ক্ষুধা- প্রেম ও ঘুম

কিছু কথা আছে, ঠিক এমন– “ক্ষুধায় মানে না মরা ভাত, প্রেম মানে না জাত-বেজাত, ঘুমে মানে না ভাঙা খাট।”
উপরোল্লিখিত কথাগুলো এই বঙ্গদেশে প্রচলিত হয়েছে কবে থেকে, তা আমার জানা নেই। তবে মনে হয় কথাগুলো প্রচলিত হয়েছে এভাবে–

১। ক্ষুধা:
শুরু করি একজন ভিখারি দিয়ে। কারণ আগেকার সময়ে সমাজের সবচেয়ে ক্ষুধার্ত ব্যক্তি ও সবসময়ের জন্য অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি ভিখারি বা ভিখারিনী বা ভিক্ষুকদেরই বলা হতো। কারণ যারা পেশাদার ভিক্ষুক বা ভিখারি, তাদের ঘরে ছয়মাসের খাবারের ধান-চাল মজুদ থাকলেও তারা প্রতিদিনই ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে ঝুলিয়ে দ্বারেদ্বারে ঘুরে বেড়ায়। যে যা-ই দেয়, তা তারা হাত পেতে খুশি মনে নিয়ে নেয়। কেউ টাকা, কেউ পয়সা, কেউ ধান, কেউ চাল, কেউ ছেঁড়া-ফাঁড়া কাপড়চোপড়ও দিয়ে থাকে।

যারা ভিক্ষুককে চাল দেয়, তারা সবাই কিন্তু একরকম চালের ভাত খায় না। কেউ মিনিকেট চালের ভাত, কেউ পায়জম চালের ভাত, কেউ বাসমতী চালের ভাত, কেউ ইরি চালের ভাত খায়। ভিখারিকেও একেক জনে একেকরকম চাল ভিক্ষা দিয়ে থাকে। যে যেই চালই ভিক্ষা দিক-না-কেন, সবার দেওয়া চালই ভিখারি তার কাঁধে ঝুলানো ঝুলিতে একসাথে মিশিয়ে রাখে। তাই গ্রাম বাংলায় আরেকটা কথা প্রচলিত আছে, “ভিক্ষার চাল আকাড়াও ভালো।” কারণ, ভিখারির ক্ষুধা নিবারণের জন্য দুমুঠো চাল হলেই হয়। সেই চাল কাড়া না-কি আকাড়া, তা ভিখারি দেখেও দেখে না। এমনকি মোটা চিকন, ভালো-খারাপও বাছাই করার ভিখারির টাইম থাকে না। সেদিকে ভিখারির দেখারও দরকার নেই। ভিখারির দরকার পরিবারের সকলের দুবেলা আহারের সমপরিমাণ চাল। তা দিয়ে পরিবারের সকলের ক্ষুধা নিবারণ হলেই হয়। এর বেশিকিছু ভিখারির দেখা আর ভাবার দরকার নেই।

সেইসব বার-মিশালি চাল দিয়ে ভাত রান্না করার পর যদি ভাতের সাথে কালো কুচকুচে ভাতও থাকে, তাও ভিখারির পরিবার দুরছাই বলে ফেলে দেয় না। পরিবারের সকলেই ক্ষুধা নিবারণের জন্য মোটা-চিকন, মরা-তাজা চালের ভাত স্বাচ্ছন্দ্যে আহার করে জীবন বাঁচায়। তাই কথায় আছে, “ক্ষুধায় মানে না মরা ভাত।” এই প্রচলিত কথা শুধু যে একজন ভিখারির জন্যই তা কিন্তু নয়! এই কথাটা সবার জন্যই। কেননা, ক্ষুধা শুধু একজন ভিখারিরই থাকে না, ক্ষুধা ধনী গরিব সকলেরই থাকে। আর একজন মানুষের যখন ক্ষুধা লাগে, তখন ক্ষুধার জ্বালা কেউ সহ্য করতে পারে না। এই ক্ষুধার জ্বালা মেটানোর জন্য দরকার শুধু খাবার। অনেকেই আছে ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে বাসি-পঁচা খাবারও খামচে খেয়ে ফেলে। তাই কথায় বলে, “ক্ষুধায় মানে না মরা ভাত।”

২। প্রেম:
কথায় আছে, “প্রেমের পবিত্র শিখা চিরদিন জ্বলে। স্বর্গ হতো আসে প্রেম স্বর্গে যায় চলে।” যার নাম প্রেম মানে পিরিতি, প্রেম মানে মোহাব্বত, প্রেম মানে ভালোবাসা। অনেকেরই রজকিনী চণ্ডিদাস’র প্রেম কাহিনী জানা আছে। তারপরও লেখার ভাব প্রকাশের কারণে রজকিনী চণ্ডিদাস’র প্রেম কাহিনী আমাকে সংক্ষিপ্তভাবে টানতে হচ্ছে। রজকিনী ছিলো দাস’র মেয়ে। মানে ধোপা’র মেয়ে। ধোপা হলো, যারা পাড়া প্রতিবেশির পুরানো কাপড়চোপড় ধোয়ার কাজ করে থাকে, হিন্দু সমাজে তাদের ধোপা বলে। এই ধোপার মেয়ে ছিলো রজকিনী।

আর চণ্ডিদাস ছিলো এক ব্রাহ্মণের ছেলে। ব্রাহ্মণ হলো হিন্দু সমাজে উচ্চ বংশ। সে-সব ব্রাহ্মনদের পুরোহিতও বলে থাকে। অনেকে গোসাই, ঠাকুর, কর্তা বলেও সম্বোধ করে থাকে। তাদের নামের শেষে চক্রবর্তী টাইটেল বসানো থাকে। তো চন্ডিদাসও ছিলো একজন ব্রাহ্মণের ছেলে ব্রাহ্মণ। তখোকার সময়ে হিন্দু সমাজে জাতে- গোত্রে মিল না থাকলে বিয়ের কথা ভাবাই যেতো না, বিয়ে করা তো দূরের কথা! কিন্তু চণ্ডিদাস ধোপার মেয়ে রজকিনীর রূপে মগ্ন হয়ে মনে মনে তাকে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু তখনকার সময়ে হিন্দু সমাজে তা কখনোই মেনে নিবে না! তবুও ব্রাহ্মণের ছেলে চণ্ডিদাস সে-সব নিয়মের তোয়াক্কা করেনি। নিয়মের তোয়াক্কা না করে ব্রাহ্মণ ছেলে চণ্ডিদাস রজকিনীকেই মনেপ্রাণে ভালোবেসে ফেলে। অবশ্যই শেষতক রজকিনীকে প্রেমিক চণ্ডিদাস জীবনসঙ্গিনী করতে পারেনি। তবুও ব্রাহ্মণ ছেলে চণ্ডিদাস রজকিনীর প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে মরতে ছিলো।

একসময় দূরের এক গাঁয়ে রজকিনীর বিয়ে ঠিক হলো। বিয়েও হলো। বিয়ের পর রজকিনী পালকি চড়ে শ্বশুরালয়ে যাচ্ছিলো। ব্রাহ্মণ ছেলে চণ্ডিদাস পাগলের মতো হয়ে শেষবারের মতো রজকিনীকে দেখতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলো। পালকির ভেতরে রজকিনী। চার বেহারা কাঁধে করে পালকি নিয়ে যাচ্ছে। ব্রাহ্মণ ছেলে চণ্ডিদাস একদৃষ্টে চেয়ে আছে। অনেক দূর চলে গেলেও চণ্ডিদাস উঁকি মেরে দেখেই ছিলো। যখন আর রজকিনীর পালকি দেখা যাচ্ছিলো না, তখন ব্রাহ্মণ ছেলে চণ্ডিদাস রাস্তার পাশে থাকা একটা গাছে উঠল। গাছে উঠে প্রিয়তমা রজকিনীকে বহন করা পালকি তেখতে লাগলো। পালকি চোখের আড়াল হলেই, ব্রাহ্মণ ছেলে চণ্ডিদাস আরও একটু উঁচুতে উঠতে থাকলো। এভাবে একটু একটু করে গাছের শেষ মাথার উপরে উঠে উঁকি মেরে রজকিনীর পালকি দেখতে লাগলো। একসময় গাছের উপরিভাগের ডাল ভেঙে নিচে পড়ে ব্রাহ্মণ ছেলে চণ্ডিদাস শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।

এমন হাজারো প্রেমকাহিনী এই সুন্দর পৃথিবীতে অনেক আছে। তা অনেকেরই জানা আছে। এই প্রেমের কারণে কতো মানুষ নিজের মা-বাবাকে ত্যাগ করে। নিজের ধর্মকেও বিসর্জন দিয়ে ফেলে। কি হিন্দু, কি মুসলিম, কি খ্রিস্টান, কি বৌদ্ধ আর মেথর চাঁড়াল। প্রেমে কোনও ধনী গরিব, ধর্ম-কর্মই মানতে চায় না। মানেও না। তাই এপার বাংলা ওপার বাংলায় প্রেম নিয়ে এই কথাটা প্রচলিত আছে, “প্রেমে মানে না জাত-বেজাত।”

৩। ঘুম:
কথায় আছে, “ঘুমে মানে না ভাঙা খাট।” কথাটা প্রচলিত হয়েছে মনে হয় এভাবে– একজন মনুষ সারাদিন পরিশ্রম করার পর যদি রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে না পারে, তাহলে ওই মানুষ পরদিন আর কাজ করার শক্তি পাবে না। হোক সে বীর পালোয়ান, আর নাহয় হোক কোনো দুর্বল ব্যক্তি। সবাইকেই নিজের শরীর ঠিক রাখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে হবে। তাই একজন রুগী ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে, বিজ্ঞ ডাক্তার রুগীকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, “রাতে ঘুম কেমন হয়?” রুগী যদি বলে, ‘ঘুম কম হয় বা ঘুম হয়-ই না!’ তখন বিজ্ঞ ডাক্তার রুগীকে রোগ নিরাময়ের ঔষধের সাথে ঘুমের ঔষধও দিয়ে থাকে।

তাছাড়াও একজন মানুষের যখন ঘুমের ভাব হয়, তখন ওই মানুষটি যেখানে সেখানেই ঘুমিয়ে পরতে পারে। কি রাস্তা আর কি যাত্রীবাহী যানবাহন! তাই অনেকেই বলে, “যেখানে হয় কাইত, সেখানেই পোহায় রাইত।” মানুষের দৈনন্দিন জীবন নামের গাড়িটা চালাতে গিয়ে অনেকেই সারারাত জেগে পরিশ্রম করে। যারা রাত জাগা পাখি, তারা রাতের পরিশ্রমের ফাঁকে একটু সময় পেলেই নিজের শরীরটা লেলিয়ে দেয় ঘুমের নেশায়। তখন সেখানে কোনও খাট পালঙ্ক থাকে না। আর কর্মক্ষেত্রে খাট-পালঙ্ক থাকার কথাও নয়। কি ফ্লোর, কি মাটি আর কি ময়লা আবর্জনার স্তুপ, ঘুমের নেশায় ক্লান্ত শরীরটাকে লেলিয়ে দিয়েই বিভোর ঘুমে মুহূর্তেই আছন্ন হয়ে পরে। তাই কথায় আছে, “ঘুমে মানে না ভাঙা খাট।” এভাবেই “ক্ষুধায় মানে না মরা ভাত”, “প্রেম মানে না জাত-বেজাত”, “ঘুমে মানে না ভাঙা খাট” এই কথাগুলো প্রচলিত হয়ে আজও রয়ে গেছে মানুষের মুখে-মুখে।

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

10 thoughts on “ক্ষুধা- প্রেম ও ঘুম

    1. সুন্দর মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম, শ্রদ্ধেয় কবি লিটন দাদা। শুভকামনা থাকলো।       

    1. সুন্দর মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম, শ্রদ্ধেয় দাদা। অফুরন্ত শুভকামনা থাকলো।         

  1. ক্ষুধা- প্রেম ও ঘুম

    ___ তিনটি শব্দের অসাধারণ ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়েছেন প্রিয় কবি নিতাই বাবু। মুগ্ধ হলাম।

    1. আপনার অনুপ্রেরণায় আমার যতো লেখা। আশা করি এভাবেই সাথে থাকবেন সবসময়। শ্রদ্ধা-সহ শুভকামনা থাকলো।       

  2. আমার কাছে ভীষণ পছন্দ হলো আপনার অন্যান্য লেখার পাশাপাশি এই লেখাটি পড়ে। অনেক ধরণের বিষয়াদি নিয়ে লিখে যাচ্ছেন, পড়তে আমি দারুণ স্বাচ্ছন্দ বোধ করছি দাদাভাই। শুভেচ্ছা

    1. আমার এ-ই নগন্য লেখা পড়েছেন শুনে খুবই খুশি হলাম, শ্রদ্ধেয়া কবি দিদি। আশা করি ভালো থাকবেন সবসময়।           

    1. সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, শ্রদ্ধেয়া কবি দিদি।     

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।