রোগী
দিগন্ত পালিত
মাঝপথেই গাড়িটা খারাপ হয়ে গেল। কলকাতা যাচ্ছিলাম। গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। ড্রাইভার সব চেক করার পর বলে ঠিক করতে দেড় – দুই ঘন্টা লাগবে। জায়গাটা সম্পূর্ণ শুনশান। বাড়িঘর কিছুই চোখে পড়ছে না। শুধুমাত্র কিছু গাছপালা দেখা যাচ্ছে।
এমন সময় একটা ছেলে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞাসা করে, তুমি কি ডাক্তার ?
আমি বলি, কী করে বুঝলে?
– তোমার গলায় ঝোলানো যন্ত্রটা দেখে।
– ঠিক ধরেছ।
– একবার আমাদের বাড়ি চলো। আমার মার খুব শরীর খারাপ।
-ডাক্তার দেখাওনি?
– এখানে কোন ডাক্তার পাওয়া যায় না। রেশম ডাঙ্গার কাছাকাছি একটা ডাক্তার আছে। কিন্তু আমরা খুব গরীব। আমাদের কাছে ডাক্তার দেখানোর মত টাকা নেই। যাবে?
ভাবলাম, গাড়ি ঠিক করতে তো এখনো দেরি আছে। তাহলে ঘুরেই আসি। যদি কারোর উপকারে লাগি।
জিজ্ঞাসা করি, তোমার বাড়ি কোথায়?
-সুবলপুর ইটভাটার পিছন দিকে আমার বাড়ি।
– চলো, ঘুরে আসি।
ছেলেটাকে এবার ভালোভাবে দেখি। দেখে মনে হয় দশ-বারো বছরের হবে। তার জামা নোংরা, পরনে একটা হাফপ্যান্ট। পা খালি। তবে তার দৃষ্টি খুবই উজ্জ্বল।
ইটভাটা পার করে পিছন দিকে যেতেই একটা ভাঙাচোরা বাড়ি চোখে পড়ল। ছেলেটা বলল, এটাই আমাদের বাড়ি।
বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম। ভিতরে জিনিসপত্র কিছুই নেই। ফাঁকা বললেই চলে। পাশের ঘরে বিছানার ওপর শুয়ে আছে এক মহিলা। ওনার দুটি চোখ বোজা। বুঝতে পারলাম ইনি হলেন ছেলেটির মা।
ছেলেটা তার মাকে দুই – তিনবার ডাকতেই তার মা চোখ খুললো।
আমি থার্মোমিটারে তাপমাত্রা চেক করলাম। একশো চার ডিগ্রি জ্বর। কিন্তু ইনি কিভাবে চুপচাপ শুয়ে আছে সেটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়।
ছেলেটাকে আশ্বাস দিলাম, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
এই জ্বরের জন্য উপযুক্ত ওষুধ আমার কাছে ছিল না। সব ছিল আমার গাড়ির মধ্যে। ছেলেটাকে বললাম, আমার গাড়িতে ওষুধ আছে। তুমি তোমার মায়ের কাছে থাকো। আমি নিয়ে আসছি।
বাড়ি থেকে বেরোলাম। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে গাড়ির দিকে গেলাম। ওখানে পৌছেই গাড়ির ভেতর থেকে ওষুধের বাক্স টা নিয়ে আবার ছেলেটার বাড়িতে ফিরে এলাম।
বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখলাম ছেলেটা নেই। এমনকি তাঁর মা-ও বিছানার ওপর শুয়ে নেই। ফলে হতভম্ব হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলাম দু তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।
একজন জিজ্ঞাসা করল, কাউকে কি খুঁজছেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ, এখানে আমি একজন রোগী দেখতে এসেছিলাম। কিন্তু….
-তা কি করে হয় দাদা। এই বাড়িটা তো বহুদিন আগে থেকেই ফাঁকা পড়ে আছে। এখানে একজন মহিলা ও তার ছেলে থাকত। হঠাৎ ওই মহিলার প্রচন্ড জ্বর হয়। আমরা ডাক্তার ডাকার আগেই তিনি মারা যান। আর তার ছেলে মায়ের শোকে থাকতে না পেরে কড়িকাঠে ঝুলে পড়ে। কি বলব বলুন ….
সব কথা শোনার পর আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আমি দ্রুত হাঁটতে শুরু করি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাড়ির কাছে পৌঁছতে হবে।
গল্প সাহিত্যে কিছুটা রহস্যের গন্ধ না থাকলে কি চলে !! ভালো লিখেছেন দিগন্ত পালিত।
একরাশ মুগ্ধতা ।