শাশুড়ি সমাচার

শাশুড়ি সমাচার

ঠাম্মা- দিম্মারা ছড়া কাটতেনঃ
ঝি জব্দ কিলে / হলুদ জব্দ শিলে
মেয়েমানুষ জব্দ হয়/ শ্বশুরবাড়ি গেলে।

এ প্রবাদ আজ পরিত্যক্ত। থালায় বসিয়ে গৌরীদানও আর হয়না। শাশুড়ি ও কচি বউকে পই- পই পাখিপড়া করে সংসারের পাঠদান করার কোনো সুযোগ আর পাননা। বস্তুত অধুনা গায়ে- গতরে, বয়সে – শক্তিমত্তায়, বুদ্ধি – বিদ্যাবত্তায়, শক্ত – সমর্থ বৌমার আতঙ্কে (বোমাতঙ্কের থেকে কী তফাৎ) শাশুড়ি কুল আজ কোনঠাসা। ছড়ার তিন নম্বর লাইনের অন্তিম শব্দটি ‘করে’ শব্দটির সঙ্গে স্থানবদল করেছে। ফলতঃ শাশুড়িদের স্বর্ণযুগ ইতিহাসে চলে গেছে। সে যুগে হুট্ বলতেই গোঁসা হলে কাশীগমনের হুমকি দিয়ে বৌ- ব্যাটাকে ব্ল্যাকমেল করা চলতো। আর একটু বলবতী সধবা হলে তো কথাই নেই, – তখনো মুখচোরা বৌমাটিকে ‘দেখতে নারি, তোর চলন ব্যাঁকা’ বলে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে বশংবদ ছেলেটিকে আবারও ছাদনাতলা ঘুরিয়ে আনা ছিল জলভাত ব্যাপার।

অধুনা শাশুড়ি তিন প্রকারঃ
ক) ক্রিমিনাল
খ) মায়ের মতো
গ) ক এবং খ – এর মাঝামাঝি। যার কাছে যেমন তার কাছে তেমন। চলনসই মাখা-সন্দেশ, যেমন ছাঁচে ফেলতে চায় সংসার।

ক) ক্রিমিনালঃ – যাদের কাছে পানের থেকে চুন খসারও দরকার পড়ে না। নিজেদের লোভ আর স্বার্থসিদ্ধির জন্যে যারা অন্দরমহলে দেদার দেশলাই – কেরোসিন – এ্যাসিডের বোতল – বিষের শিশি হাতের কাছেই মজুত করে রাখে। ওইসব কষাই, ফাঁসুড়ে, জল্লাদ শাশুড়িদের সমাজ – সংসার – আইন কোনো কিচ্ছু নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। যে করেই হোক পথের কাঁটা উপড়ে ফেলতে, থেঁতলে যেতে এদের দুবার ভাবতে হয়না। এরা জন্মসূত্রে ক্রিমিনাল। পুলিশ ও প্রশাসনের সাবজেক্ট। আমার লেখা পড়ে ওদের কচু হবে। তাই ওরা আলোচনা থেকে বাদ।

খ) মায়ের মতোঃ বিরল প্রজাতির এই মহিলারা কস্মিনকালেও কক্ষনো কারো আলোচনার মশলা জোগান না। পারসেন্টেজেও আসেন না। তাই বাদ পড়লেন এঁরাও।

গ) চলনসইঃ মনোমত বউমা পেলে এঁরা সুখী হবেন। কপালগুণে উল্টোটা হলে নিত্যকার লোকহাসাহাসির ভয়ে, নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্কে জীয়ন্তে মরে থাকবেন। এই চলনশীল শাশুড়ি গোষ্ঠীর মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে একটা গড়পড়তা ছবি আপনাদের কাছে তুলে ধরছি।

এঁদের পক্ষের সম্ভাব্য আশঙ্কাগুলি হলোঃ
১) পরের মেয়ে বেনোজল হয়ে ঢুকে পড়ে আমার ঘোরোজল পেটের ছেলেটিকে বার করে নিয়ে যাবে না তো?
২) সংসারে থেকেই যদি যায়, আমার পাতে অবহেলার ভিক্ষান্ন ছুঁড়ে দেবে না তো?
৩) এতকাল ধরে, এতো কষ্ট সয়ে যে সোনার সংসার গড়ে তুললাম তা ছারখার করে দেবে না তো?

এই প্রশ্নত্রয়ীর ক্রমানুযায়ী উত্তর দিয়েছেন শাশুড়িরাঃ
ক) পুরোপুরি গৃহবধূ সধবা শাশুড়িঃ ১) মেয়ের মতো ভালবাসবো, তাও যদি আলাদা হতে চায় হবে। মেনে নেবো। ২) নিজেদের অন্ন নিজেরাই দুটি ফুটিয়ে নোবো। আর,হে ঈশ্বর! আমি যেন কর্তার আগে চোখ বুজতে পারি। ৩) শিখিয়ে পড়িয়ে মানিয়ে গুনিয়ে নোবো। তবু যদি একান্তই না মানে, আলাদা হবে। সংসারে লক্ষীর আসনে ভূতনেত্য করতে দেবো না।

খ) একা হয়ে যাওয়া বিধবা শাশুড়িঃ
১) উত্তর নেই, নির্বাক। অনুমান করে নিলাম স্বগতোক্তি করছেন, “কাকে ছেঁটে ফেলতে আলাদা হবি, খোকা”? ২) মানুষের মৃত্যু কেন তার ইচ্ছাধীন নয়?
৩) আমার কপালে তো কিছুই হলোনা, ওরা যেভাবে পারে, যেমনভাবে ইচ্ছে, সুখের আশ্বাস জাগিয়ে তুলুক, এই পোড়াচোখে তো দেখে যেতে পারবো নিজের সন্তানের আনন্দ – দীপশিখা।

গ) স্বোপার্জিতা কর্মরতা শাশুড়ি ( সধবা, বিবাহ বিচ্ছিন্না বা বিধবা)
১) ছেলে -বউয়ের জীবন তাদের নিজস্ব, ব্যক্তিগত। ওদের যেভাবে, যেখানে থাকতে ভালো লাগবে, সেভাবেই সেখানেই থাকুক না। ২) এ সুযোগ দেবো না। ৩) ‘আমার সংসার’ ‘আমার সংসার’ বলে এতো মাতামাতির কিছু নেই। ওদের মতো করে ওরা যেটা করবে, তার নামও সংসারই। আদৌ সন্ন্যাস বা বানপ্রস্থ নয়।

সমস্ত উত্তর গুলোর একটাই ‘কী ‘ পয়েন্ট, – এ্যাডজাস্টমেন্টের সঠিক সুলুক সন্ধান জানা না থাকায়, কমবেশি প্রত্যেকের সুরেই অসহায়তা, নিরাপত্তাহীনতা। এসব ক্ষেত্রে চটজলদি রেডিমেড টিপস্ হয়না। তবু দেখুন নাঃ

১) সব পরিস্থিতিতে মোটামুটি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুন। ২) প্রত্যাশার পারদ নিচে নামিয়ে রাখুন। ৩) ছোটোখাটো দোষ ত্রুটি ওভারলুক করুন, কিন্তু ইচ্ছাকৃত নীচতা- ক্ষুদ্রতা বুদ্ধিদীপ্ত ভাবে রুখে দিন। ৪) তরবারি দিয়ে দাড়ি চাঁচবেন না। হোক না সে আপনার একান্ত বাধ্য পুত্রটির পত্নী, তার যোগ্যতাকে যথাযথ সম্মান দিন। ৫) সর্বোপরি ভেবে নিন, এ যুগটাই এমন।
আহ্লাদীরা কেবলই ভালবাসা দখল করে নেয়। বিনিময়ের অঙ্ক ওদের হিসেব করতে শেখায়নি কেউ। ওই তো গান গেয়ে ছেড়ে দিয়েছে, “… দাদা অঙ্ক কী কঠিন…”

ছোট্ট একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করবো। এটা আমার ছোটবেলা থেকে অদ্যাবধি প্রাণের প্রিয় বন্ধু ও সম্পর্কে মাসী অধ্যাপক ছায়া মুখার্জির বয়ানে শুনতে হবেঃ

“গ্রীষ্মের ছুটিতে বোনেরা সবাই ছেলেপুলে নিয়ে বাপের বাড়ি ( বাঁকুড়া জেলার সোনামুখি) জুটেছি। যার যার ঝাঁপি থেকে অনর্গল শাশুড়িকৃত্য বেরুচ্ছে। শুনশান্ ঘুঘু ডাকা গ্রীষ্মের লম্বা দুপুরের গল্প, ফুরোয় আর না। হঠাৎ সদর দরজার রাস্তার মুখ থেকে আমার পাঁচ বছরের বোনঝির চিল্ – চিৎকার। ভয়ে পড়ি কি মরি করে বাড়িসুদ্ধ লোক হাজির খাঁ খাঁ করা রোদে পোড়া রাস্তার ওপোর —-। একা একজন হতদরিদ্র পরিশ্রান্ত কালিঝুলি মাখা মাথার ওপোর বিরাটকার চুড়োয় বাঁধা রুক্ষ চুলের ভয় পেয়ে যাবার মতো চেহারার এক বয়স্কা আদিবাসী মহিলা ক্লান্ত পায়ে ধীরেধীরে পেরিয়ে যাচ্ছে পথ, —- তার দিকে আঙুল দেখিয়ে ভয়ার্ত বোনঝি বললো, “ওই দ্যাখো দ্যাখো, ওই যে একটা শাশুড়ি যাচ্ছে দ্যাখো, এক্ষুনি আমাকে শ্বশুরবাড়ি টেনে নিয়ে যাবে।”

পাঁচ বোনের হতবাক মুখের ওপোর জ্বলন্ত দৃষ্টির থাপ্পড় মেরে মা শুধু বলেছিলেন, “ছিঃ! ছেলেমেয়েদের সামনে গুরুজনদের এই ছবি এঁকে ধরতে তোমাদের লজ্জা করেনা? এই তোমাদের শিক্ষা!”

_____________
( ‘এবং প্রবন্ধ’ থেকে)

12 thoughts on “শাশুড়ি সমাচার

  1. অধুনা শাশুড়ি তিন প্রকারঃ
    ক) ক্রিমিনাল
    খ) মায়ের মতো
    গ) ক এবং খ – এর মাঝামাঝি। যার কাছে যেমন তার কাছে তেমন।

  2. অদ্ভুত বিশেষায়ণ এবং সলিউশন। দারুণ আপনার মূল্যায়ণ দিদি। মুগ্ধতা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  3. শাশুড়িদের স্বর্ণযুগ ইতিহাসে চলে গেছে। সে যুগে হুট্ বলতেই গোঁসা হলে কাশীগমনের হুমকি দিয়ে বৌ- ব্যাটাকে ব্ল্যাকমেল করা চলতো। আর একটু বলবতী সধবা হলে তো কথাই নেই, – তখনো মুখচোরা বৌমাটিকে ‘দেখতে নারি, তোর চলন ব্যাঁকা’ বলে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে বশংবদ ছেলেটিকে আবারও ছাদনাতলা ঘুরিয়ে আনা ছিল জলভাত ব্যাপার।

    অসাধারণ কথন। আপনার জন্য শুভেচ্ছা দিদি। 

  4. কবিতার পাশাপাশি আপনার এমন লেখা গুলোও চমৎকার হয়। :)

  5. ওরে বাবা!

    কী বিরাট গবেষণা!

    প্রিয়তে রাখি, বিয়ের পর মিলিয়ে দেখবো….https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Razz.gif.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।