চকবন্দি চরাচর ( কিছুটা ) (২)

লাগাতার শুভানুধ্যায়ীর ভিড়। সকালের ব্যাচ বিদেয় না হতেই ঘাড়ের ওপোর উপুড় হচ্ছে দুপুর – বিকেল-রাতের জীবন্ত জ্ঞানভাণ্ডারসমূহ। ক্রমে ক্রমে ভূমিকা- টুমিকার ভদ্রতার বালাই ছিঁড়ে- খুঁড়ে- ফর্দাফাঁই হয়ে উড়ে গেছে ক- বে।এখন সরাসরি জবরদস্ত্ ঝাঁপ প্রসঙ্গেতেই :

— এভাবে কেঁদে কেটে বুক ভাসিয়ে সমস্যার সমাধান হয় নাকি!!

রমা : ভগবান কান্নার শাস্তি দিয়েছেন, তাই ভোগ করছি।

— মেয়েটাকে তো ঘরে ফেরাতে হবে।
নির্মোহে উচ্চারণ করেশুভাকাঙ্খীরা। আর ওই ছোট্ট ‘মেয়ে’ শব্দটিই বজ্রপাত ঘটিয়ে দেয় রমার বুকের ভেতর। কাঁদতে কাঁদতে হিক্কা উঠে যায় রমার। — কী? কী বলতে চাও তোমরা? মারবে? কাটবে? পুলিশে ধরিয়ে দেবে?

আত্মীয়স্বজনদের মতিগতি আতঙ্কে কণ্টকিত করে রমাকে। ভেতরে ভেতরে কাঁপতে থাকে সর্বক্ষণ। এই যদি ঘনিষ্ঠদের মনোভাব হয়, শত্রুরা তাহলে কি ভাবছে!! রাতের ঘুম উঠে গেছে রমার। আলগা তন্দ্রা তো আরো বিভীষিকা। চোখ বুজলেই দেখতে পায় জামাইয়ের রক্তাক্ত শরীর, আর মেয়ের বৈধব্যের বেশ। লাগাতার বারোদিন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে নিরন্তর আত্মীয়স্বজনদের বিষবাণ হজম করতে করতে রমার শরীরে প্রেশার, সুগার দুই-ই আস্তানা গেড়ে বসেছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই অসহ্য লাগছে চেনা-পরিচিত- আত্মীয়স্বজনদের মুখ।

তবু চেষ্টায় ক্ষ্যমা নেই,—আমরা ধর্ম মহাসভার মাথাদের সঙ্গে কথা বলেছি। একটা কিছু সমাধান ওঁরা বার করে দেবেনই। তোমাদের সম্মত হতে হবে। কালা- বোবা রমার বদলে ওর সেজো ভাসুর কথা বললেন।– বলুন, কি সম্মতি চান আপনারা, শুনি।

— এই ধরুন প্রথমেই একটা প্রায়শ্চিত্তির।

— দাঁড়ান, দাঁড়ান। প্রায়শ্চিত্তটা প্রথমেই কিভাবে হবে? মেয়েটাকে তো আগে ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে তো তাকে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করানো যেতে পারে।

— তা, তা কন্যার অভাবে পিতা প্রায়শ্চিত্ত করলেও চলে।

আমার ভাই কি অন্যায় করেছে, যে ওকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে?

সে আমরা কাশী পর্যন্ত লোক পাঠিয়ে দিয়েছি। তো ওঁরা বিধেন দিয়েছেন, উচিত মূল্য ধরে দিলে যজমানের হয়ে ওঁরাই কাজটা করে দেবেন।

উচিত মূল্য কতটি?

— সে ধরুন গিয়ে, ( খানিক মনেমনে বিড়বিড় করে) ধরুন, সব খরচ খরচা মিলেমিশে এই হাজার সত্তরে কুলিয়ে যাবে।

—বলেন কি!! স- ত্ত- র হাজার!”

—এটা কোন চমকাবার কথা হলো! বাঁড়ুজ্জে মশায়ের মেয়ের বিয়ে দিতে কোন্ না লাখ দুয়েক টাকা গলে যেতো। আর সত্তর হাজার আপনাদের বেশি মনে হচ্ছে?

—বেশ। দেখি ভাইকে বলে…..

একটু পরে দুভাই ফিরে এলেন। স্বামীকে এই আলোচনায় আসতে দেখে রমা অবাক। এতদিনের মধ্যে এই প্রথম।

— দেখুন, আপনাদের কথাগুলো ভাইকে বলেছি। এখন ওর কতক ছোটখাটো প্রশ্ন আছে..

— বলুন।

— প্রায়শ্চিত্ত না করে শুধু যজ্ঞ দিয়ে কাজটা সারতে পারবেন না?

— তাই কখনো সম্ভব? প্রায়শ্চিত্ত — ধর্মান্তরকরন– এগুলো সেরে না নিলে মেয়ে – জামাইকে ঘরে তুলবেন কি করে?

— প্রায়শ্চিত্ত কে করবে?

— ওসব আলোচনা আপনার দাদার সঙ্গে হয়ে গেছে…

–তবে? ধর্মান্তরকরনটা কি করতেই হবে?

— ওদের জাতে তুলতে গেলে তো করতেই হবে

— কাকে?

—আপনার মেয়ে- জামাই দুজনকেই।

— মেয়েটা নাহয় আমার, আবার জাতে উঠে এলো। কিন্তু জামাই রাজি হবে কেন?

— আপনার মেয়েকে ভালবাসে, তাই রাজি হবে।

— ওর বাবা- মা নেই? সমাজ- সংসার নেই? ও কি বানের জলে ভেসে এসেছে?

— তার আমি কি জানি? আপনাদের ভাল চাই, তাই…

— ভালই যদি চান,তবে যে প্রক্রিয়ায় আমার মেয়ের বদলে আমি, আমার বদলে অর্থমূল্য নিয়ে আপনি প্রায়শ্চিত্ত করছেন, ওই একই পদ্ধতিতে আমার মেয়ে – জামাইয়ের বদলে আপনি আপনার এক সাগরেদকে নিয়ে ধর্মান্তরিত হোন। মূল্য ধরে দেবে আমার দাদা। আর হ্যাঁ, ওইসব ভুজুংভাজুং যজ্ঞ-ফজ্ঞ আমার বাড়িতে হবেনা। আপনি কোথায় করবেন সেটা নিজে ঠিক করে নিন। খবর দিলে বাড়ি থেকে কেউ একজন যাবে। পেমেন্ট তার হাতেই পেয়ে যাবেন।

গালে বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় খেয়ে মাথা হেঁট করে তখনকার মত গেট পেরিয়ে বেরিয়ে গেল বটে, কিন্তু পরদিন থেকেই ধর্মমহাসভার লোকজনদের প্রকাশ্য তৎপরতা একশো গুন বেড়ে গেল।পাড়ায় পাড়ায় এখানে সেখানে জটলা হতে লাগলো। কারা যেন রাতের অন্ধকারে গেটের বাইরে পোস্টার দিয়ে গেছে, অসীমেশ ব্যানার্জীকে খুন করা হবে।কারন, সে নিজেই নাকি মেয়েকে বিনা পয়সায় পার করার জন্য বিধর্মীর ঘরে তুলে দিয়ে এসেছে।

সনাতনধর্ম তার জন্য বিপন্ন।

ওদিকে কর্মস্থলে, ঈর্ষাপরায়ন সহকর্মীরা, ঘোলাজলে মাছ ধরতে কোমর বেঁধে নেমে পড়লো।

(আরো আসবে)
—————-

7 thoughts on “চকবন্দি চরাচর ( কিছুটা ) (২)

  1. লিখাটি পড়তে গিয়ে মনে হলো কেন এতো সংক্ষিপ্ত হলো। বড় হলো না কেনো !! চলুক। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    1. একটা পাঁচশোরও বেশি পাতার উপন্যাস এটি।

      আধখামচা ভাবে দিচ্ছি এখানে।তবু যে যত্ন নিয়ে পড়ছেন, এর জন্য অশেষ ধন্যবাদ।          

  2. এই খণ্ডে এসেও মুগ্ধতা প্রকাশ করছি দিদি ভাই। আদাব।

  3. একজন ভারতবাসী হিসেবে পর্বটিকে আমাদের সামাজিক দর্পণ হিসেবে মনে করি।

  4. (আরো আসবে)

    আসুক, আমরা সাথে আছি… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।