এদেশ ওদেশ ২

(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ দ্বিতীয় পর্ব।)

কিন্তু গোল বাঁধলো এখানেই। গান্ধীর পরেই সবচেয়ে সিনিয়র নেতা ছিলেন মহম্মদ আলি জিন্নাহ্। আর এই জিন্নাহ্ থাকলে নতুন দেশের প্রধানমন্ত্রী যে তিনিই হবেন তা বুঝেই দিল্লীর মসনদ দখলে শুরু হলো চিরাচরিত ষড়যন্ত্রের খেলা।

স্বায়ত্তশাসন পাওয়ার সময়েই রীতিমতো প্রস্তাব পাস করিয়ে জিন্নাহ্ কে অর্থদপ্তর দেওয়ার কৌশল, সুভাষচন্দ্র কে কংগ্রেস থেকে তাড়ানোর কৌশল, এই খেলারই শাখাপ্রশাখা। স্বভাবতই মর্যাদায় আহত জিন্নাহ্ বেরিয়ে গিয়ে তৈরী করলেন মুসলিম লীগ।

কিন্তু মজার ব্যাপার জিন্নাহ্ বা তাঁর দল প্রথমেই স্বতন্ত্র ভূমিখন্ডের দাবী তোলেন নি। কংগ্রেসের শীর্ষ ক্ষমতালোভীরা একের পর এক বৈষম্যমূলক আচরণ করে যাওয়ার পরে জিন্নাহ্ দাবী তুললেন পাক – ই – স্তান এর।

নিজে জিন্নাহ্ উদারমনস্ক পাশ্চাত্য শিক্ষার মানুষ ছিলেন। ধর্মীয় আচার তিনি নিজে প্রায় পালনই করতেন না। অপরদিকে হিন্দু মৌলবাদ তখন শিকড় ছড়াতে শুরু করেছে। বিভিন্ন ভাবে বিপর্যস্ত আমজনতাকে দলের সমর্থনে টানতে গেলে সবচেয়ে সহজ উপায় ধর্মীয় মেরুকরণ। অথচ হিন্দু মৌলবাদীরা সেটা করতে শুরু করে দিয়েছে, অতএব মরীয়া কংগ্রেস নিজেকে পুরো সেদিকে ঝুঁকিয়ে দিল। মুসলিম লীগ বুদ্ধিমানের মত সে কাজটা সেরেই ফেলেছিল। ফলতঃ সবচেয়ে সহজ রাস্তায় হাঁটল দুই দলই। আনঅফিসিয়ালি দুই দলের গায়ে দুই ধর্মের তকমা পড়ে গেল।

ভারত বা পাকিস্তান দুই দেশই জন্মলগ্ন থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেয়ে অন্য বৃহৎ ক্ষমতাশালীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে শুরু করেছিল। পাকিস্তান আমেরিকার আর ভারত রাশিয়ার। অথচ প্রায় সমসাময়িক স্বাধীনতা লাভের পরেই চীন বা জাপান অনেক এগিয়ে যাচ্ছিল শুধুমাত্র নিজস্ব ভাবনা আর উদ্যোগে।

বৃহৎ রাষ্ট্র তাদের নিজেদের স্বার্থেই এই দুই নবগঠিত দেশ কে মদত দিতে শুরু করল, কারন ভৌগলিক অবস্থানের সুবাদে দুই দেশই অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। বড় দেশের দাদাগিরি বা স্বার্থ বজায় রাখতে যেকোনো একটা দেশ তাদের হাতে রাখা অবশ্যম্ভাবী ছিল।

আর এখানেই শুরু হল ধর্মীয় মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত। নেহরু বা জিন্নাহ্ দুজনের কেউই আর যাই হোক মৌলবাদী ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের চারপাশে আবর্তিত মৌলবাদ ঠেকানোর কোনো চেষ্টাই তাঁরা বা তাঁদের দল করেনি ভোটের মুখের দিকে তাকিয়ে। অশিক্ষিত, হতদরিদ্র দুইদেশের মানুষগুলোকে যে শুধু ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে এক ছাতার তলায় এনে নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার পথ প্রশস্ত হয়, তা তাঁদের দুই দলই ততদিনে বুঝে গেছিল। আর এরা ক্ষমতায় থাকলে বৃহৎ শক্তিরও এই অঞ্চলে ছড়ি ঘোরাতে সুবিধা হয় বলে তারাও এতে হয় চোখ বুজে ছিল নয়তো অর্থ, সরঞ্জাম দিয়ে বাড়তে সাহায্য করে চলেছিল। সাধারণ জনতা এই কূটকথা বুঝতেই পারেনি।

(আবার আগামীকাল)

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

2 thoughts on “এদেশ ওদেশ ২

  1. স্বায়ত্তশাসন পাওয়ার সময়েই রীতিমতো প্রস্তাব পাস করিয়ে জিন্নাহ্ কে অর্থদপ্তর দেওয়ার কৌশল, সুভাষচন্দ্র কে কংগ্রেস থেকে তাড়ানোর কৌশল, এই খেলারই শাখাপ্রশাখা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_negative.gif

  2. অনেককিছু জানা হলো, দাদা। লিখতে থাকুন। সাথে আছি।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।