ট্যাগ আর্কাইভঃ ধারাবাহিক উপন্যাস

বিসর্জন

গোয়াল ঘরে যখন আগুন লাগল তখন সোহেল তার মায়ের সাথে তর্ক করছিল।

গফুর আর সোহেলের চিন্তা ভাবনায় অনেক মিল থাকলেও মায়ের সাথে সোহেলের প্রায়ই তর্ক বেধে যায়। গফুরের মা যখন বলল, তগো ঢং দেইখ্খা আর বাচি না। বলি গফুর কি একলাই বাপ অইব নাকি? দুইন্না জুইরা আর মানইষের কি আর পোলাপান অয় না। কয়দিন পর পর অই ডাক্তার হেই ডাক্তার, কই, টাহাডা আহে কই তন?
সোহেল বলে- দ্যোখ মা বেশি কতা কইবা না কইয়া দিলাম। কয়েকদিনে মধ্যে ভাবীর বাচ্চা অইব, অহন কি আর টাহার দিহে চাইয়া থাকলে অইব নাহি?
: কেন অইব না? তোরা কি অছ নাই? তগো কি আমি পেটে ধরি নাই নাহি?
: তোমাগ দিন গেছে গা, এহন সরকারী হাসপাতাল অইছে, ডাক্তাররা কত চিকিস্যা করে। কত সুন্দর সুন্দর কতা কয়।
: তা তরা সুন্দর কতা হাজার শুনগা, কিন্তুক মহাজনী টাকা ধার লইয়া তরা যে বাহাদুরি দেখাইতছ তা ভালা অইব না বইল্লা দিলাম। টাহা শুধাবি কেমনে? জানি না কি অলক্ষীই না ঘরে আইতাছে! পথের ফকির বানাইয়া ছাড়ব।

সোহেল আর কোন কথা বলল না। বর্ষার পানি নামতে শুরু করেছে। পুটি মাছের ‘মাইর’ পড়ছে। গত কয়েক দিনে পলো ভরে ভরে মাছ নিয়ে আসছে গফুর। অন্যসব মানুষেরা যেখানে অভাবে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে গত কয়েক মাসে গফুরের আয় বেশ ভালই হচ্ছিল। সোহেল ভাবে হয়ত নতুন কেউ আসছে বলেই তাদের দিন বদলাতে শুরু করেছে। পুটি মাছগুলো রোদ্রে দিয়ে শুটকি করছে তারা। তার মা শুটকিগুলোর দিকেই যাচ্ছিল। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, অ গফুর রে … অ সোহেল রে … এদিকে আয় রে … আগুন আগুন … আগুন…

মুহুর্তের মধ্যে সোহেল দৌড়ে গেল গোয়াল ঘরের দিকে। গোয়াল ঘরের পিছন দিকে নাড়া আর কুটার স্তুপের মধ্যে আগুল লেগেছে। ধাউ ধাউ করে জ্বলে উঠছে আগুনের লেলিহান শিখা। কোথা থেকে বাতাস বইতে শুরু করল। সোহেল লক্ষ্য করেছে যখনই কখনো কোথাও আগুল লেগে যায় তখন একটা বাতাস বইতে শুরু করে। মুরব্বীরা বলেন অশরীরী বাতাস । বাতাসের প্রবাহ বেড়ে গেলে সে আগুল গোয়াল ঘরের পাটকাঠিতে তৈরী বেড়াতে লেগে যায়। কিছু ক্ষনের মধ্যে একটা হুলস্থুল কান্ড ঘটে গেল। যুবক, যুবতী, বালক, বৃদ্ধ সকলে আগুন নিভানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সমস্ত উঠান জুড়ে মানুষের ছুটাছুটি। ছাগলগুলো দৌড়ে পালাল, মুরগীগুলো কক কক করে ছুটে গেল কিন্তু একটি গরুর হাম্বা হাম্বা করে গগন বিদারী চিৎকার করে যাচ্ছে সেদিকে কারোরই খেয়াল রইল না।

কয়েক দিন যাবৎ তারামনের শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। শরীর ভারী হয়ে গেছে। হাত পা ফুলে উঠেছে। পেটের আকার এতটা বড় হয়ে উঠেছে যে নড়তেই বেশ বেগ পেতে হয় তার। শুয়ে ছিল তারামন। হঠাৎ আগুন আগুন চিৎকারে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভাঙ্গতেই তুমুল হৈ চৈ-এ দিশেহারা হয়ে গেল তারামন। কিন্তু এইসব চিৎকার চেচামেচি ছাড়িয়ে তার গরুর হাম্বা হাম্বা চিৎকারটা কানে ধাক্কা দিতে থাকল। ঘর থেকে বেরিয়ে গোয়াল ঘরের দিকে চোখ যেতেই দেখতে পেল গায়ের মধ্যে আগুন নিয়ে তাদের গরুটি এলোপাথাড়ি লাফাচ্ছে। তারামন তার নিজের কথা ভুলে গেল। প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এলো, চিৎকার করে বলল- অ সোহেল রে তোর ভাই গেল কইরে? গরুডারে বাচারে! গরুডার গায়েতো আগুন লাইগা গেছে রে।

এতক্ষন আগুন নিভাতে যেয়ে কেউ খেয়াল করছিল না গরুটার দিকে। তারামনের চিৎকারে সকলে তাকিয়ে দেখল এক বিভষৎ দৃশ্য। গরুটা সারা গা ঝলসে গেছে। পুরা মাংসগুলো দেখা যাচ্ছে।
তারামন প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে আসতে গিয়ে টের পেল তার পেটে ভিষন ব্যাথা হচ্ছে। বসে পড়ল । ব্যাথা ক্রমে বেড়ে উঠায় উঠানে মধ্যে শুয়ে পড়ল সে।
তারামনের শাশুড়ি দৌড়ে এলো, বলল- এই শরীর নিয়া দৌড় দিলি কেনরে। এখন কি হইব রে … অ সোহেল রে… অ গফুর রে….

আগুনের খবর পেয়ে এসেছে মাষ্টার সাব, এসেছেন মসজিদের ঈমাম, মাতবর, মেম্বার আরো অনেকে। এসেছে বয়সের ভারে প্রায় নুয়ে পড়া জরিমুনের মা। বিশ-বাইশ বছর যাবৎ এই গ্রাম সেই গ্রামে দাইয়ের কাজ করেছে জরিমুনের মা। এখন আর লোকে তাকে তেমন ডাকে না। সকলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দৌঁড়ায়। সামন্য সমস্যা হলেই স্বাস্থ্য কর্মীর মেয়েটাকে লোকে খবর দেয়। জরিমুনের মা দেখলেন তারামন শুয়ে আছে উঠানে আর ব্যাথায় কোকড়ে কোকড়ে যাচ্ছে। জরিমুনের মা দৌড়ে এল। এখন তার দিন নেই অথচ কি দিন গেছে তার। তিন গ্রাম দুর থেকে লোক এসে তাকে নিয়ে যেত। বাচ্চা হলে টাকা আর নতুন কাপড় দিত। কখনও যে অঘটন ঘটেনি তা নয়। তখন সকলের অগোচরে বেরিয়ে আসতো । লোকে জিজ্ঞাসা করলে জরিমুনের মা বলতো, সব আল্লার ইচ্ছা। আমরা কি পারি? সকলে মেনে নিত তার কথা। কিন্তু এখন আর শুধু উপরওয়ালার ইচ্ছার দিকে বসে থাকে না। সকলেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দিকে দৌড়ায়, তাকে কেউ ডাকে না ।

একটা মানসিক জটিলতায় ভুগতে থাকে জরিমুনের মা। সে কি যাবে এই পোয়াতি মেয়েটার দিকে? না কি অপেক্ষা করবে, কেউ ডাকে কিনা তার অপেক্ষা করবে। কিন্তু দীর্ঘ দিনে অভিজ্ঞতায় দাই বুঝতে পারে এখন অভিমানের সময় না। ব্যাথা উঠে গেছে আর দেরি করা যায় না। তাড়াতাড়ি তারামনের কাছে যেতেই সে টের পেল যে, পানি ভেঙ্গে গেছে। যে আবরনের ভিতর মানব শিশু পরম নিশ্চিন্তে বেড়ে উঠছিল তার অবসান হয়ে গেছে। ভেঙ্গে গেছে নিরাপত্তা বেষ্টনী। এখন দ্রুততম সময়ের মধ্যে যদি বাচ্চার আগমন পথ তৈরী করে দেয়া না যায় তবে ঘটে যাবে অঘটন।
সকলে ধরাধরি করে তারামনকে ভিতরে নিয়ে গেল।

গফুর বিলে গিয়েছিল মাছ ধরতে । পানি নেমে যাচ্ছে দ্রুত। এখন খালগুলি দিয়ে মাছের ঝাকেরা নেমে যাচ্ছে নিম্নমুখী স্রোতের দিকে। এখন পলো দিয়ে কাড়িকাড়ি মাছ ধরা যায়। যাবার সময় বারবার জিজ্ঞাসা করেছে সে তারামনকে কোন খারাপ লাগছে কিনা। তারামন তাকে নিশ্চিন্তে যেতে দিয়েছে আর ডাক্তাররা ডেলিভারীর যে তারিখ দিয়েছে তার আরো এক সপ্তাহ বাকি। অনেক মাছ পেয়েছে সে আজ। গত কয়েক মাসে সে যত মাছ পেয়েছে সারা জীবনেও তা পায় নাই। বেশ খুশি মনে বাড়ি ফিরছিল গফুর। কিন্তু পাড়ায় ঢুকার পথে দোকানটার সামনে আসতেই লোকেরা জানাল যে, তার বাড়িতে আগুন লেগেছে। প্রায় দৌড়ে বাড়ি ফিরছিল সে। পথে সোহেলের সাথে দেখা।
: কি রে সোহেল কি হইছে?
: আগুন লাগছিল গোয়াইল ঘরে। গরুডা বাচব না ভাই। গরুডা বাচব না। তয় হেইডা বড় কতা নয়, বড় কতা হইল ভাবীর ব্যাথা উইঠা গেছে। আমি যাইতাছি স্বাস্থ্য কর্মীকে খবর দিতে। তুমি বাইত যাও।

গফুর প্রায় ছুটে আসল। অনেক মানুষের জটলা। সকলে দাড়িয়ে বিভৎষ গরুটাকে দেখতে লাগল। মেম্বারকে দেখে গফুর থমকে দাড়াল।
মেম্বার তাকে দেখে বলল: গফুর আইছো। আহো আহো। গরুডা বড় কষ্ট পাইতাছে। এহন কি করা যায়। কেউ কেউ কইতাছে গরুডারে জবাহ দিয়া দিতে। আমি কি কই জানো, পশু চিকিৎসককে খবর দেই। একটা চিকিস্যা অবশ্যই আছে।

গফুরের হৃদয়খানি কেপে উঠল। হু হু করে তার বুক। হাউ মাউ করে কেদে দিলো সে। বোবা জানোয়ারটার কষ্ট তাকে বেদনা বিহ্বল করে তুলল। গরুটা যেন গফুরের পথের দিকে তাকিয়ে ছিল। এখন তার চিৎকার করা শক্তি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পা দুটি ভাজ করে সে মাটিতে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। গফুর একটা কাঁথা ভিজিয়ে নিয়ে এলো। তারপর ঝলসে যাওয়া জানোয়ারটার গায় জড়িয়ে দিল। এতে বোধ হয় গরুটা আরাম পেল কিছুটা। মাঝে মাঝে এটা উঠে দাড়াতে চেষ্টা করল।
গফুর দৌড়ে গেল বাড়ির ভিতর। এখানে মেয়েদের ভিড়। গফুরকে দেখে তার মা বেরিয়ে এলো। গফুর আর্তনাদ করে উঠল: কি হইছে মা?
: বউ দৌড় দিছিল অর পরই তার ব্যাথা শুরু হইছে।
: এহন আমি কি করুম।
: আল্লা আল্লা কর। জরিমুনের মা দেখতাছে।
: ডাক জরিমুনের মারে। সোহেল গেছে ডাক্তার আনতে।
: আন বাবা তাড়াতাড়ি কর। নাইলে বউডারে বাচানো যাইবো না। পানি ভাইঙ্গা গেছে।
গফুরের মা জরিমুনের মারে ভিতর থেকে ডেকে আনল। জরিমুনের মা যা বলল তা হলো জরাযুর মুখ খুলে গেছে। বাচ্চাটার মাথাটা দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া অনেক রিক্স। যদি অনুমতি দেয়া হয় তবে এই দাই-ই বাচ্চা ডেলিভারীর চেষ্টা করতে পারে। গফুরের মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠল। ঘটনার নাটকীয়তা সে বিহ্বল হয়ে গেল। এমন সময় সোহেল এলো স্বাস্থ্যকর্মী মেয়েটিকে নিয়ে । তারা ভিতরে ঢুকে গেল। গফুর আল্লা আল্লা করতে লাগল।

মেয়েটি বেরিয়ে এসে বলল: সময় নেই গফুর ভাই। এ অবস্থায় কোথাও নেয়া যাবে না। এখানেই চেষ্টা করতে হবে। আমি দাইয়ের সাথে কথা বলেছি। আমরা দুজনই চেষ্টা করব। আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন।

সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। পাখিরা নীড়ে ফিরে যাচ্ছে উড়ে উড়ে। একঝাক সাদা বক উড়ে গেল হিজল গাছটার উপর দিয়ে । তারই ফাক দিয়ে অস্তগামী লাল সুর্যটা দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে বাড়িটা প্রায় ফাকা হয়ে গেল। মেম্বার এসে একবার গফুরের মাথায় হাত বুলিয়ে গেল। ঈমাম সাহেব মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। গরুটা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসছে। তার দুচোখ বুজে যাচ্ছে মৃত্যুর অবসাদে।

একসময় তার মনে পড়ল তারামনের কথা। বুকের ভিতর ঝির ঝির একটা ব্যাথা অনুভব করল গফুর। বেহুশ নেশাগ্রস্থ মানুষের মত টলতে টলতে এগিয়ে গেল সে। এখানে এক ভয়াবহ নিরবতা বিরাজ করছে, সকলের চোখে মুখে আতংকের ছাপ। কিছুই বুঝতে পারল না গফুর। তার মাথাটা ঠিক কাজ করছে না। টলতে টলতে এগিয়ে গেল সে, বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগল- ব্যাপার কি?
কেউ কোন জবাব দিল না। সকলে চোখে মুখে ভয় আর বিস্ময় নিয়ে দাড়িয়ে আছে। এতো লোক তবুও কোথাও কোন শব্দ নেই। গফুর ভাবল- বউটিও মারা গেল কি?
বুড়ি দাই-কে দেখা গেল থর থর করে কাঁপছে।
-ও খালা কি অইছে ? আমারে কেউ কিছু কও না ক্যান ? কি হইছে?
-আমি কইতে পারুম না। তুই ভিতরে গিয়া দ্যাখ।

ভিতরে ঢুকল গফুর। না, বউ জীবিত-ই আছে। জ্বল জ্বল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তারপর তার চোখ গেল পাশে রাখা ছোট বাচ্চাটার দিকে। কাঁথার উপর বাচ্চাটি কাঁদছে না এক ফোঁটাও। কিন্তু হাত দুটি নাড়ছে। নিচের দিকে চোখ যেতেই থমকে গেল সে। বাচ্চাটার নিচের দিকে দুটি পা ঠিকই নড়ছে। তার পাশেই আরও দুটি পা, দুটি হাত সামান্য ঝুলছে।
ব্যাপারটা একসাথে খেয়াল করল গফুর। বউ তার বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মরে যায়নি, ভীষন ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। উঠান ভর্তি মানুষ, বাচ্চাটি জীবিত কিন্তু কাঁদছে না এক ফোঁটাও। উপরের দিকে স্বাভাবিক এক মেয়ের অবয়ব। কিন্তু নীচের দিকে কিম্ভুতকিমাকার এক প্রাণীবিশেষ।

স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।

চলবে….

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২৭

কথা বলতে বলতে বাস ছেড়ে দিল। বুদ্ধি পরামর্শ বা চিন্তা ভাবনা যা করার তা গত রাতে আর আজকে ঝিটকা আসার পথেই নিশাত ভেবে নিয়েছে। বাস মানিকগঞ্জের কাছে আসার পর পাশে বসা নিরুকে জানিয়ে দিয়েছে পরবর্তীতে কি হতে যাচ্ছে। নিরুকে শুধু জিজ্ঞেস করেছিল
কাল যদি বিয়ে হয় তোমার আপত্তি আছে?
নিরু চুপচাপ। কোন উত্তর নেই
কি হলো কিছু বলছ না
কি বলব?
কি করবে তাই বল নয়ত যা বলেছি তার উত্তর দাও
আপনার যা ইচ্ছা তাই করেন তবে কোন পাগলামি করবেন না
পাগলামি কিসের? আমি বুঝতে পারছি না! ব্যপারটাতো আর একদিনের ঘটনা নয়, গত প্রায় সাতটা বছর ধরে চলছে এইটুক মনে পরছে তবে এর আগে কতদিন ছিল তা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। কেউ জানে না বলে কি তুমিও জান না? বাজে কথা রেখে যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দাও!
বললামতো আপনার যা ইচ্ছে তাই করেন!

নিরু জানালার বাইরে মুখ ঘুড়িয়ে বসে রইল। বাসে আর কোন কথা হয়নি। সোবহান বাগ নেমে বীণা আপার বাড়িতে নিরুকে পৌঁছে দিয়ে বাইরে থেকেই চলে এসেছিল। নিজের বাসায় না গিয়ে সেন্ট্রাল রোডে মেঝ মামার বাসায় এসে মামাকে খুঁজছিল। মামা বাসায় নেই। মামির সাথে আলাপ করছিল। মামি জিজ্ঞেস করল হঠাৎ করে চলে এসেছিস, কি ব্যাপার? ইত্যাদি নানা কিছু। অনেকক্ষণ পরে মামা বসায় ফিরেই দেখে নিশাত বসে আছে।
কিরে ব্যাটা কি খবর, কবে এসেছিস?
মামা একটা জরুরী কাজে চলে আসতে হলো তবে আবার সামনের জানুয়ারিতে চলে যাব।
কি এমন জরুরী কাজ?
বাসায় চলেন, মাকে বলেন তার বৌ নিয়ে আসার জন্য
কি বলছিস?
কাজলের কথা থেকে শুরু করে নিরুর কথা সব খুলে বলল মামাকে। বলল মামা আপনি আর মা কাল নিরুর বোনের বাড়িতে যেয়ে নিরুকে দেখবেন এবং ওর দুলাভাইকে বা অন্য কাউকে বাড়ি পাঠাবেন যেন চাচা চাচীকে নিয়ে আসে। সন্ধ্যায় তাদের মেয়ের বিয়ে হবে
দাড়া দাড়া! কি বলছিস তুই, আমি কি স্বপ্নে দেখছি? একটু খুলে বল!
নিরুর সাথের সমস্ত ঘটনা খুলে বলল এমনকি আজকের ওর দুবাই থেকে এখানে আসার কারণটাও যে নিরু সে কথাও খুলে বলল।
সব শুনে মামা বলল আচ্ছা সবই বুঝলাম কিন্তু একটু সময় দে, এখন রাত বাজে নয়টা এই সময়ের মধ্যে কি করব?
না মামা আপনাকে কিছু করতেই হবে। না হলে এইযে দেখেন আমার পকেটে টিকেট আমি জানুয়ারি মাসে লন্ডন চলে যাব আর কোন দিন ফিরব না! ভেবে দেখেন কি করবেন! বলেই পকেট থেকে টিকেট বের করে মামার সামনে মেলে ধরল।

মামি পাশেই ছিল। মামি নিশাতকে সমর্থন করে বলল তুমি যাও, আপার ওখানে খেয়ে দেয়ে আপা দুলাভাইকে বুঝিয়ে বলে রাজী করিয়ে ছেলে যেমন বলছে তেমন ব্যবস্থা করে আস।
আচ্ছা আপা দুলাভাইকে না হয় রাজী করালাম কিন্তু মেয়ের বাবাকে কে রাজী করাবে?
দুলাভাই যদি প্রস্তাব পাঠায় তাহলে ওরা কেউ অরাজি হবে না! এটা আমার বিশ্বাস। একই গ্রামের ছেলে মেয়ে। তাছাড়া ওদের কি একটা আত্মীয়তাও আছে। কাজেই বাছ বিচারের কি আছে? তাছাড়া তুমি ওই মেয়েকে দেখনি? নিরু! দুই জনে খুব মানাবে, যেমন আমাদের ছেলে তেমন মেয়েটা। কি লক্ষ্মী মেয়ে! দেখতে যেমন সুন্দর তেমন লেখাপড়া, বাধা কোথায়? তুমি এক্ষণি ওকে নিয়ে যাও।
শুধু এক পক্ষ দেখলেইতো হবে না!
আমাদের ছেলে কম কিসে?
দেখি বেটা চল

ড্রাইভার চলে গিয়েছিল বলে মামা নিজেই ড্রাইভ করে মতিঝিলে পৌঁছল। বাসায় যেয়ে এদিকে নিশাত পোশাক বদলাচ্ছিল ওদিকে মামা তার আপার কাছে খাবার চাহিদা জানাল।
কিরে জামিল তুই নিশাতকে কোথায় পেলি?
নাতো কোথাও পাইনি, এইতো তোমাদের সিঁড়িতে দেখা।
ও আচ্ছা,
একটু পরেই নিশাত চলে আসল। টেবিলে ভাত নিয়ে মা অপেক্ষা করছিল। মামা বলল, আপা একটা কথা বলি?
বল
নিশাত যখন এবার এসেছে তাহলে একটা বৌ নিয়ে আস!
হ্যাঁ আমিও বলছিলাম কাল সকালে
কি বলছিলে? মেয়ে দেখেছ? কে?
ওই যে রায়হান ভাইয়ের মেয়ে কাজলের কথা!
না আপা, আমার মনে হয় সোবহান বাগে থাকে তোমাদের ভাতিজি বীণা, ওর বোন আছে না একজন, কি যেন নাম!
কে! নিরুর কথা বলছিস?
হ্যাঁ হ্যাঁ নিরু, আমার মনে হয় নিরুকে মানাবে ভাল তাছাড়া ওরাতো একই এলাকার একই গ্রামের
না, তা কি করে হয়! এত দিন ধরে জানাজানি চলছে যদিও কথা দেয়া নেয়া হয়নি কিন্তু ভাবে সাবে এটা পরিষ্কার যে কাজলই এ বাড়ির বৌ হবে। এমন একটা অলিখিত কথা দুই সংসারে সবাই জানে এমন সময় হুট করে কি কিছু করা উচিত হবে?
দুলাভাই জানে, তার কি মত?
সে জানে, তারও একই মত
ছেলে কিছু বলেছে কখনও?
ও আবার কি বলবে? আমরা যা বলব তাই ওর কথা!
না আপা, এটা হয় না। আজকাল এ কথা তুমি বলতেই পার না। আজকাল সবারই নিজস্ব কোন মতামত অবশ্যই থাকতে পারে আর তোমাদের তা নিয়ে ভাবতেও হবে! সে যুগ আর নেই।
ওকে জিজ্ঞেস করে দেখ, কি বলে!
আপা, তোমরা রায়হান ভাইদের কিছু বলেছ?
না, আনুষ্ঠানিক ভাবে এমন কিছু বলা হয়নি তবে ঈদে বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাজলকে কাপড় চোপর দেয়া বা তেমন করে আদর আহ্লাদ করা যা এত কাল চলে এসেছে সেসব কি ইচ্ছে করলেই বাদ দেয়া যায়? নারে জামিল আমার কেমন যেন লাগছে! তুই হঠাৎ করে নিরুর কথা বলছিস কেমন করে তুইতো ওকে ভাল করে চিনিস না, তাহলে?

কে বলেছে চিনি না? খুব ভাল করেই চিনি! সিরাজ বেয়াইর মেয়ে, ওই যে মুন্নির বিয়েতে এসেছিল সেই মেয়ে। ওকে সেই ছোট বেলা থেকেই চিনি না? বড় হবার পর মুন্নির বিয়েতে দেখলাম, সেদিন দেখেই আমি নিশাতের কথা ভেবে রেখেছি। হ্যাঁ কাজলও ভাল মেয়ে আমি অস্বীকার করছি না কিন্তু নিশাতের জন্য ওর চেয়ে নিরুকেই মানায় ভাল। আমার যতদূর ধারনা মানে ওদের দেখে যা মনে হয়েছে তাতে মনে হয় ওরা উভয়েই উভয়কে পছন্দ করে!
তুই কেমনে জানলি?
আচ্ছা আপা বলতো আমার বয়স কি কম হয়েছে?
ঠিক আছে কিন্তু কাজলের কি হবে? ওর মা বাবার কাছে মুখ দেখাব কেমন করে?
বা রে! তোমরা কেউ কাওকে কোন কথা দাওনি, কারও সাথে এ ব্যাপারে কোন আলাপ হয়নি অথচ তোমরা ভেবে অস্থির হচ্ছ কেন বুঝতে পারছি না!
কি জানি দেখ তোর দুলাভাইয়ের সাথে আলাপ করে
সারারাত ধরেই জাহিদের মামা আর মা বাবার সাথে এই নিয়ে কথা কাটা কাটি চলল। এক সময় মসজিদে আজানের সুর ভেসে এলো। শেষ পর্যন্ত মেঝ মামাই জয়ী হলো।
আমি এত কিছু পারব না। আমি এখন নিশাতকে নিয়ে ওদের বাড়ি যাচ্ছি এবং বৌ নিয়ে আসব যা করার আপনারা করে রাখবেন বলে মামা বের হয়ে গেল যাবার আগে দুলাভাইকে বলে গেল আমি এখনই আসছি আপনারা রেডি হয়ে থাকেন।

সকালে ঠিক সাতটায় মামা এসে হাজির। নিচে গাড়ি রেখে উপরে এসে হৈ চৈ। কি ব্যাপার দুলাভাই আপা আপনারা রেডি হননি কেন? তাড়াতাড়ি করুন। দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হবেন।
অগত্যা মা বাবা নিম রাজি হয়েই মেঝ মামার সাথে গাড়িতে উঠে বসল। সবাইকে নিয়ে বীণা আপার বাড়ি। কবির দুলাভাই সাত সকালে এদের দেখে বেশ অবাক!
ও! মামা! কি ব্যাপার আপনারা এই সকাল বেলা!
বুঝবে বুঝবে একটু পরেই বুঝবে। বীণা কোথায় ওকে বল নাশতা বানাতে আমরা কেউ বাসা থেকে খেয়ে আসিনি।
সে হবে, এ তো ভাল কথা! বীণা দেখ কারা এসেছেন! নাস্তা রেডি কর।
নিশাতের মা ভিতরে যেয়ে হাতে আটা মাখা হাত ধরে নিরুকে বসার ঘরে এনে সোফার মাঝখানে বসিয়ে নিজে তার পাশে বসল। পিছনে বীণা আপাও আসল। মামা বলল আপা দুলাভাই আপনারা মেয়ে দেখেন। বীণা আপা এবং কবির দুলাভাই হতভম্বের মত তাকিয়েই আছে! হচ্ছে কি এসব!
মামা বলল, কবির শোন, মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে তুমি বাড়িতে কাউকে পাঠিয়ে দাও তোমার শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়ে আসবে।
মামা কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না
বুঝবে একটু পরেই বুঝবে, তোমার শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়ে আস তারপরে সব বুঝবে। আমাদের বৌ নিয়ে তোমার শ্বশুর কোথায় বিয়ে দিচ্ছে? যাক তাদের আনার ব্যবস্থা কর তারা এলে তখন বুঝবে।
দুলাভাই কিছুটা অনুমান করতে পেরে বলল
কাকে পাঠাব! আমাকেই যেতে হবে কিন্তু আমার যে অফিসে খুব জরুরী কাজ আছে!
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি একটা চিঠি লিখে ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দাও, আমার গাড়ি নিয়ে তুমি অফিসের জরুরী কাজ সেরে তাড়াতাড়ি চলে আস, আমরা আজ এখানেই থাকছি। বৌ নিয়ে তবে আজ আমরা এখান থেকে যাব। সাহস কত! আমাদের বৌ নিয়ে তোমরা এদিক ওদিক দেখাচ্ছ! তোমার শ্বশুর পেয়েছে কি?
আচ্ছা মামা! সবই হবে কিন্তু আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন কি হয়েছে, কি করতে চাইছেন? আমি এখনও পরিষ্কার করে বুঝতে পারছি না!
কেন বুঝতে পারছ না? তোমার এই শ্যালিকা নিরুকে আমরা আমাদের নিশাতের জন্য নিতে এসেছি। এত সকালে কোন মিষ্টির দোকান খুলেনি বলে মিষ্টি আনতে পারিনি, একটু পরে আমি যাচ্ছি মিষ্টি আনতে। ও ভাল কথা, গাড়িটা একটু পরে যাক, মিষ্টি পাঠাতে হবে। আর তুমি একটু পরে যাও আমার ড্রাইভার আসবে এখানে। আমরা কেউ কোথাও যাচ্ছি না।

ওইদিন বিকেলে নিরুর বাবা, মা, চাচা, শিহাব, মইন চাচা, তমাল ওরা সবাই আসল। যুঁই মিরপুরে শ্বশুর বাড়িতে ছিল বলে তখন আসতে পারেনি তবে ফোন করে বিকেলে আনান হয়েছিল। নিরুর দুলাভাই দুপুরের মধ্যেই অফিস থেকে ফিরে এলে মামা বীণাকে তার চাচীকে সাথে নিয়ে রান্না বান্নার আয়োজন করতে বলে নিরুকে নিয়ে মতিঝিল গেল। ওখান থেকে নিশাতকে নিয়ে নিউমার্কেটে এসে নিরুর পছন্দমত শাড়ি ব্লাউজ, পাঞ্জাবি শেরওয়ানি এবং অন্যান্য কেনাকাটা করে মতিঝিলের বাসায় নিশাতকে রেডি হবার জন্য নামিয়ে দিল। নিশাত মামাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে বাসায় গিয়ে তারাহুরো করে এতদিন ধরে জমান নিরুর জন্যে কেনা নানান কিছু থেকে যা তখন চোখে পরল একটা সুটকেস ভরে নিচে এনে মামার গাড়িতে তুলে দিল। মামা ওখান থেকে সোজা বীণার বাড়িতে আসল এবং নিরুকে বিয়ের পোশাক পড়িয়ে রেডি করতে বলে আবার মতিঝিলে এসে নিশাতকে বিয়ের পোশাক পড়িয়ে বীণা আপার বাড়ি নিয়ে কবির দুলাভাইকে কাজী আনতে পাঠাল।
নিরুকে সাজাবার সময় যূঁই নিরুর কানে কানে বলছিল তুই খুব ভাগ্যবতী, নিশাতের মত বর পেয়েছিস। নিশাত খুব ভাল ছেলে কত দিন থেকে দেখছি। তোর ছোট বেলা থেকেই কেন যেন আমার মনে হোত তুইই হবি নিশাতের বৌ এই জন্যেই তোকে সবসময় অমন করে বলতাম, এখন বুঝেছিস? নিশাতকে বলবি বৌর জন্য এত কিছু এনে রেখেছে আর আমার ঘটকালির শাড়ি কোথায়?
দুলাভাই কাজী আনতে যাবার পর নিরুর বাবার সাথে মামা আলাপ শুরু করল। নিরুর বাবা সামনের পরীক্ষার জন্য একটু আপত্তি জানিয়েছিল কিন্তু মামার আপত্তির কাছে তার আপত্তি টিকেনি। ওই রাতেই বিয়ে পড়িয়ে বৌ নিয়ে চলে এলো।

আকাশে চন্দ্র সূর্য এবং অগণিত তারকা অসংখ্য বার উদয় হয়ে আবার অস্ত গেছে, অনেক প্রতীক্ষার দুঃসহ লগ্ন পেরিয়ে গেছে দূর মহা সাগরের ওপাড়ে। নিরুর জীবনের অনেক গুলি নির্বাক বসন্ত কাউকে না জানিয়ে নিরুর চোখের নোনা জল বয়ে নিয়ে গেছে সেই কোন অচেনা সুদূর নীল জলের নীল মহাসাগরের অতলে যে সাগরে তার নিশাত ঘুরে বেড়ায়। নিরুর চোখের জলে মহাসাগরের সব জল নোনা হয়ে গেছে, নিরুর একটু খানি ছোট্ট অবুঝ হৃদয়ে যখন নিশাতের জন্য বিশাল হাহাকারের ঢেউ উত্তাল সাগরের উত্তাল তরঙের মত আছড়ে পরেছে এবং নিশাতের অনেক চাওয়া, অনেক সাধনা, অনেক প্রতীক্ষা, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আজ ছোট্ট দুটি অবুঝ মন এক হয়েছে। দুটি মন, দুটি আত্মা, দুটি হাহাকার, দুটি অবুঝ মনের আকুতি এক হয়ে মিশে গেল চির দিনের তরে স্বর্গিয় আবেশ পাওয়ার জন্য। শুরু হলো তাদের নতুন যাত্রা অনন্ত কালের জন্য। এ যাত্রা শুধু সমুখ পানে এগিয়ে যাবার।

সকল আনুষ্ঠানিকতা সেরে যখন নিশাত বাসর ঘরে ঢুকল তখন নিরু বলল’
বান্ধবীরা কেউ জানল না, গায়ে হলুদ নেই হাতে মেহেদি নেই, সারা জীবন মেহেদি পরিনি আমি কত ভেবে রেখেছি বিয়ের দিন হাতে মেহেদি পরব আর তুমি কি করলে এটা? এই ভাবে কারো বিয়ে হয়? সারা জীবন এমন পাগলামি করেছ তুমি!
(যারা নিরু আর নিশাতের বিয়েতে নেমন্তন্ন পাননি তারা কোন আফসোস করবেননা প্লিজ! হঠাত করে বিয়ে হয়ে গেলতো তাই, তবে বিবাহ বার্ষিকীতে মনে করিয়ে দিলে নেমন্তন্ন দেয়ার অনুরোধ করব। সবাই মিলে দারুন মজা করব। কি বলেন?)
আজ এখানেই ইতি টেনে দিলাম। সবাইকে ধন্যবাদ, যারা এতদিন ধরে ধৈর্য ধরে সাথে ছিলেন। আবার দেখা হবে মেগা সিরিয়াল “নক্ষত্রের গোধূলি” এর সাথে।

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২৬

১৮।
সেই নিরু এবার এমএসসি ফাইনাল দিচ্ছে, সামনেই পরীক্ষা, কবে শুরু হবে এখনও জানে না। এদিকে নিশাতও ক্যাডেট থেকে চিফ মেট হয়েছে এবং বুঝে নিয়েছে তার অনুমান ভুল নয়। সারা পৃথিবী ঘুরে জাহাজের জটিল এবং ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ জীবন যাপন করে এসে এই প্রশান্ত চোখ যার তার বুকে একটু আশ্রয় পাবে। নিশাত ভেবেছিল আর কিছুদিন পরে চিফ অফিসার হয়ে নিরুকে নিয়ে আসবে। এমনিতে যেমন আছে তেমনি চলছে কিন্তু বিয়ের পর কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারবে না। কত কি মনে পড়ছে! নিশাত সালোয়ার কামিজ পরা পছন্দ করে না বলে নিরু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পরে থেকে শাড়ি পড়ছে। নিশাতের গান শুনতে ভাল লাগে বলে নিরু গান শিখেছে, ছায়ানটে সেকেন্ড হয়েছিল। গাড়িতে পাশাপাশি বসে যাবার সময় বাতাসে নিরুর এলো চুল উড়ে এসে নিশাতের চোখে মুখে লাগবে আর হাতে সরিয়ে দিতে দিতে আরও কাছে আসবে তাই মাথায় তেল দেয়া চুল বাতাসে উড়বে না বলে নিশাতের ভাল লাগার জন্য শ্যাম্পু করা চুলেই নিরু অভ্যাস করে নিয়েছে। মোটামুটি নিরু নিশাতের জন্য নিজেকে সর্বতোভাবে প্রস্তুত করেছে। ওই বুকেই নিশাতের জন্য সঞ্চিত আছে উত্তাল সাগরের মত সীমাহীন সুখ আর নিরাপত্তা, ওই হাত ধরেই এগিয়ে যাবে অনেক দূর! আবার নিশাতকেও অনেক অভ্যাস পরিবর্তন করতে হয়েছে। আগে নিশাত বেশ ড্রিঙ্ক করত কিন্তু নিরুর কাছে প্রতিজ্ঞা করে সে অভ্যাস বাদ দিয়েছে তবে নানা দেশে যাদের চলাচল তাদের বিদেশিদের সাথে চলা ফেরা করতে হয়, তাদের সাথে নানান পার্টিতে যেতে হয়। শুধু পার্টির সময় হালকা কিছু পান করার অনুমতি নিয়ে নিয়েছে এবং তার পরদিন কতটা কি ড্রিঙ্ক করেছে তা বিস্তারিত নিরুকে জানাবার প্রতিজ্ঞা করেছে। নিরু আকাশী রঙ পছন্দ করে তাই নিশাতের অন্তত শার্ট আর টি শার্ট মিলে গোটা ছয়েক আকাশী রঙের জামা আছে। এই অবস্থায় কে কাকে ছাড়া বাঁচবে? নিশাতের আলমারি ভরা নিরুর জন্য মুম্বাই থেকে কেনা শাড়ি, ব্রিটেন জার্মানির কসমেটিকস, শ্যাম্পু, ফ্রান্সের পারফিউম কত কি। কিন্তু নিরু এখনই এসবের কিছুই নিবে না। ওই এক কথা সবাই জিজ্ঞেস করলে কি বলব? বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন ভর্তি হলো সেদিন নিশাতই সঙ্গে গিয়েছিল। নীলা এখনও জিজ্ঞেস করে ওই যে প্রথম যেদিন তোর সাথে দেখলাম সেই কি তোর সৌভাগ্যবান? নিরু আস্তে করে এড়িয়ে যায় কাউকে কিছু বলে না, বলতে পারে না অত্যন্ত চাপা মেয়ে।

কত স্বপ্ন। চিফ মেট হলে নিরুকে সাথে নিয়ে যেতে পারবে তখন দুইজনে একসাথে থাকবে। জাহাজের সাথে সাথে নিরুকে নিয়ে পৃথিবী ঘুরে বেড়াবে। লন্ডনের কথাই বারবার মনে আসে। বিয়ের পর দুই মাসের ছুটি নিয়ে লন্ডন আসবে। নিরুর হাত ধরে পিকাডেলি সার্কাস দেখবে, বাকিংহাম প্যালেস দেখবে, বিগবেন, মার্বেল আর্চ, লিভারপুল স্ট্রিট, অক্সফোর্ড সার্কাসে কেনাকাটা করবে। সন্ধ্যায় টেমসের পাড়ে নিরুর হাত ধরে দাঁড়িয়ে টেমসের বয়ে যাওয়া দেখবে। টিউব রেলে করে হোয়াইট সিটিতে গিয়ে বিবিসি বিশ্ব দেখবে, ব্রিটিশ মিউজিয়াম, মাদাম তোশো কত কি দেখবে! ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, বার্লিন আর প্রেমের তীর্থ ইটালির ভেনিসে না গেলে কি হয়? প্রেম নগরী ভেনিসে নৌকায় করে ঘুরবে। শীতের দেশে নাইট নেভিগেশনের সময় নিরু ব্রিজে থাকবে আর দুজনের হাতে থাকবে কাল কফির মগ। সারা দিনে কঠিন ডিউটি করে রাতে নিরুর বুকে আশ্রয় নিয়ে নিশ্চিন্তে পরম শান্তিতে ঘুমাবে! যখন ভাবনার সাগরে ডুবে গেছে তখনই বেরসিক বিমানবালার কণ্ঠস্বরে চমকে উঠল, বিমানের বাঙালি বিমান বালা বলছে, ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয় গন আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাকা বিমান বন্দরে……………………………..।

ভোরে ঢাকায় নেমে প্রথমে বাবার মতিঝিলের বাসায় যেতে হবে। মা বাবা কেউ জানে না যে নিশাত আসছে। তারা হঠাৎ করে নিশাতকে দেখে অবাক হয়ে যাবে। হিসাব অনুযায়ী আরও প্রায় এক মাস পরে ওর আসার কথা, কাজেই এমন সময় দেখলে অনেকগুলো মিথ্যা বলতে হবে। ওদিকে নিরু এখন কোথায়? হলে নাকি বাড়িতে! ওকে পেতে হলে আগে যেতে হবে বীণা আপার বাড়িতে। ক্লাস না থাকলে ও হলে থাকে না এখানেই চলে আসে। ভোর পাঁচটায় ঢাকা নেমে মতিঝিলের বাসায় আসতে আসতে সকাল আটটা বেজে গেল। মা দেখেই হা করে তাকিয়ে রইল, কি ব্যাপার তুই কোথা থেকে কেমন করে? ভাগ্য ভাল বাবা অফিসে চলে গেছে। বলছি বলছি সবই বলছি। চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে মার সাথে নাস্তার টেবিলে বসে আলাপ হলো। জাহাজ আমস্টারডাম যাবার আগে হঠাৎ করে রিলিভার চলে এলো বলে এসেই পরলাম আগামী মাসের শেষ দিকে আবার চলে যাব। ও আচ্ছা, ভাল হয়েছে। ওদিকে তোর বাবা রায়হান ভাইকে বলে রেখেছে সামনের মাসে তুই আসবি। রায়হান চাচাকে আমার আসার কথা জানাবার এমন কি প্রয়োজন?
বারে! তাকে জানাব না তো কাকে জানাব? কি বলছিস তুই? এবারে তুই আসার পরই কাজলকে নিয়ে আসার কথা ভাবছি আমরা সবাই আর তুই কি বলছিস?
কেন কাজল কি কখনও এ বাসায় আসেনি?
সে আসা এ আসা কি এক হলো?
দুই হলো কি করে? মা তোমরা যা ভাবছ তা হবার নয়!
কেন কি হয়েছে? হবে না কেন?
সে অনেক কথা কাজেই এমন করে এখনই কিছু ভাববে না এবং চাচার সাথেও এ ব্যাপারে কিছু আলাপ করবে না। মনে থাকে যেন! আমি এখন একটু বাইরে যাচ্ছি, ফিরতে দেরি হবে।
কোথায় যাবি?
এইতো কাছেই!
তাড়াতাড়ি ফিরবি।
আচ্ছা চেষ্টা করব!

বাসা থেকে বের হয়ে একটা স্কুটার নিয়ে সোজা সোবহান বাগ বাস স্ট্যান্ডের পাশে বীণা আপার বাড়িতে। এখানেও দুলাভাই বাড়ি নেই। এই সময়ে পুরুষ মানুষ কেইবা বাড়ি থাকে!
বীণা আপাও মায়ের মত অবাক, কি ব্যাপার নিশাত কবে আসলি? তুই না বলে গেলি জানুয়ারিতে আসবি!
আজই সকালে আসলাম, হ্যাঁ বলেছিলাম আগামী মাসে আসব কিন্তু চলে আসলাম, কোম্পানির খরচে যাতায়াত কিনা
ও আচ্ছা!
কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর, আচ্ছা আপা নিরু কোথায়?
ওতো বাড়িতে! ক্লাস বন্ধ তাই। এইতো কয়েকদিন আগেই চলে গেল, এ কয়দিন এখানেই ছিল বাবা এসে নিয়ে গেছে!
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আজই মানিকগঞ্জে যেতে হবে। আমি তাহলে চলি আপা!
সে কি?এতদিন পরে আসলি কিছু খেয়ে যা!
না আপা আজই আসলাম তো একটু কাজ আছে, মতিঝিলে যেতে হবে।
বীণা আপা কি বুঝল কে জানে!
বাসায় ফিরে এসে একটা ব্যাগ গুছিয়ে সোজা গুলিস্তান বাস টার্মিনাল। ব্যাগ গোছাবার সময় মা জিজ্ঞেস করেছিল: কিরে কোথায় যাচ্ছিস? এইমাত্র এসেছিস এখনই আবার কোথায় যাবি?
একটু বাড়ি যাব মা
দুই একদিন পরে যা
না আজই যাই
মানিকগঞ্জের শুভ যাত্রা কোচ কোথায় থেকে ছাড়ে নিশাত ভাল করেই জানে। বিকেলের আগেই বাড়ি পৌঁছে গেল।

মইন চাচা দেখেই অবাক,
কিরে নিশাত তুই কবে এসেছিস?
এইতো কাকা আজই এসেছি। শিহাব কি বাড়িতে আছে?
আছে বাড়িতেই আছে, একটু আগে এখান থেকে গেল
চলনা চাচা একটু শিহাবের সাথে দেখা করে আসি
এত ব্যস্ত হবার কি আছে, মাত্র এসেছ বিশ্রাম নাও খাওয়া দাওয়া কর সন্ধ্যার আগে গেলেই হবে
না চাচা তুমি চল ওদের ওখানেই যা আছে খেয়ে নিব
বাড়িতে শিহাবের সাথে দেখা হলেই নিরুকে পাওয়া যাবে।
চল, বলেই হাটা শুরু করল।
শিহাব মইন চাচার ওখান থেকে এসে বাগানের কাজ শুরু করেছে, হাতে একটা প্রুনার। দূর থেকে মইন চাচা আর নিশাতকে দেখে প্রুনার হাতেই এগিয়ে গেল আরে নিশাত কবে এসেছিস? কেমন আছিস?
ভাল আছি! আজ সকালেই এসেছি, তোরা কেমন আছিস?
আমরাও ভাল গত কয়েক দিন একটু ব্যস্ত ছিলাম নিরুকে দেখতে এসেছিল তাই
কথাটা শুনেই নিশাতের বুকে ধক করে উঠল, কি বললি, কাকে দেখতে এসেছিল?
ওইতো নিরুকে
নিশাত এতক্ষণে বুঝতে পারে। সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেল। স্বপ্নে দেখা, চিঠি এবং ঢাকায় না থাকার সব কিছু এক এক করে নিশাতের চোখার সামনে ভেসে এলো। একই সূত্র। এখনই ওর সাথে দেখা করতে হবে।
আচ্ছা শোন, তুই ভিতরে চাচীদের বল আমার ক্ষুধা পেয়েছে কিছু খেতে দিতে বল।
নিশাত জানে এখন কোন চাচীই ওকে ভাত বেড়ে দিবে না, এখন একমাত্র নিরুই আসবে ওকে ভাত বেড়ে দেয়ার জন্য আর এটাই একমাত্র সুযোগ।
চাচীরা সবাই ব্যস্ত আমি নিরুকে বলছি
যা তাড়াতাড়ি কর
শিহাব বাড়ির ভিতরে গিয়ে সম্ভবত নিরুকে কিছু বলে আসল একটু পরে নিরু এসে শিহাবের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল আসুন ভিতরে আসুন।

নিশাত উঠে নিরুর সাথে খাবার ঘরে গেল
নিরু
সারা রাত জার্নি করে এই সময়ে এখানে আসা এমন কি জরুরী ছিল? কাল আসলে কি হতো?
তুমি এমন করে স্বপ্নে দেখা দিচ্ছ বারবার, চিঠিতে একই কথা লিখছ, আসব নাতো কি করব? সিঙ্গাপুর থেকে যে চিঠি পেয়েছি তাতে যা লিখেছ দুবাই যেয়ে যে চিঠি পেলাম তাতেও ওই একই কথা
আমি আপনার কে হই যে আমাকে এত স্বপ্নে দেখবেন?
না তুমি আমার কিচ্ছু হও না, খুশী হয়েছ এবার?
আমার খুশীতে কার কি আসে যায়?
তুমি জান না কার কি আসে যায়? তুমি সামনে পরীক্ষা রেখে এখানে এসেছ কেন, তাই বল
কেন আবার? এই জন্যেইতো বারবার লিখেছি দুলাভাইকে জানাতে। তাছাড়া আমিতো আসতে বলিনি, আমি বলেছি দুলাভাইয়ের সাথে আলাপ করতে, ফোনে আলাপ করে কথাটা বলে দিলেই হত না? নয়ত চিঠিতে লিখলেই হতো
কথা বলবে নাকি খেতে দিবে? ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে, এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় যেয়ে নাস্তা করেছি এর পরে আর কিছু খাইনি
দিচ্ছি, খেয়ে নেন
কি রান্না হয়েছিল?
করল্লা ভাজি, টেংরা মাছ আর ডাল আছে
করল্লা ভাজি!
হ্যাঁ, আমি রান্না করেছি
ও আচ্ছা তাহলে দাও
নিশাত সাধারণত করল্লা ভাজি খায় না কিন্তু নিরু ভাজি করলেই শুধু খেতে পারে। খেতে খেতে কথা হচ্ছিল।
বল দেখি কি ব্যাপার?
ব্যাপার আর কি, যা হবার তাই, ঘিওর থেকে এক ডাক্তারের বাবা লোকজন নিয়ে এসেছিল, ছেলে নাকি হোলি ফ্যামিলিতে ডাক্তারি করে। আগে থেকে দুলাভাইকে বলে রাখলে এসব ঝামেলা হতো? কতবার বলেছি তা আমার কথায় তিনি কানই দিলেন না
তারা কেন এসেছিল?
কেন এসেছিল তাও বলে দিতে হবে?
তুমি কিছু বলনি?
কি বলব? আমি আপনার ভাতিজা নিশাতকে ভালবাসি আর নিশাত আমার সাথে প্রেম করে বলে এ বিয়েতে মত দিতে পারছিনা, তাই বলব?
কি যা তা বলছ, এই শোনার জন্য আমি দুবাই থেকে এসেছি? এক ফাঁকে এদিক ওদিক দেখে নিরুর হাত ধরে
নিরু!
বলেন
ঘটনা জটিল বুঝতে পারছি, কিন্তু তুমি কি বলেছ সত্যি করে বল
আমি বলেছি, পরীক্ষার আগে কিছু ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব নয়
বেশ করেছ, তাহলে এখন কি করতে হবে বল
মা বা চাচী কেউ এসে পরবে আপনি খেয়ে নেন পরে বলছি।
খাবার শেষ করে নিশাত শিহাবের ঘরে এসে বসল। শিহাব তখনও বাগানেই কাজ করছে চাচা পাশে বসে আছে। একটু পরে নিরু খাবার ঘরের সব কিছু গুছিয়ে রেখে এ ঘরে এসে সেই ছোট বেলার মত খুটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।
নিশাত আস্তে করে বলল,
তুমি কালই আমার সাথে ঢাকা চলো।
ঢাকা যেয়ে কি হবে?
একটা পথে খুজে পেতে হবে না?
পথ খুজতে হবে না, শুধু দুলা ভাইকে বললেই হবে
তাতেওতো ঢাকা যেতে হবে
আচ্ছা মাকে বলে দেখি

ঝিটকা পর্যন্ত শিহাব এবং নিরুর ছোট ভাই তমাল সাথে এলো। বাসে উঠিয়ে দিয়ে তমাল নিচে দাঁড়িয়ে বোনের সাথে কথা বলছিল। নিশাত নিচে দাঁড়িয়ে শিহাবের সাথে কথা বলছিল
এবারে কতদিন থাকবি?
নারে, বেশিদিন থাকা যাবে না, যাবার টিকেট দিয়ে দিয়েছে সাথে। জানুয়ারির ২৬ তারিখে চলে যাব।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২৫

আবার বিদায়, আবার বিরহ। তবে এবারের বিরহ আগের দিন গুলির মত নয়। একটু ভিন্ন রকমের। এতদিন দুজনে ভিন্ন ভাবে দুজনার কথা ভাবত কিন্তু এবার তাদের চলা পথ সম্ভবত একই স্রোতে মিশে যাবার পথ খুঁজে পেয়েছে।

যাবার আগে একদিন সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের এক বেঞ্চে বসে নিরুর কাঁধে হাত রেখে বলল নিরু তুমি চিঠি লিখতে পারবে?
কেন?
কেন মানে? মানুষে চিঠি লিখে কেন?
যারা চিঠি লিখে তাদের একটা নির্দিষ্ট ঠিকানা থাকে কিন্তু আপনার কি তেমন কিছু আছে? এ দেশ থেকে ওই দেশে ঘুরে বেড়ান আপনার কাছে চিঠি লিখব কোথায়? সাগরের ঠিকানায় লিখে পাঠাব আর সে চিঠি সাগর জলে ভেসে বেড়াবে? কোন সাগরের ঠিকানায় লিখব বলে যান
নিশাত এবার একটু চিন্তায় পড়ে গেল। তাইতো কোন ঠিকানায় চিঠি লিখবে?
আমি কখন কোথায় থাকি সে ঠিকানা জানিয়ে আমি লিখব আর তুমি সেখানে লিখবে। যদিও সে চিঠি আমি কবে পাব তার কোন ঠিক নেই তবুও দেরিতে হলেও আমি তোমার ছোঁয়া মাখা চিঠিটা পাব এবং আবার কিছুদিন চলার শক্তি পাব।
বেশ তাই করবেন কিন্তু আমার কাছে লিখতে কোথায় লিখবেন?
কেন, আপার বাড়িতেই লিখব
আপা কি মনে করবে?
কেন মনে করবে?
আপা আপনাকে খুব স্নেহ করে কিন্তু চিঠি পত্র দেখলে যদি বিরূপ কিছু ভেবে নেয়?
না, আপা সে সুযোগ পাবে না, তার মনে করার মত কোন কাজই আমি করব না। তোমার কাছে যে চিঠি লিখব সে চিঠি ইচ্ছে করলে তুমি আপাকেও দেখাতে পারবে, আমি এমন করেই লিখব।
তাই কি হয়?
হবে, দেখবে এতে ভালই হবে তুমি মাঝে মাঝে তোমার চিঠিগুলি আপাকে পড়তে দিও আর হ্যাঁ আমিও আপা দুলাভাইকে মাঝে মাঝে লিখব।
এমন হলে লিখতে পারেন।

এভাবেই নিশাত কয়েকটা ভয়েজ করে ফেলল। প্রতিটি ভয়েজ শেষে দেশে এসেই আগে নিরুকে চোখে দেখার জন্য ছুটে এসেছে বীণা আপার বাড়ি। আর কেউ কিছু না বুঝলেও হয়ত বীণা আপা কিছু অনুমান করেছে। এখন আর নিরুকে হারাবার ভয় নেই। যখন যে দেশেই গেছে সেখানে বন্দরে পৌছার আগেই চিঠি লিখে খামে ভরে রাখত, মুখ আটকাত না যেন পোস্ট করার আগে সর্বশেষ কথাটা নিরুকে জানান যায়। কবে কোন বন্দরে গেছে সে দেশ কেমন, সে বন্দর বা শহর কেমন, লোকজনের পোশাক আসাক থেকে শুরু করে তাদের খাবার দাবার এবং যাবতীয় বৃত্তান্ত সহ জাহাজে কবে কি করেছে কি খেয়েছে এই সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লিখতে লিখতে সে চিঠি কখনও বিশ পাতা পর্যন্ত হয়ে যেত। পরের চিঠি কোন ঠিকানায় লিখবে সে এজেন্টের ঠিকানা দিয়ে দিত সাথে। নিরুর চিঠির সাথে আপা বা দুলাভাইকেও কিছু লিখতে কখনই ভুল করত না। আপা বা দুলাভাইকে লিখত নিরুর চিঠিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছি ওর চিঠি দেখে নিবেন। দুলাভাইকে কখনও ইউরোপিয়ান মেমসাহেবদের কাহিনী লিখত। আবার মাঝে মাঝে ইয়ার্কিও করত, দুলাভাই আপনি সাথে থাকলে একজন মেমসাহেব কিনে দিতে বলতাম। যখন যেখানে গেছে নিরুর জন্য কিছু না কিছু কেনাকাটা করবেই। কখনও দেখা গেছে নিরুর জন্য যা কিনেছে তাই দিয়েই ওর এয়ার টিকেটে ফ্রি লাগেজ এলাউন্স যা পেত তার অর্ধেক হয়ে গেছে। দেশে এলে নিরুকে সেগুলি দিতে গেলে কখনও নিরু কিছুই নিত না। বলত
কেউ জিজ্ঞেস করলে কাকে কি বলব? এ নিয়ে আমি কাউকে কোন কৈফিয়ত দিতে পারব না।
নিশাত অনেক পিড়াপিড়ি করেছে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। নিরুর ওই এক কথা। সেবার প্যারিস থেকে একটা পারফিউম এনে বলেছিল
এটাতো কেউ দেখবে না এটা অন্তত নাও।
আসলেই আপনার মাথা খারাপ।
মাথা খারাপের কি হলো?
বলে নিশাত নিরুর মুখের দিকে চেয়েছিল আর নিরু বলেছিল
এর গন্ধ আমি ঢেকে রাখব কি দিয়ে? এ কথা কবে বুঝবেন আপনি?শুধু শুধু এত খরচ করেন কেন? এসব আজে বাজে খরচ না করে টাকা জমাবেন ভবিষ্যতে কাজে লাগবে, মনে যেন থাকে
নিশাত ও কথায় কান না দিয়ে সেগুলি এনে যত্ন করে তার ওই আলমারিতে তুলে রাখত আর ভাবত নিরু যেদিন নিজে এই আলমারির তালা খুলে এগুলি নিবে সেদিনই ও ব্যবহার করবে এর মধ্যে পচে গলে যা হয় হোক এগুলি নিরুর।

গত কয়েকটা ভয়েজে নিশাতের বেশ উন্নতি হয়েছে। লন্ডনে পরীক্ষা দিয়ে সেকেন্ড অফিসার হয়েছে। পাশ করল যেদিন সেদিন মা বাবা এবং বীণা আপা দুলাভাই সহ নিরুকে একসাথে চিঠি লিখে জানিয়েছিল। বীণা আপার বাসায় ফোন করে নিরুর সাথে কথা বলেছিল। আর মাত্র আড়াই বছর পরেই চিফ মেট পরীক্ষা দিব। নিরু তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া করবে যেন আমি সুস্থ থেকে দিনগুলি কাটাতে পারি। আর তুমিও ভাল করে পড়াশুনা করবে। আর হ্যাঁ গানের ব্যাপারে কিন্তু আলসেমি করবেনা। দেখবে একদিন আমি সব পাব। তখন তোমাকে নিয়ে শুধু ঢাকা নয় পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরে বেড়াব। তুমি আমার পাশে থাকবে। তোমার হাত ধরে চলে যাব অনেক দূরে যেখানে চির বসন্ত থাকে সেই দেশে। আমাদের দেখে আকাশের তারারাও হেসে হেসে আমন্ত্রণ জানাবে। যেখানে থাকব শুধু তুমি আর আমি।
এমন করে তোমার কিছু মনে হয় না নিরু?
হয়, আমারও অনেক কিছু মনে হয় কিন্তু আমারযে ভীষণ ভয় করে!
কিসের ভয়? কোন ভিয় নেই। দেখবে একদিন আমাদের সব হবে।

১৬।
এমনি করে সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনা, মান অভিমান, বিরহ বিরাগ নিয়ে দিন মাস বছর চলে গেল। এর মধ্যে নিশাত চিফ মেট পরীক্ষায় পাশ করেছে কিন্তু কোম্পানির কোন জাহাজে আপাতত চিফ মেটের পদ খালি নেই বলে ওই পদে পোস্টিং পাচ্ছে না তবে চিফ মেট এর বেতন পাচ্ছে। এক সময় সপ্তম ভয়েজের মাঝামাঝি একদিন নিশাতের সারা রাতে ঘুম হয়নি। মাত্র শেষ রাতের দিকে একটু চোখ লেগে আসছিল, এর মধ্যেই কোথা থেকে যেন নিরু এসেছিল। সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে আজ সকালে দুবাই থেকে পাওয়া চিঠির মত একই ভাষায় বারবার করে বলে গেল আপনি দুলাভাইকে বলবেন। আমার মনে হয় এখন অন্তত দুলাভাইকে বলার সময় হয়েছে। দুবাই পোর্টে হারবারে জাহাজ ভিড়ার পর এজেন্টের গাড়ি এসে যে মেইল ব্যাগ দিয়ে গিয়েছিল তাতে একটাই চিঠি ছিল আর সেটা নিরুর লেখা নিশাতের চিঠি। এই চিঠিতেও অন্তত পাঁচ বার লিখেছে আপনি তাড়াতাড়ি দুলাভাইর সাথে যোগাযোগ করে কথাটা বলুন নতুবা আমি শেষ হয়ে যাব আর এজন্যে একমাত্র আপনিই দায়ী থাকবেন। কেন এবং কি বলতে হবে তা কিছু লেখেনি। না লিখলেও নিশাত জানে কি বলতে হবে। স্বপ্ন দেখার পর ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানায় শুয়ে শুয়েই চলে গেল এবার দেশ থেকে আসার আগে যখন নিরুর সাথে নবাব বাড়ির বাগানের এক পাশে বেঞ্চে বসে চিনাবাদাম খাবার সময় কথা হচ্ছিল সেখানে। আগের মত নিরু একটা একটা করে চিনা বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছিল।
আপনি কি কোন দিন নিজে ছিলে বাদাম খেতে পারবেন না?
হয়ত পারব যেদিন তুমি করে বলতে পারবে। আসলে হয়েছে কি জান, ওসব দেশে লবণ দিয়ে ভাজা বাদাম প্যাকেট করা থাকে কাজেই দোকান থেকে কিনে অমনিই খেয়ে ফেলা যায়, আবার এখানে আসলে তুমিইতো ছিলে দাও, কাজেই আমাকে আর কোথাও ছিলে খেতে হয় না
ছেলা বাদাম হাতে দেয়ার সময় একটা চিমটি দিয়ে বলেছিল
তাহলে আর আপনার এ দেশে আসার দরকার নেই ওখান থেকেই কোন মেমসাহেব নিয়ে এলেই পারেন আমরাও একজন মেমসাহেব দেখতাম!
উহ কি হলো চিমটি দিলে কেন, লাগেনা? বেশতো আমি না হয় মেমসাহেব আনলাম কিন্তু তুমি কাকে আনবে? তাছাড়া তোমার মেম সাহেব কি বাদাম ছিলে দিবে?
বাদাম ছিলায় মগ্ন হয়ে বলল
আমার কাউকে লাগবে না! যে মেম সাহেব বাদাম ছিলে দিবে তাকেই আনবেন!
আচ্ছা তাকেই আনব।
সেদিন সারা দিন একসাথে ঘুরেছিল। দুপুরে ম্যান্ডারিনে লাঞ্চ করেছিল আবার বিকেলে নবাব বাড়ি থেকে বাদাম তলি এসে নৌকায় করে বুড়িগঙ্গায় ঘুরেছিল। কোথা দিয়ে যে সারাটা দিন চলে গেল টের পায়নি। বুড়িগঙ্গায় সূর্য ডুবতে দেখে নিরু চমকে উঠেছিল। নিশাতের হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেছিল,
তাড়াতাড়ি চলেন আমাকে সন্ধ্যার আগেই হলে ফিরতে হবে বলে এসেছি।
এমএসসি ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষা সামনে বলে পরীক্ষা পর্যন্ত হলে থেকে পরীক্ষা দিবে বলে হলে এসে উঠেছে। বিগত দিনগুলিতে দুইজনে ঢাকা শহর এবং এর আশেপাশে এমনি করে অনেক ঘুরেছে। সাভারের স্মৃতিসৌধে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে, সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে, আরিচা ঘাটের কাছে পদ্মা নদীর পাড়ে। সোহরাওয়ার্দি উদ্যান থেকে ফেরার পথে একবার শাহবাগের নিচে সুপর্ণা থেকে একটা পারফিউম কিনে দিয়েছিল। আগের মত নিরু এটাও নিতে চায়নি কিন্তু নিশাতের চাপাচাপিতে নিতে হয়েছিল। এটা কি আর কেউ দেখবে! তোমার হলে রাখবে কেউ দেখবে না। যখন গায়ে মাখবে এর সুগন্ধ আমার কথা মনে করিয়ে দিবে। মনে করবে আমি সারাক্ষণ তোমাকে জড়িয়ে রেখেছি।
এই পারফিউম মেখে আপনাকে মনে করার দরকার হবে না। এমনিই সবসময় আপনি আমার সাথে থাকেন। বলছেন কেউ দেখবে না! জানেন হলের বান্ধবীরা কেমন হয়? ধারনা আছে কিছু? ওরা একেকটা বিচ্ছুর মত বিশেষ করে রোকেয়া আর নীলাতো জোকের মত লেগে থাকবে, বল না কোথায় পেলি! জানেন?
১৭।
দুবাই থেকে জাহাজ আমস্টারডাম যাবার আগে অস্থির হয়ে সাইন অফ করে শুধু নিরুর জন্য দেশে ছুটে এসেছিল চৌকস সেকেন্ড অফিসার নিশাত জামান যে কিনা আর কয়েকদিন পরেই এমনি এক জাহাজের চিফ অফিসার হবে। ক্যাপ্টেন স্টিভ বারবার বলছিল
জামান তুমি আমস্টারডাম যাবার পর সাইন অফ কর!
না, সে কথা মানেনি। তাকে শুধু বলেছিল
দেখ স্টিভ, তুমি প্লিজ আমাকে বাধা দিও না, যে করেই হোক নিরুকে আমার চাই ই চাই ওকে ছাড়া আমার জীবন ভাবতে পারিনি কোনদিন।
ক্যাপ্টেন স্টিভ অবাক হয়েই বলেছিল
‘হু ইজ নিরু?’
ওহ স্টিভ সরি! আমি তোমাকে বেফাঁস বলে ফেলেছি। নিরু ইজ মাই ডার্লিং এন্ড মাই ড্রিম এন্ড আই কেন নট সারভাইভ উইদাউট নিরু! গত কয়েকদিন থেকেই আমি ওকে স্বপ্নে দেখছি আর এখানে আসার পর ওর চিঠিতে জরুরী এক সংবাদ জেনেছি!
আই মিন ইউ আর টেলিং এবাউট ইয়োর লাভ এফেয়ার? যার ছবি তোমার কেবিনে সাজান রয়েছে?
ইয়েস স্টিভ, ইউ আর রাইট!
ও! রিয়েলি সি ইজ এ নাইস লেডি!
বেটার ইউ আসক ফর এনাদার সেকেন্ড অফিসার এন্ড রিলিজ মি। আই উইল জয়েন আফটার এ মন্থ হোয়েন ইউ উইল বি ইন লন্ডন!
ঠিক আছে জামান তুমি যাও আমি তোমার টিকেটের ব্যবস্থা করছি। আর দেখি ইরান বা ইন্ডিয়া থেকে কোন সেকেন্ড অফিসার পেলে তাকে দিয়ে এই এক মাস চালিয়ে নিচ্ছি তবে তুমি জানতো আমস্টারডাম থেকে আমরা মাইনর রিপেয়ারের জন্য লন্ডন যাব এবং তুমি কিন্তু আমরা লন্ডন ছেড়ে যাবার আগেই ফিরে আসবে।
হ্যাঁ ঠিক আছে তুমি দরকার মনে করলে আমার টিকেট ওই ভাবে করিয়ে নিতে পার দুবাই-ঢাকা-লন্ডন।
আচ্ছা জামান ঠিক আছে আমি তাই করছি। উইশ ইয়োর বেস্ট লাক এন্ড হ্যাভ আ নাইস টাইম উইথ নিরু।

সঙ্গে সঙ্গে দুবাইর এজেন্ট ইউসুফ বিন আহমেদ কানুর অফিসে রেডিওতে জানিয়ে দিয়েছিল।
আমাকে জরুরী ভাবে একজন সেকেন্ড অফিসার দাও, এখানে থাকতেই যেন পাই আর নিশাত জামানের জন্য দুবাই- ঢাকা-লন্ডন একটা টিকেট করে দাও ঢাকা ডিপার্চার হবে এক মাস পর।
ওকে ক্যাপ্টেন।
ঠিক তিন দিন পরের একটা তারিখে নিশাতের ঢাকা যাবার টিকেট পাঠিয়ে দিল তার পর দিন এবং তার পর দিন ইন্ডিয়ান এক সেকেন্ড অফিসার এলো নিশাতের জায়গায়। টিকেট হাতে নিয়ে দেখে পরশু রাতে বিমানের ফ্লাইটে ঢাকা যাবে এবং আগামী জানুয়ারি মাসের ২৬ তারিখে বিমানের ফ্লাইটে আবার দুবাই ট্রানজিট হয়ে গালফ এয়ারে লন্ডন। সময়মত সাইন অফ করে সিডিসিটা নিয়ে সন্ধ্যায় এজেন্টের গাড়িতে দুবাই এয়ারপোর্টে চলে এলো। সারাক্ষণ একটা কথাই মাথায় ঘুরছে, হঠাৎ নিরু এতোটা ব্যস্ত হলো কেন? এমন কি হয়েছে? নিরু ভাল আছেতো? গত দুই বছর ধরেই নিরু বলছে আপনি দুলাভাইকে বলুন। কিন্তু নিশাতই বলতে পারছিল না, ভেবেছিল চিফ অফিসার না হয়ে নিরুকে আনবে না। যতবার ঢাকায় গেছে প্রতিবারেই সিঙ্গাপুর থেকে কেনা ইয়াশিকা ইলেক্ট্রো ৩৫ জিএসএন ক্যামেরা দিয়ে অনেক ছবি তুলেছে এবং তখন দেশে রঙ্গিন ছবি ওয়াস প্রিন্ট হতোনা বলে সিঙ্গাপুর কিংবা মিডল ইস্টের কোথাও থেকে প্রিন্ট করিয়ে নিত। ছবিগুলি নিরুকে দেখাবার পর সব নিশাতের আলমারিতে যত্নে রেখে দিয়েছে। কিছু ছবি নিয়ে যেত সাথে করে। জাহাজে ওর রুম সাজাত নিরুর ছবি দিয়ে। সাত বছরের ছবি গুলো বছর অনুযায়ী ভাগ করে করে সাজাত। বিয়ের পর সবাইকে এই ছবি দেখিয়ে চমকে দিবে বলে দেশে কাউকে এই ছবি দেখাত না।

দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে টেক অফ করার পর রাতের ডিনার সার্ভ করল। তার পরে প্লেনে বসে পাঁচটি ঘণ্টা ধরে এক নিরু ছাড়া আর কোন চিন্তা মাথায় আসেনি। দূর সম্পর্কের চাচার মেয়ে নিরুকে কাছে থেকে দেখার কথা আজও ভুলেনি। নিশাত যখন সবে মাত্র ক্যাডেট হিসেবে জাহাজে জয়েন করতে লন্ডন যাচ্ছে। নিরু তখন কলেজে ভর্তি হবে। দেখা অনেক হয়েছে। একই গ্রামে পাশাপাশি বাড়ি। যদিও নিশাতের বাবা চাকুরী উপলক্ষে করাচী সহ বিভিন্ন শহরে বসবাস করে কিন্তু গ্রামে নিয়মিত যাতায়াত আছে। জমিজমা দেখতে হয়, শীতের খেজুর রস, পিঠা, আম বাগানের আম খেতে হয় তাছাড়া ঈদ পার্বণে গ্রামে আসতেই হয়। তখন অনেক দেখেছে কিন্তু কখনও তেমন করে চোখে পড়েনি।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২৪

ওখান থেকে বের হয়ে সোজা চলে এলো সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে। কিছুক্ষণ হাটা হাটি করে একটা নির্জন বেঞ্চ দেখিয়ে বলল এখানে বসবে?
না বসলে হয় না?
কেন হবে? আজ তোমাকে নিয়ে ঘুরব সারাদিন বেড়াব চাইনিজ খাব তারপরে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরব
বলেই নিরুর হাত ধরে একটা বেঞ্চে বসে পড়ল
আপা দুলাভাই কি ভাববে?
যা ইচ্ছা হয় তাই ভাবুক
পাশে দিয়ে এক বাদাম ওয়ালা যাচ্ছিল তাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল বাদাম খাবে? বলে কোন জবাবের অপেক্ষা ন করে ছেলেটাকে ডেকে কিছু বাদাম কিনল। বাদামের ঠোঙ্গা নিরুর হাতে দিয়ে বলল নাও ছিলে দাও
নিরু ঠোঙ্গা হাতে নিয়ে হতভম্বের মত বসে রইল। বলে কি এই মানুষটা। একটু বসে থেকে আবার কি মনে করে দুই একটা বাদাম ছিলে দিয়ে ঠোঙ্গাটা এগিয়ে দিয়ে বলল
নেন নিজে হাতে বাদাম ছিলে খেতে ভাল লাগবে।
নিশাত একটু অবাক হয়ে বলল
কি হলো, খুব কঠিন নাকি বাদাম ছেলা?
না কঠিন কিছু নয় তবে আমার ভাল লাগছে না
থাক ভাল না লাগল তবুও তুমি ছিলে দাও আমি এই কাজটা মোটেই পারি না বলে আমার বাদাম খাওয়া হয় না
আচ্ছা ঠিক আছে দেন ছিলে দিচ্ছি
ছিলে দিচ্ছি মানে কি! তুমি খাবে না? তুমিও খাও, আমি কি বলেছি শুধু আমাকেই ছিলে দিবে?
আচ্ছা বললামতো দিচ্ছি
হাতের ক্যামেরা দিয়ে নিরুর কয়েকটা ছবি নিয়ে নিল। ছবি তোলা নিয়েও নিরুর আর পশলা বাগরা। কেন ছবি তুলবেন, যদি আপনার কাছে কেউ এই ছবি দেখে ফেলে তাহলে কেমন হবে!
কি বলছ তুমি! আমি কি সবাইকে নিয়ে এই ছবি দেখাব ভেবেছ? এগুলি শুধু আমার কাছেই থাকবে তবে তুমি চাইলে দেখতে পার বা নিতেও পার
না আমার এ ছবি নিতে হবে না
তাহলেতো আর কোন কথাই নেই
বাদাম খেতে খেতে ঘড়ি দেখে বলল একটা বেজে গেছে চল লাঞ্চ করব
না লাঞ্চ করতে হবে না চলেন বাসায় চলেন আপা চিন্তা করবে
কিচ্ছু চিন্তা করবে না, আপা জানে তুমি আমার সাথে রয়েছ এবং এই ঢাকা শহর আমি খুব ভাল করেই চিনি কাজেই তার বোনের হারিয়ে যাবার ভয় নেই, চল ওঠ

নিরু একটু কিন্তু কিন্তু করে শেষ পর্যন্ত নিশাতের পিছে হাটা শুরু করল
সোহরাওয়ার্দি উদ্যান থেকে রমনা পার্কের দিকের গেট দিয়ে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে নিউ মার্কেটের পাশে মিড নাইট সান এ এসে রিকশা থেকে নেমে ভিতরে গিয়ে বসল।
বল কি খাবে
আপনার যা ইচ্ছা
আচ্ছা বলে ওয়েটারকে ডেকে নিশাতই অর্ডার দিয়ে দিল
ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেলে জিজ্ঞেস করল
বল আজকের এই দিনটা তোমার কেমন লাগছে
জানিনা
বলনা কেমন লাগছে
বললামতো জানিনা
আচ্ছা ঠিক আছে আমার কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করবে না?
বলেন
আমার খুব ভাল লাগছে
কেন?
কেন আবার কি এই যে তুমি সাথে আছ তাই।
আমি সাথে থাকলেই কি ভাল লাগবে?
যেদিন নোমান ওই কথা বলেছিল সেদিন থেকে বুঝতে পারছি আমি তোমার সংস্পর্শে এলে ভাল থাকি মানে আমার ভাল লাগে
থাকেনতো বাইরে বাইরে আমার সংস্পর্শ কোথায় পেলেন?
কেন এই যে এখন তুমি আমার পাশে আছ। কত দিন পরে তোমাকে এই প্রথম একা পেয়েছি! ভুল বললাম আমার মনে হচ্ছে জীবনে এই প্রথম তোমাকে একা পেলাম। আমার কি মনে হচ্ছে জান? আমার মনে হচ্ছে আমার আর কিচ্ছু চাই না, শুধু তুমি আমার পাশে থাকলেই হবে।
সেই ছোট বেলা থেকে দেখে আসা সহজ সরল এই মানুষটার এমন আকুতি ভরা কথা শুনে নিরুর মন ভিজে গেল। এখন বুঝি তার এত দিনের অপেক্ষার পালা শেষ হতে চলেছে অনুমান করে চোখ দুটিও কেমন যেন ভিজে এলো এবং একটু পরেই চোখ বেয়ে এক ফোটা জল হাত ধরে রাখা নিশাতের হাতের উপর পরল আর অমনিই নিশাত চমকে উঠে নিরুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল সে কি! তুমি কাঁদছ কেন? কি হলো নিরু! কাঁদছ কেন? রাগ করেছ? বল, নিরু বল কি হয়েছে?
বলেই নিরুর ওড়না দিয়ে চোখ মুছে দিল। আস্তে করে নিরু নিশাতের হাত সরিয়ে বলল
না কিছু হয়নি।
রাগ করেছ?
না
তা হলে!
নিশাতের দিকে তাকিয়ে বলল
আপনার মত মানুষের সাথে কি কেউ রাগ করতে পারে?
তাহলে?
বললামতো কিছু না
বলনা কি হয়েছে
এখন কাঁদছি না, এতদিন কেঁদেছি। জানেন সেই যেদিন আপনাকে প্রথম দেখেছি, সেদিন থেকেই আপনার মুখ থেকে এই কথা শোনার অপেক্ষায় রয়েছি।
তাহলে এতদিন বলনি কেন?
হঠাৎ করেই নিরু মুখ তুলে হেসে দিয়ে বলল সত্যিই আপনি বড়ই সরল মানুষ, কিছুই বোঝেন না। এই কথা কি মেয়েরা বলতে পারে?
মনে মনে বলল আপনি জানেন না আপনার এই সরলতার জন্যই আপনাকে আমার এত ভাল লাগে সারাক্ষণ আপনার জন্য মন এত উতলা থাকে, এতদিন আপনার পথে চেয়ে অপেক্ষায় ছিলাম।
১৫।
এর পরে নিশাত যতদিন দেশে ছিল প্রায় প্রতিদিন নিরুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস কবে শুরু হবে সেই রুটিন জানার জন্য বা ভিন্ন কোন অজুহাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে দুই জনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে একসময় নিশাতের যাবার দিন ঠিক হয়ে গেল। কোথা দিয়ে যে দিনগুলি চলে গেল বোঝা গেল না। মনে হলো যেন ঝরের গতিতেই দিন চলে গেল। এত দিনের সঞ্চিত যত কথা সব যেন পাখির মত মুখোমুখি বসে এক এক করে কত কি বলতে চেয়েও সব বলা হলো না কত বাকি রয়ে গেল। একদিন আরিচা ঘাটের কাছে পদ্মা নদীর পাড়ে বসে ঢলে পড়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে নিশাত বলছিল নিরু একটা গান গাও
জানেন না আমি গান জানি না
কেন ওই যে সেদিন তোমাদের বাড়িতে কুয়োর পাড়ে বাসন মাজার সময় গাইছিলে
কবে?
সে অবশ্য অনেকদিন আগের কথা, তুমি তখন স্কুলে পড়
কি জানি আমার মনে নেই, আচ্ছা কোন গান?
নিঝুম সন্ধ্যায় শ্রান্ত পাখিরা……
হ্যাঁ ওটা আমার প্রিয় গান তবে এখন মনে নেই আর তাছাড়া সেই কবে কি গুনগুন করেছিলাম এখনও কি তাই মনে থাকে?
দেখনা চেষ্টা করে, সেদিন কিন্তু আমি তোমার পিছনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে গানটা শুনেছিলাম, কি যে ভাল লাগছিল, আমি আজও ভুলিনি। এখনো আমার কানে সেই সুর লেগে আছে।
কি জানি আমার কিন্তু কিছুই মনে পড়ছে না।
আচ্ছা থাক, অনেকদিন আগের কথা মনে না থাকলে নেই। তুমি গান শিখ নিরু আমি ওস্তাদের ব্যবস্থা করে দিব।
গান আপনার এত ভাল লাগে?
হ্যাঁ নিরু, সুর আমাকে পাগল করে দেয়
আমার চেয়েও গান প্রিয়?
নিশাত স্তব্ধ হয়ে নিরুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল
কি হলো এমন করে কি দেখছেন?
তোমাকে দেখছি! কি বললে তুমি?
আমার চেয়েও গান প্রিয়?
শোন, গানের জায়গায় গান আর তোমার জায়গায় তুমি। তোমার সাথে এই পৃথিবীর আর কোন কিছুর সাথে তুলনা করবে না কখনও
আচ্ছা ঠিক আছে আমি নিজেই গান শিখব, সেদিন আপাও বলছিল গান শিখব কিনা তাহলে ছায়া নটে ভর্তি হতে বলেছিল। ছায়া নটের টিচার আফরিন মজুমদার আপার প্রতিবেশি
তাহলে তুমি ছায়ানটে ভর্তি হও, তোমার এত সুন্দর কণ্ঠ তুমি খুব ভাল গান করবে, ছোট বেলায় বেশ গুনগুন করতে।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২৩

কথার সাথে সাথে শিহাবের নাশতা শেষ হলো, নিরু চা নিয়ে এলো। চা খেতে খেতে বলল এই চলনা আমি হাবিবদের বাড়ি যাব তুইও চল
আমাদের হাবিব?
হ্যাঁ, দুইজনে একসাথে গেলাম অথচ আমি চলে আসলাম ও কিন্তু এখনও আসতে পারেনি তাই চাচা চাচীদের সাথে একটু দেখা করে আসি আর ওর খবরটা জানিয়ে আসি আর তুই যখন এসেই পরেছিস তাহলে হাসির সাথে একটি দৃষ্টি বিনিময় করে যাবিনা?
কি যে বলিস, সে দিন কি আর আছে?
কেন নেই কি হয়েছে?
কি আর হবে, কতদিন হয়ে গেল সব ভুলে গেছি
আরে যাহ! এই কি কেউ ভুলে না ভুলতে পারে? লুকাচ্ছিস কেন, চল দেখা করে আসবি, বেচারি হয়ত তোর পথ চেয়ে আছে
না রে আমার অনেক কাজ আছে সবাইকে দাওয়াত দিতে হবে কিছু কেনাকাটা করতে হবে
আরে চল পরে আমিও তোর সাথে থাকব, যে কয়দিন ঢাকায় থাকবি আমি তোর সাথে থাকব
তাহলে তুই যখন বলছিস চল ঘুরেই আসি, তুই আর হাবিব কি এক সাথেই ছিলি?
না রে, আমি ছিলাম ইউরোপে আর ও ছিল এশিয়ান লাইনে তবে আমরা যখন মিডল ইস্টে আসতাম লোড নেয়ার জন্য তখন মাঝে মাঝে কথা হত। আমি দেশে আসছি জেনে বলে দিয়েছে ওদের বাড়ি যেতে।
চল

শিহাব যতদিন ঢাকায় ছিল নিশাত শিহাবের সাথেই ছিল। এই যাত্রায় সবার সাথে দেখা হলো আর সেই সাথে নানা সময়ে নিরুর সাথেও দেখা হলো।
পরেরদিন আপা জানাল তোর দুলাভাই বিয়ের দিন যাবে আমরা হলুদের দিনেই সকালে চলে যাব তুই কিন্তু এসে পরবি
আচ্ছা আপা, আমি সময়মত চলে আসব
তিনদিন পরে শিহাব আর নিরু চলে গেল।
পরের বুধ বারে সকালে উঠেই নাশতা খাবার সময় মাকে বলল
আমি বাড়ি যাচ্ছি যূঁইয়ের বিয়েতে। আজ হলুদ, বীণা আপা যাচ্ছে তার সাথে যাব আপনারা কি শুক্রবারেই আসবেন নাকি আগে আসবেন?
আগে কেমনে আসব, তোর বাবার অফিস আছে না!
আচ্ছা, তাহলে আপনারা আসেন আমি আজই চললাম।
বিয়ে বাড়িতে নিরুর সাথে সময়ে অসময়ে দেখা, চোখে চোখ আর সবার সাথে হৈ চৈ আমোদ প্রমোদে চলে গেল। নিরুর সাথে দুই একটা সাধারণ কথা ছাড়া একান্তে তেমন আলাপের সময় বা সুযোগ হয়ে উঠেনি। শনি বারে বাবা মা সহ বীণা আপা, দুলাভাই নিরুর সাথে এক সাথে ঢাকায় চলে এল।
১৪।
এবারে মাত্র দেড় মাস ছিল দেশে। এর মধ্যে এমনি করে আসা আর যাওয়ার মধ্যে দুইজনে কিছু টুকি টাকি কথাবার্তা একটু হাতে হাত এভাবেই চলে গেল। এখন নিরু আগের মত হাত ধরলে ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত হয় না। নিশাত ভাই বলে ডাকে না। এইযে, শুনছেন এমনি করে নিশাতকে ডাকে কিন্তু আপনি ছেড়ে তুমি করে বলতে পারে না। নিশাত কত অনুরোধ করেছে কিন্তু কোন পরিবর্তন হয়নি। নিশাত ভেবেই পায়না নিরু কবে তুমি বলা শিখবে। একদিন নিশাতের যাবার সময় এসে হাজির। আগের মতই নিরু আর বীণা আপার কাছে বিদায় নিয়ে নিশাত চলে গেল।
এই যাত্রায় আবার ফিরে আসতে নিশাতের অনেক সময় লেগে গেল। নিয়ম অনুযায়ী নয় মাস পরে দেশে আসতে পারেনি। বেশ অনেকদিন পরে এসে যখন বীণা আপার বাড়ি গেল তখন শুনল নিরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার অপেক্ষায় রয়েছে। দুলাভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিল। দুলাভাই বেশ আমুদে মানুষ এটা সেটা নানা কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনল। মাঝে আবার ইয়ার্কিও করল
কোন বিদেশিনী বা মেমসাহেবের দেখা পাওনি এখনও?
কি যে বলেন দুলাভাই! আমি মনে প্রাণে বাঙালি কাজেই আমার পাশে দেখলে বঙ্গ ললনাই দেখবেন। পাশে বীণা আপা এবং নিরু দুইজনেই ছিল। নিরু লজ্জা পেয়ে চা আনার ছল করে উঠে চলে গেল। দুলাভাই জানাল আগামী কাল নিরুর ভর্তি হবার তারিখ কিন্তু আমাকে যশোর যেতে হবে তোমার আপাকেও ওদের নিয়ে স্কুলে যেতে হবে। এর আগে দেখেছে শুধু অয়ন স্কুলে যেত কিন্তু এখন অয়ন রায়ান দুইজনেই যায় এবং রায়ানটা হয়েছে ভীষণ দুষ্ট। কে যাবে নিরুর সাথে তাই নিয়ে একটু চিন্তিত। নিশাত বলল
তাহলে নিরুর সাথে যাবার জন্য আমি আসলে হবে?
বীণা আপা বলল তুই আসবি? তাহলে আয়, সকাল নয়টার মধ্যে চলে আসবি
বলেই আপা নিরুকে বলল
শোন কাল আমি স্কুলে যাবার পর ও আসবে ওর সাথে যেয়ে ভর্তি হয়ে আসবি
আচ্ছা
নিশাত তুই কাল সময়মত চলে আসবি
ঠিক আছে, তাহলে আমি এখন উঠি
আচ্ছা।
নিশাত নিরুর দিকে ঘুরে বলল তুমি কিন্তু এর মধ্যে রেডি হয়ে থেকো।
নিরু মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল সে বুঝতে পেরেছে কি করতে হবে।

পরদিন সকালে যথারীতি নিশাত এসে দেখে নিরু রেডি হয়ে ওর অপেক্ষা করছে। ঘরে ঢোকার পর নিরু জিজ্ঞেস করল একটু চা খেয়ে বের হবেন?
তুমি বানাবে নাকি নার্গিস বানাবে?
নার্গিস বাসায় নেই আমিই বানাব
তাহলে দাও
চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল ছবি কাগজপত্র সব নিয়েছ?
নিয়েছি
কোন সাবজেক্টে ভর্তি হবে?
জিওগ্রাফি
এত সাবজেক্ট থাকতে জিওগ্রাফি কেন? তুমিও কি জাহাজে চাকরী করবে নাকি?
এই সাবজেক্ট আমি এখন ভাল বুঝি তাই
তাই নাকি? তুমিতো একসময় বলতে এটা খুব কঠিন
কেন, সেই যে আপনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তারপর থেকেই আমার কাছে এটা ভাল লাগতে শুরু করেছিল এখন এটাই আমার প্রিয় বিষয়।
কিন্তু সেতো মাত্র কয়েকদিন দেখিয়ে দিয়েছিলাম
হ্যাঁ তারপরে যুঁই আপাকে বলেছিলেন আমাকে পড়াবার জন্য, আপনার মনে নেই
হ্যাঁ মনে আছে কিন্তু যুঁই কি তোমাকে পড়াত?
হ্যাঁ
বেশ ভাল কথা, জেনে খুব ভাল লাগল কিন্তু তুমিতো এতদিন আমাকে কিছু বলনি!
আপনি কি ও কথা বলার কোন সুযোগ দিয়েছেন? নাকি কোনদিন জানতে চেয়েছেন?
হ্যা নিরু সত্যিই ভুল হয়ে গেছে, কথা দিচ্ছি আর এমন হবে না, আচ্ছা আজ চল
চলেন

বাইরে এসে একটা রিকশা ডেকে দুইজনে উঠে চলল বিশ্ববিদ্যালয়ের এডিমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিঙের দিকে। এরপর আর কোন কথা নেই, অনেকক্ষণ চুপচাপ। একটা বছরেরও বেশি সময়ের আগে এমনি এক দিনের কথা উভয়ের মনে পরল কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। মনে হচ্ছিল এই পথ যেন শেষ না হয়। যেন অনন্ত কাল ধরেই চলতে থাকে। কিন্তু এক সময় নিউমার্কেটের সামনে এসে পিছনের আর এক রিকশার ধাক্কায় উভয়েই সম্বিত ফিরে পেল।
শুনছ?
বলেন
আজ কিন্তু আমরা এক সাথে সারাদিন ঘুরব!
তাই কি হয়?
কেন হবে না? তুমি কেমন, কিছুই কি বুঝবে না?
নিরু কোন কথা বলল না।
এইমাত্র না বললে আমি কোনদিন সুযোগ দেইনি তাহলে এখন এমন কথা বলছ কেন?
নিরু চুপচাপ
কি হলো কিছু বলছ না!
কি বলব? আপনার ছেলে মানুষীর কথা ভাবছি, আপনি এখনও সেই অতটুকই রয়ে গেলেন। এত দেশ বিদেশ ঘুরে এলেন তবুও বড় হলেন না!
ঠিকই বলেছ সত্যিই আমি তোমার কাছে এলেই যেন কেমন হয়ে যাই, সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায় গুছিয়ে কিছু বলতেও পারি না কিছু ভাবতেও পারি না। মনে হয়…
কি মনে হয়? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক?
মনে হয়………………………
কয়েকবার শুধু মনে হয়, মনে হয় বলল কিন্তু তারপরে কথা থেমে যাচ্ছে, কিছু বলতে পারছে না। তাই শুনে নিরু বলল
কি মনে হয় বলেন, শুধু মনে হয় মনে হয় করছেন কেন?
লজ্জা লাগছে
তাহলে থাক বলার দরকার নেই
কিন্তু তোমাকে যে এ কথা শুনতেই হবে!
তাহলে বলেন!
এবার সাহস করে নিশাত নিরুকে বলল আমার চোখের দিকে তাকাও
নিরু তাকাল আর অমনি নিশাত ওর চোখে চোখ রেখে একটু কাছে এগিয়ে হাত ধরে বলল
মনে হয় আমি তোমার প্রেমে পড়েছি
আস্তে করে একটু ধাক্কা দিয়ে নিরু বলল যাহ! আপনি আগে এত অসভ্য ছিলেন না বিদেশে গিয়ে বুঝি এই হয়েছে? আর এই জন্যেই বুঝি আজ আমার সাথে আসা?
কি বল তুমি, অসভ্যের কি হলো যেটা সত্যি আমি তাই বলেছি। না, নিরু তুমি বুঝতে পারছ না, সেই ছোট বেলা থেকেই আমি লক্ষ করেছি তুমি কাছে এলেই যেন আমি কেমন হয়ে যাই। আমি অনেক ভেবে দেখেছি। সত্যি করেই আমি তোমার প্রেমে পড়েছি বিশেষ করে সেদিন নোমানের ওই কথা শুনে আমি ভাল করেই বুঝতে পারলাম এত দিন কেন এমন হয়েছে। তার পর থেকেই তোমাকে এই কথাটা বলার সুযোগ খুঁজেছি কিন্তু পাইনি আজ তাই প্রথম সুযগেই বলে ফেললাম।
নিরু নিজের মনে ভাবল এ কথাতো আমারও। আমিও কেমন যেন হয়ে যাই, সব ভুলে যাই। যুঁই আপা যখন আপনাকে বলত তোর বৌ এসেছে তখন মনে হত যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে, ভীষণ খারাপ লাগত কিন্তু আপাকে কিছু বলতে পারতাম না তাই নীরবে শুধু কেঁদেছি সে কি আপনি কিছু বুঝতে চেষ্টা করেছেন কখনও? মুখে বলল
আচ্ছা সে দেখা যাবে এখন রিকশা থেকে নামুন চলুন দেখি আগে ভর্তি হয়ে নিই। পরে বিচার করব সত্যি বলছেন নাকি বানিয়ে বলছেন!
নিশাত সামনে চেয়ে দেখে ওদের গন্তব্যে চলে এসেছে। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে নিরুর পিছে পিছে এসে যেখানে টাকা পয়সা দিতে হবে সে সব কাজ সারতে প্রায় ঘণ্টা খানিক লেগে গেল। ভর্তির কাজ সেরে ওই অফিসেই একজনের টেলিফোন থেকে বীণা আপার বাসায় ফোন করে বলল
আপা নিরুর ভর্তি হয়ে গেছে আমরা একটু পরে আসছি
কোথায় যাবি?
না তেমন কোথাও না এখানেই এলাকাটা ওকে চিনিয়ে দেই পরে যাতে কোন অসুবিধা না হয়
আচ্ছা ঠিক আছে বেশি দেরি করবি না তাড়াতাড়ি আসবি।
আচ্ছা আপা তাড়াতাড়িই আসব।
নিরুকে সাথে নিয়ে বাইরে চলে এলো। মেইন রোড।
শুনেছ তোমার আপার কাছে অনুমতি নিয়ে নিয়েছি এবার চল আমরা আজ বেড়াব এবং দুপুরে চাইনিজ খাব।
আমার কিন্তু ভীষণ ভয় করছে
তোমার ওই এক কথা, ভয় আর লজ্জা, আপার কাছে অনুমতি নিয়েছি না! তবে আবার কিসের ভয়? ভয়ের কি আছে এটা কি তোমাদের গ্রাম? এটা রীতিমত ঢাকা শহর এখানে কে কার খবর রাখে? তুমি এখন বড় হয়েছ, আজ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছ তোমার এত ভয় পেলে চলবে? এখানে লজ্জারই বা কি আছে? তোমার এখন নিজস্ব মতামত দেয়ার সময় হয়েছে
নিরু আমতা আমতা করে বলল চলেন কোথায় যাবেন।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২২

মনে মনে নিশাতের যাবার তারিখ হিসেব করে নিরু দিন গুনছে ও কবে আসবে! কি যেন বলেছিল সেদিন? নয় মাস পরে আসবে! হে খোদা, মাত্র গেল সাত মাস! আর কত? এমনিতেই কতদিন পরে পরে দেখা হয় তার কাছে এই নয় মাস এমন কিছু না কিন্তু কেন যেন মনে হয় এই দুই মাস অনেক মাস। এর আগে কখনও এমন লাগেনি। শুধু ভাবনা আর জল্পনা কল্পনার মধ্যেই সীমিত ছিল কিন্তু এবার যেন একটু অন্যরকম। কেমন যেন বোঝান যায় না বলা যায়না। আর বলবেই বা কাকে! যেখানে হাতে ধরেছিল বারবার সেখানে তাকায়, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিজে একটু আলতো করে ছুঁয়ে দেখে নিশাতের স্পর্শ লেগে আছে কিনা! এই একটু খানি স্পর্শের জন্য আজ কতদিন ধরে অপেক্ষায় আছে সে কথা কি আর কাউকে বলা যায়? না, এ যে একান্তই তার নিজের অনুভব। কাউকেই এ কথা বলা যায় না। মানিকগঞ্জে নোমান ভাইয়ের কথাটা শুনে খুবই মিষ্টি লেগেছিল, মনে হলো তাই যেন হয় নোমান ভাই। মানুষটা এমন বোকা যে নিজে যেন কিছুই বলতে পারে না। কোন আভাস ইঙ্গিতও কি কিছু বুঝতে নেই! আর সেদিন কেমন হঠাৎ করেই হাত টেনে ধরল! অবাক কাণ্ড, ভাবাই যায় না এই মানুষ এমন করে বসবে। তাড়াতাড়ি হাত ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য মুখে যা আসে তাই বলে দিয়েছে। আসলে এইতো তার মনের কথা। সারা জীবন কেন অনন্তকাল ধরে ওর অপেক্ষায় থাকতে পারি। তখন ভয়েই আর কিছু বলা হয়নি। কত কথা জমে রয়েছে কত কি বলার আছে, কবে সময় হবে? ও কি আর একটু এগিয়ে আসতে পারে না?। তখন মনে ভয় ছিল যদি হঠাৎ করে আপা এসে পরে তাহলে? যখন হাত টেনে ধরেছিল তখন কেমন যেন এক অনুভূতি আবার ওদিকে আপা চলে আসে কিনা সেই ভয়! ভয় আর অজানা এক শিহরণ মিলে কেমন যেন বলতে না পারা একটা ভিন্ন অনুভব। যা শুধু অনুভবেই অনুমান করা যায় কাউকে বলা যায় না। আপা কি কিছু বুঝে ফেলেছে? না! তা কি করে হয়! একটা চিঠিও তো দিতে পারে মানুষটা! কেমন? যুঁই আপার কাছে দিলে কি হয়? না থাক তাহলে জানাজানি হয়ে যাবে। শুধু আমার বুকের মাঝে রয়েছে তাই থাক আর কারো জানার দরকার কি? কিসে থেকে কি হয়ে যাবে সারা জীবনের জন্য সব কিছু ওলট পালট হয়ে যেতে পারে। থাক যেমন আছে তাই থাক। এই আমার ভালো। ওর মনের কথা জানতে পেরেছি তাই বুকে করেই কাটাতে পারব।

নিশাত যাবার পর নিশাতের বাবা অফিস থেকে মতিঝিল কলোনিতে বাসা পেল। নিশাতকে জানিয়েছিল যাবে কিনা। ঢাকা শহরের মুল কেন্দ্রে বলে আশেপাশে অনেক ভাল স্কুল কলেজ আছে তাই নিশাত ছোট ভাই বোনদের ভাল লেখাপড়া হবে বলে বলেছিল এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন না যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় উঠে পরুন।

দেখতে দেখতে একদিন নিশাত তার প্রথম সমুদ্রযাত্রা শেষ করে নয় মাস পরে কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে একটা অটোরিকশা নিয়ে মতিঝিলের বাসায় এসে হাজির। বাসায় মা একা ছিল সে দরজায় চেনা নক শুনে একটু অবাক হয়ে ভাবছিল কে এলো এই সময় একেবারে নিশাতের মত নক। দরজা খুলেই মা নিশাতকে দেখে অবাক স্তব্ধ হয়ে তুই! বলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। একটু পরেই সম্বিত ফিরে পেয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল বুকে। বাবা তুই এসেছিস! কোন খবর দিতে পারলি না?
না আম্মা সবাইকে চমকে দিব বলে ইচ্ছে করেই কাউকে খবর দেয়ার চেষ্টা করিনি। প্রথম বলে বিদেশ থেকে যা পেরেছে ছোট ভাই বোন এবং নিরুর জন্য কিছু কেনা কাটা করেছে। খাবার পর বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যার পর সবাই যখন একত্রে হলো বাবা মা ভাই বোন সবাই তখন যার জন্য যা এনেছিল সেগুলি একটা একটা করে দিয়ে দিল কিন্তু নিরুর জন্য যা এনেছিল সেগুলি আর বের করা হলো না। সুটকেসের ভিতরেই রয়ে গেল। পরদিন সকালে ফকিরাপুল গিয়ে একটা স্টিলের আলমারির অর্ডার দিয়ে এলো। কয়েকদিন পরে আলমারিটা এনে সুটকেস থেকে বের করে আলমারিতে সাজিয়ে রাখল। নিরু যখন আমার হবে, নিরু যখন এই বাড়িতে আসবে তখন আলমারির চাবিটা নিরুর হাতে দিয়ে বলবে আলমারিটা খুলে দেখ ওখানে যা যা আছে সব তোমার।

পরদিন বীণা আপার বাড়িতে এসে হাজির। দুলাভাই থাকলে বেশিক্ষণ থাকা যাবে মনে করে বিকেলের দিকেই এসেছিল। বাড়ির কাজের মেয়ে নার্গিস দরজা খুলে অচেনা মানুষ দেখে জিজ্ঞেস করল কাকে চান?
সর দেখি ভিতরে যেতে দাও।
একরকম ওকে ঠেলে ভিতরে এসেই দেখে বারান্দা দিয়ে নিরু এগিয়ে আসছে। ওকে দেখে নিরুর চলা থেমে গেল। কিছুটা হতভম্ব হয়ে দাড়িয়েই জিজ্ঞেস করল আপনি! এতো দিন নিশাত ভাই বলে ডাকত কিন্তু আজ কেন যেন আর সেই আগের ডাক ডাকতে পারল না। আপনি! এটুক বলেই থেমে গেল। কোথা থেকে যেন এক রাশ লজ্জা আর সংকোচ এসে পা জড়িয়ে ধরেছিল। নিশাত এগিয়ে এসে পিছনে কাজের মেয়েটার কথা ভুলে গিয়ে নিরুর কাঁধে হাত দেয়ার জন্য হাত তুলতে আসছে বুঝতে পেরে এক পা পিছিয়ে জিজ্ঞেস করল কবে এসেছেন? নিশাত একটু অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল যেদিনই এসে থাকি তাতে তোমার কি? আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু পিছনের পর্দা সরিয়ে বীণা আপাকে আসতে দেখে থেমে গেল। বীণা আপাকে দেখেই এগিয়ে এসে নিচু হয়ে বীণা আপার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলল আপা আপনারা ভাল আছেন সবাই?
হ্যাঁ কিন্তু তুই কবে এসেছিস?
গতকাল এসেছি আপা! ছেলেরা কোথায় বলে একটা চকলেটের প্যাকেট নিরুর হাতে এগিয়ে দিয়ে বলল ওদের দিও।
ওরা বাইরে খেলতে গেছে একটু পরেই আসবে যা ও ঘরে বস গিয়ে আমি আসছি।
নিরু এসে লাইট জ্বেলে দিয়ে চলে যাচ্ছিল কিন্তু সেদিনের মত আবার নিরুর হাত টেনে ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল তুমি আর কিছু জিজ্ঞেস করবে না? নিরু আজ হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল না। শুধু বলল কি জিজ্ঞেস করব? মনে মনে বলল আপনি কিছু জিজ্ঞেস করলেই পারেন। হঠাৎ বারান্দায় পায়ের শব্দ পেয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল আপা আসছে আমি যাই! একটু পরেই দুলাভাই এলো। অনেক রাত পর্যন্ত নিশাতের সমুদ্র যাত্রা ও লন্ডন ভ্রমণ নিয়ে গল্প সল্প হলো কিন্তু এর মধ্যে নিরু একবারও এ ঘরে এলো না। আপা দুলাভাই রাতে খাবার জন্য পিড়াপিড়ি করল কিন্তু কিসের এক অব্যক্ত অভিমানে নিশাত সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে চলে এলো।

প্রেম মানুষকে উদাস করে দেয়, উদার হতে শেখায়, ভালবাসতে শেখায় সেই সাথে নিষ্পাপ প্রেম মানুষকে বড়ই অভিমানী করে তোলে। সেই অভিমানের জের ধরে দুলাভাইর সাথে রাতের খাবার খেতে অসম্মতি। নিরু যদি একবারও অন্তত চায়ের ট্রে নিয়েও এ ঘরে আসত তাহলে এমন হতো না। সে রাতে দুলাভাইর কথায় বুঝতে পেরেছিল নিরুর কলেজ বন্ধ। পরদিন সকালে হিসাব করে আপার ছেলেদের স্কুলে চলে এলো। জানে আজ নিরু বাসায় আছে কাজেই আপা তার ছেলেকে নিয়ে স্কুলে আসবে না নিরুই আসবে। সত্যি সত্যি একটু পরেই দেখল একটা রিকশা আসছে তাতে নিরুর সাথে আপার বড় ছেলে অয়ন। রিকসা থামলে ভাড়া দেয়ার জন্য নিরু হাতের ব্যগটা খুলছে এমনি সময় নিশাত সামনে এসে অয়নকে বলল
মামা কাল চকলেট খেয়েছ?
হ্যাঁ মামা খুব মজা
আচ্ছা যাও স্কুলে যাও। নিরুর দিকে তাকিয়ে বলল যাও ওকে ক্লাসে দিয়ে এখানেই আসবে আমি দাঁড়ালাম।

যেন নিরুর উপরে তার কত দাবি। নিরু কেন এখানে আসবে? সে নিরুর কে? নিরু কেন তার কথামত চলবে? তাইতো! নিরু এখানে না এলে কি করব? সাত পাঁচ অনেক ভাবনা আসছে যাচ্ছে। ভাবতে ভাবতেই দেখল স্কুলের গেটের ভিতরের রাস্তা দিয়ে নিরু বের হয়ে আসছে। মাথায় ওড়না জড়ান হাতে সেই ব্যাগটা। মাথা নিচু করে নিরুর স্বভাব মত আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। নিরু আগের মত চঞ্চল ছটফটে নেই এখন অনেক বদলে গেছে। যে নিরু না হেটে দৌড়াত সেই নিরু এখন ধীর পায়ে হাটে। হতে পারে বয়সের সাথে বদলে গেছে কিংবা মনে কোন পরিবর্তন এসেছ। কি সে পরিবর্তনের কারণ? গেটের বাইরে পা রাখার সাথে সাথেই নিশাত পাশে গিয়ে বলল আজ তোমাকে নিয়ে ঘুরব চল রিকশায় ওঠ।
তোমাকে নিয়ে ঘুরব! বললেই হলো!
কেন?
সহজ সরল এই মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে নিরু কি বলবে একটু ভাবল।
কেন আবার কি, আপনি কি কোনদিনই কিছু বুঝবেন না?
এখানে বোঝার কি আছে?
আমি এসেছি অয়নকে স্কুলে দিতে, আর স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে কতক্ষণ লাগে তা আপা জানে না? সে সময় পেরিয়ে গেলে আপা কি করবে? কি বলব আপাকে? বলব তোমার প্রিয় ভাই নিশাতের সাথে বেড়াতে গিয়েছিলাম? বলব এ কথা?
ও, এই কথা! তাহলে বল তোমাকে আমি একা কোথায় কখন পাব?
এত অস্থির হবার কি হলো? একা পাবার এমন কি প্রয়োজন?
অস্থির মানে কি বলছ তুমি! জান আমার এই নয়টা মাস কি করে কেটেছে?
কি করে কেটেছে?
শুধু নিরু আর নিরু, তুমি আর তুমি
কেন আপনার কাজকর্ম কিছু ছিল না?
শোন এত কৈফিয়ত আমি দিতে পারব না
তাহলে কি করবেন? বাসায় যাবেন?
চল বাসায় যাই
তাই চলেন কাল আপনি চলে আসার পরে মেঝ ভাই এসেছে
তাই নাকি?
হ্যাঁ যূঁই আপার বিয়ে ঠিক হয়েছে
কবে বিয়ে?
এই শুক্রবারের পরের শুক্রবারে
বাহ! আমি ভাবতেই পারছি না যূঁইর বিয়েতে আমি থাকতে পারব, শিহাব বাসায় আছে?
আমিতো ঘুমে দেখে এসেছি
একটা রিকশায় উঠে বসল। এই প্রথম নিরু আর নিশাত এক রিকসায় এত কাছা কাছি বসেছে। দুইজনের মনেই এক অপার্থিব সুখস্রোত বয়ে যাচ্ছে। স্বর্গিয় অনুভুতি, অনেকক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই শুধু একজন আর একজনের স্পর্শ অনুভব করছে। হঠাৎ করেই নিশাত এই নীরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করল
আমার কথা তোমার মনে পড়েনি?
পড়েছিল
সবসময়?
সবসময় কেন হবে? মাঝে মাঝে একটু একটু
তাহলে তুমি কাল রাতে একবারও ও ঘরে এলে না কেন?
আবার বোকার মত কথা বলছেন
কেন বোকার মত কেন হবে?
দুলাভাই কি ভাবত? আপা কি ভাবত?
ও আচ্ছা! কিন্তু যেদিন আকাশে সূর্যের উদয় হবে সেদিন কি ভাববে?
আগে উদয়তো হোক, তখন দেখব কে কি ভাবে!
চলনা আজ কোথাও একটু যাই
আমি আপাকে কিছু বলতে পারব না
আচ্ছা ঠিক আছে না বললে
আরও কিছু কথা হলো
বাসায় এলে বীণা আপা দরজা খুলে ওদের দুইজনকে এক সাথে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কিরে তোরা এক সাথে হলি কি করে?
আমি বাসে কল্যাণপুর যাচ্ছিলাম ওকে দেখলাম রিকশায় করে আসছে তাই নেমে ওর সাথে চলে এলাম।
এসে ভাল করেছিস আয় ভিতরে আয়। কাল শিহাব এসেছে যূঁইর বিয়ে ঠিক হয়েছে আগামি সপ্তাহে
হ্যাঁ ওর কাছে তাই শুনলাম, শিহাব কোথায়?
কথা বলতে বলতে ভিতরে এসে দেখে শিহাব নাশতা খাচ্ছে। নিশাতকে দেখে এক লাফ দিয়ে উঠল
কিরে তুই কবে এসেছিস? তুইতো অনেক হ্যান্ডসাম হয়েছিস!
তুইওতো বেশ নাদুশ নুদুস হয়েছিস, এই যূঁইয়ের বিয়ে কবে রে?
এইতো সামনের শুক্রবেরের পরের শুক্রবারে
বাহ! কি আনন্দ! তুই বাড়ি যাবি কবে?
দুই তিন দিন পরে যাব, যাবি আমার সাথে?
একটু ভেবে বলল
তোর সাথে যেতে পারব না তবে আমি হলুদের দিন চলে আসব
বীণা আপার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল আপা আপনারা কবে যাবেন?
দেখি তোর দুলাভাইর সাথে আলাপ করিনি এখনও তবে মনে হয় আমিও হলুদের দিন যাব নিরু শিহাবের সাথে চলে যাবে। তুই তাহলে আমাদের সাথেই যাবি, পারবি? শিহাব আজ তোদের বাসায় যাবে চাচা চাচীদের দাওয়াত দিতে।
তাহলে ভালই হবে। ঠিক আছে আপা আমি আপনাদের সাথেই যাব।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২১

১২।
পর দিন সকালে ডিউটিতে যেয়ে দেখে জাহাজ প্রায় অর্ধেকের বেশি লোড হয়ে গেছে। নিশাত সব গুলি ট্যাঙ্ক একে একে ঘুরে ঘুরে দেখে এসেছে। পাম্প ম্যানের সাথে ঘুরছে। সে কোন ভাল্ব কি ভাবে কোন দিকে ঘুড়িয়ে খুলছে বন্ধ
করছে, গেট ভাল্বের পাশে পাইপ লাইনের সাথে স্পিড মিটারে দেখল ঘণ্টায় ২৪০ টন বেগে তেল আসছে। সব কিছু কৌতূহল নিয়ে দেখছে। অরুণ অফিস রুমে। এর আগে ডিজেল দেখেছে সাধারণ বোতলে ভরা কিন্তু এমন বিশাল ট্যাঙ্কে এত ডিজেল দেখে নিশাত অবাক হচ্ছে। ডিজেলের গন্ধে কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠল বমি বমি ভাব লাগল। এই তেলের এমন গন্ধ! এর আগে তো কখন এমন মনে হয়নি। একটু পরে অরুণ’দা এলে জিজ্ঞেস করল

দাদা, আমাদের দেশে যে ডিজেল দেখেছি সে গন্ধ আর এই গন্ধের মধ্যে এমন তফাত কেন?
গন্ধ একই, পার্থক্য হলো তুমি এই এত বিশাল পরিমাণ তেল কখন এক সাথে দেখনি তাই এমন লাগছে,
আমার কিন্তু বমি এসে গিয়েছিল
তাই না কি?
তা হলে তো সমস্যা। ট্যাংকারে কাজ করলে কত গ্রেডের তেল নিতে হবে, একেক তেলের একেক রকম গন্ধ তোমাকে সহ্য করতে হবে। আচ্ছা শোন তুমি বেশী করে লেবু খাবে, বুঝেছ?
কেন, লেবু খেলে কি হবে?
তেলের যে গ্যাস শ্বাসের সাথে যায় তা কিছুটা ক্ষতি করে। লেবু ওটা একটু কমাতে সাহায্য করে।
ও, আচ্ছা ঠিক আছে খাব।
ওদের ডিউটির মধ্যেও জাহাজের লোড শেষ হয়নি। ওরা চলে গেল আবার মুকিত ভাই তার সঙ্গী সাথী সহ এসে অরুণকে জিজ্ঞেস করল
আর কতক্ষণ লাগবে?
দেরী আছে তোমরা শেষ করতে পারবে মনে হচ্ছে।
বেশ ভালো, তা হলে এই সময়েই শেষ হোক আমি তাই চাইছিলাম।
আচ্ছা ঠিক আছে নাও তুমি যতটা পার কর তার পরে আমরা এসে শেষ করে সেইল করবো, তা হলে থাক আমরা চললাম।

নিশাত এসে গোসল সেরে খেয়েই শুয়ে পরল। ঠিক ৬টায় ডিউটিতে গেল। যেয়ে দেখে এখনো অরুণ বা তার সাথের আর কেউ আসেনি। এখনও শেষ হয়নি?
এইতো কাছা কাছি এসেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ে যাবে!
মুকিত ভাই জিজ্ঞেস করল
কি নিশাত ঘুম হলো?
হ্যাঁ এই একটু, সময়ের সব কিছু ওলট পালট হয়ে গেছে তো মানিয়ে নিতে একটু সময় নিবে।
কেমন লাগছে এখানে?
খুব ভালো, তবে মা বাবাকে ছাড়া কখন কোথাও এত লম্বা সময়ের জন্য থাকিনি তাই একটু খারাপ লাগে মাঝে মাঝে।
ও কিছু না, দেখবে এক সময় সব অভ্যাস হয়ে যাবে। আমরাও কি থেকেছি, কিন্তু দেখ এখন অভ্যাস হয়ে গেছে, মানুষের জীবনটাই এরকম।
হ্যাঁ মুকিত ভাই তবুও আমার ভাগ্য ভালো যে আপনাকে পেয়েছি আর অরুণ’দাও বেশ ভালো মানুষ। সবাই ভালো। আমি চিন্তা করছি আমার বন্ধু হাবিবের কি অবস্থা
হাবিব কে?
আমার বন্ধু, আমরা এক কলেজে পড়তাম, আমাদের বাড়িও এক জায়গায়, আবার এখানে এসেছিও এক সাথে, ও ফরিদা জাহাজে গেছে।
ও, ফরিদা?
হ্যাঁ
তা হলে কোন চিন্তা করো না ওখানে অনেক বাংলাদেশি আছে। দেখ আজ সেইল করার পর ওদের ডেকে দেখবে ও যদি ব্রিজে থাকে তা হলে কথা বলতে পারবে।
হ্যাঁ অরুণ’দা সেদিন বলেছে। দেখি আজ চেষ্টা করবো।

এমন সময় অরুণ এলে মুকিত ভাই বিদায় নিয়ে চলে গেল। তার সাথে থাকা অন্যান্য লোক জন সবাই গেল। এখন জাহাজের লোডিং প্রায় শেষ পর্যায়ে। অরুণ এবং সবাই ভীষণ দৌড়া দৌড়ীর মধ্যে, এই ট্যাঙ্ক থেকে ওই ট্যাঙ্কে যাচ্ছে দেখছে আর অরুণ নির্দেশ দিচ্ছে কোন ট্যাঙ্কে লোড শেষ হয়েছে ওটা বন্ধ করতে বলছে। প্রায় সব ট্যাঙ্কে লোড হয়ে গেছে এখন সর্ব শেষ ট্যাঙ্কে চলছে। জেটির লোক জনকে ডেকে জেটির পাশে দাড় করিয়ে রেখেছে আর অরুণ ট্যাঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে কখন বন্ধ করতে হবে। নিশাত পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। নিশাত দেখতে পেল নির্দিষ্ট জায়গায় আসার একটু আগেই জেটিতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে স্টপ বলে দিল আর সাথে সাথে লোকটাও তার হাতের ওয়াকি টকি দিয়ে স্টপ বলল। তেলের গতি কমে এক সময় বন্ধ হয়ে গেল। জাহাজের পাইপের গেট ভাল্ব বন্ধ করে সব গুলি ট্যাঙ্কের সব মুখ বন্ধ করে আটকিয়ে দিল। একটু পরে যারা পাইপ কানেকশন দিয়েছিল সেই গাড়ি এসে জেটির পাশে দাঁড়াল। এবার অন্য দুই জন লোক ওই আগের লোকদের মত পোশাক পড়নে এসে পাইপ খুলে জেটিতে উঠিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। একটু পরে আবার ভিন্ন এক গাড়ি নিয়ে এলো আরও দুই জন। হাতে কত গুলি বোতল আর মাপার ফিতা নিয়ে। নিশাত শুধু দেখে যাচ্ছে। জাহাজের ট্যাঙ্কের তেল মাপার যে সাউন্ডিং পাইপ সেখানে থেকে তেল তুলে বোতলে ভরে জাহাজের নাম, তেলের নাম, তারিখ এই সব লিখে একটা করে লেবেল বোতলের গায়ে লাগিয়ে নিলো। এর পর কি একটা পেস্টের মত ফিতায় বাধা একটা পেন্ডুলামের গায়ে লাগিয়ে ওই মুখ দিয়ে ট্যাঙ্কের ভিতর ছেড়ে ট্যাঙ্কে কত ফুট তেল আছে তা মেপে একটা খাতায় টুকে রাখল আর পেন্ডুলামে যে গোলাপি রঙের পেস্ট লাগিয়েছিল তার রঙ পরিবর্তন হয়েছে কি না তা দেখছে। ট্যাঙ্কে পানি থাকলে না কি এর রঙ বদলে নীল হয়ে যায়। এর পর প্রতিটি ট্যাঙ্কে থার্মো মিটার নামিয়ে তেলের তাপ দেখে ওই খাতায় লিখে নিয়েছে। এগুলি শেষ হলে ওদের নিয়ে অরুণ’দা তার অফিস রুমে চলে গেল হিসেব করতে। হিসেব নিকেশ সেরে ওরা চলে গেল আর সবাই অপেক্ষায় রইল কখন পাইলট এসে জেটির বাইরে নিয়ে যাবে।

প্রায় বিশ পঁচিশ মিনিট পর পাইলট এসে জাহাজে উঠে সরাসরি অরুনের সাথে ব্রিজে গেল। জেটি থেকে জাহাজের সিঁড়ি নামিয়ে নেয়া হলো। ওরা ব্রিজে যাবার পর ক্যাপ্টেন জাহাজ ছাড়ার অর্ডার দিয়ে দিল। এক এক করে পিছন থেকে রশি খুলে যে টাগ বোট এসেছিল তারা রশি বেধে টেনে জাহাজ ঘুড়িয়ে নিয়ে জেটি ছেড়ে বের করে দিল। বাইরে এসে সোজা চালিয়ে এক বারে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেল। পাইলটকে নামিয়ে নেয়ার জন্য পিছনে একটা পাইলট লঞ্চ আসছিল, বাইরে এসে জাহাজ থামিয়ে দিলে লঞ্চটা জাহাজের গায়ে এসে ভিড়ল আর পাইলট নেমে গেল। এবার ফুল স্পিডে জাহাজ চালিয়ে দিয়ে নিশাতকে ব্রিজে ডেকে নিয়ে গেল।

ব্রিজে এসে দেখে জাহাজ সামনে এগিয়ে চলছে স্পেনের দিকে। শাহিন স্টিয়ারিং করছে। অরুণ গ্রে বাহরাইনকে ডেকে বাহরাইন ছেড়ে যাবার সংবাদ জানিয়ে দিল। এর একটু পরেই গ্রে বাহরাইনকে ডেকে স্পেনে কখন পৌঁছাবে বলে দিল। প্রায় ঘণ্টা খানিক হয়ে গেছে জাহাজ রাস্তানুরাহ ছেড়ে এসেছে। ফাঁকে ফাঁকে অরুণ রাডারে দেখে নিচ্ছে আশে পাশে কোন জাহাজ আছে কি না। বন্দরের কাছে বলে সব সময় জাহাজ আসা যাওয়া করে এই জন্যে এত সাবধানতা। শ খানিক মাইল দূরে চলে গেলে এত সাবধানতার দরকার হয় না। স্টিয়ারিং হুইলের সামনে একটা লিকুইড ম্যাগনেটিক কম্পাস, উপরে জাইরো কম্পাসের মনিটরে দেখল জাহাজ কত ডিগ্রীতে চলছে।
জগে কফির পানি গরম দিয়ে জিজ্ঞেস করল
কফি খাবে?
হ্যাঁ।
হাবিবকে একটু দেখবেন পাওয়া যায় কিনা!
দাঁড়াও দেখছি।
ভিএইচএফের রিসিভার হাতে নিয়ে আবার ফরিদাকে ডাকল। সাথে সাথে ফরিদা থেকে হান্নান নামের এক জন জবাব দিল।
কি হান্নান, তোমরা কোথায়?
আমরা কুয়েতে
কবে এসেছ?
গত পরশু
যাবে কবে?
কি জানি হয়তো আগামী পরশু হয়ে যাবে আমাদের এখনও লোডিং শেষ হয়নি
কোথায় যাবে?
টোকিও যাব
তোমরা কোথা থেকে এসেছ?
আমরা ডান্ডি থেকে লন্ডন হয়ে এখানে এসেছি, হান্নান শোন, তোমাদের ওখানে হাবিব নামে বাংলাদেশ থেকে একজন নতুন এসেছে?
হ্যাঁ এসেছে, কেন?
ওর এক বন্ধু নিশাত আমাদের এখানে এসেছে। হাবিব কি ব্রিজে আছে?
হ্যাঁ আছে একটু অপেক্ষা কর ডেকে দিচ্ছি।
হ্যাঁলো আমি হাবিব বলছি!
হাবিব, আমাকে তুমি চিনবে না। আমি প্যাসিফিক ম্যারিনারের চিফ অফিসার অরুণ , তোমাদের চিফ অফিসার হান্নান আমার বন্ধু। তোমার বন্ধু নিশাত এইতো আমার সঙ্গে আছে।
ও আচ্ছা, অরুণ’দা নিশাত ভালো আছে?
হ্যাঁ তা মনে হয় ভালোই আছে। আচ্ছা হাবিব তুমি নিরু নামে কাউকে চেন?
নাতো, কেন কি ব্যাপার?
এদিকে অরুণ যখন হাবিবের সাথে এসব কথা বলছে তখন নিশাত অরুণের মুখ থেকে হঠাৎ নিরুর নাম শুনে চমকে উঠল। কি ব্যাপার দাদা এ নাম জানল কি করে? ওহ! ওই যে জেটিতে লিখার সময় দেখেছে তাই মনে করে রেখেছে।
না, তেমন কিছু না তবে তোমার বন্ধু আজ বাহরাইনের সিতরা জেটিতে এই নামটি লিখে রেখে এসেছেতো তাই ভাবলাম তুমি হয়ত চেন। আচ্ছা ঠিক আছে এমনিই একটু ফান করলাম। নাও নিশাতের সাথে কথা বল।
হ্যালো হাবিব
নিশাত তুই কেমন আছিস কবে জাহাজে উঠেছিস কেমন লাগছে ওখানে কি তোরা সবাই বাঙালি?
এক নিশ্বাসে হাবিব অনেক গুলি প্রশ্ন করে একটু থামল। এবার নিশাতের পালা।
থাম থাম, এক সাথে এত গুলি প্রশ্ন করলে জবাব দেব কি করে? যাক তোর সন্ধান যখন পেয়েছি তখন সামনা সামনি কথা হবে যখন তখন সব বলব।
দেখা হবে না কি?
একই লাইনে চলাচল আমাদের কাজেই দেখা অবশ্যই হবে।
১৩।
ইউরোপ এবং এশিয়ার নানা দেশ দেখার আনন্দে এবং চমকে দিন গুলি বেশ কেটে যাচ্ছে। এর মধ্যে জাহাজের সব বাংলাদেশিদের সাথে বিশেষ করে নিশাতের সমবয়সীদের সাথে ভাব জমে উঠেছে। দিন গুলি কেটে যায় কিন্তু যখন একা হয় তখন কোথা থেকে যেন নিরু এসে হাজির হয় ওই যে বীণা আপার বাসায় নিরু যখন বলেছিল “দরকার হলে আমি সারা জীবন আপনার জন্য অপেক্ষা করব” ওই কথা বলার সময়ে নিরুর চেহারা এবং ওই ক্ষণটাকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারে না। যখনই নিরুর কথা মনে হয় তখনই সেই চেহারা সেই পরিস্থিতি মনে ভেসে আসে। বীণা আপার বাসার সেই সোফায় বসে ওরা দুইজন, নিরুর ডান হাতটা শক্ত করে ধরা। নিরু বলেছে কিন্তু সিরাজ চাচা! যদি চাচা ওর কথা না মানে তাহলে! এমনিতে চাচা যেমন মেজাজি মানুষ! সে কি নিরুর কথা রাখবে? কি জানি, রাখতেও পারে কারণ চাচা নিরুকে খুব ভালবাসে মা ছাড়া ডাকে না। বড্ড ভুল হয়ে গেছে, আবার ভাবল বীণা আপা বা অন্তত যূঁইকে কিছু একটা বলে আসলে ভাল হতো। এর বেশি আর কিছু ভাবতে পারে না নিশাত। নানা দুশ্চিন্তা এসে মাথায় ভর করে। মাঝে মাঝে একটু অন্যমনস্ক হলে অরুণ’দা এবং মুকিত ভাইয়ের কাছে ধরা পরে যায় কিন্তু তবুও কখনও নিরুর কথা জানতে বা বুঝতে দেয় না। শুধু ওই জেটিতে নাম লিখা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারে না। নিরু কি আমার হবে? এই এক প্রশ্ন সারা বেলা অবেলায়। কতবার ভেবেছে একটা চিঠি দেই কিন্তু কোথায় কিভাবে কার ঠিকানায় লিখবে কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। শুধু ভয় যদি অন্য কারও হাতে পরে তাহলে কি হবে! কত বড় কেলেঙ্কারি হবে! এই ভয়ে কত চিঠি লিখে ছিড়ে ফেলেছে আর সেগুলি হয়ত এখনও বিভিন্ন সাগর জলে ভেসে বেড়াচ্ছে।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২০

এ কি, তুমি এখনও মুখ ধোওনি?
না অরুণ’দা ঘুম থেকে উঠেই দেখার জন্য ডেকে চলে গিয়েছিলাম।
আচ্ছা যাও ডিউটির জন্য রেডি হয়ে এসো, একবারে নাস্তা খেয়ে এসো!
আচ্ছা, বলে নিচে চলে এলো।
দুপুর ১২টা নাগাদ নিশাত ব্রিজেই রইল। কখনও বাইনোকুলার চোখে দিয়ে আবার কখনও রাডারের পর্দায় শুধু দেখছিল। প্রায় দুইটার দিকে সউদি রাস্তানুরাহ পাইলট এসে ওদের জেটিতে নিয়ে গেল। ইমিগ্রেশন, কাস্টম ইত্যাদি ঝামেলা সেরে ছয়টার পরে একটা পিক আপ এসে জাহাজের পাশে দাঁড়াল। পিক আপ থেকে দুই জন লোক নীল রঙের বয়লার স্যুট পড়নে হাতে টুল বক্স নিয়ে জাহাজের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো। টুল বক্স রেখে আবার পিক আপে গিয়ে একটা রাবারের মোটা হোস পাইপ এনে জাহাজের পাইপের মুখের সাথে আগে কানেকশন করে পরে আর এক মাথা জেটির পাইপের সাথে কানেকশন করে দিয়ে চলে গেল। নিশাত ওদের কানেকশন দেয়ার ঢং দেখে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। কি দক্ষ এরা! কেমন করে এই টুক সময়ের মধ্যে সেরে ফেলল। পাম্প ম্যান গেট ভাল্ব খুলে দিল। ভাল্ব কতটা খুলছে তা বেশ সুন্দর ভাবে একটা কাঠি দিয়ে দেখা যাচ্ছে, নিশাতকে বুঝিয়ে দিল বিষয়টা। একটু পরে দেখতে পেল একোমডেশন ডেক থেকে ক্যাপ্টেন এদিকে এগিয়ে আসছে, পিছনে তার স্ত্রী। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল
লোডিং শুরু হয়েছে?
না এখন হয়নি, এই মাত্র কানেকশন করে গেল
কখন শুরু করবে কিছু বলেছে?
না।
আচ্ছা ঠিক আছে লোড শুরু হলে আমাকে বলবে।
আচ্ছা বলব।
ওরা ডেকের উপরে একোমডেশন ডেক থেকে মেইন ডেকের উপর দিয়ে ফোর ক্যাসেলে যাবার কাঠের ব্রিজ দিয়ে কিছুক্ষণ হাটা হাটি করে চলে গেল।
জাহাজের পাম্প ম্যান গেট ভাল্ব খুলে অপেক্ষা করছে কখন লোডিং শুরু করবে। মুকিত ভাই ডেকে গিয়ে আবার সব ট্যাঙ্ক, কানেকশন, ভাল্ব সব দেখে ডেকের উপরেই হাটা হাটি করছে সাথে নিশাত সব কিছু দেখছে। অরুণ’দা এসে বলল
মুকিত যাও রেস্ট নাও, ও ভালো কথা লোডিং এর ব্যাপারে কিছু বলেছে?
না, ওরা এসে শুধু পাইপ কানেকশন করে গেছে, কখন স্টার্ট করবে তা কিছু বলে নাই।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও, আমি দেখছি।
ওহ ভালো কথা, অরুণ’দা নিশাতকে একটু দেখিয়ে দিবেন।
হ্যাঁ হ্যাঁ যাও সে আর তোমাকে বলতে হবে না।

মুকিত চলে গেল। ডেকে আর দুই জন জিপি ডিউটি করছিল, শাহিন এবং জয়নুল। অরুণ শাহিনকে ডেকে নিশাতকে নিয়ে শুধু ব্রিজ বাদে জাহাজের আগা গোরা সব কিছু দেখিয়ে আনতে বলে দিল। শাহিন নিশাতকে নিয়ে প্রথমে জাহাজের ফোর ক্যাসেলে (জাহাজের সামনের ভাগ, যেখান থেকে নোঙ্গর ফেলা হয়, তোলা হয় এবং জাহাজ সামনের দিকে বাধা হয়) সেখানে নিয়ে গেল। এখানে কোন জিনিসের, কোন অংশের কি নাম কি কাজ এসব দেখিয়ে নিয়ে এলো ফোর ক্যাসেলের নিচে। এখানে নোঙ্গরের চেইন কোথায় থাকে, রঙ ব্রাশের স্টোর, আরও যা যা থাকে সব দেখিয়ে নিয়ে গেল পিছনের ডেকে। ওখানে কি ভাবে জাহাজ বাধা হয় ছাড়া হয় সব কিছু দেখিয়ে দিল। গ্যালিতে গিয়ে দুই জনে চা খেতে খেতে কিছু গল্প করে আবার ডেকে নিয়ে গেল।
কি নিশাত দেখেছ?
হ্যাঁ দেখলাম।
এই মহসিন ওকে ডেকের পাইপ লাইন গুলি বুঝিয়ে দাও, বলেই আবার বলল না ঠিক আছে তুমি থাক নিশাত আমার সাথে এসো।
এখানে জাহাজের কয়টা ট্যাঙ্ক, বিভিন্ন রঙ দিয়ে আলাদা করা পাইপ লাইন তার সাথের ভাল্ব, মেইন গেট, কোন লাইনের তেল কোন ট্যাঙ্কে যায় কি ভাবে লাইন ব্যবস্থা করতে হয়, তেলের প্রেশার মিটার, টেম্পারেচার দেখার থার্মো মিটার সব কিছু দেখিয়ে দিয়ে বলল,
ব্যাস আজ এই পর্যন্তই থাকুক না হলে সব গুলিয়ে ফেলবে, আস্তে আস্তে সব দেখে শুনে বুঝে নিবে, যার কাছে যখন যে সুযোগ পাও দেখবে।
আচ্ছা অরুণ’দা। আপনারা যে ভাবে যা বলবেন সে ভাবেই করবো, ভুল ভ্রান্তি হলে বলবেন। আমি কি ভয়ে ভয়ে এসেছি জানেন, শুধু ভেবেছি কোথায় যাচ্ছি, কারা কারা থাকবে, কাদের সাথে চলতে হবে। ভাবতে পারিনি যে এখানে এসে সব বাঙ্গালি পাব।

একটা কার এসে জাহাজের পাশে জেটিতে দাঁড়াল। এক লোক হাতে ওয়াকি টকি নিয়ে নেমে পাশে এসে জিজ্ঞ্যেস করল
তোমরা কি লোডের জন্য রেডি?
হ্যাঁ আমরা কখন থেকে বসে আছি।
আচ্ছা, তাহলে লোড স্টার্ট করতে বলব?
হ্যাঁ বল, কত স্পীডে আসবে জান?
২৫০ টন।
আচ্ছা ঠিক আছে।
জেটির পাশে দাঁড়ান লোকটা ওয়াকি টকি দিয়ে কাকে বলল ‘স্টার্ট’
একটু পরে পাইপ লাইন দিয়ে ছিট মিট ,পট পট শব্দ করে তেল আসা শুরু হলো। প্রথমে পিছন দিকের ট্যাঙ্কে নিচ্ছে, ওখানে কিছু নিয়ে পরে অন্যান্য গুলিতে নিবে। অরুণ’দা পিছনের ট্যাঙ্কের মুখের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তার সাথে পাম্প ম্যানও আছে। নিশাত কৌতূহল নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ট্যাঙ্কের নীচে তাকিয়ে আছে। কি ভাবে তেল আসে তাই দেখার জন্য। একটু পরেই ট্যাঙ্কে তেল আসা শুরু হলো। অরুণ’দা আর পাম্প ম্যান ঘুরে ঘুরে সব ভাল্ব, জয়েন্ট চেক করে দেখে নিলো কোথাও লিক হচ্ছে কি না। এবার ঘড়ি দেখে হিসেব করে বলল বিশ ঘণ্টা লাগবে। মানে কাল দুপুর তিনটা বেজে যাবে। আর আমরা সেইল করতে পারব ধর আরও ঘণ্টা খানিক পর। ঠিক আছে চলুক, আমি ভিতর থেকে আসি। চল, যাবে আমার সাথে চা খেয়ে আসি!
হ্যাঁ খেতে পারি অবশ্য আমি এত চা কখনো খাইনি,
কি যে বল, জাহাজে চাকরী করতে এসেছ এখন দেখবে আগের অভ্যাস অনেক বদলে যাবে।

চা খেয়ে এসে নিশাত এবার একটু একা একা জাহাজের ডেকের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে দেখছে। তখন ভাটায় পানি অনেক নিচে নেমে গেছে। যখন এখানে এসেছিল তখন জোয়ার ছিল বলে জাহাজের ডেক জেটির বেশ উপরে ছিল। এখন পানি নিচে নেমে গেছে বলে জাহাজের ডেক জেটির লেভেলে চলে এসেছে। জেটির নিচে চোখ পরতেই দেখল জেটির পাইল এবং বিমে নানা ভাষায় নানা রঙ দিয়ে অনেক কিছু লেখা তার কোনটা সে পড়তে পারলো তবে বেশির ভাগই ভিন্ন ভাষা বলে সেগুলি পড়তে পারলো না। প্রায় লেখা গুলির মাঝে যোগ চিহ্ন দিয়ে এ পাশে ও পাশে কারো নাম লেখা, যা পড়তে পেরেছে তার মধ্যেও এই রকম আবার যা পড়তে পারেনি তাতেও এমন অনেক লেখা। কেউ কেউ আবার বিদঘুটে কিছু ছবিও একে গেছে, কেউ আবার জাহাজের নাম লিখে রেখে গেছে, কবে কে এসেছিল তারিখ লিখে তার নিজের নাম, জাহাজের নাম লিখেছে। নিশাত ভাবল তা হলে সেও পারে এমন করে তার নাম লিখে দিতে। না আমার নাম না নিরুর নাম লিখি, না তাইবা কেন নিরু কি একা? ওর সাথে যে আমিও জড়িয়ে আছি! নিশাত কি পারে না এমন করে একটা যোগ চিহ্ন দিয়ে ওর আর নিরুর নাম লিখে দিতে? না, এখানে নতুন এসেছে, সবার সাথে তেমন কোন ঘনিষ্ঠতা হয়নি এরা দেখলেই বা কি ভাববে? একটা ভ্যাবাচ্যাকার মধ্যে পরে গেল। কি করবে। না লিখেই ফেলি। এই লেখার সূত্র ধরে যদি কোন দিন নিরু আমার হয়ে যায় তা হলে মন্দ কি?
শাহিন ভাই, আপনাদের বোসন্স স্টোরে একটু যাব?
কেন?
আমার একটু রঙ আর ব্রাশ লাগবে।
এখন রঙ ব্রাশ দিয়ে কি করবেন?
কাজ আছে, দেন না একটু
আচ্ছা চলেন দেখিয়ে দিচ্ছি।

স্টোরে ঢুকে রঙ আর একটা ব্রাশ নিয়ে এসে একটা সুবিধা মত জায়গা খুঁজতে লাগল কোথায় লেখা যায়। এমন জায়গায় লিখতে হবে যেন সবার চোখে পড়ে অথচ জেটি মেইনটেনেন্স এর সময় মুছে না যায়। সব জায়গাই ভর্তি। খুঁজতে খুঁজতে একটু খালি জায়গা পেয়ে নাম লেখা শুরু করল। বাংলায় লিখবে না ইংরেজিতে এ আবার আর সমস্যা। ইংরেজিতেই লেখি পৃথিবীর সবাই পড়তে পারবে। নিশাত লিখছে ওর পিছনে শাহিন দেখছে।
লেখা শেষ হলে শাহিন জিজ্ঞেস করল
কি ভাই কার নাম লিখলেন?
দেখছেন তো।
তা দেখছি কিন্তু এ কে?
কি জানি তা জানি না।
ও বুঝেছি
একটু পরে অরুণ’দা এসে বলল
কি নিশাত ওখানে কি করছ?
কাছে এসে সদ্য লেখা এক মেয়ের নাম দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
ডুবে ডুবে জল খাচ্ছ?
না ডুবে আর খাচ্ছি কোথায়, প্রকাশ্য দিবা লোকেই তো লিখলাম।
হুম তুমি তো বেশ চালাক দেখছি, তা কার নাম লিখলে?
দেখতেই তো পাচ্ছেন।
তা তো পাচ্ছি, কিন্তু এ কে?
জানি না।
ও বুঝেছি। আচ্ছা ঠিক আছে জাহাজ ছাড়তে দাও দেখি।
জাহাজ ছেড়ে দিলে আর দেখবেন কি ভাবে, তার চেয়ে এখনি দেখে নিন, জাহাজ চলে গেলে কিন্তু দেখতে পারবেন না।
কেন?
বা রে, আমি কি জেটিটা সাথে নিয়ে যাব না কি?
ওরে বাব্বা এত দূর! তুমি দেখি সাঙ্ঘাতিক হাবু ডুবু খাচ্ছ! আচ্ছা আচ্ছা তা হলে এই ব্যাপার? তা এই সৌভাগ্যবতীটি কে?
না দাদা প্লিজ আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। যা দেখেছেন ওই পর্যন্তই থাক।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যদি বলতে না চাও তা হলে জিজ্ঞেস করবো না। তবে কাজটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না।
নিশাত হেসে দিল।
এই সব নানা হাসি তামাশার মধ্যে জাহাজের লোডিং চলছে এর মধ্যে ওদের ডিউটির সময় শেষ হয়ে এলো। মুকিত ভাই এসে হাজির। কোন ট্যাঙ্কে কতটা লোড হয়েছে তা সব কিছু মুকিত ভাইকে বুঝিয়ে দিয়ে অরুণ বলল
চল নিশাত আমাদের ছুটি। কিছু খাবে, ক্ষুধা লেগেছে?
হ্যাঁ একটু মনে হচ্ছে, বিকেলে রাতের খাবার খাইনি কখনও, তাই অভ্যাস হতে সময় নিচ্ছে।
আচ্ছা চল তাহলে গ্যালিতে যাই দেখি কি আছে।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৯

কি ব্যাপার নিশাত ভাই খেতে এসেছেন? জাহাজের নিয়ম কিন্তু এই ডিউটির সময়ের সাথে খাওয়া, এক দল ডিউটিতে যাবার আগে খেয়ে যায় আবার তার পরে আর এক দল ডিউটি শেষ করে খেয়ে ঘুমাতে যায়।

ঠিক আছে সে না হয় বুঝলাম কিন্তু এই এত তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেলে রাতে ক্ষুধা লাগবে না তখন কি হবে?
কেন এই যে দেখেন এখানে ব্রেড, বাটার, জ্যাম, ডিম, দুধ সব কিছু রয়েছে ব্রিজেও থাকে। ক্ষুধা লাগলে যা ইচ্ছা খেয়ে নিবেন, স্যান্ডউইচ বানিয়ে নিতে পারেন এই যে এই ফ্রিজে টমাটো, শসা, লেটুস সব কিছু আছে কোন নিষেধ নেই, কেউ কিচ্ছু বলবে না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, খাবার ব্যাপারে জাহাজে যথেষ্ট সাবধানতার সাথে খুব হিসেব করে মেনু তৈরি করে। চিটাগাঙে আর্টিক্যাল সই করেছেন তাতে দেখেননি এক জন মানুষের দৈনিক কি পরিমাণ এবং কোন ধরনের খাবার দিবে তা ওখানে লেখা আছে, দেখবেন এখানে এক খাবার পর পর দুই বার হবে না। প্রতি দিন ভিন্ন ভিন্ন মেনু থাকবে। এটার দায়িত্ব সেকেন্ড অফিসারের। মুকিত ভাই কিছু বলেনি?
না, বলার সময় পেল কোথায়, অন্যান্য কথায় সময় চলে গেল।
দেখবেন আরও অনেক নিয়ম আছে জাহাজে, নেন খেয়ে নেন আপনার আবার ডিউটির সময় হয়ে গেছে।
কি রান্না হয়েছে?
এখন সবজী, মুরগী আর ডাল
আচ্ছা ওই ফিলিপিনোরা কি খাবে? ওরাও কি এই খাবে? তারপর ক্যাপ্টেন চিফ ইঞ্জিনিয়ার ওরা?
হ্যাঁ ওরাও এই খাবে, এখানে এমন ভাবে রান্না হয় যা সবাই খেতে পারে তবে ক্যাপ্টেন ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য আলাদা রান্না হয়।
আচ্ছা বেশ ভালোই তো এই নিয়ম, দেন দেখি কি দিবেন, তবে এনাম ভাই আমার কাছে এই বিকেল বেলা রাতের খাবার খেতে একটু কেমন অবাক লাগছে।
তা প্রথম প্রথম একটু লাগবেই, পরে অভ্যাস হয়ে গেলে তখন আর অসুবিধা হবে না।
খাবার খেয়ে নিশাত কেবিনে গিয়ে চিটাগাং থেকে দেয়া ডিউটির পোশাক পড়ে ডেকে মুকিত ভাইর কাছে গেল। মুকিত ভাই ওকে দেখে বলল কি ব্যাপার এত তাড়াতাড়ি এলে?
তাড়াতাড়িই এলাম দেখি কি হচ্ছে।
বেশ ভালো কথা, হ্যাঁ সব সময় এই ভাবে পাঁচ সাত মিনিট আগে আসবে এতে অফিসাররা তোমাকে সুদৃষ্টিতে দেখবে।

ওদের কথা বলতে বলতে চীফ অফিসার অরুণ এসে হাজির।
কি ব্যাপার নিশাত, বল দেশের খবর কি, তখন একটু কাজ করছিলাম বলে কথা বলতে পারিনি, তোমার শরীরে বাংলাদেশের গন্ধ পাচ্ছি।
না, অরুণ’দা বাংলা দেশের গন্ধ দুবাইতে দামী হোটেলের দামী সাবান দিয়ে গোছল করে ধুয়ে ফেলেছি।
আরে ধুর কি বল! আমি এখনও গন্ধ পাচ্ছি, সাবান দিয়ে কি দেশের গন্ধ ধোয়া যায়? আমার মনে হচ্ছে বাংলাদেশটা বুঝি এসে পরেছে। তা বল দেখি কোন কোন ঘাট ধরে এসেছ?
নিশাত এক এক করে বলছে আর মুকিত, অরুণ ডেকের আর দুই জন শাহিন এবং জয়নুল এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে।
একটু পরে কথা শেষ করে মুকিত বলল তাহলে অরুণ’দা আমি যাই? মুকিত ভাই চলে যাবার পর নিশাত অরুণ’দার সাথে ব্রিজে ঢুকল। অরুণ’দা প্রথমেই সব কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, ব্রিজ দেখেই নিশাতের খুব ভালো লেগে গেল। মন দিয়ে সব শুনছে। প্রাথমিক ভাবে দেখে যা বোঝা যায় এক নজরে দেখে নিয়েছে। রাডার, স্টিয়ারিং হুইল, কম্পাস, জাইরো কম্পাস, হেল্মস ইন্ডিকেটর, ইঞ্জিন রুম টেলিগ্রাম, ব্যারো মিটার, হাইগ্রো মিটার, ট্রিমিং ইন্ডিকেটর, ইকো সাউন্ডার, স্যাটালাইট ন্যাভিগেটর, ডেকা ন্যাভিগেটর আরও কত কি!
অরুণ’দা ব্রিজের টেবিলের পাশে কফি বার থেকে কফি বানিয়ে কাপ হাতে নিয়ে এলো চার্ট টেবিলের কাছে। অরুণ’দা চার্ট টেবিলে একটা ম্যাপের মত মেলে কি যেন করছে
ভূগোল, ম্যাপ কেমন বুঝ?
একে বারে খারাপ না, ভূগোল আমার প্রিয় সাবজেক্ট,
তাই নাকি! বেশ ভালো হয়েছে, তাহলে ম্যাপ বুঝতে তোমার সুবিধা হবে।
টেবিলের উপর একটা ম্যাপের মত বিছানো রয়েছে। তার পাশে কাটা কম্পাস, দুইটা বড় স্কেলের মত এক সাথে জোড়া লাগান রয়েছে এগুলি দেখিয়ে আবার বলল
দেখ তো এগুলি চিনতে পার কি না?
হ্যাঁ এটা একটা ম্যাপ বুঝতে পারছি এই যে এই হচ্ছে সাগর, আর এই যে আমরা যেখান থেকে এসেছি সেই এলাকা, এই হচ্ছে ল্যাটিচুড মার্ক আর এটা লঙ্গিচুড, আর এই পেন্সিলের লাইনটা মনে হচ্ছে আমাদের রাস্তা, তাই না?
বাহ বেশ!, তুমি তো অনেক জান দেখছি!
তবে এই স্কেলটা এমন কেন?
এটাকে প্যারালাল রোলার বলে, দেখ এটা দিয়ে কি করি
এবার চার্ট টেবিলের পাশে উপরে দেয়ালের সাথে লাগান ডেকা ন্যাভিগেটর কেমন যেন একটা ক্লিক ক্লিক শব্দ করছিল ওটায় কি রিডিং দেখে রোলার দিয়ে মেপে চার্টে একটা দাগ দিয়ে বলল
এই যে আমরা এখানে আছি এখন
ও বুঝেছি এর নাম নেভিগেশন?
হ্যাঁ।

কফি শেষ হয়ে গেছে কাপ ধুয়ে রেখে দিল। রাডার দেখে বলল
আচ্ছা এই যে সাদা দাগ দেখা যাচ্ছে এগুলি কি?
ওগুলি জাহাজ বা অন্য কিছু হতে পারে, সে তুমি লক্ষ্য করে দেখবে এই দাগ মুভ করছে কি না, যদি মুভ করে তা হলে বুঝবে এটা জাহাজ, আর যদি মুভ না করে স্থির থাকে তা হলে বুঝবে ওটা সাগরের কোন বয়া বা কোন স্থির কিছু হবে, ওয়েল রিগও হতে পারে, দেখ আমাদের পিছনে এই স্থল ভাগ কেমন দেখাচ্ছে, আর সাগরের পানি কেমন দেখাচ্ছে। এখানে এই যে এই রাডার এটার রেঞ্জ আরও বেশি। এই ইংলিশ চ্যানেলে আমরা এটা চালাই না। এখানে এই ৫০ মাইল রেঞ্জ যথেষ্ট। আর একটু কফি খাবে?
না আর না আপনি খেলে খান আমি বানিয়ে দিই?
না না আমিই বানিয়ে নিচ্ছি
কি শাহিন তুমি খাবে?
না দাদা।
ওকে আজ এই পর্যন্তই, তুমি স্টিয়ারিং করতে পারবে?
চেষ্টা করে দেখি
শাহিন ওকে একটু দাও তো।
শাহিন স্টিয়ারিং হুইল ছেড়ে টুল থেকে নেমে এলো, নিশাত ওখানে বসে স্টিয়ারিং হাতে নিলো।
শাহিন বলে দিল এটা হচ্ছে হেল্মস ইন্ডিকেটর মানে আপনার স্টিয়ারিং সোজা আছে না কোন দিকে ঘুরছে তা বুঝতে পারবেন আর এই হচ্ছে আপনার কম্পাস। দেখেন আমাদের জাহাজের হেড এখন কত ডিগ্রিতে আছে দেখছেন?
হ্যাঁ দেখলাম,
তাহলে ঠিক এই কোর্সে রেখে চালান।
নিশাত স্টিয়ারিং করছে। অরুণ ব্রিজের বাইরে বের হয়ে পিছনে দেখে এসে বলল তোমার স্টিয়ারিং ঠিক হচ্ছে না।
কি ভাবে বুঝলেন?
কি ভাবে বুঝলাম দেখবে এসো আমার সাথে।
ব্রিজের বাইরে এসে পিছনে প্রপেলারের ঘূর্ণির ফলে পানিতে ফেনা উঠেছে সেদিকে দেখিয়ে বলল
দেখ কেমন জিগ জাগ দেখাচ্ছে না? কারেক্ট স্টিয়ারিং হলে এই লাইনটা সোজা হবে। এই দেখে মিটার না দেখে যে কেউ বলতে পারবে স্টিয়ারিং কেমন হচ্ছে। তবে সে যা হোক তুমি যে সাহস করে হাতে নিয়েছ এতেই আমি খুশি, আস্তে আস্তে শিখে নিও।
দাদা ফরিদা কোথায় আছে একটু দেখবেন?
হ্যাঁ দেখছি,
ফরিদাকে ডেকে পেল না।
আমার মনে হয় ওরা ইউরোপে নেই। কেন, ফরিদাকে কেন?
আমার সাথে আমার এক বন্ধু এসেছে ওকে ফরিদায় দিয়েছে তাই জানতে চাচ্ছিলাম ওরা কোথায় আছে
ও আচ্ছা! তোমার বন্ধু কে?
হাবিব!
হাবিব?
আমি আর হাবিব এক সাথে এসেছি, আমরা এক সাথে একই কলেজে পড়া শুনা করেছি এবং আমাদের বাড়িও এক জায়গায়।
ও, তাই নাকি?

১১।
আজ নিশাত ঘুম থেকে উঠেই লক্ষ করল জাহাজের ইঞ্জিন চলছে না থেমে আছে। কি ব্যাপার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে জাহাজ চলছে না এবং কোন রোলিং হচ্ছে না, নোঙর করে রয়েছে। কাছা কাছি আরও অনেক জাহাজ এমনি নোঙ্গরে রয়েছে। সউদি আরবের সবুজ সাদা পতাকা উড়ছে। কেবিন থেকে বের হয়ে ওই ডেক থেকে নেমে মেইন ডেকে এসে বাইরে দেখে এটা এক নতুন দেশ। সুয়েজ খালের পাশে যেমন দেখেছে অনেকটা ওই রকম। সামনে একটা ডকইয়ার্ড দেখা যাচ্ছে আশে পাশে বেশ কয়েকটা বিশাল বিশাল জাহাজ নোঙ্গর করে আছে। ওইতো দূরে কিনারা দেখা যাচ্ছ। একটু একটু ওগুলি কি মাটির ঘর, না কী ওগুলি? সুয়েজের দুই পাড়ে আরব দেশগুলিতে এমন দেখেছে। অন্যান্য সমুদ্র বন্দর যেমন হয় ছোট ছোট অনেক বোট এবং পালের বোট এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে। ওইতো সমুদ্রের মাঝখানে জেটি দেখা যাচ্ছে, অনেকগুলি জাহাজ ভিড়ে রয়েছে। মনে হয় সবগুলি ট্যাংকার হবে, একটারও মাস্তুল বা ক্রেন নেই। নিশাত অবাক হয়ে শুধু দেখছে। নাস্তা খাবার কথা ভুলে গেছে। মিডল ইস্টের প্রচণ্ড গরমেও ওর খেয়াল নেই। লন্ডন থেকে এখানে আসার পথে এ পর্যন্ত কতগুলি দেশ এবং সাগর দেখে নিয়েছে। মনে মনে শুধু ভাবছে, এ কোথায় এসেছি! কত কি দেখছি! কি আনন্দের চাকরী! তন্ময় হয়ে যখন দেখছে আর ভাবছে তখন ব্রিজ থেকে অরুণ’দা ডাকল ‘এই নিশাত ওখানে কি করছ?’ নিশাতের সম্বিত ফিরে এলো। পিছনে ফিরে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল অরুণ’দা ডাকছে! দেখছি অরুণ’দা! কাপড় বদলে ব্রিজে চলে আস!
আচ্ছা আসছি!
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৮

ভিতরে গিয়ে দেখে এটা ইমিগ্রেশন অফিস। এন্ড্রু ইমিগ্রেশন অফিসারকে দিয়ে সই স্বাক্ষর করিয়ে পাশের ছোট জেটিতে ভিড়ে থাকা একটা ছোট স্পিড বোটের কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বোটের চালককে ডাকল। একটু পরে ভিতর থেকে বোটের ড্রাইভার বের হয়ে এসেই কি কি যেন বলল। এন্ড্রু ওদের দেখিয়ে আবার কি বলল। ড্রাইভার ওদের নামার পথ দেখিয়ে দিল। এন্ড্রু গুডবাই বলে আবার দেখা হবার আশ্বাস দিয়ে চলে গেল।
বোট ছেড়ে দিল। প্রচণ্ড বাতাস বইছে, মাথার চুল এলো মেলো উড়ছে, ভীষণ ঠাণ্ডা গায়ের জ্যাকেটে বাতাস ফর ফর শব্দ তুলছে। বেশ ঠাণ্ডা বাতাস। ওরা আধ খোলা বোটের বাইরে থেকে ভিতরে গিয়ে ড্রাইভারের পিছনে বেঞ্চে বসল। আর ড্রাইভার দূরের একটা জাহাজ দেখিয়ে বলল ওই যে তোমাদের জাহাজ। প্রায় চল্লিশ মিনিটের মধ্যে ওই জাহাজের পাশে এসে ভিড়ল। একটু দূরে থেকে দেখতে পেয়েছিল জাহাজের পাশে যেখানে বোট ভিড়বে সেখানে একটা সিঁড়ি নামিয়ে রেখেছে। পাশে কয়েক জন জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বোট ভিড়ার পর ওরা এক এক করে সিঁড়ি বেয়ে জাহাজে উঠে গেল। নিশাত কোন দিন এমন সিঁড়ি বেয়ে উঠেনি বলে ভয় পাচ্ছিল। তাই দেখে উপর থেকে কে এক জন একটু আগেই হাত বাড়িয়ে নিশাতের কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে ওকে ধরে উঠাল। জাহাজে উঠে দেখে ওর স্কুলে নিশাতের সিনিয়র মুকিত ভাই সবার সাথে দাঁড়িয়ে আছে। সেও অবাক হয়ে ওর দিকে এগিয়ে এসে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল,
আরে নিশাত তুমি! আমি তো ভাবতেই পারছি না! কাকে দেখছি!
হ্যাঁ মুকিত ভাই আমিও দূর থেকে আপনাকে দেখে ভাবছিলাম চেনা চেনা লাগছে কে হতে পারে? যাক ভালোই হয়েছে আপনাকে পেয়ে।

চল ভিতরে যাই
বোট ড্রাইভার ওদের নামিয়ে দিয়ে ওরা যাদের জায়গায় এসেছে তাদের নিয়ে ফিরে গেল। মুকিত ইউনিফর্ম পরা ছিল কিন্তু নিশাত এই ইউনিফর্মের মানে কি জানে না। এর আগে কখন জাহাজে উঠেনি। জাহাজে উঠেনি বলতে এক বার যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন ওর বন্ধুর সাথে করাচীর মনওয়ারাতে নেভীর সাব মেরিন দেখতে গিয়েছিল। ব্যাস এই পর্যন্তই ওর জাহাজ সম্পর্কে ধারনা। মুকিত ভাই সবাইকে নিয়ে ভিতরে গিয়ে সবার থাকার কেবিন দেখিয়ে দিয়ে যার যার ব্যাগ রেখে নিয়ে গেল ক্যাপ্টেনের রুমে। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ওদের দেখে এগিয়ে এসে ওয়েল কাম জানিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। সবার সাথে হ্যান্ডশেক করে সৌজন্য মূলক কিছু কথা বার্তা বলে যার যার সিডিসি চেয়ে নিয়ে খুলে সবার চেহারা মিলিয়ে দেখল। এবার ভিতরে দেখছে কে কোথায় কোন কোন জাহাজে কাজ করেছে। সব দেখে নিশাতকে বলল ও তুমি একে বারে নতুন। বেশ, মুকিত তুমি ওকে ভালো করে সব কিছু বুঝিয়ে দিবে। এর পর অন্যান্য যারা ছিল তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। এনামুলকে ওর কাজের জায়গা গ্যালিতে নিয়ে চীফ কুক অরবিন্দ সিনহার কাছে বুঝিয়ে দিল। সালেককে সারেং এর কাছে বুঝিয়ে দিয়ে নিশাতকে নিয়ে চীফ অফিসার অরুণ এর কাছে নিয়ে গেল। এখানে এসে কথায় কথায় বুঝল মুকিত ভাই সেকেন্ড অফিসার। জাহাজে ডেক অফিসার এবং ডেক ক্রু সবাই বাংলাদেশি তবে চীফ কুক সিনহা কোলকাতার। ক্যাপ্টেন ব্রিটিশ, চিফ ইঞ্জিনিয়ার গ্রীক এবং অন্য ইঞ্জিনিয়ার ও ইঞ্জিন ক্রু সবাই ফিলিপাইনের।

মুকিত ভাই স্টোর থেকে ওদের বিছানার চাদর বিছানা পত্র গোছলের সাবান, কাপড় ধোয়ার ডিটার্জেন্ট পাউডার আর যা যা লাগে সব বের করে দিয়ে সব গুছিয়ে ব্রিজে যাবার কথা বলে আবার চীফ অফিসারের কাছে গেল।
নিশাত তার জন্য সুন্দর পরিপাটি করে সাজান কেবিন দেখে অবাক হলো। এই টুক ঘরের মধ্যে বিছানা, মাথার পাশে একটা রিডিং লাইট, পাশের দেয়ালে জাহাজের লে আউট নক্সা, বিছানার নিচে জুতা রাখার বক্স, হাবি জাবি এটা সেটা রাখার ড্রয়ার, কাপড় চোপড় রাখার জন্য পাশে ছোট্ট একটা আলমারি, আলমারির এ পাশে তোয়ালে ঝুলিয়ে রাখার একটা হ্যাঙ্গার, একটা ছোট টেবিল, চেয়ার, টেবিলের উপরে সেলফের মত তাতে সেভিং ক্রিম টুথ ব্রাশ এই জাতিয় জিনিস রাখা যায়, তার উপরে একটা বেশ বড় আয়না, আবার ছোট্ট একটু খানি গোল একটা সিঙকে ঠাণ্ডা গরম পানির ব্যবস্থা, এর উপরেও শেভ হবার জন্য একটা আয়না আবার আয়নার উপরে একটা লাইট। জানালায় মোটা ভারি পর্দা। ফ্লোরে কার্পেট বিছানো, পুরো জাহাজটাই এয়ারকন্ডিশন্ড, গরম বাতাস বের হচ্ছে। এতো কিছু, এতো আয়োজন দেখে নিশাতের বেশ ভালো লাগল। বাহ! কি সুন্দর পরিবেশ। এমন চাকরী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এতো আরামের ব্যবস্থা। এই সব ভাবছে আর বিছানা গোছাচ্ছে, ব্যাগ থেকে বের করে যেখানে যা রাখার সেগুলি গুছিয়ে রাখছে। নিশাত বরাবরই গুছিয়ে ছিম ছাম ভাবে থাকা পছন্দ করে। তার কাছে এমন পরিবেশ ভালো লাগার কথা। এই গুছিয়ে রাখছে আর ভাবছে এমন সময় মুকিত ভাই এসে জানাল নিশাত তোমার ডিউটি কিন্তু সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত আবার সকালে ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। এখন তোমার ব্রিজে না গেলেও চলবে তবে দেখতে চাইলে যেতে পার এখন আমার ডিউটি চলছে। তুমি অরুণ দাদার সাথে ডিউটি করবে। আমরা এখন মিডল ইস্টে চলে যাব। আচ্ছা ভালো কথা কিছু খাবে, ক্ষুধা লেগেছে?
না মুকিত ভাই হোটেল থেকে খেয়েই বের হয়েছি।
আচ্ছা তা হলে তুমি এগুলি সেরে উপরে এসো আমি যাই, নোঙ্গর তুলতে হবে।
মুকিত ভাই চলে গেল নিশাত একটু পরে সব সেরে ব্রিজে গেল। দেখে জাহাজ চলছে।
কত দিন লাগবে মুকিত ভাই?
কিসের?
না এই যে আমরা মিডল ইস্টে যাচ্ছি সেখানে যেতে
দশ/বার দিন লেগে যাবে যদি সুয়েজে ট্রাফিক না থাকে, এবার যাব সউদি আরবের রাস্তানুরাহ পোর্টে।
কিন্তু আমি যে জাহাজের কিছুই জানি না চিনি না।
তাতে কি, যারা নতুন আসে তারা কেউ কিছু জানে না, সব দেখিয়ে চিনিয়ে দিবো তুমি কিচ্ছু চিন্তা করোনা, আমার সাথে তোমার ডিউটি হলে ভালো হত তবে অরুণ দাদা খুব ভালো মানুষ দেখবে সে তোমাকে সব শিখিয়ে দিবে। আচ্ছা এবার দেশের কথা বল, কি অবস্থা?
বলেই একটু ভেবে বলল
না থাক পরে শুনব এখন ইমিগ্রেশন হবে জেটিতে জাহাজ ভিড়িয়ে নেই, অরুণ দাদাও শুনবে, চা কফি সবই আছে কি খাবে?
কিচেনে যেতে হবে?
না, এখানেই ব্যবস্থা আছে,
হ্যাঁ চা খেতে পারি
তা হলে ওই দেখ ওই ইলেকট্রিক জগে পানি গরম দাও আর দেখ ওখানেই চা পাতা দুধ চিনি সব আছে বানিয়ে নাও, আমাকেও এক কাপ দিও।
নিশাত চা বানাচ্ছে আর মুকিত ভাইর কথা শুনছে,
আর শোন, জাহাজের কিছু ভাষা আলাদা যেমন এখানে কিচেনকে বলে গ্যালি, আমরা যেখানে বসি, টিভি দেখি ওটার নাম সেলুন এরকম আরও অনেক কিছু আছে সে আস্তে আস্তে সব জানবে। আমার কাছে কিছু বই আছে ওগুলি নিয়ে পড়বে। আমি আগামী ভয়েজ শেষ করে ইংল্যান্ডে যাব চীফ মেট পরীক্ষা দেবার জন্য।
মানে অরুণ’দা যা তাই?
হ্যাঁ, তুমিও পারবে কয়েক বৎসর গেলে সরাসরি সেকেন্ড মেট পরীক্ষা দিও, এর মধ্যে যদি ভালো ভাবে সব কিছু শিখে নিতে পার তা হলে দুই এক বৎসরের মধ্যেই ক্যাপ্টেন তোমাকে থার্ড অফিসারে প্রমোশন দিতে পারে। কাজেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু বই গুলি দেখবে। সেলুনেও দেখবে কিছু বই আছে সেগুলিও পড়তে পার। অবসর সময়ে আজে বাজে চিন্তা ভাবনা না করে, সিনেমা না দেখে পড়াশুনা করতে হবে।
কি কি পড়তে হবে?
অনেক কিছু, নেভিগেশন, সিম্যানশিপ, কম্পাস, চার্ট ওয়ার্ক, রুল অফ দা রোড, সিগনালিং, ফার্স্ট এইড আমি বলে দিবো সব। তোমার ভাগ্য ভালো আমার কাছে এসে পৌঁছেছ। কোন চিন্তা করবে না। কাজে মন দিবে কে কখন কি করে সব কিছু মন দিয়ে লক্ষ্য করবে, দেখবে তুমিও পারবে।
হ্যাঁ ঢাকা থেকে আমার মামা বলেছে এখানে নাকি এ ভাবে ক্যাপ্টেন পর্যন্ত হওয়া যায়?
হ্যাঁ। আচ্ছা ঐযে দেখছ পাইলট লঞ্চ আসছে?
হ্যাঁ ওই যে উপরে একটা লাল সাদা ফ্ল্যাগ উড়ছে ওইটা?
হ্যাঁ, ওটায় পাইলট আসছে, ও আমাদের নিয়ে জেটিতে ভিড়িয়ে দিবে।
পাইলট তো শুনেছি প্লেন চালায়
হ্যাঁ আসলে পাইলট মানে পথ প্রদর্শক, কাজেই যে পথ দেখিয়ে নেয় সেই তো পাইলট তাই না?
ও হ্যাঁ তাই, কিন্তু আপনারা একা জেটিতে ভিড়তে পারেন না?
পারি কিন্তু এটা নিয়ম না, কারণ প্রত্যেক দেশের হারবারের নিজস্ব কিছু কিছু নিয়ম থাকে, হারবারে পানির নিচে কোথায় কি আছে তা আমরা জানি না, ওগুলি এই পাইলটেরা জানে, এদেরও আমাদের মত সার্টিফিকেট আছে। এদের বিশেষ ভাবে এই হারবার এলাকার উপর ট্রেনিং দিয়ে পাইলট বানানো হয়। এটা আন্তর্জাতিক আইন।

কথা বলতে বলতে মুকিত ভাই জাহাজের স্পিড কমিয়ে এক সময় থামিয়ে দিল আর ওই পাইলট লঞ্চ এসে জাহাজের পাশে আগে থেকে নামানো সিঁড়ির কাছে ভিড়ল আর সিঁড়ি বেয়ে পাইলট উঠে এলো। পাইলটকে নামিয়ে দিয়ে লঞ্চ চলে গেল। জাহাজের স্পিড বাড়িয়ে দিল। পাইলট উপরে ব্রিজে উঠে এসে মুকিত ভাইর সাথে একটু কথা বলে যে স্টিয়ারিং করছিল তাকে কি সব অর্ডার দিচ্ছে আর সে সেই ভাবে স্টিয়ারিং করে করে এক সময় জাহাজ লন্ডন পোর্ট ইমিগ্রেশন অফিসের জেটিতে ভিড়িয়ে দিল। মুকিত ভাইকেও ইঞ্জিনের গতি সম্পর্কে বলছিল। জাহাজের সামনে পিছনে কোন রশি কখন বাধতে হবে পাইলট তাও বলে দিচ্ছিল। জাহাজ ভিড়ার পর কিছু কাগজ পত্রে ক্যাপ্টেনের সই নিয়ে পাইলট নেমে গেল। একটু পরে জেটির পাশে একটা পিক আপ এসে থামল।
ওটা দেখে জয়নুল বলল স্যার ওই তো ওরা এসে গেছে,
ইমিগ্রেশন অফিসার ও তার সহকারী এবং কাস্টম অফিসার জাহাজে উঠে এলো। মুকিত ভাই এবং পাইলট নিচে নেমে গেল। পাইলট এখান থেকে চলে গেল আর মুকিত ভাই অফিসারদের নিয়ে ক্যাপ্টেনের অফিসে ঢুকল। ওখানে জাহাজের সবার সিডিসি, ক্রু লিস্ট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখে দেখে সই স্বাক্ষর দিয়ে চলে গেল। এবার এখান থেকে বের হয়ে ইংলিশ চ্যানেল, বে অফ ভিস্কি এবং জিব্রালটার প্রণালী হয়ে ভূমধ্য সাগর দিয়ে সুয়েজ খাল পাড় হয়ে আরব সাগর পাড়ি দিয়ে মিডল ইস্টে যেতে হবে। শুনে নিশাত খুব খুশি। একসাথে এত গুলা দেশ দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে! এতদিন যে সব দেশের নাম শুধু ভূগোল বইতে পড়েছে আজ সেগুলি নিজ চোখে দেখতে পাবে! কি আনন্দ!

জাহাজ চলছে। মুকিত ভাই একটু পরে বলল যাও তুমি রেস্ট নাও রাতে তোমার ডিউটি আছে। নিশাত এসে বিছানায় শুয়ে পরল কিন্তু বইতে পড়া এবং গল্পে শোনা ইংলিশ চ্যানেলের বুকে তার জাহাজ সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে এই আনন্দে নিশাতের ঘুম আসছে না সে উঠে কেবিনের জানালা দিয়ে বাইরে খোলা সাগরের দিকে তাকিয়ে রইল কিন্তু দেশ ছেড়ে আসার পর গত কয়েকদিনের উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা এবং ক্লান্তির জন্য কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাড়াতাড়ি ধরমর করে উঠে আশে পাশে সবকিছু নতুন এবং অচেনা দেখে বোঝার চেষ্টা করল আমি কোথায়? আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল। আমি এখন জাহাজে। যে জাহাজে চাকরী করার জন্য দেশ ছেড়ে মা বাবা ভাই বোন ছেড়ে এত দূরে এসেছি গত কয়েকদিন ভরে। বিছানা ছেড়ে উঠে কেবিনের সিংকে মুখ ধুয়ে ব্রিজে চলে এলো। আরে নিশাত এসো এসো। এখনি এসে পড়েছ?
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
তাহলে আর আসার কি দরকার ছিল যাও তুমি রাতের খাবার খেয়ে ইউনিফর্ম পরে রেডি হয়ে এসো।
নিশাত ব্রিজ থেকে সরাসরি গ্যালিতে এসে দেখে এনামুল বসে আছে।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৭

দুপুরে খাবার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে, বিশ্রাম আর কি হল রুমে বসে টিভি দেখার পর নিশাত বলল চলেন বাইরে থেকে ঘুরে আসি। আমার একটা ক্যামেরা কেনার শখ অনেক দিনের দেখি যদি পাই নিয়ে আসব।
চলেন ঘরে বসে থেকে কি করবো তার চেয়ে ঘুরে আসি, আমরাও কখনো এই দেশে আসিনি।

আপনারা এর আগে কোথায় কোথায় গেছেন?
আমি বেশি গেছি ইস্টে, অনেক জায়গায় গেছি, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং।
ওদিকে কেমন দেখেছেন?
ওদিকে এরকম শীত নেই, গাছপালা আছে, সবুজ আছে, বিদেশে সব জায়গাই ভালো, মানে আমাদের দেশের মত এত চোর বাটপার পকেট মার নেই তবে দেখতে আমাদের দেশ সুন্দর যদি এই সব না থাকত তাহলে আমাদের দেশই সবচেয়ে ভাল দেশ হতো।
জাহাজে চাকরী করলে এই একটা সুবিধা তাই না? বিভিন্ন দেশ দেখা যায়। এইযে দেখেন এই আমি এখনও জাহাজি উঠিনি অথচ এর মধ্যে দুইটা দেশ দেখা হয়ে গেল!

৯।
ওরে বাব্বা যা ঠাণ্ডা, একটু চা হলে ভালো হতো।
চলেন দেখি হোটেলে যাই ওখানে চা বা কফি পাই কি না।
হ্যাঁ চলেন
তিন জনেই হোটেলে এসে দেখে দুপুরের খাবার খাচ্ছে কেউ কেউ।
তা হলে আমরাও খেয়ে যাই?
হ্যাঁ তা খারাপ হয় না আমি তখন তেমন খেতে পারিনি
ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করল এখানে কি মেনু আছে?
ওয়েটার মেনু এনে দিল।
মেনুতে দেখে সব ইংলিশ খাবার।
তাহলে আমাদের খাবার কি হবে?
নিশাত ভাই এক কাজ করেন ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করেন এশিয়ান খাবার আছে কি না!
আচ্ছা!
নিশাত ওয়েটারকে ডেকে বলল, তখন ওয়েটার বলল
দুঃখিত তেমন কিছু এখানে নেই তবে তোমরা ফিস অথবা চিকেন এন্ড চিপস বা রাইস খেতে পারবে
ওদের সাথে একটু আলাপ করে নিয়ে বলে দিল এখন ফিস এন্ড চিপস দাও রাতে চিকেন এন্ড রাইস খাব
হ্যাঁ আমিও
আমিও
আচ্ছা তা হলে সবার জন্য একই আইটেম
ওয়েটার চলে গেল। একটু পড়ে খাবার নিয়ে আসল তিনটা ডিশ ভরে, বিশাল এক টুকরা ভাজা মাছ, বেশ অনেক গুলো ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, অনেক সালাদ।
খেয়ে বেশ ভালই পেট ভরল। তবে নিশাত ভাবল এই শুরু হলো বিদেশের খাবার। এখন আর ইচ্ছে করলেই মায়ের রান্না খাবার পাওয়া যাবে না কিংবা মাকে জ্বালাতনের জন্য বলাও যাবে না যে এটা খাব না ওটা খাব না। এখানে যা পাওয়া যাবে তাই খেতে হবে।
খেয়ে দেয়ে ম্যানেজারের সাথে আলাপ করল কোথা থেকে কি কিনতে হবে। ম্যানেজার বলে দিল এখান থেকে পপলার টিউব স্টেশনে গিয়ে একটা করে রিটার্ন টিকেট নিয়ে হোয়াইট চ্যাপেল চলে যাও ওখানে যেয়ে ব্রিকলেন বা হোয়াইট চ্যেপেল থেকে তোমার যা খুশি কিনে আন।

ওরা হাঁটছে আর কথা বলছে। জিজ্ঞেস করে করে পপলার টিউব স্টেশনে এসে ম্যানেজারের কথা মত তিনটা অল্ডগেট ইস্ট রিটার্ন টিকেট নিয়ে সেন্ট্রাল লাইনের ট্রেনে উঠে পরল। অল্ডগেট ইস্ট নেমে টিউব থেকে বের হয়ে আবার জিজ্ঞেস করে করে ব্রিকলেনে চলে এলো। কথায় কথায় মার্কেটের নাম দেখার সুযোগ পায়নি। প্রায় সব দোকান সুন্দর ছিম ছাম সাজানো গুছানো। লন্ডন শহরের দোকান পাট! এগুলি কি আর আমাদের ঢাকা শহরের দোকানের সাথে তুলনা করা চলে? কিছু কিছু রাস্তার নাম বাংলায় লেখা, ব্রিকলেন এমনি আরও কিছু। রাস্তায়ও প্রচুর এশিয়ান এবং বাঙালি বলেই মনে হলো যদিও কারো সাথে কথা বলেনি এমনিই চেহারা দেখে যা মনে হয়েছে। দোকান পাট সব বাইরে থেকে দেখছে। বিচিত্র সব মানুষ গিজ গিজ করছে। বিভিন্ন রকমের পোশাক, বিভিন্ন চেহারা। ইংরেজ দেশ বলে যে সবাই ইংরেজ তা নয় অনেক বিদেশী দেখে একটু বিস্মিত হলো। এটা একটা আন্তর্জাতিক শহর বলে নানান জাতের নানান রঙের মানুষ থাকবেই। সবাই পায়ে হেঁটে এসেছে। মার্কেট এলাকায় কোন গাড়ি নেই, সম্ভবত গাড়ি পার্কিং এলাকায় রেখে এসেছে নয়ত টিউবে এসেছে।

নিশাতরা বাইরে থেকে কাচের দেয়াল দিয়ে দেখল একটা দোকানে কিছু ঘড়ি ক্যামেরা সাজানো রয়েছে এই দোকানে ঢুকে পরল। বিভিন্ন ডিজাইনের বিভিন্ন সাইজের সেলফে নানা রকম জিনিস সাজিয়ে রেখেছে। প্রতিটা জিনিসের সাথে কাগজের একটা কার্ডের মত আছে যাতে ওই জিনিসের বিবরণের সাথে দাম লেখা রয়েছে। যেখানে ক্যামেরা রয়েছে ওখানে গেল, ইয়াশিকা, অলিম্পাস, ক্যানন, পেনটেক্স নানা কোম্পানির তৈরি নানা মডেলের ক্যামেরা। এর মধ্যে একটা ইয়াশিকা ক্যামেরা দেখল তাতে যে দাম লেখা রয়েছে তাতে আজ সকালে স্টেনলি যে টাকা দিয়েছে তার চার ভাগের এক ভাগেই হয়ে যায়। ছোট বেলা থেকে একটা ইয়াশিকা ক্যামেরার খুব শখ। মেঝ মামাকে দেখেছে ইয়াশিকা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে। ভাবনায় পরে গেল এতো টাকা দিয়েছে! কিনব না কি? থাক দেখি আগে জাহাজে যাই আরও কিছু দিন যাক পরে কেনার অনেক সুযোগ পাওয়া যাবে, কোথায় কত টাকা লাগে না লাগে তা না জেনে খরচ করা উচিত হবে না। হঠাৎ কোন প্রয়োজন হলে কে তাকে টাকা দিবে? এখানে তাকে কে চিনে? কার কাছেই বা হাত পাতবে নানা রকম সাত পাঁচ ভেবে কেনার ইচ্ছা বাদ দিল। দেখতে এসেছি দেখি কালই তো আর চলে যাচ্ছি না। দেখতে দেখতে এক জায়গায় দেখে নানা ধরনের অলংকার সুন্দর করে থরে থরে সাজানো রয়েছে নানা আঙ্গিকে নানা ধরনের। দেশে অলংকারের দোকান দেখেছে কিন্তু সে তো এর কাছে কিছুই নয়। এখানে হিরা বসানো, সাদা এবং গোলাপি মুক্তা বসানো কত রকমের ডিজাইনের। আবার একটা দেখল সাদা স্বর্ণ, এটা আবার কি? স্বর্ণ কি সাদা হয় নাকি? আগে তো কখন দেখিনি! এর দাম হলুদ স্বর্ণের চেয়ে অনেক বেশী। প্রতিটির সাথেই স্বর্ণের পরিমাণ, কি পাথর বা কত ক্যারেটের হিরা আছে দাম কত সব লেখা। নিরুর কথা মনে হলো। নিরু কি আমার হবে? আমি কি নিরুর জন্য এসব কিনতে পারব? আমার যদি এগুলি কেনার মত অত টাকা হয় তা হলে সব কিনে এক দিন নিরুকে অবাক করে দিবো, একটা একটা করে পড়িয়ে মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখব। এগুলি পড়লে ওকে কেমন দেখাবে? হঠাৎ করে এক বিদেশীর সাথে ধাক্কা লেগে নিশাতের নিরু স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল, সরি বলে সরে এলো।

কোথায় কেন যেন এসেছে, ও হ্যাঁ এই তো দোকানে। এর পরে গেল ঘড়ির কাছে। ওরে বাব্বা এতো দাম! অবাক হয়ে গেল, এই দাম দিয়ে কারা কিনে এগুলি? তার হাতে আগে কখন ঘড়ি ছিল না যে ঘড়ি রয়েছে সেটা মামা যে টাকা দিয়েছিল সে টাকা দিয়ে চিটাগাং থেকে একশ বিশ টাকায় কিনেছে। কত রঙ বেরঙ্গের ঘড়ি, কোনটা স্বর্ণের সংখ্যা, স্বর্ণের ডায়াল, স্বর্ণের চেইন স্টেনলি যা দিয়েছে তাতে কুলায় না এমন সব দাম আবার ওই টাকা দিয়ে বিশটাও কেনা যায় এমনও আছে। হবেই তো এদের পকেটে আর ব্যাঙ্কে কত টাকা। না বাবা আমার হাতে যা আছে এই যথেষ্ট শুধু সময় দেখা এই তো, আর কি হবে? আমাকে যে নিরুকে পেতেই হবে ওর জন্য আমার অনেক টাকার দরকার হবে। বাড়িতে মা বাবা, ভাই বোন এরা তো আমার পাঠান টাকার পথ চেয়ে রয়েছে। নিরুকে আনতে হলে অনেক টাকা জমাতে হবে, অনেক ত্যাগ করতে হবে, অনেক সহ্য করতে হবে। কাজেই এসব দেখে মন বিভ্রান্ত করা যাবে না। কিছু না বলে চলে যাওয়া নিরুর মুখ কিছুতেই ভুলতে পারছে না। নোমানের কথার খেই ধরে নিরু শুধু মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া একটা কথাও বলেনি। পরে এখানে আসার আগে বীণা আপার বাড়িতে শুধু অপেক্ষা করবে বলে বলেছে, কিন্তু এর মধ্যে নিশাত যাবার আগে যদি কিছু হয়ে যায়? তাহলে? অন্য কিছু মানে নিরুর বাবা যদি অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেয়! তাহলে কি নিরু পারবে তাকে সত্য কথাটা বলতে? না না এ হতে পারে না। নিরু ঢাকা লালমাটিয়া কলেজে যখন ভর্তি হয়েছে তাহলে আর সহসা বিয়ের পরিকল্পনা মাথায় নেই বলেই মনে হয়। তবুও মনে একটা কিন্তু জেগেই রইল। ভুল করেছে মস্ত ভুল! অন্তত বীণা আপাকে কিছু ইঙ্গিত দিয়ে এলে পারত। এখানেও কিন্তু! কি ইঙ্গিত দিত? কি বলত? ওর এখন কি সঙ্গতি আছে?
চলেন এনাম ভাই, সালেক ভাই চলেন দেখার কোন শেষ নেই, এর চেয়ে বাইরে দেখি। কেনাকাটা যা করার পরে করব!
চলেন, তাই ভাল
চলেন, সিঙ্গাপুরে দেখেছি এখানের চেয়ে অনেক কম দাম
তাই নাকি?
হ্যাঁ, সিঙ্গাপুর ডিউটি ফ্রি দেশ। কেনাকাটা করলে ওখান থেকেই করবেন কিংবা দুবাই থেকেও করতে পারেন এই দুই দেশে কোন ডিউটি নেই একেবারে ট্যাক্স ফ্রি দেশ
ও আচ্ছা, বুঝেছি মানে ওখানে কোন কাস্টম ডিউটি নেই, তাই না?
হ্যাঁ, নিশাত ভাই কিছু খাবেন?
কি খাব, চলেন একটা করে কোক নেই, সবাই হাঁটছে প্রায় সবার হাতেই দেখছি কিসের ক্যান একটা। আমরা আর বাদ থাকি কেন, চলেন ওইতো ওই দোকান ওই যে সামনে বাম দিকে।
কোক কিনে সবাই হাঁটছে আর একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছে। হঠাৎ সালেক বলল
দেখছেন ওই যে সিনেমা হল!

হ্যাঁ তাই তো, হিন্দি সিনেমা চলছে মনে হয়, চলেন তো দেখি, যদি হিন্দি সিনেমা হয় তা হলে দেখবেন?
হ্যাঁ দেখব না মানে, জানেন সিঙ্গাপুরে শোর পাস পেলেই হিন্দি সিনেমা দেখতাম, চলেন।
চলেন, আমি উর্দু হিন্দি সব জানি, আমার কোন অসুবিধা নেই!
একটু এগিয়ে হলের সামনে দেখে হেমা মালিনি আর ধর্মেন্দ্রের ছবি চলছে। টিকেটের দাম খুবই কম, মাত্র এক পাউন্ড। ওরা তিন জনে তিনটা টিকেট নিয়ে দেখে আরও কিছুক্ষণ পরে শো শুরু হবে। এই ফাঁকে বাইরে বের হয়ে আর কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখল। সময় মত ফিরে এসে হলের ভিতর যেয়ে বসল। একে বারে আমাদের দেশের মত ব্যবস্থা। নিশাত কখনো ভারতের হিন্দি সিনেমা দেখেনি। করাচীতে থাকা সময়ে উর্দু সিনেমা দেখেছে। রাত নয়টায় সিনেমা শেষ হলে হল থেকে বের হয়ে আবার টিউবে করে পপলার এসে বাকি পথে হেটে হোটেলে ফিরে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরল। বাইরে ভীষণ ঠান্ডা!
পরদিন আবার সারা দিন হেঁটে যত দূর যেতে পারে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে নিলো।

১০।
পরদিন সকালে সাড়ে আটটার দিকে রুম সার্ভিস ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল, হ্যাঁ গুড মর্নিং।
ওপাশ থেকে স্টেনলির কণ্ঠে গুড মর্নিং ভেসে এলো। নিশাত, কি খবর তোমাদের, কেমন আছ?
হ্যাঁ ভালো আছি সেদিন সিনেমা দেখলাম এদিক ওদিক বেড়ালাম ভালোই কাটছে।
বেশ ভালো করেছ, জায়গা চিনে নিয়েছ। আচ্ছা শোন তোমাদের জাহাজ চলে এসেছে আজ দুপুর দুইটায় তোমরা রেডি হয়ে থেক এন্ড্রু গিয়ে তোমাদের জাহাজে পৌঁছে দিয়ে আসবে, মনে থাকবে?
হ্যাঁ মনে থাকবে না কেন?
তা হলে এখন রাখি, সময় মত রেডি হয়ে থেক।
ঠিক কাটায় কাটায় দুপুর আড়াইটায় সে দিনের সেই ড্রাইভার এসে হোটেলের গেটে গাড়ি রেখে ভিতরে ওদের দেখে বলল,
ও, তোমরা রেডি হয়ে বসে আছ, বেশ! চল গাড়িতে ওঠ।
সবাই যার যার ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠার পর গাড়ি ছেড়ে দিল। টেমস নদীর পাড় ঘেঁসে যে রাস্তা গেছে ওই রাস্তায় মিনিট পাঁচেকের মধ্যে জেটির পাড়ে একটা ছোট অফিসের মত ঘরের পাশে গাড়ি রেখে ওদের সিডিসি গুলি চেয়ে নিয়ে বলল আমার সাথে মালামাল নিয়ে আস।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৬

এর পর দুপুরে দোতলা থেকে একটার মধ্যে লাঞ্চ করে উপরে রুমে গিয়ে একটু বিশ্রাম করে নিল রাতে লন্ডনের ফ্লাইট প্রায় আট ঘণ্টার জার্নি। শেষ বিকেলে সবাই ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হয়ে নিচে নেমে রিসিপশনের কাজ সেরে যার যার সিডিসি নিয়ে বসে রইল। ঠিক সাতটায় সেই ড্রাইভার এসে হাজির।
ও, তোমরা রেডি?
হ্যাঁ চল, আমরা রেডি হয়েই আছি।
চল।
গাড়িতে উঠে বসার পর গাড়ি ছেড়ে দিল। সে রাতের মত আজ এত স্পিডে চালাচ্ছে না তবুও কম না, ৮০ মাইলের কাছা কাছি।
দুবাই এয়ারপোর্টে নামিয়ে গালফ এয়ারের চেক ইন ডেস্কের সামনে পৌঁছে দিয়ে ড্রাইভার গুড বাই বলে চলে গেল। একটু পরে প্লেনে উঠে সিট নম্বর দেখে বসে সিট বেল্ট বেধে নিল। লন্ডনে হিথ্রো এয়ারপোর্টে নামবে লন্ডনের সময় রাত নয়টায়। ওখানে নেমে আবার কি হয় কে জানে এ পর্যন্ত ভালোই কেটেছে, হাবিব কোথায় কি ভাবে কোন জাহাজে উঠল কিছু জানতে পারলাম না, কবে জানব কে জানে। ভাবতে ভাবতে বিমান বালার কণ্ঠ শোনা গেল বাহরাইন মোহাররেক বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার বার্তা জানিয়ে দিল। একটু পরে ছোট বোইং 727 প্লেন মটরিং করে বেরিয়ে এসে রান ওয়ে দিয়ে এক দৌড়ে আকাশে উঠে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে এরাবিয়ান গালফের উপর দিয়ে বাহরাইনের পথে এগিয়ে চলল। নিচে নীল সাগরের উপর দিয়ে আরবদের প্রিয় বাজ পাখির ছবি আঁকা গালফ এয়ারের প্লেন উড়ে চলছে। একটু পরে হালকা পানীয় নিয়ে এলো। এর পরে বাহরাইন থেকে টেক অফ করার পর পরিবেশন করবে রাতের খাবার। আধা ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে বাহরাইন বিমান বন্দরে প্লেন নামার পর ওরা বের হয়ে টার্মিনাল ভবনে চলে এলো। এখানে ট্রান্সফার ডেস্কে জিজ্ঞেস করে লন্ডনের প্লেন যে গেট থেকে ফ্লাই করবে তা জেনে নিয়ে ১২ নম্বর গেটে গিয়ে দেখে লোকজন প্লেনে উঠছে। লম্বা কিউ এর পিছনে দাড়াল। এক সময় প্লেনে উঠে বসার পনের বিশ মিনিট পড়েই প্লেন টেক অফ করল। প্লেন আকাশে উঠে যবার পর হালকা পানীয় সার্ভ করল। নিশাত এর আগে কখনও এত লম্বা প্লেন জার্নি করেনি। দুবাই থেকে বাহরাইন হয়ে সরাসরি লন্ডন।

যথা সময়ে লন্ডন হিথরো এয়ারপোর্টে নেমে দেখে মহা যজ্ঞ। কোথায় থেকে কোথায় যাবে কিছুই বোঝা যেত না যদি এখানে কঠিন শৃঙ্খলা না থাকত। এরো দেয়া আছে তাই দেখে দেখে ইমিগ্রেশন ডেস্কে চলে এসেছে এখানেও সেই চিঠি দেখাল আর অমনি সিডিসিতে হিথ্রো এরাইভ্যাল সিল লাগিয়ে ফেরত দিয়ে দিল। এর পর কাস্টম হয়ে বাইরে এসে দেখে নিশাত জামান এন্ড গ্রুপ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে এক মহিলা দাঁড়ান।
ওদের এশিয়ান চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করল নিশাত?
ইয়েস
ওকে, প্লিজ ফলো মি।
বলেই তর তর করে এগিয়ে গিয়ে বাইরে রাখা বিশাল গাড়ির কাছে এসে বলল ওঠ। এয়ারপোর্টের দরজা দিয়ে বের হয়ে ঠাণ্ডার একটা তীব্র ঝাঁকুনি লাগল কিন্তু গাড়িতে উঠে বুঝল হিটার চলছে। কোন কথা বলছে না কেউ। চুপ করে বসে রইল। নিশাতের বিশ্বাস হচ্ছে না সে এখন লন্ডন শহরে গাড়িতে করে ছুটে চলছে কোন এক অচেনা হোটেলের দিকে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে নিয়ে এলো পপলারের পাশে হেইচএসবিসি ব্যাঙ্কের হেড কোয়ার্টারের কাছে এক হোটেলে। লন্ডন শহরে মরিসন হোটেলে। এই হোটেল দুবাইর হোটেলের মত কোন নামী হোটেল না মনে হলো। খুবই সাধারণ একটা বাড়ির মত মনে হলো। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে সামনের রিসিপশন কাউন্টারে বসে থাকা ম্যানেজারের সাথে ওই মহিলা যার বুকে নেম প্লেটে লেখা দেখেছে ক্যাথরিন যে হিথ্রো থেকে নিয়ে এসেছে, পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল এরা থাকবে। কাল এসে অফিসে নিয়ে যাব। ওদের গুড বাই বলে চলে গেল। ম্যানেজার ওদের সাথে কথা বলছিল, ওদের নিয়ে চারতলায় দুইটা রুম দেখিয়ে দিল একটাতে দুই বেড আর একটাতে এক বেড। নিশাত এক বেড যে রুমে ওই রুমে ওর ব্যাগ রেখে বের হয়ে এলো, ম্যানেজার হোটেলের নিচ তলায় খাবার ঘর দেখিয়ে সময় টময় বলে তার কাউন্টারে চলে গেল।
ওরা নিজেরা একটু গুছিয়ে নিয়ে সবাই নিশাতের ঘরে এসে বসল। কিছুক্ষণ এটা সেটা নিয়ে আলাপ করে নিশাত জানতে চাইল এখানে ওরা কেউ আগে এসেছে কি না। না আমরা আগে আসিনি।

এখানেও দুবাইর মত হোটেল তবে পার্থক্য একটাই আর তা হলো গরম আর শীত। দুবাইতে হোটেলের বাইরে দেখেছে প্রচণ্ড গরম আর এখানে শীত। রাতের খাবার প্লেন থেকেই খাইয়ে দিয়েছে বলে এখানে খাবার ঝামেলা নেই। যার যার রুমে ঢুকে শুয়ে পড়ল। সকালে উঠে দুবাইর মত সবাই নিশাতের রুমে আসল। এখান থেকে এক সাথে নাশতা খেয়ে আসল। দুবাইর মত এখানে ইন্ডিয়ান ডিশ নেই এখানে সব বিলাতি ইংলিশ নাস্তা। দুই তিন রকমের ব্রেড, বাটার, জ্যাম, ডিম, কলা এবং কফি। নাস্তা খেয়ে নিচে রিসিপসন ডেস্কের পাশে হল রুমে বসল ওরা তিনজনে। এখানে দুবাইর মত অত ভিড় নেই লোকজনও তেমন বেশি না। বসে থাকতেই ওদের ফোন এলো। কোম্পানির অফিস থেকে ফোন করেছে। রিসিপসন থেকে ওদের দিকে তাকিয়ে রবার্ট বলল ‘হু ইস নিশাত’?
ইয়েস আই এম নিশাত
প্লিজ টেক ইয়োর কল
হাই নিশাত গুড মর্নিং, আমি তোমার অফিস থেকে স্টেনলি বলছি
গুড মর্নিং স্টেনলি
কেমন আছ, পথে কোন অসুবিধা হয়েছে কি?
ভালো আছি, না কোন অসুবিধা হয়নি তোমাদের লোক জনেরা বেশ ভালো ভাবেই রিসিভ করেছে, দুবাইতেও যেমন এখানেও তেমন
বেশ, তা হলে তোমরা সবাই অফিসে চলে এসো
অফিসে?
হ্যাঁ এইতো হেঁটে আসলে মিনিট পনের লাগবে
কিন্তু আমরা যে কেউ অফিস চিনি না
ওহ সরি, তোমরা তো নতুন এসেছ, আচ্ছা একটু অপেক্ষা কর আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি
আচ্ছা ঠিক আছে,
কথা শুনে বুঝতে পারলো ইংরেজ নয়। ঠিক আছে একটু পরে তো যাচ্ছি তখন দেখা যাবে কে। মেঝ মামার কথা মত সব সময় ড্রেস আপ হয়েই থাকত, তা ছাড়া এটা বিদেশ, এখানে সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। ব্যাপ্টিস্টও বলে দিয়েছিল লন্ডনে যেন কখনও গরম কাপর ছাড়া কোথাও বের হবে না
নিশাত ওদেরকে বলল
চল বাইরে অপেক্ষা করি, অফিসে যেতে হবে গাড়ি পাঠাচ্ছে।
বাইরে বেশ ঠাণ্ডা
চার পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা নীল রঙের গাড়ি এসে হোটেলের গেটে থেমে যে ড্রাইভ করছিল সে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল তুমি কি নিশাত?
হ্যাঁ
আমি অফিস থেকে তোমাদের নিতে এসেছি
ও আচ্ছা, বলে গাড়িতে উঠে পরল।

তিন চার মিনিটের মধ্যে এক বিশাল অফিস বিল্ডিঙের গেট দিয়ে ঢুকে পরল। গেটের বাইরে পুরনো একটা বিরাট নোঙ্গর দাড় করা রয়েছে, গেটের ভিতরে ঢুকে বাম পাশে একটা গার্ডেন ক্লকে সকাল সাড়ে আটটা বাজছে, আসে পাশে অনেক ছোট ছোট গাছ দেখ বুঝে নিল এগুলি ফুল গাছ শীতের জন্য ন্যাড়া হয়ে গেছে হয়ত গরম কালে ফুল ফুটবে। নানা রঙের রকমারি পাথরে সাজানো, সামনের দেয়ালে অফিসের নাম লেখা ‘গ্রে ম্যাকেঞ্জি ম্যারিন সার্ভিসেস ই সি, লন্ডন’। এতো বড় আর এত সুন্দর অফিস দেখে নিশাত অবাক হয়ে গেল, এই এত বড় কোম্পানিতে কাজ করতে এসেছি! গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার নেমে গেল। ওরাও ওর পিছনে নেমে এলো। অটোমেটিক দরজা একা একা খুলে গেল, নিশাত বিসমিল্লা বলে দরজার ভিতরে পা বাড়াল। ড্রাইভার হাতের ইশারায় বাম দিকে যেতে বলে বেরিয়ে গেল। বাম দিকে একটু এগিয়ে যেতেই একটা রুম থেকে এক ভারতীয় চেহারার অল্প বয়েসি এক লোককে বের হতে দেখল কিন্তু ওরা চিনতে পারেনি যে এই স্টেনলি। লোকটা ওদের দেখে বলল
তোমরা এসে পরেছ, বেশ, আমিই স্টেনলি। এসো আমার সাথে
বলে ওদের ক্রু সুপার রামস বটমের রুমে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল। এ আবার ইংরেজ। ওদের বসতে বলল। কেমন লাগছে, কোন অসুবিধা হয়েছে কি না, এর আগে কখনো বিদেশে এসেছে কি না সব জেনে নিলো। নিশাত জানাল
আমি এই প্রথম বিদেশে এসেছি তবে এরা দুই জন আগে জাহাজে কাজ করেছে। এবার রামস বটম ওদের সিডিসি দেখতে চাইল।
সিডিসি দেখে বলল হ্যাঁ তোমার সিডিসি দেখছি একে বারে নতুন। বেশ, আশা করি আমাদের কোম্পানিতে কাজ করতে তোমার ভালোই লাগবে, আচ্ছা স্টেনলি তুমি ওদের কিছু টাকা এডভান্স দিয়ে দাও আর ওদের জাহাজ কবে আসবে সব কিছু বুঝিয়ে দাও।
আচ্ছা,
বলে ওদের নিয়ে আসার আগে রামস বটম উঠে ওদের সাথে হ্যান্ডশেক করে আবার বলল
নতুন এসেছ, কাজেই সাবধানে থাকবে, আর কোন অসুবিধা হলে সঙ্গে সঙ্গে তোমার জাহাজের ক্যাপ্টেনকে জানাবে।

ধন্যবাদ জানিয়ে ওরা স্টেনলির সাথে বের হয়ে স্টেনলির রুমে বসল। স্টেনলি কিছু কাগজ পত্র রেডি করে ওদের সই নিয়ে সবার হাতে কিছু স্টার্লিং পাউন্ড দিয়ে বুঝিয়ে দিল এই এক পাউন্ড সমান এত ডলার এবং তোমাদের বাংলাদেশের টাকায় এত টাকা। নতুন বিদেশে এসেছ ইচ্ছা মত খরচ করবে না। এদেশে কিন্তু টাকা খরচ করার অনেক পথ আছে কাজেই বুঝে শুনে খরচ করবে। নেহায়েত যা একান্ত দরকার তাই কিনবে আর বাকি টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিবে। এক জন বিদেশির মুখে এ কথা শুনে নিশাত অবাক হয়ে গেল।
সত্যিই এই টাকার জন্যই দেশ, বাবা মা, ভাই বোন ছেড়ে এতো দূরে আসা। এতো ত্যাগের টাকা কি আর যেমনে সেমনে খরচ করলে চলবে? এদিকে আবার জীবনের প্রথম বেতন স্টার্লিং পাউন্ডে পেয়ে মনে একটা আনন্দও পেল। স্টেনলির প্রতি মন কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। রামস বটমই বা কম কি সেও বলেছে সাবধানে থাকবে, কোন অসুবিধা হলে ক্যাপ্টেনকে জানাবে। বিদেশের মানুষ এত ভালো হয়? কাজে জয়েন করার আগেই টাকা! ভাবতেও কেমন অবাক লাগছে। আমাদের দেশে পুরো মাস না গেলে টাকার চিন্তাই করা যায় না। নিশাত মনে করল একবার বাড়ির কাছাকাছি এক ছেলেকে প্রাইভেট পড়িয়েছিল মাস দুয়েক কিন্তু তিনমাস পর সেই টাকা দিয়েছিল। এদের কি দিয়ে বানিয়েছে নিশাতের মাথায় কিছু আসছে না। এদের সভ্যতা কেমন?

স্টেনলি আবার শুরু করল এবারে তোমাদের কাজের কথায় আসি,
তোমাদের জাহাজ এখনো আসেনি, হয়ত আরও ২/১ দিন লেগে যাবে। ওরা ডান্ডি থেকে সেইল করবে, যাই হোক যেদিন আসবে আমি তার আগে তোমাকে ফোন করে জানাব। এ কয় দিন তোমরা ঘোরা ঘুরি করতে পার তবে বেশি দূরে কোথাও যাবে না। ওরা পুরনো মানুষ ওরা জানে ওদের কি কাজ, তুমি কি জান? তুমি চিটাগাঙে যে এপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়েছিলে ওতে বা যে আর্টিক্যালে সই করে এসেছ তাতে দেখেছ?
হ্যাঁ দেখেছি, আর ওখানে বুড়ো ব্যাপ্টিস্ট বলে দিয়েছে।
ও কে, মাই ফ্রেন্ডস তোমরা এখন যেতে পার, বাই, এখন মনে হয় একা যেতে পারবে তাই না?
হ্যাঁ পারব। কিন্তু,
কি কিন্তু কি?
আচ্ছা আমাদের সাথে যে হাবিব এসেছে যাকে দুবাইতে জাহাজে নিয়ে গেছে ও কোন জাহাজে আছে বলতে পারবে?
হ্যাঁ বস দেখি,
কম্পিউটারে খুঁজে বলল ও আছে ফরিদা নামের জাহাজে।
ওর সাথে যোগাযোগ করার কোন ব্যবস্থা আছে?
হ্যাঁ তুমি চিঠি লিখতে পার কিংবা কখনও কাছাকাছি পোর্টে এলে তখন ভিএইচএফ দিয়ে কথা বলতে পারবে
চিঠি লিখলে খামে ভরে ঠিকানা লিখে জাহাজের মেইল ব্যাগে করে এজেন্টের কাছে দিয়ে দিবে ওরাই ডাকটিকেট লাগিয়ে পোস্ট করে দিবে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, অবশ্যই
যাক নিশ্চিন্ত হলাম,
কেন ও কি হয় তোমার?
না এমনি কিছু হয় না তবে আমরা এক সাথে কলেজে পড়েছি আমার বন্ধু, আমাদের বাড়ির কাছেই ওদের বাড়ি।
গুড, তাহলে তোমাদের ভালোই হয়েছে, দুই বন্ধু কাছাকাছি থাকতে পারবে।
হ্যাঁ তাই। তাহলে আমরা উঠি এখন।
বাই বলে হ্যান্ডশেক করে বের হয়ে এলো।
রুমের বাইরে এসে আবার এদিক ওদিকে দেখল কি সুন্দর পরিষ্কার আর সাজানো অফিস, এতো মানুষ কাজ করছে অথচ নীরব, কোন সারা শব্দ নেই, কোথাও একটু খানি কাগজের টুকরো পড়ে নেই সারাটা ফ্লোর চকচক করছে।
গেট থেকে বের হয়ে গাড়ি যেদিক দিয়ে যেভাবে এসেছিল সে পথ ধরে হেঁটে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে এসে ঠিক মরিসন হোটেলে পৌঁছল। হোটেলে পৌঁছে নিজের মনে বেশ একটু আনন্দ পেল। যে পথে কোন দিন আসিনি, সব নতুন রাস্তা ঘাট, নতুন শহর নিজের দেশ থেকে অনেক দূরে ভিন্ন মহাদেশে একা একাই আসতে পারলাম। যে পথে কোন দিন এই পায়ের ছাপ পরেনি সে পথ চিনে এসেছি।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৫

৮।
বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট নির্দিষ্ট সময়ে দুবাই এয়ার পোর্টে ল্যান্ড করল। নিশাত এবং সঙ্গীরা নেমে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে ইমিগ্রেশন ডেস্কে এসে নিশাত সবার সিডিসি সংগ্রহ করে সবার সামনে কিউতে দাঁড়াল। এক সময় অফিসারের
ডেস্কের উপর চারটা সিডিসি নামিয়ে দিয়ে পিছনে সবাইকে দেখিয়ে দিল। ইমিগ্রেশন অফিসার সিডিসি খুলে এক এক করে সবার চেহারা দেখে দুবাই এরাইভ্যাল সিল লাগিয়ে ওদের ফেরত দিয়ে দিল। সিডিসি নিয়ে নিশাত একটু এগিয়ে এসে এদিক ওদিক দেখল কিন্তু ফিনলে অফিসের বুড়ো ব্যাপ্টিস্টের কথা মত ওদের এগিয়ে নেবার মত কাউকে দেখতে পেল না। মনে মনে ভাবছে সেই লোক আমাদের চিনবে কি ভাবে বা আমরাই বা ওকে চিনবে কি ভাবে! সবাই এসেছে নিশাতের নেতৃত্বে কাজেই ওর মাথা ব্যথা একটু বেশি। হঠাৎ করেই দেখতে পেল সামনেই কালো পোশাক পরা মোটা এক মহিলা নিশাত জামান এন্ড গ্রুপ লেখা একটা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে ওদের দিকে আসছে।
নিশাত এগিয়ে গিয়ে বলল আমি নিশাত জামান আর ওই ওরা আমার সাথের।
বেশ বেশ এসো আমার সাথে।
বলে পিছনে ঘুরে দ্রুত হাটতে লাগল।

এত মোটা মানুষ এত দ্রুত হাঁটছে যে ওরা তার সাথে তাল মিলাতে হিম সিম খাচ্ছে। ৪/৫ মিনিট হেঁটে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে একটু দূরে দাঁড়ান এক লোককে ইশারায় কি যেন বলল। এবার ওদের দিকে ঘুরে বলল তোমাদের মধ্যে হাবিব কে?
এই তো এই হাবিব।
আচ্ছা ঠিক আছে তোমার জাহাজ এখানে আছে আর তোমারা যাবে লন্ডন, তবে এখন না। এখন তোমরা সবাই হোটেলে যাবে ওখান থেকে হাবিব কাল জাহাজে যাবে আর তোমাদের ফ্লাইট কাল রাতে তোমরা কেউ হোটেল থেকে বের হবে না।
মহিলা কথা বলতে বলতেই একটা কাল রঙের বুইক গাড়ি পাশে এসে দাঁড়াল।
নাও গাড়িতে ওঠ।
তুমি যাবে না?
আরে না, আমার এখনো কত কাজ, একটু পরে পাকিস্তান থেকে ফ্লাইটে লোক আসবে ওদের রিসিভ করতে হবে, এই লোক তোমাদের হোটেলে নিয়ে যাবে। গুড নাইট বলে যেমনে এসেছিল অমনিই দৌড়ের মত চলে গেল।

ওরা একে একে গাড়িতে উঠে বসল, মাল পত্র বলতে আর কি, সবার সাথে একটা করে ব্যাগ ছাড়া আর কিছু নেই। বিশ্বের একটা নতুন দরিদ্র দেশের কয়েক জন তরুণ এসেছে নিজেদের ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে। বিলাসিতা করার জন্য তো আর আসেনি। কিই বা থাকবে, দুই একটা সার্ট প্যান্ট, লুঙ্গি, গেঞ্জি, গামছা এই তো আর কি। ড্রাইভার সবাইকে দেখে নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল। জানালার কাচ খোলা ছিল একটু পরেই ওরা দেখল জানালার কাচ একা একাই উঠে বন্ধ হচ্ছে। নিশাত ভাবল সব অটো সিস্টেম। এয়ারপোর্ট এলাকা ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় এসেই আস্তে আস্তে গাড়ীর স্পিড বাড়ছে ৫০, ৬০ থেকে একটু একটু করে ১০০ মাইল বেগে ছুটে চলেছে। নিশাত এর আগে বুইক গাড়ির নাম শুনেছে কিন্তু উঠে দেখার বা গাড়িতে চলার সুযোগ হয়নি। জীবনে এই প্রথম এত স্পিডে চলছে। ভয়ে একটু দম বন্ধ হওয়া ভাব। রাস্তার দুই পাশে সোডিয়াম বাতির আলোতে যতটুকু দেখা যাচ্ছে শুধু ধু ধু বালু আর বালুতে গজানো কিছু ছোট ছোট ঝোপ জাতিয় গাছ। যে গাছের ডাল বা পাতা ভাঙলে সাদা কস বের হয় তেমন কিছু ঝোপ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার মাঝে একটু ফাঁকে ফাঁকে একটা একটা করে লাইট পোস্ট পিছনে চলে যাচ্ছে। সামনে দূরে ডান দিকে লাইন ধরা নানা রঙের বাতির কিছু ঝিলি মিলি দেখা যাচ্ছে। মনে হয় ওটাই শহর এলাকা। গাড়ি উল্কার গতিতে ছুটছে আর ভিতরে বসা কয় জন তরুণ ভাবছে এ কোথায় এলাম, সামনে ভাগ্যে কি আছে, কি হবে, কেমন হবে এই ভাগ্য। সাহস করে কেউ কোন কথা বলছে না চুপ চাপ বসে শুধু ভাবছে। গাড়ি চালাচ্ছে এক আরবি যুবক, তার পরনে সাদা আরবি পোশাক।

প্রায় আধা ঘণ্টা পর লক্ষ করল স্পিড কমিয়ে আনছে। বুঝতে পারলো হয়ত কাছে এসে পরেছি। আর একটু এগিয়ে বাম দিকে একটু ঘুরে একটা বিশাল আলো ঝলমল সুন্দর কারু কাজ করা এক বিশাল দালানের সামনে গেট দিয়ে ঢুকে দেখল বাগানে নানা দেশের পতাকা উড়ছে। নিয়ন সাইনে লেখা দালানের গায়ে নাম দেখে বুঝল এটা একটা হোটেল। হোটেলের পোর্টিকোর নিচে এসে গাড়ি থেমে গেল। ড্রাইভার ইংরেজিতে বলল তোমরা যার যার মালামাল নিয়ে আমার সাথে চল। সবাই যার যার ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে স্বয়ংক্রিয় দরজা পার হয়ে ভিতরে পা দিতেই একটা সুন্দর নরম সুগন্ধ ওদের স্বাগত জানাল। আহ! ভিতরে কি আরাম! একে বারে ঠাণ্ডায় গা জুড়িয়ে যায় যেন, পায়ের নীচে কার্পেটে পা ফেলতেই মনে হলো পায়ে কোন জুতা নেই। আরবি ড্রাইভারের পিছে পিছে সামনের দিকে এগিয়ে রিসিপশন ডেস্কের পাশে দাঁড়াল সবাই। কাউন্টারে ৩/৪ জন লোক কি কি সব করছিল। ড্রাইভার তাদের এক জনকে ডেকে ওদের দেখিয়ে দিয়ে আরবিতে কি বলল। সুন্দর চেহারার এক লোক ওদের পাসপোর্ট চাইল আর একটা বড় ভারী মোটা খাতা এগিয়ে দিয়ে যার যার নাম পাসপোর্ট নম্বর লিখতে বলল। সবার লেখা হলে নিশাত খাতাটা টেনে নিয়ে নিজের নাম ধাম সব লিখে আবার খাতাটা ওই লোকের দিকে ফিরিয়ে দিল। ড্রাইভার এবার ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গুড নাইট জানিয়ে চলে গেল। কাউন্টারের লোকটা ওদের হাতে একটা একটা করে চাবি ধরিয়ে দিয়ে পাশের লিফট দেখিয়ে সাত তলায় উঠে যেতে বলে দিল। সবাই এক সাথে লিফটে উঠে সাত তলার বোতামে চাপ দিয়ে উপরে উঠে এসে চাবিতে লেখা নম্বর মিলিয়ে যার যার রুম খুঁজে নিলো। সব গুলিই প্রায় পাশা পাশি। যার যার রুমে ঢুকে পরল। নিশাত রুমে ঢুকে কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে রুমের চারি পাশে ঘুরে ঘুরে দেখে অবাক হলো। এমন সুন্দর রুমে কি থেকেছে কোন দিন? দেখা শেষ হলে কাপড় বদলে বাথ রুমের কাজ সেরে এসে একে একে সবার রুমে গিয়ে সবাই ঠিক ঠাক মত আছে কিনা দেখে আগামী কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে ওর রুমে আসতে বলে এলো।

হাবিব জিজ্ঞেস করল আমার কি হবে কিছু বুঝেছিস?
কেন ওই মুটকি বলল না কাল সকালে জানাবে, এখন ঘুমিয়ে পর কাল দেখব কি করে। আমি যাই ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
এয়ারকন্ডিশন রুমে ফিরে এসে নরম ধব ধবে বিছানায় শুয়ে কম্বলটা গায়ে দিয়ে শুয়ে পরল।
প্রায় সবারই সকাল হলো নয়টার দিকে। নিশাত কাল হোটেলের রিসিপশন থেকে দেখে হাতের ঘড়ি মিলিয়ে নিয়েছিল। একে একে সবাই এলো। নিজেরা একটু আলাপ করে নিচে নেমে গেল। নাশতা খাবার কি ব্যবস্থা দেখতে হবে আর কোন ম্যাসেজ আছে কি না তাও জানতে হবে। লিফট বেয়ে নিচে নেমে দেখে, রিসিপশনে কাল যারা ছিল এখন তারা নেই, যারা আছে তাদের এক জনকে জিজ্ঞেস করল
নাশতার কি ব্যবস্থা?
এখনো নাশতা করনি?
না আমরা কাল লেট নাইটে এসেছি এই মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম আর তা ছাড়া ব্রেকফাস্ট কোথায় তাও জানি না।
ও আচ্ছা, ওই দিকে দেখ ডাইনিং রুম আছে ওখানে গিয়ে খেয়ে আস।
আচ্ছা আমাদের কোন ম্যাসেজ আছে?
রুম নম্বর প্লিজ
রুম নম্বর বলল
হ্যাঁ তোমাদের হাবিব কে?
এই যে এই হাবিব।
তোমাকে নেয়ার জন্য গাড়ি আসবে সকাল এগার টায় আর তোমাদের বাকি তিন জনের জন্য গাড়ি আসবে সন্ধ্যা সাতটায়। যাও ব্রেকফাস্ট করে এখানে এসো কথা আছে।
নাশতা সেরে ঘণ্টা খানিকের মধ্যে আবার কাউন্টারে এসে দাঁড়াল,
কি বলবে বলেছিলে
ও হ্যাঁ, তোমরা কিন্তু বাইরে যেয়ো না, এখানে লাউঞ্জে বসে টিভি দেখতে পার বা ও পাশে সর্বক্ষণ সিনেমা চলে তাও দেখতে পার কিন্তু বাইরে যাবে না বাইরে গিয়ে হারিয়ে গেলে তোমাদেরও বিপদ আমাদেরও বিপদ।
না না আমরা কেউ বাইরে যাব না, আমরা নতুন এসেছি কিছু চিনি না কোথায় যাব, কাজেই তোমাদের সে ভয় পেতে হবে না।

যা হাবিব তোর ব্যাগ নিয়ে আয় আমরা এখানেই বসি।
ঘড়িতে দেখে সাড়ে দশটা বেজে গেছে, হ্যাঁ আমি আসছি বলে হাবিব উপরে চলে গেল। ওরা নিচেই সুবিধা মত এক জায়গায় বসে পরল। সামনে টিভি চলছে আরবি চ্যানেল, কিচ্ছু বুঝে না। একটু পরেই হাবিব নেমে এলো।
নিশাত আমার ভয় করছে
আরে ধুর! কিসের ভয়? যেখানে যাচ্ছিস ওখানে নিশ্চয় দুই এক জন বাঙ্গালি পাবি, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই যে এখন চলে যাচ্ছিস তোর সিডিসি নিবি না?
আরে হ্যাঁ, আমি তো ভুলেই গেছিলাম, চল
রিসিপশনে যেয়ে হাবিব রুমের চাবিটা দিয়ে বলল আমি এখন চলে যাব, কি করতে হবে?
হ্যাঁ দাড়াও, সেই সুন্দর বাধান বড় খাতাটা বের করে ওর সই নিয়ে একটা ভাউচারের মত কাগজ বের করে দিল সই করার জন্য, কোম্পানির কাছে বিল পাঠাবে বলে এটা রাখা হলো। ওগুলি রেখে সিডিসি ফেরত দিয়ে দিল।
দেখবি এটা সাবধানে রাখবি কিন্তু
হ্যাঁ মনে থাকবে।
কবিতাকে একটা চিঠি লিখে পাঠাবি
যাঃ কি যে বলিস
আরও কিছু টুকরা আলাপ হলো, একটু পরেই দেখে গেট দিয়ে সেই কালকের ড্রাইভার আসছে।
ওই যে হাবিব তোর সমন এসে গেছে
হাবিব ঘুরে দেখে উঠে দাঁড়াল। ড্রাইভার সাথে যাবার ইশারা করে বেরিয়ে গেল। হাবিবের সাথে সবাই বের হয়ে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল। গাড়ি ছেড়ে যাবার আগে জানালায় মুখ রেখে নিশাত আবার বলে দিল ভয় বা চিন্তা কিছু করবি না। দেখলি তো কি ভাবে সব হচ্ছে।
হাবিবকে নিয়ে গাড়ি হোটেলের সীমানা থেকে বের হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ওরা গেটে পোর্টিকোর নিচে রইল। মেইন গেট থেকে বের হয়ে গেলে আবার এসে যেখানে বসে ছিল সেখানে বসে টিভি দেখছে। বিরক্তিকর চ্যানেল। ভালো লাগছে না,
চলেন ভাই একটু হাটা হাটি করি আর নয়ত দেখি ওখানে কি সিনেমা চলছে।
চলেন।

কিছু করার নেই। কোন কাজ নেই। নিশাত ও পাশে সিনেমার সামনে বসে ভাবছে আর চারিদিকে দেখছে। এই যে এত বড় ফাইভ স্টার হোটেলে কি আর নিজের টাকায় থাকতে পারতাম কোন দিন? কত রকমের মানুষ আসছে যাচ্ছে। কেউ সুদৃশ্য বিশাল লাউঞ্জে বসে টিভি দেখছে নয়তো বই পড়ছে, কেউ রিসিপশনের কাউন্টারে হেলান দিয়ে সঙ্গীর সাথে কথা বলছে। তার পরেও সবার মধ্যে একটা চাপা ব্যস্ততা। বিভিন্ন ভাষায় কথা বলছে, বিভিন্ন জাতীর লোক জন। বিচিত্র গুঞ্জন তার মধ্যে আবার অদৃশ্য স্পীকারে মৃদু স্বরে মিউজিক বাজছে যেন একটা ভিন্ন জগতে এসে পরেছে। তার চির চেনা জগত এটা নয়। রাতারাতি এক ভিন্ন গ্রহে চলে এসেছে। মানিয়ে নিতে হবে এই পরিবেশ। নিজের পয়সায় এই হোটেলের গেটের ভিতরেই ঢুকতে পারত না। সে সাধারণ একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান বাবা সাধারণ এক জন সরকারী কর্মচারী। কোম্পানির জোড়ে আজ এই ভিন্ন গ্রহে বসে ভাবতে পারছে। একটু আগে যে নাশতা করে এসেছে তা কি কখনো খেয়েছে? দেশে ঢাকায় এমন সোনার গাও হোটেল, ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেল রাস্তা দিয়ে যেতে আসতেই শুধু দেখেছে, কখনো ভিতরে ঢুকতে পারেনি। তবুও মনে হচ্ছে দেশের ওই সব হোটেল এর কাছে কিছুই নয়। ওর চেয়ে এর সৌন্দর্য অনেক বেশি। নিশ্চয়ই এই দুবাইতে এমন আরও অনেক হোটেল আছে হয়ত এর চেয়েও দামী। কোম্পানি কি আর তাদের অত বেশি দামী হোটেলে রাখছে? নিশ্চয় এর চেয়ে অনেক দামী হোটেল আছে। সেখানে কারা থাকে, কত টাকা থাকলে অমন হোটেলে থাকা যায়? নিশ্চয় আর যারা আছে তাদের সবাই ওর মত কোম্পানির টাকায় থাকছে না। হঠাৎ করেই নিশাতের মনে এক প্রশ্ন এলো, আচ্ছা যদি কোম্পানি বলে এই হোটেলে থাকার খরচ তার বেতন থেকে কেটে রাখবে, তা হলে কি উপায় হবে? ওকে বিক্রি করলেও তো এই ভাড়া দেয়া সম্ভব না। তা হলে কি হবে? কত কি সাত পাঁচ ভাবছে মাথা মুণ্ডু কিছু ঠিক নেই। অজানা অচেনা একেকটা নিত্য নতুন ভাবনা মনে আসছে যাচ্ছে। এমন সময় ওদের সাথে যে কুক সে এসে বলল
ভাই এখানে একা একা কি করছেন চলেন ওখানে ভালো একটা হিন্দি সিনেমা হচ্ছে দেখি
চলেন দেখা যায়, এ ছাড়া আর কিই বা করবো।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৪

নিশাত ভিতর বাড়ি গিয়ে দাদিকে সামনে পেয়ে বলল দাদু আমরা কাল চলে যাচ্ছি।
আবার কবে আসবে?
জানি না, আব্বার ছুটি না হলে আসা হবে না,

আচ্ছা ঠিক আছে ভালো ভাবে থাকবে, মন দিয়ে পড়া শুনা করবে।
চাচীরা কোথায়?
দেখ তো রান্না ঘরে না কি?
নিশাত এগিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় নিরু ওর ঘরে থেকে বের হয়ে রান্না ঘরে যাচ্ছিল। নিশাত ডাকল
নিরু চাচীরা কোথায়?
সবাই রান্না ঘরে। আপনারা তাহলে কালই যাবেন?
হ্যাঁ নিরু, কালই যাচ্ছি, চল চাচীদের একটু বলে যাই।
আসেন। মা, নিশাত ভাই এসেছে তোমাদের সাথে দেখা করতে, উনারা কাল চলে যাবে।
নিরুর চাচী রান্না ঘর থেকে উকি দিয়ে নিশাতকে ডাকল,
এই যে বাবা আমরা এখানে।
চাচী আমরা কাল যাচ্ছি।
আচ্ছা বাবা ভালো ভাবে থাকবে মন দিয়ে পড়া শুনা করবে।
ওখান থেকে বিদায় নিয়ে আসার পথে নিরু জিজ্ঞেস করল
সত্যিই আপনারা কাল যাবেন?
হ্যাঁ নিরু, আমি যেগুলি দেখিয়ে গেলাম সেগুলি মন দিয়ে পড়বে, না বুঝলে যুঁইকে জিজ্ঞেস করবে। আচ্ছা যুঁই কোথায় ওকে দেখছি না।
আপা পুকুরে।
পুকুরে কি করে একটু ডাকবে ?আমি ওকে তোমার পড়া দেখার জন্য বলে যাব।
আপনি যান মেঝ ভাইয়ের কাছে বসুন আমি ডেকে আনছি।
একটু পরেই যুঁই এসে বলল কি রে নিশাত তোরা তা হলে কাল যাচ্ছিস?
হ্যাঁ তাই বলতে এলাম। শোন তুই কিন্তু নিরুর পড়াটা একটু দেখবি, ও তো ভাল ছাত্রী মনে হলো, তা তুই একটু দেখলেই ওর অনেক সাহায্য হবে। দেখবি।
হ্যাঁ তোর বৌকে তো দেখে রাখতেই হবে, আচ্ছা তুই চিন্তা করিস না। এই নিরু এখন থেকে আমার কাছে নিয়ম করে বসবি। একা পড়বি না, আমার সাথে বসবি। মনে থাকে যেন।
নিশাতের দিকে তাকিয়ে, দেখলি তোর সামনেই কেমন অর্ডার দিয়ে দিলাম?
৭।
এর পরের দিন নিশাতরা ওই অত টুক নিরুর মনে গভীর একটা দাগ দিয়ে চলে গেল। নিরুর মনে যে দাগ কেটে গেল, নিরুর মনের যে জানালা খুলে দিয়ে গেল সে আর কিছুতে বন্ধ হবার নয়। সে তো ভিন্ন জগতের অনুভূতি, ভিন্ন সে ধ্যান, ভিন্ন জ্যোতি, ভিন্ন আকুতি। এত দিন যা ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। এ যে কি এমন এক ব্যথা, এমন এক যাতনা যা কাউকে বলা যায় না, কাউকে দেখান যায় না। নিজের বুকের ভিতর তুষের আগুনের মত জ্বলতেই থাকে। নিতান্ত চেপে রাখা ছাড়া আর কোন পথ নেই। শুধু চোখের জলেই যার সমাধান। আশা পথ চেয়ে দিন যায়, রাত আসে। এক দিন ফিরে আসবে সে আজ হোক বা কাল। ফিরে যে তাকে আসতেই হবে, এই এক সান্ত্বনা বুকের গভীরে পুষে রেখে নিরু নিজেকে নিশাতের জন্য প্রস্তুত করছে।
দিন যায়, মাস যায়, বছরও চলে যায়। নিরুর কাছে মনে হয় যেন একটা যুগ যাচ্ছে। ক্লাসে নিয়মিত হাজিরা, যুঁইয়ের কাছে পড়া, সংসারের কিছু তদারকি এতেই দিন চলে যায়। ভাবে এমন হয় কেন, ও আমার কে? ওর জন্য এমন লাগে কেন? এক জন পুরুষ মানুষের প্রতি এমন টান কেন হয় কিছুতেই এর কোন জবাব খুঁজে পায় না। এই টান কোথা থেকে আসে, এই কি নিয়ম, যদি তাই হয় তা হলে ও কিছু বলে গেল না কেন? আবার ভাবে সেদিন তো বলেছেই “আমি থাকলে তোমার ভালো লাগবে?”এর চেয়ে কি আরও একটু খুলে বলতে পারত না? না, আমিই তো ওকে নিয়ে গেলাম না ও তো পুকুর পাড়ে যেতে চেয়েছিল। ওখানে গেলে কি বলত? না কি আমি যা ভাবছি ও তেমন করে ভাবছে না। তাই বা কি করে হয়, যুঁই আপা যখন অমন করে বলত তখন এত লজ্জা কি জন্! এই নানা ধরনের বিচিত্র প্রশ্ন তার মাথায় ঘুর ঘুর করে কোন ফাঁকে যেন চোখ দুইটা বন্ধ করে দেয়।

দেখতে দেখতে প্রায় দুই বৎসর চলে গেল নিশাতদের আসার কোন নাম গন্ধ নেই। নিরুর মনে যখন নানা ধরনের চিন্তা ভাবনা শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে তার ছোট্ট হৃদয়ের মাঝে নিশাতের জন্য একটা গভীর সাগর বানিয়ে ফেলেছে তখন দেশে শুরু হলো স্বাধীনতার আন্দোলন। তারপর মুক্তি যুদ্ধ। যুদ্ধ চলা কালীন এক দিন সত্যিই নিশাতরা কাউকে কিছু না জানিয়ে দেশে এসে হাজির।

এক দিন সকালে নিরু বাড়ির দক্ষিণ পাশে কুয়া থেকে পানি তোলার জন্য কুয়ায় মাত্র বালতি ফেলেছে এমন সময় সামনে তাকাতেই দূরে নিশাতদের বাড়ির ওদিক থেকে দুই পাশে ধান ক্ষেতের মাঝে বাধানো উঁচু রাস্তা দিয়ে শার্ট প্যান্ট পরা কে এক জনকে আসতে দেখে একটু থেমে গেল। চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু! হ্যাঁ তাই তো, বুকটা কেপে উঠল। হ্যাঁ সেই, যার জন্য এতো দিন অপেক্ষা, যার জন্য পথ চেয়ে কল্পনার জাল বুনে, দিন রাত যন্ত্রণা সয়ে এক উত্তাল সাগরের উন্মত্ত ঢেউ বুকে নিয়ে এতো গুলো দিন কেটেছে এ সেই। মানুষটা কেমন! একটা খবরও কি দিতে নেই? এমন কেন? আনমনা হয়ে কত কি এলো মেলো ভাবনা এসে জড়িয়ে গেল। হাত পা সব যেন কেমন আড়ষ্ট হয়ে এলো। বালতির রশি হাতেই ধরা রইল।
কি নিরু, কেমন আছ?
কণ্ঠ শুনে নিরুর ভাবনা থেমে গেল। বুকে এক অজানা কাঁপন অনুভব করল, গলা জিহ্বা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

কি নিরু কথা বলছ না কেন?
কোন রকম একটু ঢোক গিলে বলল
কবে এলেন?
কই আমি যে বললাম, কেমন আছ তার কিছু বললে না?
হ্যাঁ ভালোই আছি, আপনি?
হ্যাঁ আমিও ভালো আছি, তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ, প্রায় চেনাই যায় না।
নিরু এতো দিন যার পথ চেয়ে দিন রাত একটা ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছে, নিজেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু যার জন্য তৈরি করেছে আজ এই তাকে এমন হঠাৎ দেখে হত বিহ্বল হয়ে গেছে। মনে মনে বলল আমি কেমন আছি সে তুমি বুঝ না? তোমার পথ চেয়ে আমার দিন গুলি কি ভাবে গেছে সে বোঝার শক্তি তোমার কবে হবে, না কি কোন দিন হবে না? একটু স্থির হয়ে বলল
যান, ওই যে বাড়ির পিছনে মেঝ ভাই বাঁশ কাটছে ওখানে যান।
আমি এসেই তোমাকে দেখতে পাব ভাবতেই পারিনি। তোমাদের কি সৌভাগ্য কি সুন্দর পরিবেশে তোমরা থাক। তোমাদের এই কুয়ার পাড়টা কি সুন্দর, ও পাশে পুকুর পাড়ে ঝোপে পাখি ডাকছে, সামনে ধান ক্ষেতের বিশাল সবুজ প্রান্তরে বাতাসে ঢেউ তুলছে। আচ্ছা ওই যে ওটা কি পাখি?
নিরু নিশাতের দৃষ্টি অনুসরণ করে পাশে তাকিয়ে বলল ওটা মাছ রাঙ্গা।

কি চমৎকার পরিবেশে থাক তোমরা, চারি দিকে উঁচু নিচু ঝোপ ঝাঁর, তাতে নানা রঙের পাতা ফুল কত সুন্দর এ দেশ আর আমরা যেখানে থাকি শহরে সেখানে শুধু ইট লোহা কাঠ পাথরের দালান কোঠা আর তার সাথে মানুষের মনও তেমন হয়ে যায়!
এখানে আসার সময় তাই দেখলাম রাস্তার পাশে কি সুন্দর পানিতে ধানের ক্ষেত গুলি মনে হচ্ছে যেন ভাসছে। এই সবুজের মধ্যে থেকে থেকে তোমার মন কত সরল।
আমার সাথে কখনো ভালো করে কথাই বলেননি কি করে জানলেন আমার মন সরল, এ সব আপনার বানানো কথা।
না নিরু, আমি বানিয়ে কথা বলতে পারি না, যা সত্যি মনে হয় তাই বলি, বানানো কথা আমি কখনো ভাবতে পারি না। এই যদি এখন বলি এ বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগে তোমাকে, এটাও সত্যি এবং মোটেই বানানো নয়। তোমার দুরন্তপনা, তোমার চঞ্চলতা আর তোমার এই হাসি ভরা মুখটা আমি এক দিনের জন্যেও ভুলতে পারিনি, তা কি তুমি জান?
তাই যদি হবে তবে এতদিন পরে আসলেন কেন নাকি যুদ্ধ শুরু না হলে আর আসতেন না?
কি যে বল তুমি!
নিরুর চোখ কুয়োর নিচে একেবারে গহীনে পানির উপরে স্থির হয়ে আছে। ও পাশে রাখালরা আসা যাওয়া করছে এদের মধ্যে যারা নিশাতকে চিনে তারা এসে একটু জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে, কবে এসেছে। ফাঁকে ফাঁকে ওদের কথার জবাব দিচ্ছে। নিরুর কানে কে যেন মধু ঢেলে দিচ্ছে, এই টুকু শোনার জন্যই এতো দিন অপেক্ষায় ছিলাম। আজ আমার সাধনা যেন পূর্ণ হতে চলেছে, আমার মনের কথা শুনতে পেয়েছে। নিরু ভিন্ন এক জগতে হারিয়ে গেছে, তন্ময় হয়ে শুধু শুনে যাচ্ছে। হঠাৎ নিশাতের মনে হলো নিরু ওর কথা শুনছে না কি! কি হলো তুমি আমার কথা শুনছ না?
লজ্জায় নিরুর ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেল। কোন রকম পিছনে ফিরে
ওই যে মা ডাকছে আমি যাই।
বলেই কুয়োয় বালতির রশি ছেড়ে এক দৌড়ে ভিতর বাড়ি। নিরুর যাবার পর নিশাতের মনে হলো তাইতো এটা গ্রাম, এভাবে একটা ছেলে একটা মেয়র সাথে খোলা কুয়োর পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলা কারো নজরে এলে ফলাফল নিশ্চয় খুব একটা সুখের হবে না। নেহায়েত তারা গ্রামে থাকে না বলে হয়তো আপাত কেউ কিছু বলবে না তবে এর আগের বারে নিরুর মুখেই এই কথা সে শুনে মনে রেখেছে। কিন্তু নিরু? মুনি ঋষিরাই যেখানে ব্যর্থ সেখানে নিশাত আর কি! নারী হৃদয় বোঝার ক্ষমতা তার নেই। তবুও নিশাত হতভম্বের মত কিছুক্ষণ সেখানে দাড়িয়েই রইল। নিরুর এই হঠাৎ চলে যাওয়া কি শুধুই লোক লজ্জা না কি ভিন্ন কিছু? এমন করে কিছু না বলেই চলে যাবে? কিছুটা বোকার মতই দাঁড়িয়ে রইল। এ কথা কাউকে জিজ্ঞেস করা যাবে না। কেন, সরাসরি কিছু বলে গেলে কি হতো? কেন এমন হয়? লজ্জা, নাকি অন্য কিছু? তা হলে সে অন্য কিছু কি? আর কি হতে পারে? কোন জবাব খুঁজে না পেয়ে আস্তে আস্তে নিরুর দেখানো বাড়ির পিছন দিকে যেখান থেকে বাঁশ কাটার শব্দ আসছে সে দিকে চলে গেল।
[চলবে]