৪.
সিনিগ্ধার চিরকুটটি আমার কাছে একটা শ্রেষ্ঠ অর্জন মনে হল। তার প্রত্যুৎত্তর কী, আমার জানা ছিলোনা। শুধু মাথায় কাজ করছে তার জীবনটা আমাকে উৎসর্গ করেছে মানেই হচ্ছে সিনিগ্ধা শুধু আমার। আমি তার ভালোবাসার পরীক্ষায় জয়ী হয়েছি। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। শর্মিকে না দেখিয়ে বুক পকেটে যক্ষের ধনের মত লুকিয়ে রাখলাম আমার পবিত্র অর্জনকে। চিঠি বলি আর চিরকুট যাই হোক এটি আমার জীবনের প্রথম প্রাপ্তি। তার গুরুত্ব প্রকাশ আমার কাছে দুর্বোধ্য হয়ে রইলো আজও।
হঠাৎ মনে হল সিনিগ্ধাকে তো ঠেকানো দরকার ছিল। আসলাম একসাথে অথচ আমাদের রেখে এভাবে চলে গেলো আমরা কিছুই বললাম না, নিজের কাছে কিছুটা অপরাধবোধ হওয়ায় শুর্মিসহ দুজন বেরিয়ে দেখলাম, সিনিগ্ধা তাদের নির্ধারিত বাসে বাসায় চলে যাচ্ছে। মনে হল লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আমাদের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, আমাদের বেরুতে না দেখেই চলে যাচ্ছে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হল। এখনকার সময় হলে বাসায় ফোন করে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারতাম কিন্তু তখন সে সুযোগও ছিলোনা। পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় ছিলোনা। বাসায় গিয়ে ক্ষমা চাইব, সে সৎ সাহস কোন কালে আমার ছিল না।
শর্মি এতক্ষণ আমাকে মনে হয় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিলো। একটা কথাও বলেনি। নীরবতা ভেঙে সে বলল, কীরে আদিত্য- সিনিগ্ধা এভাবে চলে গেলো কেন? আর কাগজটিতে কী লিখে দিয়ে গেলো দেখি? আর তোর আপত্তি থাকলে আমার দেখার ইচ্ছাও নাই। আমার বান্ধবী কী এখন আমার আছে! এখন তো তোর হাতে তুলে দিলাম।
-যা, এগুলো কী বলছিস। সিনিগ্ধা তোকে অনেক পছন্দ করে। তোর মাধ্যমেই তো ওর সাথে পরিচয়।
– হ্যাঁ, তা বৈ কী। কিন্তু ক্যাম্পাসে তো তোদের সবাই একনামে চেনে।
– কেন চেনবেনা? আমরা তো আর লুকিয়ে আড্ডা দেই না। খোলা ময়দানে বসেই গল্প করি।
– তা বটে। কিন্তু ডিপার্টমেন্টে যাওয়া তো ভুলে যাচ্ছিস! একবার নন-কলেজিয়েট হলে বুঝবি।
– নন-কলেজিয়েট হবো কেন। চেয়ারম্যান স্যারের সব ক্লাসে তো উপস্থিত থাকি।
– শুধু চেয়ারম্যান স্যারের ক্লাস করলে হবে? অন্য ক্লাস করতে হবেনা!
এভাবে শর্মির সব কথার উত্তর দিয়ে যাচ্ছি বটে কিন্তু সব কথা যেন মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। কিছুই ধরতে পারছিনা। তাই বললাম, আরে বাদ দে। দেখবি পরীক্ষায় আমি ঠিকই ছক্কা হাঁকাবো।
– জানি, তুই একটু চেষ্টা করলে ভালো করবি, সে কথা আর কেউ না বুঝলেও অন্তত আমি বুঝি।
লাইব্রেরির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে এভাবে জ্ঞান দিবি, নাকি চা পানি কিছু হবে। চল, ঝুপড়িতে গিয়ে বসি কিছুক্ষণ।
– না রে, আজ বসতে পারবোনা। বাসায় কিছু কাজ আছে। আমাকে এখনি যেতে হবে। শর্মিও বাসার দিকে চলল।
এখন ভাবনার অন্তহীন গভীরে ডুবে যেতে লাগলাম। এটি কী অর্জন নাকি বিসর্জন। কোন কিছুই মাথায় ডুকছেনা। তবে উৎসাহ যোগাচ্ছে, “জীবনটা তোকে উৎসর্গ করলাম“ এই কথাগূলো। অনভিজ্ঞ জীবনে মনে হল, এ প্রেম নিবেদনের এক অভিনব পন্থা ভেবে উৎসাহিত হলাম। সত্যতা নির্ণয়ের কোন উপায় না থাকায় আমিও আমার ক্ষুদ্র নিবাসে ফিরে এলাম।
পরেরদিন সকালে ক্যাম্পাসে আসার বাসের জন্য অপেক্ষা না করেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলাম ক্যাম্পাসে। সাত টা পঁয়তাল্লিশ থেকে আমাদের ক্লাস শুরু হতো। কিন্তু ফ্যাকাল্টিতে এসে দেখি তখনও সাত টাও বাজেনি। মনে হয় ফ্যাকাল্টিতে আমিই প্রথম ব্যাক্তি! তখন থেকে সিনিগ্ধার আসার অপেক্ষা। অপেক্ষার প্রহর অতিক্রম করা কতটা কষ্টের একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বোঝে।
ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে, ডিপার্টমেন্টে যাওয়া হয়নি। আমাদের আড্ডার নির্দিষ্ট একটা যায়গা আছে, তার চারপাশে ঘুরপাক খেতে লাগলাম। কখন সিনিগ্ধা আসবে, সে অপেক্ষায়। কিন্তু সিনিগ্ধার আসার কোন নামগন্ধও নাই। তবু যায়গাটি ছেড়ে যেতে মন চাইছেনা। তবুও অপেক্ষা। যদি আসে…।
সাতটা, আটটা, নয়টা, কখন বারটা বেজে গেছে টেরই পাইনি একথা ঠিক নয়। কিন্তু উপায় খুঁজে বের করতে পারিনি বলে, অপেক্ষা ভিন্ন অন্য কোন পথ দেখিনি। এর মধ্যে অনেকে বাসায় ফেরার প্রস্তুতি শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, শর্মি ক্লাস শেষ করে কথায় যাচ্ছিলো। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো।
– কীরে, আদিত্য। ক্লাসে গেলি না যে?
– ক্লাস করতে মন চাইছিলোনা, তাই যাওয়া হলনা। সিনিগ্ধাকে দেখেছিস?
– কেন? তোর সাথে দেখা হয়নি? সে তো এতক্ষণ আমাদের সেমিনারে বসা ছিল। তোর কথা জিজ্ঞেস করলো। বললাম, তুই আসিস নি। তাই চলে গেলো।
– যাওয়ার আগে তো একবার এখানে আসতে পারত।
– মানে? এখানে তো তোর সাথেই আসে। তুই নাই কেন আসবে?
– জী, জনাব। আজ ধরা পড়ে গেছেন। ভাবছিলেন, ক্লাসে না গিয়ে লম্বা একটা আড্ডা দেবেন সিনিগ্ধাকে নিয়ে। সিনিগ্ধা বসে আছে আপনার খোঁজে আপনার ডিপার্টমেন্টে, আর আপনি এখানে! বাহ! চমৎকার। বাহ! সিনিগ্ধা এতক্ষণে সম্ভবত আপনাকে না পেয়ে বাসায় চলে গেছে। কী আর করা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে চাইলে আমার সাথে আড্ডা দিতে পারেন।
শর্মির সাথে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম বটে, কিন্তু মন যেন ছুটে চলছে সিনিগ্ধার পানে। শর্মির কথায় কিছুটা উৎফুল্ল হলাম কিছুটা, সিনিগ্ধা আমাকে খুঁজতে অনেকক্ষণ আমাদের ডিপার্টমেন্টে ছিল! অবশ্য আমার তুলনায় সেই আমাকে খুঁজতে প্রায় আমাদের ডিপার্টমেন্টে আসে। কিন্তু আজ একবারও মনে হয়নি, আজও সে আমার জন্য আমাদের সেমিনারে বসে আছে! কিংবা তার ডিপার্টমেন্টে গিয়ে তার একবার খবর নিয়ে আসার কথা। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজেকে বেশ বোকা বোকা মনে হল। আরও একটি দিনের জন্য অপেক্ষা, ভাবতে ভাবতে শর্মিকে বিদায় দিয়ে বাসারদিকে চললাম।
অনেক প্রত্যাশা নিয়ে এই পর্বটি পড়তে বসেছিলাম। আশাহত হলাম।
দেখি আগামী পর্বে গল্প নায়িকার সাথে কি আলাপ করিয়ে দেন। ধন্যবাদ প্রিয় কবি।
* প্রিয় প্রেরণাদাতা মুরুব্বী, অনেক অনেক ধন্যবাদ।
অপেক্ষার ফল মন্দ হয়না।
ভালো থাকুন নিরন্তর।
সিনিগ্ধার সাথে দেখা হওয়াটা খুব জরুরী ছিল আজ। হলো না।
* প্রিয় কবি দি, অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আদিত্য সকল ক্লাস বাদ দিয়ে সিনিগ্ধার সাথে দেখার জন্য অপেক্ষা করেছিল…
ব্যাথিত হলাম। পরিণতি যাই হোক গল্প নায়ক নায়িকার দেখা হওয়ার প্রয়োজন ছিলো কবি হুসাইন ভাই।
* জী, অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রিয় কবি দাদা।
আদিত্যও অপেক্ষায় ছিল দেখা হওয়ার জন্য।
শুভরাত্রি।