দেশ স্বাধীন হবার আরও অনেক আগে থেকে আমার বাবা নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন চিত্তরঞ্জন কটন মিলের আউট অফ সাইট ক্যালেন্ডারে চাকরি করতেন। ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে একদিন দুপুরবেলা চিত্তরঞ্জন কটন মেলে আউট অফ সাইটক্যালেন্ডার মেশিনের আমার বাবার বাম হাতের চারটে আঙুল থেঁতলে যায়। তারপর থেকে বাবার হাতের অবস্থা দিন-দিন খারাপ হতে থকে।
আমার মা আর আমি একদিন পর-পর বাবাকে নিয়ে চিত্তরঞ্জন কটন মিলের অফিসের সামনে ফকির মিসকিনের মতো বসে থাকতাম, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাহায্যে বাবার ঔষধ কেনার টাকার জন্য। দুই-তিন দিন ঘুরা-ঘুরির পর একদিন তাঁদের দয়া হতো, নাহয় আরও দুই-তিন গিয়ে অফিসের সামনে ভিক্ষুকদের মতো বসে থাকতে হতো। মাস শেষে মূলবেতন পাওয়া যেতো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দয়ার উপর নির্ভর করে। তাও মিলের সব শ্রমিকদের বেতনের পরই পাওয়া যেতো।
একারণে আমাদের সংসারে তখন নতুন করে দেখা দিলো ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সংসার চলতো একমাত্র বড় দাদার বেতনে। তখন বড়দাদা যেই টাকা বেতন পেতো, সেই টাকায় আমাদের ৯ সদস্যের সংসার ১৫ দিনও চলার মতো ছিল না। দোকান বাকি জমতে জমতে একসময় গলা সমান গয়ে গেলো। এর সাথে শেষ হয়ে যাবার উপক্রম হলো আমার লেখাপড়া। বাবা অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার পর থেকে আমার স্কুলে যাওয়াও আগের চেয়ে কমে গেলো। সপ্তাহে দুইদিন স্কুলে গেলে বাকি চারদিন স্কুলে থাকতাম অনুপস্থিত। বাসায়ও বই নিয়ে কখনো পড়তে বসতাম, সময়তে পড়তাম না। বাবার অসুস্থতার কারণে পড়তে বসতে মনও চাইতো না।
স্কুলে না গিয়ে সারাদিন থাকতে হতো বাবার সাথে, আর মিলের ডেলি কাজ পাবার আশায়। একদিন কাজ পেতাম, দুইদিন বসা থাকতাম। এভাবে কেটে গেলো কয়েকমাস। এভাবে আমার কিছুতেই মন ভালো লাগছিল না। তখন সংসারের অভাব আর বাবার হাতের ব্যথার ডাক-চিৎকারে আমার ঘরেই থাকতে মন চাইতো না।
একদিন একটা চুক্তি কাজ পেলাম। কাজটা হলো মাটি কাটার কাজ। আমরা ছিলাম ছয়-সাত জন। দুইদিন মাটি কাটার কাজ করে ৩৫টাকা হাতে পেলাম। সেই টাকা পেয়ে সাথের একজনের সাথে আলাপ করলাম, ‘নারায়ণগঞ্জ থেকে কাঁচা বাদাম এনে বাসায় ভেজে বিকাল বিকাল মিলের গেইটে বসে বিক্রি করলে কেমন হয়!’ লোকটা বললো, ”ভালোই তো হবে। বাদামে লাভ আছে! করতে পারলে ভালো হবে।”
এর পরদিন আমি ৩৫ টাকা সাথে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নারায়ণগঞ্জ গেলাম কাঁচা বাদাম আনতে। ২০ টাকা দিয়ে ৪ সের কাঁচা বাদাম কিনলাম। ছোট দাঁড়িপাল্লা-সহ প্রয়োজনীয় বাটখারাও কিনে আনলাম। মাকে বললাম, বাদামগুলো ভেজে দিতে। আমার মা তো আগেই মূড়ি ভাজার ওস্তাদ ছিলেন। তাই কীভাবে বাদাম ভাজতে হবে, তা আর মাকে কিছুই বলতে হয়নি। মা বালুর সাহায্যে খুব সুন্দরভাবে বাদাম গুলো ভাজলেন। আমি পরদিন বিকালবেলা একটা মুড়ির টিনে করে বাদাম নিয়ে মিলের গেইটে গিয়ে বসলাম, বিক্রি করার জন্য।
সেসময় আদর্শ কটন মিলের গেইটের সামনে আর কেউ বাদাম বিক্রি করতো না। গেইটের সামনে আমিই ছিলাম একমাত্র বাদামওয়ালা। মায়ের হাতে ভাজা বাদাম গুলো ১০ টাকা সের দামে, আধা ছটাক, এক ছটাক, আধা পোয়া, একপোয়া করে মুহূর্তে সব বাদাম শেষ করে ফেললাম। লাভ হলো ১০-১২ টাকার মতো। পরদিন সকালে আবার কাঁচা বাদাম আনতে চলে গেলাম নারায়ণগঞ্জ। এদিন কাঁচা বাদাম আনলাম ৫ সের। সেগুলো ভেজে আগের দিনের মতো বিকালবেলা আবার মিল গেইটের সামনে গিয়ে বসলাম। এদিনও সব বাদাম বিক্রি করলাম।
এভাবে প্রতিদিন সকালবেলা আমি নারায়ণগঞ্জ পায়ে হেঁটে যেতাম, আবার বাদাম মাথায় করে পায়ে হেঁটে বাসায় আসতাম। আমার এরকম কষ্ট দেখে একদিন আমার বড়দাদা আমাকে ৫০ টাকা হাতে দিলেন, বেশি করে বাদাম আনার জন্য। যাতে প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ যেতে না হয়। তা-ই করলাম। বড় দাদার দেওয়া ৫০টাকা আর আমার কাছে থাকা কিছু টাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে একসাথে ২০ সের (আধা মণ) কাঁচা বাদাম কিনে আনলাম। এতে অন্তত ৫/৬ দিন নারায়ণগঞ্জ যাওয়া-আসার ভেজাল শেষ করলাম।
প্রতিদিন ৪-৫ সের বাদাম মিল গেইটে নগদে বাকিতে মিলিয়ে বিক্রি করতাম। বিক্রি করে যা পেতাম, সব মায়ের কাছে এনে দিতাম। লাভের টাকা থেকে মা কিছু সংসারেও খরচ করতো। টুকটাক বাবার ঔষধ কিনে আনতো। মায়ের পান-সুপারি আনতো। আমি মাঝে-মধ্যে স্কুলে যাওয়া সময় আমাকেও চার আনা, আট আনা দিতো। সেসময় এভাবেই চলতে থাকলো আমাদের দুর্ভিক্ষের সংসার।
তখন আমাদের দুর্ভিক্ষপীড়িত সংসারের দায়িত্ব যেন বড় দাদার সাথে আমার উপরেও বর্তাল। আমি তখন মাঝে-মধ্যে স্কুলে যেতাম। বাবাকে নিয়ে চিত্তরঞ্জন কটন মিলেও যাতাম। আবার প্রতিদিন বিকালবেলা শ্রমিকদের ছুটি হবার আগেই মিল গেইটে বাদামের টিন নিয়ে বসে থাকতাম। বাদাম বিক্রি শেষে আবার সময়তে সন্ধ্যার পর ওই ডেলি লেবারদের সাথেও কাজ করতাম। তবু্ও আমরা দুই ভাই-সহ আমাদের ৯ সদস্যের সংসারে অসুস্থ বাবাকে নিয়ে কোনো-কোনো সময় দিন রাতে কিম্বা সকালে দুপুরে না খেয়েই থাকতাম। তবুও লেখাপড়া চালিয়ে যাবার ইচ্ছেটা মনের ভেতরের পুষিয়ে রাখতাম। কিন্তু না পারিনি। অভাব অনটনের কাছে আমি হেরেই গেলাম।
জীবন যুদ্ধের এমন লড়াই পড়লে আমি অশ্রু সিক্ত হই।
ভালো থাকুন মি. নিতাই বাবু। আশীর্বাদ রাখি।
গল্প নয়, জীবনের সত্য ঘটনা দাদা। সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে নীরবে কাঁদি!
শুভমাকনা থাকলো।
Very sad
Best wishes
সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, প্রিয় দাদা।