এক ভিক্ষুকের ভিক্ষার বাটি! ছবিটি গত কয়েকদিন আগে নিজ এলাকা থেকে তোলা। এই ভিক্ষুকের ঘরে প্রায় ২০ থেকে ৩০ কেজি কয়েন জমা আছে। প্রতিদিন কিছুকিছু করে দোকানদারদের হাতে পায়ে ধরে সাপ্লাই দিয়ে থাকে। বললেন, ভিক্ষুক নিজেই।
ধাতব মুদ্রাকে আগে লোকে বলতো, ভাংতি পয়সা বা রেজকি পয়সা বা খুচরা পয়সা। বর্তমানে এটাকে বলে ‘কয়েন’। আগেকার সময়ে এক পয়সা, দুই পয়সা, পাচ পয়সা, দশ পয়সা আর আধলি সিকি খুব যত্ন করে ঘরের বাঁশের খুঁটি কেটে জমা করে রাখা হতো। যে ক’পয়সাই জমাক-না-কেন, এগুলোই হলো গ্রামের গরিব- দুঃখীদের দুর্দিনের কষ্টের যোগান। যাকে বলে গরিবের সম্বল!
একসময় আমার মা বোনেরাও রান্নাঘরের বাঁশের খুঁটি কেটে ভাংতি পয়সা জমাতো। কোনও পূজাপার্বণের আগমনে বা কোনও মেলা উপলক্ষে বাঁশের খুঁটি কেটে জমানো পয়সা বের করতো। সেসময় এই ভাংতি পয়সা (এসময়ের কয়েন) দেখে মনের মাঝে কী আনন্দ-ই-না জাগতো। গ্রাম্য গৃহিণী খুঁজে পেতো শান্তির পরশ। ছেলে- মেয়েরা দেখতো মজার স্বপ্ন।
আগের সেই তামার এক পয়সা, দুই পয়সা, আর পিতলের পাচ পয়সা, এলুমিনিয়ামের দশ পয়সা এখন আর নেই। নেই সেই সময়কার পয়সা জমানোর আনন্দও। সেই স্বপ্ন হারিয়ে গেছে আরও অনেক আগেই। বর্তমানে স্টিলের ধাতব মুদ্রার কয়েনও এখন দুঃস্বপ্নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছবিটি নিজ এলাকার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ছবি। তিনি পান-বিড়ি-সিগারেট বিক্রেতা। সাথে রাখে আইসক্রিম-সহ নানারকম শিশু খাদ্য। কয়েনের ভারে লোকটির এখন কোমর বাঁকা।
কারণ, ভাংতি পয়সা হলো, এসময়ের অপছন্দের কয়েন। যেই কয়েন এখন বাংলার মানুষের কাছে অবহেলিত এক ভারি ওজনের মাথার বোঝে। এই কয়েনের ভারে দেশের অনেক ছোট-খাটো ব্যবসায়ী-সহ সাধারণ মানুষের কোমর বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান এক টাকা, দুই টাকা, পাচ টাকার কয়েন একসাথে ১০টি কয়েনও কেউ নিতে চায় না। তাই কেউ শখ করেও কয়েন ঘরে মাটির ব্যাংকে জমায় না। কারোর কাছে পাচ টাকার চার পাচটি কয়েন জমা হয়ে গেলেই, তাঁর মাথা খারাপ হয়ে যায়। খুচরা ব্যবসায়ীর দোকান থেকে পান-বিড়ি-সিগারেট কিনে কয়েনের ওজন কমিয়ে রাখে।
কেউ কেউ কয়েনের ওজন কমানোর জন্য আইসক্রিম ফ্যাক্টরির মালিকদের সাথে শলাপরামর্শ করে আইসক্রিমের ভেতরে দুই টাকার কয়েন ভরে দেয়। সেই আইসক্রিমের দাম ধরা হয় চার টাকা। ছেলে-পেলে মনের আনন্দে দুই টাকার লোভে পড়ে সেই আইসক্রিম চার টাকা দিয়ে কিনে খায়। আইসক্রিম চুষে খেতে খেতে শেষপর্যায় আসলে আইসক্রিমের নিচের অংশে দুই টাকার একটা কয়েন পেয়ে মহা আনন্দে নাচতে থাকে।
আইসক্রিমের ভেতরে দুই টাকা মূল্যমানের কয়েন। এই কয়েনের লোভে পড়ে ছোটছোট স্কুল ছাত্র-ছাত্রী-সহ এলাকার আরও দশটি দোকানের সামনে প্রতিদিন ভিড় জমায়। আইসক্রিম কিনে খায়, আর আইসক্রিম থেক কয়েন বের করে নাচে।
কিন্তু তাতে কি আসলে কয়েনের ভার বা ওজন বা বোঝা কমছে? মনে হয় না! মনে হয় ‘যেই লাই, সেই কদু’র মতো অবস্থা। ক্ষণিকের জন্য কয়েন সাপ্লাই করে স্বস্তির নিশ্বাস পেলা ছাড়া আর কিছুই নয়! কয়দিন পর আবার ‘যেই কপাল, সেই মাথা’।
সময় সময় এমনও দেখা যায়, কয়েনের পুটলি মাথায় নিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরতে। কিন্তু দোকানদার অন্তত কয়েন না রাখার বান্দা। প্রয়োজনে মাল বিক্রি করবে না, কিন্তু কয়েন নেওয়া হবে না। নেয়ও না। এরপর নিয়ে যাওয়া হয় বাস স্ট্যান্ডে। বাসের কন্ট্রাক্টররা কিছু রাখে প্যাসেঞ্জারের কাছ থেকে ন্যায্য ভাড়া আদায় করার জন্য। তাও মনে হয়, ১০০টাকার কয়েন মাত্র ৯০টাকা ধরে। কয়েনের মালিক কয়েন বিক্রি করে কয়েনের ওজন কমিয়ে নিজের কানে ধরে উঠবস করতে থাকে। কয়েন জমানো ব্যক্তি বলে, “ছাইড়া-দে-মা কাইন্দা বাঁচি”।
আবার কেউ নিয়ে যায় নদী পারাপার হওয়ার গুদারা ঘাটে। সেখানেও একই অবস্থা দেখা যায়। কয়েন গুনো টোল আদায়কারীর কাছে বুঝিয়ে দিয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়। কয়েনের সাথে দেওয়া হয় কয়েন মালিকের ফোন নাম্বার। গুদারা ঘাটে টোল আদায় করে জমা দেওয়া কয়েনের পরিমাণমত টাকা জোগাড় হলেই ফোন করে টাকা দেওয়া হয়। এতে কয়েনের পরিবর্তে কাগুজে নোট হাতে পেতে দু’এক দিন সময়ও লেগে যায়। তবু কি ধাতব মুদ্রা কয়েনের ওজন কমছে? মনে হয় না। সমস্যা থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করি।
কয়েনের ওজন কমানো যেতো, যদি সরকার বর্তমান বাজারে কয়েন ছাড়া বন্ধ করে দিতো। কিন্তু না, তা আর সরকার করছে না। বরং প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে কয়েন বাজারে ছাড়ছেই। তাহলে এই কয়েনের ওজন কমবে কি করে? তাই আর কয়েনের ওজন কমছে না। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছোটখাটো দোকানদার, সাধারণ মানুষও কোমর সোজা করতে পারছে না। একবার এনিয়ে এক ব্লগে মাননীয় অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে প্রশ্ন করে লিখেছিলাম।
লেখার শিরোনাম ছিল, “মাননীয় অর্থমন্ত্রী দুই টাকা, পাচ টাকার কয়েক কি পানিতে ফেলে দিবো”! লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, মাননীয় অর্থমন্ত্রী, দেশে দুই টাকা, পাচ টাকার কাগুজে নোট থাকতে এতো ব্যয়বহুল ধাতব মুদ্রার দুই টাকা, পাচ টাকার কয়েন কেন? দুঃখ হয়! এর কোনও প্রতিকার পেলাম না।
এখন মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন না রেখে প্রিয় পাঠকের কাছে আমি ছোট একটা প্রশ্ন করি! প্রশ্ন হলো, “এই দেশের বাজারে একই মূল্যমানের দুইপ্রকার মুদ্রা থাকা কতটুকূ যুক্তিযুক্ত?” যদিও বর্তমানে আমরা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে চলছি। তাই এই দেশের সিংহভাগ জনসাধারণই আজ বিত্তশালী। এরপর অনেক আছে মধ্যবিত্ত। আমরা যারা আছি নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। মধ্য আয়ের দেশেও বর্তমানে আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায়।
এরপরও সারাদিন ফ্যাক্টরিতে, গার্মেন্টসে, রিকশা চালিয়ে বাসায় ফেরার পর, পকেটে থাকা অবশিষ্ট কয়েকটা কয়েন মাটির ব্যাংকে জমা করে রেখে দেই; অসময়ের সম্বল হিসেবে। যাতে গরিবের জমানো কয়েনগুলো দুর্দিনে হাতের লাঠি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু তা না হয়ে কষ্টার্জিত কয়েনগুলো যদি মাথার বোঝা হয়ে দাঁড়ায়? তখন একজন অসহায় গরিব মানুষ বা ছোট-খাটো একজন দোকানদারের অবস্থা কেমন হতে পারে তা একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়। যা এখন অনেকেরই মাথার বোঝা। না পারে রাখতে, না পারে ফেলে দিতে।
ছবি : নিজের মোবাইল ফোন দিয়ে তোলা।