আয় বৃষ্টি ঝেঁপে

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে

এখন বর্ষার খবর- ছবি সবই মিডিয়া বাহিত। অল্প বৃষ্টিতেই কোন রাস্তায় কোমর অবধি জল, কোথাও থাক থাক ইটের ওপোর খাট তুলে দিয়ে অগোছালো সংসার আগলে থাকা, কোথাও মাথার ওপোর গামলা তার ওপোর বুড়িমাকে বসিয়ে জল পেরোবার চেষ্টা, এমনকি জনপ্রিয় অভিনেত্রী জুতো হাতে রিক্সায় বসে জল কাটাচ্ছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

বর্ষার বিবরণ শুনেছিলাম আমার মাসি দিদা, ছোটবেলুনের দিদার কাছে। কোথায় লাগে মিডিয়ার থার্ড আই এফোর্ট!

ছোটবেলুন হলো বর্ধমান জেলার অন্তর্গত ভাতার থানার এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। আমার মায়ের মাসীর বাড়ি। তখনকার দিনে বোনের মেয়ে আর নিজের মেয়ের কোন তফাত থাকতো না। আমরাও আপন মামাবাড়ির আদর পেয়েছি ছোটবেলুনে।

তো, আমার মায়ের মাসি রানীদিদা নাতি- নাতনিদের জুটিয়ে নিয়ে সন্ধেবেলায় গল্পের আসর জুড়তেন। এমন কিছু রাজা-গজা- যুদ্ধ – বিগ্রহের কথা নয়, সাধারন নিত্যিদিনের সাদা সাপ্টা কথা দিদার মুখে, তাঁর বলার ঢংয়ে কেমন অসাধারন রঙীন হয়ে ফুটে উঠতো।

…. তো জানিস ভাই, সেকালে বর্ষাকালকে আমরা রীতিমতো সমীহ করে চলতুম। গাঁ- ঘরের ব্যাপার, বুঝতেই পারিস, আর তখন তো এমন বাড়ির দুয়োর পর্যন্ত বাস আসতো না, বর্ষাকালে যেদিকেই যাই দু- আড়াই ক্রোশ কাদা না ভেঙে পিচ রাস্তায় ওঠার তো বাগ নেই। আর বর্ধমান জেলার তো বিখ্যাত এঁটেল মাটির কাদা! পারতো পক্ষে কেউ বর্ষাকালে বাইরে বেরুতে চাইতোনা। আছাড়ি পিছাড়ি, হাত- পা ভেঙ্গে প্রাণ হাতে করে বাড়ি ঢোকাই তো দুষ্কর! তাই পারতপক্ষে বর্ষাকালে কেউ পথে বেরোতনা।

আর সে বর্ষাও কি যে সে!!
লাগাতার দশ- বারো দিন আকাশ কালো করে ঝমঝমানি বৃষ্টি। আশপাশ- সামনে পেছনে কোনও দিকে দৃষ্টি চলে না। স্নান করা কাপড় চোপড় তিন- চারদিনে ঘরের আওতায় শুকতো। শুকোবার পরেও কেমন স্যাঁতসেঁতে। আবার নতুন করে, রান্না হবার পর, উনুনের ওপোর বেতের ঝুড়ি উবুড় করে কাপড় – চোপড় সেঁকে গরম করে তবে যেয়ে পরনের যুগ্যি!

তো সারা সারা দিনরাতের লাগাতার ঝমঝমানি চতুর্দিক আঁধার করা বৃষ্টি।
আমাদের চাষবাসের ঘরে বর্ষাই তো ভরসা! বর্ষাতেই তো চাষআবাদ।বর্ষাই আশীর্বাদ।

আবার এমন তোড়ের লাগাতার বৃষ্টি সীমা ছাড়ালে আতঙ্কও এনে দেয়। বৃষ্টিরও তো রকমফের আছে ভাই। সারারাত বৃষ্টি হয়ে দিনে যদি রোদ ওঠে, তবে তা চাষের পক্ষে খুব মঙ্গল। গাছে পোকামাকড় লাগতে পারেনা। রোদের তেজে মরে যায়। আর উল্টোটা হলে কিন্তু বড়ই বিপদ। ডাকের কথাতেই আছে :
“দিনে জল রাতে তারা,
সে বছর নিশ্চিত খরা।”
তো, বর্ষা তো আর কারুর বশ নয় ভাই। যেমন বর্ষা, তেমন ফসল, তেমনই সারাটা বছরের জীবনযাপন।

তো, এই বর্ষাকে সমীহ না করে উপায় আছে!!

বর্ষা আসার মাস তিন- চার আগে থেকেই গাঁ- ঘরে সাজো সাজো রব। ভাতের ধান, মুড়ির ধান সব আলাদা আলাদা চেহ্নোত্ করা বস্তায় সিজিয়ে, শুকিয়ে, ভাঙ্গিয়ে এনে থাক করে লাট্ দেওয়া। বাড়ির কর্তা গিন্নির সঙ্গে পরামর্শ করে শহরের বাজার থেকে তিন চার মাস চলার মতো তেল- ঝাল- মশলা- ডাল- পাঁপড়- বাদাম – চিনি- ময়দা- সুজি ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদির বিরাট ভাণ্ডার আগাম খরিদ করে গরুর গাড়ি বোঝাই করে ভাঁড়ার ঘর ভরিয়ে দিতেন। বাড়ির বৌ- ঝিরা চড়া রোদে পিঠ করে ঝোলের বড়ি, ভাজা বড়ি, চালকুমড়োর বড়ি, উচ্ছের বড়ি ইত্যাদি রকম রকম বড়ি বয়েম ভরে মুখ এঁটে রেখে দিতো। কি, না বর্ষা নামলে তো আনাজ কিনতে শহরে যাওয়া যাবেনা, আর শহর থেকেও কেউ গাঁয়ে হাঁটুভোর কাদা ঠেলে বিচতে আসতে পারবেনা। আর হতো আমসত্ত্ব, আমসি, গুড়আম, আমতেল ইত্যাদির স্টক। বড়ো বড়ো পাকা কুমড়ো, আলু, পেঁয়াজ সব ওপোরতলার আলাদা সব্জীঘরে হাওয়া খাইয়ে রেখে দেওয়া হতো। তার পরেও, মেয়ে বৌরা শীত ফুরোতেই বিরাট বিরাট বাঁধাকপি, ফুলকপি ঝিরি ঝিরি করে কেটে চড়া রোদে শুকিয়ে তুলে রাখতো বর্ষায় আনাজ আকালে তরকারিটা চালিয়ে নেবার জন্য। তাবাদে, ঘরের পুকুরের মাছ, হাঁসের ডিম তো পাওয়া যেতোই।

তবে শুধু পেটের কথা ভাবলেই তো হতোনা, আপদবিপদের কথাও আগাম ভেবে রাখতে হতো। মেয়ে – বৌ অন্তঃসত্ত্বা হলে, বর্ষার মধ্যে হবার দিন পড়লে, তাকে শহরে বাপের বাড়ি, কি শ্বশুর বাড়ি রেখে আসা হতো। দুকুলেরই নিবাস পাড়াগাঁ হলে মা সমেত নিকটাত্মীয়ের বাড়ি। ওতে কেউ কিছু মনে করতোনা। তখন ওটাই রেওয়াজ ছিল। সামাজিক কর্তব্য হিসেবে পালন ও করতো সবাই। আর হঠাৎ করে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে, গোটা গ্রাম এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধার করে দেবে বিপদ।
ডুলি বেঁধে কাঁধে করে যত কষ্টই হোক ঠিকপৌঁছে দেবে দূর শহরের হাসপাতালে।

বর্ষা এলেই হলোনা, তাকে রীতিমত সম্ভ্রমভরে বরণ করে তুলতে হতো আমাদের।

10 thoughts on “আয় বৃষ্টি ঝেঁপে

    1. পাঠকের ভাল লাগাই তো লেখার উপার্জন। ভাল থাকুন  ভাই ।

  1. এমনও মুধরও সময় ছিলো একসময়। লিখাটি পড়ে নস্টালজিক হলাম প্রিয় বন্ধু। গুড। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    1. শুভেচ্ছা জানাই। ভাল থাকুন। 

  2. আপনার লেখা যতবার পড়ি আমার কাছে অসাধারণ লাগে দিদি ভাই। কিভাবে লেখেন যে, পাঠককে মুগ্ধ করেই ছাড়েন!! অভিনন্দন দিদি ভাই। :)

    1.   উৎসাহিত হলাম বোনটি।

  3. অপূর্ব এক স্মৃতিমধুরতা। অনেক ভালো লাগা রইলো।

  4. ছোট বেলায় কতো ভিজেছি বর্ষায়! এখন বৃষ্টি হবে ভাব বুঝলেই আগে ছাতার খবর নেই। বৃষ্টির সাথে খিচুড়ির যে সম্পর্ক সেটাও ছোট বেলা বুঝতাম না। এখন বেশ বুঝি। আপনার বর্ষার লেখা পড়তে পড়তে মনে পড়ছিলো ছোট বেলার কথা। অপুর্ব লিখেছেন দিদি। শুভেচ্ছা  ও শুভকামনা নিরন্তর!!!

    1. প্রেরণা পেলাম বন্ধু

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।