ট্যাগ আর্কাইভঃ নিতাই বাবু’র গল্প

ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর–মুখ অতিশয় গম্ভীর-২ শেষ পর্ব

ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর-মুখ অতিশয় গম্ভীর-১

প্রথম পর্বের শেষাংশ:
শেষতক এই খবর পৌঁছে গেল জীবন বামনার কানে। জীবন বামনা তখন আরেক মুল্লুকে থাকা এক মন্দিরে থেকে খেয়ে-না-খেয়ে দিন পার করছিল।

জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনার হুলুধ্বনি যখন জীবন বামনার কানে আসলো, জীবন বামনা মনে মনে বলতে লাগলো, ‘না না, আমার লেখা এক টুকরা কাগজের লাইগা জমিদার কার্তিক বাবুর জীবন বাঁচে নাইক্কা। কার্তিক বাবু জীবন বাঁচছে হের সৎ কামের লাইগা। জমিদার কার্তিক বাবুর আয়ু আছিল দেইখাই, হের জীবন বাঁচছে। আমার লেখা এক টুকরা কাগজ হেদিন হেই জায়গায় না থাইকলেও জমিদার কার্তিক বাবুর জীবন বাঁইচতো। হেইডা যেমনেই ওক অইতো। এনো আমার লেখা কাগজখান খালি উছিলা, আর সাক্ষী অইয়া রইছে। ইল্লাইগা আমি যদি কার্তিক বাবুর তুন কিছু চাই, তয়লে আমার অইবো বড় অন্নাই।

এই ভেবে জীবন বামনা সিদ্ধান্ত নিলো, কিছুতেই সে জমিদার কার্তিক বাবুর কাছে গিয়ে কিছু চাইবে না, কাগজে লেখার ব্যাখ্যাও দিবে না। যদিও জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে যেতে হয় তো বামনীকে সাথে করেই নিয়ে যাবে। কিন্তু বামনীকে তো বলে এসেছে টাকাপয়সার বস্তা সাথে করে নিয়ে যাবে। এখন খালি হাতে বামনীর সামনে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? বামনী যদি ঝাঁটা মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়? এমনিতেই বামনী আমাকে বলে কুমিরা আইলসা!’ মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে জীবন বামনা খিটখিটে জোরে জোরে শব্দ করে হাসতে লাগলো।

জীবন বামনার হাসির শব্দে মন্দিরে থাকা ঠাকুরের একটু খারাপ লাগলো। ঠাকুর তখন মন্দিরে থাকা দেবমূর্তিতে পূজা দিচ্ছিলো। ঠাকুর মূর্তি পূজা বাদ দিয়ে বারান্দায় বসা জীবন বামনার সামনে এসে বললো, ‘ওই বেডা হারামজাদা, ‘পূজা দেওয়নের সুম আমার কোনও ভুল অইছে?’ জীবন বামনা বললো, ‘নাতো গোসাই!’ ঠাকুর উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘তয়লে বেডা তুই এমনে বেটকাইলি ক্যা, ক?’ জীবন বামনা বললো, ‘আজ্ঞে গোসাই এমনেই হাইসলাম।’ তারপরও মন্দিরের ঠাকুর বিশ্বাস করতে পারছে না। ঠাকুর আবারও বললো, ‘হাছাকথা যদি না কছ, তয়লে তোরে অনকা মন্দিরের তুন খেদাইয়া দিমু! ভালা অইবো হাছা কইরা ক। এনো থাকলে অইলে কইতে অইবে জোরে জোরে বেটকাইলি ক্যা?’

জীবন বামনা কোনও অবস্থাতেই মিথ্যা বলার পাত্র নয়! এতে যেতো সমস্যাই হোক, সে সত্যই বলবে। তাই মন্দিরের ঠাকুরের চাপাচাপিতে জীবন বামনা জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে সেদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ী করে বললো, ‘জমিদার কার্তিক বাবুর ঘরের দরজায় এক টুকরা কাগজ আমিই লাগাইয়া রাখছিলাম, ঠাকুর মশাই। হেই কাগজের লাইগা জমিদার কার্তিক বাবুর জীবন বাঁইচা গেছে। আইজ ক’দিন ধইরা হেই কাগজ কে লেখছে আর কে লাগাইছে, হিল্লাইগা হারা মুল্লুকে ঢোল পিডাইতাছে। এই কথা আমার মনে পরছে দেইখা আমি হাসতাছিলাম, ঠাকুর মশাই। হের লগে আবার আমার বামনীর কথাও মনে পইড়া গেছে। বামনী আমারে কতায় কতায় কয় কুমিরা আইলসা।’ এই বলেই জীবন বামনা আবারও হাসতে লাগলো, হা-হা-হা-হা!

জীবন বামনার কথা শুনে মন্দিরের ঠাকুর অবাক হয়ে বললো, ‘আরে বেডা তুই কছ কী? হাছা হাছাই তুই কাগজ লাগাইছত? চল বেডা, পুরস্কার আছে। যেয় নিকি সন্ধান দিতে পারবো, কার্তিক বাবু হেরে দিবো এক হাজার টেকা। আর যেয় লিখছে, লাগাছে, হেরে দিবো দুই হাজার টেকা। চল তাড়াতাড়ি কইরা। আমি অইলাম গিয়া সন্ধানদাতা, আর তুই লেকছত লাগাইছত। তুই পাইবি দুই হাজার টেকা। চল চল, চলরে বেডারে চল!’ এই বলেই মন্দিরের ঠাকুর জীবন বামনার হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলো। ঠাকুরের জবরদস্তি আর টানাটানিতে মন্দিরের সামনে আরও কয়েকজন মানুষ হাজির হয়ে গেলো। উপস্থিত সবাই যখন এই ঘটনা শুনে ফেললো। তখন মন্দিরের ঠাকুর ভাবছে, ‘হায় হায়, এই লোকগুলা তো আগে আগে জমিদার কার্তিক বাবুর কাছে যাইয়া কইয়া দিবো! তাইলে তো আমি হালায় ফাও যামু!’ এই ভেবে মন্দিরের ঠাকুর মন্দির ফেলে এক দৌড় দিলো জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির দিকে। আর যাঁরা এই ঘটনা শুনল, তাঁরাও ঠাকুরের পিছনে পিছনে দৌড়াতে লাগলো। জীবন বামনা তখনো মন্দিরের বারান্দায় বসে কি যেন ভাবছিল! আর লোকজনের দৌড়াদৌড়িতে এই কথা এক কান থেকে আরেক কানে যেতে লাগলো।

এভাবে এই খবর পৌঁছে গেল জীবন বামনার বামনীর কাছে আর জমিদার গণেশ বাবুর কাছে। জমিদার গণেশ বাবু খবর শুনে তাঁর লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়ে দিলেন জীবন বামনাকে ধরে নিয়ে যেতে। এদিকে দশ গ্রামের মানুষও জীবন বামনাকে দেখার জন্য জড়ো হয়ে গেল মন্দিরের সামনে। গ্রামের লোকজনের ভিড়ের মধ্য থেকেও গণেশ বাবুর লাঠিয়াল বাহিনী এসে জীবন বামনাকে ধরে নিয়ে গেল, জমিদার গণেশ বাবুর বাড়িতে।

জমিদার গণেশ বাবু জীবন বামনাকে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। জমিদার গণেশ বাবু রেগেমেগে হাতে একটা লাঠি নিয়ে জীবন বামনাকে বলছে, ‘ও-ই বেডা হাছা কইরা ক, আসলে কার্তিক্কার দরজার মাধ্যে কি তু-ই কাগজের টুকরা লাগাইছত? জীবন বামনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘আজ্ঞে হ, আমিই লাগাইছি। হিল্লাইগা কী অইছে?’ গণেশ বাবু ক্ষেপে বললো, ও-ই বেডা তুই কত্ত বড় শিক্ষিত অইছত দেহি!’ এই কথা বলেই জীবন বামনার ঝুলির ভেতরে হাত দিল। জীবন বামনার সাথে থাকা ঝুলিতে শুধু কাগজের টুকরো আর টুকরো।

এসব কাগজের টুকরো দেখে জমিদার গণেশ বাবু ভাবলো লোকটা মনে হয় পাগল। কিন্তু কাগজের টুকরোগুলোতে লেখা দেবদেবীর পূজার মন্ত্র, আর শাস্ত্রগ্রন্থের লেখা দেখে গণেশ বাবু তখন রীতিমতো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, বাবা, তোর বাড়ি কই? তুই বাবা কী করছ? কার্তিক্কার ঘরের দরজার মাধ্যে তুই কী লেকছত? তর হেই লেখার লাইগগা নাপতা হালায় কার্তিক্কার গলা কাইটতে পারে নাইক্কা। ক তুই কাগজে কী লেকছত, ক?’ গণেশ বাবুর কথা শুনে জীবন বামনা হেসে বললো, ‘জমিদার বাবু, ‘এই দুইন্নাইত কেডা কারে মাইত্তে পারে? আয়ু থাকতে মানুষ মরে না। কেউ কারোরে মাইত্তেও পারে না। আমার কাগজখান অইলো উছিলা। হেদিন কার্তিক বাবুর ঘরের দরজার মাধ্যে আমার কাগজ লাগাইন্না না থাইকলেও কার্তিক বাবু যেমনেই ওক বাঁইচা যাইত। আম্নে বড় একখান ভুল করছেন বাবু। এই ভুলের পাচিত্ত আম্নের করন লাগবো।’

জীবন বামনার কথা শুনে জমিদার গণেশ বাবু অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘আসলেই আমি ভুল করছিরে। কিল্লাইগা যে এই আকাম করতে গেলাম! মাথাডা ঠিক আছিল নারে।’ জীবন বামনা বললো, ‘জমিদার বাবু, শত্রুর লগে শত্রুতা না কইরা বন্ধু অন যায় না? তাইলেই ত শত্রু আম্নেরে গোসাই মনে কইরা পূজা দিবো।’ এবার জমিদার গণেশ বাবু নিজের ভুল স্বীকার করলো। আর কীভাবে এই ভুলের ক্ষমা পাওয়া যেতে পারে সে-ব্যাপারে জীবন বামনার কাছে জানতে চাইল। জীবন বামনা বললো, যাঁর কাছে অপরাধ করছেন, হে ও-ই ক্ষমা করতে পাইরবো। হে ছাড়া স্বয়ং ভগবানও ক্ষমা করতো না, বাবু। এই ভুলের ক্ষমা একমাত্র কার্তিক বাবুই করতে পারবো, অন্য কেউ না।’ জীবন বামনার কথা শুনে জমিদার গণেশ বাবু বললো, ‘ঠিক আছে কার্তিক বাবুর বাড়িত যাইয়া হের কাছ তুনে মাপ চাইয়া লমু। তুই বেডা আমার লগে থাকবি।’ জীবন বামনা হেসে বললো, ‘ঠিক আছে বাবু, আমি আম্নের লগেই থাকুম। চলেন আমার লগে কার্তিক বাবুর বাইত।’ জীবন বামনার কথায় জমিদার গণেশ বাবু আর দেরি না করে লোকজন সাথে নিয়ে জীবন বামনা-সহ জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির দিকে রওনা হলো।

এদিকে বামনী জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিজের স্বামী ঘটিয়েছে জানতে পরে বামনীও জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে এসে হাজির হলো। বামনী এসে দেখে জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। বাড়ির ভেতরে হাতাহাতি তর্কাতর্কি চলছে। কেউ বলছে আমি আগে খবর নিয়া আইছি। কেউ বলে আমি আগে আইছি। মন্দিরের ঠাকুর তো সবার আগে এসে কার্তিক বাবুর কাছে বলে সবার আগে বসে আছে। কার্তিক বাবু একজন একজন করে জিজ্ঞেস করছে, যে লিখেছে তাঁর নাম কী? তাঁর বাড়ি কোথায়? কিন্তু কেউ আর এসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারছে না। শুধু বলছে, লোকটা জীবন পুর গ্রামের কালীমন্দিরে থাকে। সবার মুখে জীবন পুর কালীমন্দিরের কথা শুনে জমিদার কার্তিক বাবু সবাইকে বসতে বলে লোক পাঠিয়ে দিলেন জীবন পুর কালীমন্দিরে। ততক্ষণে জীবন বামনাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল জমিদার গণেশ বাবুর লোকজন।

এরমধ্যেই জীবন বামনার স্ত্রী বামনী এসেই দেখে বাড়ি ভর্তি লোকজন। বামনী এসেই জমিদার কার্তিক বাবুকে বললছে, ‘আমার স্বামী কই? আমার স্বামীরে কি বাইন্দা রাখছেন?’ জমিদার কার্তিক বাবু জানতে চাইলো, ‘কে তোমার স্বামী?’ বামনী বললো, ‘আম্নের ঘরের দরজার মাধ্যে যেয় কাগজখান লাগাইছে, হেয় আমার স্বামী জীবন চক্রবর্তী।’ তখন বাড়িতে উপস্থিত লোকজনের মাথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কেউ বলছে, ‘যা, সন্ধানদাতা তো কাগজ লাগাইন্নার বউ। তয়লে দুইডা পুরস্কার হেরাই পাইতাছে। আমরা খালি খালি আইয়া নিজেরা নিজেরা গোলমাল লাগাইলাম।’ বামনীর কথা শুনে জমিদার কার্তিক বাবুর বিশ্বাস হলো। বামনীকে সম্মান করে বসতে দিলো। বামনী বসলো। অপেক্ষা এখন জীবন বামনার।

এদিকে বাড়িতে অনেক লোকের মাঝে একজন বললো, জীবন পুর কালীমন্দির থেকে জীবন বামনাকে জমিদার গণেশ বাবু তুলে নিয়ে গেছে। সাথে সাথে জমিদার কার্তিক বাবু ১০/১২ জন লোক পাঠিয়ে দিলো জমিদার গণেশ বাবুর বাড়িতে। পথিমধ্যেই কার্তিক বাবুর লোকজন দেখে জমিদার গণেশ বাবু লোকজন নিয়ে কার্তিক বাবুর বাড়ির দিকে আসছে। কার্তিক বাবুর লোকজন তা দেখে দৌড়ে আবার কার্তিক বাবুর বাড়িতে এসে বললো, ‘জমিদার বাবু, গণেশ বাবু লোকজন নিয়া আম্নের বাড়ির দিকে আইতাছে।’ এই কথা শুনে কার্তিক বাবুর তাঁর লাঠিয়াল বাহিনীকে প্রস্তুত হতে বললো। লাঠিয়াল বাহিনী লাঠিসোটা নিয়ে প্রস্তুত হলো। এখন পুরো বাড়িতে থমথমে অবস্থা বিজার করছিল। এমন সময় জমিদার গণেশ বাবু জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির ভেতরে ঢুকতে চাইলে কার্তিক বাবুর লোকজন বাধা দিলো। জীবন বামনা কার্তিক বাবুর লোকদের বললো, ‘আম্নেরা যাইয়া কার্তিক বাবুরে কন, আমি জীবন চক্রবর্তী, জীবন বামনা আইছি। জমিদার গণেশ বাবুরে আমিই লগে কইরা লইয়া আইছি। যাইয়া কনগা।’ কয়েকজন লোক গিয়ে কার্তিক বাবুর কাছে বললো, ‘জীবন বামনা জমিদার গণেশ বাবুরে লগে কইরা লইয়া আইছে। অন আম্নে কইলে হেগো আইতে দিমু।’ কার্তিক বাবু বললো, ‘ঠিক আছে আসতে দাও।’

কার্তিক বাবুর অনুমতি পেয়ে জীবন বামনা আর গণেশ বাবুর লোকজন কার্তিক বাবুর বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। কার্তিক বাবু সবাইকে বসতে দিলো। সবাই বসলো। সাথে সাথে জীবন বামনার স্ত্রী বামনী এসে জীবন বামনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। জীবন বামনা বামনীকে শান্তনা দিয়ে আগের জায়গায় গিয়ে বসতে বললো। বামনী গিয়ে চুপ করে বসে থাকল।

এবার কার্তিক বাবু জীবন বামনাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘গত তিনদিন আগে আমার বাড়িতে এসে আমার ঘরের দরজায় একটুকরো কাগজ তুমি লাগিয়েছিলে?’ জীবন বললো, ‘হ বাবু, আমি আইছিলাম ভিক্ষা করনের লাইগগা। হেসুম আম্নেরা কেয় ঘুমেতুন উডেন নাই। আমি বহুতক্ষণ বইয়া থাইক্কা আম্নের দরজার মাধ্যে একখান কাগজের টুকরা লাগাই থুইয়া গেছি, আম্নে যন জানতে পারেন যে আমি আইছিলাম।’

জমিদার কার্তিক বাবু এবার জানতে চাইল, ‘কাগজে কী লিখেছিলে, তা কি তোমার মনে আছে?’ জীবন বামনা বললো, কি যে কন বাবু, আমি লেখছি, আমিই লাগাইছি। আর আমিই কইতে পারতাম না, তয় কইবো ডা কেডা?’ কার্তিক বাবু বললো, ‘বলো দেখি তুমি কী কী লিখেছিলে?’ জীবন বামনা বললো, ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর, মুখ অতিশয় গম্ভীর, শ্রী শ্রী বিশ্বপানি তুমি যাহা করিবা তাহা আমি জানি।’ কার্তিক বাবু জানতে চাইলেন, এসবের মানি কী?’ সুন্দর করে ব্যাখ্যা দিতে পারবে?’ জীবন বামনা হেসে বললো, ‘তাইলে ত পুরা ঘটনা আবার নতুন কইরা কন লাগে, বাবু। হুনতে যন চাইছেন, তয় ত কনই লাগে। তয় হুনেন, হেদিন আমার বামনীর লগে কাইজ্জা কইরা ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে লইয়া ঘরের তুন বাইর অইয়া, আটতে আটতে আম্নেগো বাড়ির রাস্তায় আইছি। দেহি রাস্তার মাধ্য কেডা যানি একটা বলদ গরু খুডা গাইডরা থুইয়া দিছে। গরুডা রাস্তার মধ্যখানে আইয়া খারাইয়া রইছে। গরুডার লাইগগা আমি আর আম্নের বাড়ির দিকে আইতে পাত্তাছিলাম না। গরুডায় খালি সামনের একখান পায়ের তিনডা খুর দিয়া মাডি খুদ্দাছে।

হিল্লাইগা আমি লেখছি, “ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর।
কদ্দুর পরে দেহি, গরু মুখ কালা গম্ভীর কইরা অনক্ষণ খারাইয়া রইছে।
হিল্লাইগা আমি লেখছি, “মুখ অতিশয় গম্ভীর।
হের পরে দেহি পেছ পেছ কইরা মুত্তা আস্তে কইরা রাস্তার নিচে নাইম্মা গেছে। হিল্লাইগা আমি লেখছি, “শ্রী শ্রী বিশ্বপানি তুমি যাহা করিবা তাহা আমি জানি।

এই লেখার কাগজখানই আমি আম্নের দরজার মাধ্যে আমগাছের আডা দিয়া লাগাইয়া থুইয়া গেছিগা, বাবু। হের পরে আম্নের বাইত কি অইছে আমি কিচ্ছুই কইতে পাত্তামনা। আম্নের দরজার মাধ্যে একখান কাগজের টুকরা লাগানে যদি আমার ভুল অয়, তয় আমারে ভগবানের দিকে চাইয়া মাপ কইরা দেন।’

জমিদার কার্তিক বাবু জীবন বামনার কাছ থেকে কাগজে লেখার ব্যাখ্যা পেয়ে চেয়ার থেকে উঠে বামনাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তোমার সেই অসাধারণ লেখা কাগজের টুকরো সেদিন আমার জীবন বাঁচিয়েছিল। আর তুমি বলছ, মাপ করে দিতে? তুমি কোনও অপরাধ করোনি জীবন বামনা। তোমার নাম যেমন জীবন চক্রবর্তী। ঠিক তুমি মানুষের জীবন রক্ষায় সবসময় নিয়োজিত। তোমার বুদ্ধিতে আমি নতুন করে জীবন পেলাম। তাই আজ থেকে সবসময় তুমি আমার জীবনের সাথেই মিশে থাকবে। তোমার যাকিছু দরকার তা আমিই দেখবো। আর আমার ঘোষণা করা তিন হাজার টাকা একমাত্র তুমিই পাওনা।’

কার্তিক বাবুর কথা শেষ হতে-না-হতেই জমিদার গণেশ বাবু কার্তিক বাবুর সামনে গিয়ে হাতে ধরে বললো, ‘কার্তিক বাবু আপ্নে আমারে মাপ কইরা দেন। আমি রাগের মাথায় একটা আকাম কইরা ফালাইছি। আইজকা আম্নের বাইত আমারে লইয়া আইছে এই জীবন বামনায়।’ জীবন বামনাও জমিদার কার্তিক বাবুর হাতে ধরে বললো, জমিদার বাবু, আম্নে গণেশ বাবুরে মাপ কইরা দেন। আইজগার তুন আম্নেরা দুইজন বন্ধু অইয়া থাকবেন। আর যেই নাপিত আম্নের গলা কাটতে আইছিল, তাঁরেও মাপ কইরা দেন। জীবন বামনার কথায় জমিদার কার্তিক বাবু তা-ই করলো। এরপর সবাই মিলে কোলাকুলি করলো। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া করে যার যার বাড়ি চলে গেল। জীবন বামনা আর বামনী জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতেই থেকে গেল।

এখানেই সমাপ্তি

ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর–মুখ অতিশয় গম্ভীর-১

রাতভোর হতে-না-হতেই বামনীর লক্ষ্মী পাঁচালীর সুর তোলা শুরু হয়ে গেলে, ঘরে চাল-ডাল তেল লবণ-সহ তরিতরকারি না থাকার কারণে। বামনী তাঁর স্বামী বামনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে জোরে চিল্লাতে চিল্লাতে বলছে– আমি আর পারুম না। আমার জান আর চলে না। ভগবান আমারে নেয় না ক্যা রে? ভগবান আমারে দেহে না ক্যা? দুন্নাইর এতো মাইনষেরে লইয়া যায়, ভগবান আমারে চোক্ষে দেহে না। আমারে লইয়া যা-রে ভগবান, আমারে লইয়া যা। আমি আর কাম করতে পারি না। মাজায় কুলায় নারে ভগবান, দেহে কুলায় না। আমি হারাদিন মাইনষের বাড়িত খাইটা মরি, আর আমার হোয়াদের বামনায় খালি বইয়া বইয়া খাইবো। আমি কি হারাজীবন পরের বাইত বান্দালিগিরি করুম? আর পাত্তাম না। এই কুমিরা আইলসা বামনার লগে ঘর কইরা আমার জীবনডাই শেষ কইরা দিছি। বিয়া অইছে ১৫/১৬ বছর অইয়া গেছে। অনও ভগবান একখান পোলাপাইনের মুখ আমাগো দেখাইল না। আর মনে অয় দেখাইতোও না। হিল্লাইগা কই, আরে বামনা অহন হুইয়া থাইক্ক না। কাম কাইজ কইরা, খাইয়া দাইয়া কিচ্ছু না রাইখলে বুড়া বষে আমাগো দেখবো কেডা? বুঝে না, বুঝে নারে ভগবান। বুঝবো বুঝবো, যনকা বিছনাত পড়বো তনকা বুঝবো।

–হ, হ, যনকার টা তহনকা বুঝা যাইবো। বেয়াইন্নাবেলা বেশি চিল্লাচিল্লি করিস না কইয়া দিলাম বামনী। হালার মাইনষে বেয়াইন্নাবেলা ঘুমেত্তুন উইঠা হরিনাম জপে। আর আমার বামনী জপে শয়তানের নাম। হালার শান্তি পাইলাম না। খালি মরার জীবনকাহিনী! এই জীবনকাহিনী হুনতে হুনতে কান দুইডার ছেদা বন্ধ অইয়া গেছেগা। অহনে মাইনষে ভালা কথা কইলেও হুনি খারাপ কথা। হিল্লাইগা মাইনষের লগে লাগে কাইজ্জা। আর ঘরে ত শান্তি নাই ও-ই।

–এ-এ-এ, শান্তি বিছরায়, শান্তি! শান্তি থাকবো কইতন? কাম না করলে শান্তি থায়ে? শান্তি অ-ত শান্তি চায়! ভাত চায়, কাপড় চায়, এইডা চায় ওইডা চায়। এডি না দিতে পারলে ত অশান্তি অ থাকতো না। অশান্তি অ চায় শান্তিত থাকতে। বামনা আমার ভাত দেওনের মুরুদ নাই, কিল দেওনের গোসাই হাইজ্জা বইয়া বইয়া শান্তি বিছরায়। আইজগা আমি নিজের মতন ঘরে হুইয়া থাকুম। দেহি কেডা আম্নেরে চাইল ডাইল আইন্না রাইন্দা খাওয়ায়।

–ও-ই, বামনী, আমি আইলসা? আমি হুইয়া বইয়া খাই? আমি কি পরের বাইত ভিক্ষা করতে যাই না? পরের বাইত তন চাইল ডাইল কম আনি? যেডি আনি, এডি যায় কই? এডি কি আমি একলা খাই? আইজগা তোর রান্দন লাগত না। আমি বাইর অইলাম এই ঘরেরতুন। হালার এক পেট কুত্তায়ও চালাইতে পারে। মাইনষের বাইত খাইয়া দাইয়া রাস্তায় হুইয়া থাকুম। হের পরেও যদি আহি, কামাই রোজগার কইরা টেকা পইসা বস্তা ভইরা লইয়া আইমু। না অইলে আর বাইত আইতাম না, আমি জীবন বামনা কইয়া গেলাম। এলা তুই একলা একলা থাইছ। এই বলেই বামনা জীবন চক্রবর্তী তাঁর ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

বামনা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর ভাবছে, কার বাড়িতে গেলে অন্তত দুপুরের খাবার খাওয়া যাবে! জীবন বামনা ভেবে দেখলো যার বাড়িতে অভাব অনটন নাই, সেই বাড়ি গেলেই হয়তো দুপুরের খাবার কপালে জুটতো পারে। এই ভেবে জীবন বামনা জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। যেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, সেটি গ্রামের রাস্তা। রাস্তার দুইপাশে খাল, মাঝখান দিয়ে হলো রাস্তা। জীবন বামনা যেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, সেই রাস্তার মধ্যে কে একটা গরু খুটা গেড়ে বেধে রেখেছে। গরু তাঁর গলায় বাধা রশির আওতায় ঘুরে ঘুরে ঘাস খেয়ে রাস্তার ঠিক মধ্যখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে। এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, গরুটির জন্য এখন আর জীবন বামনা রাস্তার সামনের দিকে যেতে পারছে না। বামনা এখন বসে বসে ভাবছে, এই গরু কখন রাস্তার কিনারে যাবে! এই ভেবে জীবন বামনা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও গরুটি কিছুতেই রাস্তা ছাড়ছে না। জীবন বামনাও জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ি যেতে পারছে না।

বামনা এখন বসে রইল গরুটির সামনে রাস্তার একপাশে। জীবন বামনা রাস্তার পাশে বসে তাঁর ঝুলি থেকে কাগজ কলম বের করলো, তাঁর ঝুলিতে থাকা কাগজে কিছু লেখার জন্য। জীবন বামনা আবার গরুটির গতিবিধিও ফলো করছে, গরুটি দড়ি ছেড়ে লেজ তুলে গুঁতো দিতে আসে কিনা! কিন্তু না, গরুটি কাউকে গুঁতো দেওয়ার ভাব নিচ্ছে না। গরুটি তাঁর লেজ উপরে উঠিয়ে প্রস্রাব করতে লাগলো। গরুটি প্রস্রাব করে ঘাস খাবার জন্য আস্তে আস্তে রাস্তার নিচে নেমে গোলো। জীবন বামনা তা দেখে কিছুক্ষণ একা একাই হাসলো। এরপর জীবন বামনা তাঁর হাতে থাকা কাগজে তিনটি কথা লিখে, জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির দিকে রওনা হলো।

জীবন বামনা গেলেন জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে। এই বাড়িতে জীবন বামনা আরও অনেকবার গিয়েছিল। তাই জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির সবাই জীবন বামনাকে খুব ভালো করে চিনে এবং জানে। কিন্তু সেদিন সকালে জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির কেউ তখনো ঘুম থেকে উঠেছিল না। জীবন বামনাও জমিদার বাড়ির উঠোনের এককোণে অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে ভালো লাগছিল না। অনেকক্ষণ পর জীবন বামনা ভাবলো আর কতক্ষণ এখানে বসে থাকবো? তারচেয়ে বরং অন্য বাড়িতে চলে যাই। কিন্তু আমি যে আজ জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে এসেছি, তার একটা প্রমাণ রেখে যাই। এই ভেবে রাস্তায় বসে গরুর কাহিনী লেখা কাগজের টুকরোটা জমিদার কার্তিক বাবুর ঘরের দরজায় গাছের আঠা দিয়ে লাগিয়ে রেখে, জীবন বামনা অন্য এক বাড়িতে চলে গেল।

সেইদিনই আবার কার্তিক বাবুর মুখের গোঁফদাড়ি ছাঁটানোর কথা মরণ সীল নামের এক নাপিতের। যেই নাপিত জমিদার কার্তিক বাবুর গোঁফদাড়ি ছাঁটতে এসেছে, সেই নাপিতই আবার গণেশ জমিদারের গোঁফদাড়িও ছাঁটানোর কাজ করে। এদিকে গণেশ বাবু আর কার্তিক বাবুর সাথে অনেক আগে থেকে রেষারেষি চলছিল। এমন রেষারেষির ফলে কার্তিক বাবু সুযোগ খুঁজে গণেশ বাবুকে মারতে, গণেশ বাবু সুযোগ খুঁজে কার্তিক বাবুকে মারতে। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর দুই জমিদারের একে অপরকে খতম করার চেষ্টা। কিন্তু কেউ কাউকে সুযোগ বুঝে কোপ দিতে পারছে না। একসময় জমিদার গণেশ বাবু এই মরণ শীল নাপিতকে ফুসলিয়ে আর টাকার লোভ দেখিয়ে হাত করে ফেলে। মরণ শীল নাপিতকে গণেশ বাবু বুদ্ধি দিলো, তুমি যেদিন কার্তিক বাবুর গোঁফদাড়ি ছাঁটতে যাবে, সেদিন তোমার হাতের ধারালো খুর দিয়ে কার্তিক বাবুর গলা কেটে ফেলবে। বিনিয়ে তোমাকে এক হাজার টাকা দেওয়া হবে। যা দিয়ে তুমি অনেক বছর কাজ না করেও পরিবার পরিজন নিয়ে চলতে পারবে। জমিদার গণেশ বাবুর কুবুদ্ধিতে দরিদ্র নাপিত মরণ শীল রাজি হয়ে, এইদিনই জমিদার কার্তিক বাবুকে মেরে ফেলার প্রস্তুতি নিয়ে আসে তাঁর বাড়িতে।

নাপিত মরণ শীল জমিদার বাড়িতে এসে ডাক দিলো, ‘জমিদার বাবু, ‘আমি মরণ আইছি। আম্নে আহেন।’ নাপিত মরণের ডাক শুনে জমিদার কার্তিক বাবু গোঁফদাড়ি ছাঁটতে বাড়ির উঠোনে এসে, দরজার বরাবর মুখ করে জলচকির পর বসলো। নাপিত বসলো জমিদার বাবুর সামনা-সামনি মুখ করে। নাপিতের সাথে ছোট একটা বাক্স। বাক্সের ভেতরে চুলদাড়ি কাটার খুর কেচি বাটি-সহ লম্বা একটা পশুর চামড়া। যা দিয়ে খুর ধার করে। বাক্স খুলে ভেতর থেকে ছোট পিতলের বাটিটা বের করলো। বাটিতে জল ঢেলে জমিদার বাবুর মুখে সাবান মাখলো। এরপর নাপিত যখন লম্বা চামড়ার সাথে খুরটা ঘষতে ছিল, তখন জমিদার বাবুর চোখ গেল দরজায় লাগানো জীবন বামনার লেখা কাগজের দিকে। তখন নাপিত খুর ঘষছে, আর জমিদার কার্তিক বাবু জীবন বামনার লেখাগুলো পড়ছে, “ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর।” নাপিত এখন মনে মনে ভয় পাচ্ছিল। নাপিত মনে মনে বলছে, ‘খাইছে আমারে, কার্তিক বাবু কি কইতাছে? কার্তিক বাবু কি আগেত্তে টের পাইয়া গেছে? চামড়ার লগে খুরডা ত আমি তিনবারই ঘষা দিছি। হিল্লাইগাই কার্তিক বাবু কইছে, ‘ঘষন্তি মাঝন্তি তিন খুর।’

এই ভেবে ভয়ে ভয়ে নাপিত মরণ শীল যখন মুখটা কালো করে ফেললো, জমিদার বাবু তখন দরজায় জীবন বামনার লাগানো কাগজের লেখা পড়ছে, ‘মুখ অতিশয় গম্ভীর।’ নাপিত মরন শীল এখন ভয়ে থরথর। এবার কাঁপতে কাঁপতে নাপিত মরণ শীল বাটি থেকে কয়েক ফোঁটা জল বামহাতের তালুতে দিয়ে খুরটা ডানহাতে ধরে যখন ঘষছিল, জমিদার বাবু তখন দরজায় জীবন বামনার লাগানো কাগজে লেখা পড়ছে, ‘শ্রী শ্রী বিশ্বপানি তুমি যাহা করিবা তাহা আমি জানি।’ জমিদার কার্তিক বাবু এই কথা বলার সাথে সাথেই নাপিত খুর ফেলে দিয়ে কার্তিক বাবুর পায়ে ধরে বলছে, ‘বাবু আমারে মাপ কইরা দেন। আমার কোনও দোষ নাই। ঐ গণেশ জমিদার আমারে এক হাজার টেকা জোর কইরা দিয়া কইছে আম্নের গলা কাইট্টা মাইরা হালাইতে।’ নাপিতের মুখে এই কথা শুনে জমিদার কার্তিক বাবু জলচকি থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। জমিদার কার্তিক বাবুর লোকজন এসে নাপিতকে ধরে বেধে ফেললো।

এরপর জমিদার কার্তিক বাবু জীবন বামনার লেখা কাগজটা হাতে নিয়ে বলছে, ‘আজ সকালে আমার বাড়িতে কে এসেছিল? তোমরা কেউ কি দেখেছ?’ একে একে বাড়ির সবাই বললো, ‘না।’ কার্তিক বাবু বললো, ‘তাহলো আমার ঘরের দরজায় এই কাগজটা লাগালো কে?’ এবারও বাড়ি সবাই বললো, ‘জানি না।’ এবার জমিদার কার্তিক বাবু ঢুলিকে আসতে খবর পাঠালো। ঢুলি আসলো। ঢুলি জমিদার কার্তিক বাবুর কাছে জানতে চাইলেন, ‘কী ঘোষণা দিতে হবে এবং কীভাবে বলতে হবে?’ জমিদার কার্তিক বাবু ঢুলিকে সব বুঝিয়ে দিলো। ঢুলি তাঁর ঢোল নিয়ে জমিদারের মুল্লুকে বের হলো।

ঢুলি কার্তিক বাবুর পুরো মুল্লুকে ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দিলো।, ‘আজ জমিদার কার্তিক বাবুর ঘরের দরজায় একটা কাগজ লাগানো ছিল। সেই কাগজের জন্য আজ জমিদার কার্তিক বাবুর জীবন রক্ষা পেল। কিন্তু এই কাগজটা কে লাগিয়েছে তা এখনো জানা যাচ্ছে না। তাই ঘোষণা দিচ্ছি যে, যিনি এই কাগজের টুকরোটি জমিদার কার্তিক বাবুর ঘরের দরজায় লাগিয়েছে, কেউ তাঁর সন্ধান দিতে পারলে তাকে নগদ এক হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। আর যিনি এই কাগজে লিখেছেন, তাকে দুই হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে, দমদমা-দম, দমদমা-দম, দম-দম-দম!

ঢুলি আবারও বলতে লাগলো, ‘আজ জমিদার কার্তিক বাবুর ঘরের দরজায় একটা কাগজ লাগানো ছিল। সেই কাগজের জন্য আজ জমিদার কার্তিক বাবুর জীবন রক্ষা পেল। কিন্তু এই কাগজটা কে লাগিয়েছে তা এখনো জানা যাচ্ছে না। তাই ঘোষণা দিচ্ছি যে, যিনি এই কাগজের টুকরোটি জমিদার কার্তিক বাবুর ঘরের দরজায় লাগিয়েছে, কেউ তাঁর সন্ধান দিতে পারলে তাকে নগদ এক হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। আর যিনি এই কাগজে লিখেছেন, তাকে দুই হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে, দমদমা-দম, দমদমা-দম, দম-দম-দম!

ঢুলির ঢোলের আওয়াজে অনেক মানুষে জড়ো হয়ে গেল। ঢুলি সবার উদ্দেশে বললো, ‘কাগজটি কে লাগিয়েছে, তার সন্ধান কেউ কি দিতে পারবেন? এ বিষয়ে কেউ কি কিছু জানেন? জানা থাকলে ঢোল ধরুন, পুরস্কার নিন!

কিন্তু ঢুলির এই ঘোষণায় উপস্থিত অনেকে জানি বলে ঢোল ধরে। যাঁরা ঢোল ধরে, তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় জমিদার কার্তিক বাবুর কাছে। জমিদার কার্তিক বাবু কাগজে লেখা বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে, তখন আর কেউ এর সদুত্তর দিতে পারে না। শেষমেশ কান ধরে ওঠবস করে ছাড় পেতে হয়। এরপর আর কেউ এই খবর শুনলেও ঢোল ধরার সাহস পায় না। কারণ, সত্যিকারের প্রমাণ কারোর কাছে নেই বলে। এভাবে দুইদিন গত হয়ে গেল ঢুলির ঢোল পেটানো। তারপরও এর কোনও সুরাহা মিলছে না। শেষতক এই খবর পৌঁছে গেল জীবন বামনার কানে। জীবন বামনা তখন আরেক মুল্লুকে থাকা এক মন্দিরে থেকে খেয়ে-না-খেয়ে দিন পার করছিল।

ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর–মুখ অতিশয় গম্ভীর-২ শেষ পর্ব

চলবে…