ডেঙ্গু জ্বরের জানা-অজানা

ডেঙ্গু জ্বরের জানা-অজানা

ডেঙ্গু ভাইরাস নামক চার ধরনের ভাইরাসের মধ্য থেকে যে কোনো একধরনের ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট জ্বর বা অসুস্থতাই হলো ডেঙ্গু জ্বর। এই ভাইরাসগুলো প্রত্যেকে একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও এরা সম্পূর্ণ এক নয়। কোনো ব্যক্তির কোনো একধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়া মানে এই নয় যে, আর কোনো ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সে রক্ষা পাবে। সুতরাং ডেঙ্গু জ্বর একই মানুষের একাধিকবার হতে পারে।

শুধু কি দিনে কামড়ায়?
ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী একধরনের মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু জ্বর ছড়ায়। এই মশা সাধারণত দিনের আলোয় কামড়ালেও সারাদিনের যে কোনো সময়ে এই মশা কামড়াতে পারে। কাজেই সংক্রমণ ঋতুতে সবসময়ই সতর্কতা প্রয়োজন। অন্ধকার জায়গায় এই ধরনের মশার বাস এবং জমাকৃত জলে এরা বংশ বিস্তার করে। সুতরাং প্রজনন ঋতুতে বাড়ির ভেতরে ও বাইরে কোথাও জল জমিয়ে রাখা বা অপ্রয়োজনীয় জল জমতে দেয়া উচিত নয়।

উপসর্গগুলো কী?
ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী মশা কামড়ানোর ৪-৭ দিনের মধ্যেই আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়; যা ৫-৭ দিন পর্যন্ত থাকে। জ্বর, মাথা ব্যথা, চোখের পেছন দিকে ব্যথা, অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে ব্যথা, র‌্যাশ; এটি চ্যাপ্টা বা স্ফীত আকৃতির হতে পারে, এতে চুলকানিও থাকতে পারে। সাধারণত যাদের আগে ডেঙ্গু হয়নি, তাদেরই র‌্যাশ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পেটের সমস্যা তথা বমিভাব, বমি বা ডায়রিয়া হতে পারে। কাশি, বন্ধ-নাক, গলাব্যথা হতে পারে, কণ্ঠনালি লালচে থাকতে পারে।

রক্তবর্ণ চোখ
শিশু ও অল্প বয়স্কদের ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গগুলোর তীব্রতা কম হতে পারে। যাদের আগে অন্তত একবার ডেঙ্গু হয়েছে বা যে কোনো ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণ হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তীব্রতর ডেঙ্গু সংক্রমণের উপসর্গগুলো এ রকম হতে পারে:-

অসহ্য পেটে ব্যথা, ব্যথা না পাওয়া সত্ত্বেও ত্বকে আঘাতের চিহ্ন, ত্বকে ছোট ছোট বেগুনি রঙের স্পট দেখা দিতে পারে, রক্ত বমি, নাক থেকে রক্তপাত, কালচে মলত্যাগ, অচৈতন্য হয়ে যাওয়া, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি নিজে থেকেই প্রতিকার হয়ে যায়, তবুও ডাক্তারের কাছে যাওয়া জরুরি কেন?

উপরোক্ত লক্ষণগুলোর একটিও যদি আপনার শিশুর ক্ষেত্রে ২-৩ দিনের বেশি স্থায়ী হয়, তবে একজন চিকিৎসকই বলতে পারবেন রোগের তীব্রতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে কিনা অথবা নিম্ন রক্তচাপ বা রক্তপাতের সম্ভাবনা আছে কিনা।

ডেঙ্গু মশা শীতকালে মারা যায় কি?
মশা শীতল রক্তের প্রাণী এবং বেঁচে থাকার জন্য এদের ৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি তাপমাত্রা প্রয়োজন হয়। ৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের নিচের তাপমাত্রায় অর্থাৎ শীতকালে এরা শীতনিদ্রায় চলে যায়। কোনো কোনো প্রজাতির মশকী কোনো ছিদ্রপথে বাস করে এবং উষ্ণ আবহাওয়ার অপেক্ষায় থাকে। অন্য কোনো প্রজাতির মশকী শীতকালে ঠাণ্ডা জলে ডিম পাড়ে এবং মারা যায়। শীতকালে এই ডিম এখানেই থাকে এবং আবহাওয়া উষ্ণ হতে শুরু করলে মশার ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়।

ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয়ের পরীক্ষা:
ল্যাবরেটরিতে রক্ত পরীক্ষার এবং উপসর্গগুলো যাচাইয়ের পর একমাত্র একজন চিকিৎসকই বলতে পারেন ডেঙ্গু আছে কিনা। রক্তে ডেঙ্গু ভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য দু’ধরনের পরীক্ষা হয়। প্রথমটি হলো এনএস ১ এন্টিজেন; যা লক্ষণ প্রকাশের এক দু’দিনের মধ্যেই পজিটিভ হতে পারে। দ্বিতীয়টি এন্টিবডি আইজিএম ডেঙ্গু টেস্ট; যা লক্ষণ প্রকাশের ৪-৫ দিনের মধ্যেই পজিটিভ দেখাতে পারে। যদিও খুব তাড়াতাড়ি রক্ত পরীক্ষায় সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ এতে টিএলসি এবং প্লেটলেট্স কাউন্ট কম দেখাতে পারে।

ডেঙ্গু নিশ্চিত হওয়ার পর চিকিৎসককে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ছে কিনা (যার অর্থ রক্তে ফ্লুয়িড কম হয়ে যাচ্ছে) এবং প্লেটলেট্ কাউন্ট কম হচ্ছে কিনা জানার জন্য পুনরায় রক্ত পরীক্ষা করাতে হতে পারে। ডাক্তারের কোনো সন্দেহ হলে ফ্লুয়িড সংগ্রহের প্রমাণ পরীক্ষার জন্য তিনি ফুসফুস ও তলপেটের আলট্রাসনোগ্রাফিও করতে বলতে পারেন।

প্রতিকার
ডেঙ্গু ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক না থাকলেও ডাক্তাররা উপসর্গগুলো কমানোর চিকিৎসা করতে পারেন। অধিকাংশ শিশুর ক্ষেত্রে জ্বর নিয়ন্ত্রণের ওষুধ দিয়েই তাকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। এক্ষেত্রে প্যারাসিটামল সবচেয়ে নিরাপদ। মেফানেমিক এসিড অথবা আইবুপ্রোফেনের ব্যবহারে রক্তপাত হতে পারে বিধায় এসবের ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়া উচিত। প্যারাসিটামলে জ্বর নিয়ন্ত্রণে না আসলে শিশুকে কলের জলে (স্বাভাবিক তাপমাত্রার জলে) স্পঞ্জ করিয়ে দিন। উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে বমি ও ডায়রিয়ার চিকিৎসা করা দরকার। চিকিৎসকের পরামর্শে ডেঙ্গু আয়ত্তের মাঝে এলেও শিশুর রক্তচাপ পরিমাপ এবং রোগের অগ্রগতি জানার জন্য পরবর্তী কয়েকদিনে বেশ কয়েকবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এ সময় শিশুকে প্রচুর পানীয়জাত খাবার দিন। তবে সংক্রমণের মাত্রা তীব্র হলে অবশ্যই শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করে অতিরিক্ত ফ্লুয়িড থেরাপি এবং প্লেটলেট পরিসঞ্চালন করতে হবে।

ডেঙ্গু মশকী দিনের আলোয় অধিক কার্যক্ষম থাকে। এ সময় শিশুকে বাড়ির বাইরে বের করবেন না। স্ক্রিন ও এয়ারকন্ডিশন্ড বিল্ডিং সবচেয়ে নিরাপদ। বিশেষত বাইরে খেলতে পাঠানোর সময় শিশুকে জুতো, লম্বা-হাতার জামা, লম্বা প্যান্ট পরিয়ে দিন। জমাকৃত জলে মশা বংশ বিস্তার করে। কাজেই বাড়ির আশপাশের পরিত্যক্ত জলাধার, গামলা, ফুলের টব থেকে জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করুন। বাড়ির বাইরে যাওয়ার সময় অবশ্যই শিশুকে মশা বিতারক ক্রিম লাগিয়ে দিন।

মশা বিতারক ক্রিম বা লোশন শরীরের অনাবৃত অংশে লাগানো উচিত। এক্ষেত্রে অ্যাডভান্সড ওডোমস বা অন্যান্য পণ্য শিশুর জন্য নিরাপদ। কিন্তু ৩০% এর চেয়ে অতিরিক্ত পণ্যের ব্যবহারে শিশুর ত্বকে এলার্জি হতে পারে। প্রাকৃতিক পণ্য যেমন সাইট্রোনেলা বা ইউক্যালিপটাস জাতীয় পণ্য ভালো হলেও রাসায়নিক মশক বিতারকের মতো অতটা কার্যকর নয়। মশা নিরোধক রিস্ট ব্যান্ড বা প্যাচেসগুলো শরীরের সব জায়গা, তথা গলা বা মুখমণ্ডলে লাগানো সম্ভব নয় বিধায় এগুলো ততটা কার্যকরী নয়।

2 thoughts on “ডেঙ্গু জ্বরের জানা-অজানা

  1. মোদ্দা কথা ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে আমাদের সবাইকে সর্বদা সচেতন থাকতে হবে। বিশদভাবে আলোচনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ সুরাইয়া নাজনীন।
    শুভ সন্ধ্যা। নিরাপদ থাক প্রতিটি সকাল দুপুর সন্ধ্যা রাত।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।