আজ ইরাবতীর বিয়ে

রুহিলা বেগমকে আজ সকাল থেকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। তার মুখের ভাব ফ্যাকাসে, ব্লাড প্রেসার লো হয়ে গেছে। এর প্রধান কারন আজ তার একমাত্র মেয়ে ইরার বিয়ে। মেয়ের বিয়েতে মায়েরা বোধ হয় একটু বেশী উদ্বিগ্ন থাকেন। রুহিলার বেলাতেও সেটির ব্যতিক্রম হচ্ছে না। তার চিন্তার আরেকটি কারন আছে তা হল ফয়সালকে চিলেকোটার রুমে আটকে রাখা হয়েছে। অন্য আট-দশটি বিয়ের মত এই বিয়ে নয়। খুব সাধারন পারিবারিক ভাবে ইরার বিয়ে হচ্ছে। সকাল থেকে রুহিলা বেগম রান্নাঘর থেকে বের হয়নি। এক হাতে তিনি সব সামাল দিয়ে যাচ্ছেন। তার কাছে আজ যেন সব কিছু নতুন লাগছে। তিনি মনে মনে ভাবলেন ইরার রুমে গিয়ে একবার দেখে আসা উচিৎ সে কি করছে। ইরার রুমে যাবার সময় রুহিলা বেগম বারান্দায় একবার উকি দিলেন, ইরার বাবা ওসমান সাহেব বারান্দায় বসে এক হাতে সিগারেট, অন্য হাতে খবরের কাগজ ধরে আছেন। দীর্ঘ ৩৫ বছর তিনি সেনাবাহিনীতে চাকুরী করেছেন। এ বাড়ীর সবাই তাকে ভয় পায়। ওসমান সাহেব সব সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পছন্দ করেন। ইরার বিয়েটা তিনি নিজে ঠিক করেছেন কারো সাথে পরামর্শ করেননি। তার ধারনা মেয়ে মানুষের সাথে পরামর্শ করা অহেতুক বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। গত সপ্তাহে রাতের খাবার খেতে খেতে ওসমান সাহেব বললেন, ইরাবতী – আমি তোমাকে এবং তোমার মাকে না জানিয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইরা বুঝতে পারছে তার বাবা তাকে কঠিন কিছু বলবেন কারন তিনি ইরা থেকে ইরাবতীতে চলে গেছেন। কঠিন কিছু কথা বলার আগে তিনি মানুষের পুরো নাম ধরে ডাকেন। যেমন-তাদের বাড়ীর কাজের লোক সামাদের উপর রাগ হলে তিনি তাকে ‘আব্দুল সামাদ হাওলাদার’ বলে ডাকেন। ইরা তার বাবাকে বুঝতে পারে। ইরার মনে করে তার বাবা খুব সহজ-সরল কিন্তু সে রাগী রাগী মুখ নিয়ে বসে থাকতে পছন্দ করেন।
ইরা খুব স্বাভাবিক বলল- বাবা তোমার সিদ্ধান্তের কথা আমি জানি। তুমি আমার বিয়ে ঠিক করেছ। তাই তো? এবং এও জানি আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে।
ওসমান সাহেব আর কিছু বললেন না, চোখ-মুখ শক্ত করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

রুহিলা বেগম মেয়ের ঘরে ঢুকে খানিকটা আবাক হলেন। দিনের বেলা পুরো ঘর অন্ধকার। ইরা দরজা-জানলা, লাইট-ফ্যান বন্ধ করে শুয়ে আছে। মাকে দেখে ইরা স্বাভাবিক ভাবে বলল- লাইট জ্বালাবে না মা। যা বলতে চাও, বলে চলে যাও।
রুহিলা বেগমের খানিকটা মন খারাপ হল। এ বাড়ী সবাই তার সাথে কেমন যেন আস্বাভাবিক আচরন করে। বিশেষ করে ইরা দিন দিন কেমন যেন ওর বাবার মত হয়ে যাচ্ছে। রাগী রাগী ভাব নিয়ে কথা বলে। ইরা আবার বলল- মা, তুমি কি কিছু বলতে চাও?
-ইরা, তুই চাস তোর বাবা আবার স্ট্রোক করুক।
-তুমি এই কথা বলার জন্য এসেছ। তার আগে বলো ফয়সাল কি পাগল?
-পাগল হবে কেন? এ কি কথা বলছিস?
-তাহলে বাবা কেন তাকে চিলেকোটার রুমে আটকে রেখেছে? আমিতো তোমাদের সব কথা মেনে নিয়েছি।
-কেন আটকে রেখেছে সেটা তুই ভাল করেই জানিস। তোর বাবা চায় না তোর বিয়েতে কোন ঝামেলা হোক। আমি এত কিছু শুনতে চাইনা তাড়াতাডি উঠে তৈরী হয়ে নে, বর পক্ষ এখনি চলে আসবে।
ইরা আরো কিছু বলতে পারতো কিন্তু রুহিলা বেগম সে সুযোগ তাকে না দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন।

বিকেল ৫টা। ওসমান সাহেব ড্রয়িং রুমে বসে আছেন। তার সামনের বর পক্ষ বসা। ওসমান সাহেব হাসি হাসি মুখ রাখার চেষ্টা করছেন কিন্তু তা সহজ হচ্ছে না কারন তিনি তরতর করে ঘামাচ্ছেন। ইতিমধ্যে কাজী সাহেব চলে এসেছেন। ওসমান সাহেব হাক ছেড়ে ডাকলেন- আব্দুল সামাদ হাওলাদার ! সামাদ ছুটে এসে বলল- জে স্যার ,আমারে বুলাইছেন ?
-তোর চাচী আম্মারে বল ইরাবতীকে জলদি নিয়ে আসতে।
সামাদ যাওয়ার আগেই রুহিলা বেগম ইরাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন। ওসমান সাহেব ইরার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, তার মেয়ে যে এত সুন্দর তা আগে কখনো লক্ষ্য করেনি, লাল শাড়ীতে ইরাকে দেখতে পরীর মত লাগছে। ওসমান সাহেবর বুকের মধ্যে ধরফর করে উঠলো তিনি কোন ভাবে ভাবতেই পারেন না এত সুন্দর মেয়েকে কোন এক জানোয়ার কষ্ট দিয়েছে না হলে আজ এই দিন দেখতে হত না, চুপচাপ এভাবে বিয়ে দিতে হত না।
কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করেছেন। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে সব কিছু ঠিকঠাক ভাবে সম্পূর্ন হয়ে গেল। বিদায় বেলায় ইরা কারো সাথে কোন কথা বলল না স্বাভাবিক ভাবে গাড়ীতে উঠে গেল। ওসমান সাহেব রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়ের চলে যাওয়া দেখতে লাগলেন, তার কাছে সব কিছু স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে, তবে তার ঘোর কাটল রুহিলার চিৎকার শুনে! ইরা চলে যাবার পর রুহিলা আকাশ ফাঁটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল- আমার মেয়ে কোন অপরাধ করেনি, আপনি কেন তাকে এভাবে বিয়ে দিলেন? সে যাবার সময় কারো সাথে একটি কথাও বলল না, আপনার কি একটু খারাপ লাগলো না? আপনি এত পাষান বাবা? ওসমান সাহেব কোন কথা বলতে পারলেন না। চুপচাপ বাড়ীর ভেতরে চলে এসে ডাক দিলেন- সামাদ ! চিলেকোঠা রুমের চাবিটা নিয়ে আয়। সামাদ দৌড়ে চাবি নিয়ে এল। সামাদের হাত থেকে চাবি নিয়ে ওসমান সাহেব তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন।
ওসমান সাহেব চিলেকোঠা রুমের সামনে দাড়িয়ে আছেন তার হাত কাঁপছে, মনে হচ্ছে তিনি তালা খুললে পারবেন না। অনেকক্ষন যাবত চেষ্টা করার পর ঘট ঘট শব্দে তালা খুলে গেল, শব্দ শুনে ভেতর থাকা ৪ বছর বয়সী ফয়সালের ঘুম ভেঙে গেল, গুটি গুটি পায়ে সে দরজার কাছে এগিয়ে এল, কাছে যেতে ওসমান সাহেব তাকে তাকে কোলে তুলে নিলেন।
ফয়সাল কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞাসা করে- মা কোথায়, নানাজান? আমাকে মার কাছে নিয়ে চল। আমি মার কাছে যাব।
-তোমার মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বলতেই ওসমান সাহেবের গলা জড়িয়ে আসে। হুঁ হুঁ করে কেঁদে ওঠে ।
ফয়সাল কিছুতেই বুঝতে পারে না শুধু নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নানাজানের চোখের দিকে।

লেখাটি উৎসর্গ করলাম –
তাহসিন বিনতে উমর।
খুব কাছের অপরিচিত একজন মানুষ।

পবিত্র হোসাইন সম্পর্কে

মাঝে মাঝে নিজেকে আঠেরো শতাব্দীর অঘোষিত, সাফল্যহীন কবি মনে হয়। যার কিছু লেখা নামহীন বাজারি পত্রিকায় ছাপা হয়ে ছিল কিন্তু কেউ তা পড়ে দেখিনি।

19 thoughts on “আজ ইরাবতীর বিয়ে

  1. অসাধারণ একটি পড়লাম পবিত্র হোসাইন ভাই। তবে গল্পের শেষ প্রান্তে না এলে ফয়সাল এর ব্যাপারটা জানা হতো না। 

    1.  প্রিয় সুমনদা গল্পটা পড়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  2. তাহসিন বিনতে উমরকে শুভেচ্ছা জানাই। তিনি চমৎকার একটি গল্প উপহার পেয়েছেন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    1. আপনার ভালো লেগেছে জেনে মনের মধ্যে শান্তি লাগছে

  3. সুন্দর অণুগল্প। ভালোবাসা পবিত্র হোসাইন ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  4. ওসমান সাহেব এর উপর রাগ হলেও গল্পের আবহে সেটা মেনে নিতেই হলো।

    1. ওসমান সাহেব যে নিরুপায় , সমাজের বেড়াজালে বাধা

  5. মানুষ নিরুপায় হয়ে অনেককিছুই করতে বাধ্য হয়। যাকে বলে সমাজের বেড়াজাল।    

    1. একদম খাঁটি কথা বলেছেন দাদা, মানুষ নিরুপায় হয়ে অনেককিছুই করতে বাধ্য হয়।

      মানুষের জীবন বড়ই বিচিত্র ! 

      -মন্তব্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ

    1. আছি তো প্রতিক্রিয়া ভাই , 

      আপনাকে তো পাই না 

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।