বুকটা হু হু করতে লাগলো। অন্তরে এখন এক নাদেখা আপন; সম্মুখে নাই!

ওয়ার্ডবয় ট্রলি ঠেলছে। সে জানে, এখন নাভিদের দেখা পাওয়ার ভাবনা একেবারেই অবাস্তব! তবুও নিজেকে বুঝ দিতে পারছেনা। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে, কতো ডাক্তারই তো যাচ্ছে আসছে; যদি সে আসে !?

সবুজ গাউন এবং মাস্ক পরে একজন ওটির দরজা থেকে সুতপার ট্রলি রিসিভ করে ভিতরে নিয়ে গেলো।

সুতপাকে ওটি টেবিলে ওঠানো হয়েছে।
কেউ একজন সুতপাকে বিশেষ মাস্কটা পরিয়ে দেয়।
এনেস্থেটিস্ট হাতের চ্যানেল দিয়ে ড্রাগ পুশ করছে।

সুতপা ক্রমশ জ্ঞান হারাচ্ছে। কিন্তু বুঝতে ভুল হয়নি কেউ একজন পরম নির্ভরতা দিয়ে তার হাতটাকে হাতের ভিতরে নিয়ে নিচ্ছে।

-কে এ এ এ ? প্রায় অজ্ঞান সুতপা টেনে টেনে উচ্চারণ করলো!
-আমি
-তি য়ি.. ব ছ .. প..
(তিরিশ বছর পর)

12 thoughts on “গল্পঃ তিরিশ বছর পর

  1. গল্প বা উপন্যাসে লক্ষ্য করেছি ঘটনা টেনে লম্বা করার এক ধরণের প্রতিচ্ছা লিখকের লিখনী বা মাথায় কাজ করে। আপনার বেলায় তেমনটা হয়নি। বেশ কাট্ কাট্ এসেছে ঘটনার প্রবাহ গুলোন। চমৎকার মানের একটি অণুগল্প নিঃসন্দেহে। ভালো লেগেছে।
    অভিনন্দন মি. মিড ডে ডেজারট। ভালোবাসা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    1. লেখাটা নিয়ে আপনার বিশ্লেষন আমাকে মুগ্ধ করেছে মিঃ মুরুব্বী। অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।

  2. নাভিদের কথায় সুতপা নিজের অন্তরে একটা গভীর সমুদ্রের অস্তিত্ব টের পায়।সেখান থেকে কিছু নোনা ঢেউ এসে তার চোখের দুই দীঘিতে আছড়ে পড়ে —–

    "ত্রিশ বছর পর "গল্পটাতে সুতপার বিয়োগ ব‍্যথায় আমি ও ব‍্যথিত হয়েছি। চমৎকার প্রকাশ কবি মিড ডে ডেজারট। শুভ কামনা আপনার জন্য।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_smile.gif.gif

    1. "ত্রিশ বছর পর "গল্পটাতে সুতপার বিয়োগ ব‍্যথায় আমি ও ব‍্যথিত হয়েছি"—আপনার এই মন্তব্য আমার প্রাপ্তিতে যোগ হলো। অশেষ ধন্যবাদ!

  3. আপনি অসাধারণ লিখেন প্রিয় ডেজারট ভাই। আপনি লিখেছেন, আজকের দিনে আমি কিছু লিখতে পারি নাই। :)

    1. আপনার কমপ্লিমেন্ট মন ভরে নিলাম দাদা। 

      আজকে যেটা লিখা হয়নি সামনের কোন একদিন নিশ্চয়ই সেটা আমাদেরকে পড়তে দিবেন। 

      অশেষ ধন্যবাদ!  

  4. কী চমৎকার ভাবেই না আপনি প্রতিটি লেখা উপস্থাপন করেন ভাবলে অবাক হই। কেমন আছেন মিড দা। আপনি না থাকলে শব্দনীড় কেমন জানি খালি খালি লাগে। গল্পটি পড়ে ভীষণ আপ্লুত হয়েছি। ভাল থাকবেন।

    1. আমার লেখা এবং ব্লগে উপস্থিতি নিয়ে আপনার অন্তরগলা কথায় যারপরনাই সম্মানিত বোধ করছি।

      আমি ভালো আছি দিদি। আপনি ভালো থাকুন!

       

    1. আপনার আন্তরিক মন্তব্যে খুব আনন্দিত হয়েছি; ছোট মন্তব্যে বড় প্রাপ্তির আনন্দ!

      শুভেচ্ছা রইলো!

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।