ট্যাগ আর্কাইভঃ মম চিত্তে নিতি নৃত্যে

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১২

প্রায় চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই ঢাকা ডমিস্টিক টার্মিনালে নেমে ভিতর দিয়ে ওরা আন্তর্জাতিক লাউঞ্জে এসে পৌঁছেই দেখে নিশাতের দাদি, মা বাবা সহ সব ভাই বোন এসেছে। নিশাত আরও যেন কাকে খুঁজছিল। এদিক ওদিক তাকাল কিন্তু
না কেউ কোথাও নেই। হাবিবের মা বাবা ভাই বোনদের দেখল। এগিয়ে এসেই দাদিকে সালাম করে নিলো। দাদি মাথায় হাত দিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। এই বয়সে তোকে একা একা বিদেশ যেতে হচ্ছে। দাদির কথা জড়িয়ে জড়িয়ে আসছিল। নিশাত দাদিকে বুকে জড়িয়ে শিশুর মত বোঝাল। যাবার সময় কেঁদে মন দুর্বল করে দিবেন না, মন ভালো আছে তাই থাকুক। শুধু শুধু তাকে কেন দুর্বল করছেন? এমন না যে, না গেলে চলবে, যেতে যখন হবেই তা হলে আর কান্না কাটি করে কি হবে? একে একে মা বাবা সবাইকে সালাম করে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে একটু আদর নিয়ে ছোট ভাই বোন দের বুকে নিয়ে আদর করে এদিক ওদিক কাকে যেন খুঁজে কাওকে না পেয়ে হাবিবকে নিয়ে এগিয়ে গেল চেক ইন কাউন্টারের দিকে। সাথের এনাম আর সালেক একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। ওরা সহ চেক ইন কাউন্টারে এসে টিকেট, সিডিসি দেখিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে নিলো। সাথে মালপত্র কিছু নেই শুধু সবার সাথে একটা করে হাত ব্যাগ। এর আবার কি ওজন হবে তাই মালামাল ওজনের ঝামেলা নেই। শুধু একটা ট্যাগ লাগানো। বোর্ডিং কার্ড নিয়ে আবার ফিরে এলো মা বাবার কাছে। আবার এক দফা সবাই মিলে বিচ্ছেদের গান গেয়ে মাইকে দুবাই যাত্রীদের প্লেনে আরোহণ করার ঘোষণা শুনে এগিয়ে গেল ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। ওখানে জেমস ফিনলে অফিসের ক্রু ডিপার্টমেন্টের বুড়ো ব্যাপ্টিস্টের দেয়া খাম আর সিডিসি দেখাল। ইমিগ্রেশন অফিসার খাম খুলে চিঠি দেখে সবার সিডিসিতে ঢাকা ডিপার্চার সিল দিয়ে ফেরত দিয়ে দিল। ওরা এগিয়ে বোর্ডিং লাউঞ্জে গেল। একটু পরে প্লেনে উঠে সীট নম্বর দেখে খুঁজে যার যার সীটে বসে পরল। সব যাত্রী ওঠা হলে যাত্রীদের সীট বেল্ট বাধার ঘোষণা। নিশাত এর আগে বাবা মায়ের সাথে অনেক বার ঢাকা করাচী বা করাচী ঢাকা বিমানে ভ্রমণ করেছে কিন্তু হাবিবের এই প্রথম, কাজেই হাবিব নিশাতের কাছে কাছে থাকছে।

একটু পরেই প্লেন ট্যাক্সিং করে রাতের ঝল মল ঢাকা শহরের বাতি গুলি নিচে রেখে নিজের ডানা মেলে পাখির মত আকাশে উড়ে গেল। নানা ভাবনার পর আবার সেই নিরু। প্লেন তো বীণা আপার বাড়ির উপর দিয়েই যাচ্ছে। ওখানে নিরু কি করছে এখন, ঘুমিয়ে পরেছে? হাতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ভাবল এখন কি ও রাত জেগে গল্পের বই পড়ছে নাকি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে? নিরু কি জানে এই প্লেনে কে যাচ্ছে?

৬।
সিরাজ চৌধুরী এক জন প্রভাবশালী ব্যক্তি। আশে পাশে দশ গ্রামে তার প্রতাপ। বিভিন্ন শালিস দরবার, আচার অনুষ্ঠানে সিরাজ চৌধুরী উপস্থিত না হলে সে অনুষ্ঠানের মান হানী হয়। গ্রামে যথেষ্ট জমি জমা, পাশের বাজারে বিশাল ব্যবসা। দেশ বিভাগের আলামত পেয়ে আগেই কোলকাতায় কাপড়ের যে ব্যবসা ছিল তা গুটিয়ে ভাইকে নিয়ে চলে এসেছিল। চল হাশেম এখন আর আমাদের এখানে থাকা ঠিক হবে না। গ্রামে ফিরে কোলকাতার ব্যবসার টাকা দিয়ে ঢাকায় কিছু জলা ভূমি কিনে রেখেছিল আজ যার দাম কোটি টাকার উপরে। বাকি টাকা দিয়ে স্থানীয় বাজারে একটা দোকান করেছে সেটা ছোট ভাই হাশেম দেখা শুনা করে। পৈতৃক জমিগুলি আগের মতই রাখাল চাকরেরা দেখে। দুই ভাই মিলে একান্নবর্তী সংসার। রাখাল চাকর, দোকানের কর্মচারী মিলে বাড়িটা একটা হাটের মত। বাড়িতে দৈনিক প্রায় এক মন চাউল না হলে চলে না। মাঝে মাঝে বাজারে ছোট ভাইকে সাহায্য করে। আশে পাশের যত দরবার শালিস করা আর বর্ষা এলেই লোহা কাঠের তৈরি জেলেদের মত এক মস্ত মাছ ধরার নৌকায় চেপে পদ্মার ইলিশ পাঙ্গাশ ধরার নেশা। এই নিয়েই তার দিন বেশ সুখে কেটে যায়। মাছ ধরার এমন কোন সামগ্রী নেই যা তার সংগ্রহে নেই। ও পাড়ার সুবল তার মাছ ধরার সঙ্গী বা সহকারীও বলা যায়। নৌকার যত্ন নেয়া, যন্ত্রপাতির যত্ন নেয়া গুছিয়ে রাখা এ গুলি সেই করে। কোথাও যাওয়া আসার পথে এক নজরে জমি জমা যা নজরে আসে তাই যথেষ্ট, বাড়িতে ফিরে বা ক্ষেতের আলে দাঁড়িয়ে প্রধান রাখাল জয়নুলকে বলে দেয় কি ব্যাপার জয়নুল মিয়া এই জমিতে কি আগাছার চাষ করেছ না কি বুনেছ কিছু বুঝতে পারছি না, পাশের জমিটা একটু দেখ ওর পিয়াজ গুলি কেমন সুন্দর হয়েছে আর তোমার এ অবস্থা হলে সংসার কোথায় যাবে? তাড়াতাড়ি নিড়ানি দেবার ব্যবস্থা কর।

বড় মেয়ে বীণার বিয়ে দিয়েছে ভাগ্নে কবিরের কাছে, ঢাকায় তার বাড়ি আছে, ভালো চাকরী করে বেশ সুখেই আছে। মেঝ মেয়ে নিরু গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে যায় আসে। পড়াশুনার চেয়ে বাবার মত মাতব্বরি করাতেই তার বেশি আগ্রহ। গ্রামের আর সব সম বয়সীদের নিয়ে তার সমাজ। তাদের মধ্যে বিচার সালিশ করা, ঝগড়া ঝাটির নিষ্পত্তি করা, গাছের মাথায় শালিকের বাসা থেকে বাচ্চা তুলে এনে পেলে পুলে বড় করা, সারা দিন এ গাছের ও গাছের ফল মুল পেড়ে বিলানো তার প্রধান কাজ। ওদের বাড়িটাও বেশ বড়, গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাড়ি বলা যায়। বাড়ির সামনে পিছনে দুই দিকেই রাস্তা। সামনের রাস্তা দিয়ে উঠে ডান পাশে সাবেক আমলের পরিষ্কার টলটলে জলের বিশাল এক ইঁদারা, তার একটু দুরেই পুরনো এক জাম গাছ, বাম দিকে একটু ভিতরে একটা কত বেল গাছ। চারি দিকে ঘিরে নারকেল, খেজুর, সুপারি এবং নানা জাতের ফলমূলের গাছ পালায় ঘেরা বাড়ি। পশ্চিমে চাচাত ভাইয়ের বাড়ি। পূর্ব দিকে পুকুরের পাড়ে ঈদগাহ, তাদেরই পূর্বপুরুষদের ওয়াকফ করে দেয়া। নিরুর গণ্ডি অবশ্য এর মধ্যেই সীমিত। পুকুরে ডুবানো নৌকা তুলে মাছ ধরাও তার বাবার মত এক নেশা।

বাবা পদ্মা থেকে মাছ ধরে ফিরে এসে বাড়ির ঘাটে পৌছার আগেই ডাক ছাড়ে কই রে মা নিরু আয় দেখ কি এনেছি। নিরু এসে দেখে নৌকা তখনো ঘাটে ভিড়েনি। তাতে কি, এক লাফ দিয়ে পানিতে নেমে সাতরে নৌকার কাছে যেয়ে হাত বাড়িয়ে বাবার হাত ধরে নৌকায় উঠে পাটাতন খুলে মাছ দেখে চিৎকার করে বাড়ির সবাইকে ডেকে অস্থির। ততক্ষণে সুবল ঘাটে ভিড়ে লগির সাথে নৌকা বেধে ফেলেছে। নিরুর চিৎকারে মা চাচী ভাই বোনেরা এসে ধরা ধরি করে মাছ গুলি ভিতরে নিয়ে গেল। এবার ভিতর বাড়ির পালা। নিরুর মা হাঁক ছাড়ল বারেকের মা তাড়াতাড়ি মশলা বাট।
এই নিরু এখন একটু বড় হয়েছে। গ্রামের পাঠশালা ছেড়ে ঝিটকা হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এক দিন স্কুল থেকে ফিরে দেখে অচেনা এক ছেলে চাচাত ভাই শিহাব আর বোন যুঁই এর সাথে শিহাবের ঘরে বসে সিনেমার নায়কদের মত সুন্দর ভাষায় কথা বলছে। কোঁকড়ানো চুল, সুন্দর চেহারা, পরিপাটি করে শার্ট প্যান্ট পরা। এই চেহারা তো আগে কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। মনে একটু বিস্ময় নিয়ে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাড়ির ভিতরে এসে বই খাতা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে এক দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে দাদির কাছে এসে জিজ্ঞেস করল
ওই যে ওই ঘরে মেঝ ভাই আর যুঁই আপার সাথে কথা বলছে ও কে?
কেন, তোর পছন্দ হয়েছে, ঘটক পাঠাবো?
তখনো সে এই ইঙ্গিতের পছন্দের মানে বোঝে না, ঘটক কে জানে না। তবে ওর মনে হলো ও যেমন সুন্দর খুঁজছে, যেমন সুন্দরের ছবি ওর মনে আঁকা আছে এ যেন সেই। আজ সেই ছবি যেন নিজের ঘরে খুঁজে পেয়েছে।

এ যে প্রকৃতির নিয়ম, যা একান্তই স্বাভাবিক। যে ভাবে এতো দিন ধরে এই পৃথিবীতে চলে এসেছে। অদৃশ্য ভালবাসা আর প্রেমের বন্ধন। যা কখনো কাউকে জানিয়ে ঢাক ঢোল পিটিয়ে আসে না। একান্ত নীরবে এসে ধরা দেয়। যা এখনো জীব জগতে সকল প্রাণীকে বিহ্বল করে রেখেছে। অদৃশ্য এক সুতার টান। নিরুও তার থেকে ভিন্ন কিছু নয়। নিরুর মাঝে কেমন যেন একটা পরিবর্তন এলো, মনটা কেমন যেন নাড়া দিয়ে উঠল।
আহা দাদু বল না ও কে? আগে তো ওকে কখনো দেখিনি।
দেখেছিস তোর মনে নেই, ওরা গ্রামে থাকে না। ওই পুরনো বাড়ির ফরিদের বড় ছেলে, ওর নাম নিশাত। তুই যখন খুব ছোট তখন দেখেছিস তোর মনে নেই।
ও আচ্ছা।
দাদিকে এ কথা বলে চলে এলো কিন্তু ওর মনে কেমন যেন একটা তৃষ্ণার্ত ভাবের উদয় হলো যা আগে কখনো হয়নি। কেন যেন আবার দেখতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু অবুঝ হলেও নারী মন তাই কোথা থেকে এক পাহাড় লজ্জা নেমে এসে সে ইচ্ছা থামিয়ে দিল। নিরু এই লজ্জার পাহাড় অতিক্রম করবে কি করে? একান্ন বর্তি সংসারে বড় হচ্ছে, বড় বোনদের দেখে আসছে তাদের কাছে এমন কিছু দেখেনি। যদিও এ বাড়ির আর সব মেয়েদের থেকে নিরু একটু ভিন্ন। তারা প্রায় সবাই ভীরু, নরম মেজাজের যেন মোমের পুতুল কিন্তু, নিরু তা নয়। সে তো অস্থির, দুরন্ত, চঞ্চল, দৌড়া দৌড়ী, লাফ ঝাপ হৈ চৈ যার স্বভাব। যেন চৈত্রের তপ্ত সূর্যের প্রখর তাপ। কিন্তু নিমেষের মধ্যেই নিরুর এ কি পরিবর্তন! নিরু দাড়িয়েই আছে। নিশাতের সাথে কথা বলার ফাঁকে যুঁই বেরিয়ে এলো ওর জন্য নারকেলের লাড়ু আর মুড়ি নিতে। বেরিয়ে দেখে দাদির পাশে নিরু দাঁড়িয়ে আছে।
নিরু, এক জগ পানি আর গ্লাস নিয়ে ও ঘরে রেখে আয়, আমি নাড়ু মুড়ি নিয়ে আসছি।

নিরু এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। কোন ভাবে পা টেনে রান্না ঘরে ঢুকে কলস থেকে এক জগ পানি ভরে ভালো করে একটা কাচের গ্লাস ধুয়ে এ ঘরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে রইল। যুঁই এসে ওকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল
কি রে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন, আয় ভিতরে আয়।
সামনে যুঁই আর তার পিছনে নিরু ঘরে ঢুকতেই নিশাতের চোখে পড়ল। ফর্সা এক কিশোরী হালকা আকাশী নীলের উপর কাল ছাপার ফ্রক পরনে, মাথায় দুই বেণী, তাতে ফুল করে ফিতে বাধা, চুল গুলি কিছুটা কুঞ্চিত মনে হলো। মানুষ এমন সুন্দর হতে পারে? আমি কি এই ছবি আঁকতে চাইছিলাম? এই কি সেই যে ছবি আমি এতো দিন ধরে কোথায় দেখেছি কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে? চোখের দিকে তাকিয়েই নিশাত বুঝতে পারলো এ মেয়ে দুরন্ত। সাধারণ নয়, অসাধারণ কিংবা আরও কিছু। শিহাবের সাথে কথা বলছিল হঠাৎ কথা থেমে গেল। এক পলকে ওর দিকে চেয়ে রইল। কে? ওদের বাড়ির কেউ নিশ্চয়, কিন্তু কে? ওদিকে এক হাতে পানির জগ আর এক হাতে গ্লাস নিয়ে নিরু ঘরে ঢুকে এক নজর নিশাতের দিকে তাকিয়েই নিরুপায় দুটো চোখ মাটিতে নামিয়ে এক ভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। অদৃশ্য নিয়তির লীলা ভূমিতে এর মধ্যেই একান্ত নীরবে রোপিত হলো দুটি মনের প্রথম প্রেমের একটা নতুন অংকুর যা ওরা কেউ বুঝতে পারলো না। নিশাতের মনে হলো বিধাতা কি একে আমার জন্য পাঠিয়েছেন? হ্যাঁ, এ তো আমার। ওদের এ ভাবে দেখে যুঁই বলল
কি রে নিশাত কি হলো?
নিশাতের কানে সে কথা গেল না। যে ভাবে কিশোরীকে দেখছিল তেমনিই তাকিয়ে রইল। সে কোন এক অচেনা দূর দেশে চলে গেছে যেখানে প্রবল এক চৌম্বক শক্তি ওর চোখ দুটিকে আটকে রেখেছে। নিশাতের অন্তরাত্মা চিরাচরিত এক সুরের মূর্ছনায় সম্মোহিত হয়ে গেল। নিরুও ঠিক তেমনই একই সুতার এ প্রান্ত আর ও প্রান্ত যেমন তেমনি বিমোহিত হয়ে দাড়িয়েই রইল। পানির জগ গ্লাসের কথা ভুলে গেল। এতো দিন কোথায় ছিল? শিহাব একটু ধাক্কা দিয়ে বলল
কি রে নিশাত কি হলো?
তখন নিশাত সম্বিত পেয়ে জিজ্ঞেস করল কি বললি, এ কে?
জুই বলল আমার চাচাত বোন, বীণা আপার কথা মনে আছে?
কোন বীণা আপা, ওই যে ঢাকায় থাকে? বীণা আপা!
হ্যাঁ।
তার ছোট বোন নিরু, আগে দেখেছিস এখন বড় হয়েছে তাই চিনতে পারছিস না।
ও আচ্ছা।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১১

নিশাত মনে মনে ভাবল আমরা দুই জনে আমাদের ডার্লিং এর সাথে দেখা করেই এসেছি।
ওরা বুড়োকে গুড নাইট জানিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে এলো। বুড়োর কাছে আসা যাওয়া করে এর মধ্যেই কিছু
ইংরেজি ভাব কায়দা শিখে নিয়েছে।
হাবিব বলল তাহলে আমরা এক জাহাজে থাকছি না?
তাইতো শুনলি।
আমি ভেবেছিলাম এক সাথে থাকব।
আমিও তো তাই ভাবছিলাম, ওই যে ওই লোকটার সাথে যখন কথা বলছিল তখন আমার সন্দেহ হলো তা হলে কি আমরাও দুই জায়গায় যাচ্ছি, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
চল এখন আর কোথাও যাব না বাসায় যাই।
হ্যাঁ তাই চল, রাত জাগার জন্য কেমন যেন ভালো লাগছে না, ওহ! দর্জির দোকানে যাবি না?
ও, হ্যাঁ তাইতো আমি ভুলেই গেছিলাম। চল, আরে ওইতো সামনেই, দেখেছিস?
আরে হ্যাঁ ওইতো! দেখেছি!
দর্জির দোকানে মাপ দিয়ে সেদিনের মত সোজা হাবিবের খালার বাড়ি এসে খালার কাছে সারা দিনের বিবরণ দিয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখে খেয়ে দেয়ে বিছানায়। সকালে উঠে হাবিব নিশাতকে নিয়ে কাছা কাছি যে সব আত্মীয় আছে তাদের সাথে দেখা করতে গেল। ওখান থেকে বিকেল চারটার আগেই এসে বুড়োর কাছে।
ও, তোমরা এসেছ বলেই হাতের ঘড়ির দিকে দেখেই বলল ভেরি গুড একে বারে জাস্ট টাইম। গুড! ভেরি গুড! তোমরা আগামী রবিবার বিকেলে ফ্লাই করছ। এখান থেকে ঢাকা তারপর দুবাই আর তুমি দুবাই থেকে লন্ডন। দুবাইতে হাবিব থেকে যাবে এজেন্ট নিয়ে তাকে জাহাজে পৌঁছে দিবে আর তুমি এবং তোমার সাথে আরও যে দুই জন আছে ওরা সহ গালফ এয়ারে লন্ডন। ওখানে গিয়ে ২/৩ দিন থাকবে পরে জাহাজ এলে তখন জাহাজে যাবে।
কোন দুই জন?
বস, ওরা একটু পরে আসবে। ওহ, তোমাদের ড্রেস কবে দিবে, কাল না পরশু?
কাল দিবে বলেছে।
গুড, তা হলে কাল ড্রেস নিয়ে নিও। এখন ওই জেমস রয়ের কাছে যাও ওখানে আর্টিক্যালে সই করে আবার এখানে এসো।
এই জেমস, শুনছ?
কোণায় বসা হালকা পাতলা খাট মত এক জন বুড়োর দিকে তাকিয়ে বলল
বলেন স্যার শুনছি।
এই যে এই দুই জ্যান্টল ম্যানের আর্টিক্যাল রেডি করেছ?
হ্যাঁ রেডি, আসেন ভাই আপনারা এদিকে আসেন
যাও ওনার কাছে।

জেমস রয়ের সামনে এসে বসল।
আপনাদের বাড়িতে কি মানি অর্ডার পাঠাতে হবে?
মানে কি, আমরা তো নতুন কিছু জানি না, একটু খুলে বলেন প্লিজ।
অফিসে এসে যেখানে যা কথা বলা দরকার হচ্ছে হাবিব নিশাতকে ঠেলে দিচ্ছে, তুই বল। সবার সাথেই নিশাত কথা বলছে, হাবিব শুধু ওর সাথে রয়েছে। এর মধ্যেই নিশাত বুঝে ফেলেছে এখানে সব বিদেশি কাজকর্ম, বিদেশি স্টাইল। সবাই কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ, সরি, প্লিজ এই সব বলছে।
আপনারা যখন জাহাজে থাকবেন তখন আপনাদের বাড়িতে টাকা পাঠাতে হলে আমরা সেটা মনিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিবো। ও ভালো কথা, আপনারা কি জানেন, আপনাদের পুরো বেতন কিন্তু জাহাজে পরিশোধ করবে না।
তা হলে?
ওখানে মুল বেতনের ৬০% দিবে আর বাকি ৪০% টাকা এখানে শিপিং অফিসে জমা হবে। আপনারা যখন সাইন অফ করে এখানে আসবেন তখন আমরা সে টাকা শিপিং অফিস থেকে এনে আপনাদের দিবো। এটাই নিয়ম। ওখানে যা পাবেন তা দিয়ে নিজের যা লাগে তা কেনা কাটা করতে পারবেন দরকার হলে ব্যাংক থেকে বাড়িতেও পাঠাতে পারবেন। আর এমনি যদি এখানে কিছু টকা লাগে মনে করেন তা হলে কার নামে কোন ঠিকানায় পাঠাতে হবে তা এই যে এই খাতায় লিখে দিন।
বলে একটা বড় হিসাবের খাতার মত একটা খাতা ওদের দিকে ঠেলে দিল। নিশাত হাবিবের সাথে আলাপ করে নিলো।
তুই কি করবি, তোর কি বাড়িতে টাকা লাগবে?
লাগবে না, তবুও কিছু দিয়ে যাই।
কত দিবি?
কি জানি কত পর্যন্ত দেয়া যায় জিজ্ঞেস কর দেখি কি বলে।
আচ্ছা জেমস সাহেব, কত টাকা পর্যন্ত দেয়া যায়?
৫০০ টাকার বেশি না।
তা হলে আমার দুইশ হলেই হবে।
আমার একটু বেশি দরকার, আমি তিনশ দেই।
ওরা ওই খাতার ছক অনুযায়ী সব পূরণ করে দিল।
এটা হয়ে গেলে জেমস রয় দুই জনের নামে দুইটা ভিন্ন বইয়ের মত বের করে দেখিয়ে দিল এখানে এখানে সই করেন।
নিশাত হাতে নিয়ে দেখল, ওই বইতে ওদের নাম ঠিকানা, আইডি নম্বর, পদ, বেতন, জাহাজের নাম, জাহাজ কোন বন্দরে রেজিস্ট্রি হয়েছে এমন নানা ধরনের তথ্য লেখা। সই স্বাক্ষর হয়ে গেলে জেমস বলল যান এবার ওখানে যান। এবার বুড়োর টেবিলে এসে দেখে অচেনা দুই জন বুড়ো ব্যাপটিস্টের সাথে কথা বলছে। ওরা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শুনেই নিশাত বুঝল এরা ওদের মত নতুন নয়। ব্যাপ্টিস্ট এবার নিশাতকে বলল এই যে এই দুই জন তোমার সাথে যাবে। এ হচ্ছে এনামুল হক, তোমাদের কুক আর এ সালেক মিয়া, টোপাস মানে তোমাদের ক্লিনার। এদের দায়িত্ব কিন্তু তোমার।
আচ্ছা ঠিক আছে এখন তোমাদের আর কোন কাজ নেই তোমরা পরশু সকালে এসে সব কিছু নিয়ে যাবে। এখন তাহলে গুড নাইট।
এমন সময় দরজার দিকে দেখে শিকদার সাহেব আসছে।
দাঁড়াও যেয়ো না দেখি শিকদার কোন খবর পেয়েছে কি না জেনে যাও।

শিকদার, এদের কনফার্মেশন পেয়েছ? শিকদার এদিকে এগিয়ে এসে বুড়োর হাতে কয়েকটা কাগজ দিল। বুড়ো সেগুলি দেখে বলল নাও তোমাদের ফ্লাইটের ডিটেইলস নিয়ে যাও। সবার হাতে যার যার একটা ফ্লাইট সিডিউল দিয়ে দিল। নিশাত দেখে আগামী রবিবার বিকেল ৫টায় চিটাগাং থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানে রাত ৯টায় দুবাই, দুবাই থেকে পরদিন রাত ৯টায় গালফ এয়ারে বাহরাইন হয়ে লন্ডন।
তা হলে আমরা কি এখন যেতে পারি?
ওকে মাই ডিয়ার, শনিবারে সকালে এসে সব কিছু নিয়ে যাবে আর ফ্লাইটের দিন দুপুর দুইটার মধ্যে এসে এখানে রিপোর্ট করবে, গুড নাইট।
গুড নাইট।
অফিস থেকে বের হতেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
নিশাত বলল, হাবিব আজ হলো মাত্র বুধবার তাহলে বাড়িতে একটা টেলিগ্রাম করে দেই, অন্তত ঢাকা এয়ারপোর্টে ওরা আসলে দেখা হবে।
হ্যাঁ চল টেলিগ্রাম অফিসে, দেখি খোলা আছে কিনা।
একটা রিকশা নিয়ে কাছের আগ্রাবাদ টেলিগ্রাম অফিসে গিয়ে হাবিব এবং নিশাত দুই জনেই নিজ নিজ বাড়িতে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিল, চিটাগাং থেকে আমাদের ফ্লাইট আগামী রবিবার বিকেলে, ঢাকা থেকে টার্মিনাল চেঞ্জ করার সময় কিছুক্ষণের জন্য দেখা হতে পারে, আপনারা সবাই ঢাকা এয়ারপোর্টে আসবেন। টেলিগ্রাম করে আবার আর একটা রিকশা নিয়ে মাদার বাড়ি খালার বাসায় ফেরার পথে বারেক বিল্ডিঙের কাছে এসে হাবিব নিশাতকে জিজ্ঞেস করল
কি রে নিশাত তোর কি হয়েছে আমাকে বলবি না?
নিশাতের কোন সারা নেই।
হাবিব আবার জিজ্ঞেস করল।
এবারেও নিশাত নিরুত্তর দেখে হাবিব নিশাতের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতেই নিশাত চমকে উঠে বলল
কি হয়েছে?
তুই কি এখনই লন্ডন চলে গেলি?
না।
তাহলে সেদিন থেকেই দেখছি তোর কোন কথা নেই এখনও দুই বার ডাকলাম কোন সারা নেই, কি ব্যাপার কি হয়েছে আমাকে খুলে বল।

নিশাত মনে মনে বলল না রে হাবিব আমি লন্ডন যাইনি। আমি যেখানে গিয়েছিলাম সে তোকে এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। যেখানে নিরু নামের এক চঞ্চলা দুরন্ত হরিণীর মত এক মেয়ে আছে, সারা দিন ছুটে বেড়ায়, গুন গুন করে গান গায় যার মনের কোন এক গহীনে আমার জন্য একটু খানি জায়গা আছে এবং আমি সে কথা বুঝতে পারি। সেদিন সে আমাকে বলেছে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।
হাবিব আবার তারা দিল, কি রে বলবি না?
না হাবিব কিছু হয়নি এমনিই ভাবছি কোথায় যাচ্ছি, কেমন হবে কি হবে এই সব।
তুই কি ভয় পাচ্ছিস?
আরে না, ভয়ের কি আছে, শুনলি না বুড়ো কি বলল, ওখানে এজেন্ট আছে না?
তাই বলে এমন মন খারাপ করে থাকবি না কি?
না মন খারাপ করলাম কোথায়?
এই যে কোন কথা বলছিস না, ডাকলে তার কোন জবাব দিস না। চল কাল তো কোন কাজ নেই, আলমাস হলে একটা সিনেমা দেখে যাই।
কাল?
হ্যাঁ, কাল দুপুরে বা সন্ধ্যার শো।
চল, দেখা যায়।
কথা বলতে বলতে খালার বাসা এসে গেল। বাসায় ঢুকে গত রাতের মত খালা খালুর সাথে আজ সারা দিনের ফিরিস্তি জানাল। ফ্লাইটের খবর শুনে হাবিবের খালাত ভাই বোনেরা সবাই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। পর দিন সকালে নাশতা খেয়ে আশে পাশে একটু ঘোরাঘুরি করা বাসায় ফিরে এসে দুপুরে খেয়ে আবার বের হলো আলমাস হলের দিকে। সিনেমা দেখে সন্ধ্যায় ফিরে এলো। যাবার আগে এক দিন পতেঙ্গা, ফয়েজ লেক আরও কোথায় কোথায় বেড়াল।

শনি বার সকালে এসে জেমস ফিনলের অফিসে বুড়োর সাথে দেখা করল। ওরা সবাই এসেছে। বুড়ো চা খাচ্ছে। নিশাতকে দেখে হ্যাল্লো ইয়াং ম্যান গুড মর্নিং!
গুড মর্নিং।
বুড়ো টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা একটা করে বড় খাম বের করে তার ভিতরে থাকা ওদের টিকেট, ঢাকা এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসারকে লেখা চিঠি এবং আরও কিছু প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র বুঝিয়ে দিয়ে বলল এগুলি সব সাবধানে রাখবে। তোমরা এই প্রথম দেশের বাইরে যাচ্ছ সাবধানে থাকবে, ওয়েল ড্রেসে থাকবে। আর শোন মেয়েদের দিকে কিন্তু ভুলেও তাকাবে না বলে একটু হেসে দিল। কি, বুঝেছ?, অল ক্লিয়ার?
ইয়েস অল ক্লিয়ার।
ও কে, তাহলে কমপ্লিটলি রেডি হয়ে ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ নিয়ে কাল ঠিক দুপুর দুইটায় এখানে এসে ওই শিকদার সাহেবের সাথে দেখা করবে। উনি তোমাদেরকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে।
হুট করেই শনিবার ফুরিয়ে গেল। রাতে নিশাতের চোখে ঘুম নেই। সারা রাত নিরু তার চোখের পাতা দিয়ে ধীর পায়ে কেমন একটা উদাস ছন্দে হেঁটে বেড়াল। গানের সুরে সুরে যেন কি কি বলেছে কিন্তু নিশাত তার কিছুই বুঝতে পারেনি শুধু কান পেতে দূর পাহাড়ের ঝর্ণাধারার তানের মত একটা সুর ওর কানে বেজেছে। মনে হচ্ছিল তুমি আমার তুমি আমার। চোখে ঘুমের কোন চিহ্ন নেই। সকালে হাবিব ডাকল
নিশাত উঠবি?
আমিতো উঠেই আছি।
উঠ, নাশতা করে সব গুছিয়ে নিই।

নিশাত উঠে হাত মুখ ধুয়ে খালার সাথে নাশতা খেয়ে হাবিবের সাথে এসে ব্যাগ থেকে সব কিছু বের করে আবার ভাজ করে কাপড় চোপর টুকি টাকি এটা সেটা সব গুছিয়ে সবার শেষে ক্রু ডিপার্টমেন্টের বুড়োর দেয়া প্যাকেট বের করে সিডিসি, আইডি কার্ড, টিকেট, চিঠি সব কিছু বুড়ো যে ভাবে বলে দিয়েছে সে ভাবে ভরে ব্যাগের পকেটে রেখে রেডি হয়েই বসে রইল। খালা আজ একটু তাড়াতাড়ি রান্না করে ওদের খাইয়ে দিলেন। বাসা থেকে একটায় বের হয়ে সময় মত অফিসে এসে পৌঁছে দেখে এনামুল আর সালেক মিয়া এখনো আসেনি। একটু অপেক্ষা করার পর ওরা এলো।
দুপুর তিনটা। সবাইকে নিয়ে অফিসের একটা বড় গাড়িতে শিকদার সাহেব চিটাগাং এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালেন। এখানে ডমিস্টিক এয়ারপোর্ট তেমন কিছু দেখল না। শুধু টিকেট দেখে মালামাল চেক করে বোর্ডিং কার্ড দিয়ে দিল। শিকদার সাহেব সবার সাথে হ্যান্ড সেক করে বুড়োর মত মাগনা কিছু উপদেশ দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল আর ওরা প্লেনে উঠে বসল। একটু পরেই বিমান বালার ঘোষণা শুনে বুঝল প্লেন টেক অফ করতে যাচ্ছে। ঘোষণা শেষ হবার সাথে সাথেই প্রায় প্লেন রান ওয়ে দিয়ে ট্যাক্সিং করে এক সময় সো করে আকাশে উড়ে গেল। সামনে নিচে বঙ্গোপসাগর পরে রইল। নিশাত আর হাবিব মাত্র সেদিন পতেঙ্গা এসে এই সাগর দেখে গেছে।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১০

নিশাত বেরিয়ে যাবার পর নিরু ভাবতে বসল মানুষটকে কতদিন ধরে দেখছি কিন্তু কখনও এমন পাগলামি করেনি আজ কি হলো? কাল নোমান ভাই না জেনে অমন কথা বললই বা কি করে, একটু ইশারা ইঙ্গিতে রেখে ঢেকে বললেও পারত। যাক যা বলেছে বেশ করেছে তবুও যদি মানুষটার একটু বোধোদয় হয়। এমন পরিস্থিতিতে সবাই কি করে? আশেপাশে কাওকে এমন দেখছি না। কি করি এখন? কি করি? কতদিন ধরেইতো পথ চেয়ে রয়েছি এই বুঝি আজ কিছু বলবে বা কাল কিছু বলবে। কি ভাবছে সে? আমি বলব? কেন প্রথমে কি মেয়েরা বলে? একটু এগিয়ে এলে কি হতো? কিছু না বলে একেবারে হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশে বসান? ঈশ বয়েই গেল! হুহ্! এতদিনে তার সময় হলো! ভেবেছিলাম ঢাকায় এলে মাঝে সাঝে দেখা হবে কিন্তু এ কি হলো? যাক যা হবার ভালই হয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন। কতদিন পরে আসবে বলল, নয় মাস না? হ্যাঁ তাইতো! এই নয়টা মাস দেখতে পাব না!

দেখতে দেখতে দিন কেটে গেল। আজ রবি বার। সকাল থেকেই বাড়িতে একটা হুলস্থূল ভাব। বাবা আজ ছুটি নিয়েছেন। সকালে নাশতা করেই বাজারে গেলেন নিশাতের প্রিয় ইলিশ পোলাও রান্নার জন্য ইলিশ মাছের সন্ধানে। দুপুরে ইলিশ পোলাও রান্না করলেন মা। ভাই বোন সবাই এক সাথে খাবার সময় আলাপ হলো। বাবা স্টেশনে যাবেন, সাথে মেঝ ভাইও যাবে। তবে হাবিব সহ সবাই এক সাথে যাবে, ওদিকে হাবিবের সাথে ওর মা বোন আর বাবাও যাবে।

রাত আটটায় মাকে সালাম করে ভাই বোনদের কোলে নিয়ে বুকে নিয়ে আদর করে নিশাত বাবা আর মেঝ ভাইয়ের সাথে হেঁটে হাবিবদের বাড়িতে চলে এলো। এসে দেখে ওরা রেডি। হাবিবের বাবা মা বোন সহ সবাই স্টেশনে যাবে। প্রায় সাড়ে নয়টায় কমলা পুর স্টেশনে পৌঁছে সবাই এক জায়গায় দাঁড়ালো। নিশাত আর হাবিব টিকেট নিয়ে এসে সবাইকে নিয়ে প্লাটফর্মে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকা চিটাগাং মেইলের একটা বগিতে দেখে শুনে সীট নিয়ে কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রেখে নেমে এলো। বাবা ভেজা চোখে কিছু উপদেশ দিলেন। নিশাত মনোযোগ দিয়ে শুনল। নিশাত আবার মেঝ ভাইকে কিছু উপদেশ দিল। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে, শেষ হুইসল দিয়ে দিয়েছে। প্লাটফর্মে আর দাঁড়াবার সময় নেই। উঠে সীটে বসে জানালা দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে রইল। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। প্লাটফর্ম থেকে ওরা সবাই ওদের দিকে চেয়ে আছে। ট্রেন আস্তে আস্তে কমলাপুর ছেড়ে চিটাগাং এর দিকে যাচ্ছে। এক সময় ওরা সবাই চোখের আড়াল হয়ে গেল। পিছনে রেখে গেল নিরুর সাথে শেষ কথার এক টুকরা উষ্ণ স্মৃতি “দরকার হলে আমি সারা জীবন আপনার জন্য অপেক্ষা করব” এইতো আর কি চাই! তবুও মনের ভয় যেতে চায় না! যদি কিছু হয়ে যায়! অন্তত যুঁই অথবা বীণা আপাকে একটু ইঙ্গিত দিয়ে আসলে হতো না? নানা কথা এলোমেলো ভাবে আসছে যাচ্ছে। সারা পথে নিশাতের মুখে কোন কথা নেই। হাবিব বার বার জিজ্ঞেস করছে
কি রে তোর মন খারাপ লাগছে? এমন চুপ চাপ রয়েছিস কোন কথা বলছিস না!
কি বলব, যাচ্ছি তো।
আরে, বিদেশে যাচ্ছি কোথায় একটু আনন্দ উল্লাস করবি তা না মুখ কেমন করে রেখেছিস।
নিশাত মনে মনে বলল তুই জানিস না আমি কি ছেড়ে যাচ্ছি। আমিতো যাচ্ছি কিন্তু প্রাণ যে এখানে রয়ে গেল!

সকালে চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছে একটা রিকশা নিয়ে হাবিব মাদারবাড়ি ওর খালার বাড়িতে এলো। এখানে নিশাতকে কেউ চিনে না। হাবিব খালা খালু সবাইকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ওদের চট্টগ্রাম আসার উদ্দেশ্য জানাল। খালা খালু সবাই বেশ খুশি। হাত মুখ ধুয়ে আসার পর খালা তাড়াতাড়ি নাশতা এনে দিলেন। নাশতা খেয়ে আগ্রাবাদ জেমস ফিনলে অফিসে এসে ওদের নিয়োগ পত্র দেখালে বুড়ো ব্যাপ্টিস্টের টেবিল দেখিয়ে দিল। তার কাছে গিয়ে বলল আমরা এসেছি। বুড়ো কি এক ফাইল দেখছিল। ওদের দিকে তাকিয়ে বসতে বলল। একটু পরে ফাইল রেখে বলল
ইয়েস ইয়াং মেন্স হোয়াট কেন আই ডু?
ওরা আবার এই বুড়োকে নিয়োগ পত্র দেখাতে বুড়ো লাফ দিয়ে বলে উঠল
ওহ! ইউ আর হেয়ার, গুড! ভেরি গুড! তোমরা জান তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
না।
তোমরা লাকি ইয়াং ম্যান, ডাইরেক্ট ব্রিটিশ জাহাজে যেতে পারছ, আপাতত লন্ডন যাবে, ওখান থেকে জাহাজে উঠবে।
কবে যেতে হবে?
দাড়াও, তোমাদের সিডিসি বানাতে হবে, টিকেট করতে হবে এমন আরও কিছু কাজ আছে সেগুলি হলে তখন বলতে পারব। মনে হয় ৩/৪ দিন লেগে যাবে। তোমরা রেডি হয়ে এসেছ?
হ্যাঁ, আমরা বাড়ি থেকে রেডি হয়েই এসেছি।
এখানে কোথায় থাকছ?
হাবিব বলল মাদারবাড়িতে আমার খালার বাড়ি।
দেখ, থাকার কোন অসুবিধা হলে সিম্যান হোস্টেলে থাকতে পার।
না কোন অসুবিধা নেই।
গুড।
তাহলে তোমাদের সাথে ছবি আনতে বলেছিলাম তা এনেছ?
হ্যাঁ এনেছি।
বলে ওরা দুই জনেই পকেট থেকে ছবি বের করে দিল।
না আমাকে সব গুলি দিতে হবে না একটা করে দিলেই হবে শুধু আইডি কার্ড বানাবার জন্য, অবশ্য আইডি কার্ড শিপিং অফিস থেকেও একটা দিবে, তোমদেরকে এখন শিপিং অফিসে পাঠাচ্ছি বাকিগুলি ওখানে লাগবে। আচ্ছা তোমরা একটু বস, আমি শিপিং অফিসের জন্য চিঠি রেডি করে নেই।
আচ্ছা ঠিক আছে।

বুড়ো পাশের এক জনকে ডেকে বলল এদের জন্য দুইটা চিঠি টাইপ করে নিয়ে আস।
আধা ঘণ্টার মধ্যে চিঠি নিয়ে এলে বুড়ো নিয়ে গেল তার বসের কাছে স্বাক্ষরের জন্য। একটু পরেই এসে দুই জনকে খামে ভরা দুইটা চিঠি দিয়ে বলে দিল রাস্তার ওপাশে যে সিজিও বিল্ডিং ওর চার তলায় শিপিং অফিস, তোমরা এই চিঠি নিয়ে ওখানে যাও। ওরা সিডিসি বানিয়ে দিবে।
সিডিসি কি?
পাসপোর্ট চেন?
হ্যাঁ চিনি।
এটাও ওই পাসপোর্টের মত, জাহাজে চাকরীর জন্য পাসপোর্টের পরিবর্তে সিডিসি ব্যবহার হয়। আচ্ছা যাও দেরি করো না তাড়াতাড়ি যাও।
ওরা দুই জনেই অফিস থেকে বের হয়ে ব্যাপ্টিস্টের কথা মত শিপিং অফিসে যেয়ে চিঠি দেবার পর ওরা কয়েকটা কাগজে সই স্বাক্ষর, টিপ, রেখে উচ্চতা ইত্যাদি মেপে বিকেল ৪টায় আসার জন্য বলে দিল। ওখান থেকে বের হয়ে আবার ব্যাপ্টিস্টকে জানাল। ঠিক আছে তোমরা বিকেলে ওটা নিয়ে তারপরে এসো। এর মধ্যে তোমাদের আর কিছু করার নেই।
ওখান থেকে বের হয়ে হাবিব বলল
চল, মামার বাড়ি যাই।
নিশাত চট্টগ্রামের কিছু চিনে না। হাবিবদের বাড়ি চট্টগ্রাম বলে ওর আত্মীয় স্বজনেরা অনেকেই এখানে।
চল।

হাবিবের মামা বাড়ি থেকে সরাসরি বিকেল ৪টার মধ্যে শিপিং অফিসে এসে হাজির। যার সঙ্গে কথা হয়েছিল সে একটা রেজিস্ট্রি বইতে স্বাক্ষর নিয়ে দুই জনকে সিডিসি আর আইডি কার্ড দিয়ে দিল। ওখান থেকে বের হয়ে আর কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বই খুলে দেখছে এটা কি দিল। আইডি কার্ডে লেখা দেখল বাংলাদেশি নাবিকের পরিচয় পত্র। সিডিসি খুলে দেখে ওদের যাবতীয় বিবরণ লেখা সহ পাসপোর্টের মত একটা বই। ওই বই নিয়ে ব্যাপ্টিস্টের অফিসে এসে বুড়োর হাতে দিল। বুড়ো বলল ওকে মাই ডিয়ার, তোমরা এখন চলে যাও আমি কাল সকালে তোমাদের ফ্লাইট বুকিং করতে দিবো। এই যে এই ঠিকানা নিয়ে যাও এটা একটা টেইলরএর দোকান ওখানে গিয়ে এই চিঠি দিবে ওরা তোমাদের পোশাকের মাপ রাখবে। আগামী কাল বিকেলে এসে আর্টিক্যালে সই করবে আর ফ্লাইটের সময় জেনে পরে কি করতে হবে সে সব ওই যে শিকদার সাহেব বসে আছে তার কাছে জেনে যাবে, উনিই তোমাদের নিয়ে এয়ারপোর্টে যাবে।
নিশাত জিজ্ঞেস করল একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
কি কথা?
আমরা দুই জনে কি একই জাহাজে থাকব?
নো নো মাই ডিয়ার, তুমি যাবে লন্ডন আর ও যাবে দুবাই, তবে এখান থেকে তোমরা এক সাথে দুবাই পর্যন্ত যাবে। আরও দুই জন আছে তারাও তোমাদের সাথে যাবে।
ও দুবাই আর আমি লন্ডন কেন?
ওর জাহাজ দুবাইতে রয়েছে আর তোমার জাহাজ ডান্ডি থেকে সেইল করে লন্ডন আসছে মেরামত করার জন্য ওখানে পৌছাতে কয়েক দিন লাগবে, তাই তুমি লন্ডন যাবে। ভয় পেয়ো না ওখানে সব জায়গায় আমাদের এজেন্ট আছে তারাই তোমাদের দেখা শুনা করবে। এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করা থেকে হোটেলে থাকা এবং জাহাজে তুলে দেয়া পর্যন্ত সব তারা করবে। তোমাদের এ নিয়ে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। আর কিছু?
না ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের যোগাযোগ হবে না?
হ্যাঁ তা হবে যদি কখনো তোমাদের জাহাজ এক পোর্টে আসে তখন দেখা হবে না হলে কাছাকাছি থাকলেও ভিএইচএফে কথা বলতে পারবে।
তা হলে এখন যাও ডার্লিং এর সাথে দেখা করগে। আগামী কাল বিকেল ৪টার মধ্যে চলে এসো। মনে থাকে যেন।
হ্যাঁ মনে থাকবে।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৯

নিরু ঝিটকা স্কুল থেকে পাশ করে বের হলো। এখন ধানমন্ডিতে বড় বোনের কাছে থেকে লালমাটিয়া কলেজে পড়বে। বাড়ি থেকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। নিরুর বাবা, বড় বোন আর নিশাতের দাদি আর মা একসাথে ঢাকা আসছিল। গাড়িতে নিরুর চোখের দিকে তাকিয়ে অনেকদিন পরে এই প্রথম নিশাত একটু অবাক হলো। এইতো এই চোখ আমি খুঁজছিলাম এতদিন! নিরু বড় হবার পর এত কাছে থেকে নিরুকে দেখার সুযোগ হয়নি এতদিনেও। আজ কাছে পেয়ে নিরুর চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। এতদিন এই চোখ কোথায় ছিল? যে চোখে প্রশান্ত মহা সাগরের গভীরতা! যে চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই কাটিয়ে দেয়া যায় সারাটা জীবন! অবাক হয়ে চেয়ে ছিল পলক হীন। মানুষের অবস্থার পরিবর্তনের সাথে মানুষের ঋতু পরিবর্তনের সাথে তার মনের অনেক পরিবর্তন হয়। নিশাত এতদিন যেমন ছিল আজ আর তেমনটি নেই। আজ সে চাকরী নিয়ে লন্ডনের যাত্রী। নিরুকে এতদিন মনে মনে ভাল লাগলেও তা কেমন করে যেন কিসে চাপা পড়ে ছিল কিন্তু আজ সে লন্ডনের যাত্রী বলে তার দৃষ্টি ভঙ্গি বদলে গেছে। সে নিরুর চোখের চাওনি বা চোখের গভীরতা নিরূপণ করতে পারছে। মানিকগঞ্জে এসে গাড়ি থামিয়ে কিছু খাবার আর বীণা আপার ছোট বাচ্চার জন্য কি যেন কিনতে হবে বলে বীণা আপা গাড়ি থামতে বলল। নিশাতের মা নিশাতকে পাঠাল, বীণা আপাও বলল নিরু তুই যা ওর সাথে ও চিনতে পারবে না। এমন কি আনবে যে নিশাত চিনে আনতে পারবে না! যে কিনা মাত্র কয়েকদিন পরে একা একা লন্ডন যাচ্ছে সেই ছেলে আনতে পারবে না? নিশাতও নিষেধ করল না। সাথে নিরু আসছে বলে কোন প্রতিবাদ করেনি। নবীন সিনেমা হলের পাশে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল আর গাড়ির সবাই নেমে একটু হাত পায়ের জড়তা ছাড়াচ্ছিল। ওরা রাস্তা পার হয়ে গড়পাড়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কাছে যেতেই একটা মোটর সাইকেল হুট করে নিশাতের পাশে এসে ব্রেক করল। আরোহী পিছন থেকে নিশাতের কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করল
এই বাঙালি, কোথায় যাচ্ছিস?
নিশাত দাঁড়িয়ে পড়ল, নিশাতকে দেখে নিরুও দাঁড়াল। নিরুকে দেখে মটর বাইকের আরোহী নোমান বলল
কিরে তুই বিয়ে করলি কবে?
বিয়ে! কি বলছিস?
ফিসফিস করে বলল তাহলে এ কে?
এই চুপ! আস্তে করে বলল, সর্বনাশ করে ফেলেছিস! এ হলো শিহাবের ছোট বোন নিরু, ও লালমাটিয়া কলেজে ভর্তি হবার জন্য ঢাকা যাচ্ছে, ঐযে গাড়িতে সবাই আছে, আমরা কিছু কেনার জন্য নেমেছি
নোমান ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলল সরি দোস্ত, কিছু মনে করিস না
না কি মনে করব! মনে মনে ভাবল তোর কথা যেন সত্যি হয়!
নোমানকে দেখিয়ে বলল নিরু এ আমাদের বন্ধু নোমান, শিহাব চেনে
নিরু নোমানকে সালাম দিয়ে বলল ভাই আপনার বাড়ি গোপীনাথপুর না?
হ্যাঁ, তুমি আমাকে চেন?
খুব ভাল করেই চিনি, আপনি ঊর্মির ভাই না? আমি ঊর্মির সাথেই পড়েছি, ও কোথায় ভর্তি হবে ভাইয়া?
ও এখানেই দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি হয়েছে
ও আচ্ছা, আমার কথা বলবেন, আমি ঢাকা যাচ্ছি, বড় আপার কাছে থাকব
নিশাতের লন্ডন যাবার ঘটনা নিয়ে নোমান আরও কিছু আলাপ করে নিশাতের লন্ডন যাত্রা আর জাহাজে চাকরীর কথা জেনে খুশী হয়ে বিদায় নিল।
নোমানকে বিদায় দিয়ে নিশাত বলল শুনেছ ও কি বলেছে?
নিরুর মুখ লাল হয়ে গেল, মাথা নিচু করে দাড়িয়েই রইল
মনে মনে ভাবল এ আবার কেমন মানুষ! এমন কথা কাউকে বলা যায়? না জেনে সে না হয় ভুল করেই ফেলেছ তাই বলে…………।
আচ্ছা দাড়াতে হবে না চলো
এইতো নোমানের এই কথায় মনে হয় এতদিনে ওরা দুই জনে মন দেয়া নেয়ার চিরাচরিত মহান কাজটা ওদের অজান্তে একান্ত নীরবে সেরেই ফেলল তবে নিরু এখনও বুঝতে পেরেছে কি না সে একটা সংশয় হয়ে রইল। সেদিন একটা বেকারিতে খাবার কিনতে কিনতে নিরুই প্রথম কথা বলল,
তাহলে আপনি লন্ডন চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ
আবার কবে ফিরবেন?
নয় মাস পরে, ফিরে আসলে আমাকে চিনতে পারবে?
পারব, আপনাকে এত দিন ধরে চিনি, এই কয় দিনেই ভুলে যাব? কি যে বলেন না!
আর সাধারণ কিছু টুকিটাকি কথাবার্তা হয়েছিল। সেদিন বেশি কিছু বলার সময় পায়নি বা সুযোগও হয়নি। সময় পেয়েছিল ঢাকায় যাবার পরে।

৫।
ঢাকায় পৌঁছে নিশাতদের বাড়ির পাশে ওদের নামিয়ে দিয়ে বীণা আপা নিরু আর চাচাকে নিয়ে চলে গেল। রাস্তায় চাচা নানা কথা জিজ্ঞেস করছিল কি চাকরী কেমন করে কোথায় থাকবে ইত্যাদি নানা কিছু। চাচা বেশ খুশি হয়েই বলেছিল যাক বাবা আমাদের গ্রামের মধ্যে তুমিই প্রথম লন্ডন যাচ্ছ কাজেই বাবার মান সম্মানের দিকে খেয়াল রেখো। ও ছোট বেলা থেকেই অনেক কষ্টে বড় হয়েছে, বাবা মায়ের সুখ শান্তির দিকেও লক্ষ রেখ।

বাড়িতে পৌছার একটু পরেই হাবিব এলো।
কিরে তোকে এমন চিন্তিত মনে হচ্ছে না কি ভুল দেখছি?
না চিন্তার কি আছে, কিছু চিন্তা করছি না। বল তোর কি অবস্থা, সব কিছু গুছিয়েছিস?
হ্যাঁ আমার মোটা মুটি কমপ্লিট, তোর কত দূর?
এই তো পরশু দর্জির কাছে কাপড়ের মাপ দিয়ে গ্রামে গিয়েছিলাম। দাদুর সাথে দেখা করে তাকে নিয়ে এইমাত্র আসলাম তবে এবার গ্রামে যেয়ে…………
এই পর্যন্ত বলেই থেমে গেল, মুখে আর কোন সারা নেই।
কি, গ্রামে যেয়ে কি?
না কিছু না।
না, কিছু একটা আছে তুই বলতে গিয়েও থেমে গেলি কেন?
না হাবিব কিছু না। আচ্ছা, তুই কবিতার সাথে দেখা করেছিস?
ও! বুঝেছি, তোরও এমন কেউ আছে, এত দিন কিছু বলিসনি কেন?
আমি কি বলি আর তুই কি বলিস?
হ্যাঁ গত কাল দেখা হয়েছে, কিন্তু তোর কথা কি বল।
নারে আমার তেমন কোন কিছু নেই।
আলাপ আর তেমন এগোয়নি। মা এসে গেল।
কি হাবিব, তোমার কি অবস্থা, সব কিছু গুছিয়েছ?
হ্যাঁ খালাম্মা।

সামনে আর মাত্র দুএক দিন বাকি। বাড়িতে ছোট ভাই বোনেরা আনন্দে বিভোর। দাদা বিদেশে যাবে। মা এটা সেটা যা নিশাতের পছন্দ তাই রান্না করছেন। সূর্য তার নিয়ম মত ডুবছে উঠছে। নিশাতের মনের বিষণ্ণ ভাব যাচ্ছে না। মা দেখে ভাবলেন কোন দিন বাড়ির বাইরে থাকেনি এখন হয়ত সবাইকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলে মন খারাপ তাই এক দিন সন্ধ্যায় নিশাতকে ডেকে বোঝালেন।
কি করবে বাবা যে বয়সে আর দশটা ছেলে বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করে সেই বয়সে তোমাকে রুজির সন্ধানে দেশের বাইরে যেতে হচ্ছে বলে মন খারাপ করে থেকো না। ওখানে গিয়ে আমাদের জন্য চিন্তা করবে না। মন দিয়ে কাজ করবে, সবার সাথে মিলে মিশে থাকার চেষ্টা করবে,
ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এ সব কথা নিশাতের কানে কিছু ঢুকছে আর বেশির ভাগই পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। মা জানে না নিশাতের কিসের ভাবনা।

পরদিন বিকেলে বীণা আপার বাড়িতে এলো। যাবার আগে দেখা করে যাবার উছিলায়। নোমানের ওই কথা বারবার মনে পরছে। আবার নিরু কি ভাবল জানা হলো না। কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নিরুই দরজা খুলে দিয়েছিল।
আপনি!
হ্যাঁ আমি! চাচা কোথায়?
আমাকে ভর্তি করে দিয়ে তখনই বাবা বাড়ি চলে গেছে
ও আচ্ছ তুমি তাহলে ভর্তি হয়েছ?
হ্যাঁ
সেদিন, এত দিন পরে নিরুর সাথে দেখা হলো কিন্তু তেমন কিছুই আলাপ হলো না। নোমানের ওই কথার পর থেকেই মনে হতে শুরু করেছে যেন নিরু এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। চোখে মুখে কোন এক অচেনা মায়াবী ছাপ পড়েছে দেখতে আরও সুন্দর হয়েছে। এত দিনের চেনা সেই নিরু আর নেই এখন নিরুর চোখ কথা বলতে শিখেছে। চোখে ফুটে উঠেছে প্রশান্ত মহাসাগরের অতল গভীরতার ছায়া। এত দিনের নিরু আর আজকের নিরুর মধ্যে অনেক তফাত। আজকের নিরু পরিপূর্ণ এক নারী। তার স্বত্বায় জেগে উঠেছে নারী হৃদয়ের মমতা, প্রেম। এই নিরু কি নিশাতের জন্য অপেক্ষা করবে?
কি হলো! ভিতরে যেতে দিবে না? বলেই ঘরে ঢুকে নিরুর হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে সোফায় বসল। ভিতর থেকে বীণা আপা জিজ্ঞেস করল কে রে নিরু? অপ্রত্যাশিত প্রথম স্পর্শের ঘোর কাটিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে ভিতরে যেতে যেতে বলেছিল আপা নিশাত ভাই। মেয়েদের যে ষষ্ট ইন্দ্রিয় থাকে তাই দিয়ে অনুভব করে মনে মনে ভাবছিল হঠাৎ করে এই মানুষ এমন হলো কেন? তবে যাই হোক, এই আকর্ষণে কোন ইতর ইঙ্গিত নেই, কোন লালসা নেই, বরঞ্চ একটু কেমন যেন নির্ভরতার ছোঁয়া আছে। দেখা যাক সামনে কি হয়!
ওকে ভিতরে নিয়ে আয়
বসার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে পিছনে ঘুরে ইশারায় বলল আপা ডাকছে
নিশাত উঠে ওর পিছে পিছে আপার সামনে হাজির হলো। আমি কাল চিটাগাং চলে যাচ্ছি ওখান থেকে কয়েকদিনের মধ্যে চলে যাব হয়ত ঢাকায় আসা নাও হতে পারে আপা, দুলাভাই কোথায়? তোর দুলাভাই এখনও আসেনি
নিরু পাশেই ছিল, সব শুনল।
তাহলে আমি ওই ঘরে বসি?
যা বয় আমি আসছি
নিরু, ওকে চা নাস্তা দে। একটু পরে কাঁপা হাতে ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে নিরু যখন ট্রে নিয়ে বসার ঘরে এলো তখন নিরুর হাত কাপতে দেখে নিশাত উঠে ট্রেটা নামিয়ে নিচ্ছিল কিন্তু নিরু ফিরে যাবার জন্য ঘুরে দাড়াতেই অন্য হাতে ওকে টেনে দাড় করিয়ে হাতের ট্রে নামিয়ে আবার ওকে নিয়ে পাশে বসল।
পালাচ্ছিলে কেন? কাল নোমান কি বলেছিল শুননি?
আমার ভয় করছে, ছেড়ে দেন আপা দেখে ফেলবে
নিরুর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এবার মোটামুটি নিশ্চিত হলো এই আকর্ষণে নিরাপত্তার অভাব নেই, নির্ভরযোগ্য। এতদিন যার অপেক্ষা করেছে এ সেই হাত।
আপা দেখল তো কি হলো? আপারও এমন দিন গেছে, সে জানে
আজই এর একটা সমাধানে পৌছাতে হবে! এ ঘরে নিরুকে একা পেয়ে নিশাত জোর করে পাশে বসিয়ে সেই কথা কানে কানে বলছে। নিরু কি ভাবছে সে কথা বোঝার মত ধৈর্য বা জ্ঞ্যান কোনটাই নিশাতের ছিল না। নিশাতের হাতে বাধা পড়ে নিরু শুধু ভাবছিল এই মানুষটা হঠাৎ করে এমন পাগল হয়ে গেল কেন? যাকে সেই ছোট বেলা দেখে আসছি সেতো কোনদিন এমন ছিল না! শান্ত সৌম্য সহজ সরল একজন সুপুরুষ কিন্তু আজ কি হলো? কাল চলে যাচ্ছে বলে? যতক্ষণ নিশাত নিরুর হাত ধরে রেখেছিল ততক্ষণ বারবার উঠি উঠি করছিল।
আহ! ছাড়ুনতো! আপা এসে দেখে ফেলবে!
না, তুমি বল তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না!
ছাড়ুন না! আপা দেখে ফেললে কি হবে ভেবেছেন?
কিচ্ছু হবে না তুমি বল তুমি অপেক্ষা করবে!
ছাড়া পাবার জন্য মুখে যা আসে নিরু তাই বলে ফেলল,
দরকার হলে সারা জীবন আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব! এবার ছাড়ুন!
আস্বস্ত হয়ে নিশাত এবার নিরুকে ছেড়ে দিল। কোন রকম নিজেকে ছাড়িয়ে নিরু বলল
আজ কি হয়েছে আপনার, এমন ডাকাতের মত করলেন কেন? অমনিই পিছনে আপার পায়ের শব্দ পেয়ে পিছনে ফিরে দেখে আপা পর্দা সরিয়ে ভিতরে আসছে।
আপা, দুলাভাইয়ের আসতে দেরি হবে আমার আবার অনেক জায়গায় যেতে হবে আমি বরং উঠি আপনি দুলাভাইকে বলবেন আমার জন্য দোয়া করতে।
আর একটু বসে দেখ
দুলাভাইকে বলা তেমন জরুরী না। নিশাতের যা জানার তা জেনে ফেলেছে কাজেই
না আপা, আমাকে অনেক জায়গায় যেতে হবে, বলেই উঠে পরল।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৮

খালাম্মা আমি বাড়ি যাই, হাবিব এলে আমাদের বাড়ি যেতে বলবেন
বিকেলে হাবিব এলো। দুই বন্ধু একে অপরকে জড়িয়ে কোলাকুলি করে বলল
আমি সাতার জানি না বলে মা রাজী হচ্ছে না। দেখ তুই একটু বুঝিয়ে দেখ কোন লাভ হয় না কি। তারপর রাতে
আব্বার সাথে কথা বলে দিন ঠিক করতে হবে তুইও খালুর সাথে আলাপ করে কি বলে কাল সকালে এসে জানাবি।
আচ্ছা আমি খালাম্মাকে বুঝাই। দেখি কি বলে।
একটু পরে হাবিব এসে জানাল না রে নিশাত খালাম্মা রাজী হচ্ছে না।
আচ্ছা আব্বা আসুক দেখি সে কি বলে। তুইও দেখ খালু কি বলে। কাল আবার আসবি।

কাল সকালেই হাবিব এসে হাজির।
কিরে খালু কি বলল, খালু কি খুশি হয়েছে?
হ্যাঁ আব্বা আম্মা সবাই খুব খুশি, তোর খবর কি?
মা রাজী হচ্ছিল না আব্বা বুঝিয়ে কোন রকম রাজী করিয়েছে তবে আব্বা খুশি হলেও চিটাগাং গিয়ে কোথায় থাকব সেই চিন্তা করছে।
এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই আমি আমার খালার বাড়ি থাকব, তুইও আমার সাথে থাকবি। তাহলে কবে যাবি ভাবছিস?
কিছু গোছ গাছ করতে হবে তা ছাড়া আব্বা কবে চিটাগাং যাবার ভাড়া যোগার করতে পারে তা ঠিক দেখে নিই আগে। আমার বাবার তো তোর বাবার মত অবস্থা না, তাকে একটু চেষ্টা করতে হবে। তবে আমার মনে হয় মোটা মুটি আগামী রোববারের মেইল ধরে গেলেই হবে। তোর কি মনে হয়?
হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছি।
তা হলে দেখি আজ আব্বার সাথে একটা ফাইনাল ডিসিশন নিতে হবে, কি বলে না বলে আমি কাল তোকে জানাব।
ঠিক আছে তা হলে আমি এখন আসি।

সেদিন রাতে খাবার পর বাবা নিজেই জিজ্ঞেস করলেন। কবে গেলে সুবিধা হবে।
ওরা আগামী ২৩ তারিখের মধ্যে যেতে বলেছে কিন্তু আমার মনে হয় একটু আগে যেতে পারলেই ভালো। তাই ভাবছি আগামী ২১ তারিখে রবিবারের রাতের মেইলে যেতে পারলে হয়। হাবিব বলল ও ওর খালার বাড়ি থাকবে আমিও ওখানে ওর সাথে থাকতে পারব।
তা হলে ঠিক আছে তাই কর, দেখি এর মধ্যেই টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
নিশাতের মা বলল
যাবি যখন তোর মেঝ মামার সাথে দেখা করে বলে আয় দেখ ও কি বলে।
তাহলে সকালেই যাই?
যেতে চাইলে যা।
মায়ের মুখে কথাটা শুনে নিরুর কথা মনে হলো। নিরুর সাথে দেখা করতে হলে গ্রামে যেতে হবে কিন্তু গ্রামে যাবার সুযোগ একমাত্র দাদুর সাথে দেখা করা। এছাড়া গ্রামে যাবার কোন অজুহাত নেই!
আম্মা, গ্রামে যেয়ে দাদুর সাথে দেখা করব না?
হ্যাঁ অবশ্যই করবি। চল কাল যেয়ে আম্মার সাথে দেখা করিয়ে নিয়ে আসি!
হ্যাঁ আম্মা তাই ভাল হবে
সকালে উঠে নিশাত কাপড় বদলে মতিঝিলে মামার অফিসে চলে গেল। মামা অফিসে কি একটা জরুরী মিটিঙে ব্যস্ত।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মামা এসে নিশাতকে দেখেই জিজ্ঞেস করল
কি রে, কি ব্যাপার এখানে এসেছিস?
মামা একটা ভালো সংবাদ আছে তাই মা বলল তোর মামার সাথে আলাপ করে আয়, তাই এলাম।
কি খবর?
আমি আর আমার বন্ধু হাবিব বিদেশের জাহাজে চাকরী পেয়েছি।
বাহ! বেশ ভালো কথা, তা দুলাভাই আপা কি বলে?
নিশাত এক এক করে সব বলল আর সাথে করে আনা নিয়োগ পত্রটা দেখাল।
মামা নিয়োগ পত্র পড়ে খুব খুশি। চিন্তা করিস না, তোর লেখা পড়া হলো না বলে মন খারাপ করিস না। এখানেও এক দিন জাহাজের ক্যাপ্টেন হতে পারলে অনেক দাম, অনেক বেতন পাবি। আমার বন্ধু আনিসকে মনে আছে? ও কিন্তু জাহাজের ক্যাপ্টেন। তা কবে যাবি ঠিক করেছিস?
হ্যাঁ, সামনের রবিবার রাতের মেইলে।
কেনা কাটা করেছিস কিছু?
না, কি কিনব, চিটাগাং যাবার টাকা দিতেই আব্বার অবস্থা কাহিল। থাক ওখানে যেয়ে বেতন টেতন পেয়ে যা লাগে কিনে নিবো।
বোকা ছেলে একটা দেশ থেকে বিদেশে যাবি এই ফকিরনির হালে যাবি নাকি? অন্তত কিছু কাপড় চোপর বানিয়ে নে। কি গায়ে দিয়ে যাবি?
বলেই মামা পকেট থেকে মানি ব্যাগ বের করে একশ টাকার দশটা নোট নিশাতের হাতে দিয়ে বলল
যা যা লাগে কিনে নিবি, কোন কিপ্টেমি করবি না। তুই এখন আন্তর্জাতিক পথে পা ফেলতে যাচ্ছিস কাজেই সেই ভাবে চলাফেরা করবি। যাবার আগে তোর মামির সাথে দেখা করে যাবি।
আচ্ছা মামা। হ্যাঁ মামির সাথে দেখা না করে কি যাব না কি, শুক্রবারে বাসায় যাব। সবার সাথেই দেখা করে যেতে হবে। তা হলে আমি আসি এখন?
কিছু খেয়ে যা।
না, বাসায় গিয়েই খাব।
দেখিস টাকা গুলি সাবধানে নিবি।
আচ্ছা মামা।

টকাটা পকেটে রেখে মামাকে সালাম করে অফিস থেকে বের হয়ে এসে নিশাতের মনে আনন্দের আর সীমা নেই। এক হাজার টাকা! নিশাত ভাবতেই পারছে না। এই এত টাকা ও কোথায় খরচ করবে? থাক বাবার কাছ থেকে তা হলে আর ওই টাকা নেয়ার দরকার নেই। মামা যা দিয়েছে এতেই চলে যাবে। সোজা বাসায় এসেই মাকে আনন্দ সংবাদটা জানাল। মা মামা আমাকে কেনা কাটা করার জন্য এক হাজার টাকা দিয়ে ফকিরনির মত বিদেশে যেতে নিষেধ করে দিয়েছে। ভালো জামা কাপড় বানিয়ে নিতে বলেছে।
তুই হলি ওর প্রিয় ভাগ্নে তোকে তো দিবেই। যাক বাবা ভালো হয়েছে, তাহলে ওখান থেকে আসার পথে গুলিস্তান থেকে সার্ট প্যান্টের কাপর কিনে নিয়ে আসলেই পারতি। এক কাজ কর কিছু খেয়ে আবার যা, কাপড় নিয়ে আয় আর তোর তো জুতাও নেই এক জোড়া জুতাও নিয়ে আসবি।
আচ্ছা মা আমি হাবিবকে নিয়ে যাই।
হাবিবকে নিয়ে গুলিস্তান গিয়ে দুইটা সার্ট, দুইটা প্যান্টের কাপড়, একটা ব্যাগ, গেঞ্জি আরও কিছু টুকি টাকি যা মনে পড়ল সে সব কিনে বাটার দোকান থেকে দেখে এক জোড়া জুতা, কিনে বাসায় চলে এলো। পর দিন সকালে মাকে নিয়ে বের হলো। কল্যাণপুরে দর্জির দোকানে আর্জেন্ট ডেলিভারি দেয়ার কথা বলে মাপ দিয়ে মায়ের সাথে গাবতলি গিয়ে ঢাকা আরিচা রুটের বাসে বানিয়া জুরি নেমে গ্রামে চলে গেল।

নিশাত জানে না তার ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। হায়রে মানুষ তুমি জান না আজকে যে পাহাড় সমান সম্পদ পেয়ে তুমি আনন্দে আত্মহারা হয়েছ কালই সামান্য একটা ইঁদুর তার কত বড় ক্ষতি করতে পারে। কিংবা আজ তোমার সামান্য একটা পয়সা না থাকায় দুঃখে মন ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে হয়ত কাল তোমার পকেটে দেখবে সহস্র মুদ্রার ঝলকানি। সবই সেই অদৃশ্য শক্তির কারুকাজ।

গ্রামে এসে প্রথমে নিজেদের বাড়িতে না ঢুকে পথের পাশে শিহাব যুঁইদের বাড়িতে গেল। যাবার সময় মাকে বলে গেল আপনি বাড়ি যান আমি আসছি।
কিরে নিশাত কবে এসেছিস?
এইতো আসছি।
কি খবর বল
শুনেছিস, আমি লন্ডন যাচ্ছি!
শুনে যুঁই আর শিহাব এক সাথে বলে উঠল, কি বললি
হ্যাঁ যা বলেছি সঠিক বলেছি
কবে যাবি?
এইতো এখান থেকে ফিরে রবিবারে চিটাগাং যাব ওখান থেকে দিন তারিখ ঠিক হলেই চলে যাব। এখানে এসেছি তোদের সাথে দেখা করতে।
ওমনিই যুঁই বলল, ঈশ তোর বৌয়ের সাথে দেখা করে যাবি না? ও তো ঢাকা যাবে লালমাটিয়া কলেজে ভর্তি হবে।
কথাটা শুনেই আনন্দ আর লজ্জায় নিশাতের মুখ লাল হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কোন কথা বের হলো না। তাহলে? তাহলে কি নিরুকে না দেখেই চলে যেতে হবে? কোন কুল কিনারা পাচ্ছে না। একটু সময় থেমে পরিস্থিতি বুঝে আস্তে করে জিজ্ঞেস করল নিরু কোথায়?
কেন নিরুর কি দরকার? বৌকে দেখে না গেলে হবে না? ওতো মামার বাড়ি গেছে। আজই আসার কথা। বীণা এসেছে দুই তিন দিন হলো, ওকে নিয়ে যাবে। বীণা সহ ওদের মামা বাড়ি গেছে।
নিশাত উঠে দাঁড়িয়ে বলল তাহলে আমি যাই দাদুর সাথে দেখা হয়নি এখনও
ঢাকা যাবি কবে?
আগামী কাল যাব
তাহলে আবার বিকেলে আসবি?
নিশাত এতক্ষণে নিরুর সাথে দেখা হবার জন্য বিকেলে আবার এখানে আসার সুযোগ খুঁজছিল। যুঁইয়ের কথা শুনে সে সুযোগ পেয়েছে বলে একটু জোরেই বলল হ্যাঁ আবার আসব, শিহাব কোথাও যাবি?
না এখন আর কোথাও যাব না
তাহলে আমার সাথে চলনা মইন চাচার বাড়ি যাব এক সাথেই যাই
চল
দুইজনে এক সাথে নিশাতদের বাড়ি চলে এলো। হাতের ব্যগটা নামিয়ে রেখে দাদির সাথে দেখা করে শিহাবকে নিয়ে চলল মইন চাচার বাড়ি। চাচা বাড়িতে ছিল না, পারাগ্রামের কোন এক জমিতে নিড়ানি দিতে গেছে। একটু বসে মইন চাচার মাকে বলল দাদু আমি একটা খুব ভাল চাকরী পেয়েছি আমাকে লন্ডন চলে যেতে হবে ওখানেই চাকরী। দাদি খুব খুশি হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেকক্ষণ দোয়া করলেন। দাদিকে বলে আসল চাচা এলে আমাদের বাড়ি যেতে বলবেন
আচ্ছা দাদা আমি বলব, তুমি সাবধানে থেকো, শুনেছি বিলাতি মেমসাহেবদের কোন লাজলজ্জা নাই দেখবে আবার অমন কাউকে সাথে করে নিয়ে এসো না।
না দাদু আপনাকে সেজন্যে ভাবতে হবে না।
সন্ধ্যার আগে মইন চাচা এলে তাকে নিয়ে আবার শিহাবদের বাড়ি। বাড়িতে ওঠার আগেই বীণা আপাকে দেখল পুকুর পাড় থেকে বাংলা ঘরের দিকে আসতে। বুঝতে পারল বীণা আপার সাথে নিশ্চয়ই নিরু এসেছে। এখন ওকে দেখার সুযোগ খুঁজতে হবে। নিশাতকে দেখে বীণা আপা কতবেল গাছের নিচে দাঁড়াল।
নিশাত, যুঁই বলল তুই নাকি লন্ডন যাচ্ছিস?
হ্যাঁ আপা, যুঁই ঠিকই বলেছে।
বেশ, খুব ভাল কথা। তা ঢাকায় কবে যাবি?
কালকেই যেতে হবে।
কালই যাবি! তাহলে আমাদের সাথে চল, আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি।
আপা আমিতো একা না মাও আছে সাথে আবার দাদুও যাবে।
তাতে কি হলো এ তো আরও ভাল হলো। তারাও যাবে তোদের নামিয়ে দিয়ে আমি নিরু আর বাবা চলে যাব।
এখানে এ কথা সে কথা, নানা গল্পে গল্পে বেশ রাত হয়ে গেল। এখনও নিরুকে দেখার সুযোগ হয়নি। চাচীদের সাথে দেখা করার অছিলায় বীণা আপার সাথে ভিতরে চলে এলো। চাচীদের সাথে কথার ফাঁকে দেখল নিরু ছোট চাচাত বোনকে কোলে নিয়ে খাটের এক কোণায় বসে আছে। হারিকেনের মৃদু আলোতে যেন আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। চোখের দিকে তাকাল কিন্তু কোন সারা নেই দেখে মনটা একটু খারাপ হলো। আবার ভাবল কাল এক সাথে ঢাকা যাবার সময় প্রাণ ভরে দেখে নিবে।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৭

৪।
সদ্য স্বাধীন দেশে সব জিনিস পত্রের দাম দিনকে দিন বেড়েই চলছে। প্রকৃতি তার রুদ্র রূপ মেলে দিচ্ছে। জীবন হয়ে উঠছে কঠিন থেকে কঠিনতর। নতুন দেশ, নতুন অর্থনীতি, শূন্য ভাণ্ডার আর তার সাথে অবাধ চাহিদা। চারিদিকে শুধু
ক্ষুধা আর ক্ষুধা। বিরূপ পরিবেশ। এর মধ্যেই আবার প্রকৃতি নিয়ে এলো তার প্রচণ্ড হিংস্র মূর্তি। দেশে দেখা দিল বন্যা। এমনিই মানুষ সামাল দিতে পারছে না তার মধ্যে আবার এই দুর্যোগ। রেশন কার্ড নিয়ে নিশাত রাত তিনটায় রেশন দোকানে লাইনে দাঁড়াত, তবুও গিয়ে দেখত তার আগে আরও কয়েক জন এসে পরেছে। ঘুমে চোখ একা একাই বন্ধ হয়ে আসতে চাইত কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি আর ঘুমানো যায়? তীর্থের কাকের মত চেয়ে থাকত কখন সূর্য উঠবে কখন নয়টা বাজবে, কখন দোকান খুলবে! এই রেশন নিয়ে বাড়ি গেলে মা রান্না করবে। ক্ষুধা নামক জীবের অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য প্লাস্টিকের চাউল যা সেদ্ধ হতে জ্বালানী খরচ হত অনেক, পোকা ধরা দুর্গন্ধে ভরা কিছু গম আর কিছু চিনি এই ছিল রেশন কার্ডে বরাদ্দ। তবুও নিরুপায় মানুষকে তাই খেতে হত। শাক সবজি, ডাল, মাছ এসব তো আর রেশনে পাওয়া যায় না। ওগুলি পাবার ব্যবস্থা আছে কিন্তু তা অন্য ভাবে। বাজারে ওসব পাওয়া যায় কিন্তু তা কেনার সামর্থ্য খুব কম লোকের হাতে। বাড়িটা করতে গিয়ে নিশাতের বাবা কিছু ঋণ করেছিল। গ্রামের জমি বিক্রির টাকায় হয়নি। অল্প কিছু ঋণ করতে হয়েছিল। সেই ঋণ শোধ করতে গিয়ে নিশাতের বাবাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। তার মধ্যে আবার ওদের পাঁচ ভাই বোনের লেখা পড়া।

ওই দুর্যোগের মধ্যেই মাছ ভাতের বাঙ্গালি তার চিরাচরিত অভ্যাস ছেড়ে খেতে শিখল গমের আটার রুটি। তাও আবার যারা দিচ্ছে তাদের অখাদ্য। আরও শিখল সরষের তেলের পরিবর্তে সয়াবিন তেলে রান্না। বুড়ি গঙ্গা আর তুরাগ নদী দিয়ে অনেক পানি বঙ্গোপসাগরে মিশেছে আবার সেই পানি সূর্যের তাপে বাষ্পায়িত হয়ে হিমালয়ে কিংবা কাঞ্চনজঙ্ঘা কিংবা মানস সরোবরে এসে জমেছে। এখান থেকে নদী বেয়ে আবার গেছে বঙ্গোপসাগরে। প্রকৃতি থেমে নেই। সে তার আপন গতিতে নিজ রূপে বয়েই চলছে। তার কোন তাড়া নেই, কোন অভাব নেই। আকাশের চন্দ্র সূর্য তারা নক্ষত্র রাজি সবই উদয় হয়েছে আবার অস্তও গেছে। বাতাস বয়ে গেছে সাথে করে কখনও উড়িয়ে নিয়েছে কিছু মেঘমালা, কখন শান্ত বেগে কখন অশান্ত ঝড়ের বেগে, কখন নিস্তব্ধ মৃদু বেগে। এই ভাবেই ক্যালেন্ডারের পাতা একের পর এক উলটে গেছে। ঘড়ির কাটা ঘুরে ঘুরে ঋতুর পরিবর্তন এনেছে। যত্নে সাজানো বাগানের এবং অযত্নে বেড়ে উঠা ঝোপ ঝাঁরে বন ফুলের অনেক কলি ঝরে গেছে আবার তার জায়গায় নতুন কুড়ি এসেছে। এগুলিও কিছু আধো ফোটা অবস্থায় ঝরে গেছে, কিছু ফুটে তার সৌরভ ছড়িয়েছে আবার কিছু ঠাই পেয়েছে কারো সাজানো ঘরের ফুল দানিতে নয়ত কারো প্রিয়ার খোপায় তার হিসেব কে রেখেছে কে জানে! এই ভাবেই বয়ে চলেছে জীবন নদীর শান্ত অশান্ত স্রোত। কোনটা সাগরে মহা মিলনে মিলিত হয়েছে আবার কোনটা মাঝ পথেই শুকিয়ে গেছে। আবার কোনটা কিছু দূর এগিয়ে মাঝ পথে এসে স্তব্ধ হয়ে থমকে গেছে। এই ভাবে চলেছে, চলছে এবং মহাকালের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চলতেই থাকবে। তার পর এক দিন হবে সব কিছুর অবসান। কেউ নিজের ইচ্ছে মত নিজের বাগান সাজাতে পারেনি। সব কিছু যেন কোন অদৃশ্য এক ভাগ্য নামের রিমোট কন্ট্রোলের হাতের পুতুল হয়ে ডানে বামে সামনে পিছনে চলছে। কে কার খবর রাখে?

ছোট বেলা থেকে নিশাতের ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবে, মস্ত ইঞ্জিনিয়ার। নিজ হাতে বানাবে নানা রকম ইঞ্জিন যা মানুষের কাজে লাগবে, মানুষের দৈনন্দিন জীবন সহজ করে দিবে। কিন্তু তার সে স্বপ্ন থমকে গেল কলেজে ইলেক্টিভ ম্যাথে এসে। নিশাত বাবার কাছ থেকে সাধারণ গণিত বেশ ভালো বুঝে নিয়েছিল কিন্তু ক্যালকুলাস, স্ট্যাটিস্টিকস, ডাইনামিকসের ধাক্কায় সব থেমে গেল। নিশাত তার মাথায় এগুলি জোড় করেও ঢুকাতে পারলো না। ওদিকে বাবার এমন সামর্থ্য নেই যে এ জন্য তাকে আলাদা প্রাইভেট টিউশনের খরচ যোগায়। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বায়োলজি নিয়ে পড়ে ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে এমন সিদ্ধান্ত নিলো। এতেও গবেষণার সুযোগ রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু কলেজ শেষ করে আর বেশি দূর এগুতে পারেনি। দেশের ক্রম বর্ধমান দুর্মূল্যের ফলে তার বাবা তাদের এই পাঁচ ভাই বোনের সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল।
মানুষ মুখে যাই বলুক যতই বলুক দেশের জন্য দশের জন্য ভাবছে। আসলে তার কতটা সত্য তা নিশাত জানে না। নিশাত এখন ভাবছে আসলে এগুলি কিছু নয়। মানুষ ভাবে শুধু তার নিজেকে নিয়েই। সে তার নিজের চাহিদা, নিজের খেয়াল অভাব মেটাবে এটাই এক মাত্র উদ্দেশে। তার নিজের চাহিদা বাস্তব রূপ নিবে, মনে আত্ম তৃপ্তি পাবে, সাথে পাবে যশ প্রতিপত্তি, সম্মান আর সুখ। সুন্দরী শিক্ষিতা স্ত্রী, সাজানো বিলাস বহুল বাড়ি তাতে থাকবে ফুলের বাগান। আরাম আয়েশের যাবতীয় ব্যবস্থা। মালী, চাপরাশি ড্রাইভার সারাক্ষণ তাকে ঘিরে থাকবে। পাশে সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে দামী গাড়িতে চলাফেরা করবে এমন অনেক কিছু। নিশাতও ভাবে এই যে আমি চাইছি আমাদের সংসারের বর্তমান অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে সংসারের উন্নতি করবো, ভাই বোনদের নামী দামী স্কুল কলেজে পড়িয়ে উচ্চ শিক্ষিত করে তুলব, তাদের দামী পোশাক পরাব। সমাজে পাড়া প্রতিবেশীদের ঈর্ষার কারণ হবো তাদের চোখ ধাঁদিয়ে দিবো, সমাজের উন্নতি করবো দেশে বিদেশে নিজের খ্যাতি ছড়াবো তার মুলে কিন্তু ওই একই। নিজের স্বার্থ জড়ান রয়েছে।

মানুষ যতই বলুক তার অন্তর্নিহিত সারমর্ম সে নিজেই। নিজের পেটে ক্ষুধা রেখে কে কার জন্য কতটা পরতে পারে, কত দূর যেতে পারে? নিজের চলার শক্তি হারিয়ে কেউ বেশি দূর যেতে পারে না। এই হয়, এটাই স্বাভাবিক। মানুষের মনের খবর আমরা কতটা রাখতে পারি? এক জন আর এক জনের মনের কথা কতটা জানতে পারি? এক জনের সাথে আর এক জনের কতটা মিল থাকে? হয়তোবা তাই নয়ত কি জানি কেন নিশাতের মনে এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। হায়রে নিয়তি তোমার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কি মানুষ তার ইচ্ছে মত কিছুই করতে পারবে না? এই বিশ্ব সংসারে তুমিই কি রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে মানব জীবনের স্টিয়ারিং ঘোরাবে?
এই সব ভাবনা নিয়ে যখন নিশাত ক্ষত বিক্ষত তখন এক দিন সহপাঠী পাশে কল্যানপুরের বন্ধু হাবিব এসে জানাল, এই নিশাত, জাহাজে চাকরী করবি?
কি করে?
এই যে দেখ আমি কি নিয়ে এসেছি.
বলে একটা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন বের করে দেখাল। নিশাত সেটা নিয়ে পড়ে দেখল. চট্টগ্রামের এক শিপিং এজেন্ট জেমস ফিনলে জাহাজের জন্য কিছু ডেক ক্যাডেট চেয়েছে। প্রথমে ক্যাডেট হিসেবে জয়েন করবে পরবর্তীতে জাহাজে কাজের অভিজ্ঞতা হলে নির্দিষ্ট সময় পর পর ইংল্যান্ডে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পরবর্তী উন্নত পদে উন্নীত হয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন পর্যন্ত হবার সুযোগ আছে।
দারুণ একটা খবর এনেছিস, বেশ ভালো করেছিস এটা এনে, তা তুই কি এপ্লাই করবি?
হ্যাঁ আমিও করবো।
তাহলে চল দুই জনে এক সাথেই করি। এক মাস যাবত কলেজ বন্ধ থাকবে কাজেই এর মধ্যে আর কোন ঝামেলা নেই।
যা যা কাগজ পত্র চেয়েছে সেগুলি যোগার করে বাবা মাকে না জানিয়ে নিশাত হাবিবের সাথে এপ্লিকেশন পাঠিয়ে দিল। কয়েক দিন পর ইন্টার্ভিউ লেটার এলো বাড়িতে। চট্টগ্রাম যেয়ে ইন্টার্ভিউ দিতে হবে এজন্য টাকার দরকার। এখন আর বাবাকে না জানালে চলছে না। বাবাকে জানাবার আগে মাকে জানাতে হবে। মা নিজেই যেন বাবাকে বলে। ওই দিন মাই জিজ্ঞেস করল তোর নামে এই চিঠি কিসের, কে দিয়েছে? নিশাত মাকে সব খুলে বুঝিয়ে বলল। সবার শেষে বাবাকে বলার জন্য অনুরোধ করল। মা ওই রাতে খাবার সময় বাবার সাথে এ নিয়ে আলাপ করতেই বাবাও রাজী হয়ে গেল। কবে যেতে হবে জানতে চাইলে নিশাত বলল আগামী সোমবার।
আচ্ছা ঠিক আছে।

রবিবার রাতের চিটাগাং মেইলে করে দুই বন্ধু এক সাথে রওয়ানা হয়ে পর দিন আগ্রাবাদে জেমস ফিনলে অফিসে এসে ইন্টার্ভিউ দিল। দুই জনেরই বেশ ভালো ইন্টার্ভিউ হয়েছে। মোটা মুটি যা যা জিজ্ঞেস করেছে সঠিক জবাব দিয়েছে। ইন্টারভিউ দিয়ে আবার রাতের মেইল ট্রেনে ঢাকায় ফিরে এলো। কয়েক দিন পরেই নিশাতের নামে আর এক চিঠি, ওই ফিনলে অফিস থেকে। সেদিন নিশাতের কলেজ বন্ধ বলে কলেজে যায়নি, বাড়িতেই ছিল। পিওন সরা সরি নিশাতের হাতে চিঠিটা দিয়ে গেল। দুরুদুরু বুকে চিঠি খুলে পড়ে দেখে আনন্দে মা বলে এক চিৎকার দিয়ে দৌড়ে মার কাছে এসে মার বুকে মাথা রেখে মাকে জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ নিশাতের এই কাণ্ড দেখে মা অবাক হয়ে জানতে চাইল
কিরে কি হয়েছে?
আমার চাকরী হয়ে গেছে!
কোথায়?
ওই যে সেদিন ইন্টার্ভিউ দিয়ে এলাম ওখানে।
তা হলে কি চিটাগাং?
না মা একে বারে বিদেশের এক জাহাজে।
কি বললি?
হ্যাঁ মা এই যে দেখেন এই চিঠিতে সব লেখা আছে।
জাহাজের চাকরী?
হ্যাঁ মা!
তুই কি সাতার জানিস যে জাহাজে চাকরী করবি?
জাহাজে চাকরী করতে সাতার জানা লাগবে কেন? জাহাজের মানুষেরা কি জাহাজে থাকে না কি সাগরে ভেসে থাকে?
না বাবা, আমার ও চাকরীর দরকার নেই! আমার দাদাও জাহাজে চাকরী করেছে আমি জানি সব।
কি বলেন মা, এখন দেশের এই অবস্থায় এমন একটা চাকরীর সুযোগ হাত ছাড়া করা কি ঠিক হবে?
না, বললাম তো আমার ও চাকরীর দরকার নেই।
আচ্ছা ঠিক আছে আব্বা আসুক দেখেন আব্বার সাথে আলাপ করে দেখেন আব্বা কি বলে।
জেমস ফিনলে ইংরেজিতে লেখা চিঠিতে জানিয়েছে তোমাকে একটা ব্রিটিশ পতাকা বাহী জাহাজে ডেক ক্যাডেট হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। স্থান কাল বেতন সহ সব কিছু উল্লেখ করে নিয়োগ পত্রের শেষ প্যারায় বলেছে তুমি যদি উপরোক্ত প্রস্তাবে রাজী থাক এবং দেশ ছেড়ে বিদেশে যেতে আপত্তি না থাকে তা হলে অপর পাতায় বর্ণিত শর্ত মেনে এই চাকরী করতে চাইলে আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে আমাদের অফিসে সাক্ষাত কর। শর্তাবলী যাই থাক বেতনের কথা আর লন্ডনে যেয়ে জাহাজে জয়েন করার সুযোগ দেখে নিশাতের মাথা খারাপ হবার দশা। খুশীতে আত্মহারা। ইংরেজ জাত যতই সভ্য হোক ওরা কাউকে আপনি বলতে জানে না। সে যাই হোক। চিঠিতে যে সব শর্তাবলী রয়েছে তাতে আপনি আর তুমিতে কিছু যায় আসে না। তারপর এক লাফে দেশের বাইরে এবং সরাসরি লন্ডনে, যাবতীয় খরচ পত্র সবই কোম্পানি বহন করবে। তার উপর লোভনীয় বেতন, বেতনের সাথে আবার বেশ কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধা। এমন চাকরী হাত ছাড়া করার মত বোকামি এই মূহুর্তে করা কোন অবস্থায়ই উচিত হবে না। মা যতই নিষেধ করুক তাকে রাজী করাতেই হবে!
নিশাত বলল মা তাহলে আমি একটু হাবিবদের বাড়ি থেকে আসি দেখি ওর কি খবর। হাবিবের বাড়ি গিয়ে দেখে হাবিব বাড়ি নেই। হাবিবের বোন হাসি দরজা খুলেছে। হাবিবের কোন চিঠি এসেছে কি না জিজ্ঞেস করলে হাসি বলল হ্যাঁ দাদার একটা চিঠি এসেছে আজ। দেখি, আমাকে একটু দেখাও। হাসি নিশাতকে বসতে বলে ভিতরে গিয়ে চিঠিটা এনে নিশাতকে দেখাল। সেই একই চিঠি নিশাতের কাছে যেমন এসেছে তেমন। খুলে দেখে এতেও ওই একই কথা লেখা।
হাসি, জান এটা কিসের চিঠি?
না ভাইয়া।
চল ভিতরে খালাম্মার কাছে চল এক সাথেই বলি।
এমন সময় খালাম্মা মানে হাবিবের মা নিজেই এলেন। কি রে নিশাত তোকে এত খুশি লাগছে কেন?
খালাম্মা, শুধু আমি না, শুনলে আপনিও খুশি হবেন।
কি ব্যাপার?
হাবিবের একটা চাকরী হয়েছে বিদেশে, আমারও।
তাই নাকি বলিস কি?
হ্যাঁ খালাম্মা এই যে এই চিঠি দেখেন। এতেই সব লেখা আছে। ঐযে সেদিন যে ইন্টার্ভিউ দিয়ে এসেছি সেই চাকরী!
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৬

এই গানইতো গত নয় মাস ধরে শুনছে কিন্তু আজ যেন অন্য রকম মনে হচ্ছে, আজ এই গানের সুরে আলাদা একটা আমেজ, আলাদা এক অনুভূতি। আজ যে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে! সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল তখন সারা জীবনের জন্য একটা সোনালী স্মৃতি সৃষ্টি করে থেমে গেল শুধু গানের রেশটা রয়ে গেল। নিশাত উঠে মইন চাচা সহ বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল পিছন থেকে নিরু একটু জোরেই বলল। খেজুর গাছ কাটার সময় আজ হান্নান ভাইকে দিয়ে হাড়িতে এলাচ দিয়ে রেখেছি কাল সকালে এসে রস খেয়ে যাবেন। কাকে উদ্দেশ্য করে বলা তা নিশাত ভালো করেই বুঝল আর বুঝল যুঁই। পিছন থেকে ডেকে যুঁই বলল শুনেছিস, তোর বৌ কি বলল? নিশাতের কানে আজকের এই রাতে যুঁইয়ের কথাটা সুমধুর হয়ে বাজলো। নিরুর চেহারা কেমন হয়েছিলো তা আর মৃদু চাঁদের আলোতে পিছন ফিরে দেখা হয়নি। তবে নিশাতের অন্ধ-দৃষ্টি তা ঠিক অনুমান করে নিয়েছিল। পরদিন আর রাত পোহায় না, হে যামিনী কেন আজ বিদায় নিচ্ছ না তুমি?

দেশ স্বাধীন হলো। নতুন দেশ। নিশাতের বাবা তার ছুটির কাগজ পত্র নিয়ে ঢাকায় এলেন। সাথে নতুন দেশ, নতুন রাজধানী ঢাকা শহর দেখার জন্য নিশাতও এলো। নিশাতের মামার সেই ধানমন্ডির বাসায় উঠল। পরদিন তার বাবা সেক্রেটারিয়েটে গেলেন কি করা যায় সেই উদ্দেশ্যে। ভাগ্য ভালো সেক্রেটারিয়েটে তার কাগজ পত্র দেখে পর দিন থেকে কাজে জয়েন করতে বলে দিল। বাবার চাকরী হয়ে গেল। নিশাত ২/৪ দিন নতুন দেশের রাজধানী শহরে বেড়িয়ে বাড়ি ফিরে এলো। বাবা ঢাকায় রয়ে গেলেন। ফেরার দিন বাবা বলে দিলেন দুই এক মাসের মধ্যে একটা বাসা পেলে তোমাদের নিয়ে আসব, কলেজে ভর্তি হতে হবে। মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করবে বেশি ঘোরা ঘুরি করবে না।

সময় চলে যায়। আকাশে তারা জ্বলে, চাঁদ ওঠে, জোসনা ছড়ায়। আবার সূর্য ওঠে। শীতের সোনালি বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। ইছামতী নদী দিয়ে পানি পদ্মায় গিয়ে মিশে আবার সেই পানি পদ্মা থেকে মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে মহা মিলনের জন্য মিশে যায়। গ্রামের মেঠো পথ ধরে ঝাঁকা মাথায় হাটুরেরা হাট থেকে নানা সওদা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে। নিশাত পথের পাশে হালটে বসে বসে চেয়ে দেখে। কলই ক্ষেতে নীল ফুল ফোটে, সিম ধরে আবার সেগুলি ফসল হয়ে উঠে। কৃষকেরা মাথায় করে বাড়ি নিয়ে আসে। সোনালী গম ক্ষেতের আড়ালে আবার সূর্য তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিগন্তে হারিয়ে যায়। দোয়েল, শালিক, ঘুঘু পাখি ডেকে ডেকে বিষণ্ণ দুপুরের মায়া ছড়িয়ে দেয়। এ ভাবেই প্রকৃতি তার অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়, আমি আছি। সবাই তার নিজস্ব ভঙ্গিতে চলতে থাকে কিছুই থেমে থাকে না। নিশাতের জীবনও থেমে থাকে না। নিরুর সাথে নিয়মিত না হলেও প্রায়ই দেখা হয়। ক্ষণিকের জন্য চারটি চোখে কি যেন এক দুর্বোধ্য ভাষায় কথা হয়। সে কথার মানে অন্য কেউ বোঝে না। তবে এটুক বোঝে যে কিছু একটা আদান প্রদান হলো। এই আদান প্রদানের রেশ কোথা থেকে কোথায় যাবে দুইজনের কেউ অনুমান করতে পারে না।

এক দিন সন্ধ্যায় মাঠ থেকে ফিরে নিশাত দেখল বাবা এসেছেন। রাতে খাবার পর বাবা বললেন ঢাকায় বাসা পেয়েছেন। তোমরা সবাই আগামী শুক্রবারে চলে এসো। একটু কাগজ আন আমি ঠিকানা লিখে দিই। নিশাত উঠে তার রাফ খাতা আর একটা কলম এনে বাবার হাতে দিলে বাবা ঠিকানা লিখে নিশাতকে বুঝিয়ে দিলেন গাবতলি বাস স্ট্যান্ডে নেমে কি ভাবে যেতে হবে বুঝিয়ে দিলেন। নিশাতের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, কি চিনে আসতে পারবে না কি আমি আসব?
না, আপনাকে আসতে হবে না, আমি যেতে পারব।

ঢাকায় যাবার দিন ঠিক হবার পর থেকেই নিশাতের মনটা বিষণ্ণ, কি জানি কি এক আশঙ্কা। শীতের শেষে প্রকৃতিও যেন নিশাতের মনের সাথে যোগ দিয়েছে। নিরুর বোন যুঁই এর সাথেও তেমন কথা জমে উঠে না, শিহাবের সাথেও খুব একটা দেখা সাক্ষাত নেই বললেই চলে। গাছের সবুজ পাতা সেই কবেই ঝরে গেছে মাঠ ঘাটের সবুজ তাজা ঘাস গুলিও যেন শুকিয়ে হলুদ বিবর্ণ হয়ে গেছে। বাঁশ ঝাড়ের পাতা গুলি ঝরে গিয়ে কাঠির মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। চারি দিকেই কেমন যেন একটা শুকনো মলিন ভাব। সূর্য ডোবার আগে দিগন্তের রক্তিম আভার সাথে গরু বাছুরের পায়ের ধুলো, রাখালের পায়ের ধুলো, বাড়িতে বাড়িতে কলই গম মাড়ানোর ধুম। পিঁয়াজ খেতের ফুল গুলি শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে আসছে কখন যেন কৃষক এসে তুলে নিয়ে যাবে। বিলের ধারে সকাল বেলা বক পাখি ধ্যানে মগ্ন থাকছে না। রোদের তেজ যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তাহলে কি ওরাও নিশাতের মনের কথা বুঝতে পেরেছে?

যাবার আগে সন্ধ্যা বেলা শিহাবদের বাড়ি এলো। শিহাব বাড়ি নেই, যুঁই বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল কিরে, তোরা তাহলে কালই চলে যাবি? কখন যাবি, আয় ভিতরে আয়। আজ আমাদের খৈ বানিয়েছে, হাট থেকে বাবা দৈ এনেছে একটু খেয়ে যা। ভিতরে নিয়ে বসতে বলে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। দরজার পাশে এসে দাঁড়াল নিরু। যুঁই একটু পরে এক হাতে দৈ খৈ এর পেয়ালা আর এক হাতে এক গ্লাস পানি এনে নিশাতের সামনে টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল নে খা। আবার কবে আসবি না আসবি তার ঠিক নেই। তোদের বাড়িতে তাহলে কেউ থাকবে না সবাই চলে যাবি?
আর কে থাকবে বল?
বিষণ্ণ মনে যুঁই বলল বাবা মনে হয় আমাকে মানিকগঞ্জের কলেজে ভর্তি হতে দিবে না, কাজেই আমার পড়া শুনা বন্ধ। তুই কিন্তু বাবাকে বলে যাবি অন্তত তুই ঢাকায় যে কলেজে ভর্তি হবি শিহাবকেও যেন সেখানে ভর্তি হতে দেয়। এসব কথার কিছু নিশাতের কানে ঢুকছে কিছু ঢুকছে না। তার মন রয়েছে দরজার ওপাশে। ও কি একটু ভিতরে আসতে পারছে না। মনে একটা সূক্ষ্ম অভিমান এসে ভর করল। কেন? এখন কি আমার ভিতরে যাওয়া সাজে? তাহলে যুঁই কি বলবে? তুমি একটু এ ঘরে আসতে পারছ না কেন? আর কিছু ভাবতে মন চাইল না। কোন রকম খৈ খেয়ে যুঁইকে বলল শিহাব এলে ওকে রাতে দেখা করতে বলবি। বলেই বের হয়ে বাড়ি চলে গেল।

৩।
পরদিন ওরা ঢাকায় চলে এলো। মিরপুর এলাকায়। বাবা যেভাবে ঠিকানা লিখে বলে দিয়েছিলেন সেই অনুযায়ী ঠিক ভাবে আসতে কোন অসুবিধা হয়নি। গাবতলি নেমে নতুন শহর বলে একটু ইতস্তত লাগছিল তবুও আসতে পেরেছে। নিশাত কলেজে ভর্তি হলো, ছোট ভাই বোনেরা স্কুলে। কয়েক মাস থাকার পর মা এক দিন নিশাতের সাথে পরামর্শ করলেন, পরের বাড়িতে থেকে মাসে মাসে এত গুলি টাকা ভাড়া দিয়ে সংসার চালান কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবছি যদি নিজেদের একটু জায়গা হত তাহলে যেমন তেমন একটু টিনের চাল বেধে থাকার ব্যবস্থা করতে পারলে এই ভাড়ার টাকা গুলি বেচে যেত।
তা হয় কিন্তু জমি কেনার এত টাকা পাবেন কোথায়?
কেন, গ্রামের বাড়িতে আমাদের এজমালি জমি গুলি আছে সেগুলি থেকে আমরা কি পাই ওগুলি বিক্রি করে দিলে যে টাকা আসবে তা দিয়ে হয়ে যাবে।
বেশ ভালো কথা, আব্বার সাথে আলাপ করে দেখেন কি বলে।

নিশাতের বাবা বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পর হাত মুখ ধুয়ে চা নাস্তা খাবার সময় নিশাতের মা কথাটা তুললেন। শুনে সেও মোটা মুটি সম্মতি জানাল। এবার গ্রামের ওই সব টুকরা টুকরা জমি, পুকুর, বাগানের অংশ যেখানে যা ছিল সব বিক্রি হয়ে গেল। শুরু হলো ঢাকায় জমি খোজার পালা। এক সময় তাও হয়ে গেল। যেখানে ভাড়া থাকত তার কাছেই ছোট এক টুকরো জমি পেয়ে রেজিস্ট্রি ইত্যাদি যা করার তাও হয়ে গেল। নতুন জমিতে কোন রকম কাচা মাটির একটা দোচালা টিনের ঘর। পাশে বাঁশের বেড়ার চাল দেয়া রান্না ঘড় আর কাচা একটা টয়লেট বানানোর কাজ হয়ে গেল। এবার একটা শুভ দিন শুভ লগ্নে তারা নতুন বাড়িতে উঠে পরল। কাচা পাকা যাই হোক নিজেরতো! মাস শেষে ভাড়ার টাকা গুনতে হবে না। বাইরের দিকে আস্তে আস্তে বাঁশের বেড়া দিয়ে ভিতরে কিছু শাক সবজির বাগান করে নিলো। পাশেই একটু খোয়ারের মত করে কয়েকটা মুরগী। এইতো নিজের বাড়ি আর ভাড়া বাড়ির তফাত। এখন থেকে ভাড়াতো দিতে হয়ই না উপরন্তু কিছু শাক সবজী সহ ডিম মাংসের খরচও কমে গেল। যত ছোটই হোক আর যত সামান্যই হোক ঢাকা শহরে নিজের একটু খানি কুটিরের দাম যে কি তা হারে হারে বোঝা যাচ্ছে।

এক দিন সকালে কলেজে যাবার আগে নিশাত বাগানে সবজির যত্ন করছে এমন সময় একটু দূরে খোলা রাস্তায় নজর গেল। দেখল সবুজ শাড়ি পরা এক জন মহিলা আর তার সাথে বাচ্চা কোলে নীল কামিজ গায়ে এক মেয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ চেনা চেনা মনে হলো। আরও একটু কাছে এলে দেখল নিরু আর তার বড় বোন বীণা আসছে। বীণা মাঝে মাঝেই আসে। কাছেই বাড়ি। পাশে যখন ভাড়া বাড়িতে থাকত তখনও এসেছে কয়েক বার। কিন্তু সেই আসা আর আজকের আসার মধ্যে কোথায় যেন একটু পার্থক্য মনে হলো নিশাতের কাছে। আজ যেন এক ভিন্ন সুর বেজে উঠল নিশাতের মনে।

বিশ্বে প্রতিনিয়ত কত কিছুই ঘটে যাচ্ছে তার সব কিছু মনের চোখে সব সময় ধরা পরে না। আবার অনেক কিছু আজ যে রকম মনে হয় সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথেই ভিন্ন জনের কাছে ভিন্ন ভাবে ধরা দেয়। সময়, কাল, স্থান ভেদে ভিন্ন রূপ ধারণ করে। এ ও ভালো। এক ধরনের বৈচিত্র্য। প্রকৃতি যেমন খেয়াল পাল্টায় ঋতু বদলায় মানুষের মনও তেমন। আজকে যা ভালো লাগছে কাল তা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারছে না। শুধু পার্থক্য এ টুক যে ঘড়ির কাটা মহা কালের সাথে মিলনের জন্য বার বার ঘুরেই চলেছে। দক্ষিণ মেরু থেকে অনেক বাতাস উত্তর মেরুর দিকে বয়ে গেছে। পৃথিবীতে অনেক ক্ষুধা তৈরি হয়েছে।

বীণা নিরুকে নিয়ে নিশাতদের বাড়িতে এসেছে। চাচীর সাথে দেখা করার জন্য। গতকাল নিরু এসেছে গ্রামের বাড়ি থেকে। ওকেও সাথে করে নিয়ে এসেছে। নিরুর স্কুল বন্ধ হলেই একটা দিনও দেরি না করে সোজা বড় বোনের কাছে এসে কাটিয়ে যায়। নিরু গ্রাম থেকে আসার সময় এই এটা ওটা যা গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে আনতে হয়, ক্ষেতের কিছু মটর শাক, ধনে পাতা, কলার মোচা, গাছের কিছু ফল মুল, কাচা আম, কিছু আম সত্ত্ব, নারকেলের লাড়ু, গাছের পাকা কুমড়োর মোরব্বা যা কিনা মা নিজে বানিয়েছে, কয়েকটা গাছ পাকা কত বেল। ঢাকা শহরে কি আর গাছ পাকা কত বেল পাওয়া যায়! যা পায় সব জাগ দেয়া। যা খেয়ে বড় হয়েছে সেই ছোট বেলায় যা নিয়ে মন কষা কষি হয়েছে, যা নিয়ে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছে সে দিন গুলির স্মৃতি কি মনে পড়ে না? সেই বাড়ির ঘাটের নয়তো চৌরাস্তার ছবি, সেই গন্ধ আবার পিছনে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে না? তাই আসার আগে মা পোটলা বেধে এগুলিও দিয়ে দেয়। বীণা আবার তাই কিছু চাচীর জন্যে নিয়ে এসেছে। চাচীও ওগুলি পেয়ে বেশ খুশি।
মা সিঙ্গারা বানালেন, রান্না ঘরের পাশে পিঁড়িতে বসেই চা সিঙ্গারার পালা শেষ। মা বায়না ধরলেন নিরুকে নিয়ে এসেছিস আজ দুপুরে এখানে খেয়ে যাবি, কবির আসবে সেই সন্ধ্যায় কাজেই আর চিন্তা কি? বাড়িতে ভাড়াটিয়ারা আছে। অকাট্য যুক্তি দেখালেও প্রথমে বীণা আপা একটু আমতা আমতা করে শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে গেল। নিশাতের মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে নিশাতকে একটা মুরগী বের করতে বলে কলেজে যাবার তাগিদ দিলেন। নিশাত আস্তে করে বলল আজ কলেজ বন্ধ।
বন্ধ! তখন যে বললি তাড়াতাড়ি যাবি!

বলেছিলাম না কি! কি জানি ভুলে বলেছি মনে হয়। আচ্ছা থাক কলেজে আজ যেতে হবে না তার চেয়ে মুরগীর খাঁচার বেড়া গুলি জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গে গেছে ওগুলি ঠিক করি কাজে লাগবে। মুরগী বেরিয়ে যায় ধরে আনতে আপনার কষ্ট হয়।
মা কি বুঝলেন তা নিশাত জানে না তবে মা আর চাপা চাপি করেননি। নিশাত একটা মুরগী বের করে পাশের বাড়ির কালামকে ডেকে জবাই করে মার হাতে এনে দিয়ে ঘর থেকে সাড়াশি গুনা তার এনে আবার লেগে গেল খোয়ার ঠিক করার জন্য। মন কাজে ছিল না। হাত দুটাই শুধু নেট বাধার কাজে উঠা নামা করছে। এক সময় পিছনে চেনা পায়ের শব্দ শুনে ফিরে দেখে নিরু এসে দাঁড়িয়ে তার মুরগীর খামার দেখছে। নিশাতকে পিছনে তাকাতে দেখে নিরু বলল বাহ্ বেশ সুন্দর! এক এক করে মুরগী গুলি গুনে দেখে বলল পনেরটা! নিশাত পিছনে তাকিয়ে বলল তুমি আবার এখানে কেন, যাও তোমার চাচীর কাছে গিয়ে বস। এ কথা শুনে নিরু আর একটা মুহূর্ত দেরি না করে চলে গেল। মনে বিষাদের করুন সুর বেজে উঠেছিল। সেদিন ঢাকায় আসার সময় একটু দেখা দিয়ে আসতে পারনি আজ আমি নিজে এসেছি কোথায় দুটি কথা বলবে তা না করে বলে কি না যাও চাচীর কাছে যাও। আমি কি চাচীর কাছে এসেছি? আমি এসেছি শুধু তোমাকে একটু দেখতে। তুমি কেন বুঝলে না। নিশাত আবার পিছনে ফিরে ওকে দেখতে না পেয়ে কেমন যেন বিদিশা হয়ে গেল। এ কি করলাম যার জন্য কলেজে গেলাম না তাকে এ কি বললাম! কি হে নিশাত! তুমি কোন ধরনের মানুষ? এ যে তোমার প্রথম প্রেম তা কি বুঝতে পারছ না? ওদিকে নিরু এসে সেই যে চাচীর কাছে বসল যতক্ষণ ও বাড়িতে ছিল ততক্ষণ কারো সাথে আর একটি কথাও বলে নি।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৫

টাকার নোট গুলি ঘড় ভরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিলো। তার পিছনে কিউতে দাঁড়ানো পাকিস্তানি লোকেরা তামাশা দেখছিল। নিশাত স্থির থাকতে পারেনি, কাচের কাউন্টারের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে লোকটার মাথার চুল টেনে ধরে বলেছিল ‘কিউ নেহি যায়গা ইয়ে তেরা বাপকা রুপিয়া হায় কিয়া দিখা তেরা সরকারি হুকুম দিখা। পিছন থেকে এক পাঞ্জাবি লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো কিতনা রুপিয়া? যাদা নেই স্রেফ ৫০ রুপিয়া। শুনে সে কেরানীকে বলে বুঝিয়ে তারপর সে টাকা পাঠায়। সেই দিনই বুঝতে পেরেছিল স্বাধীনতা আমরা এখনো পাইনি। স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হবে। মামার বাসায় ২/১ দিন থেকে তারা সোজা চলে এসেছিলো ঢাকা ছেড়ে মানিকগঞ্জের অদূরে ছয়য়ানি গালা নামের ছোট্ট এক গ্রামে। মামার গাড়িই তাদের মালামাল সহ বানিয়া জুরি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলো। বর্ষা কাল বলে গাড়ি আর যেতে পারেনি। সেখানে থেকে নৌকায় করে এসেছিলো গালা ইউনিয়নের ছয় আনি গালা গ্রামে। তখন মুক্তি যুদ্ধের তোলপাড়। নিশাত সেই পোস্ট অফিসের ক্ষত এখনো ভুলেনি। গ্রামে তার সমবয়সী চাচা, অন্যান্য চাচাত ভাইদের সাথে বুদ্ধি পরামর্শ করে মুক্তি যুদ্ধে যাবার দিন তারিখ ঠিক ঠাক করে ফেললো। গোপন চুক্তি হলো। কে কে যাবে, কখন কোথা থেকে কি ভাবে যাত্রা শুরু হবে সব পরিকল্পনা অত্যন্ত চুপি চুপি করা হলো। কাক পক্ষীতেও টের পায়নি।
লুঙ্গী, গামছা, গুড় চিরা সব কিছুই বেধে রেডি। রাত ১২টায় চাচাতো ভাই শিহাব আরও কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে আসলে এক সাথে রওয়ানা হবে। রাত জেগে বসে রইলো, এক সময় মোরগে বাগ দিল, কাকের কা কা ডাক শুরু হলো, পাখীরা কিচির মিচির করতে করতে বাসা ছেড়ে রওয়ানা হলো, ঘড়ের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভোরের মৃদু আলো এসে ঢুকল কিন্তু শিহাব এলো না। তার বদলে এলো বাবা।
কি, মুক্তি যুদ্ধে যাওয়া হলো না?

বাবা টের পেলেন কি ভাবে? কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না! কি জানি কোথায় কোন ভুল করে ফেলেছি সব পরামর্শ ফাঁস হয়ে গেছে! বাবা বললেন
তুমি কখনো গ্রামে থাকনি, গ্রামের কাচা রাস্তায় খালি পায়ে হাটনি, গাছে উঠতে পারো না, সাতার জানো না তুমি মুক্তি যুদ্ধ করবে কি ভাবে, তার চেয়ে চল বিজয় নগরে সুশীল বাবুর কাছে নিয়ে যাই উনি অন্তত তোমাকে মুক্তি যোদ্ধা না হোক উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়ে তাদের সহকারী বানিয়ে দিবেন। এই দিয়েই মোটা মুটি দেশের কাজ করার সুযোগ পাবে।
যুদ্ধে যাওয়া হলো না বলে যতটা খারাপ লাগছিল নিজেকে যতটা নিঃস্ব মনে হচ্ছিলো, অকর্মণ্য মনে হচ্ছিলো বাবার কথা শুনে তা থেকে কিছুটা স্বস্তি পেলো। তখনই সুশীল বাবুর বাড়ির পথে রওয়ানা হলো। পনের বিশ মিনিটের মধ্যে চলে এলো। এখানে এসে দেখে তার মত অনেকেই সেখানে উপস্থিত এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো শিহাবও ওখানে রয়েছে। শিহাবের সাথে চোখা চোখি হতেই একটা ষড়যন্ত্রের আভাস দেখতে পেলো ওর চোখে মুখে। ও! আচ্ছা, তাহলে তুমিই এই কাজ করেছ?

স্কুলে যেমন স্কাউটিংয়ের ক্লাস হোতো, সুশীল বাবুও সেই ভাবে তার হবু মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সহকারীদের সামনে দাঁড়িয়ে হাতে একটা রাইফেলের মত কি এক অস্ত্র নিয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন। পাশে মেশিন গান রাইফেল এইগুলিও রয়েছে, পরে জেনেছে ওটার নাম স্টেন গান। বাবা আর সুশীল বাবু একই স্কুলে পড়তেন। বাবাকে দেখেই সুশীল বাবু থেমে গেলেন। এসো বাদশা, বাবার গ্রামের নাম বাদশা। বাবা নিশাতকে দেখিয়ে বললেন এই হলো আমার বড় ছেলে, একে আপনার কাছে দিয়ে গেলাম কাজে লাগাবেন। ওর খুব ইচ্ছা দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করে। সুশীল বাবু খুশি হয়ে ওকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন এমন ছেলেই আমার দরকার, যাও বাবা ওই ওখানে বস বলে হাত দিয়ে তার সামনের ব্যাটেলিয়ন যে খেজুর পাতার মাদুরে বসেছে সে দিকে দেখিয়ে দিলেন, বাবাও এক পাশে বসলেন। সুশীল কাকা আবার শুরু করলেন। কি ভাবে শত্রু পক্ষের এলাকা পার হয়ে নিজ দলের কাছে পৌঁছান যায়, কি ভাবে শত্রুকে আক্রমণ করতে হয়, নিজেকে রক্ষা করা, অস্ত্র রক্ষা করার নানা খুঁটিনাটি কৌশল তিনি বলে যাচ্ছেন। এই ভাবেই বেশ কয়েকদিন গেল। ভোরে আজানের পর থেকেই শুরু হয় আর বেলা একটু উপরে উঠলে যখন মানুষের চলা ফেরা শুরু হয় তখন শেষ হয়।

নিশাতের সারা দিন কাটে এ গ্রামে ও গ্রামে ঘুরে ঘুরে, সুযোগ পেলেই শিহাবদের বাড়ি। ওই বাড়িতে কি যেন অদৃশ্য এক সুতায় বাধা কি একটা আকর্ষণ আছে যা এখনো বুঝে উঠেনি। এদিকে শিহাবও ওর ঘনিষ্ঠ জনদের মধ্যে এক জন। ওই ঘটনার পর থেকে শিহাবের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। একটু দূরে দূরেই থাকে। বুঝতে পেরে শিহাবই একদিন এগিয়ে এসে হাত চেপে ধরে বলল দেখ তুই আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে কাজ করতে পারবি না জেনে বুঝেই আমি মইন চাচার সাথে পরামর্শ করে চাচাকে বলে দিয়েছিলাম। আমাকে ভুল বুঝবি না, তার চেয়ে এটাই ভালো হয়েছে এখানেও আমরা সবাই এক সাথে থাকতে পারবো।
নিশাতদের একটা চার ব্যান্ডের ট্রানজিস্টার ছিল। সন্ধ্যা হলেই পাড়ার প্রায় সবাই এসে জমা হতো ওদের বাড়ি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার জন্য। নিশাত, শিহাব, মইন চাচা এরাও শুনত। বিশেষ করে চরম পত্র আর দেশাত্মবোধক গানগুলি।

দেশ স্বাধীন হবার আশা নিরাশার স্বপ্ন আর নানান আলাপ আলোচনার মাঝে দিনগুলি বৈশাখী ঝড়ের মত উত্তাল গতিতে ছুটে চলেছিল। সুশীল বাবুর দেয়া ট্রেনিং শেষ এখন তা কাজে লাগাবার পালা। এখন তার আদেশে সঙ্গী সাথিদের সাথে নিয়ে গোলা বারুদ, সংবাদ, রসদ ইত্যাদি পৌঁছানোর কাজ চলছিল। সুশীল বাবু নিশাতকে দূরে কোথাও পাঠাতেন না। তাই কাজ শেষ হতেই শিহাবদের বাড়ি। ওখানে না গেলে কি জানি কি একটা অপূর্ণ থেকে যায়, নানা ছল ছুতায় ও বাড়িতে যেতেই হয়। মূলত এই এখন থেকেই শিহাব আর যুঁইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা। ও বাড়ি গেলেই যুঁইয়ের লাগামহীন ইয়ার্কি ফাজলামি সত্যেও যেতে হয়। বেশি দূরে না, ওদের বাড়ি থেকে দেখা যায়। মাত্র কয়েক পা পথ। পথই যেন কেমন করে টেনে নিয়ে যায়, সারা দিন যেখানে যাই হোক দিনের শেষে এক বার অন্তত যেতেই হয়। গায়ের সবুজ প্রান্তর, খোলা আকাশ, খোলা বাতাস নিশাতকে কানে কানে বলে যায় কি হলো নিশাত আজ তুমি এখনো যাওনি! বেচারা নিশাত আর কি করে তাই যায়। কাউকে কিছু বলতেও পারে না। এই যে মইন চাচা এতো কাছের মানুষ কোথায় কি হচ্ছে কি করছে তার সব কিছু চাচার কাছে না বলা পর্যন্ত স্বস্তি নেই সেই মইন চাচাকেও বলতে পারছে না। যা আছে তা শুধু তার একান্ত আপন মনেই আছে। কারো কাছেই তা প্রকাশ করতে পারছে না, কেমন একটা চাপা অস্থিরতা নিয়েই দিন গুলি চলে যাচ্ছে।

দিন কারো জন্যই থেমে থাকছে না। নিশাতের দিন গুলিও থেমে নেই, চলে যাচ্ছে। সুশীল বাবুর নির্দেশে কাজ করতে গিয়ে এলাকার অনেক কিছুই চেনা হয়ে যাচ্ছে, অনেক লোক জনের সাথে আলাপ পরিচয় হচ্ছে। এই ভাবেই এক দিন দেশ স্বাধীন হলো। পাকিস্তানিরা মিত্রবাহিনী ভারতীয় সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করল। রেডিওতে খবর শুনে সবাই একে একে জড়ো হলো সুশীল বাবুর বাড়িতে। বিজয় পতাকা ওড়াতে হবে। আনন্দ হবে, উৎসব হবে, স্বাধীনতার উৎসব। বাসি স্বাধীনতার উৎসব নয়। স্বাধীনতা বার্ষিকী নয় একেবারে জীবন্ত স্বাধীনতা। সদ্য স্বাধীনতার উৎসব। এর কি কোন তুলনা আছে না কারো সাথে এর তুলনা করা চলে! কয়জনের ভাগ্যে এই উৎসব জোটে? এই দেশে আরও কত কোটি কোটি মানুষের জন্ম হবে কত কি হবে কিন্তু আজকের এই দিনের স্বাদ কজনে দেখবে? সুশীল বাবু নিশাতের হাতে এক টাকার একটা নোট দিয়ে বললেন যাও ঝিটকা থেকে বাংলাদেশের পতাকা কিনে আন। কোন রকম টাকাটা হাতে নিয়েই দৌড়। দেড় মাইল পথ প্রায় দৌড়েই এলো। একটা মুহূর্ত নষ্ট করার উপায় নেই। উল্লাস কমে যাবে, আনন্দের গতি ধীর হয়ে যাবে। সুখের স্রোতে ভাটা পরে যাবে। পতাকা কিনেই তা বগল দাবা করে আবার দৌড়। বাজার থেকে বেড় হয়ে এসে পথে গ্রামের মেঠো পথের পাশে সবুজ গম খেতের গমের শীষে বেধে কখন যে পতাকাটা আটকে রয়ে গেছে তা বুঝতে পারেনি। বাড়ির কাছে এসে যখন দেখে বগলের পতাকা নেই, কি হলো? আবার উলটো দৌড়। বেশ খানিকটা পথ এসে দেখে গমের শীষের সাথে পতাকা ঝুলছে। নিয়ে আবার দৌড়। বাড়িতে এসে দেখে বিশাল আয়োজন। সমস্ত এলাকার মানুষ চলে এসেছে। সবুজের মাঝে রক্ত লাল আর তার মাঝে দেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা বাঁশের তৈরি মাস্তুলের মাথায় বেধে ওড়ানো হলো। হারমোনিয়াম তবলা রেডি ছিল, পাশে দাঁড়িয়ে সবাই স্বাধীন ভাবে, মনের উচ্ছ্বাসে চিৎকার করে এক সুরে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইল। সে যে কি শান্তি, কি উল্লাস তা কি আর ভাষায় বলা যায়? সে শুধু অনুভূতি দিয়ে অনুভবের। জাতীয় সঙ্গীতের পর আরও দেশাত্মবোধক গান হলো। কে যেন কলতা বাজার থেকে মিষ্টি এনেছিল। গানের পরে মিষ্টি বিলানো হলো। সুশীল কাকার বাড়িতে খেজুরের গুড় দিয়ে ক্ষীর রান্না হয়েছিল কলাপাতায় করে সে ক্ষীর বিলানো হলো। হৈ চৈ শেষ করে গভীর রাতে শিহাব এবং মইন চাচার সাথে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো। পথে আসতে আসতে ভাবছিল এমন দিনে নিরুকে এক নজর না দেখলে কি আর স্বাধীনতার সুখ পূর্ণ হয়? যে করেই হোক একবার যেতেই হবে। কি ছুতা ধরে এই এতো রাতে যাওয়া যায় তাই ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল।

বেশি ভাবতে হলো না। বাড়ির কাছে আসতে শুনতে পেল ওই শিহাবদের বাড়ি থেকেই গানের সুর ভেসে আসছে। স্বাধীনতার উৎসবের ঢেউ এখানেও তোলপাড় হচ্ছে। জোসনা রাতে দুয়ারে খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে তাতে বসে সব বোনেরা মিলে গাইছে। সবার মাঝে বসা নিরুর কণ্ঠটাই বেশি করে কানে বাজছে। যে গান শুনে বাঙ্গালির রক্তে উত্তাল স্রোত বেয়ে উঠেছিল, যে গান শুনে বাঙ্গালি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল সেই সব গান। বোনেরা হাতে তালি বাজিয়ে বাজিয়ে গাইছিল। নিশাতরাও এসে যোগ দিলো পাটির এক পাশে বসে। শিহাব তাড়া দিলো ‘এই এইভাবে শুধুই হট্টগোল করে গান গেয়ে কি উৎসব হয়, যা চা নিয়ে আয়। শুনেই নিরু মাঝখান থেকে লাফ দিয়ে উঠে এক দৌড়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই কয়েকটা কাপ, জগ ভরে চা আর তার সাথে এক গামলা গুর মুড়ি নিয়ে এলো এক এক করে। গুড় মুড়ি শেষ হলে আবার মেঘ বিহীন আকাশে বৃষ্টির মত সুরের ঝঙ্কার। চারিদিকে শীতের কুয়াশা ঢাকা মেঠো পথ বেয়ে সে ঝংকার ছড়িয়ে গেল দূরে অনেক দূরে। আজ যে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার উল্লাস!
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৪

মাস্কাট আউটার এঙ্কারেজে পৌঁছে ফরিদাকে খুঁজে পেতে কোন অসুবিধা হলো না। ফরিদার এক মাইলের মধ্যে ওদের দেয়া ইটিএ অনুযায়ী ঠিক ভোর সাড়ে পাঁচটায় নোঙ্গর করে রেডিওতে গ্রে বাহরাইনকে জানিয়ে দিল।

ব্রিজের টুকিটাকি কিছু গোছগাছ করতে করতে সকাল ছয়টা বেজে গেল। ব্যাস, এখনকার মত ওর ডিউটি শেষ। এবার নিজের রুমে গিয়ে পোশাক বদলে আবার গরম গোসল দিয়ে একটু আগে তারেকের বানানো বিরাট দুই স্যান্ডউইচ খেয়ে আর ক্ষুধা নেই বলে সরাসরি বিছানায়। এয়ারকন্ডিশন রুমে কম্বল গায়ে শোবার প্রায় সাথে সাথেই ঘুম।

ঘুম ভাঙল দুপুর একটায়। উঠে সবাইকে ফরিদার নিমন্ত্রণের কথা জানালো।
অরুণ’দা বলল সবাই কি আর যেতে পারবো জাহাজ নোঙ্গরে রয়েছে জাহাজে থাকবে কে?
শুনে তারেক বলল আপনারা সবাই যান আমি থাকবো। শফিক ভাইর সাথে আমার একটু দরকার ছিল তা রাতে রেডিওতে কথা বলে সেরে নিয়েছি।
আচ্ছা বেশ তাহলে তুমি থাক।
নিশাত আবার এই সব সামাজিকতা নিয়ে বেশ সতর্ক। দেশে সব আত্মীয় স্বজন বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখার কাজটা সে নিরলস ভাবে নিয়মিত করে যেত। এটা ওর কাছে একটা দায়িত্বের মত মনে হতো। কারো কোন নিমন্ত্রণে সময় মতো হাজির হতো, বলতো অবশ্যই যাবো। যাবো না কেন, সমাজে বাস করি না? আমরা সামাজিক জীব না? এক জন আরেক জনের কাছে না গেলে কি হয়? অবশ্যই যেতে হবে!

বিকেলে জাহাজের ক্যাপ্টেনের অনুমতি নিয়ে নিলো। দুপুরে খাবারের পর শাহিনকে নিয়ে ওদের জাহাজে ইঞ্জিন চালিত রাবারের ডিঙ্গি পাম্প করে, ইঞ্জিনে তেল ভরে টেস্ট করে লাইফ জ্যাকেট, রেফট নিয়ে রেডি করে রেখেছিল। ক্রেন দিয়ে ডিঙ্গি নামিয়ে তাতে করে ফরিদায় এসে পৌঁছল। তারেক রেডিওতে বলে দিয়েছিল। কাছে এসে দেখে ওখানকার সবাই এসে জাহাজে ওঠার জন্য সিঁড়ি নামিয়ে জাহাজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ইমরান, শফিক, হাবিব সবাই।
হাবিব এবার বল কি আয়োজন করেছিস।
আরে মাত্র এলি এখনি কি একটু ধৈর্য ধর দেখবি কি করেছি।
না তুই আগে বল, তুই তো জানিস আমার সমস্যা কোথায়, কত রিস্ক নিয়ে ডিঙ্গিতে করে এসেছি। শুধু তোদের ডিঙ্গি নেই বলে এসেছি না হলে কি আমাকে আনতে পারতি?
আরে বেকুব দেখ এই সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখ কোন কিনারা দেখা যায়?
নতুন করে আবার কি দেখতে বলছিস, আমি সাগরে বাস করি না কি আকাশে বাস করি?
আচ্ছা এখন বল এই কুল কিনারাহীন সাগরে সাতার জানলেই কি আর না জানলেই কি! তুই যদি সাতার জানতি তাহলে সাতরে কোথায় যেতে পারতি কোথায় গিয়ে উঠতি?
জ্ঞান দিয়ে ভুলাতে পারবি না, মাস্টারি করিস না বল কি করেছিস।
আরে পাগল এখনি কি এখন একটু ড্রিঙ্কস খা খাবার সময় হোক তখনই দেখবি।
না তুই বল।
তাহলে চল গ্যালিতে (জাহাজের কিচেন) চল, নিজেই দেখ।
সত্যিই গ্যালিতে গিয়ে দেখেত নিশাতের মাথা খারাপ হবার অবস্থা। চিংড়ি ভর্তা, শুঁটকির ঝুরি, রূপ চান্দা মাছ ভাজি, তাজা ম্যাকারেল মাছ ভুনা, মাংস ভুনা আর পাতলা ডাল।
রূপ চান্দা কোথায় পেলি?
বলিস না কুয়েত থেকে আসার পথে দেখি জেলেরা ফিশিং ট্র্যাপ ফেলে রেখেছে, জাহাজ কাছে নিয়ে ক্রেন দিয়ে সেই ট্র্যাপ উঠিয়ে দেখি বোঝাই মাছ। সব নিয়ে এসেছি। এই ম্যাকারেলও। অনেক মাছ ছিল। তোরা যাবার সময় কিছু নিয়ে যাবি।
নিশাত এবার একটু শান্ত হলো।
চল এবার সেলুনে চল।
কেক আর কোক খেতে খেতে হৈ চৈ। শাহিন মহসিনের নাচা নাচি, টেবিল ঠুকে তবলা বাজিয়ে গান সবই হলো।
চল এবার খেতে যাই।
হ্যাঁ যাবো তবে তারেক একা রয়েছে ওর জন্য আগে কিছু দিয়ে দে না হলে পরে মনে থাকবে না।
সত্যিই হাবিব কয়েকটা প্যাকেটে করে তারেকের জন্য এই সব অমূল্য খাবার আর ফ্রিজ খুলে দুই বালতি ভরা মাছ ওদের ডিঙ্গিতে নামিয়ে রেখে এলো। এবার সবাই খেতে বসল। ফরিদার বাঙ্গালি কুক চিটাগাংয়ের আব্দুল হাই, চমৎকার সব রান্না করেছে। নাক পর্যন্ত ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে আবার এক তরফা আড্ডা দিয়ে রাত নয়টায় জাহাজে ফিরে এলো।

২।
ফরিদা থেকে ফিরে এসেই কম্বল গায়ে বিছানায় শুয়ে পরেছে। রাত বারোটায় ডিউটি। যদিও নোঙ্গর করা অবস্থায় ডিউটি তেমন কিছু না শুধু কয়েকটা বিয়ারিং দেখা এবং রাডারে চোখ রাখা। নোঙ্গর পিছলে জাহাজ সরে যাচ্ছে কি না তাই লক্ষ রাখা। চা, কফি, জুস কোক যা খুশি যত খুশি খাও। ব্রিজে বসে যা খুশী কর কোন বাধা নেই শুধু নিদ্রা দেবীর আরাধনায় মগ্ন না হলেই হলো। সেই রকম শিক্ষাই দিয়েছে তাদের বিভিন্ন ক্যাপ্টেন। বলতেন ইউ আর গোইং টু বি এ কিং অফ এ স্মল কিংডম সো, ইউ স্যুড গ্রো দ্যাট ওয়ে, আই ডিজায়ার দিস। ইওর এটিচুড, ইওর ম্যানার স্যুড বি লাইক দ্যাট, ইউ স্যুড নট বি এন অর্ডিনারি ম্যান ইউ স্যুড বি এ পারফেক্ট জ্যান্টল ম্যান, দিস ইস মাই ড্রিম। ঠিক এই রকম কঠিন নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থেকে নিশাত হয়ে উঠেছে একজন আদর্শ মানুষ।

অথচ সে সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘড়ের ছেলে। জন্ম নানা বাড়ি ঢাকা শহরের অদূরে। বাবা মার প্রথম সন্তান হিসেবে বেশ আদর যত্নেই বেড়ে উঠেছে। ছোট বেলা থেকেই সৌখিন জীবন যাপন তার পছন্দ। তবে বাবার সাধ্য সীমার বাইরে কখনো কিছু দাবী করেনি। পোশাক আসাক যাই ছিল তা চকচকে ইস্ত্রি করা ছাড়া কোন পোশাক তাকে কেও কখনো পড়তে দেখেনি। পায়ের জুতা জোড়াও সবসময় চকচক করতো। সেই ছোট বেলায় যখন সে মাত্র থ্রিতে পড়তো তখন থেকেই নিজের কাপর কয়লার ইস্ত্রিতে পাখা দিয়ে বাতাস করে কয়লা জ্বালিয়ে ইস্ত্রি করে পড়তো। নিজের জিনিষ পত্র ঘড় দরজা নিজেই গুছিয়ে পরিষ্কার করে রাখতো। নিজের স্কুলের কাপর চোপর ধুয়ে শুকিয়ে ইস্ত্রি করে গুছিয়ে রাখতো, সাথে বাবা মার কাপরও ইস্ত্রি করে দিত মাঝে মাঝে। তবে জুতা পালিশের ব্যাপারে তার একটা খুঁতখুঁতানি ভাব থেকেই যেত। এই কাজটাতে সে কখনোই তৃপ্তি পেত না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে জুতা পালিশ ওয়ালাদের দেখত কেমন করে তারা জুতা পালিশ করছে। আবার বাড়ির কাছের লন্ড্রির সামনে দাড়িয়েও দেখত তারা কোন কাপর কি ভাবে ইস্ত্রি করছে। বাসায় এসে সেই ভাবে চেষ্টা করতো। এভাবেই অনেক কিছু শিখে নিয়েছিলো। কুলি মজুর, ঠ্যালা গাড়ি ওয়ালা, কাঠ মিস্ত্রী, আকাশ, বাতাস, নীল প্রশান্ত সাগর, মাটির ধরণী, কারো কাছ থেকে শেখার কিছু বাকী রাখেনি। ওর বিশাল কৌতূহলী মন যার কাছে যা পেত তাই ধরে রাখত। মা যখন সেলাই মেশিন নিয়ে বসতেন তখন তার কাছে বসে দেখত মা কি ভাবে কেঁচি দিয়ে কাপর গুলি কেটে তা আবার সেলাই করে কি সুন্দর জামা পাজামা বানিয়ে ফেলছে। ওর অবাক চোখ শুধু বিস্মিত হত।

সব কাজের লোকদের বেশ সমীহ করে চলতো, কখনো কাউকে ছোট ভাবতে পারতো না। এরা কি সুন্দর করে সব কিছু বানিয়ে ফেলছে এই থেকে তাদের প্রতি একটা শ্রদ্ধা বোধ আসতো ওর মনে। সংসারের কাজ মা একাই করতেন বাসায় কোন কাজের মানুষ ছিল না তাই সবসময় মাকে এটা ওটা কাজে সাহায্য করত। আটা মাখা, ঘড় ঝাড়ু দেয়া, কাপর গুছিয়ে রাখা থেকে শুরু করে ছোট ভাই বোনদের কান্না থামানো এমনকি রান্নার কাজেও মাকে সাহায্য করতো। সার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেলে কিংবা কোথাও একটু সেলাই খুলে গেলে নিজেই ঠিক করে নিতো মাকে কখনো বলতো না। এই ভাবেই ধীরে ধীরে কখন যেন সংসার নামের বিশাল নাট্য মঞ্চের সকল কুশীলবের অভিনয় তার মুখস্থ হয়ে গেছে তা সেও বুঝতে পারেনি। মা শেখাতেন কি ভাবে বাজার থেকে তাজা সবজী চিনে কিনতে হয়, কি ভাবে তাজা মাছ চেনা যায়, বাসায় নতুন অচেনা কোন অতিথি এলে তার পরিচয় কিভাবে জানতে হয়, কি ভাবে অতিথি আপ্যায়ন করতে হয়, কোথায় কখন কি খেতে হয় কি খেতে হয় না। সব কিছু।

বাবা মাসের প্রথমে বেতন পেয়ে বাসায় এসে খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বাজারে যাবার সময় নিশাতকে সাথে নিয়ে যেতেন। সেদিন সকাল থেকে মাকে দেখত তেলের বোতল, বাজারের ব্যাগ ধুয়ে মুছে শুকিয়ে রাখতে, বাজারের লিস্ট করতে আর তাই দেখে নিশাত বুঝতে পারতো আজ মাসের প্রথম, নিশ্চয়ই বাবা বাজারে যাবেন। বাবার সাথে বাজারে যেয়ে লক্ষ করতো বাবা কোন দোকান থেকে কি কিনছে, কি ভাবে দামাদামি করছে, কোন দোকানে কি জিনিষ পাওয়া যায়। বাজার শেষ করে সাইকেলের চার চাকার ঠ্যালা গাড়িতে মালামাল উঠিয়ে দিয়ে বাসার ঠিকানা দিয়ে দিতেন গাড়ি ওয়ালাকে। সে বাসায় মাল পৌঁছে দিত। আর ওদিকে বাবা তাকে নিয়ে যেতেন মিষ্টির দোকানে। দেখ বাবা তোমার কি পছন্দ। নিশাত ঘুরে ঘুরে চানাচুর, ডাল ভাজা কিংবা বাদাম ভাজা দেখিয়ে দিত আর তাই দেখে বাবা রসিকতা করেই বলতেন তোমাকে নিয়ে এলাম মিষ্টি কিনতে আর তুমি এসব কি দেখাচ্ছ?
হ্যাঁ মা তো মিষ্টি খায় না তাই মায়ের জন্য এগুলি নিবেন।
ও আচ্ছা আচ্ছা বেশ তাহলে বল তোমার জন্য কি নিবে?
একটা কিছু হলেই হবে।
মিষ্টি আর ঝাল কিছু নিয়ে বাবার হাত ধরে বাসায় এসেই মার হাতে ঠোঙ্গাটা দিয়ে দিত। বাবা সরকারি চাকরী করতেন কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত ন্যায় পরায়ণ লোক, কোন অসদুপায় অবলম্বন করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যা বেতন পেতেন সচ্ছল ভাবে না হোক মোটা মুটি ভাবেই চলে যেত, বিলাসিতা করা হয়ে উঠত না। এখনো নিশাতের পরিষ্কার মনে আছে যখন সে ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছিল তখন স্কুলের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বাবার হাতে কিছু টাকা তুলে দিয়ে একটা ইলেকট্রিক ইস্ত্রি কিনে আনার জন্য বলেছিল। বাবা তাই দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন তুমি এতো টাকা কোথায় পেলে? যাই হোক সেই দিনই বাবা সন্ধ্যায় দোকানে গিয়ে একটা ইস্ত্রি কিনে এনেছিলেন। নতুন চকচকে ইস্ত্রি পেয়ে নিশাতের আনন্দ দেখে কে, বারবার উলটে পালটে দেখছে। প্লাগে কানেকশন দিয়ে দেখে নিলো গরম হচ্ছে কি না। গরম হতে দেখে সে যে কি খুশী। সাথে সাথেই নিজের স্কুলের জামা প্যান্ট, বাবার জামা মায়ের শাড়ি সব ইস্ত্রি করে ফেললো।

পাকিস্তানের করাচী শহরেই এতদিন বড় হয়েছে। সবে মাত্র স্কুল ফাইনাল শেষ হবার পর পরই শুরু হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। যুদ্ধ চলা কালীন জুলাই মাসে ওরা করাচীর সব ছেড়ে চলে এলো নিজ দেশে। ঢাকা এয়ারপোর্টে নামার আগেই প্লেনের জানালা দিয়ে দেখতে পেল পাকিস্তানি আর্মিরা নানা রকম অস্ত্র হাতে এয়ারপোর্ট ঘিরে রেখেছে। দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেল। বাবা মা যেতে দিক বা না দিক আমিতো অবশ্যই মুক্তি বাহিনীতে যাব, তখন দেখবি মজা। ব্যাটারা পরের দেশ দখল করে রেখেছ আবার অস্ত্র দেখাচ্ছ? এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দেখে মেঝ মামা দড়িয়ে আছেন। বাবা আগেই টেলিগ্রাম করে জানিয়ে রেখেছিলেন।
মামার গাড়িতে করে তার ধানমন্ডির বাসায় এলো। পথে বৃষ্টি ভেজা, কাদা মাখা চাপা রাস্তা, শেওলা ধরা দালান কোঠা দেখে মনটা দমে গেল। পরক্ষনেই আবার মনে জোড় ফিরে এলো যাই হোক এই হলো আমার নিজ দেশ। পরের চাকচিক্য দেখে ভুলে থাকলে চলবে না, নিজের যা আছে তাই নিয়েই মাথা উঁচু করে বাচতে হবে, এরই নাম জীবন, এরই নাম স্বাধীনতা। আবার মনে হলো এইতো যুদ্ধ শুরু হবার পর এখানে আসার মাস দুয়েক আগে বাবা দাদির জন্য কিছু টাকা পাঠাতে দিয়েছিলেন। করাচী শহরে তাদের স্থানীয় পোস্ট অফিসে গিয়ে টাকা সহ মানিঅর্ডার ফরমটা পোস্ট অফিসের কেরানির হাতে দেয়ার পর যখন সে দেখল ইস্ট পাকিস্তানে যাবে তখনই সে ফরমটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো মুখে বলেছিল ইস্ট পাকিস্তানমে রুপিয়া নেহি যায়গা, ভাগো ইহাছে।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৩

আমাদের দেশের কেউ যদি এই ভাবে কোন দেশে পৌছাতে পারত তাহলে আমরাও আজ বিশ্বজুড়ে রাজত্ব করে বেড়াতাম। কি জানি তারা কেউ কি এভাবে চিন্তা করেছিলো? মনে হয় না। কারণ ইতিহাস দেখলে দেখা যায় আমাদের

দেশের কোন নাবিক টেন্ডল বা সারেঙ্গের উপরে যেতে পারেনি। তাদের কারো কি ক্যাপ্টেন হবার সাধ জাগেনি? জাগলে কি আর এমন হতো! নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দেয়। হঠাৎ করেই ওর ভাবনার তার ছিড়ে যায়। এতক্ষণে কফি শেষ হয়ে গেছে, অনেকক্ষণ খালি কফির কাপ স্ক্রিনের এক পাশে না নামিয়ে রেখে হাতেই ধরে বসে সামনে তাকিয়ে ভাবছিল।
ঘড়ির দিকে তাকাল, পরবর্তী পজিশন নেয়ার সময় হয়েছে। এবার উঠে এলো। রাডারের পর্দায় চেয়ে দেখে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে সামনের পাঁচ ডিগ্রি ডানে একটা জাহাজ দেখা যাচ্ছে। ঘড়িতে আবার সময় দেখে চার্ট টেবিলের কাছে এসে পজিশন নিয়ে নিলো। জাহাজ কোন দিকে ড্রিফট করেনি। স্টিয়ারিং হুইলের সামনে জাইরো কম্পাসের মনিটরে তার নিজের হেড দেখে নিলো, জাহাজ কত ডিগ্রী কোর্সে চলছে। কোর্স ঠিক আছে। একটু পরে আবার রাডারের পর্দা। যে জাহাজ দেখা গিয়েছিল সেটা তাদের স্টার বোর্ড (ডান) সাইড দিয়ে পিছনের দিকে চলে যাচ্ছে। আজকের মত ছয়টা বেজে গেল, আবার অরুণ এলো।

তাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিল, তার এই সময়ের মধ্যে জাহাজ তেমন কিছু ড্রিফট করেনি। শান্ত সাগরে ড্রিফট করবেই বা কেন তা ছাড়া তারেক ভালো স্টিয়ারিং করে। নিজের রুমে এসে পোশাক বদলে গোসল দিয়ে চলে গেল সোজা কিচেনের পাশে ডাইনিং রুমে। খেয়ে দেয়ে এসে কিছুক্ষণের জন্য সেলুনে বসল। সাগরের মাঝে কোন টিভি চ্যানেল পাবে না। জাহাজ চলছে, সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত নয়ত ঘুমে। সেলুনে দাবা, তাস বা সময় কাটাবার মত অনেক কিছুই আছে ওগুলি সে কোনটা পছন্দ করে না। কোন রকমে এক বোর্ড খেলেই আর দাবার চাল দিতে পারে না কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। ঘোড়া চালিয়ে দেয় সোজা কিংবা নৌকা চালায় ঘোড়ার মত আড়াই ঘর পাশে আর তাস দেখলেই মাথা ঘুরে।
প্রজেক্টরে একটা সিনেমা চালাল কিন্তু, বেশিক্ষণ বসা যাবে না নাইট নেভিগেশন আছে। চলন্ত জাহাজে ডিউটির সময় ঝিমানোর কোন উপায় নেই। তাড়াতাড়ি ঘুমুতে হবে। বিশ পঁচিশ মিনিট দেখে এসে শুয়ে পরল। কখন যে কি কি সব আজগুবি ভাবনা কোথা থেকে যে উড়ে এসে মাথায় ভিড় করে কে জানে। দিনের ভাবনার মধ্যে অনেকটাই নিরুর দখলে থাকে। তারপর আবার নতুন যোগ হয়েছে লাল পাড় নীল শাড়ি। মনে হচ্ছিল গভীর নীল সাগরের পাশ দিয়ে লাল স্রোতের একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। সেই মেয়েটি, যার জন্য শাড়িটি কিনেছে তাকে এই শাড়িটা কি বলে দিবে? আদৌ কি দেয়া হবে তাই ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে।

রাত পৌনে বারোটায় শাহিন এসে ডেকে দিল। জাহাজে এই নিয়ম। পরবর্তী ডিউটির লোকদের ঘুম থেকে ডেকে দেয়া। উঠে চোখ মুখ ধুয়ে ডিউটির পোশাক বদলে হাতে একটা সোয়েটার নিয়ে এলো। রাতের খোলা সাগরে শীত লাগতে পারে। তারেককে নিয়ে এক সাথে ব্রিজে এলো। ওদের দেখে অরুণ’দা হেসে ইয়ার্কি করে বলল গুড মর্নিং ক্যাপ্টেন নিশাত, ওরা দুই জনেই এক সাথে তার জবাবে বলল
গুড মর্নিং টু ইউ। ওকে স্যার- নাউ ইউ ক্যান গো টু বেড এন্ড হ্যাভ এ গুড ড্রিম।
অরুণ’দা নিশাতের সিনিয়র কিন্তু হাসি তামাশা ইয়ার্কি ফাজলামি সমানে চলে। তারেক এগিয়ে গেল মিজানের স্টিয়ারিং সিটের পাশে। মিজান চলে গেল তারেক ওর সিটে বসল স্টিয়ারিং হুইল ধরে।
নাও দেখ চার্ট দেখে নাও বলে অরুণ’দা চার্ট টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল ঘণ্টা খানিক পর কোর্স চেঞ্জ করতে হবে।
চার্টে রুট প্ল্যান দেখে নিশাত বলল আচ্ছা ঠিক আছে। কোর্স কত চলছে?
বলেই কম্পাসের দিকে দেখে নিলো।
আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যেতে পারেন, নাকি একটু কফি খেয়ে যাবেন?
তুমি যা বল না! এখন যাবো ঘুমাতে আর তুমি বলছ কফি খেতে!
তাতে কি, সব কিছু ঠিক ঠাক থাকলে আপনি ঘুম থেকে উঠে দেখবেন জাহাজ মাস্কাটের আউটারে নোঙ্গর করে আছে। আচ্ছা গ্রে বাহরাইনকে কি আমাদের স্পেন ইটিএ (এস্টিমেটেড টাইম অফ এরাইভ্যাল) জানিয়েছেন?
হ্যাঁ, সে তো বাহরাইন থেকে ছাড়ার সময় বলেছিলাম।
ওরা তো জাহাজ না পৌঁছা পর্যন্ত অস্থির হয়ে থাকে তাই জিজ্ঞেস করলাম, একটা মজার ব্যাপার কি জানেন কাল আমার ডিউটিতে একবারও ডাকেনি।
এখনো আমি ডাকিনি ওরাই ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলো।
ইটিএ কত দিয়েছেন?
মাদ্রিদ ফেয়ার ওয়ে বয়া আগামী ১৮তারিখ ভোর সাড়ে পাঁচটা। নাও আর পণ্ডিতি করতে হবে না সময় মতো জাহাজ পৌঁছে দিও। আমি যেন উঠে দেখি জাহাজ নোঙ্গরে। এখন জাহাজ চালাও আর কফি খাও আমি চললাম বলেই ব্রিজ ছেড়ে হাসতে হাসতে বের হয়ে গেল।

নিশাত যথারীতি রাডার, জাহাজের হেড এর পজিশন, কোর্স সহ সব কিছু রুটিন চেক আপ করে ইলেকট্রিক জগে কফির পানি গরম দিল। কালো কফি। কাল কফির পোড়া পোড়া গন্ধটা নিশাতের দারুণ ভালো লাগে। সাথে সামান্য চিনি। মিষ্টি বেশি খায় না, ভালো লাগে না। রাতে চলন্ত জাহাজে ব্রিজের এই ডিউটিতে কালো কফি এক দারুণ জিনিস। কে যে এই কফি আবিষ্কার করেছিলো তাকে পেলে অন্তত একটু ধন্যবাদ জানান উচিত! কফি বানিয়ে এক কাপ তারেকের হাতে দিয়ে নিজে একটা নিয়ে আবার তার প্রিয় সেই স্টার বোর্ড সাইডের সাইড লাইটের স্ক্রিনের উপর বসল। এতক্ষণে ব্যস্ততার জন্য লক্ষ করেনি এখন চোখ পরল সামনের সাগরের দিগন্ত রেখা থেকে জেগে উঠছে বিরাট চাঁদ। চাঁদ থেকে চকচকে একটা রূপালী মেঠো পথের মত এসে পৌঁছেছে ওদের জাহাজের সামনে।
তারেক চাঁদটা দেখেছ?
তাই দেখছি।
কি সুন্দর তাই না?
হ্যাঁ।
ইস আমি যদি এখন এই পথ দিয়ে হেঁটে যেতে পারতাম!
মনে মনে এই পথ বেয়ে চলে গেল অনেক দূরে। হাতের কফির কাপে এখনো একটা চুমুকও দেয়া হয় নি। কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, কাপটা হাতেই ধরা রয়েছে। রাতের এই তারা ভরা খোলা আকাশের নিচে সাগর বুকে চাঁদ থেকে বয়ে আসা এমন পথে কার না একটু হেঁটে বেড়াতে ইচ্ছা করে! নিশাতের কি দোষ? সে তো এমন দায়িত্ব জ্ঞান হীন না। সে যতই ভাবুক না কেন কাজের দিকে তার পুরো খেয়াল। সাগর যতই উত্তাল মাতাল হোক না কেন তার ডিউটির সময় জাহাজ এক আধ মাইলের বেশি ড্রিফট হবে না। লোড আনলোডের সময় তো পাইপ লাইন, পাম্প, প্রত্যেকটা ভাল্ব, জয়েন্ট লিক করছে কি না, টেম্পারেচার ঠিক আছে কি না, পাম্পিং প্রেসার ঠিক আছে কি না, কোন গ্রেডের তেল কোন ট্যাঙ্কে যাচ্ছে, এক ট্যাঙ্কের তেল লিক করে ভিন্ন ট্যাঙ্কে যাচ্ছে কি না সব তার নখ দর্পণে।
এক হাতে কফির কাপ আরেক হাতে টর্চ থাকবেই, তার বয়লার স্যুটের পকেটে আস্ত এক ওয়ার্কশপ। বার বার করে তার চোখ সব কিছুর উপর দিয়ে ঘুরছে। সে নিজে ঘুরছে ডেকের এ মাথা থেকে ও মাথা। কখনো কোন গাফিলতি বা অবহেলা বা অমনোযোগ নেই। সম্পূর্ণ দায়িত্ব সচেতন। তবে খোলা সাগরে ব্রিজে ডিউটির সময় কিংবা অবসর সময় কিংবা বহির্নোঙরে নোঙ্গর করে থাকার সময় যখন ডিউটি করে তখন তার বিস্মিত চোখ অবাক হয়ে বারবার নতুন সব দৃশ্য দেখে নেয় আর ভাবে বিধাতার কি অপূর্ব সৃষ্টি যা নিজ চোখে না দেখলে বোঝা কত কঠিন!

এখন জাহাজ চলছে। এখন কোন অবস্থায় সাগর বুকে চাঁদের বিছান পথে কোন ভাবেই বেড়ানো চলবে না। আবার জাহাজে ফিরে এলো। কাপে চুমুক দিয়ে দেখে ঠাণ্ডা বরফ হয়ে গেছে। উঠে এসে আবার পানি গরম দিল, তারেককে জিজ্ঞেস করলো আর এক কাপ চলবে কিনা।
নিশাত ভাই আমি এখন আর না।
আচ্ছা বলে সে নিজে এক কাপ নিয়ে এবার ব্রিজের ভিতরে বসল। বাইরে ঠাণ্ডা লাগছে। বসে তারেকের সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ। কখনো নিজ দেশের আবহাওয়া, রাজনীতি, দেশি খাবার, প্রেম ইত্যাদি। হঠাৎ করেই একেক প্রসঙ্গ আসে আবার তা হঠাৎ করেই মিলিয়ে যায়।
দেখলাম কাল তোমার চিঠি এসেছে তা বাড়ির কি খবর?
না নিশাত ভাই তেমন কোন বিশেষ খবর নেই, এই কেমন আছ, আমরা ভালো আছি এই সব যা গতানুগতিক তাই।
হ্যাঁ তাইতো হবে, তুমি আর কি চাও?
কেন এর বাইরে আর কিছু থাকতে পারে না তাই আর কি। আচ্ছা নিশাত ভাই, ফরিদাকে (একটা জাহাজের নাম) একটু ডেকে দেখেন তো পান কিনা, শুনলাম ওরা নাকি মাস্কাটে আছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, আপনি যখন বাইরে ছিলেন তখন আমি শুনেছি ওরা গ্রে বাহরাইনের সাথে কথা বলছিল।
আচ্ছা দাঁড়াও এখনি ডাকছি।
বলে উঠে এসে রেডিওর রিসিভার হাতে নিয়ে ডাকতে শুরু করলো
‘ফরিদা ফরিদা দিস ইস প্যাসিফিক ম্যারিনার কলিং’
সাগর বুকে ইথার এর মাধ্যমে হাবিবের কণ্ঠে ভেসে এলো ফরিদার জবাব
‘ইয়েস প্যাসিফিক দিস ইস ফরিদা প্লিজ কাম ডাউন টু চ্যানেল ১৯’
চ্যানেল পরিবর্তন করে ১৯ এ এসে আবার ডাকল ফরিদাকে। ওপাশ থেকে এলো হাবিবের কণ্ঠ,
কিরে নিশাত তোদের মাস্কাট ইটিএ আমি জানি তা তোরা কি শিডিউলে আছিস নাকি চেঞ্জ হবে?
না, উই আর ইন শিডিউল!
আচ্ছা তোরা এখান থেকে শুধু ফ্রেশ ওয়াটার নিবি নাকি বাঙ্কারও (জ্বালানি তেল) নিবি?
দুইটাই লাগবে, আজ সী খুবই শান্ত কাজেই আমরা একেবারে কাটায় কাটায় পৌছাতে পারবো, এইতো আর মাত্র ৩৫ মাইল দূরে আছে, মাস্কাটের লাইট দেখা যাচ্ছে। ওদিকে আবার অরুণ’দা বলে গেছে তাকে যেন সকালে ব্রিজে আসতে না হয় তার আগেই যেন আমি নোঙ্গর করে রাখি। তাছাড়া আমরা যে ইটিএ দেই তা সাধারণত মেইনটেইন করি, আমরা তোদের মত নাকি? মনে নেই ওই যে রাস্তানুরাহ থেকে ইটালি ফেরার পথে কি কাণ্ড করেছিলি?
না রে সে তো হঠাৎ একটা দুর্যোগের কারণেই হয়ে গিয়েছিল।
আচ্ছা শোন, মনির কি ফ্লাই করতে পেরেছে খবর পেয়েছিস?
হ্যাঁ ও এতো দিনে বাংলাদেশে পুরোন হয়ে গেছে।
যাক ভালো হয়েছে, আমার সাথে মানামাতে দেখা হয়েছিল।
হ্যাঁ বলেছে, ওরা যেদিন দুবাই আসছিল সেদিন আমরা কুয়েত থেকে এখানে আসছিলাম তখন আমার সাথে কথা হয়েছে।
তাহলে তোরা এখানে কত দিন যাবত আছিস?
এইতো আজ কয়েক দিন হবে, তোদের ও এখানে দেরি হবে আমাদের পরে তোরা বের হবি কাজেই তোরা সবাই আজ বিকেলে আসবি আমাদের জাহাজে।
সেতো আসব কিন্তু এত দেরি কেন?
এদের ফ্রেশ ওয়াটারে কি যেন সমস্যা তাই
এখানে আয় আলাপ হবে তখন সব জানবি, আসবিতো?
নিশাত আমতা আমতা করছে দেখে হাবিব বলে দিল ভয় করিস না লাইফ জ্যাকেট পরে আসবি আর এক্সট্রা রেফট নিয়ে আসবি।
আচ্ছা ঠিক আছে আসবো। তোরা কোথায় নোঙ্গর করেছিস?
আমরা একটু সাউথে আছি।
আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে, আমি তোদের কাছাকাছি এঙ্কর ড্রপ করবো।
হ্যাঁ তাই করিস।
আচ্ছা শোন, তারেক মনে হয় শফিক ভাই এর সাথে কথা বলবে, উনি কি ডিউটিতে?
হ্যাঁ আছে দে ওকে।

নিশাত গিয়ে স্টিয়ারিং ধরে তারেককে কথা বলার জন্য পাঠিয়ে দিল। তারেকের কথা শেষ হলে বলল নিশাত ভাই আপনি আরও একটু থাকেন আমার ক্ষুধা লেগেছে কিছু খেয়ে আসছি।
শোন আমারও ক্ষুধা পাচ্ছে মনে হয় আমার জন্যও কিছু নিয়ে এসো।
কি খাবেন?
তুমি যা খাও তাই নিয়ে এসো।
কিছুক্ষণ পর তারেক গরম দুইটা স্যান্ডউইচ আর এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস নিয়ে এসে চার্ট টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল
দেন এবার আমার হাতে দেন আপনি খেয়ে নেন।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২

কয়েকদিন পরেই নিশাত তাদের বাড়ির পাশেই পথের পাড়ে বিরাট এক লেবু গাছের নিচে বসে সমবয়সী মইন চাচার সাথে গল্প করছিলো এমন সময় ওরা কয়েক জন এক সাথে ওই পথেই স্কুলে যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখে চোখ পরে গেল।

কি কথা হলো কি না হলো কে জানে! ওর পথ চলা থেমে গেল। ইতিমধ্যে সাথের সঙ্গীরা সবাই কিছুটা এগিয়ে গেছে, চট করে প্রায় দৌড়ের মতই এগিয়ে গিয়ে তাদের সাথে মিশে গেল। জাহাজে চাকরীতে আসার আগে সামান্য কথা হয়েছে তারপরে প্রথম ভয়েজ করে দেশে ফেরার পর সে আলাপ কিছুটা গাড় হয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার সময় থেকে শুরু করে যতদিন দেশে ছিল ততদিন প্রতিদিন একবার হলেও দেখা হয়েছে দুইজনে একসাথে বেড়িয়েছে ছবি তুলেছে। সে ছবি নিশাতের কেবিনে সাজিয়ে রেখেছে এই এর জন্যই তাহলে নিয়ে নিই, নাকি? নিজেকেই প্রশ্ন করল! গায়ের রঙ ফর্সা, গোল ধরনের চেহারা, গালের ডানপাশের তিল আর থুতনির নিচের আঁচিলটা চোখে পরার মত, দীর্ঘ এক হারা গড়ন, চোখে পরার মত সুন্দরী বলা চলে। নীল জমিনে লাল পাড় শাড়ি মানাবে ভালো। কিন্তু!! না, কোন কিন্তু নয়! যে করেই হোক এ শাড়ি তাকে দিতেই হবে। যে যা বলে বলুক। গতবার কত কি কিনে দিতে চেয়েছে কিন্তু আপার ভয়ে লোকলজ্জার ভয়ে কিছুই নিতে চায়নি। প্রথম ভয়েজেও যা নিয়েছিল তার কিছুই নেয়নি। সেগুলি নিশাতের আলমারিতেই তোলা রয়েছে। যাক, যদি নাই নেয় তাহলে এটাও আলমারিতে তুলে রাখবে।
শেষ পর্যন্ত নিশাতই কিনে নিয়ে দোকান থেকে বেড় হয়ে দেখে মনির তখন বাইরে দাঁড়ানো।
কিরে, তোর হাতে এটা কি, কী কিনলি?
না, কিছু না।
চল, ওই দোকানে দেখি।
না রে মনির, আমার ভালো লাগছে না, আমি জাহাজে চলে যাব, তুই যা।
বলেই বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা শুরু করলো। পিছন থেকে মনির ডাকল কিন্তু সে ডাক নিশাতকে ফেরাতে পারলো না।

কিছু দূর গিয়ে বুঝতে পারলো ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। পাশের দোকান থেকে এক ক্যান ঠাণ্ডা আপেল জুস নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো। কি হলো আজ? নিশাতের কিছুই ভালো লাগছে না। এই নিশাত পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি লম্বা, গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, মাথায় কোঁকড়ানো চুল, ছিপছিপে গড়নের কঠিন ব্যক্তিত্বের মানুষ, সেই নিশাতের কি হলো আজ? সারাদিন বাইরে ঘুরবে, বাইরে খাবে এই মনে করেই তো বেড় হয়েছিলো। এখন তার সব কিছু কেমন যেন ওলট পালট হয়ে গেছে কিছুই মনে করতে পারছে না।

এক হাতে শাড়ির প্যাকেট আর এক হাতে জুসের ক্যান, আর মন চলে গেছে সেই ঢাকা শহরে সোবহান বাগের বীণা আপার বাড়িতে যেখানে আছে নিরু নামের সেই মেয়েটি। ও কি এখন বই খাতা হাতে ক্লান্ত দেহে কলেজ থেকে রিকশায় চেপে বাড়ি ফিরছে, না কি আজ ক্লাস বন্ধ বলে আপার সাথে আপার ঘর সংসার সামলাচ্ছে? কি রঙের কামিজ পরেছে আজ, দেখতে কেমন লাগছে? এই শাড়িতে কি ওকে মানাবে? শাড়িটা দেবার সময় কি বলবে? এই সব ভাবনায় যখন সে হারিয়ে গেছে তখন একটা বাস এসে দাঁড়ালো। কোথাকার বাস কোথায় যাবে তা কিছু না দেখেই পকেট থেকে বাস ভাড়া ২৫ ফিলস ভাংতি বের করে ড্রাইভারের হাতে দিয়ে টিকেট নিয়ে পিছনের একটা সিটে বসে পড়লো। বাস এসে দাঁড়ালো মোহাররেকে। নেমে কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে খেজুর বাগানের মধ্যে গিয়ে বাগানের ছায়ায় বসে পড়লো।

বেশ গরম আজ, এপ্রিল মাস। এখনই এমন গরম জুন জুলাই মাসে কি হয় কে জানে! ওর পরনে লেভীস এর নীল জিনস, গায়ে হালকা আকাশ নীল টি শার্ট আর পায়ে ইতালির আরাম দায়ক জুতা তবুও ঘেমে ভিজে গেছে। বাগানের ছায়ায় কিছুক্ষণ বসে থেকে জুড়িয়ে নিলো। হাতের জুস তখন শেষ হয় নি। ঘাম শুকানোর পরে উঠে একটু হেঁটে সাগর পাড়ে একটা বড় পাথর পেয়ে তাতে বসে সাগরের দুর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইলো। হাতের কাছে পাওয়া দুই একটা ঝিনুক কুড়িয়ে সাগরের পানিতে ছুড়ে দিল, আর একটা ঝিনুক নিয়ে উঠে গিয়ে বসল সাগরের ঢেউ যেখানে আসছে যাচ্ছে সেখানে।

বসে বসে ঝিনুক দিয়ে বালুকা বেলায় সেই মেয়েটির নাম লিখল। নিরু। তার বুকের ভিতরে যে নাম লিখা রয়েছে যা কেউ জানে না, শুধু সে একাই বয়ে বেড়াচ্ছে। একটু পরেই ঢেউ এসে সে নাম মুছে দিল। আবার লিখল আবার মুছে দিল। এই এক খেলা পেয়ে বসল নিশাতকে। নাম লিখছে আর ঢেউ এসে তা মুছে দিচ্ছে। মনে মনে হেমন্ত কুমারের গাওয়া সেই গান গুন গুন করছে “এই বালুকা বেলায় ……………” কত দিন থেকে ভাবছে এই নাম? না, মনে পরছে না। হয়ত সেই ছোট বেলায় যখন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেত আর ওকে দেখত চঞ্চলা হরিণীর মত দৌড়ে বেড়াতে। জাম গাছে উঠে জাম পেড়ে সবাইকে বিলাত নিশাতকেও দিতো। ওদের বাড়ির দক্ষিণ পাশে কুয়ার পাড়ে একটা জাম গাছ ছিল, এখন নেই। পুকুর পাড়ের গাব গাছে উঠে পাকা টস টসে হলুদ গাব পেড়ে এনে নিশাতকে দিতো, আহা সেই গাবের সে কি ঘ্রাণ এখনো মনে আছে। বাড়ির পূর্ব পাশে ছিল ঈদগাহ, ওদেরই পূর্ব পুরুষদের ওয়কফ করা। ঈদগাহের উত্তর পাশেই একটা বিশাল বকুল গাছ ফুলে ফুলে একাকার হয়ে যেত আর তার গন্ধে পুরো এলাকাটাই বদলে যেত।

শহরে থাকা নিশাত বকুলের গন্ধ নেয়ার জন্য গাছের কাছে দাঁড়াত আর বাতাস তার কানে কানে বলত, শুধুই কি বকুলের গন্ধ নেবার জন্য এখানে এসেছ? একটু এগিয়ে দেখ আরও কিছু আছে। বালক নিশাত অনভ্যস্ত বন পথে পায়ে পায়ে ঝোপ ঝাড় ডিঙ্গিয়ে দেখতে পেল সেই মেয়েটি আপন মনে কুড়ানো বকুল ফুলের মালা গাঁথছে। কি করবে এই মালা দিয়ে? ভোর বেলা অনেকক্ষণ ধরে বালিকার মালা গাথা দেখল, সেই তখন থেকেই কিনা! কোন ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকার পাতায় সে দিন তারিখের কথা লেখা নেই। ওই নাম নিশাতের বুকের ভিতর কোন এক গোপন ভল্টে লিখা হয়ে গিয়েছিল নিশাতের অজান্তে যা সে জানতেও পারেনি। এই নামটা যে কে লিখে রেখেছে তা কেউ জানে না। নিশাত নিজেও না। তখন শিহাব বা যুঁই কারো সাথে তেমন একটা ভাব জমে উঠেনি।

এই গোপন ভল্টের চাবি নিশাত ছাড়া কারো কাছেই নেই। যখন মনে হয় গোপন ভল্টের গোপন চাবি দিয়ে সে নিজেই শুধু খুলে দেখে সে সব স্মৃতি গুলি, বার বার, এ ভাবে ও ভাবে উলটে পালটে। আচ্ছা, নিরু কি জানে এই গোপন ভল্টের কথা? কেন জানে না, কেন? কখন যেন আবার ওই পাথরের উপর গিয়ে বসেছে। বসে বসে সূর্য ডোবা দেখল। উঠতে মন চাইছে না। সাগরের নোনা জলের কণায় আকাশ লাল হয়ে গেছে। দিনের আলো নিভে গেছে। দূর দিয়ে চলে যাওয়া জাহাজের নেভিগেশন বাতি দেখা যাচ্ছে, পিছনে ঘুরে দেখে শহরের আলোর ঝলকানি জ্বলে উঠেছে। এতক্ষণে মনে হলো ক্ষুধা লেগেছে। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হেঁটে বাস স্ট্যান্ডে এসে বাসে করে জাহাজে চলে এলো।

মনে একটা বিষণ্ণ ভাব নিয়ে নিশাত জাহাজে ফিরে এসে দেখে শাহিন, জয়নুল ওরা সবাই রাতের খাবার খেয়ে সেলুনে বসে টিভি দেখছে, এরামকো চ্যানেলে একটা ডকুমেন্টারি ছবি চলছে। ওর প্রিয় সিরিজ কিন্তু আজ কোন আগ্রহ নেই। সেলুনে উঁকি দিয়ে দেখেই ফিরে এলো নিজের রুমে। পিছন থেকে শাহিন ডাকল কিন্তু তার কোন জবাব দিল না। কাপড় বদলে গরম জলে ঝারা একটা গোসল দিয়ে খেয়ে দেয়ে এসে আবার বসল সেলুনে। এর মধ্যে রাত সাড়ে নয়টা বেজে গেছে।
সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ওদের সাথে টিভি দেখল। জয়নুল বার বার জিজ্ঞেস করল কি কি করলে, কোথায় গেলে কিন্তু তার কোন জবাব নেই। ওরা আর চাপাচাপি করল না। জানে, নিশাত মাঝে মাঝেই হারিয়ে যায়, তখন হাজার ডাকাডাকি করেও ওকে ফেরান যায় না। আপন মনে বিভোর হয়ে থাকে। রাত সাড়ে এগারটা পর্যন্ত টিভি দেখে উঠে এলো। বারোটা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত ডিউটি। ডিউটির পোশাক পরতে হবে।

তার পরে ওরা বাহরাইনে তিন দিন ছিল এর মধ্যে আর কোথাও যায়নি। তৃতীয় রাতে সিতরা ট্যাংকার বার্থের আউটার এঙ্কারেজে এসে নোঙ্গর করলো। আধা ঘণ্টা পর পাইলট এসে জাহাজ জেটিতে নিয়ে গেল। এই জেটি কিনারা থেকে দশ মাইল সমুদ্রের দিকে। জেটিতে ভেরার পর ট্যাঙ্কে গ্যাস আছে কিনা বা পাইপ লাইনে কোন লিক আছে কি না, লিক করে সমুদ্রে তেল ভেসে যাবে কি না তা দেখার জন্য জেটি কর্তৃপক্ষের লোকজন এলো। তাদের সাথে হাই হ্যালো করে সাথে নিয়ে দেখাল। একটু পরেই আবার আসবে ইমিগ্রেশন, কাস্টমের লোকজন। তাদের অপেক্ষা। এই দেশে ওদের কোম্পানির রিজিওনাল হেড অফিস। তাছাড়া এখানে ওরা প্রায়ই আসে বলে কাস্টম ইমিগ্রেশন তেমন কোন ঝামেলা করে না। শুধু নিয়ম পালনের জন্য এসেই কাগজ পত্রে সই স্বাক্ষর করে চলে যায়। তবুও এই ফর্মালিটি গুলি শেষ না হলে জাহাজ লোড শুরু করতে পারে না। এক সময় সব কিছু হয়ে গেলে জাহাজ লোডিং শুরু হলো। লোডিং এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব ওর। ক্রুড ওয়েল লোড করে স্পেন নিয়ে যাবে। লোডিং এবং তার পরে মাপজোক হিসাব নিকাশ ইত্যাদি ফর্মালিটি সারতে সারতে সকাল দশটা বেজে গেল। এখন পাইলটের অপেক্ষা। আধা ঘণ্টার মধ্যেই পাইলট এসে ওদের জাহাজ জেটি থেকে বের করে আউটার এঙ্কারেজে পৌঁছে দিয়ে নেমে পাইলট লঞ্চে করে চলে গেল আর ওরা যাত্রা শুরু করলো স্পেনের দিকে। কয়েক দিনের পথ।

জাহাজ চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যে পিছনে ফেলে আসা মুক্তা দ্বীপের দেশ বাহরাইন দিগন্ত রেখার সাথে মিশে গেল। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি, অথৈ নীল সাগরের বুক চিড়ে এগিয়ে চলছে। এই সময় সাধারণত সাগর কিছুটা উত্তাল থাকে কিন্তু আজ বেশ নীরব শান্ত। সাগর কি নিশাতের মনের কথা জানতে পেরেছে? পারার তো কথা, সেদিন বার বার করে সাগরের বালুকা বেলায় লিখা নাম মুছে দিচ্ছিল তখন কি আর পড়ে দেখেনি কার নাম মুছে দিচ্ছে! দুপুর বারোটা বেজে গেছে, নিশাত ব্রিজে এলো।
ব্রিজ হলো জাহাজের সব চেয়ে উঁচু অংশ যেখান থেকে জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে নেভিগেশন সহায়ক নানা ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সাজান থাকে। হাই ফ্রিকোয়েন্সি রেডিও, ওয়ারলেস, ম্যাগনেটিক কম্পাস, জাইরো কম্পাস, স্টিয়ারিং ইন্ডিকেটর, ট্রিমিং ইন্ডিকেটর, ইকো সাউন্ডার, রাডার, থার্মোমিটার, হাইগ্রমিটার, আর থাকে লঙ্গিচুড ল্যাটিচুড মেপে জাহাজের অবস্থান দেখার জন্য ডেকা ন্যাভিগেটর, জিপিএস, নেভিগেশন লাইটের ইন্ডিকেটর, চার্ট(সামুদ্রিক ম্যাপ) ইত্যাদি নানা কিছু। জাহাজ চলন্ত অবস্থায় প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় তার পজিশন দেখে চার্টে চিহ্ন দিয়ে রাখতে হয়, এতে তার গতি সম্পর্কেও জানা হয়ে যায় এবং বিগত এক ঘণ্টায় কত দূর ক্রুজ করেছে এবং ডানে বা বামে কোন দিকে ড্রিফট করছে কি না তাও বোঝা যায়। ওদের জাহাজে ওরা পাঁচ জন বাঙ্গালি। ওদের সাথে আছে দুই জন ইরানি, পাঁচ জন ইন্দোনেশিয়ান এবং তিন জন ব্রিটিশ।

নিশাত ডিউটিতে এসে চিফ অফিসার অরুনের কাছ থেকে সব কিছু বুঝে নিলো। অভ্যাস মত এক বার রাডারের পর্দা দেখে নিলো, চার্টে এক নজর চোখ ঘুড়িয়ে আনল। রুটিন মাফিক যা যা দরকার সব দেখে দুই কাপ কাল কফি বানিয়ে তারেককে এক কাপ দিয়ে নিজে এক কাপ নিয়ে ব্রিজের বাইরে সাইড লাইটের স্ক্রিনের উপর যেয়ে বসল। সব ঠিক আছে। আশে পাশে ৫০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে কোন জাহাজ নেই।
স্টিয়ারিং করছিলো তারেক। জাহাজে এসে নেভিগেশনের সাথে দায়িত্ব বোধ, কঠিন নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, মার্জিত আচরণ, পরিচ্ছন্নতা সব কিছুই শিক্ষা পেয়েছে স্কটিশ ক্যাপ্টেন আলস্টার ক্যাম্পবেল, নেভিগেশন বিশেষজ্ঞ সাবেক সাউদি নেভীর সিএনসি ইংলিশ ক্যাপ্টেন মার্টিন, সীম্যানশীপ বিশেষজ্ঞ ডাচ ক্যাপ্টেন হ্যাগওয়েল এর কাছে। অনেক কিছুই শিক্ষা পেয়েছে। সে এখন দক্ষ নাবিক, কদিন পরেই হবে এই রকম কোন এক জাহাজের কর্ণধার বা ক্যাপ্টেন। পরিচালনা করবে জাহাজের সার্বিক দায়িত্ব। বয়সে তরুণ, মনে রঙ্গিন স্বপ্ন। নিশাতের মনে আবার একটু ভিন্ন ধরনের স্বপ্ন।
সে ভাবে কি ভাবে মানুষের জন্য, দশের জন্য, দেশের জন্য কিছু করা যায় বড় কিছু। অনেক বড়। নিজের না হোক মানুষের মঙ্গল হবে এমন কিছু। ও ভাবে এক সময় এই পথে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা শুধু মাত্র একটা ড্রাই কম্পাস সম্বল করে আকাশের সূর্য তারা নক্ষত্র আর দিগন্ত রেখা দেখে অনুমান করে নিজের অবস্থান নিরূপণ করে সম্পূর্ণ অনিশ্চিতের উপর ভিত্তি করে পালের জাহাজ নিয়ে কি ভাবে এই সাগর পাড়ি দিয়েছে আজ আমরা জিপিএস ব্যবহার করেও হিম সিম খাচ্ছি। যে জিপিএস মাত্র তিন মিটার এদিক সেদিক হয়। এই বিশাল কুল কিনারা বিহীন সাগরের মধ্যে তিন মিটার এমন কিছু নয়। তবুও কেমন দিশা হারিয়ে ফেলি। অথচ ক্যাপ্টেন কুক কি ভাবে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছল, কলম্বাস কি নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকা পৌঁছল নিশাতের কাছে এ এক বিস্ময়!
[চলবে]

একান্ত মার্জনীয়

সুপ্রিয় বন্ধুরা, এতদিন নীরব দেখে কি ভেবেই নিয়েছিলেন য়াহা! লোকটা বুঝি হারিয়েই গেল! না বন্ধুরা হারাইনি বা ভুলেও যাইনি। জীবনের তাগিদে নিতান্ত ব্যস্ততায় কিছুটা আড়ালে ছিলাম। আজ একটু সুযোগ পেয়ে আবার আসলাম এই শব্দনীড়ের ছায়ায়। আশা করি এই দীর্ঘ অনুপস্থিতি স্বগুনে মার্জনা করবেন। না একেবারে খালি হাতে আসিনি, আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি একটি নিটোল প্রেমের সম্পূর্ন উপন্যাস “মম চিত্তে নিতি নৃত্যে”

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে-১ (২৭)
১।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিশাতের মনে কেন যেন বেশ একটা চক চকে ঝরঝরে ভাব। ভীষণ ভাল লাগছে। কিন্তু, কি যে সে কারণ তা সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। বাইরে যাবে, নিজের খেয়াল মত ঘুরবে, বেড়াবে এই
জন্য না কি বিশেষ কারো কথা মনে পরেছে! যাই হোক, সে কারণ খোঁজার কি এমন প্রয়োজন? মন ভালো আছে, ভালো লাগছে এইতো বেশ! আর কি আছে এই বিদেশে? মরুভূমির দেশে সাগরে ভেসে থেকে এর চেয়ে আর কি চাইতে পারে? এই যথেষ্ট। সকালের টুকিটাকি কিছু কাজ ছিল, সেগুলি সেরে চিফ অফিসারকে বলে জাহাজ থেকে নেমে গেল। আজ তার শোর লিভ। মানে, আজ তার ছুটি। সাগর ছেড়ে মাটিতে চলার অনুমতি। নোনা জলের সাগর ছেড়ে সে আজ সারা দিন মাটির উপর ঘুরে বেড়াবে। এরাবিয়ান গালফের ছোট্ট দ্বীপ বাহরাইনের মানামা শহর। এখানে তার ব্রিটিশ পতাকাবাহী ‘প্যাসিফিক মেরিনার’ তেল বাহি ট্যাংকার জাহাজ রুটিন মেইনটেন্যান্স এর জন্য এসেছে।

তিন দিন থাকবে, তারপর আবার চলে যাবে এশিয়া কিংবা ইউরোপের এ বন্দর ছেড়ে ও বন্দরে । ওরা কোন বন্দরে লোড বা আনলোড করার জন্য দুই তিন দিনের বেশি সময় পায় না। কোথাও আবার সাগর পাড় থেকে পাঁচ দশ মাইল দূর থেকেই লোড আনলোড করে চলে যেতে হয়। তখন দূরের শহরের বাতি নয়তো প্রায় আকাশের কাছে পৌঁছে যাওয়া দালান গুলি দেখে স্বপ্নের কোন দেশের মত মনে হয়। আজ নিশাতের মনে খুবই আনন্দ। সাগরের বুকে ছোট্ট দ্বীপ শহরে সারা দিন একা একা ঘুরে বেড়াবে। কখনো বাসে চেপে, কখনো ট্যাক্সিতে কিংবা পায়ে হেঁটে।

সাগরের বুকে গাং চিলেদের নিঃশব্দে নীলাকাশে ওড়া, মাঝে মাঝে ডলফিনের ঝাঁকের জলকেলি, খোলা নীল আকাশ, নীল আকাশের নিচে নীল সাগরের নীল ঢেউ, ঢেউ এর চূড়ায় সাদা ফেনার লুকোচুরি নিশাতের মনকে উদ্ভ্রান্ত করে কোথায় যেন নিয়ে যায়। কোথায় যে সে হারিয়ে যায় সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। আজ একটু ভিন্ন রকম। আজ সাগর ছেড়ে সে নেমে এসেছে মাটির পৃথিবীতে। মাটির গন্ধ নেয়ার জন্য, মাটির ছোঁয়া পাবার জন্য।

জাহাজ থেকে নেমে হেঁটে ডকের বাইরে এসে পাশের স্টোর থেকে এক ক্যান ঠাণ্ডা জিঞ্জার এল কিনে মুখটা খুলে এক চুমুক দিয়ে ক্যান হাতে পাশের বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল।
হঠাৎ মন পরিবর্তন করল। না, আজ কোন বাস ট্যাক্সি নয়, আজ শুধু হাঁটবে। হাটতে হাটতে চলে এলো মানামা শহরে। এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত এলো চেনা পাকিস্তানি সিঙ্গারার দোকানে। এখানে ১০০ ফিলসে কাগজের প্লেটে চারটা সিঙ্গারা আর তার সাথে চাটনি। সাধারণ আলুর সিঙ্গারা কিন্তু কি ভাবে বানায় কে জানে, ভীষণ মজা। আর তার সাথের চাটনিটা আরও বেশি মজার। বিশেষ করে এই চাটনির লোভটাই বেশি। বাহরাইনে এলেই এই সিঙ্গারা তার চাই। নিজে যেতে না পারলেও যেই যাক তাকেই বলে দেয় আমার জন্য সিঙ্গারা এনো। আরও একটু চাটনি চেয়ে নিলো। দোকানে কোন বসার জায়গা নেই, রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে খেতে হয়, কোন পানিও নেই। আলাদা করে পানি বা সফট ড্রিঙ্ক যার যা পছন্দ তা কিনে নেয়, এ জন্য আলাদা ৫০ ফিলস। তার হাতে এখনো সেই জিঞ্জার এলের ক্যান রয়েছে। ক্যানটা দোকানের কাউন্টার টেবিলের উপর রেখে এক হাতে প্লেট ধরে আর এক হাতে খাচ্ছিল। সিঙ্গারা শেষ হলে হাতের খালি প্লেট বিনে ফেলে দিয়ে শেষ চুমুক দিয়ে ক্যানটাও বিনে ফেলে দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলো।

উদ্দেশ্য হীন ভাবে। কোন গন্তব্য নেই। মার্কেটে মানুষ গিজ গিজ করছে। প্রায় সবাই যার যার গাড়ি রেখে এসেছে শহরে ঢোকার আগে ওই সাগর পাড়ের পার্কিং এলাকায়। কেউ জোড়ায় জোড়ায়, কেউ তার মত একা। শিশু, কিশোর, তরুণ তরুণী, যুবক বৃদ্ধ, কালো, ককেশিয়ান, সাদা নানা রকমের নানা রঙের মানুষের ভিড়। আমাদের দেশের ছোট ছোট চায়ের দোকানের মত বাইরে সামিয়ানা টানান রয়েছে তার নিচে বয়স্ক লোকেরা টেবিলের চার পাশে বসে বিশাল কলকির হুক্কা টানছে আর গাওয়া (এক ধরনের কাল কফির মত) খাচ্ছে, হুক্কার নল এর হাত থেকে ওর হাতে বদল হচ্ছে। কেউ দোকানির সাথে দামাদামি করছে, কেউ কিনছে, আবার তার মত কেউ শুধু দেখছে।

সাজানো দোকান পাট তো রয়েছেই তার পাশে আমাদের দেশের ফুটপাতের মত ক্যানভাসের চাদর বিছিয়ে খোলা দোকানও আছে। বাচ্চাদের খেলনা, তৈরি পোশাক, ঘর সাজাবার নানা রকমের সৌখিন জিনিসপত্র, পারফিউম, আতর, মশলা রাখার সুন্দর রেকাবি, মোম দানি, নানা রকম কারু কাজ করা ছবি বাধানোর ফ্রেম, আরও কত কি। হঠাৎ তার চোখে পরল এই রকম এক খোলা দোকানের এক দোকানি মিসরিয় কারুকাজ করা ধুপ দানির মত একটা পাত্রে ছোট ছোট কাঠের টুকরোর মত কি যেন জ্বলন্ত কয়লার আগুনে ছেড়ে দিতেই ধোয়ার সাথে ভুর ভুর করে একটা মন মাতানো সুগন্ধ ভেসে এলো ওর নাকে। জাহাজ থেকে নামার সময় স্যেনেল ফাইভ স্প্রে করে এসেছে এ গন্ধ সে গন্ধকেও হার মানানো গন্ধ। মনে কৌতূহল হলো, এটা কী? জিজ্ঞেস করবে কিন্তু নিশাত আরবি তেমন জানে না। তার ছোট বেলা কেটেছে করাচী শহরে তাই উর্দু ভালোই জানে। তারপর আবার জাহাজে চাকরী করতে এসে পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরতে গিয়ে ইংরেজিটাও ভালোই রপ্ত করে নিয়েছে। কাজেই, কোথাও তেমন অসুবিধা হয় না। তবুও এগিয়ে গিয়ে আরবি যা জানে তাই আর উর্দু হিন্দি ইংরেজি মিশিয়ে দোকানিকে জিজ্ঞেস করলো।
ইয়েমেনি দোকানিও সেই ভাবে জবাব দিল।
কেন, আগে দেখনি? এগুলির নাম হলো আগর, বাংলাদেশ থেকে আসে। বিশাল একটা গাছ থেকে মাত্র চার বা পাঁচশ গ্রাম আগর বের হয় বলে খুব দামী জিনিষ।
কত দাম?
পাঁচ গ্রামের এই প্যাকেটের দাম দশ দিনার।

নিশাত ভেবে দেখল যাদের পকেটে এতো দিনার বা ডলার আছে, যাদের পকেটের দিনার বা ডলার দিয়ে ব্যাঙ্ক গুলি চলছে তারা ছাড়া এগুলি আর কে ব্যবহার করবে! তাদের ঘরের স্বপ্নিল আবেশ তৈরির জন্য কিংবা রাতের মোহময়তা বাড়াবার জন্য তারাই এগুলি জ্বালাতে পারে। আমার দেশেও এমন জিনিষ আছে যা আমার জানা ছিল না অথচ এই পেট্রো ডলারের দেশের ধনী লোকেরা তা ব্যবহার করছে! কি বিচিত্র এই পৃথিবী!
আগরের খবর জেনে খুশি মনে আবার চলল উইন্ডো শপিং করতে। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আজকালের ব্যস্ত মানুষের জীবন সহজ করার জন্য কি কি আবিষ্কার করেছে! বাজারে কি কি নতুন জিনিষ এসেছে তাই দেখার জন্য। ইলেকট্রনিক্সের দোকান, নানা ধরনের যন্ত্রপাতির দোকান, তৈজস পত্রের দোকান দেখে বের হয়ে কাপড়ের দোকানে ঢোকার পথেই মনিরের সাথে দেখা। মনির নিশাতের সাথে নিশাতের ২য় ভয়েজে এক জাহাজে ছিল সেই থেকেই বন্ধুত্ব। এখন ও অন্য আর এক জাহাজে আছে, সেও শোর লিভ নিয়ে কেনা কাটা করার জন্য এসেছে।
কিরে নিশাত, কেমন আছিস?
ভালো, তোর কি খবর, ইস তোকে দেখে হিংসা হচ্ছে রে!
কেন, হিংসা কেন?
ভয়েজ শেষ করে দেশে যাচ্ছিস হিংসা হবে না?
তুইও তো আর কদিন পর যাচ্ছিস।
না, আমার দেরি হবে কারণ আমার রিলিভার না এলে আমাকে ছাড়বে না বলেছে, আবার ওদিকে চিটাগাংয়ের এজেন্ট রিলিভার পাচ্ছে না।
যাক আর কিছু দিন থাক, অসুবিধা কি তোর জন্যে কি আর কেউ পথ চেয়ে বসে আছে?
যাক বাদ দে ওসব, এখন বল কি করবি?
কিছু কেনা কাটার জন্য এসেছি।

তোরা না কাল দুবাই যাচ্ছিস তাহলে এখান থেকে কিনবি কেন, এখানে তো দাম বেশি।
না, দুবাই পৌঁছবো রাতে আর আমার ফ্লাইট সকালে, টিকেট করে ফেলেছে শুনেছি, তাই ওখানে সময় পাবো না। বেশি কিছু কেনার নেই শুধু ভাবীর জন্য একটা শাড়ি।
ও তাহলে চল।
না তোর সাথে এতো দিন পর দেখা হলো চল আগে কিছু খেয়ে নিই।
কি খাবি, আমি এই মাত্র সিঙ্গারা খেয়ে এসেছি।
হ্যাঁ আমিও ভেবেছি তুই বাহরাইন এসেছিস আর এখনো সিঙ্গারা খাসনি এ হয় কি করে?
চল তুই খেয়ে নে।
না থাক, ভাবীর শাড়িটা আগে কিনে নেই তার পর দেখবো।
বা হাতে এক দোকান দেখে, এই দোকানই তো।
দুজনে দোকানে ঢুকে এদিক ওদিক খুঁজে যেখানে শাড়ি রয়েছে সেখানে গেল। অনেক শাড়ি দেখল কিন্তু কোনটাই মনিরের পছন্দ হচ্ছে না।
দেখ নিশাত এই সব মেয়েলি কেনা কাটা আমার কাজ না, তুই একটা দেখে দে।
বারে, এ আবার কি ধরনের কথা বলছিস, আমি কি তোর ভাবীকে দেখেছি? যাকে দেখিনি তার জন্য কি পোশাক বাছাই করা যায়?
শেষ পর্যন্ত নিশাতকেই একটা বাছাই করে দিতে হলো।
লাল পাড় নীল শাড়ি।
পছন্দ হয়েছে তোর?
হ্যাঁ খুব!
তাহলে দেখ দাম কত। দোকানির সাথে দামাদামি ঠিক হলো। মনির পকেটে হাত দিয়েছে দিনার বের করবে। হঠাৎ পকেট থেকে হাত বেড় করে বলল,
নারে নিশাত ভাবীর এই শাড়ি পছন্দ হবে না, এটা নেয়া যাবে না।
কি হলো, আবার এ সিদ্ধান্ত কেন?
ভাবির নীল রঙ পছন্দ না।
তাহলে এ কথা আগে মনে করিসনি কেন, এখন দোকানি বলবে কি? আমি বলছি তুই এটা নিয়ে নে, পছন্দ না হলে দেশ থেকেই না হয় আর একটা কিনে দিবি আর এটা অন্য কাউকে দিবি। তাছাড়া বিদেশ থেকে মনে করে নিচ্ছিস এটা কি কম? আমার তো মনে হয় ভাবী এতো অবিবেচক না, উনি খুশিই হবেন। নিয়ে নে, নাহয় আর একটা দেখ।
না চল অন্য দোকানে যাই।

মনির তো বলেই হাঁটা শুরু করে দিল। নিশাত তা পারলো না। নিশাত পরে গেল এক সমস্যায়। এখন কি করে! তার শাড়ি পরার মত এক মা ছাড়া আর কেউ নেই। মার জন্য এই শাড়ি চলে না। বোন আছে এক জন কিন্তু, সে এখনো ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরার মত হয়ে উঠেনি। এদিকে দোকান থেকে বেড় হয়েও আসতে পারছে না। দোকানে দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে যার কথা মনে হলো তাকে কি এই শাড়ি দেয়া যায়? কি ভাবে দিবে? কি বলে দিবে? যার সাথে আলাপ মাত্র শুরু হয়েছে এই তাকে কি করে এই শাড়ি দিবে? সে কি এই শাড়ি নিবে ওতো কিছুই নিতে চায় না!

গ্রামে যখন যেত তখন তাদের বাড়িতে ছিল নিশাতের বেশি যাতায়াত। ওর বড় চাচাত ভাই শিহাব আর বোন যুঁই ছিল নিশাতের সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই সুবাদে না কি যেন কোন সুবাদে ওই বাড়িতেই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটত। ও বাড়িতে গেলেই যুঁই ছোট বোনকে ডেকে বলতো দেখ কে এসেছে! তোর হবু বর এসেছে যা বরন কর গিয়ে! ছোট বোনের সাথে এভাবে কথা বলতে যুঁই এর মুখে একটুও আটকাত না। যা মনে আসে তাই বলে ফেলে। নিশাতও তার প্রতিটি পা ফেলার শব্দ বুঝতে পারতো, আসে পাশেই আছে। নীরবে নিভৃতেই তা অনুভব করতো। কাউকে কখনো সে কথা বলতে পারেনি। ওর সাথে কথা যা হয়েছে তা শুধু চোখে চোখে। তবে নিশাত এখনো নারী চোখের ভাষা বোঝার মত জ্ঞানী হয়ে উঠে নি। বরাবরই সে একটু উদাসীন, ভাবুক প্রকৃতির। এক দিন সকাল থেকে ফিজিক্সের কি একটা কঠিন চ্যাপ্টার নিয়ে ওরা তিন জন মাথা ঘামাচ্ছিল, এর মধ্যে দুপুরের খাবার সময় বয়ে যাচ্ছে তাই যুঁই বলল এখন আর বাড়ি যাবি কেন চল এখানে খেয়ে নে। নিশাত রাজী হয়ে ওদের সাথেই খেতে বসে গেল। আর যেন কি কি ছিল মনে নেই তবে বাতাসি মাছ আর বেগুনের চচ্চড়ি মুখে দিয়েই বলল বাঃ চমৎকার হয়েছে। আর যায় কোথায়?
সঙ্গে সঙ্গে যুঁই বলে উঠলো, হবে না, রেঁধেছে কে জানিস? তোর বৌ রেঁধেছে! নে খা, খেয়ে অভ্যাস কর বলেই আর এক চামচ উঠিয়ে নিশাতের পাতে দিয়ে দিল।

লজ্জায় নিশাতের নাক কান যেন গরম হয়ে উঠলো। কেন বোকার মত এ কথা বলতে গেল ভেবে নিজেকে মনে মনে বকল। সেদিন আর কোন কথা না বলে চুপ চাপ খেয়ে বাড়ি চলে এসেছিলো।
[চলবে]