সেই লোকটা

আকৃতিবিহীন ঝুপড়ির তেলচিটে কালো বেঞ্চিতে বসে লোকটা ভাত খাচ্ছিল। আলুসেদ্ধ, ডাল আর চালকুমড়োর আধসেদ্ধ তরকারি আবেগবর্জিত হয়ে চালান হয়ে যাচ্ছিল আগ্নেয়গহ্বরে। শস্তা জিনসের শার্ট তেলকালি ময়লার কোলাজে অপরূপ অয়েলপেন্টিং।

প্যান্টের অবস্থা তার চেয়েও খারাপ সময়ের চিহ্ন বয়ে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বছরের পর বছর। ওপর আর নীচের দুই আব্রুতেই কুটিল ছেঁড়া উঁকি মেরে যাচ্ছে ক্রমাগত।
ভয়ংকর ময়লা শস্তার কোল্ডড্রিঙ্কের প্লাস্টিকের যে বোতলে জল আছে সেই ছোট্ট থলি নিম্নাঙ্গ ছাড়াই দিব্যি বইছে জলভার।

লোকটা জল আনে কেন? সে তো পয়সার বিনিময়ে নির্মল জলের সংজ্ঞা শোনেনি কখনো! লোকটা জল আনে কেন? জলীয় বিবাদ তার চব্বিশ ঘন্টাই ছুঁয়ে থাকে অপরা বিষাদে। এক কামরার আট বাই দশের অ্যাসবেস্টসের ছাউনি আর অপুষ্ট বউ খান দুই কর্পোরেশনের স্কুলের নাবাল বেড়ালিবাচ্চা ছাড়াও এক তোরঙ্গ বিস্তর হাবিজাবি তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত পেরিয়ে রোজই নরম ভোরে উঠে শেয়ারিং পায়খানায় উবু হয়ে বসে সে।

ফুটপাতের সাড়ে পাঁচ দামী কালো দন্তমঞ্জন রগড়ে দাঁতের ছাল চামড়া উঠে গেলে সালফার মেশানো কমদামী গুঁড়ো চিনির শরবৎ চা খেয়েই দে দৌড় দে দৌড় …
একদিন রাস্তায় এক টিভি চ্যানেলিয়ান তাকে পাকড়াও করে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপকা রিলিজিয়ন কেয়া?”
লোকটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল।
বিরক্ত প্রশ্ন আবার ছিটকে এসেছিল, “আরে আপনি কি?”
লোকটা ফ্যালফ্যাল করে দেখেছিল।
লোকটা ঠাস্ করে মেরেছিল গালে বসা মশার বাচ্চা।
লোকটা গুটখার পিক পিচ করে ছিটিয়ে বলেছিল, “ঠিকাদারী লেবার বাবু!”
ঝুপড়ির পার্লারী ত্বকবিহীন অন্ধ গর্তের ভেতরে তখন বেঞ্চিতে নামগোত্রহীন জলের ময়লা বোতল।
হাপুস হুপুস শব্দে পরম তৃপ্তিতে একমনে আলুভাতে ডাল চালকুমড়ো ভাত খেয়ে চলেছিল অচ্ছে অনাগরিক ভারতবর্ষ।

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

2 thoughts on “সেই লোকটা

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।