পবিত্র হোসাইন এর সকল পোস্ট

পবিত্র হোসাইন সম্পর্কে

মাঝে মাঝে নিজেকে আঠেরো শতাব্দীর অঘোষিত, সাফল্যহীন কবি মনে হয়। যার কিছু লেখা নামহীন বাজারি পত্রিকায় ছাপা হয়ে ছিল কিন্তু কেউ তা পড়ে দেখিনি।

হঠাৎ সন্ধ্যা (৫ম পর্ব )

new-1

বরাবরের মত সেদিনও খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম। কলপাড়ে মুখ ধুতে গিয়ে দেখি বাবা উঠানে দাঁড়িয়ে কাদের চাচার সাথে কথা বলছেন। কাদের চাচা পেশায় একজন বাবুচি। তার রান্নার সুনাম আশে পাশে ১০ মহল্লা পর্যন্ত আছে। লোকে বলে তার কাছে চারটি জ্বিন আছে। বড় কোন অনুষ্ঠানে জ্বিনদের রান্নার দায়িত্ব পরে। জ্বিনদের মধ্যে একজন আবার অন্ধ। সেই অন্ধ জ্বিনের মাংসের রেজেলা নাকি বেহেস্তের খাবারকেও হার মানায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হল সে মাংসের রেজালা কখনো কেউ খেয়ে দেখেনি। রান্না করতে বললে কাদের চাচা মাথা নিচু করে বলে- আইজ রান্না করা জাইবো না, আইজ একটু সমস্যা আছে!
বাবা উঁচু আওয়াজে কাদের চাচার সাখে কথা বলতে লাগলেন। এমন সময় মোতালেব আংকেল তাদের সাথে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমাকে দেখে দূর থেকে হাত উঁচিয়ে ডাকলেন। অন্য সময় মোতালেব আংকেল ডাকলে সাড়া দেই না। কিন্তু এখন বাবা সাথে আছেন না গিয়ে উপায় নেই। কাছে যেতেই মোতালেব আংকেল দাঁত বের করে বললেন-কেমন আছ ইরা?
-জ্বি, ভাল।
-তোমার কি মন খারাপ?
-জ্বি না।
-তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে মন খারাপ। যাই হোক বিয়ের দিন মেয়েদের মন খারাপ করে থাকতে হয় না। এতে অমঙ্গল হয়। চেষ্টা কবরে সব সময় হাসি-খুশি থাকতে। সবার সাথে নিজে থেকে কথা বলতে। ঠিক আছে?
মোতালেব আংকেলের কথা শুনে আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। শরীর জুড়ে জ্বরের স্রোত বয়ে গেল। মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো। গলা শুকিয়ে গেল। এমন সময় বাবা ফের চেঁচিয়ে বললেন-দাঁড়িয়ে মূর্তি হয়ে গেছিস? মুখ দিয়ে কথা বের হয় না? একটা মানুষ কিছু বলছেন সেদিকে কোন খেয়াল নেই, উনি মূর্তি মানবী হয়ে গেছেন। মেয়ে গুলো কোন ভদ্রতা শেখেনি। যা ভেতরে যা, গিয়ে তোর মাকে চা দিতে বল। এক ঘন্টা আগে চা চেয়েছি। তারও মুখে বন্ধ।
আমি দ্রুত সেখান থেকে রান্না ঘরের দিকে গেলাম। রান্না ঘরে ঢুকে দেখি মা মশলা বাটছে। আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন-ইরা, চুলার উপরে গরম চা আছে কাপে ঢেলে বাবাকে দিয়ে আয়। আমি মায়ের কথা অনাগ্রহ করে এক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি জানি মা আমার সাথে চোখ মেলাতে পারছেন না। তবুও আমি মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না।সকল না বলা কথা কন্ঠে আটকে গেল।

আজকাল বড় চাচা সারাদিন বই নিয়ে ব্যাস্ত থাকেন। আশে পাশে কি ঘটছে তা নিয়ে খবর রাখেন না। সারাদিন নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখেন। আমি বড় চাচার ঘরে ঢুকে দেখি তিনি চেয়ারে বসে বই পড়ছেন। আমাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে গেলেন। আমতা আমতা করে বলতে লাগলেন-তুই! তুই কখন এলি? কোথায় ছিলি এতোদিন? আমি হতাশ গলায় বললাম-বড় চাচা, আমি ইরা! মীরা নই। তুমি আজকাল এই ভুলটা খুব বেশী করছ। আমাকে মীরা মনে করছো। মীরা আপা চলে গেছে ১০ বছর হয়েছে। বড় চাচা চশমা খুলতে খুলতে বললেন-তুই দিন দিন একদম মীরার মত হয়ে যাচ্ছিস। তোর আর মীরার চেহরা একই রকম, দেখে বুঝা যায় না কে ইরা, কে মীরা? আচ্ছা বাদ দে, কিছু বলবি না হলে পরে আসিস আমি এখন খুব ইমপরটেন্ট একটা বই পড়ছি।
-বড় চাচা, আমিও তোমার সাথে জরুরী একটা কথা বলার জন্য এসেছি।
-বল, তোকে ২ মিনিট টাইম দেয়া হলো। ২ মিনিটের মধ্যে কথা শেষ করে চলে যা।
-তুমি কি জানো আজ আমার বিয়ে?
-জানি।
-তাহলে কার সাথে বিয়ে সেটাও জানো?
-জানি
-জানি, জানি, করবে না! কার সাথে বিয়ে সেটা অন্তত বলো?
-কেন, তোর পাগল বাপ তোকে বলেনি।
-না।
-তোকে বিয়ের কথা কে বললো?
-মোতালেব আংকেল।
-তাহলে তাকে গিয়েই জিজ্ঞাসা কর কার সাথে বিয়ে?
এ পর্যায়ে বড় চাচা বই বন্ধ করে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন। আমার সামনে এসে বললেন-তোর বাপ সারাজীবন আমার কথা শোনেনি। তার পাগলামিতে আমি অতিষ্ট। সে কখন কি করে সে নিজেও জানে না। দুই-তিন দিন আগে আমার ঘরে এসে বলল-ভাইজান, ইরার বিয়ের পাকা কথা বলে আসলাম। ছেলের বাপ মস্তবড় ব্যবসায়ী, নাম আসলাম তালুকদার। রায়পুরে বাড়ী, বাজারে অনেক গুলো দোকান আছে। টাকার কুমির। আমি বললাম-ভাল করেছিস। দেখে শুনে তুইও একটা বিয়ে করে নে। এ কথা শুনে সে চুপচাপ ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। আমি জানি তোর বাপ এখন তোর বিয়ে নিয়ে পরেছে তাকে কেউ আটকাতে পারবে না। আমি দোয়া করি তুই সুখী হ বলেই বড় চাচার গলা ধরে এলো। তিনি মাথা নিচু করে ফেললেন, চোখ দিয়ে টপ টপ পানি পরতে লাগলো। আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে মাটিতে বসে বড় চাচার পা জড়িয়ে ধরলাম। হাউমাউ কেদেঁ ফেললাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগলাম-আমাকে বাঁচাও বড় চাচা, আমি মরে যাব, আমাকে বিয়ে দিও না, কিছু একটা করো! আমাকে বাঁচাও! বড় চাচা আমার মাথায় হাত রাখলেন। ভেজা গলায় বলতে লাগলেন-চলে যা, তোর দুই মিনিট শেষ, এক্ষুনি বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে।

চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে দেখি মা আমার ঘরে বসে আছে। তার হাতে নিজের বিয়ের পুরাতন শাড়ী সাথে কিছু রুপার গহনা। আমাকে দেখে বলতে লাগলেন-তারাতারি গোসল করে শাড়ীটা পরে নে। সময় মত রেডি না হলে তোর বাবা হুল্লো করবে। দেরি করিস না। আমি মায়ের হাত থেকে শাড়ীটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন।

আট-দশটা বিয়ের মতো এ বিয়ে নয়। কোন ধুম-ধাম নেই, নেই কোন সানাইয়ের সুর। হৈই-হৈলো, বিয়ে বাড়ীর আমেজ কিছুই নেই।পাশের বাড়ীর মিতা দিদি আর পাড়ার কিছু মুরুব্বি ছাড়া কোন আত্নীয়-স্বজন চোখে পরলো না। সব কিছুর মূলে ছিল বাবা অর্থনৈতিক সমস্যা। এই বাড়ী ছাড়া বাবার হাতে আর কিছুই নেই। সব মদ খেয়ে শেষ করেছেন। শেষ সম্বল বাড়ীটাও বিক্রি করবেন আমি চলে যাবার পর। মিতা দিদি মীরা আপার বান্ধুবী ছিলেন। স্বামী মারা যাবার পর একমাত্র ছেলের হাত ধরে ফের বাপের বাড়ী চলে আসেন।পরিচিত মহিলাদের মধ্যে তিনিই এক মাত্র আমার বিয়েতে এসেছেন। ঘরে ঢুকেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু খেয়ে বললেন তোর কপালটা অনেক ভালরে অনেক বড় ঘরে বিয়ে হচ্ছে। সবাই অনেক ভাল। তোকে অনেক পছন্দ হয়েছে। আমি মৃদু হেসে বললাম-তুমি কিভাবে জানলে? তারাতো আমাকে দেখেইনি।
-সেকি বলছিস? কদিন আগেই তো তোকে দেখে গেল। তোর মনে নেই, মীরার কথা শুনে যারা চলে গিয়েছিল তারাই আবার তোকে নেবার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছে। ছেলে তোকে খুব পছন্দ করেছে। তোকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে রাজি নয়।
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। মিতা দিদি একা ধারে কথা বলে চললো। বাদ যোহর বরপক্ষ চলে এলো। মোতালেব আংকেল সবাইকে নিয়ে ঘরে বসালেন। বাবা খুব শান্ত থাকার চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। চেচিঁয়ে মাকে বলতে লাগলেন-এতোক্ষন লাগে? তারাতারি ইরাকে নিয়ে আসো। বরপক্ষ কি রাতে থাকতে এসেছে? বিয়ে করে নিয়ে চলে যাবে।
মিতা দিদি আমার মাথায় আঁচল তুলে দিয়ে সকলের সামনে নিয়ে গেল। চেয়ার টেনে বরের সামনে বাসাতেই জাকির মাস্তান দরজা দিয়ে ঢুকলেন। জাকির মাস্তানকে দেখে বাবা উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন-বাবা জাকির, কাজী.. কাজী সাহেব কোথায়?

(চলবে)

সেপাই সেপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই!

zia

১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাস। ক্যান্টনমেন্ট জুড়ে উত্তাল হাওয়া বইছে। সিপাহীরা বিদ্রোহ করছে। তবে তাদের দাবী স্পষ্ট নয়। একটু পর পর আকাশে গুলি ছোরা হচ্ছে। পরিস্থিতি কোন যাচ্ছে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে মেজর জিয়াকে বন্দি করা হয়েছে। বেগম জিয়া ব্যাকুল হয়ে বার বার জেনারেল ওসমানীকে ফোন করতে লাগলেন। তার একটি কথা স্পষ্ট-স্যার, আমার স্বামীকে নিরাপত্তা দিন! তাকে ছাড়াবার ব্যবস্থা করুন। আমি কথা দিচ্ছি, আমার স্বামী, ছেলেদের নিয়ে গ্রামে চলে যাব। আপনি কিছু একটা করুন। জেনারেল ওসমানি কর্নেল তাহেরকে ফোন করে মেজর জিয়াকে ছড়াবার ব্যবস্থা করতে বললেন। কর্নেল তাহের ছিলেন মেজর জিয়ার ঘনিষ্ট বন্ধু। শুধু বন্ধু নন তারা ছিলেন সহযোদ্ধা। কর্নেল তাহের গাড়ী নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে রওনা হলেন। তার গাড়ী ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে যেতেই সকল সৈনিক তার সাথে যুক্ত হল। সৈনিকরা ছিল কর্নেল তাহেরের পক্ষে। তারা কর্নেল তাহেরকে দেখে অতি উৎসাহী হয়ে পড়লো। কর্নেল তাহের সিপাহীদের উদ্দেশ্য সংক্ষিপ্ত ভাষান দিতে গিয়ে বললেন-প্রিয় ভাইয়েরা আমার, আপনারা জানেন, দেশ আজ স্বৈরাচারীদের দখলে, অফিসাররা সৈনিকদের লাশের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। আমরা কখনো তা হতে দিব না। মেজর জিয়াকে অন্যায় ভাবে জেলে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাকে বেআইনি ভাবে রিটায়ার্ড করানো হয়েছে। আমরা তাকে মুক্ত করে আমাদের অধিকার আদায় করবো। মেজর খালেদ মোশারফ দেশে ফের ভারতীয় সেনাদের প্রতিষ্ঠা করতে চায় আমরা কখনো তা হতে দিব না।
কর্নেল তাহেরের এ বক্তব্যে সৈনিকরা রোশে ফেটে পড়লেন। তারা আকাশ ফাটিয়ে স্লোগান দিতে লাগলেন-
“সেপাই সেপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই!… সেপাই সেপাই ভাই ভাই
সুবেদাররের ওপরে অফিসার নাই”।

সেদিন কর্নেল তাহেরের নির্দেশে সৈনিকরা অফিসারদের খুন করতে লাগলেন। সেনাবাহনীর শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ রুপে ভেঙে গেল। সিপাহীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য অফিসাররা পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন। জাতি চুপচাপ দেখতে লাগলো এক নারকীয় অধ্যায়।

মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ (বীর উত্তম) অফিসার মেসে বসে আছেন। তার চোখে কালো চশমা, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। মেজর খালেদকে খুব একটা বিচলিত মনে হচ্ছে না। এমন সময় মেজর হুদা এবং মেজর হায়দার এলেন। কিছু সময় মেজর খালেদের দিকে তাকিয়ে বললেন-স্যার কিছু একটা করুন। পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে খারাপ। আপনি মেজর জিয়াকে ছেড়ে দেবার নির্দেশ দিন।
খালেদ মোশারফ সিগারেট টানতে টানতে বললেন-তোমরা কি জানো? বঙ্গবন্ধুর খুনি কে?
– জ্বি স্যার! জানি।
– তোমরা কি জানো দেশে কারা অশান্তি সৃষ্টি করছে?
– জ্বি স্যার! জানি।
– তাহলে তোমরা কেন আমাকে খুনিদের সামনে মাথা নত করতে বলছো? একজন সৈনিক কখনোই খুনিদের সামনে মাথানত করতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর খুনি মোশতাক, ডালিম, ফারুক এবং রশিদকে আমি দেশ ছাড়া করেছি। এখন জিয়ার পালা। জিয়াকে আমি হাতির আট পা দেখাবো।

এমন সময় স্টেনগান হাতে নিয়ে দুজন ব্যক্তি অফিসার মেসে ঢুকলেন। তারা হলেন ক্যাপ্টেন আসাদ, ক্যাপ্টেন জলিল। তারা স্টেনগান খালেদ মোশারফের দিকে তাক করলেন। খালেদ মোশারফ ক্যাপ্টেনদের দিকে তাকিয়ে বললেন- তোরা আমাকে খুন করতে চাস? আমি যুদ্ধের মাঠে নিজের জীবনকে বাজি রেখে তোদের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছি। তোরা কি ভুলে গেছিস? ক্যাপ্টেনরা একে অপরের মুখে দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলেন। তাদের মুখ শুকিয়ে গেল। হঠাৎ এমন সময় বাইরের থেকে কেউ একজন এসে বললেন-শ্যুট দেম! তার কমান্ড শুনে ক্যাপ্টন আসাদ এবং ক্যাপ্টন জলিল স্টেনগান চালাতে লাগলেন। সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন দেশের তিন সূর্য্য সন্তান। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল চারিদিক।

মেজর খালেদ মোশারফের হত্যার মাধ্যমে দেশের জঘন্যতম সিপাহী বিদ্রোহ শেষ হলো। কর্নেল তাহের মেজর জিয়াকে মুক্ত করে আনলেন। মুক্ত হবার পর মেজর জিয়া কর্নেল তাহেরকে জড়িয়ে ধরলেন, আবেগের সাথে বললেন, আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু নও তুমি আমার আপন ভাই। তোমার এ উপকার আমি কখনো ভুলবো না।

ছাড়া পাবার পর মেজর জিয়া ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে আসেন। সে সময় সিপাহী বিদ্রোহীদের বিচারের দায়িত্ব নেন। মেজর জিয়া এই বিচারের নামে প্রথমেই তিনি কর্নেল তাহেরকে গ্রেফতার করেন। নির্বাচিত সরকার উৎখাত, সেনাবাহিনীতে উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত কারার দায়ে কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পত্রে মেজর জিয়া সাক্ষর করেন। বিচারে ২১ জুলাই, ১৯৭৬ মেজর জিয়ার আদেশে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হয়।

হঠাৎ সন্ধ্যা (৪র্থ পর্ব )

eted-2

না, সেদিন সন্ধ্যায় জাকির মাস্তান আমাকে তুলি নিতে আসেনি। বরং সেদিন তার উপকারের কথা ভুলবার মত নয়। বাবা মদ খেয়ে বাড়ী ফিরছিলেন। বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে ডান হাত ভঙ্গে নেন। জাকির মাস্তান তাকে দেখে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে মোটর সাইকেলে বাড়ীতে নিয়ে আসেন। তাই সেদিন দরজায় দাঁড়িয়ে জাকির মাস্তানকে দেখে যতটা ভয় পেয়েছি তার চেয়ে বেশী আতংকিত হয়েছি বাবার ভাঙ্গা হাত দেখে। ভাঙ্গা হাত নিয়ে বাবা ঘরে ঢুকতেই চেঁচাতে লাগলেন- কই মরছিলি? দরজা খুলতে এতক্ষণ লাগে? ঘরে বসে বসে কি করিস? পিড়িত করিস? বেশী পিড়িত ভাল না। একটা পিড়িত করে পালিয়েছে। আরেকটার সুর উঠেছে।

আমার খেয়াল রাখিস? আজ জাকির না থাকলে কি হত সে চিন্তা আছে? জাকিরকে ঘরে নিয়ে যা, বসতে দে, চা, পানির ব্যবস্থা কর। আমি আসছি বলেই বাবা চিলেকোঠার দিকে রওনা হলেন। তার রোগ-কষ্ট এখন একটি মানুষ ঠিক করতে পারবেন সে হল মোতালেব আংকেল। বাবার কাছে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এক পাশে এবং মোতালেব আংকেল অন্যপাশে। তার হোমিও বিদ্যার যাদু না পেলে বাবা এখন ঠিক হবেন না।

আমি জাকির মাস্তানের দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বললাম- জাকির ভাই, ভেতরে আসুন। একটা গামছা দিচ্ছি মাথা মুছে ফেলুন। এ কথা শুনে সে মাথা নিচু করে বললো-আমি ঠিক আছি ইরা, আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।
– জাকির ভাই, আপনাকে নিয়ে কেউ ভাবছে না। বাবা আপনাকে বসতে বলেছে তাই ভেতরে এসে বসুন আমি চা নিয়ে আসছি। আমার কথা শুনে জাকির মাস্তান বাধ্য ছেলের মত ঘরে এসে বসলেন। ইনিয়ে বিনয়ে বলতে লাগলেন -আমি খুব লজ্জিত ইরা, সেদিনের কাজটি আমার মোটেও উচিৎ হয়নি। আমি কিছুক্ষণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, না বোঝার ভঙ্গিতে বললাম কোন কাজটির জন্য লজ্জিত?
জাকির মাস্তান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন-ওই যে, সেদিন তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছি! বিশ্বাস করো আসলে আমার কোন বাজে উদ্দেশ্য ছিল না। মজা করতেই চিঠিটা দেয়া।
– আচ্ছা, তার মানে আপনি আমাকে ভালবাসেন না! মজা করতেই চিঠি দিয়েছেন?
– না, তা নয়। তুমি ভুল বুঝছো!
– আপনি কি ঠিক বুঝছেন? আপনার এই ঠিক বুঝার জন্য আমার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?
– আমি না হয় তোমার বাবাকে বুঝিয়ে বলবো।
– আপনাকে কিছুই করতে হবে না। আমার মনে হয় না সে এসব কিছু মনে রেখেছেন! নেশাগ্রস্ত মানুষ কোন কিছু মনে রাখেন না। যে কাউকে যখন তখন বন্ধু বানিয়ে ফেলে। যাই হোক, আপনার চায়ে কয় চামচ চিনি দিব?
আমার কথা শুনে জাকির মাস্তান আরো কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু বললেন না, নিরীহের মত তাকিয়ে রইলেন। আমিও আর কোন কথা না বলে রান্না ঘরে চলে এলাম।

মানুষ বড়ই অদ্ভুদ প্রাণী। উপরে দেখতে যেমন ভেতরে তেমন নয়। কয়েক বছর আগে দোকানদার বাচ্চু মারা যাবার পর কিছু মানুষ বাচ্চুর দোকানে লুট চালায়। মানুষ দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে থাকে, সেদিন কেউ এগিয়ে না আসলেও এগিয়ে আসে জাকির মাস্তান, পিটিয়ে ব্যাঙ বানিয়ে দেয় সব গুলোকে। মার খেয়ে লোক গুলো কোয়াক কোয়াক শব্দ করতে থাকে। সেদিনের পর থেকে জাকিরের নামের পাশে মাস্তান টাইটেল বসে যায়। তাছাড়া জাকির মাস্তান সম্পর্কে আরো কিছু শোনা যায়। লোকে বলে নির্বাচনের দিন জাকির মাস্তান নাকি চেয়ারম্যানকে থাপ্পর দিয়ে মুখে থেকে পান ফেলে দিয়েছে। সে নিয়ে অবশ্য চেয়ারম্যান কিছু বলেনি। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে চেয়ারম্যান বলে জাকির নটি বয়, ভেরি নটি বয়!

প্রেমে পড়ার কিছু লক্ষন থাকে। জাকির মাস্তান যে আমার প্রেমে ডুবে যাচ্ছে এটা তার চোখ থেকে বুঝা যায়। শুধু মজা করে মানুষ কাউকে প্রেমপত্র দেয় না, প্রেমপত্রে লিখে না ‘ইরা, তোমাকে দেখলে আমার বুকে ব্যাথা হয়‘ হয়তো এই ব্যাথা সারাতে জাকির মাস্তান প্রতিদিন আমাদের বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো, কলেজের যাবার সময় পিছু নিত। তার সিগারেটের উচ্চ ধৌঁয়া জানান দিত আমাকে ঘিরে তার কতো হতাশা! আমি সব কিছু বুঝতাম কিন্তু কিছু করার ছিল না। মীরা আপা যে কাজ করেছে তার পুনরাবৃত্তি ঘটা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার জীবনের এক অন্ধকার অধ্যায় আছে, আমি চাই না সে অন্ধকারে কেউ হারিয়ে যাক।

(চলবে)

পড়ুন-হঠাৎ সন্ধ্যা (৩য় পর্ব)
পড়ুন-হঠাৎ সন্ধ্যা (২য় পর্ব)
পড়ুন-হঠাৎ সন্ধ্যা (১ম পর্ব)

হঠাৎ সন্ধ্যা (৩য় পর্ব )

selected

সেদিন হঠাৎ সন্ধ্যা নেমে বসলো। আকাশ কালো করে মেঘেরা ঝুম ঝুমিয়ে গাইতে লাগলো। আচমকা বিদ্যুৎ ঝলকানি মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। মনে হয় কেউ জগৎকে আলোকিত করার বৃথা চেষ্টা করছে। এই আলো নিভুর খেলায় মীরা আপাকে খুব মনে পড়ছে। বৃষ্টির দিনে আমি আর আপা বাড়ীর পেছনে আমড়া গাছ তলায় চলে যেতাম। আঁচল ভরে আমড়া কুঁড়িয়ে আনতাম। আপার হাতে জাদু ছিল। আপা বেশী করে কাঁচা মরিচ দিয়ে আমড়া মাখাতো। আপার ঝাল ঝাল আমড়া মাখা অমৃত মনে হতো। সেই স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে। কিন্তু আজ আপা নেই, গাছটিও নেই। গাছও হয়তো মানুষের ভালবাসা বুঝে। তাই আপার মত সেও অভিমান করে চলে গেছে। যে চলে যায় সে কখনো ফেরে না। আপাও চলে গিয়েছে তার রাজকুমারের হাত ধরে হয়তো সেও ফিরবে না।

মনের শত শত কল্পনা ভেঙ্গে গেল সদর দরজার শব্দের আঘাতে। এই বৃষ্টি সন্ধ্যাবেলায় কে এলো? বাবাতো এতো আগে বাড়ী ফেরেন না। অনেক রাতে যখন মায়ের কান্নার শব্দ শোনা যায় তখন বুঝি বাবা এসেছে। আজকাল বাবা খুব রাতে বাড়ী ফেরেন। পৈতৃক ব্যবসাটা ধংস করে মদ খাওয়টা ভালই শিখেছেন। আসলে বাবা যে হোমিওপ্যাথিক বিদ্যা শিখছেন এটা তার ফলাফল। মোতালেব আংকেল যে হোমিওপ্যাথিক বিদ্যার নামে বাবাকে মদের নেশায় ডুবিয়েছেন সেটা আর কেউ না জানলেও আমি জানি। আজকাল বাবার মাতলামি সবাইকে আরোও অতিষ্ট করে তুলেছে। জানিনা মা কিভাবে সহ্য করে। তবে এজন্য আমি মাকে দোষ দেই তার অতিরিক্ত পতিভক্তি বাবাকে আরো হিংস্র করে তুলেছে। সেদিনকার ঘটনা- বাবা মদ খেয়ে অনেক রাতে বাড়ী ফিরছেন। রাস্তার কুকুরটা বাবাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো। বাবা সেখানে দাঁড়িয়ে হইচই করতে লাগলেন। বলতে লাগলেন-হারামজাদা আমার বড়ো মেয়েকে খেয়েছিস এখন আমাকে খাবি? আমি তোকে গুলি করে মারবো। এ বলেই বাবা গালি দিতে দিতে বাড়ীতে ঢুকলেন। হিংস্র হয়ে আলমারী থেকে বন্দুক বের করে আবার রাস্তায় নেমে পড়লেন। কুকুরটিকে গুলি করে মারলেন। তারপর শান্ত হয়ে হয়ে ঘরে ফিরে মাকে বললেন- মাগী একটি ছেলে জন্মাতে পারিস নাই। তোর মেয়েকে নিয়ে রাশেদ পালায়। শালাকে গুলি করে রাস্তায় ফেলে এলাম। ফের যদি তোর মেয়েকে রাশেদের সাথে দেখি ওই শালীকেও গুলি করে মারবো। বাবা এতেই চুপ রইলেন না। কথায় কথায় বন্দুক বের করতেন বলে পরের দিন আবারো বন্দুক নিয়ে হট্টগোল শুরু করলেন। বড় চাচার সামনে বন্দুক রেখে বললেন- তিনি এই পুরনো বাড়ীতে আর থাকতে চান না। বাড়ীটা বিক্রি করে একটি নতুন বাড়ী কিনতে চান। মোতালেব আংকেলের এক পরিচিত লোক বাড়ীটা কিনতে আগ্রহী সে মোটা টাকা দিতে চাচ্ছে তার কাছে বাড়ীটা বিক্রি করে নতুন বাড়ী কিনবেন। বড় চাচা তার এমন পাগলামি দেখে কিছু বললেন না। চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলেন। বাবা তখন কিছুটা হতাশ হলেও পরে লোক ডেকে বাড়ী মাপতে লাগলেন।

আমাদের বাড়ীটা অনেক পুরোনো। উঠান পেরিয়ে সদর দরজায় যেতে হয়। এই বৃষ্টি সন্ধ্যায় একা একা সদর দরজা খোলার সাহস হয় না কিন্তু আমাকে যেতে হবে। আজ দু-দিন হলো মা জ্বরে কাবু। জানি বড় চাচাকে ডাকলেও কাজ হবে না। তিনি সারাদিন নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখেন। ডাকলেও সাড়া দেন না। তাকে ডাকার বৃথা চেষ্টা না করে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সকল ভয় ভেঙ্গে দরজা খুলতেই আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। আমার সামনে জাকির মাস্তান দাঁড়িয়ে আছে।

(চলবে)

হঠাৎ সন্ধ্যা ১ম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

হঠাৎ সন্ধ্যা ২য় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

হঠাৎ সন্ধ্যা (২য় পর্ব )

selected

দেখতে দেখতে ১০ বছর হয়ে গেল মীরা আপার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এর মাঝে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। আমি কিশোরী থেকে যুবতী হয়েছি। বড় চাচার গোলাপ গাছটি ঝরে গেছে। পাড়ার জাকির মাস্তান আমাকে প্রেমপত্র দিয়েছে। মোড়ের দোকানদার বাচ্চু মারা গিয়েছে। পাত্রপক্ষ আমাকে কয়েকবার দেখতে এসেছে। হতে গিয়েও আমার বিয়েটা হয়নি। আরো কতো কিছু তা বলে শেষ করা যাবে না। তার মাঝে একটি ঘটনা আমার জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে। সে ঘটনাও সময়মত বলা হবে।

মীরা আপা চলে যাবার পর থেকে রাশেদ ভাইকেও পাওয়া যাচ্ছিল না। সবাই ধরে নিয়েছে মীরা আপা রাশেদ ভাইয়ের সাথে পালিয়েছে। এ নিয়ে বাবা কম পাগলামি করেননি। বোকা মানুষ সব কিছু নিয়ে হট্টগোল করে। বুদ্ধিমানেরা তাদের চিন্তা শক্তি দিয়ে সমস্যার সমাধান করে। বাবা পরিচিত সব জায়গায় খোঁজ করেছেন। এমনকি পীর-ফকির, কবিরাজ, সাধু- সন্যাসি কেউ বাদ যায়নি। তবু আপাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। একবার এক ফকিরকে আনা হলো। তিনি অনেক যোগ-বিয়োগ করে বললেন কোন এক জালিম মীরা আপাকে আটকে রেখেছে তাকে পেতে হলে শুক্রবার বাদ জুম্মা দুইটি কালো ছাগল জবাই করে মিসকিন খাওয়াতে হবে, বাবা তাই করলেন কিন্তু আপা ফিরে এলো না বরং পাড়ার রটে গেল মীরা আপাকে কে যেন পতিতালয়ে আটকে রেখেছে। বাবা এতেই খান্ত হলেন না মায়ের পুরোনো গয়না বিক্রি করে লাইসেন্স করা বন্দুক কিনে এনে বললেন- রাশেদ হারামজাদাকে আমি গুলি করে মারব! কত বড় সাহস আমার মেয়েকে নিয়ে পালায়!

দিন দিন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে লাগলো। আমার যেন কষ্টের অন্ত রইলো না। পাত্রপক্ষ যতবার দেখতে এসেছে আপার কথা শুনে আর এগোয়নি। আমাকে একা একা বাইরে যেতে হত। কলেজে উঠার পর জাকির নামের এক মাস্তান আমাকে প্রেমপত্র দিয়ে বসলো। কলেজের যাবার সময় সে আমার পিছু নিত। এই ঘটনা বাবা একদিন রাস্তায় দেখে ফেলল তাতে জাকির মাস্তানের কোন ক্ষতি হয়নি বরং আমার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেল। বাবা বাড়ীতে এসে হুংকার দিয়ে বললেন কাল থেকে আর কলেজে যেতে হবে না। তোর পড়াশুনা বন্ধ। একটা গেছে গোল্লায়, আরেকটা যাচ্ছে চুল্লায়! একথা শুনে সবচেয়ে খুশী হলেন যে তার নাম “মোতালেব”। আমার জীবনের কলঙ্ক অধ্যায়ের নায়ক এই মোতালেব আংকেল।

ছেলেবেলা থেকেই এই মোতালেব আংকেলকে আমি প্রচুর ভয় পেতাম। তার অশালীন কর্মকাণ্ডে অতিষ্ট ছিলাম। তার ব্যাপারে কখনো কাউকে কিছু বলতে পারিনি। এমনকি বাবাকেও না। কারন বাবার নেশা ছিল হোমিওপ্যাথিক বিদ্যা অর্জন করার। তিনি ছিলেন মোতালেব আংকেলের একমাত্র ছাত্র। বাবা তাকে পীর মানতেন। বাবা সব সময় বলতেন- মোতালেব ভাই একজন টেলেন্ট মানুষ। হোমিওপ্যাথিক বিদ্যায় তাকে টক্কর দেয় এমন কোন বাপের বেটা এখনো জন্মায়নি। তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার পীর আর আমি তার মুরিদ। হা হা হা !!! তাই বাবাকে তার সম্পর্কে কিছু বলা অর্থহীন। হয়তো মীরা আপাও কিছু বলতে পারেনি এজন্য রাশেদ ভাইয়ের হাত ধরে পালিয়েছে।

আপনাদের বলেছিলাম আমার জীবনের সবচেয়ে কালো অধ্যায়ের গল্প বলবো। সময়টা ছিল আপা চলে যাবার একমাসের মাথায়। সে সময় বাবা চরম মাত্রার পাগলামি শুরু করলেন। যখন তখন আমাকে এবং মাকে ধরে মারতেন। ভয়ে তাদের ঘরের সামনে যেতাম না। রাতে একা একা আপার রুমে ঘুমাতাম। আপার ঘরটা ছিল একেবারে শেষে দিকে। সে রাতে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল রাতে খাবার শেষ করে রুমে গিয়ে দেখি বিদ্যুৎ নেই। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। ভয়ে ভয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়তেই হঠাৎ কেউ একজন আমার মুখ চেপে ধরলো। অনেক চেষ্টা করেও তাকে ছাড়াতে পারিনি। সেই ভয়াল রাতে কথা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। আমার সর্বস্ব শেষ হয়েছিল সেই রাতে। তীব্র ব্যাথার স্রোত বয়েছিল সমস্ত শরীর জুড়ে। কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল আমি মারা যাচ্ছি। সেই রাতে আমাকে বাঁচানোর মত কেউ ছিল না। হৃদয় ভেঙে চুরমার করা বজ্রকম্পনকে থামনোর সাধ্য ছিল না করো। বিদুৎ চলে আসতেই আলোর ঝলকানিতে দেখতে পেলাম মোতালেব আংকেল মুখ। তিনি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরে আছেন। আমার স্বত্তাকে ধ্বংস কারার নেশার মেতেছেন। তার ক্ষুর্ধাত হিংস্র ভয়াল থাবা থেকে সেদিন নিজেকে মুক্ত করতে পারিনি।

(চলবে)

হঠাৎ সন্ধ্যা (১ম পর্ব) পড়তে ক্লিক করুন

হঠাৎ সন্ধ্যা (১ম পর্ব)

selec

প্রচন্ড শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। উঠে দেখি বাবা মাকে মারছেন। মেঝেতে ভাঙ্গা গ্লাসের টুকরা পড়ে আছে। মায়ের পা থেকে রক্ত ঝরচ্ছে, মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদচ্ছে। আমি দৌড়ে বড় চাচাকে ডাকতে যাচ্ছিলাম এমন সময় বাবা চেঁচিয়ে বললেন- কই যাস?
-বড় চাচার কাছে !
-এই ভরদুপুরে তাকে ডাকার দরকার কি? চিলেকোঠা থেকে মোতালেব সাহেবকে ডেকে নিয়ে আয়। সে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার।
আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠছি আর সূরা একলাস পড়ছি, এ বছর আমি যখন ক্লাস ফাইভে উঠলাম বড় চাচা আমাকে এই সূরা শিখিয়েছেন, বলেছেন- যদি কোন বিপদে আসে এই সূরাটা যেন পড়ি। আমার সামনে এখন মহাবিপদ! মোতালেব আংকেলকে ডাকতে হবে। তিনি কেমন যেন! ডাকতে গেলেই কাছে টেনে নিয়ে কোলে বসায়, আমার বুকে হাত দেয়, চুলের বেণী খুলে দেয়। একদিন সন্ধ্যায় মা বলল- খুকি যাতো মোতালেব সাহেবকে বেগুণী ভাজা গুলো দিয়ে আয়। গিয়ে দেখি মোতালেব আংকেল নগ্ন হয়ে কি যেন করছে! আমাকে দেখে সরল ভঙ্গিতে বলল- ইরা, টেবিলের উপর থেকে তেলের বোতলটা নিয়ে কাছে আয়তো, আমার এখানে একটু মালিশ করে দে। আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম- মা এখনই যেতে বলেছে আমার হোমওয়ার্ক করা হয়নি। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন- যা ভাগ, বদ মেয়ে কোথাকার! আমি কোনোমতে দৌড়ে পালালাম।

৬০ বছর বয়সী মোতালেব আংকেল বড় চাচার বন্ধু। চাচী মারা যাবার কিছুদিন পর বড় চাচা বাবাকে বললেন- মোতালেবের কেউ নেই রে…বেচারার না হল ঘর, না হল সংসার। চিলেকোঠার ঘরটা পরিষ্কার করে দে, মোতালেব এসে আমাদের সাথেই থাকুক। বিকেলে আমি, বাবা, মীরা আপা লেগে গেলাম ঘর পরিষ্কার করতে। পরদিন পুরনো একটি টাঙ্ক হাতে মোতালেব আংকেল হাজির হলেন। কালো, বেটে, টাকলা এই মানুষটি দেখে মীরা আপা চুপিচুপি আমাকে বলল- ইরা লোকটির চোখ দেখ! একটি চোখ কেমন সাদা! মনে হয় নষ্ট। আমি লোকটি চোখের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলাম! মনে হল চোখটি এখনি খোসে পরবে।

বড় চাচার গোলাপ গাছে দুটি কলি এসেছে। আমি প্রতিদিন সকালে ছাদে যাই গাছগুলো দেখতে। মীরা আপা আমাকে বলেছে কাল একটি গোলাপ চুরি করবে, তার প্রিয় একজন মানুষকে দিবে। তবে এ কথা কাউকে বলা যাবে না। এক বোনের গোপন কথা অন্য বোন কাউকে বলে দিলে তখন তারা আর বোন থাকে না। একথা মীরা আপা বলেছে। মীরা আপা এত সুন্দর করে কথা বলে! কথা বলার সময় চোখ ঘুড়িয়ে হাত নাড়িয়ে কথা বলে। কিন্তু মাঝে মাঝে কি যে হয়? সারাদিন দরজা বন্ধ করে থাকে।
প্রতি শুক্রবারে আমি আর মীরা আপা শাড়ি পড়ি, চোখে কাজল দেই, পায়ে আলতা লাগাই, মোড়ের বাচ্চুর দোকান থেকে আচার কিনে আনি। ছাদে দাঁড়িয়ে আচার খেতে খেতে মীরা আপা গুন গুন করে উঠে। তার মিষ্টি কণ্ঠে সুবাস ছড়ায়। তখন আমার কি যে ভাল লাগে মনে হয় আপাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকি।

রাশেদ ভাই আমার বড় খালার ছেলে। খালা মারা যাবার পর খালুর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি বলে রাশেদ ভাই ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে থাকেন। প্রতিদিন বিকেলে আমাকে পড়াতে আসেন। মীরা আপা কেন জানি রাশেদ ভাইকে খুবই অপছন্দ করেন। তিনি রাশেদ ভাইয়ের নাম রেখেছ “অক্টোপাস” রাশেদ ভাইয়ের চুলগুলো নাকি অক্টোপাসের মত।
সেদিনকার কথা, রাশেদ ভাই আমাকে পড়াচ্ছিলেন কোথা থেকে মীরা আপা কাঁচি হাতে এসে বললেন- অক্টোপাস ভাইয়া এখন আমি আপনার চুল কেটে দিব! আপনার কি কোন সমস্যা আছে?
রাশেদ ভাই বোকার মত বলল- না কোন সমস্যা নেই। তবে এর জন্য তোমাকে কোন টাকা দিতে পারব না। আমার কাছে কোন টাকা নেই।
মীরা আপা রেগে গিয়ে বললেন-আপনি জানেন এই চুলের জন্য আপনাকে পাগলের মত দেখায়? আপনি এখনই আমার সামনে থেকে যান সেলুন থেকে চুল কাটিয়ে আসুন।
-বললাম তো আমার কাছে টাকা নেই। তাছাড়া ওর সামনে পরীক্ষা। আমি এখন যেতে পারবো না।
-রাশেদ ভাই আপনি যদি এখনই চুল কেটে না আসেন তাহলে আপনার খবর আছে! বলেই আপা কেঁদে ফেললেন।
রাশেদ ভাই মন খারাপ করে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন। আমি আপার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
আপা চোখ মুছে আমাকে বললেন-ইরা, সিঙ্গারা খাবি?
-আপা তুমি কাঁদলে কেন?
-কই? কখন?
-আমি দেখলাম একটু আগে!
-জানিস না আমি অভিনয় শিখছি! কয়দিন পর আমার বিয়ে হবে সবাইকে কেঁদে দেখাতে হবে না?
-আপা আমি তোমাকে বুঝি না ! তুমি রাশেদ ভাইয়ের সাথে কেন এমন করো?
-তোকে বুঝতে হবে না। তুই মন দিয়ে পড়। বাবা সিঙ্গারা এনেছে আমি বড় চাচাকে দিয়ে আসি।

চিলেকোঠার দরজার সামনে অনেকক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছি। কড়া নাড়তেই মোতালেব আংকেল বেরিয়ে এলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন -কি হয়েছে রে? যৌবনের আগুনে পানি ঢালতে হবে নাকি? ভেতরে আয় আমি তোকে একটি জিনিস দেখাই।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, মায়ের পা কেটে গেছে, বাবা আপনাকে ডাকছে!
একথা শুনে তিনি অনেক মজা পেলেন হাসতে হাসতে বললেন-শুনলাম তোর বোনকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? কার সাথে পালিয়েছে? তোর বোন নাকি বেশ্যা পাড়ায় নাম লিখিয়েছে। ঠিক হয়েছে, মাগীর খুব দেমাগ ছিল। আমাকে বলে কানা বুড়া!
হঠাৎ এ কথায় আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমার তো মনেই ছিল না গতকাল কলেজে যাবার পর থেকে মীরা আপা এখন অবধি বাসায় ফেরেনি!

(চলবে)

রঙিন ভালোবাসা

আমার কপালের মাঝ বরাবর পিস্তলটা ঠেকিয়ে যখন আমার শেষ ইচ্ছাটি জানতে চাওয়া হল আমি তখন আমার মধ্যে নেই। পুরো শরীর জুড়ে বিজলীর মত ঝাকুনিতে ঘামের অনুভূতি আন্দাজ করা কঠিন হবে।

-না ! আমাকে বাঁচতে দিন, আমাকে মারবেন না।

লোকটির অদ্ভূত হাসি এবং পিস্তলের গুলির শব্দের মিশ্রণে আমি হারিয়ে যাই গভীর অতলে, শূন্য থেকে শূনে, যেখানে কোন ব্যথা নেই, নেই কোন অনূভূতি!
হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করি আধা ঘুমে আধা জাগ্রত অবস্থায়। মাঝে মাঝে আমি এমন স্বপ্ন দেখি নাক মোটা কালো বর্ণের একজন ব্যক্তি আমাকে মারতে চায় কিন্তু তার চেহারা কখন দেখতে পারি না, পুরো মুখ জুড়ে বড় নাক!

বালিশের নিচে থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখলাম রাত ৩:২৫ মিনিট কিন্তু ততক্ষণে ঘুমের ভাবটা কেটে গেছে। হঠাৎ গোসল করার তীব্র ইচ্ছে হল। যখন আমাকে কেউ বলে আপনার শখ কি? আমি নি:সন্দেহে বলি গোসল করা! বাথ ট্যাবের মধ্য বসে সিগারেটের টান দিয়ে পানিতে মুখ ডুবিয়ে ধোয়া ছাড়ার মধ্যে একটা আনন্দ আছে যদিও পানিতে ধোয়া ছাড়া যায় না তবে পানির বুদ বুদ শব্দ আমাকে আনন্দ দেয়। নাহ্ উঠে একটি সিগারেট গরম করতে হবে! সিগারেটকে হলকা আচেঁ গরম করে টানলে তামাক পাতার চির চির শব্দ সেটিও আমাকে আনন্দ দেয়। আমি সব সময় তাই করার চেষ্টা করি যা আমাকে আনন্দ দেয়। প্রতিটি মানুষের তাই করা উচিৎ যাতে সে আনন্দ পায় তবে লক্ষ্য রাখতে হবে এতে অন্যের ক্ষতি যেন না হয়।

এই মাঝ রাতে আমার সকল আনন্দের প্রস্তুতি ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট ছিল একটি ফোন কল! ফোনটা বার বার বেজে যাচ্ছে কিন্তু সেটি ধরার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই। আমি চাই না এই মুহূর্তে মোটা কণ্ঠস্বরে কাউকে হ্যালো বলতে তবে আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি তাদের জন্য মাঝ রাতের ফোন কল গুলো অনেক বিপদের সংকেত বয়ে আনে।

-হ্যালো
-(অপর পাশে নিরবতা)
-যদি কথা না বলতে চান ফোনটা রাখতে পারেন !
-১৫ মিনিটের মধ্যে নর্থ-ওয়েস্টার্ন হসপিটালে আসতে পারবে ?
-মাই গস!!! লেলিনা!!!! এতদিন পরে? তুমি ঠিক আছতো?
-হুম…
-একটু অপেক্ষা কর, আমি আসছি …

ফোন রাখার পরে আমার অবস্থা চক্রবৃদ্ধি সুদ নির্ণয়ের সূত্রের ন্যায়। যেমন : C= P(1+r)n [এখানে, C= আমি P= লেলিনা, n= সময় এবং ফোন কল, r= হাসপাতাল]

ছোটবেলা থেকে গনিত নিয়ে আমার সমস্যার কোনই অন্ত ছিল না। আজও তার কোন ব্যতিক্রম ঘটলো না, না জানি কি ঘটলো হাসপাতালে? ফলাফল জানার জন্য এখনি হাসপাতালে যেতে হবে।
(চলবে ….)

দ্বিতীয় এবং শেষ পর্ব পোস্ট করা হবে শনিবার সকালে

রাফির আন্ডারওয়ার (একটি কক্ কক্ ধর্মী গল্প)

আর মাত্র দুইদিন পর বাংলাদেশে যাচ্ছি। কয়েকদিন যাবৎ মনটা অনেক ভাল। যা করছি সব কিছুতে মজা খুঁজে পাচ্ছি। পাশের বাসার কুত্তাটা ঘেউ ঘেউ করলে মনে হয় কেউ সঙ্গীত চর্চা করছে। ছোট ভাই রাফির অ-খাদ্য, কু-খাদ্য রান্না অমৃত মনে হচ্ছে। ইদানিং জ্যাকলিন গাঁঢ লিপস্টিক দিয়ে অফিসে আসতে শুরু করেছে। আমাদের বস আবার গাঁঢ লিপস্টিক পছন্দ করেন। গত রাতে ফোনে জানতে পারলাম বসের নাকি ডায়রিয়া হয়েছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক তাই হাসপাতালে ভর্তি। তাকে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। ফেরার সময় বসকে কানে কানে বললাম- লিপস্টিক খাওয়া বন্ধ করুন, না হলে ডায়রিয়া পিছু ছাড়বে না। বেচারা আমার কথায় কিছুটা লজ্জা পেলেন। রাতে প্রচন্ড ঘুম চোখ নিয়ে বাসায় ফিরে দেখি রাফি আন্ডারওয়ার পরে আমার বিছানায় ঘুমাচ্ছে। কোন কিছু চিন্তা না করে ওর পাশে আমিও শুয়ে পড়লাম। তিন বছর পর দেশে যাচ্ছি, মনের আনন্দে ঠিক মত ঘুম আসে না, কিন্তু চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে, সাঁপুড়ে বীণ বাজাচ্ছে, রাফি নাক ডাকছে, ফোনটা বেজে চলছে, মা ফোন করেছে।
-হ্যালো মা!! কক্ কক্!!
-কিরে বাবা কেমন আছিস? তোর ফ্লাইট কখন?
-এইতে মা ভাল। ফ্লাইট সকাল ৭ টায়। কক্ কক্!!
-কিরে মুরগীর মত কক্ কক্ করছিস কেন? তোর শরীর ভালতো?
-খিদে পেয়েছে মা। কক্ কক্!!
-আহারে, আমার বাবাটার খিদে পেয়েছে। কি খাবি বল ? আমি রেঁধে রাখি।
-পাঁচ মিশালি ছোট মাছের ঝোল সাথে আমন চালের লাল ভাত। কক্ কক্!!
-ঠিক আছে বাবা, তাড়াতাড়ি চলে আয়, আর কিছু খাবি?
-হ্যালো মা! হ্যালো!! কক্ কক্!!! যাহ্!!! ফোনের লাইনটা কেটে গেল মনে হয়!!

শশ্ আওয়াজে প্লেন চলছে। আমি এবং জ্যাকলিন পাইলট। পিছনে বসে আমাদের বস কক্ কক্ করছে। জ্যাকলিন আজ গাঁঢ লিপস্টিক দেয়নি। বসের দেখাদেখি জ্যাকলিনও কক্ কক্ ডাকা শুরু করল। হঠ্যাৎ করে প্লেনে আগুন লেগে গেল। আমি একটা প্যারাসুট নিয়ে লাফ দিলাম। অনেক চেষ্টা করেও প্যারাসুট খুলতে পারছি না। একি! এতো প্যারাসুট না! রাফির আন্ডারওয়ার! হায় আল্লাহ !!! প্যারাসুট ভেবে রাফির আন্ডারওয়ার নিয়ে লাফ দিলাম?
আমি পড়ে যাচ্ছি গভীর অতলে। বাঁচাও আমাকে! কক্ কক্! বাঁচাও!!!

তীব্র ব্যথার যন্ত্রনা নিয়ে ঘুম ভেঙে গেল। গাল ঘষতে ঘষতে উঠে দেখি রাফি ভীত চোখে আমার সামনে বসা।
-কিরে রাফি, তুই ছোট হয়ে আমাকে থাপ্পড় মারলি? তোর এত বড় সাহস?
-কি করব ভাই, আপনি যেভাবে কক্ কক্ করে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন!
-তাই বলে থাপ্পড় মারবি? ঘুম ভাঙ্গানোর আর কোন উপায় নেই? বেয়াদব কোথাকার!! বিদায়-হ চোখের সামনে থেকে।
-যাচ্ছি ভাই, তার আগে আমার আন্ডারওয়ারটা দেন।
-আবার ফাজলামি করিস। তোর আন্ডারওয়ার আমি কই পাবো?
রাফি সবিনয় ভাবে আমার দিকে ইশারা করতেই আমি আঁতকে উঠলাম।
আমার হাতে রাফির আন্ডারওয়ার!
হায়রে অবস্থা…..

একটি গল্প এবং আমরা ব্লগার

কিছুদিন আগে একজন চায়নিজ বান্ধবীর সাথে কথা হচ্ছিল। টপিকগুলো ছিল খুবই সাধারণ। যেমন-আমার দেশ, আমাদের কালচার, মানুষ, পোষাক, ইত্যাদি সম্পর্কিত। পর্যায়ক্রমে সে আমার সম্পর্কে জানতে চায়। আমার জীবনের লক্ষ্য, শখ, অবসরে কি করতে পছন্দ করি এসব ছোট-খাট বিষয়ে। আমি তাকে বলে যাচ্ছিলাম, বিড়ালের সাথে টিভি দেখা, পছন্দের খাবার তৈরী করা, ছবি তোলা, কাজের ফাঁকে ব্লগিং করা, ইত্যাদি। ব্লগিংয়ের কথা শুনে বিস্ময়ের চোখ নিয়ে তাকালো আমার দিকে!
-তুমি ভ্লগ কর? কিসে কর? ফেসবুকে নাকি ইউটিউবে? আমি দেখতে চাই, তোমার চ্যানেলের লিংক দাও!
তার এই কথা শুনে আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। আসলে শব্দ উচ্চারণের দিক থেকে চায়নিজ বা জাপানি জাতি এখনো অনেক অদক্ষ। সেক্ষেত্রে বাঙালিদের অবস্থান অনেক ভাল। আমরা যদি ডক্টর বলি তারা বলে দক্তর! আরো অনেক দৃষ্টান্ত আছে যা বলতে গেলে কয়েক পাতা লিখতে হবে। যখন (Vlog) এবং (Blog) এর পার্থক্য তাকে জানালাম তার বিস্ময় আরেকটু বেড়ে গেল। সরাসরি আমাকে জিজ্ঞাসা করল-ব্লগ কি?

যাইহোক, ব্লগ নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের অবস্থা আরো ভয়াবহ! মা, চাচী, ফুপু, খালা, টাইপের কেউ যদি জানতে পারে আপনি ব্লগার তাহলে তো কথাই নাই, চোখের পানিতে সাঁতার কাটিয়ে হোক অথবা মাথার দিব্যি দিয়ে হোক আপনাকে এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে তাদের গোয়েন্দা ভূমিকায় দেখা যাবে। বাবার বন্ধুরা দাঁত উঁচিয়ে বলবে, আকরামের ছেলেটা শেষ পর্যন্ত জঙ্গিতে যোগ দিল?
পাড়া-প্রতিবেশী বা হুজুর টাইপের মানুষ আপনাকে নাস্তিক বলবে!
বন্ধু-বান্ধব কম পেতে পারেন।
তাছাড়া, তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে এমন টাইপের কথা ফ্রি-তে শুনবেন।

বর্তমান সময়ে কিছু মানুষের ব্লগিং অবাক করার মতো। দেখলে মনে হয় ব্লগিং নয় ফেসবুকিং করে। মনে যা চায় কিছু একটা পোষ্ট করেন, উত্তর-প্রতিউত্তের কোন ধার-ধারেন না। বিষয়টা আমার কাছে মনে হয়- আপনি আপনার বাসায় মানুষকে দাওয়াত দিলেন কিন্তু তাদের সাথে কথা বলার প্রয়োজন মনে করলেন না! আমার মতে, একজন ভাল ব্লগারের গুণাবলী হল মন্তব্যের উত্তর দেয়া, অন্যের লেখায় মন্তব্য করা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়া, ব্লগকে ফেসবুকের মতো ব্যবহার না করা, ব্লগ সম্পর্কে মানুষকে সঠিক ধারনা দেয়া।

একমাত্র আলোচনা বা মতামতের মাধ্যমে গড়ে উঠবে সু-সম্পর্ক, ভালবাসা, ভ্রাতৃত্ব, সুন্দর সমাজ।

রঙিন ভালোবাসা -(২য় এবং শেষ পর্ব)

লেলিনা এবং জিওন আমার অনেক ভাল বন্ধু। বলতে গেলে আমরা এক সাথে থাকি, বাসাটা আমার হলেও ফ্রি-তে তারা আমার রুম পাটনার। কুকিং থেকে শুরু করে মুভি দেখা সব চলে আমার বাসায়। লেলিনার বাবা সম্ভবত পর্তুগীজ তবে মায়েরটা বলতে পারব না। এবং জিওন পিওর কোরিয়ান। ওয়েস্টার্ন কালচারের একটা বিষয় আমার ভাল লাগে, এদের ধর্ম, বর্ণ, জাতি নিয়ে মাথা ব্যথা কম। লেলিনা খুব চঞ্চল প্রকৃতি মেয়ে, চুল গুলো সোনালী হলেও তার হাসি দিয়ে ১০১ টা ছেলেকে ঘায়েল করার ক্ষমতা রাখে। কোন মেয়ের হাসি যে এত সুন্দর হতে পারে, লেলিনাকে না দেখলে বুঝতাম না। এই হাসি দেখে কত ছেলে প্রেমে পড়েছে তা লেলিনা ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। অস্বীকার করব না, আমি তার প্রেম জলে হাবুডুবু খেয়ে সাঁতার শিখেছি। তবে তা কখনো বলি নি।

জিওনের কথা বর্ণনা করতে গেলে পুরা দিন-রাত মিলিয়ে শেষ করতে পারব না। এরকম কমেডিয়ান ছেলে বিশেষ ভাগ্যে জোটে। সত্যি বলতে তার সামনে আমি কখন মন খারাপ করে থাকতে পারি নি, একেবারে মন ভাল করার মেশিন তার বিশেষ গুণের মধ্যে অন্যতম মানুষ কে কপি করা, সারাদিন কোন মানুষ-টা কেমন করবে সেটা খুব ভাল করে লক্ষ্য করে রাতে আমাদের দেখানো তার প্রধান লক্ষ্য। সত্যি এমন বন্ধু থাকলে জীবন অসাধারণ।

সে বছরের শেষের দিকে কোন এক জরুরী কাজে আমাকে বাংলাদেশে যেতে হয়েছিল তবে সেটি খুব দীর্ঘ নয়, মাএ ১৫ দিনের জন্য। তখন লেলিনা এবং জিওন আমার সাথে বাংলাদেশে যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করে, আমি ওদের না করিনি। শেষ মুহূর্তে জিওনের বাবা মারা যাওয়া-তে তা হয়ে ওঠেনি। জরুরীভাবে জিওনকে কোরিয়া ব্যাক করতে হয় এ নিয়ে লেলিনার অভিযোগের শেষ ছিল না, আমরা দু-জন এক সাথে চলে গেলে সে কি করবে?
বাংলাদেশে গিয়ে লেলিনা আর জিওনের জন্য খুব খারাপ লাগছিল তারচেয়ে বড় কষ্টের ব্যাপার এই কদিন একবারের জন্য ওদের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি।
আমার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভূদ ঘটনা ঘটে ১৫দিন পর যখন আমি শিকাগোতে ফিরে যাই! কোন ভাবে লেলিনা এবং জিওনের সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। ওদের দুজনের সকল ধরনের কন্টাক্ট বন্ধ! পরিচিত সব জায়গায় খোঁজ নিয়ে ওদের কোন সন্ধান পায়-নি। এক কথায় হারিয়ে ফেলি ওদের।
তাই ৬-৭ মাস পরে এই রাতে লেলিনার ফোন কল আমাকে যথেষ্ট অবাক করেছে তার সাথে মনে জন্ম দিয়েছে অনেক প্রশ্নের!

হাসপালের গেটে দেখা হয় লেলিনার মায়ের সাথে। লেলিনার ব্যাপার জিজ্ঞাসা করতে সে আমার হাত ধরে নিয়ে যান একটি রুমে। কিছুক্ষণ পর একজন নার্স ফুটফুটে এক নবজাতক আমার কোলে তুলে দেয়। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি, আমি নিস্তব্ধ, আমি গতিহীন, আমি অনুচ্চারিত, আমার পৃথিবী থেমে গেছে, এতো পরীর বাচ্চা! কিভাবে তার বর্ণনা করব আমার জানা নেই। ছোট ছোট চোখ, নরম তুলতুলে গাল, ঠোঁট এতটাই লাল যা কালো বর্ণ ধারণ করেছে। হৃষ্টপুষ্ট আঙ্গুল গুলো দেখলে চুমু দিতে মন চায়, তার ড্যাব ড্যাব চাহনি ভুলিয়ে দেয় সব কষ্ট। চেহারা দেখে বুঝতে বাকি থাকে না এর বাবা জিওন! ভেতরে ভেতরে এত কিছু, আমি জানতে পারলাম না? জিওন এমন করতে পারে সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।সাহস করে বলে ফেললাম,
-আন্টি, জিওন এবং লেলিনা কোথায়?
-জিওন আর ফিরে আসে-নি ! লেলিনের সাথে প্রতারণা করেছে।
-আমি কি একটু লেলিনের সাথে কথা বলতে পারি?
-হ্যাঁ ! A113 নাম্বার কেবিনে চলে যাও ।

কেবিনে ঢুকে দেখি লেলিনা বিছানায় শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে বসতেই আমার হাত জড়িয়ে তার প্রথম কথা,
-আমার একটা উপকার করতে পারবে?
-একটা না দশটা করব।বল কি করতে হবে।
-আমার বাবুর নাম রেজিস্ট্রেশন করাতে ওর বাবার নাম প্রয়োজন! আমাকে সাহায্য করবে?
-হুম…সমস্যা নেই “পবিত্র হোসাইন” লিখে দিব কিন্তু একটা শর্ত আছে?
-কি শর্ত?
-প্রতিদিন এই পরীর বাচ্চার আঙ্গুলে চুমা দিতে চাই এবং তুমি সেটা মানা করতে পারবে না। বল রাজি কিনা?

লেলিনা অপলক দৃষ্টি-তে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, সে চোখের ভাষা আমি পড়তে পারি। তার মিষ্টি হাসির চাহনি আবার আমাকে মাতাল করে দেয়। আজ স্বার্থপরের মতো সৃষ্টিকর্তার কাছে বলতে চাই জিওন ফিরে না আসুক। কখনই না আসুক আমাদের রঙিন ভালোবাসায়।
১ম পর্ব পড়ুন

(আমি সত্যি অনেক দুঃখিত, আমি আমার কথা রাখতে পারিনি। অসুস্থতার কারণে শেষ পর্ব সময় মতো পোস্ট করতে পারিনি)

কাজল-জল, ৩ কাব্য

১।
ইরাবতী,
আমি জানতাম তুমি আজ আসবে,
আজ যে বৃষ্টি দিবস!
বৃষ্টির পানিতে বেলী ফুলের গন্ধ পাও?
জানি পাও, কারন বেলী ফুল হাতে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম
বেলী ফুল দিয়ে বৃষ্টির গায়ে লিখেছিলাম -প্রিয় ইরাবতী
আজ আমি অভিমানী ছিলাম তোমার সামনে যাইনি!
কারন আজ যে তুমি কাজল পরনি।

২।
বামুন দুপুরে পুকুর ঘাটে পদ্ম খেলার ছলে,
ছুঁয়েছিলাম তোমার রাঙা দুই গালে,
কাজল ছোঁয়া দিব্যি তোমার, আমার বুকে সংসার,
-দেবী কার হাসিতে হাসো, চারিদিকে অন্ধকার!

৩।
ইরাবতী,
শুনেছি সব কিছুর প্রতিশোধ নাও তুমি?
তাহলে একদিন কাছে টেনে তোমার ঠোঁটে বিষ শুকাবো,
দেখবো কেমন প্রতিশোধ নাও। নীল শাড়ীতে কাজল মেখে এসো কিন্তু!

আমি কাব্য লিখতে পারি না এটাই প্রথম চেষ্টা

আজ ইরাবতীর বিয়ে

রুহিলা বেগমকে আজ সকাল থেকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। তার মুখের ভাব ফ্যাকাসে, ব্লাড প্রেসার লো হয়ে গেছে। এর প্রধান কারন আজ তার একমাত্র মেয়ে ইরার বিয়ে। মেয়ের বিয়েতে মায়েরা বোধ হয় একটু বেশী উদ্বিগ্ন থাকেন। রুহিলার বেলাতেও সেটির ব্যতিক্রম হচ্ছে না। তার চিন্তার আরেকটি কারন আছে তা হল ফয়সালকে চিলেকোটার রুমে আটকে রাখা হয়েছে। অন্য আট-দশটি বিয়ের মত এই বিয়ে নয়। খুব সাধারন পারিবারিক ভাবে ইরার বিয়ে হচ্ছে। সকাল থেকে রুহিলা বেগম রান্নাঘর থেকে বের হয়নি। এক হাতে তিনি সব সামাল দিয়ে যাচ্ছেন। তার কাছে আজ যেন সব কিছু নতুন লাগছে। তিনি মনে মনে ভাবলেন ইরার রুমে গিয়ে একবার দেখে আসা উচিৎ সে কি করছে। ইরার রুমে যাবার সময় রুহিলা বেগম বারান্দায় একবার উকি দিলেন, ইরার বাবা ওসমান সাহেব বারান্দায় বসে এক হাতে সিগারেট, অন্য হাতে খবরের কাগজ ধরে আছেন। দীর্ঘ ৩৫ বছর তিনি সেনাবাহিনীতে চাকুরী করেছেন। এ বাড়ীর সবাই তাকে ভয় পায়। ওসমান সাহেব সব সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পছন্দ করেন। ইরার বিয়েটা তিনি নিজে ঠিক করেছেন কারো সাথে পরামর্শ করেননি। তার ধারনা মেয়ে মানুষের সাথে পরামর্শ করা অহেতুক বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। গত সপ্তাহে রাতের খাবার খেতে খেতে ওসমান সাহেব বললেন, ইরাবতী – আমি তোমাকে এবং তোমার মাকে না জানিয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইরা বুঝতে পারছে তার বাবা তাকে কঠিন কিছু বলবেন কারন তিনি ইরা থেকে ইরাবতীতে চলে গেছেন। কঠিন কিছু কথা বলার আগে তিনি মানুষের পুরো নাম ধরে ডাকেন। যেমন-তাদের বাড়ীর কাজের লোক সামাদের উপর রাগ হলে তিনি তাকে ‘আব্দুল সামাদ হাওলাদার’ বলে ডাকেন। ইরা তার বাবাকে বুঝতে পারে। ইরার মনে করে তার বাবা খুব সহজ-সরল কিন্তু সে রাগী রাগী মুখ নিয়ে বসে থাকতে পছন্দ করেন।
ইরা খুব স্বাভাবিক বলল- বাবা তোমার সিদ্ধান্তের কথা আমি জানি। তুমি আমার বিয়ে ঠিক করেছ। তাই তো? এবং এও জানি আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে।
ওসমান সাহেব আর কিছু বললেন না, চোখ-মুখ শক্ত করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

রুহিলা বেগম মেয়ের ঘরে ঢুকে খানিকটা আবাক হলেন। দিনের বেলা পুরো ঘর অন্ধকার। ইরা দরজা-জানলা, লাইট-ফ্যান বন্ধ করে শুয়ে আছে। মাকে দেখে ইরা স্বাভাবিক ভাবে বলল- লাইট জ্বালাবে না মা। যা বলতে চাও, বলে চলে যাও।
রুহিলা বেগমের খানিকটা মন খারাপ হল। এ বাড়ী সবাই তার সাথে কেমন যেন আস্বাভাবিক আচরন করে। বিশেষ করে ইরা দিন দিন কেমন যেন ওর বাবার মত হয়ে যাচ্ছে। রাগী রাগী ভাব নিয়ে কথা বলে। ইরা আবার বলল- মা, তুমি কি কিছু বলতে চাও?
-ইরা, তুই চাস তোর বাবা আবার স্ট্রোক করুক।
-তুমি এই কথা বলার জন্য এসেছ। তার আগে বলো ফয়সাল কি পাগল?
-পাগল হবে কেন? এ কি কথা বলছিস?
-তাহলে বাবা কেন তাকে চিলেকোটার রুমে আটকে রেখেছে? আমিতো তোমাদের সব কথা মেনে নিয়েছি।
-কেন আটকে রেখেছে সেটা তুই ভাল করেই জানিস। তোর বাবা চায় না তোর বিয়েতে কোন ঝামেলা হোক। আমি এত কিছু শুনতে চাইনা তাড়াতাডি উঠে তৈরী হয়ে নে, বর পক্ষ এখনি চলে আসবে।
ইরা আরো কিছু বলতে পারতো কিন্তু রুহিলা বেগম সে সুযোগ তাকে না দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন।

বিকেল ৫টা। ওসমান সাহেব ড্রয়িং রুমে বসে আছেন। তার সামনের বর পক্ষ বসা। ওসমান সাহেব হাসি হাসি মুখ রাখার চেষ্টা করছেন কিন্তু তা সহজ হচ্ছে না কারন তিনি তরতর করে ঘামাচ্ছেন। ইতিমধ্যে কাজী সাহেব চলে এসেছেন। ওসমান সাহেব হাক ছেড়ে ডাকলেন- আব্দুল সামাদ হাওলাদার ! সামাদ ছুটে এসে বলল- জে স্যার ,আমারে বুলাইছেন ?
-তোর চাচী আম্মারে বল ইরাবতীকে জলদি নিয়ে আসতে।
সামাদ যাওয়ার আগেই রুহিলা বেগম ইরাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন। ওসমান সাহেব ইরার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, তার মেয়ে যে এত সুন্দর তা আগে কখনো লক্ষ্য করেনি, লাল শাড়ীতে ইরাকে দেখতে পরীর মত লাগছে। ওসমান সাহেবর বুকের মধ্যে ধরফর করে উঠলো তিনি কোন ভাবে ভাবতেই পারেন না এত সুন্দর মেয়েকে কোন এক জানোয়ার কষ্ট দিয়েছে না হলে আজ এই দিন দেখতে হত না, চুপচাপ এভাবে বিয়ে দিতে হত না।
কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করেছেন। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে সব কিছু ঠিকঠাক ভাবে সম্পূর্ন হয়ে গেল। বিদায় বেলায় ইরা কারো সাথে কোন কথা বলল না স্বাভাবিক ভাবে গাড়ীতে উঠে গেল। ওসমান সাহেব রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়ের চলে যাওয়া দেখতে লাগলেন, তার কাছে সব কিছু স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে, তবে তার ঘোর কাটল রুহিলার চিৎকার শুনে! ইরা চলে যাবার পর রুহিলা আকাশ ফাঁটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল- আমার মেয়ে কোন অপরাধ করেনি, আপনি কেন তাকে এভাবে বিয়ে দিলেন? সে যাবার সময় কারো সাথে একটি কথাও বলল না, আপনার কি একটু খারাপ লাগলো না? আপনি এত পাষান বাবা? ওসমান সাহেব কোন কথা বলতে পারলেন না। চুপচাপ বাড়ীর ভেতরে চলে এসে ডাক দিলেন- সামাদ ! চিলেকোঠা রুমের চাবিটা নিয়ে আয়। সামাদ দৌড়ে চাবি নিয়ে এল। সামাদের হাত থেকে চাবি নিয়ে ওসমান সাহেব তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন।
ওসমান সাহেব চিলেকোঠা রুমের সামনে দাড়িয়ে আছেন তার হাত কাঁপছে, মনে হচ্ছে তিনি তালা খুললে পারবেন না। অনেকক্ষন যাবত চেষ্টা করার পর ঘট ঘট শব্দে তালা খুলে গেল, শব্দ শুনে ভেতর থাকা ৪ বছর বয়সী ফয়সালের ঘুম ভেঙে গেল, গুটি গুটি পায়ে সে দরজার কাছে এগিয়ে এল, কাছে যেতে ওসমান সাহেব তাকে তাকে কোলে তুলে নিলেন।
ফয়সাল কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞাসা করে- মা কোথায়, নানাজান? আমাকে মার কাছে নিয়ে চল। আমি মার কাছে যাব।
-তোমার মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বলতেই ওসমান সাহেবের গলা জড়িয়ে আসে। হুঁ হুঁ করে কেঁদে ওঠে ।
ফয়সাল কিছুতেই বুঝতে পারে না শুধু নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নানাজানের চোখের দিকে।

লেখাটি উৎসর্গ করলাম –
তাহসিন বিনতে উমর।
খুব কাছের অপরিচিত একজন মানুষ।

মহাত্মা ভালোবাসা

বিরক্ত নিয়ে ছেলেটি ফোন রিসিভ করে,
-হ্যালো
-ফয়সাল… কি করো?
-কেন ?
-তুমি আমার ফোন রিসিভ করো না কেন?
-জানি না।
-আচ্ছা একটা জরুরী কথা!
-হুম।
-রাগ করবা?
-এত ঢং না করে বল।
-তুমি তো প্রথমেই রাগ করছো!
-বললে বল, না বললে চুপ করে থাক।
-আচ্ছা, জানো,আমার একটু একটু পেটের মধ্যে ব্যাথা করছে!
-তো? আমি কি করব?
-কেন বুঝ না? আমি ভয় পাচ্ছি!
-কিসের?
-আমমমি…মনে হয় কনসেভ করেছি!
-মানে কি?
-হুম..
-এখন আমি কি করতে পারি?
-জানি না, তবে…
-তবে কি?
-তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?
-বিয়া করবার জন্য মন সব সময় উতলা থাকে, তাই না?
-এভাবে বলবা?
-দেখ! এটা তোমার সমস্যা, তোমাকে কি করতে হবে তা তুমিই যান, আমাকে এর মধ্যে আনবা না, বাই।

অতঃপর মেয়েটি ভাবে,
এবার বুঝি মা আমাকে মেরেই ফেলবে !!!
ঠিক একই ভাবে পেটে থাকা শিশুটি ভাবে,
এবার বুঝি মা আমাকে মেরেই ফেলবে !!!

বি:দ্র: লেখাটি ফেসবুকের কোন স্ট্যাটাস থেকে অনুপ্রাণিত ।

ডগি সেলফি

তিন বছর আগের কথা। ফেসবুকে ঢুকে দেখলাম এক ছেলে বন্ধু ছবি পোষ্ট করেছে, তাতে ক্যাপশন লিখেছে – “একদা লিওনার্দো দা ভিঞ্চি দ্বারা ছবিটি আঁকিয়ে নিয়েছিলাম” তার এই ক্যাপশন দেখে দুই মিনিট মুখ হা করে বসে ছিলাম। কি বলবো বুঝতে পারিনি। পরে তাকে কমেন্ট করলাম “তোমাকে মোনালিসা আপুর মত লাগছে”।
তার দুই-তিন দিন পরে জানতে পারলাম প্রিজমা নামের একটি অ্যাপ বাজারে এসেছে। অ্যাপটির বিশেষ্যত হল সদ্য তোলা ছবি বা ইমেজ লাইব্রেরি থেকে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ৩৩টি ফিল্টার ব্যবহার করে বিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, পিকাসো, মনেট, ভ্যান গগ, মাঞ্চ, লেভিটান, ক্যানডিনস্কি’র শিল্প ভঙ্গির আদলে ছবির রূপ দিতে পারে। তাছাড়া ডিসি কমিক বুকের জনপ্রিয় ডিজাইনগুলোর আলোকেও ছবি ফিল্টার করতে পারে। সেই সময়ে বাংলাদেশে কি যে হুলুস্থূল অবস্থা হয়েছিল! ছেলে, বুড়ো থেকে শুরু করে সবাই প্রিজমা অ্যাপ খেতে শুরু করলো। বেশ কিছুদিন চলেছিল অ্যাপটি তারপর শেষ। মূলত পাবলিক এক জিনিষ বেশীদিন খায় না।
প্রিজমা শেষ হবার পর ভালই চলছিল দিনগুলো কিন্তু এর পরবর্তী ঘটনা আরো ভয়াবহ!

ঈদের দিন বন্ধু বাসায় বেড়াতে গেলাম। আমাকে দেখে তার ৪ বছর বয়সী ছেলে মোবাইল নিয়ে ছুটে এল। কাছে এসে বলতে শুরু করল:
-আঙ্কেল, আঙ্কেল! চল আমরা ডগি সেলফি তুলি।
আমিতো রিতিমত অবাক, বলে কি এই বাচ্চা? ডগি সেলফি?
-ডগি সেলফি কিভাবে তোলে আমি জানিনা বাবা।
-আঙ্কেল তুমি না অনেক বোকা, চল আমি তোমাকে শিখিয়ে দেই।
মোবাইলের ক্যামেরা তুলে ধরতেই আমার চোখ ছানাবড়া! আমি কুত্তা হয়ে গেছি, কু্ত্তার মত নাক, কান আমার!
পরে বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম এটা এক ধরনের অ্যাপ যা ছবি তোলার সময় মানুষের মুখের আকৃতি কুকুর বা বিড়ালের মত করে দেয়। তাহলে ভাবুন একবার কি ভয়াবহ অবস্থা? কবে যেন দেখবো অ্যাপগুলো কুত্তার মত লেজও বানিয়ে দিয়েছে।

সম্প্রতি শুরু হয়েছে আরেক ছাগুমি, ফেস অ্যাপ! ভাইরাল এই অ্যাপটি জোয়ান মানুষকে বুড়ো বানিয়ে দিচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ নিজের বুড়ো ছবি আপলোড দিচ্ছে। কিন্তু আরেক জাতীয় মানুষ এতে খুশি না, কারন এই ট্রেন্ডে মেয়েদের অংশগ্রহন নাকি অনেক কম, তারা নাকি বুড়ি হতে পছন্দ করছে না।

যাইহোক এখন ভাবছি আমার কথা আমি তো এমনিতে বুড়ো তাহলে আমার জন্য কোনো ব্যবস্থা করা যায়না যদি একটু জোয়ান টোয়ান হতে পারতাম।

আসমানী

-হাসমত মিয়া, কই যাও?
-হাটে যাই মিজান ভাই।
-ভালা আছনি?
-আল্লায় রাকছে।
-তোমার কাছে কিছু টেক্যা পাইতাম মনে আছেনি?
-মিজান ভাই, এ বছর বন্যায় সব ভাইস্যা গেছে, টেক্যাডা…
-আচ্ছা বুঝছি, অসুবিদা ন্যাই। শোন, আমগো কালু ভাইরে তো চেনো?
-হ..
-সে তো এখন বিরাট মানুষ হইয়া গেছে। সৌদি আরবের ১০০ খানা ভিসা আনসে। সৌদির বাদশা গো লগে চলা ফেরা করে বুঝইতো।
-তাই নাকি? আমারে একখান ভিসা লইয়া দেন না ভাই।
-কিন্তু এহন তার কাছে সব ম্যাইয়াগো বাসাবাড়ীর কামের ভিসা, পোলাগো ভিসা বন্ধ,তয় বাদশার লগে কালু ভাইয়ের কথা হইছে ৬ মাস পরে পোলাগো ভিসা দিব। এক কাম কর না, তোমার ম্যাইয়া রে পাঠায়ে দেও, ছয়মাস পরে তুমার ম্যাইয়া কামাইয়ে ট্যাকা দিলে তুমি চইল্লা যাবে। তখন বাপ আর ম্যাইয়া মিলা একসাথে মাল কামাইবা।
-না! ম্যাইয়া রে না! ম্যাইয়া মানুষ কাম করবো ক্যা? ছয় মাস পরেই আমি যামু।
-আরে ধুর মিয়া, তুমি কোন যুগে থাক? বিদেশে পোলা ম্যাইয়া সমান। আরে, বিদেশ ক্যা, তুমি ঢাকা গ্যেসিলা দেহ নাই? ম্যাইয়ারা আফিসে কাম করে। আমাগো টিএননো ম্যাডামরে দেহ না? খালি চিন্তাকর, যখন তুমার ম্যাইয়া যখন বিদেশ থেইক্যা মাল কামায়্যা আসবো তখন কার লগে বিয়া দিবা? মেমবরের পোলার লগে? নাকি চেয়ারম্যানের পোলার লগে?
-কিন্তু ওয়তো আরো পড়ালেখা করবার চায়।
-সমস্যা নাই, যে সৌদিরবাড়ীতে কাম করবো সে তো কালু ভাইয়ের বন্ধু। কালু ভাই কইলে স্কুলে ভর্তি কইরা দিব। সৌদি ম্যাইয়া গো সাথে স্কুলে যাইবো…বুঝলা মিয়া।
-কয় ট্যাকা লাগবো মিজান ভাই?
-সবাই ৫লাখ দিয়াও ভিসা পাইতেছে না তয় তুমি নিজেগো লোক কালু ভাইরে কইয়্যা ৫০ হাজার কম কইরা দিমু নে।
-আপনি যা ভালা বুঝেন মিজান ভাই তাই কইরা দেন। আর কত দিন জমি চাষমু। জমিডা বেইচ্যা ফালামু।
-জমি দিয়া কি করবা? মাইয়্যা গেলে ঐরহম জমি ১০ ডা কিনবার পারবা। কাইল সকালে রেডি থাইক্কো মাইয়্যারে আর তুমারে লইয়া কালু ভাইয়ের বাড়ীত যামুনে।
হাসমত মিয়ার খুশি যেন আকাশের চাঁদের সমতুল্য।
এক মেয়ে, ছোট ছেলে আলামিন আর স্ত্রী মরিয়মকে নিয়ে কোন রকম সংসার চলে। আজ হাটে থেকে একটু তারাতারি বাড়ী ফিরে আসে হাসমত মিয়া।
-কই …..আসমানীর মা…..ও…আসমানীর মা…..এদিকে আহ, একখান সুসংবাদ আছে !!!
-কি ওইছে ?
-আসমানী কই?
আসমানী: জ্বি বাজান?
সব ঘটনা খুলে বলার পর, আসমানী এবং মরিয়ম বেগমের চোখ জ্বল জ্বল করে ওঠে। যেন আনন্দের জোয়ারে ভাসে …এর মধ্যে আসমানীর ছোট ভাই আলামিন এসে বলে,
-বুবু যখন বিদেশ থেইক্যা আসবো আমার লেইগ্যা চামের জুতা আনতে ওইবো….
পরের দিন হাসমত মিয়া ও আসমানী, মিজানের সাথে কালুর বাড়ী যায়।

কালু: হাসমত মিয়া তুমার ম্যাইয়ার বয়স কত?
হাসমত: ১৬ বছর হইবো কালু ভাই।
কালু: এত কম বয়সেতো পাসপোর্টে ভিসা ইস্যু হইবো না।
হাসমত: তয় কালু ভাই উপায়?
মিজান: ৫ হাজার ট্যােকা দিলে আমি জন্মনিবন্ধন ঠিক কইরা দিতে পারমু। টেক্যাতো আমি লমু না, যারা কাম করবো তারাই লইবো।
হাসমত: সমস্যা নাই দিমু তয় কামের পরে টেক্যা।
হাসমত মিয়া মনে মনে ভাবে “আমারে কি বোকা পাইছো? কাম হইলে টেক্যা দিমু।
কালু: হাসমত মিয়া ভিসার টেক্যা তো আগেই দিতে ওইবো মিজান তো তুমারে সব কইছেই, রাজি থাকলে একসপ্তার মইধ্যে আধা টেক্যা দিতে হইবো আর বাকিডা কাম হওনের পরে।
তাইলে আমরা অহন আসি কালু ভাই, মিজান বলে।
একসপ্তার মধ্যে জমি বেচে টাকা দেয় হাসমত। সব কিছু যেন ঝড়ের বেগে হতে থাকে, পাসপোর্ট, মেডিকেল, ভিসা প্রসেসিং, আর টিকেট।

আসমানী: বাজান, মার লগে কইলাম ঝগড়া করবা না। আর একটু চিন্তা কইরো না আমি যাইয়্যাই তুমারে ফোন দিমু।
হাসমত: তুইও কোন চিন্তা করিস না আমরা ভালা থাকুম।
মরিয়ম: ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করিস।
আলামিন: আমার লেইগ্যা কিন্তু চামের জুতা আনবাই আনবা।
মিজান: তারাতরি চল আসমানী, দেরী হইয়া যাইতাছে।

মরুর দেশে উড়াল দেয় আসমানী-
বিকেল ৪টা-
কিং খালিদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট-
আসমানী সহ আরো চারজনকে বসিয়ে রাখা হয়েছে একটি ওয়েটিং রুমে। আসমানীর চোখ যেন থামে না যেন ছুতে চায় সুন্দরের সব কণা গুলো। কিছুক্ষন পর এয়ারপোর্টের এক লোক সহ সাদা জুব্বাওয়ালা একজন আসে।
আসমনী দেখে লোকটা দেখতে একদম তাদের গ্রামের ঈমাম সাহেবের মত।
আসমানীর কাছে আসে তারা।

লোকটি: আস্সালামুআলাইকুম। ক্যাইফ্যা হাল? (কেমন আছ ?)
আসমানী লজ্জা পায় সাথে একটু ভয় ! সালাম পেয়ে লোকটির সম্মান আসমানীর কাছে আকাশ চুম্বী হয়। মনে মনে ভাবে ভাগ্যটা আসলেই অনেক ভাল তার….

লোকটি : তাল,ছয়া ছয়া….(আমার সাথে আস) জিব পাসপোর্ট…(পাসপোর্ট দেও)
আসমানী কোন কিছুই বোঝে না শুধু তাকিয়ে থাকে।

আসমানীর ব্যাগ নিয়ে নেয় সে এবং হাতের ইশারায় বোঝায় তার সাথে যাবার জন্য।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে সুন্দর একটা গাড়ীতে বসে তারা। ১ঘন্টা চলার পর একটা বাড়ীর সামনে গাড়ী থামে ভিতরে গিয়ে আসমানী অবাক হয় ,এত সুন্দর বাড়ী !
কিন্তু কোন মহিলা মানুষ নেই, নেই কোন বাচ্চাও। ঈমাম সাহেবের মত আরো তিনজন কে দেখতে পায় সে, তার মধ্যে দুইজন একটু বয়স্ক, মোট চারজন !
আসনানীকে থাকার একটি রুম দেখিয়ে দেয় লোকটি।
প্রচন্ড খিদে পেয়েছে আসমানীর কিন্তু কিভাবে বলবে? বিশ্রাম নিতে নিতে ঘুমিয়ে পরে সে। রাত গভীর হয় কলো ছায়া এসে পরে আসমানীর ওপর!
একি করতেছেন ছাড়েন আমারে..ছাড়েন…..আমি মা’র কাছে যামু…ও…মা.. মা…
বয়ষ্ক লোকটি হুংকার করে বলে-এসসাদা , লেস গিরগির? মাফি গিরগির যাদা..আনন্তা শীল কাতির ফুলুস্।(একি, কেন কথা বলিস? বেশী কথা বলবি না। আমি অনেক টাকা খরচ করেছি)
ভয়ে শুধু চাপা গোংড়ানো আওয়াজ বের হয়, কথা বলতে পারে না আসমানী, তীব্র ব্যাথার যন্রনা বয়ে যায় শরীর জুড়ে, রঙিন স্বপ্নগুলো রক্তে লাল হতে সময় লাগে না।
লোকটি চলে যায় আগুনের চোখ দেখিয়ে, ভয় আর সাদাকালো মন নিয়ে পরে থাকে আসমানী। কিন্তু শেষ হয় না ভয়, তারপর আসে এয়ারপোর্টে নিতে আসা আসমানীর সম্মানিত ব্যক্তি। ঘৃণায় থুতু দিতে মন চায় আসমানীর কিন্তু মুথ দিয়ে থুতু বের হয় না, হয় রক্ত ….
সময়ের পালা বদল করে সবাই আসে আসমানীর ঘ্রাণ নিতে আর আসমানীর নিথর দেহ পরে থাকে অচেতন…
এভাবে চলে যায় কিছুমাস…
অপরদিকে,
হাসমত মিয়ার চিন্তা বারে, মনে মনে ভাবে মাইয়্যা বিদেশ গিয়া কি ভূইল্যা গেল নাকি? একটা ফোনও দিল না।

-মিজান ভাই, বাড়িত আছেন নাকি?
-আরে হাসমত ভাই।
-মাইয়্যাডা গেল একখান ফোনও দিল না।
-আরে তুমি মিয়া বোকাই রইয়া গেলা বিদেশ থেইক্যা ফোন আসতে ইন্টারনেট ফোন লাগে, তুমার আছে নাকি? কালু ভাইয়ের লগে কথা ওইছে তুমার মাইয়্যাতো মেল্যা সুকে আছে ।
-কালু ভাই কই আছে?
-আরে তার কি সুময় আছে নাকি? সে বছরে, ছয় মাস ঢাকা ছয় মাস বিদ্যেশ থাকে। বোঝইতো বড় মাইনষ্যের বিরাট কারবার…
-আচ্ছা যাই তাইলে।
বাড়ীর পথে হাটা দেয় হাসমত আর মনে মনে ভাবে মাইয়াডা আমার বড়ই ভাগ্যবতী।

মরিয়ম: এই যে হুনছেন আসমানীতো একখান ফোনও দিলো না। মাইয়্যাডা জন্য মনডা আনচান করতাছে। কেমন যে আছে?
হাসমত: আরে কালু ভাইয়ের লগে কতা ওইছে, খুব ভালা আছে। বিদেশ থেইক্যা ফোন আসতে ইন্টারনেট ফোন লাগে, আসমানী টেক্যা পাডাইলে একখান ইন্টারনেট ফোন কিনতে হইবো।

আসমানীর কাছে রাত দিনের হিসাব নেই। বন্ধ ঘরটাতে রাত দিন সমান লাগে, দিনে একবার দুবার খাবার পায় সে কিন্তু সেটাও এটো!
বাজান, আইজ তুমার কতা খুব মনে পরতাছে কেমন আছ তুমি? তুমার কি মনে আছে, কাধে কইরা আমারে তুমি হাটে লইয়্যা যাইতা,গরম জিলাপী কিনন্যা দিতা। বাজান- লইব্যা আমারে একটু কাধে? আমার খুব মন চায় গরম জিলাপী খাইতে ….
হঠ্যাৎ আবার কালো ছায়া দেখতে পায় আসমানী।
-আমার বাজানরে একটু ফোন দিবেন? আপনি যা কইবেন আমি শুনুম…ইশারায় বোঝায় আসমানী।
কালো ছায়ার মুখে হাসি দেখতে পায় আসমানী।
-হ্যালো, বাজান!
-আসমানী, কেমন আসিছরে মা?
-বাজান আমারে লইয়্যা যাও..আমারে ওরা মাইরা ফালাইবো।
-ক্যা রে মা… কি হইছে? ওরা কি তোরে মারে?
-বাজান ওরা কি করে আমি মাইয়্যা হইয়্যা তুমারে কইতে পারুম না..আমারে লইয়্যা যাও…
ধপ করে কেটে যায় ফোনের লাইন তারসাথে হাসমত মিয়ার বুকের মধ্যেও। কোনো কিছুই বুঝতে বাকি থাকে না তার।

-মিজান ভাই, আমার মাইয়্যা আইন্যা দেন, আপনার পায়ে পরি। আমার কিচ্ছু লাগবো না শুধু মাইয়্যাডা আইন্যা দেন।
-তুমি মিয়া অনেক জালাইতেছো। টেক্যা দিয়া তুমি ভিসা কিনছো, আমি কি সব কিছুর জ্বিম্মেদার নাকি? আমি জানি না।
-কালু ভাইরে একটা খবর দেন।
-কালু ভাই বিদ্যেশ চইল্যা গেছে আমি কিছু জানি না।

উপায় না পেয়ে হাসমত যায় (টি এন ও) ম্যাডামের কাছে, সব কিছু শুনে ম্যাডাম আর হাসমত যায় থানায়। পুলিশ মিজানকে আটক করে বয়স জালিয়াতির দায়ে।

পুলিশ: আমরা এম্বাসির সাথে কথা বলেছি। আপনার মেয়ে দালালের মাধ্যমে বিক্রী হয়ে গেছে আমরা দালালকে ধরার চেষ্টা করছি।আসলে এম্বাসি বলতে পারছে না আসমানী সৌদির কোথায় আছে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।

অপরদিকে আশার প্রহর গুনছে আসমানী। তার বাজান নিতে আসবেই। মিলবে নরক থেকে মুক্তি !
আবার মনে পরে যায় গরম জিলাপীর কথা।
ওয়াক…ওয়াক….আসমানী বুঝতে পারে নীল বিষে বিষায়িত সে। নতুন প্রাণের সৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু সে জানে না কার বিষে বিষায়িত। হয়তো সেই অস্তিত্ব একদিন তাকে বের করে নিয়ে যাবে এই নরক থেকে। মনে মনে ভাবে আর যাবে না দেশে, তার নীল অস্তিত্বের মায়ায় থেকে যাবে আসমানী।

-হ্যালো, বাজান।
-মারে তুই কোন চিন্তা করিস না আমি তোরে নিয়া আসুম।
-বাজান, আমি যামু না। ভুইল্যা যাও আমারে …সবাই রে কও মইরা গেছে আসমানী।
হাসমত মিয়ার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না। শুধু মাথায় আসে, দৌড়া হাসমত ! ডুব দে নদীর জলে !
নদীর সামনে গিয়ে দাড়ায় হাসমত। ডুব দিতে পারে না হাসমত, কলিজা ছিদ্র হয়ে হয়ে গেছে আজ তার, আকাশের পানে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে-
“আসমানীরে……ও….. আমার আসমানীইইই……আমার মা রে……”

হাসমত বিশ্বাস করে একদিন ঠিকই ফিরবে তার মা।
একই ভাবে আমরাও বিশ্বাস করি, একদিন ঠিকই ফিরবে আমাদের সকল মা।
হয়তো মৃত, হয়তো জীবিত লাশ হয়ে….