ট্যাগ আর্কাইভঃ মামুনের উপন্যস

আগন্তুক: ধারাবাহিক উপন্যাস// পর্ব-৮

FB_IMG_1487255081432
নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য নয়। এমনি ছুটে চলা। জীবন কারো কারো কাছে অর্থহীন। তবুও ছুটে চলা। নিরর্থক ছুটে চলে প্রাপ্তি কতটুকু?

বাসটি ছুটে চলেছে ওটার নির্দিষ্ট গন্তব্যে। পেটের ভেতর রাহেলার মত গন্তব্যহীন আরো কিছু মানুষদের কে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে।
কেমন বিপরীতধর্মী লজিক! শেষ প্রান্তে গিয়ে আসলেই যে ফলাফল আসবে, তার ভেতরে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভব কতটুকু?

ভাবনার এই পর্যায়ে না চাইতেই থামতে হয়। বাসটা রাস্তার পাশে থেমেছে। রাহেলা বাসের মাঝ সারির বাম পাশের দ্বিতীয় সিটটিতে বসা। অন্য যাত্রীদের বিরক্তসূচক উস্মা প্রকাশের ভেতরেই থামার রহস্য জেনে যায়। বাসের জানালার কাচের ওপারে নিশ্চিদ্র আধার না হলেও স্পষ্টও তেমন না। গতকাল পূর্ণিমা ছিল। আজও চাঁদ মায়াবী.. গোল..নিস্প্রভ নয় আলোকরশ্মির তেজ। এর ভেতর দিয়ে কেউ একজন বাসে উঠে। সামনের দিকের লাইট জ্বলে ওঠে। ওখানে একটা সিট খালি ছিল। সেই যাত্রী.. পথের শেষ যাত্রী.. পথ এখনো অনেক.. দূরের।

লাইট নিভে গেলে অচেনা পুরুষ পেছন থেকে আবছা দেখায়।

বাসের ভেতর আলোআঁধারি পরিবেশ। অচেনা পুরুষ নিজের চেনা পরিচয়কে পেছনে ফেলে অজানা গন্তব্যে এক নতুন আইডি নিয়ে পথ চলতে এসেছে। পথের শুরু বা শেষ তাঁর জানা নেই। দক্ষ ড্রাইভার চার লেইনের রাস্তা দিয়ে অনায়াসে একের পর এক গাড়িগুলিকে ওভারটেক করে চলেছে। বেশ লাগছে। এই অন্যকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়াটা! মানব মনের চিরন্তন প্রবৃত্তি এই অন্যকে পেছনে ফেলে নিজে এগিয়ে যাওয়া। শিহাবেরও এভাবে জার্ণি করতে অনেক ভালো লাগে। ইদানিং ভালোলাগাদের বড্ড আকাল চলছে ওর জীবনে।

নিজের নেটবুক বের করে। ডিসপ্লের আলোয় নিজে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। অবশ্য পাশের যাত্রী ও সেটা টের পায় কি না শিহাবের অনুভবে আসে না। চোরা চোখে একবার সাথের ভদ্রলোককে দেখার চেষ্টা করে। নাহ! সে নিজের মনে আছে। কানে হেডফোন। সঙ্গীত পিপাসু মন! নিজের মনে একটু হেসে নিজের আয়তাকার ডিসপ্লের দিকে মনোনিবেশ করে শিহাব।

এই বাসে একজন রয়েছে। যার জন্যই এই অচেনা পথের যাত্রি হওয়া। প্রযুক্তির কল্যাণে একবার নোটবুকের ডিসপ্লেতে সেই নারীকে দেখে। অসাধারণ মুখশ্রী! সিমপ্লি বিউটিফুল!! তবে একটু জুম করে চোখ দুটি দেখতে গিয়ে ধাক্কা খায়!
এতটা বিষণ্ণ কেন নারীর চোখ?
ম্লান বেতফলের মত ঐ চোখে জমে আছে বুঝি রাজ্যের বিষাদ! কষ্টের আবরণ সরিয়ে সেখানে এক আকাশ আনন্দ ঢেলে দিতেই তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
মেয়েটির বাবা দিয়েছেন।
একজন বাবা! একজন ক্ষমতাধর। কতটা ক্ষমতা তিনি ধারণ করেন?

শিহাবের সেই দিনটির কথা মনে পড়ে… ইন্টারভিউ’র দিনটি ছিল চরম মেঘলা। আকাশ ছেয়ে ছিল কালো মেঘে। ক্রমশঃ সেটা নীলচে কালোয় রুপ নেয়। থেকে থেকে গুড়ুম গুড়ুম শব্দে পিলে চমকানো। এর ভেতরেই গুলসানের নির্দিষ্ট বাড়িটির গেটের সামনে এসে ইতস্ততঃ বোধ করছিল শিহাব। গেটে কঠোর প্রহরা। অবশ্য সবাই সিভিল ড্রেসে। কিন্তু তাদের ব্যায়ামপুষ্ট পেটা একহারা শরীর দেখে আর শীতল সাপের দৃষ্টিতে শিহাবকে মাপার ভঙ্গিটা কেন জানি ওর পছন্দ হল না। নিজের অজান্তেই একবার ভাবে চলে যায়। কিন্তু জীবনের যে গ্যাঁড়াকলে সে পড়ে আছে, সেখান থেকে এই মুহুর্তে ওকে বের করে আনতে পারে কেবল একটা জব। গোলামির রশি একজন মুক্ত মানুষকে জীবনের বাঁধন থেকে মুক্ত করতে সক্ষম!! কেমন গোলমেলে লাগে শিহাবের কাছে ভাবনা-চিন্তার এই পর্যায়টি।

যখন ক্ষমতাধর মানুষটির সামনে বিশাল এক লিভিং রুমে ওকে নিয়ে আসা হলো, বাইরে তখন আকাশের মন খারাপ পর্যায়ের অবসান হয়েছে। মেঘ বালিকারা নিজেদেরকে উজাড় করে কেঁদে চলেছে। চাকরিদাতা লোকটি ওর থেকে একটু দূরে। রুমের অপেক্ষাকৃত নির্জন কোণে আবছা আলোয় অস্পষ্ট দেখাচ্ছিল তাকে শিহাবের চোখে।
কোনো মানুষ কি রাষ্ট্রের থেকেও বড় হতে পারেন? ঐ লোকটিকে দেখে শিহাবের কাছে এমন মনে হলো। হ্যা, কখনো কখনো মানুষ রাষ্ট্রের চেয়েও বড় হন বৈকি।

উন্নত বিশ্বের অঙ্গুলি হেলনে যে সকল উন্নয়নশীল রাষ্ট্র নিজেদের প্রতিটি মুহুর্ত মেরুদণ্ডহীন ভাবে কাটায়, সে দেশগুলির জন্য কোনো কোনো মানুষ রাষ্ট্রের চেয়েও বেশী প্রভাব রাখে। শিহাবকে বলা হয়েছিল যার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সে, ‘তিনি’ বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রের একজন ‘খুব কাছের’ মানুষ। যাকে অবহেলা করা কিংবা যার যে কোনো ইচ্ছেপূরণ না করাটা, শিহাবের দেশের প্রধান নির্বাহীর পক্ষেও সম্ভব নয়। এধরণের কিছু মানুষ যাদেরকে ‘স্লিপার এজেন্ট’ বলা চলে কিংবা তাদেরকে ঐ নির্দিষ্ট ক্ষমতাধর দেশটির প্রতিনিধি- যিনি সবার অগোচরে প্রেরিত দেশটির জন্য এক ‘ইগো’ হিসেবে উপলব্ধিতে বাস করেন।

এমন মহা-শক্তিধর মানুষটির কাছে সে এসেছে। এসেছে এমনটা শিহাব ভাবছে। আসলে ওকে লাখ লাখ মানুষের ভেতর থেকে জটিল হিসাব-নিকেশ করে খুঁজে বের করে আনা হয়েছে। কেবল একজন পুরুষের সাথে ওর চেহারার লক্ষ্যনীয় মিলের কারণে!
এমন একজন পুরুষ, যে ক্ষমতাধর দেশটির এই দেশীয় প্রতিনিধির মতই ভিন্ন এক বৈরী দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। সে ও একজন ‘স্লিপার এজেন্ট’… এই ক্ষেত্রে সে ‘গ্রান্ড গ্রান্ডমাস্টার’! তবে বর্তমান মোড়ল দেশটির সাথে টক্কর দিচ্ছে এমন একটি দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে সেই মানুষটি।

সমস্যাটি মোড়ল রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর মানুষটির মেয়েকে নিয়ে। দুই বৈরী দেশের প্রতিনিধি দু’জন মানুষের ভেতরকার তীব্র রোষানলের আগুনে পুড়ে যাবার জন্যই যে শিহাবকে বেছে নেয়া হয়েছে, একথা ঘুণাক্ষরেও যদি ওর মনে উপলব্ধিতে আসত! কিন্তু নিয়তির টানেই শিহাব সেদিন এক আলোআঁধারি পরিবেশে একজন অন্ধকারের মানুষের সামনে দীর্ঘক্ষণ বসেছিল… চুপচাপ সব শুনেছিল… এরপর?

এরপর এখন এই বাসের দুরন্ত গতির সাথে তাল মিলিয়ে পৃথিবীর দীর্ঘতম সাগর সৈকতের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে। গন্তব্যহীন কিন্তু সঙ্গীবিহীন নয়। একজন অচেনা সঙ্গিনী রয়েছে ওর এই যাত্রায়। যাকে ঘিরেই নেপথ্যের কুশলীবেরা জাল রচনা করেছেন। সেই অচেনা সঙ্গীনিকে চেনাটাই ওর এবারের এসাইনমেন্ট।
এসাইনমেন্ট! একটু জোরেই কি হেসে ফেলে সে? সাথের যাত্রীর কানে হেডফোন নেই। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু ওর হাসির আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে অবাক তাকিয়ে রয়।

ক্ষমা প্রার্থনার হাসি হেসে নিজের নেটবুকে নিজের জগতে হারায় শিহাব। সাথের যাত্রী ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখে নিয়ে চোখ বুজে হেড-রেস্টে হেলান দেয়।

চমৎকার এক মধ্যরাতে কালো পিচ ঢালা পথে জোছনায় ভিজে ভিজে একটি দূরপাল্লার বাস অন্য গাড়িগুলিকে মুহুর্মুহু ওভারটেক করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে ছুটে চলে… কেবল একজন পুরুষ ও এক বিষণ্ণ নারী যার যার মনে জেগে থাকে।

(ক্রমশঃ)