কবিতাঃ অদৃশ্য কালি

মিরপুর-১ থেকে বিরতিহীন বাসে উঠলাম;
পাঁচ সিকি ভাড়া।
পথে এখানে সেখানে একজন দুইজন করে প্যাসেঞ্জার নেমে যাচ্ছিল;
এসব দেখে একজন চেঁচিয়ে ওঠলো, “এমন তো হবার কথা নয়!”
তার সাথে কয়েকজন যোগ দিল
এবং পরে আরও অনেক জন!
অবশেষে অবনত হয়ে কন্ডাক্টর বললো, “কী হচ্ছে
কিংবা কী হবার কথা,
তা আমি নিজেও জানিনা;
সম্ভবত আমরা কেউই তা জানিনা”!
অতঃপর যারা চিৎকার করছিল তারা থেমে গেল
কেননা তাদেরই একজনকে হঠাৎ পথে নেমে যেতে হলো।
পঞ্চাশ মিনিট পর বাসটা যখন গোলাপশাহ মাজারে পৌঁছলো;
আমি আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে, অনির্ধারিত ভাবে
আমাকে পথে নেমে যেতে হয়নি।”

মাজারটার পাশেই এক লোক আইস্ক্রিম বেচছিল।
“একটার দাম কত?”
“দশ পয়সা থেকে শুরু করে আট আনা পর্যন্ত আছে;
তুমি কোনটা নেবে?” – লোকটা জবাবে বললো।
চার আনা দিয়ে একটা কাঠি আইস্ক্রিম কিনে
খেতে খেতে গুলিস্তান সিনেমা হলের পাশে গেলাম;
সেখানে ফুটপাথে সারি ধরে সব হকার বসে আছে।
একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, “অদৃশ্য রঙের কালি হবে?”
আসলে নীলখামে জল ভরে চিঠি পাঠাবো
সাথে অদৃশ্য কালিতে লেখা একটা শব্দ!
হকার লোকটা বেশ বৃদ্ধ মতোন; চোখে হাতল ভাঙ্গা গোল চশমা
মাথা চুলকাতে চুলকাতে তিনি একবার আমার দিকে তাকালেন;
একবার আকাশের দিকে।
তারপর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন;
থামিয়ে দিয়ে বললাম,”ওই যে —-বুঝলেন কিনা–
গোপন চিঠির জন্য যে কালি!
এবার তিনি মৃদু হাসলেন, “হবে;
দাম পড়বে গুণে গুণে পাঁচ টাকা”।
“আড়াই টাকাতেই পাওয়া যায়; পাঁচ টাকা কেন”?
প্রশ্নটা করলাম বটে; তবে
পাঁচ টাকা দিয়েই চট জলদি এক প্যাকেট কিনে নিলাম।
কারণ তখন পেছনে আমার মতন এক কিশোর ছিল
তার পেছনে একজন যুবক ছিল
যুবকটার পেছনে একজন বৃদ্ধ
তার পেছনে কয়েকজন ভিক্ষুক, এবং রাজার লোকেরাও!
একটা ময়লা ঠোঙ্গায় ওটা ভরে দিতে দিতে
তিনি বললেন, “বুঝলে বাপু, আজকাল সবাই সবকিছুর আড়াল খুঁজে
মুখোশের ডিমান্ড তাই বেশ বেড়ে গেছে”!
তারপর কয়েক পিছ নীল খাম কিনে ঘরে ফিরলাম;
ওতে আশিটা সমুদ্র ভরে আজই একটা চিঠি পাঠাতে হবে;
প্রতি, মনলতা
সাকিন- অন্তরপুর!

ঠিক সাতদিন পর-
তাপে অদৃশ্য কালি ভেসে না উঠার অভিযোগ নিয়ে
যখন সেই হকারের কাছে গেলাম;
দেখি আমার সম্মুখে সেই কিশোর
তার সম্মুখে সেই যুবক, বৃদ্ধ, ভিখিরি এবং রাজার লোকেরাও!
হকার লোকটা তার ভাঙ্গা চশমা পরছিলেন আর খুলছিলেন
খুলছিলেন আর পরছিলেন।
আবার মাথা চুলকাতে চুলকাতে তিনি বললেন,
“বুকের উত্তাপে না পোড়ালে কোন কিছুই প্রাণময় হয়না।
মুখোশে রঙের প্রলেপ থাকে; উত্তাপ থাকেনা! “

একদিন পর-
আবার যখন সেই লোকটার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম;
আবছা কাঁচের চশমাটা চোখে পরতে পরতে তিনি বললেন,
“অন্তরের লেখা পড়তে অন্তর পোড়াতে হয়”।

17 thoughts on “কবিতাঃ অদৃশ্য কালি

  1. “বুকের উত্তাপে না পোড়ালে কোন কিছুই প্রাণময় হয়না।
    মুখোশে রঙের প্রলেপ থাকে; উত্তাপ থাকেনা!

    অন্তরের লেখা পড়তে অন্তর পোড়াতে হয়।“

    তিনি সঠিক বলেছেন মি. মিড ডে ডেজারট। বেঁচে থাকলে শুভেচ্ছা জানিয়ে আসবেন। :)

    1. আমি বেঁচে আছি যেহেতু উনিও বেঁচে আছেন নিশ্চয়ই!

      মন্তব্যে খুশি হয়েছি মিঃ মুরুব্বী। অশেষ ধন্যবাদ!

  2. অদ্ভুত একটি কবিতা। ফিনিশিং লাইন থাকায় ধাঁধায় পড়তে হয়নি। 

    1. মন্তব্যে ভীষণ খুশি হয়েছি।

      অশেষ ধন্যবাদ!

  3. কোন কিছুকে প্রাণবন্ত করতে হলে বুকের উত্তাপে পোড়াতে হবে…।

     

    সাথে অন্তর পুড়িয়েই

    অন্তরের লেখা পড়তে জানতে হবে।

     

    1. একদম ঠিক!

      মন্তব্যে খুশি হয়েছি । অশেষ ধন্যবাদ!

  4. অদৃশ্য কালি'র স্মৃতিচারণ। শুভেচ্ছা রইলো ডেজারট ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    1. মন্তব্যে খুশি হয়েছি । অশেষ ধন্যবাদ কবি!

  5. “অন্তরের লেখা পড়তে অন্তর পোড়াতে হয়”। সত্যকথন। অদৃশ্য কালিতে যে চিঠি আমিও লিখেছি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    1. সুন্দর একটা সময় ছিল। চিঠির অপেক্ষা। তবে আমি অদৃশ্য কালিতে কোন চিঠি লিখিনি।

      একদম ছোট বেলায় গুলিস্তানে এক হকার থেকে এমনিতেই কিনেছিলাম; কিন্তু লোকটা আমাকে ঠকিয়েছিল! সেটা আসলে কালি ছিলনা! ওটাকেই বাড়িয়ে লেখা——

      মন্তব্যে খুশি হয়েছি দিদি। অশেষ ধন্যবাদ!

  6. অদৃশ্য কালিতে একসময় আমিও মনের কথা লিখেছি। মোমের আলোয় স্পষ্ট করে তা পুড়িয়েও দিয়েছি। বিক্রেতা ভুল বলেননি। :)

    1. হ্যাঁ, চিঠি লেখা ছাড়া ওটা একটা খেলাও ছিল। তাপে লেখা ভাসিয়ে তুলে আনন্দ পাওয়া। আমি আসলেই সেজন্যই এক সিসি কিনেছিলাম। ৫ টাকা দিয়েই। কিন্তু লোকটা অসৎ ছিল; ভুল জিনিস দিয়ে টাকা নিয়েছিল। 

      মন্তব্যে খুশি হয়েছি। অশেষ ধন্যবাদ!

  7. "অন্তরের লেখা পড়তে অন্তর পোড়াতে হয়" ।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif সুন্দর কথা ।শুভেচ্ছা …..

  8. এই ধরনের কবিতা পড়তে ভাল লাগে। একবার নয়, একাধিকবার পড়েছি।

    মুগ্ধতা জানবে,  কবি।       

  9.  

     

     

    বাহ !!  চমৎকার লাগলো- 

    অন্তরের কথা যেন কবিরাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে পড়িয়ে দেয়- দেখিয়ে দেয়। 

     

    শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা কবি মিড ডে ডেজারট 

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।