সেদিন বিয়ে সম্পাদন হতে রাত প্রায় শেষ হয়ে গেল। অমি আর কানাই সহ এলাকার আরো তিন চারজন বন্ধু বাড়ির বাহিরে পুকুরপাড়ে ছালার চট বিছাইয়ে বসে বসে গল্পগুজব করতে করতেই রাত শেষ করলাম ৷ মাঝে মাঝে ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে কিরে, তোর কি একটুও খারাপ লাগছেনা? ওদের প্রশ্নের উত্তরের প্রত্যুত্তর দেই লাগলেই কী কিছু করা যাবে? এমন আরো কয়েকজনই সেদিন রাতে সামনে এসে এসে জিজ্ঞেস করলো, একই ধরণের কথা। সবাইকে একই উত্তর দিয়ে বিদায় দিলাম। আমার মা’ও সেদিন একটু ভয় পেয়েছিল আমার জন্য। খানিক পর পরই মা’ আমাদের কাছে এসে কানাইকে ডেকে শুধু আমার মনের গতিবিধি জানতো। কানাই মা’কে বুঝিয়ে শান্তনা দিত কিছুই হবে না মাসিমা। তুমি কোন চিন্তা করো না ঘরে যাও। কানাই এসে আবার আমার কাছে বলতো। মাসিমা এসে তোর খবর নিল, আমি বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। আর বলে দিলাম কোন চিন্তা যাতে না করে। চিন্তা তো করার কথাই, শত হলেও গর্ভধারিণী মা।
আমাদের হিন্দুধর্মের বিবাহ কয়েকটা পর্বে হয়ে থাকে। যার সবগুলো নিয়ম বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষের বিবাহে ওইসব নিয়ম মানতে দেখা যায় না। বিবাহের পর্বগুলি (১) পাটিপত্র, (২) পানখিল, (৩) দধিমঙ্গল, (৪) গায়েহলুদ বা অধিবাস, (৫) শঙ্খ কঙ্কন বা সোনা’কাপড়, (৬) বর বরণ, (৭) শুভ দৃষ্টি, (৮) সাত পাক, (৯) মালা বদল, (১০) সম্প্রদান, (১১) অঞ্জলি, (১২) সিঁদুর দান, (১৩) বিবাহ অনুষ্ঠান, (১৪) বাসিবিবাহ। এইসব পর্বের ভিতরেও টুকিটাকি অনেক পর্ব আছে। যা একেক গোত্রের একেক নিয়মের পর্ব। মূলতঃ পর্ব দুইটা, প্রথম পর্ব হলো “বিবাহ অনুষীঠান” দ্বিতীয় পর্ব হলো “বাসিবিবাহ”। প্রথম পর্বে পুরোহিতের মন্ত্র দ্বারা মেয়ের পক্ষ থেকে কন্যাদান। ছেলের পক্ষ থেকে কন্যাকে গ্রহন করা। তারপর শুরু হয় ছেলে ও মেয়ের গুন জ্ঞানের পরীক্ষার খেলা। পাশাখেলা, আংটিখেলা, চাউল ছিটানীখেলা, মনিমনা খেলা। পরিশেষে সমাপ্তি ঘটে বাসিবিবাহের মধ্য দিয়ে।
ওইসব খেলায় উভয়ই জিততে হবে বা জিতার চেষ্টা করে। কেউ কারো কাছে হার মানতে নারাজ। ওইসব খেলার মধ্যে আংটিখেলা হলো অন্যতম। যে চারটে কলাগাছকে সাক্ষী করে ছেলে মেয়েকে সাতপাক ঘুরানো হয় বিয়েতে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে, ওই কলাগাছের নিচে ছোট একটা চার কোনা পুকুর বানিয়ে সেই পুকুরে জল ঢেলে দেয়। তারপর ছেলের হাতের আঙ্গুলের শ্রীআংটিখানা সেই পুকুরপাড়ে লুকানো হয়। যা ছেলে লুকোয় তিনবার, আর মেয়ে লুকোয় তিনবার। একজন লুকাবে, অন্যজন বাহির করবে। তখন দেখা যাবে কে কতবার লুকানো আংটিখানা বাহির করতে পারলো। খেলায় যে এগিয়ে থাকবে সেই হবে বুদ্ধিমান। চাউল ছিটানো খেলা ৷ এই খেলাটি ও উভয় পক্ষের শান্তস্বভাব কেমন হবে সেই পরীক্ষা ৷ আংটি খেলার পর, ছেলে মেয়েকে নিয়ে যাবে একটা ঘরে ৷ সেই ঘরের মেঝেতে পাটি বিছাইয়ে সেই পাটি’র উপর বসবে ছেলে-মেয়ে আড়াআড়ি ভাবে। সেখানে থাকে একটা মাটির ঘটে কিছু চাউল ৷ ওই ঘটের চাউল ছেলে পাটি’র উপরে ছিটিয়ে দিবে। আর মেয়ে সমস্ত চাউলগুলি খুঁজে-খুঁজে ঘটে রেখে’ ঘটের ঢাকনাটা এমন ভাবে বসাতে হবে, যাতে করে কোন শব্দ না হয়। যদি শব্দ হয়, তবে গুরুব্যক্তিরা বুঝবে যে, মেয়ের হাঁটা-চলায় শব্দ হবে। এবং উৎপাত করবে বেশি। ছেলের বেলায়ও তাই। মেয়ে চাউলগুলি ঢেলে ছিটিয়ে দিবে, আর ছেলে চাউলগুলি উঠাবে, শব্দ যেন না হয়। মনিমনা খেলা” একটা বড় আকারের বলবাটিতে কিছু জল দিয়ে সেখানে ছেলের মাথার মুকুট থেকে একটু বস্তু ছিঁড়ে, মেয়ের মাথার মুকুট থেকে একটু বস্তু ছিঁড়বে। বস্তুগুলি ওই বলবাটির জলে ছেড়ে দিয়ে হাতে ওই জল ঘুরাইতে থাকবে। সেই সাথে ঘুরতে থাকবে ওই মুকুটের বস্তু দুইটি। বস্তু দুইটি ঘুরতে ঘুরতে যদি একসাথে জোড় লাগে, তবে লোকে বুঝবে স্বামী-স্ত্রী মিলেমিশে থাকবে চিরদিন। আরেকটি খেলা হচ্ছে পাশাখেলা” এখন এই খেলাটি নাই বললেও চলে। কেননা এই খেলাটি খুবই কঠিন খেলা ও হিসেবের খেলা। যা, আজকালকার ছেলেমেয়েদের মাথায় ঢুকে না। আসলে এটিই হচ্ছে বর-কনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ খেলা। এই খেলাটাকে বলা হয় “চতুরাজি” খেলা। এই খেলায় চারটে গুটি থাকে। অনেকটা দাবাখেলার মত। গুটিগুলির নাম: (১) বোড়ে বা রাজা, (২) নৌকা, (৩) ঘোড়া, (৪) গজ, প্রত্যেক দানে দুইটি পাশার গুটির জন্য দুইটি চাল দিতে হয়। বর্তমানে কোন কোন বিয়েতে পাশার পরিবর্তে কড়িখেলা খেলতে দেখা যায়। যে জিতবে সেই হবে বুদ্ধিমান। ওইসব খেলা থেকেই গুরুব্যক্তিরা বুঝে নিবে তাদের সংসার কেমন সুখের হবে। আর কে বেশি বুদ্ধিমান হবে, ছেলে না মেয়ে।
তারপরে হবে বর-কনের খাওয়াদাওয়ার পালা। সাথে থাকবে ছেলের বন্ধুবান্ধব ও জামাইবাবুরা। মেয়ের সাথে থাকবে, মেয়ের বান্ধবীরা বর বউদিরা ও বউদির বোনেরা। যাদের সাথে ঠাট্টাতামাশা করা যায়। আমাদের হিন্দুধর্মে বিয়ের দিন ছেলে এবং মেয়েকে উপবাস থাকতে হয়। বিয়ের প্রথম পর্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত। খাওয়াদাওয়ার জন্য ছেলে-মেয়েকে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। বড় একটা কাঁসের থালা করে সবপদের তরকারি থালার চারদিকে সাজিয়ে দিয়ে, মাঝখানে দিলো ভাত। এটা হিন্দুধর্মীয় নিয়ম মত যেভাবে দেওয়া হয় ঠিক সেভাবেই দেওয়া হলো তাঁদের। সাথে আছে ছেলের ভগ্নিপতি ও সাথে আসা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। মেয়ের সাথে আছে মেয়েটার ছোট ভাই, ও শ্যামসুন্দর দাদার বাড়ির ভাড়াটিয়া কয়েকজন অল্পবয়সী মেয়ে। আর শ্যামসুন্দর দাদা স্ত্রী। ছেলেকে বসানো হলো এক পিঁড়িতে। তার বিপরীত দিকে এক পিঁড়িতে বাসানো হলো মেয়েকে। ছেলের বন্ধুবান্ধব ও ছেলের জামাইবাবু ভাত খাওয়ার জন্য খাবারে হাত দিলেও, মেয়েটা কিন্তু খাবারে হাত দিচ্ছে না। সবাই বলছে, খাও খাও কিছুতেই খাবারে হাত দিচ্ছেনা মেয়েটা। শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী রেগে বলল খাওনা কেন? খাও তাড়াতাড়ি করে। খানিক পর সকাল হয়ে যাবে। শুরু হবে আবার বাসি বিয়ের কাজ। মেয়েটা বলল “মামি”, নিতাই দাদা কোথায়? ৷ নিতাই দাদা ছাড়া আমি খাবো না, মেয়েটার সোজা কথা। শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী তো হতবাক! বলে কী? রেগে বলল। ওর কি পাত্তা আছে? তুমি খাও তাড়াতাড়ি করে। মেয়েটির এক কথা “মামি” নিতাই দা বাহিরে আছে। তাকে আসতে বললেই আসবে। নিতাই দা রাতে খায় নাই। শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো। নিতাই রাতে খায়নি তুমি জানলে কী করে? মেয়েটি প্রত্যুত্তরে কিছুই বলল না, শুধু চুপ করে রইল। মেয়েটার অনুরোধে শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী বাহিরে এসে, সোজা চলে আসলেন পুকুরপাড়। যেখানে আমরা থাকার কথা সেখানে। আমি আর কানাই সহ তিন চারজন বন্ধুবান্ধব মিলে কথা বলছিলাম তখন। এরমধ্যেই শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী এসে আমার হাত ধরে টানতে লাগল। আমি বললাম বউদি, কী হয়েছে বলেন শুনি! বউদি কানাই’কেও বলছে। কানাই তুইও আয় ওর সাথে। বউদির সাথে খাবার ঘরে গিয়ে দেখি, খাবারের থালা মাঝখানে রেখে সবাই চুপচাপ বসে আছে। আমার বুঝতে আর বাকী রইল না, ঘটনা কী হয়েছে। বউদি বলল কানাইকে নিয়ে মেয়েটার সাথে বস ভাত খেতে। তোদের ছাড়া ও খাবে না, তাই তোদের এখানে টেনে আনলাম, বস-বস তাড়াতাড়ি। কানাই বসলো, আমিও বসলাম কানাই’র সাথে। দেখলাম মেয়েটা কানাইকে কানে-কানে কী যেন বলল। কানাই আমাকে বলল, তুই ওকে প্রথম খাইয়ে দিবি, তারপর ও খাবে। ছেলে পক্ষের সবাই শুধু আমাদের দিকেই তাকাচ্ছিল। কিন্তু কেউ কিছুই বলছেনা। কানাই’র কথা শুনে আমার বিষণ লজ্জা হচ্ছিল। আবার খারাপও লাগছিল। ছেলের পক্ষের কেউ যদি আবার মেয়ে’টাকে সন্দেহের চোখে দেখে! তাই খারাপ লাগছিল। এরপর সবাই বলল, দাদা শুরু করুন সকাল হয়ে গেল। আর কী করা, ভাত মেখে মেয়েটার মুখের সামনে নিতেই, কেঁদে দিল হাউমাউ করে। ওর কাঁদা দেখে আমি কি ঠিক থাকতে পারি? আমিও কাঁদছি। আমার কাঁদা দেখে কানাইও কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, নাও সারাদিন তো কিছুই খাওনি এখন খাও, আমি খাওয়াইয়ে দিচ্ছি। সবাই বলল খাও-খাও, মেয়েটা আমার হাত ওর দুহাত দিয়ে ধরে, আমার হাতের খাবারগুলি ওর মুখে নিয়ে খাচ্ছে। আবার মেয়েটা ভাত মেখে আমার মুখের সামনে এনে আমাকে খাওয়াইয়ে দিতে চাচ্ছে। এমন সময় আমি ওর দুহাত ধরে বললাম। আগে তোমার স্বামীর মুখে দাও, তারপর আমাকে খাওয়াবে। মেয়েটি আমার কথা মত ওর স্বামীকে খাওয়াইয়ে দিয়ে, পরে আমাকে খাইয়ে দিল। আমিও ওর স্বামীকে ভাত মেখে খাওয়াইয়ে দিলাম। কানাই তখন খুশিতে হাততালি দিতে লাগল। কানাইর দেখাদেখি উপস্থিত সবাই হাততালি দিতে শুরু করল। কেউ কেউ আবার বলছে, একথা আগে বললেই হতো। এভাবেই সেদিন বর-কনের খাওয়াদাওয়ার পর্বটা শেষ করলাম। ওকেও খাওয়ালাম নিজেও খেলাম।
তারপর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। দ্বিতীয় পর্ব হলো বাসিবিয়ে। অর্থাৎ পুরোহিতের মন্ত্র দ্বারা ছেলে ও মেয়েকে সূচিত করা বা শুদ্ধ করা। এটা ঠিক সূর্য উদয়ের সাথে সাথে হয়ে থাকে। বাসিবিয়ের বাজনা যখন বাজছিল, তখন বুঝতে পারলাম এই বাজনা বিবাহের শেষ পর্বের। ভাবছিলাম মনে মনে। এমন সময় কানাই আমাকে বলল, চল বিয়ে প্রায় শেষ। বাসিবিয়েটা দেখে আসি। আমি যেতে চাচ্ছিলাম না, কানাই একপর্যায়ে জোর করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল। সাথে আছে চার পাঁচজন বন্ধুবান্ধব। সবাই একসাথেই বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। পুরোহিত মহাশয় মন্ত্রপাঠ করছে। আরেক দিকে বাজনাও বাজাচ্ছে জোরে-সোরে। কানাই ও সাথের বন্ধরা বাজনার তালে-তালে নাচতে লাগলো। ওরা নাচছে আর আমাকেও ওদের সাথে নাচার জন্য টানছে। ওদের টানের সাথে সাথে আমার পিছন থেকেও আমাকে ধাক্কাচ্ছে, ওদের সাথে নাচার জন্য। উপায়ান্তর না দেখে আর কী করা ! নাচতে লাগলাম সবাই মিলে। একপর্যায়ে বাসি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্তি ঘোষণা করল পুরোহিত মহাশয়। কিন্তু আমাদের নাচ তো থামছে না। বাড়ির সবাই তখন আমাদের সাথে নাচতে লাগলো। সাথে মহল্লার লোকও যোগ দিলো। বাজনাবাদকেরা বাজনা আর বাজাবেনা বলে বাজনা বন্ধ করে দিল। নাচ থেমে গেল সকলের। তখন সবাই ক্ষেপলো বাজনাবাদকদের উপর। বাজনা আরো বাজাতে হবে, বিনিময়ে তাদের আরো বেশি টাকা দেওয়া হবে। এই আশ্বাসের পর আবার শুরু হলো বাজনা। সকলে শুরু করলো নাচ, অনেকক্ষণ পর্যন্ত নাচ চলছিলো বাসি বিয়ের সময়। বাসি বিয়ে বলতে, ছেলে মেয়েকে স্নান করানো একটা পর্ব। স্নান করাইয়া পবিত্র করা বা শুদ্ধ করা। দুজনকে দুই পিঁড়িতে দাঁড় করে, পুকুর থেকে কলশী দিয়ে জল আনবে। পুরোহিত মন্ত্রপাঠ করবে, আর কলশীর জল দুজনের মাথায় ঢালবে। এভাবে স্নান করানোর সময় আমরা নাচছিলাম। আর মেয়েটা সেই নাচের দৃশ্যগুলি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল।
বাসিবিয়ের আনুষ্ঠানিকতার শেষে আমি কানাইকে বলছি। আজতো কাজ করতে পারবো না কানাই। সারারাত ঘুমাইনি, কাজ করবো কী ভাবে। কানাই বলল, তাহলে মিলের কাজ করবে কে? ম্যানেজার রাগ করবে। আমি বললাম তুই মিলে গিয়ে ম্যানেজারকে বলবি ওস্তাদ অসুস্থ, লাঞ্চের পরে আসবে। কানাই বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, যাবো আট ঘটিকার সময়। তুই এখন বাসায় গিয়ে ঘুমা, আমিও একটু ঘুমাবো। সারারাত’তো আর ঘুমানো হয়নি।
এসব বলতে বলতে শ্যামসুন্দর দাদা, ও বউদি পুকুরপাড় এসে, আমাকে আর কানাইকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন। আমরা খাওয়াদাওয়া করছি কি না। কানাই বুদ্ধি করে বলল, হাঁ দাদা, আমরা খাওয়াদাওয়া করেছি। আপনারা দুজনে খাওয়াদাওয়া করেছেন তো? শ্যামসুন্দর দাদা বললেন, হ্যাঁ করেছি কোনরকম। আর শোন, কিছুক্ষণ পরে তো ওকে জামাইদের ওখানে নিয়ে যাবে। নিতাই সহ তোরা উপস্থিত থাকিস কেমন ! কানাই বললো, দাদা আপাতত ওকে নিয়ে জামাই কোথায় উঠবে? শ্যামসুন্দর দাদা বললেন, আপাতত শহরের মাসদাইরে উঠবে ওরা। ওখানে জামাইর কাকা থাকে। ওদের বাপদাদার ভিটেবাড়ি কুমিল্লা। ছেলেটা একটু সোজা রকম’তো তাই, আমার দোকানেই রেখে দিব। আর মেয়েটা’তো আমার এখানে থাকবেই। ওদের আলাদা একটা ঘর বানিয়ে দেওয়ার, চিন্তাভাবনা করছি। আটনাইয়রীর পর আর যেতে হবেনা ওদের। আমার বাড়িতেই থাকবে ওরা। শ্যামসুন্দর দাদা বললেন, আর আমি শুধু শুনছিলাম। আমাকে কিছু জিজ্ঞেসও করেনি, আমিও কিছু বলিনি। শ্যামসুন্দর দাদা চলে গেলেন, বাড়ির ভিতরে। দাদার সাথে সাথে বউদিও চলে গেলেন। একটু পরে মেয়েটি পুকুরপাড় এসে আমাদের দেখে সামনে এসে বললো। সারারাত হয়তো ঘুমানো হয়নি আপনাদের। তারপরেও এখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন দুজনে? ঘুমাননি তো বেশ করেছেন। কিছুক্ষণ পরে আমাকে হয়তো নিয়ে যাবে তাদের বাড়িতে। যাওয়ার সময় যেন ডাকতে নাহয়। যা চেয়েছিলাম তাতো আর পাওয়া হলো না। না পেলাম দুঃখ নেই, কোনদিন সামনে থেকে তাড়িয়ে দিবেন না, কথা দিন ! আমি আর ওর সাথে কথা বলতে পারছিনা। ওর কথা শুনে আমার কান্না আসতে লাগল। মেয়েটি আমার দুহাত ধরে কথাগুলি বলছিল। হাত আর ছাড়ছে না, ধরেই রাখছে। আমার অবস্থা টের পেয়ে কানাই বলল, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি এখন বাড়ি যাও। মেয়েটি বলল, দাদা কিছু বলছেনা কেন? তখন আমি মেয়েটাকে বললাম। তুমি বলছো তোমাকে কথা দিতে হবে, কোনদিন সামনে থেকে যেন তাড়িয়ে না দেই। এটা কী করে সম্ভব? আমি এবাড়ির ভাড়াটিয়া। আজ আছি, কাল এখানে না ও থাকতে পারি। তুমিও এখানে চিরদিন থাকতে তো পারবেনা। একদিন না একদিন, তোমাকে অন্যত্র চলে যেতে হবে। তাহলে তোমাকে আমি কী করে কথা দেই বলো? তবে তোমায় আমি কথা দিলাম। আমি এই পৃথিবীতে যতদিন বাঁচবো, ততদিন তুমি আমার এই অন্তরেই থাকবে সারাজীবন, যাও কথা দিলাম। আমার কথা শুনে মেয়েটি তখন কান্নাকাটি শুরু করে দিল, হাউমাউ করে। ওর কান্না আর থামছে না। আমি মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম। এখন তুমি কান্নাকাটি করলে, লোকে আমাকে কী ভাববে বলো? তখন মেয়েটি আমার দুহাত ছেড়ে দিয়ে বললো। চিরদিন আপনিও আমার অন্তরে থাকবেন। আজ বিদায় বেলা যেন সামনে পাই। এই কথা বলে মেয়েটি চলে গেল বাড়ির ভিতরে।
আমরা দুজনে রওনা হলাম, কোন এক চা’ দোকানের উদ্দেশে। কানাই শুধু বলল, নিতাই অবস্থা বেগতিক। কানাই’র কথায় কোন উত্তর দিলাম না। সোজা হাঁটতে লাগলাম, দোকানের উদ্দেশে। সকাল দশটায় আটজন বরযাত্রী সহ, জড়ো হলো পুকুরপাড়, রিকশার জন্য। পাঁচটা রিকশার দরকার ওদের। দুইটা পেয়েছ, আরো লাগবে তিনটে। যেকোন মেয়েদের বিয়ে দিলে, স্বামীর বাড়ি যাওয়ার সময়, সব মেয়েরাই কান্নাকাটি করে। যাওয়ার আগে মেয়েটিও কাঁদছে। বাড়ির সবাই কাঁদছে পুকুরপাড় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এমন সময় কানাই আর আমি, দোকান থেকে আসছি। দূর থেকে দেখি পুকুরপাড়ে অনেক লোকের সমাগম। কানাই বলল, মেয়েটা মনে হয় জামাইবাড়ি যাচ্ছে, চল শিগ্গির। কানাইকে বললাম, তুই যা আমি বরং মিলের দিকে যাই। কানাই বলল, কেন? তোকে না মেয়েটি বলছে, যাওয়ার সময় সামনে থাকতে? তোকে না দেখলে তো আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিবে। আমি বললাম, শোন কানাই। বিদায় বেলা যদি সামনে থাকি, ও আরো কান্নাকাটি বেশি করবে। তখন ওর জামাইবাড়ির লোকজন, ওকে সন্দেহের চোখে দেখবে সবসময়। তুই বরং ,সামনে থেকে ওকে একটু বুঝিয়ে বলিস। যে, নিতাই’র মিলে খুব কাজ ছিল বিধায়, ও তাড়াতাড়ি মিলে গেছে। কাজটা সেরে আসতে সময় লাগতে পারে। তুই যেভাবে পারিস ওকে ম্যানেজ করবি। কানাই’তো আমার কথায় একটুও এদিক সেদিক করবে না করেও না। কানাই সোজাসুজি চলে গেল পুকুরপাড়ে। যেখানে জামাই সহ, মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। রিকশা পাঁচখানা রেডি, সবাই রিকশায় উঠে বসে আছে। মেয়েটা শুধু ওর মা’ আর ছোট ভাইটাকে ধরে কাঁদছে। কানাইকে দেখেই মেয়েটা বলল, কানাই’দা নিতাই দাদা কোথায়? কানাই ওকে উদ্দেশ্য করে মুখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝালো চুপ। মেয়েটি চুপকরে কানাই’র দিকে তাকিয়ে বলল কী? কানাই তখন মেয়েটাকে একটু দূরে টেনে নিয়ে বলল, আমার শিখানো কথাগুলি। কানাই’র কথা শুনে মেয়েটা আরো জোরেসোরে কাঁদতে লাগল। কানাই আর শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী মিলে, ওর হাত ধরে, জামাই’র সাথে রিকশায় বসিয়ে দিয়ে, সব রিকশাওয়ালাদের যেতে বলল। রিকশা যাচ্ছে,আর পিছন ফিরে তাকাচ্ছে বারবার। আমি দূর থেকে কাঁদছি, আর ওর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি চুপিচুপি ৷
কানাই এসে আমাকে বলল, আয় ঝামেলা শেষ। তুই বাসায় গিয়ে ঘুমা, আমিও বাসায় গিয়ে কিছু খাওয়াদাওয়া করে, খানিক পর, মিলে যাব ম্যানেজারকে বলতে। কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, কী বলেছে মেয়েটা? কানাই বলল, কিছু বলার সুযোগ দেইনি, শুধু তোর দেয়া, মন্ত্রপাঠ করে বিদায় দিলাম। ওতো আবার কাল না হয় পরশু আসবে। আড়াই দিনের একটা নিয়ম তো আছে। কানাই গেল বাসায়, আমিও বাসায় এসে স্নান করে, মায়ের দেওয়া কিছু খাবার খেয়ে ঘুমালাম। সেই ঘুমেই রাত পাড় করলাম, কেউ আর সেদিন আমাকে ডাকও দেয়নি। একদিন পরেই ঠিক বিকালবেলা, মেয়েটি জামাই নিয়ে শ্যামসুন্দর দাদার বাড়ি আসলো, আড়াই দিনের নিয়ম পালন করার জন্য। আমি আর কানাই মিলে কাজ করছিলাম। ছোট দুইটা বাচ্চা ছোলে মিলে গিয়ে দারোয়ানকে বলল, আমাকে ডেকে দিতে। দারোয়ান গিয়ে বলল, বাবু তোমার লোক এসেছে গেইটে। বলালাম, ভিতরে আসতে বলেন কাকা। দারোয়ান কাকা ওদের নিয়ে ভিতরে আসলো। ওরা আমার কাছে গিয়ে বলল, কাকা তোমায় ডাকছে দিদি, শিগ্গির আস আমাদের সাথে। কানাই রাগ করে ওদের বলল, যা’ গিয়ে বল আসতে দেরি হবে, কাকা কাজে ব্যস্ত। আমি আর কিছু বললাম না বাচ্চা দুটোকে, ওরা মিল থেকে বাড়ি চলে গেল, আমরা কাজ করছি। ছুটি হবে রাত আটটায়। এখনো তিন ঘন্টা বাকী? আমার আর ভাল লাগছিল না, শুধু ওকে দেখতে মন চাইছে। কানাইকে বললাম আজ আর কাজ করতে মন চায় না, ম্যানেজার সাহেবকে বলে বাসায় যাব। কানাই আর উত্তর দেয়নি আমার কথায়, ম্যানেজারকে বলে মহল্লায় ফিরলাম, বাসার সামনে এক বন্ধুর মুদিদোকানে দাঁড়ালাম আমি আর কানাই। পুকুরপাড়ের দিকে তাকাচ্ছি ওকে দেখা যায় কিনা, দোকানদারের সাথে কথা বলতে বলতেই দেখি পুকুরঘাটে কী যেন করছে। কানাই আমাকে বলল, ওই দেখ তোর …., আমি কানাইকে ইশারায় বলালাম দেখেছি তো! কানাই বলল, যা, গেলাম সামনে, মেয়েটি আমাকে দেখেই একটা হাসি দিয়ে বলল, পরশুদিন ছিলেন না যে? বললাম কাজ ছিল বিস্তর তাই। কেমন আছো তুমি? বলল, ভালও আছি খুব, মনে শান্তি নেই। বললাম শান্তিও হয়ে যাবে আস্তে আস্তে, সংসার করতে থাক মনস্থির করে সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করো না।
ওর সাথে কথা বলছিলাম আর শ্যামসুন্দর দাদা দূর থেকে দেখছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, আমি বাসায় গেলাম, মা’ আমাকে বলল, আজ এত তাড়াতাড়ি বাসায় আসলি? মিলে কাজ কম? তো শোন! মেয়েটা বাড়িতে এসেছে, ওর সাথে কথা কম বলবি যাতে কলঙ্ক না হয়। বললাম কেন মা’ কিছু হয়েছে নাকি? মা’বললেন না, আমি’ই বললাম কারণ: মেয়েটার বিবাহ হয়েছে, পরের ঘর, কখন কোন কথা উঠে যায় কে জানে! আমার বিষণ ভয় হয়। বললাম না মা’ তুমি কোন চিন্তা করবেনা, ভয়ের কোন কারণ নাই, তোমার ভয় যাতে না হয়, প্রয়োজনে বাসা বদলে ফেলব। খানিক পর শ্যামসুন্দর দাদা বউদিকে সাথে নিয়ে আমার বাসায় এসে বসলো, আমাকে বলছে তোকে কিছু বলবো বলে আসলাম। আমি বললাম বলেন কী বলবেন! দাদা বললেন মেয়ে’টাকে তো বিয়ে দিয়েছি! মেয়ে’টা এখন পরের ঘরের রমণী, তোর সাথে কী সম্পর্ক সেটা আমি জানিনা, তবে তোর কারণে যদি ওর কোন সমস্যা হয় তবে তোকেই তো এর দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে। আমি বলালাম দাদা, এখন আপনি ও বউদি কী বলতে চাইছেন সেটা বললেই হবে। দাদা বলল, ওর সাথে তুই কোন কথাই বলবি না। আমি বুঝতে পারলাম, তাদের মনে সন্দেহের ডানা মেলেছে নতুন করে, এখানে আর থাকা যাবে না, বাসা ছেড়ে দিব শীঘ্রই। দাদাকে বললাম দাদা, আমি কথা দিলাম ওর সাথে আমার যদি কোন কথা হয় তা হয় খনিকের জন্য, এতে ওর কোন অসুবিধা হবে না, আপনি ও বউদি নিশ্চিত থাকুন। শ্যামসুন্দর দাদা ও বউদি চলে হেলেন বাসায়, আমি মা’কে বললাম সামনের একমাস এখানে থেকে বাসা ছেড়ে দিবো। মা’ রাজি হয়ে বলল, তাই কর আমার মোটেই ভাল লাগে না, মেয়েটার বিয়ের পর থেকে।
তাই করলাম, বাসা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি দাদাকে জানিয়ে দিলাম খুব গোপনে, যাতে মেয়েটি জানতে না পারে। আড়াই দিনের নিয়ম করে যাওয়ার দিন আর দেখা করি নাই, লোকচক্ষুর ভয়ে, আটনাইয়রীর বেলায় ও খুব কম কথা বলেছি মেয়েটার সাথে, আটনাইয়রীর আসার পর, মেয়ে’টির জামাই সহ এই বাড়িতেই থেকে গেল, জামাই আমাকে দেখলে খুব সম্মান করতো। হয়তো মেয়েটাই বলে দিয়েছিল জামাইকে, জামাইটা সোজা মানুষ, যে যাই বলে তাই শুনে। এই বাড়িতে থাকবো আর কয়েক মাস, আমার একটা চাকরি হওয়ার কথা ফরিদপুর রাজবাড়ির গঙ্গাবর্দি, সেখানে গেলে তো আর মা’কে সাথে করে নেওয়া যাবে না, মা’ থাকবে বড়দাদার সাথে, আমি কানাইকে নিয়ে চলে যাবো ফরিদপুর গঙ্গাবর্দি কানাইপুর হাঁট সংলগ্ন। যা কথা তাই করলাম, চাকরিটা খুব জোর দিয়েই ঠিক করলাম শুধু মেয়েটিকে ভুলে থাকার জন্য, আমার দ্বারা মেয়েটার যাতে কোন কলঙ্ক না হয় সেই জন্য। আমার বড় দাদাকেও মা’ সব খুলে বলেছে, আমার দাদাতো রেগে অস্থির। দাদা মা’কে বারবার বলছে তাড়াতাড়ি বাসা ছেড়ে দিতে, না হয় বিপদ সম্মুখে। মেয়েটি জানতে পারলো যে আমি বাসা ছেড়ে দিচ্ছি অতি শীঘ্র, একদিন মেয়েটি আমাকে পুকুরপাড়ে একা পেয়ে বললো, আমার ভয়ে আপনি বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন কেন? আমিতো আপনার কোন ক্ষতি করিনি, আর করবও না কোন দিন, শুধু চোখের সামনে আপনাকে চুপিচাপি একনজর দেখতে পারলেই শান্তি পাই। আমি মেয়েটিকে বুঝিয়ে বললাম যে, দেখ আমি চাকরিজীবী মানুষ, একেক সময় একেক জায়গায় আমার চাকরী করতে হয়, তোমার ভয়ে নয়, চাকরি করে তো চলতে হবে বলো! আর মাত্র পনের ষোল দিনের মধ্যেই আমি আর কানাই ফরিদপুর যাচ্ছি, তুমি আমাকে ভুল বুঝবেনা। মেয়েটি আর কোন কথা না বলে সোজা চলে গেল বাসায়, আমি আর কানাই, এই মাস শেষ না হতেই ফরিদপুরে যাবো, বড় দাদাকেও বলা হয়েছে আগে। আমরা ফরিদপুর যাওয়ার পর মা’ চার পাঁচদিন এই বাড়িতে থাকবে, তারপর দাদা বাসার মালামালগুলি দাদার বাসায় নিয়ে যাবে ভ্যানগাড়ি দিয়ে।
সেদিন ছিল শুক্রবার, ফরিদপুর যাবো কানাই আর আমি, নাইট কোচে যাবো বলে বিকালবেলা থেকেই প্রস্তুতি চলছিল আমাদের। বিকালবেলা মেয়েটি তিনবার জিজ্ঞেস করেছিল, ভুলে যাবেন না আমাকে। আপনি তো আমাকে কথা দিয়েছিলেন, সারাজীবন অন্তরে ঠাঁই দিবেন। বললাম সারাজীবন আমার অন্তরে থাকবে তুমি, এটাই সত্য চিরসত্য। রিকশায় উঠলাম আমি আর কানাই। আমার মা’,কানাই’র মা’, আমাদের বিদায় দিচ্ছে। তাদের সাথে মেয়েটিও আমাদের বিদায় দিলো। তারপর ফরিদপুর থেকে কানাই আর আমি পাঁচ মাস পর ছুটিতে আসলাম। আমি আমার বড় দাদার বাসায় না গিয়ে, কানাই’র সাথে সোজা সেই মহল্লায় গেলাম, মেয়েটিকে দেখবো বলে। দুঃখের বিষয়, মেয়েটি একমাস আগে শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে, জামাই নিয়ে এই বাড়ি থেকে মেয়েটির জামাই’র বাড়ি কুমিল্লা চলে যায়। এইসব কথাগুলি কানাই’র মা,’ মাসিমার কাছ থেকে সেদিনের শোনা। ওই দেখার পর শুধু লোকমারফত খবরাখবর নিতাম, জানা শোনা লোকের কাছ থেকে। কেমন আছে মেয়েটি? ভাল আছে। দুই সন্তানের জননী, শুনতাম লোকের মুখে।
১৯৮৬ সালের শেষদিকের কথা, তখন আমি সবেমাত্র বিয়ে করছি। একদিন বিকেলবেলা গিয়েছিলাম নারায়নগঞ্জ শহরে, নিজের একটা কাজের জন্য। কালিরবাজার, কালীমন্দিরের সামনে রিকশা থেকে নেমে, রিকশা ভাড়া দিচ্ছিলাম রিকশাওয়ালাকে। এমন সময় একটা শিশুবাচ্চা কোলে করে একজন মহিলা, আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি রিকশা ভাড়া দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম মহিলাকে পাশ কেটে। মহিলা, আমার পিঠে টোকা দিয়ে বলছে, কেমন আছেন? তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ মহিলার দিকে। বলল, চিনেন না? আমি সেই মেয়েটি। অবাক দৃষ্টিতে আরো কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম তুমি সেই ! বলতে বলতেই কেঁদে কেঁদে বললো, হ্যাঁ আমি ! বললাম কোলে? বলল, আমার ছোট ছেলে, বড়ো একজন আছে ! ওর মুখে প্রসাদ দিবো বলে কালীমন্দিরে মানস করেছিলাম। তাই কাকা শশুরের বাসা থেকে এখানে আসলাম। জিজ্ঞেস করলো, বিয়ে করেছেন? বললাম কেবল মাত্র তিনমাস হলো করেছি। আমার সাথে সেদিন ছিল মাত্র চারশ টাকা। সেখান থেকে দুইশ টাকা, ওর ছেলের হাতে দিয়ে বললাম। তোমার কাকা শশুরের বাসার ঠিকানাটা দাও, আমি আগামীকাল তোমার সাথে দেখা করবো। আমার হাত ধরে বললো, না’ না’ তাদের বাসার ঠিকানায় আপনি গেলে তাঁরা সন্দেহ করবে আমারও সমস্যা হবে। আর আমিতো আজকেই বাড়ি চলে যাচ্ছি। এমনিতেই আর বেশিদিন হয়তো থাকবো না, কাকা শশুর সহ সবাই মিলে বাড়ি বিক্রী করে দিবে বলে শুনছি। হয়তো ওপারে হতে পারে আমাদের গন্তব্য। আমার ঠিকানাটা লিখে দিয়ে বললাম চিঠি দিও মাঝে মাঝে। মন্দিরের ভিতর থেকে ডাক পড়ল ওর, বললো যাই, ভালো থাকবেন আর মনে যেন থাকে ! আমিও ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। আরো অনেক কথাই হলো, শুনলাম, বুঝলাম ওর কথায় জীবন মানেই যন্ত্রণা, শুধু ভালো লাগার কারণে। যেই কাজের জন্য শহরে গিয়েছিলাম, সেই কাজ আর হলো না সেদিন। তারপর লোক মারফত কিছু পাঠাতাম কয়েক বছর, আমার দেয়া কিছু পেলে মেয়েটি যেন আকাশের চাঁদ পেল হাতে, যেই লোক মারফত পাঠাতাম সেই লোক ফিরে এসে আমার কাছে বলতো। এখন আর কাউকে পাই না যে, কিছু পাঠাবো ওর জন্য। আছে কী নেই তাও জানিনা, চার-পাঁচ বছর ধরে খোঁজ নিতে পারি না। এখন আরো বেশি মনে পড়ে মেয়েটিকে। চোখ বুজলেই দেখি যেন সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, আমাকে সারাজীবন আপনার অন্তরে রাখবেন বলছিলেন,রেখেছেন কিনা জানিনা। আমি রেখেছি আপনাকে আমার হৃদয়ে যতন করে, ভুলবো না কোনদিন।
অসাধারণ ভাবনা। ভালো লাগলো
ভালো লাগার কারণে আমি অত্যন্ত খুশি হলাম, দাদা। সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
পরিসমাপ্তি এখানেই এবং এবং এবং এই পর্যন্তই ঠিক আছে বলে মনে হয়েছে।
পড়তে গিয়ে পাঠক হিসেবে নিজের কাছে লিখাটিকে যেন আমার আমার মনে হয়েছে।
সেদিনের সেসব স্মৃতি আমাকে আজও তাড়া করে। তবে এখন প্রিয়া কোথায় আছে, তা আমার জানা নেই। তবুও পরিচিত কাউকে দেখলে ওর খবরটা জানতে চাই। কিন্তু কেউ বলতে পারে না। তার মানে হয়তো সে দেশের ওপারে পাড়ি দিয়েছে। যেখানে থাকুক, ভালো থাকুক। এটাই আমার প্রার্থনা।