স্মৃতির সরণি

স্মৃতির সরণি

মহালয়া চলে গেলো। পিতৃপক্ষের শেষ, দেবীপক্ষের শুরু। এইদিন পুর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে জল দিতে হয়, সারা বছর তারা তৃষ্ণার্ত থাকেন। কিন্তু মাতৃকুলের কি জল তেষ্টা পায় না? তাদের জল দেওয়ার রীতি নেই। আমি যেহেতু সৃষ্টি ছাড়া, নিয়মের তোয়াক্কা করি না। আমি জল দিই। তিনজনকে। তাদের মধ্যে দুজন মহিলা একজন পুরুষ। মহালয়ার দিন সারাদিন মন খারাপের ঘর বাড়ি হয় আমার ভেতর প্রতি বছর। যে পুরুষের উদ্দেশ্য আমি সক্কাল সক্কাল স্নান করে জল দিই তার জন্য।

তিথি অনুযায়ী মহালয়ার ঠিক দুদিন পরেই আমার জন্ম। অর্থাৎ দেবীপক্ষে। সেই সময় বাড়িতে আমার নাম রাখা নিয়ে হুলুস্থুল পড়ে যায়। তারপর রিয়া নামই বেছে নেওয়া হয়। মহালয়ার দিন নানান স্মৃতি ভীড় করে আসে। আমাদের একটা দেশলাই বাক্সের মতো বড় কাঠের রেডিও ছিলো। বাড়িতে তখনও টেলিভিশন আসে নি। একান্নবর্তী পরিবার ছিলো আমাদের। সব কিছুই নিয়মমতো। মহালয়ার আগে বাড়ি ঘর পরিষ্কার করা হতো। নতুন রং করা হতো। আমাদের এখনকার মতো যখন তখন জামা কেনা হতো না। পয়লা বৈশাখ আর পুজো বছরে এই দুবার নতুন জামা কেনা হতো। জেঠু, বাবা কাকাই তিনজন তিন রকম জামা দিতো। মহালয়ার আগের দিন রেডিও ঠিকমতো বাজছে কিনা দেখে নেওয়া হতো। দাদুর ঘরে ছিলো ওই রেডিও। রাতের বেলা বড়মা দাদুকে বলে রাখতেন “বাবা একটু জোরে চালাবেন রেডিও, যাতে আমরাও শুনতে পাই।”

যে পাড়ায় আমি বড় হয়েছি, সেখানে তখনও হিন্দু মুসলিম মিলে মিশে উৎসব করতো। এখনের কথা বলতে পারবো না। দীর্ঘ ১৮ বছর আমি শিকড়হীন। অর্থাৎ সেই পাড়া ছেড়ে এসেছি। আমরা কখনও ঘড়িতে এলার্ম দিতাম না। ছোটথেকেই জানতাম ভোরের আজানের সময় ঘুম থেকে উঠে পড়তে হবে, কারণ মহালয়া শুরু হবে। যেহেতু আমি দাদুর কাছেই ঘুমোতাম তাই খুব ছোটবেলায় অতো ভোরে দাদু জোরে রেডিও চালালে, আমার ঘুম ভেঙে যাওয়ার জন্য তুমুল কান্না জুড়ে দিতাম। “যেখান থেকে পারো আমার ঘুম এনে দাও।” বড়মা বলতেন “কাঁদিস না, একটু সকাল হলেই জেঠু ঘুম কিনে নিয়ে আসবে। ততক্ষণ কাকাইয়ের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। ওদিকে আওয়াজ যাবে না।” আমিও একরাশ বিরক্তি ভরা মুখ নিয়ে ওপরে উঠে গেলাম। কাকাই দরজা খোলা রাখতো, কারণ প্রতি বছর তো একই গল্প। আমি কাঁদতে কাঁদতে ওপরে উঠবো। কাকাই আমাকে রিয়া বলে ডাকতো না, একটা বিশেষ নামে ডাকতো। কাকাই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো আর আমি ঘুমিয়ে পড়তাম।

পুজোর আগে নতুন জামা কাপড়ের মতোই নতুন শ্যাম্পু সাবান, পারফিউম কেনা হতো। সারা বছরের শ্যাম্পু, সাবানের সাথে ওই শ্যাম্পু, সাবানের মিল থাকতো না। ওগুলোর মধ্যে কেমন একটা পুজো পুজো গন্ধ মিশে থাকতো। আমাদের বাড়িতে ষষ্ঠী, অষ্টমী আর দশমীর দিন নতুন জামা পরার রীতি। সেদিন সকাল সকাল স্নান করে নতুন জামা পরে মাঠে খেলতে চলে যেতাম। সেই সময়ে পুজোর জন্য HMV থেকে আলাদা গানের রেকর্ড বেরোতো। সেইসব গান পাড়ার প্যান্ডেলে বাজতো। একটা অদ্ভূত আনন্দে মন ভরে থাকতো। কিশোর কুমার, মহম্মদ রফি, মান্না দে, হেমন্ত, গীতা দত্ত, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখার্জী, ওই সময়ের সমস্ত গায়ক গায়িকা পুজোর গান রেকর্ড করতেন। সেইসব গান আজ মনকেমনিয়া।

পুজো আজও আসে। জামাকাপড় এখন দেওয়ার লোক কমে গেছে, নিজে নিজেই কিনি। পুজোর ঠিক এক মাস আগে বাবা ফোন করে জানতে চাইবেন “এইবার পুজোতে কি কি শাড়ি উঠেছে রে।” কখ‌নো বাবার কাছে কিছু চাই নি। আজও বলি তুমি জেনে কি করবে? বাবা বলেন দিতে হবে না, মা, বড়মা, কাকিমা, বোনদের, তাই জেনে নিই। উত্তরে আমি বলি, আমি সবার জন্য কিনে ফেলেছি বাবা, তোমাকে আর কিনতে হবেনা। তুমি তাঁত কিনে দিও সবাইকে। অঞ্জলি দেবে তাঁত পরে। বাবা হা হা করে হেসে ওঠেন। হয়তো বোঝেন যে রিটায়ার করেছেন বলে তার মেয়ে তাকে বেশি খরচ করতে দিতে চায় না। একদিন নাতি নাতনীদের নিয়ে তিনি বেরোন, যার যা পছন্দের কিনে নিতে বলেন। রিতিকা আমার মতোই, বলে দাদাই মা তো অনেক কিছু কিনে দিয়েছে তোমাকে আর কিছু দিতে হবেনা। বাবা বলে ওঠেন বড় হয়েছিস বুঝি?

পুজো এখনও আসে, সাথে ছোটবেলার সেই আনন্দ আর ফিরে আসে না। এখন সব কিছুই রোবটের মতো। হয়তো বড় বেশি যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি আজকাল।

10 thoughts on “স্মৃতির সরণি

  1. 'পুজো এখনও আসে, সাথে ছোটবেলার সেই আনন্দ আর ফিরে আসে না। এখন সব কিছুই রোবটের মতো। হয়তো বড় বেশি যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি আজকাল।' আমরাও। :(

    1. ঠিক বলেছেন প্রিয় বন্ধু। শুভেচ্ছা নিন ভাল থাকুন।

  2. “যেখান থেকে পারো আমার ঘুম এনে দাও।” বড়মা বলতেন “কাঁদিস না, একটু সকাল হলেই জেঠু ঘুম কিনে নিয়ে আসবে।

    মোংলায় থাকার সময় আমার বাসার নিচতলায় সামসু ভাইয়ের ছোট মেয়ে বলত আমার সব কান্না মাটিতে পরে যাচ্ছে কেও ধরছনা কেন? আজও ওকে সেই কথা মনে করিয়ে দিলে হো হো করে হাসে। কাকু আমি কি এত ছোট ছিলাম কখনও? সে এখন দুই ছেলের মা।

    পুজো এখনও আসে, সাথে ছোটবেলার সেই আনন্দ আর ফিরে আসে না। এখন সব কিছুই রোবটের মতো। হয়তো বড় বেশি যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি আজকাল।

    ঘুরে ফিরে সবারই এক কথা, বাশী কই আগের মত বাজেনা!

    সিদিনের দিনগুলির কথা পড়তে খুবই ভাল লাগল দিদিভাই। অনেক অনেক ভালবাসা এই দিনে।

    1. দারুণ ভাবে জীবনের ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়েছেন খালিদ দা। বাঁশী আর আগের মত বাজে না। ধন্যবাদ।

  3. পুজো এখনও আসে, সাথে ছোটবেলার সেই আনন্দ আর ফিরে আসে না। এখন সব কিছুই রোবটের মতো। হয়তো বড় বেশি যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি আজকাল।

     

    * যান্ত্রিক জীবন ও বাস্তবতা আমদের অনেক কিছু কেঁড়ে নিয়েছে।

    সুপ্রিয়, শারদ শুভেচ্ছা… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  4. দিন যাচ্ছে আর অনেক কিছু হারাচ্ছি আমরা । হারানোর তালিকায় যুক্ত হয়েছে মায়া মমতাও । ধণ্যবাদ আপু সুন্দর লেখার জন্য । 

  5. আমার স্মৃতিচারণ

    রিয়া রিয়া শ্রদ্বেয় দিদি, আপনার লেখা পড়ে মনটা চলে গেল সেই ছোটবেলার স্মৃতিতে। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১১বছর। সময়টা ছিল ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি। তখনকার সময়ে এই বঙ্গদেশের প্রতিটা জেলাশহরে একযুগে চলছিল দুর্ভিক্ষ। সেই দুর্ভিক্ষপীড়িত সময়ে আমরা সপরিবারে থাকতাম নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন আদর্শ কটন মিল অভ্যন্তরে। চলছিল আশ্বিনের শুভাগমনে শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি। যত দুর্ভিক্ষই হোক-না-কেন, মিল কর্তৃপক্ষ মিল অভ্যন্তরে দুর্গাপূজা করবেই। দুর্গাপূজা উপলক্ষে মিলের ভেতরে থাকা সব হিন্দু ধর্মাবলম্বী যার যার সাধ্যমত কেনাকাটা করছে। শুধু কেনাকাটা নেই আমাদের সংসারে। কারণ, বাবা চিত্তরঞ্জন কটন মিলে ক্যালেন্ডার মেশিনে কর্মরত অবস্থায় ডানহাতে চারটে আঙুল হারিয়ে ঘরে শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে, আর মৃত্যুর প্রহর গুনছে। সেই সময়ই ঘরে ঘরে শারদীয় দুর্গোৎসবের আনন্দ। আমাদের সংসারে আমিই একমাত্র ছোট। আমার বড় আরও দু'বোন ছিল। সে সময় তাঁরা বিয়ের উপযুক্ত হওয়ায় সংসারের দুঃখকষ্ট বুঝতো। বুঝতাম না শুধু আমি। মিলের ভেতরের আরও দশজন ছেলেমেয়েদের নতুন পোশাক দেখে আমিও নতুন জামাকাপড়ের জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম। আমার মা তখন নিরুপায় হয়ে বাঁশের খুটিতে নিজের কষ্টের জমানো সিকি-আদলি বের করলেন। দু'বোন মিলে গুনে দেখলেন, মোট বিশ টাকা হয়েছে। মা সেই বিশ টাকা আমার বড়দা'র হতে দিয়ে বললেন, "যেভাবেই হোক এই টাকা দিয়ে ওর জন্য একটা জামা আর একটা হাফ প্যান্ট কিনে নিয়ে আয়।" মায়ের জমানো সেই টাকা দিয়ে বড়দা একটা গাউনের জামা  আর একটা হাফ প্যান্ট কিনে এনে দিয়েছিলেন। সেই গাউনের জামা পেয়ে দুর্গোৎসবের অনন্দ উপভোগ করেছিলাম মনের আনন্দে।

    আজ আপনার লেখা পড়ে সে সময়ের অভাবের দিনের কথা আর স্মৃতিবিজড়িত ঘটনাবলি আবার মনে পড়ে গেল। লেখার আরও অনেককিছুই ছিল দিদি। লিখলাম্র না, মন্তব্যের বক্স ভারি হয়ে যাবে বলে। তবে এ নিয়ে কিছু লিখে শব্দনীড়ে আমি একটা পোস্ট করবো বলে মনস্তাপ করেছি। দেখি সময় আর সুযোগ বুঝে অতি শীঘ্রই পোস্ট করবো। আপনার জন্য সদা শুভকামনা রইল। সাথে শারদীয় শুভেচ্ছা ।

    নিতাই বাবু
    ১০/১০/২০১৮ইং

  6. আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম…. পুরো গানটা যথার্থ

    চমৎকার এই স্মৃতিপট এর জন্য।

    শারদ শুভেচ্ছা ও প্রীতি জানবেন শ্রদ্ধেয়া রিয়া দিhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।