পর্ব-১২
প্রতি বছরের মত মিলুর ঠাকুরমা এবারও অনেক আমসত্ব দিয়েছেন। আচার করেছেন।
সেগুলো একটা হোগলার চাচের উপর রোদে শুকাতে দিচ্ছেন ঠাকুরমা। সাথে সাহায্য করছে মিলু। পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে অশোক।
মিলুদের বাড়িতে অনেক আমগাছ। আম পাকা শুরু হলে মিলুর প্রতিদিনের নেশা বারবার আমতলাতে যাওয়া। আম কুড়ানো। মাঝে মাঝে গাছি মামুদ আলি এসে আম পেড়ে দিয়ে যায়।
সেই আম পাড়ার সকল পরিবারকে যেমন দেওয়া হয় তেমনি ঠাকুরমা আমসত্ব দেন ও আচার করে রাখেন। সারাবছর ধরে সেসব খাওয়া চলে। মিলু বাবা-কাকার একটা প্রিয় খাবার হল এই আমসত্ব আর দুধ ৷ শেষপাতে এটা না পেলেও তাদের খাওয়াটা যেন পূর্ণ হয় না ৷ মিলুদের খাবার ধরণ আবার অন্য ৷ তারা শুকনো আমসত্ব চুষে চুষে খেতেই বেশি ভালবাসে ৷
আমসত্ব দেওয়া, আচার বানানো- সব ক্ষেত্রেই মিলুর উৎসাহের অন্ত নেই ৷ সে ঠাকুরমায়ের সাথে সবসময়ই থাকে ৷ হাতে হাতে তাকে সাহায্য করে৷ আমের খোসা ছাড়িয়ে দেওয়া, রস বের করা – তারপর সেই রস যাকে আমগোলা বলে – সেসব ঠাকুরমায়ের সাথে উঠোনে নিয়ে যাওয়া – সবকিছুই করে ৷ ছোট ছোট হোগলার চাটাই, কুলো , থালা প্রভৃতিতে ঠাকুরমা সেই গোলার লেপ দেন বারবার ৷ শুকিয়ে গেলে আবার ৷
এবছরের মত আমসত্ব দেওয়া শেষ হয়েছে ৷ এখন সেগুলো ভাল করে গ্রীষ্মের কড়া রোদে শুকিয়ে রাখা হচ্ছে যাতে তাডাতাড়ি নষ্ট হয়ে না যায় ৷
আমসত্বগুলো রোদে দিতে দিতে ঠাকুরমা মিলুকে বলেন- দাদা যাও তো, ঘর থেকে আচারের বয়েমগুলো নিয়ে এসো ৷ ওগুলো তো কাল রোদে দেওয়াই হয়নি ৷
– আচ্ছা – মিলু একছুটে চলে যায় ঘরে | অশোকও যায় দাদার পিছে পিছে ৷ একে একে সব ক’টা আচারের পাত্র নিয়ে আসে ওরা ৷
ঠাকুরমা বলেন-ওপাশে সাজিয়ে দিয়ে দাও ৷
দুই ভাইয়ের দায়িত্ব হল – আমসত্ব আর আচার পাহারা দেওয়া ৷ যাতে কুকুর, বিড়াল বা পাখিটাখি এসে ওগুলো নষ্ট করে না দেয় ৷ এছাড়া আরো একটা কাজ আছে ৷ সেটা হল – এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখে মাঝে মাঝে বয়েমের মুখ খুলে একটু আচার চেখে দেখা কিংবা একটু আমসত্ব ছিঁড়ে মুখে পুরে দেওয়া ৷
মিলুর জেঠিমা পাশ দিয়ে থালাবাসন নিয়ে পুকুরের দিকে যাচ্ছিলেন ৷ দাঁড়িয়ে শ্বাশুড়ি মাকে বললেন – মা , আপনার আচারের বয়েমগুলো তো ভরাই ছিল ৷ ওগুলো অত কমে গেল কী করে? আর আমসত্বগুলোও যেন একটু ছোট ছোট হয়ে গেছে মনে হচ্ছে ৷
ঠাকুরমা সবই জানেন ৷ তবে এতে তিনি মজাই পান ৷ ওনারও ওদের এই লুকিয়ে খেতে দেখে নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায় ৷ কত আটা দুধ থেকে সর তুলে খেয়েছেন মায়ের চোখ এড়িয়ে ৷
তিনি মিলুর দিকে চেয়ে একটু চোখ টিপে হেসে বলেন- রোদে শুকোতে দিলে ওরকম আস্তে আস্তে কমে যায় ৷ কী বলো মিলু দাদা ? তাই না?
পাশেই কুসুমকুমারী রোদে শাড়ি মেলছিলেন ৷ হেসে বললেন –
বাঘের কাছে গরু রাখা –
ধীরেধীরেই গোয়াল ফাঁকা ৷
কুসুমকুমারীর এরকম ছন্দ মিলিয়ে কথা বলার একটা অভ্যাস আছে ৷ আর মজার কথার ক্ষেত্রে তো তার মুখ থেকে যেন ছন্দ মিলের খই ফোটে ৷
ঠাকুরমা হেসে তার বৌমাকে বলেন- সে তুমি ছন্দ দিয়ে যা খুশি বলতে পারো ৷ তবে আমার জিনিস নিয়ে তোমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে ৷ নিজেদের কাজবাজগুলো মন দিয়ে করো গে যাও।
তারপর একগাল হেসে মিলুর দিকে চেয়ে বললেন – তোমাদের কাজ তোমরা মন দিয়ে করে যাও ৷ খেয়াল রেখো- যেন কুকুর বিড়াল উপরে উঠে না পড়ে ৷
মিলু হাঁ সূচক ঘাড় নাড়ে ৷
ধারাবাহিক উপন্যাসের খণ্ডাংশ যতটুকু পড়েছি তাতে কবি জীবনানন্দ দাশ এর বাল্য জীবনের অসামান্য কিছু প্রতিচ্ছবি অসাধারণ ভাবে আমাদের মননে উঠে আসছে।
অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয় কবি মি. শংকর দেবনাথ।
দাদা আপনাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ