(বর্তমানে পাকিস্তান অশান্ত। আজ থেকে কয়েক বছর আগে আমার “এদেশ ওদেশ” নিবন্ধে লিখেছিলাম এরকম ঘটনা ওখানে বারবার হয়, কেন হয়। প্রকাশিত সেই পূর্ণ নিবন্ধের কিছুটা অংশ মাঝে মধ্যে তুলে দেব। পাঠকের দেখুন কিছু বোঝেন কি না।)
মজার ব্যাপার হলো, চরম দক্ষিণপন্থার মৌলবাদকে প্রতিরোধ করতে পারত যে বামপন্থী কমিউনিস্ট দল, তারাই জন্মলগ্ন থেকেই অদ্ভুত মতাদর্শগত দ্বন্দ্বে সর্বদাই লিপ্ত থাকত, আর কিছু সময় অন্তরই টুকরো হতে থাকত। নরম কমিউনিস্ট, মধ্যপন্থী কমিউনিস্ট, চরমপন্থী কমিউনিস্ট। আবার এক জাতীয় মতাদর্শেও বহু আলাদা আলাদা আণুবীক্ষণিক দল। অথচ, ধর্মীয় ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দলগুলো টুকরো হওয়া তো দূরের কথা বিভিন্ন শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে বেড়েই চলছিল। এর আরেক কারন হলো, মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও, বহু বামপন্থী দলও সেই ভোটবাদী হয়ে ধর্মীয় ওড়নায় মাঝেমধ্যে মাথা ঢাকতে শুরু করেছিল। মানুষ এটাও ভালোভাবে মেনে নেয়নি। ফলতঃ বাড়বাড়ন্ত মৌলবাদের।
ওপারের দেশ পাকিস্তানের অবস্থা প্রায় কাছাকাছি হয়েও স্বতন্ত্র কারনে বিভাজিত হচ্ছিল।
সীমানার ওপারে বিভাজনের সমস্যা বুঝতে আরোও পিছিয়ে যেতে হয়। পৃথিবীর প্রথম ধর্ম ভিত্তিক দ্বেষ এবং তার আধারে যুদ্ধ ছিল ক্রুশেড। খ্রীস্টান ও ইসলাম ধর্মের এই বিবাদও আধারিত ছিল সাম্রাজ্য কেন্দ্রিক মূলতঃ ভূমি দখলের লড়াই। আসলে তখন ওই জাতীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে যুদ্ধে পরস্পর বিবাদমান প্রতিবেশী দেশগুলোকে একত্রিত করে মুসলমান শাসকদের সাম্রাজ্য দখলের ফন্দির হোতা ছিল ইউরোপ। ধর্মীয় জিগির তুলে কার্যসিদ্ধির চেষ্টা সেই শুরু।
চারশো বছর অতিক্রান্ত তবু সেই অপচেষ্টা সমানে অব্যাহত। ইউরোপের সাম্রাজ্য সূর্য অস্তমিত হলে আসরে নামলো আমেরিকা। পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বহাল রাখার জন্য তারা যেকোনো কুকাজ করতে পিছপা হলো না। ধর্মীয় জিগির তুলে হোক কিম্বা সুশিক্ষিতের ছদ্মবেশে হোক দুনিয়ায় তাদের থাবা কায়েম হচ্ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তর সময়ে পরমানু শক্তিধর আমেরিকা নিজের স্বার্থে বিভিন্ন দেশে নিজের প্রতিনিধি বসানোর চেষ্টা করছিল। ফলস্বরূপ তেলসমৃদ্ধ মধ্য এশিয়া আর দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে দ্রুত বিভিন্ন উপায়ে শাসক পরিবর্তন ঘটছিল। আগেই বলেছি ভারতীয় উপমহাদেশ সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এর চতুর্দিকে শক্তির আকর এর খনি। তাই ইরান, ইরাক, তুরস্ক, সৌদি আরব, লেবানন, আরব আমীরশাহী, ইজরায়েল সমেত মধ্য এশিয়া করায়ত্ত করার পরেও তাদের দরকার ছিল উপমহাদেশের মালিকানা। একদিকে রাশিয়া অন্যদিকে চীন হয়ে উঠছিল প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি।
ভারত নিজেকে জোট নিরপেক্ষ ঘোষণা করেও রাশিয়ার মিত্রজোটে সামিল হয়ে গেল। অতএব পাকিস্তান কে যেন তেন উপায়ে নিজের দিকে টানতেই তার আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে লাগলো আমেরিকা। সামরিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক সবরকম সাহায্য অবাধে আসতে লাগলো। মধ্য এশিয়ায় অবাধ্যদের শায়েস্তা আর রাশিয়াকে সহবত শেখানোর জন্য তৈরী হল ফ্রাঙ্কেস্টাইন সাদ্দাম হোসেন, বিন লাদেন ইত্যাদি এবং তাদের সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী।
পাকিস্তানেও গণতন্ত্র ভন্ডুল করে নিজের জোহুজুর কে বসানোর জন্যই এভাবেই সাদ্দাম বা লাদেন যুগের কয়েক দশক আগেই হয়েছিল আমেরিকার প্রচ্ছন্ন মদতে সেনা অভ্যুত্থান।
জিন্নাহ্ যুগ যে পাকিস্তানের স্বর্ণযুগ ছিল, তা বলব না। কিন্তু এই সময়ে অন্তত সেই দেশের নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক ধর্মীয় শাখার বিবাদ ছিলনা। ছিল গণতন্ত্র। ছিলনা আমেরিকা বা কোনো বৃহৎ শক্তির চাটুকারবৃত্তি। উচ্চশিক্ষিত এই মানুষটির সম্পর্কে বিরোধী মৌলবাদীরা যাই প্রচার করুক, কিম্বা শাসক হিসেবে তাঁর সাফল্য অসাফল্যের যতই চুলচেরা বিচার হোক, মানুষ হিসেবে জিন্নাহ্ সাহেব ছিলেন সাচ্চা। নরমপন্থী চিহ্নিত করে জিন্নাহ্ কে গান্ধীর মতোই ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে ক্ষমতাহীন করার কাজ তলেতলে শুরু হয়ে গেছিল তাঁর জীবিতকালেই।
জিন্নাহ্ শাসনের অন্তকেই ধরা যেতে পারে উপমহাদেশের কালো অধ্যায়ের সূচনা। জেনারেল আইয়ুবের সময় থেকেই পারস্পরিক দ্বেষে বিভাজিত হতে থাকল প্রাচীন ঐতিহ্যের সুসভ্য সমাজ।
(যদি কেউ সত্যিই পড়েন তাহলে বাকি অংশ পরে দেব)
পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বহাল রাখার জন্য যেকোনো কুকাজ করতে কেউ কেউ পিছপা হবে না। এবং ধর্মীয় জিগির তুলে হোক কিম্বা সুশিক্ষিতের ছদ্মবেশে হোক দুনিয়ায় তাদের থাবা কায়েম হয়েছে আর ভবিষ্যতেও হবে।