মাইকের শব্দে হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলাম, একটা রিকশায় লাগানো মাইক থেকে ভেসে আসছে “একটি নিখোঁজ সংবাদ”
আজ একটা শুভদিন,অনেক কষ্টে আজ একটা টিওশানি পেয়েছি। এমন একটা দিনে হারিয়ে যাবার কাব্য শুনতে মোটেও ভাল লাগছে না, তাই শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলাম বাথরুমে, অন্য কিছু ভাবার অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু হচ্ছেনা, মাইকটা অনেক দূরে হলেও শব্দগুলো যেন খুব কাছ থেকে শুনতে পাচ্ছি, অসস্থি লাগছে, ঝিনঝিন করছে মাথাটা। মনে হচ্ছে কানের খুব কাছাকাছি এসে কেউ ফিসফিসিয়ে বলছে “একটি নিখোঁজ সংবাদ”
সেই ছোটবেলায় একবার মাঠে লাটিম ঘোরানো থেকে শুরু, চকচকে লাল একটা লাটিম কিনে দিয়েছিলেন বাবা, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খেলতে খেলতে হঠাৎ একটা ঝোপের দিকে ছুটে গেল লাটিমটা, পিছু ছুটলাম, বন্ধুদের ডাকলাম তারাও সাহায্যের জন্য এসে হাত দিয়ে সরাতে লাগল কাটাঘেরা ঝোপঝাড়, প্রায় ঘন্টাখানেক টলটলে চোখ আঁকড়ে ধরে খুঁজলাম অথচ লাটিমের টিকিটাও খুঁজে পেলাম না কোথাও, শেষরক্ষা হলোনা, কষ্ট আমার অবুঝ চোখ গড়িয়ে জল নামিয়ে দিল বুক পর্যন্ত। বেশ কদিন পর আমি ঠিক আমার সেই লাটিমটা দেখেছিলাম অন্য একটি ছেলের হাতে, সেদিন ঠোঁটের কোনের সে হাসিটা এখনো আমার ঠোঁটে। আমি লাটিমটা ফেরত চাইনি, শুধু ভেবেছি আমার কাছে না হোক অন্তত সে আছে, অন্তত কোন নিখোঁজ সংবাদ সে নয়।
প্রায় দশটা বাজে, এগারোটায় ছাত্রের বাসায় যেতে হবে, আধঘন্টার মত সময় হাতে আছে, বাসে যেতে পনের মিনিটের মত সময় লাগবে, আজ প্রথম দিন তাই ভাবছি রিকশাতে চড়েই যাই, অন্তত শার্টের ইনটা ঠিকমত থাকবে।
রিকশাতে চড়েই প্রথমে পকেটে হাত চলে গেল, হ্যা সব ঠিকঠাক আছে, রিকশা চলছে তার আপন গতিতে, হঠাৎ কে আবার ফিসফিসিয়ে বলে উঠল “একটি নিখোঁজ সংবাদ”
সেবার সবে মেট্রিক দিয়েছি, ছুটিতে নানুবাড়িতে গিয়ে সে কি হৈহুল্লোর, সবাই মিলে সেখানকার একটা জোড়া পুকুড়ের ঘাটে ভর দুপুরে পানিতে ঝাপাঝাপি করছিলাম, দেখছিলাম কে কার চেয়ে বেশি সময় পানিতে থাকতে পারে, পানির নিচের পরিবেশটা আমার খুবই ভাললাগে সবসময়ই, ভাবলাম দেখি কে কে উঠেছে, পানি থেকে মাথাটা বের করতেই চোখটা যা দেখল তা কখনোই ভুলতে পারিনি, একটা মেয়ে, নির্ঘাত পরী, টেলিফোনের তারের মত কোমড় পর্যন্ত ভেজা কালো চুলগুলো সেটে আছে দুধরঙা গায়ে, এতক্ষণ সে আমাদের আশেপাশেই ছিল হয়ত, খেয়াল করিনি, অথচ গোসল শেষ করে সে উঠে যাচ্ছিল, বন্ধুদের ডাকে হুস ফেরে, আমি আবার ডুব দেই, ৩০ সেকেন্ডের মত পানিতে ছিলাম তখন। পানি থেকে উঠে আমি আর তাকে কোথাও দেখতে পাইনি, দৌড়ে ঘাটের ওপরে উঠলাম, নাহ কোথাও নেই, এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল মেয়েটিকে সেও দেখেছে তবে তাদের মধ্যে কেউ তাকে চেনেনা। আমি ষ্পষ্ট মনে করতে পারি তার লাল ঠোঁটটার বা পাশের তিলটা অথচ জলজ্যান্ত মানুষটাকে আর কোথাও দেখিনি, কখনো জানতেও পারিনি কে সে! সে ছিল আমার জীবনে মনে রাখার মত আরো একটি নিখোঁজ সংবাদ। ন বছর কেটে গেছে অথচ এখনো তার মুখখানা আমার কাছে স্পষ্ট।
এইতো কিছুদিন আগে নানুবাড়িতে একটা জরুরি প্রয়োজনে গিয়েছিলাম, গাড়ি থেকে নামার সময় বামদিকে টিকেট কাউন্টারের পাশের সিগারেটের দোকানে তাকালাম অনিচ্ছায়, অন্যদিকে ফিরিয়েও নিয়েছিলাম চোখ, হঠাৎ মনে হল আমি কিছু একটা দেখেছি যা আমার খুব চেনা, হ্যা সেই মেয়েটি,সেই টেলিফোনের তার, কিছু না ভেবেই পা চালালাম, একটু সামনে যেতেই দেখলাম তার পেছন থেকে একটা ছোট বাচ্চা তার শাড়ির আচল জড়িয়ে রেখেছে, অবাক হইনি এতটা সময় পেরিয়ে গেছে, এতো স্বাভাবিক। অবাক হলাম যখন দেখলাম একটা ছেলে এসে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে মেয়েটার হাত ধরে সামনে আসছিল, ছেলেটি আমার সেই বন্ধু যাকে আমি মেয়েটার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আমাকে চিনে ওবন্ধুটি না চেনার ভান করে আমার সামনে দিয়ে চলে গেল, পরে জানতে পেরেছিলাম মেয়েটি ছেলেটির চাচাতো বোন। খুব হেসেছিলাম, কষ্ট লাগছিল না একফোঁটাও, আমি তাকে পেয়েছি, অন্তত কোন নিখোঁজ সংবাদ সে নয়।
রিকশাওয়ালার ডাকে ঘোর ভাঙলো, ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সামনে এগুলাম,পকেট থেকে ঠিকানাটা বের করে হাতে নিয়ে দেখলাম, ৭৮/এ, হ্যা ঠিকানাটা এ বাড়িরই। বেল টিপতেই দারোয়ান টাইপ একটা লোক গেটের ভেতর থেকে বলল কাকে চাই? আমি পরিচয় দিয়ে বললাম আমি এ বাড়ির বাচ্চার নতুন শিক্ষক, তার মুখটা ছোট হয়ে গেল নিমেষেই, সে বলল আপনি ছোট সাহেবের শিক্ষক! কিন্তু ছোটসাহেবকে তো গতকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না..
বেশ ভাল লাগা রেখে গেলাম সুপ্রিয়।

অনেক ধন্যবাদ খালিদ ভাই
স্মৃতিকথা শেয়ার করাও এক ধরণের শিল্প।
শেষের চমকটি অসাধারণ লেগেছে দাদা। 
এটা স্মৃতিকথা নয় দিদি ,এটা একটা কাল্পনিক গল্পমাত্র।
অসাধারণ অণুলেখা নিশাদ দা।
অনেক ধন্যবাদ দাদা।
জীবন স্মৃতিকথা'র সাথে সাথে অণুগল্পের প্রধান চরিত্রের হেলোসিনেশন ফীল করলাম মি. একজন নিশাদ। কেমন আপনার ব্যস্ততা চলছে ? ফ্রি হোন স্যার।
এইতো হলাম প্রায়।
* শৈল্পিক…
ধন্যবাদ দিলওয়ার ভাই