ট্যাগ আর্কাইভঃ মাহবুব আলী’র গল্প

বৃত্ত-আবদ্ধ জনম

তেরো মাসের শিশু; মায়মুনার মন কিছুতেই সায় দেয় না। সে তো মা। সে কি করে পারবে অমন কাজ? দুধের বাচ্চা, ওকে না দেখে মরে যাবে যে! না না কিছুতেই পারবে না।
সিরাজুদ্দিন প্রথমে মাথায় হাত বুলোয়। মিষ্টি করে দুটো কথা বলে। তারপর খুব দ্রুত আর গভীরভাবে বউয়ের গালে চুমু খায়। তির্যক তাকায় শিশুপুত্রের দিকে। দুপুরের ঝাঁজালো রোদ ঝুপড়ির ভেতর কেমন শীতল আর ম্লান হয়ে গেছে। সেই আলোতে দেখে, সুলেমান ছোট্ট হাতদুটো দিয়ে মায়মুনাকে জড়িয়ে ধরে আছে। ঠোঁট দিয়ে টেনে নিচ্ছে অমৃতধারা। মায়মুনার ফরসা স্তনের চারপাশ ঘিরে থাকা শিরার নীলচে রেখাগুলো এই জীবন আর বেঁচে থাকার অনন্য এক শিল্প। মা ও শিশুর এই মায়াময় দৃশ্য সিরাজের বুক ঠেলে ভারী দীর্ঘশ্বাস বের করে দেয়। আর উপায় নেই, তাদের বাঁচতে হবে।
সিরাজ বেঁচে থাকার অনেক মূল্য দিয়েছে। অবশেষে একান্ত বাধ্য হয়ে অসহায়ের মতো মায়মুনাকে বলে রুবির মায়ের কথা শুনতে। ছেলেকে তো একেবারে দিয়ে দিতে হচ্ছে না। বিকেলে বা সন্ধেয় ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। আর এই সামান্য কয়েক ঘণ্টার জন্য রুবির মা কুড়ি-পঁচিশ টাকা হাতে দেবে। হতভাগা সংসারে কার‌ও ঠিকমতো খাওয়া জোটে না। একটু তো সুদিন আসবে। স্থিতি আসবে। সুলেমানকে সুজি বার্লি কিংবা কৌটার খাবার, কি বলে সেরেলাক কিনে দেবে।

দিন কয়েক আগে থেকেই কথা হচ্ছিল। রুবির মা বসে বসে পান চিবোয়। সিরাজের পেছনে বসেছিল মায়মুনা। সে তাদের সব কথা শুনে রেগে যায়। কি বাচ্চা ভাড়া! কোন্ মায়ে তার বুকের ধন ভাড়া দেয়? রুবির মা, বিগত যৌবন চেহারায় রাজ্যের ছেনালি এনে হি হি করে হেসে উঠে। ঝুপড়ির দেয়াল ঘেসে অনাদরে গজিয়ে ওঠা টমেটো গাছের পাতায় পচাৎ করে পানের পিক ফেলে। সবুজ সুন্দর চারাগাছ আপনিই কোনোদিন মুখ উঁচিয়ে সূর্য দেখতে শুরু করেছে কে জানে! তখন আধবুড়ি খ্যাসখ্যাসে গলায় মায়মুনার উদ্দেশ্যে বলে, –
‘ছইল নিয়া কি হাওয়া হইম বা হে! মোর উবি যদু বাঁচি থাকিল হয়, ওরে বেটাবেটিনি কাজোত গেনু হয়। আর মাগনা তো তোর ছইল নিগাম না…ট্যাকা দিম।’
সিরাজের সবকিছুতে অতি আগ্রহ। সেই ধরে এনেছে বুড়িকে। কোত্থেকে কি খবর কেমন করে যে পায় কে জানে! সে দু-চোখে চকচকে লোভ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, –
‘কত্ ট্যাকা দিবু?’
‘তা কামাই ভাল্ হইলে বিশ পঁচিশ দিম।’
‘আর যদু তেমন ওজগার না হয়?’
‘ওজগার ক্যান হবি না!’
বুড়ি আচমকা সিরাজুদ্দিনের উপর ধমকে উঠে। প্রত্যুত্তরে সে মিন মিন করে থেমে যায়। বুড়িকে ক্ষ্যাপানো যাবে না। সে মায়মুনার দিকে দৃষ্টি দেয়। তাকে বোঝা যায় না। গতরাতেই আভাস দিয়েছিল। রুবির মা সকালে আসবে। কিন্তু মায়মুনা ভোর থেকেই ছেলেকে একেবারে বুকের ভেতর নিয়ে বসে থাকে। ঝুপড়ির ভেতর শুইয়ে রাখেনি। সিরাজ আবার ছোট একদীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয় মায়ের বুকের ওমে নিরাপদ নিশ্চেন্তে বাচ্চা হয়তো কোনো পরির দেশের স্বপ্ন দেখতে থাকে। সেখানে ক্ষুধা নেই বেঁচে থাকার যন্ত্রণা নেই। স্বপ্ন দেখে আর ফিক ফিক করে হাসে। সিরাজ আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজেকে তার পাষাণ সীমারের মতো মনে হয়। কিন্তু উপায় আর কি আছে? তার দিনকাল খুবই খারাপ যাচ্ছে। গেল সপ্তাহে ভ্যান টানতে গিয়ে পিঠের উপর রগ উঠে গেছে। নিজের ক্ষতি তো শুধু নয় ভ্যানটাও শেষ। সেটার ফ্রেম কয়েক টুকরোয় ভেঙে পড়ে। ভ্যানের মালিক পৌরসভার কমিশনার, খবর পেয়ে রিকশায় পায়ের উপর পা তুলে ছুটে আসে । এসেই দুর্দান্ত গালাগাল।
‘চুতমারানির বাচ্চা, ওভারলোডিং করছিস ক্যা? এইডা কি লোহার গাড়ি যে তোর মায়ে-বাপে চোদ্দো গুষ্টি রে উঠাবি? শালা বানচোত।’
‘আপনারে তো অনেকবার কইছি মহাজন, ওল্ডিং ফেরেম বেশি দিন যাবা ন। দুইটা বস্তা উঠাইতে এই অবস্থা।’
‘শালা পলিয়া ধুর, খালি মুখে-মুখে তক্কো করসি, যা তোরে আর ভ্যান চালাইতে হবে না। ভাগ এইখান থিক্যা।’
‘কিছু ট্যাকা দেন অষুধপত্তর কিনিবা লাগিবে।’
কমিশনার তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। হাঁটুর নিচে পেছন দিকে কেটেছে। রক্ত চুইয়ে পড়ে জমাট বেঁধেছে। কয়েকটা মাছি রক্তের স্বাদে ভনভন করছে সেখানে। কমিশনারের মন কি ভেবে আদ্র হয়। দশ টাকার একটা নোট এগিয়ে ধরে।
‘মহাজন পঞ্চাশ টাকা দেন, বাড়িতে চাল-ডাল কিছু নাই।’
‘ভাগ শালা, গাড়ি ভাঙলি আবার টাকা।’
‘দেন মহাজন দেন। পিঠের বেদনাটা সারি গেইলে ফির কাম করি শোধ দেমো।’
‘তোকে আর গাড়ি দেব না। পলিয়া চাষা, পথঘাট বুঝিস না, ট্রাফিক মানিস না। যা আর এই পাঁচ টাকা নিয়া দূর হ।’

সিরাজুদ্দিন মালিকের মন গলাতে পারেনি। ভাঙাচুরা ভ্যানগাড়ি মেরামত কারখানায় পৌঁছে দিয়ে হাসপাতাল যায়। ডাকতারের লিখে দেয়া স্লিপের কয়টা ট্যাবলেট নিতে ওয়ার্ডবয়কে পাঁচ টাকা ঘুষ সাধে। তারপর দশ টাকা দিতে হয়। সেই অষুধে কাজ হয়নি। পিঠের ব্যথায় সুড়সুড়ি লাগে মাত্র। মায়মুনা পয়মন্ত বউ। একটু একটু করে সঞ্চয়ের যে কয়েকটি টাকা হাতে রেখেছিল, ওই দিয়ে আরও ট্যাবলেট কেনে। এক-দেড় কিলো চাল, আড়াই শ মসুর ডাল। পাঁচ টাকা অ্যারারুট বার্লি। জীবন আর বেঁচে থাকায় কত কি লাগে! সব জোগাড় করা যায় না। সেই টাকাও ফুরিয়ে গেল। গত দু-দিন আশেপাশের সক্ষম পরিবারগুলোর কাছে থেকে এটা-ওটা ধার করে লবণে ফুটিয়ে চলছে। এখন কেউ আর কিছু দেয় না। ধারবাকি নেই। পাওয়া যাচ্ছে না। সকলের এককথা, আশ্বিন-কার্তিক মাস…মঙ্গার দিনকাল। অনেকের কাজ নেই। ষষ্টিতলা আর ঘুগড়াতলি গিয়ে বসে থাকে। কেউ কাজের জন্য ডেকে নেয় না। সিরাজও কয়েকদিন বসে ছিল। কাজ করতে পারবে কি না কে জানে, তবু আশায় আশায় সময় গোনে; আশাই তো জীবন। কিন্তু কেউ ডাকে না। সে বুঝে ফেলে, যার কিছু নেই, কোনো দাম নেই। জগৎ তেলা মাথায় তেল ঢালার। যারা শূন্য তারা শূন্য…মূল্যহীন। তাদের জীবন কষ্টের বৃত্তে আবদ্ধ। তারা সেখানেই ঘুরপাক খেতে থাকে।

গত পরশু ভোরবেলা আবার ষষ্টিতলার মোড়ে বসে থাকে। অনেকেই আসে। কারও হাতে টুকরি কোদাল, কেউ দা-কুড়াল নিয়ে অস্থির বসে বা দাঁড়িয়ে থাকে। এদিক-ওদিক হেঁটে বেড়ায়। বিষাদ দৃষ্টিতে অচেনা প্রত্যাশার রংধনু খেলা। সবাই মজুর। এই দুনিয়া হুজুর আর মজুরের। ঈশ্বর আর বান্দার। সে হতভাগা বান্দা। বটগাছের নিচে বিমর্ষ চেহারা শুকনো দৃষ্টি বসে থাকে। তার হাতে দা-কুড়াল-টুকরি-কোদাল কিছু নেই। মাথায় জড়ানো ময়লাটে লাল-গামছা পরিচয় বহন করে। সে শ্রমিক। মজুর মানুষ। কাজ জোটে না। একনাগাড়ে বসে থাকায় পিঠের শিরা পেশি আরও টানটান হয়ে যায়। ব্যথা বাড়ে। সে অসহায়ের মতো এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে, কিছু খুঁজতে খুঁজতে একবার খুব অসহায় কষ্টে ভাবে, ঝুপড়িতে ফিরে যাওয়াই ভালো; একটু শুয়ে থাকতে মন চায়। উপায় কি আছে? সে ওঠে না। অপেক্ষা যদি কোনো কাজ পাওয়া যায়। আশায় আশায় সকাল গড়িয়ে চলে। তারপর আকস্মিক এক পুলিশ এসে ডেকে নেয়। তার বাসায় গিয়ে কচি এক জলপাই গাছ টুকরো টুকরো কাটে। পুলিশের ছেলেমেয়েরা অপরিপুষ্ট জলপাই কুড়োতে হইচই লাগিয়ে দেয়। সিরাজের মন বড় বিষণ্ন। আহা এত সুন্দর গাছ! সবুজে সবুজে ভরে ছিল। নতুন ফলের অদ্ভুত সুবাস। গাছের প্রতি অনেক দরদ। বাসাবাড়ি থাকলে অনেক অনেক ফলের গাছ থাকত তার। কিন্তু উপায় কি? তার তো কোনো জায়গা-জমি নেই। এত বড় পৃথিবীতে এক-দুই আঙুল জায়গাও না। রেললাইনের ধারে পাথর-সুরকি-আবর্জনার পাশে ছোট ঝুপড়ি তুলেছে। তারই অন্ধকার স্যাঁতসেতে মাটিতে শুয়ে থাকে। মায়মুনা আছে। আদরের বউ। এখন সুলেমান। তার আত্মজ। নিজের জন্য নয়ই, তাদের জন্যও কোনো সুখ-শান্তি এনে দিতে পারে না সে। এভাবেই সংসার-জীবন আর বেঁচে থাকা…সেভাবেই কোনো একদিন টুপ করে মরে যাওয়া। অর্থহীন আসা-যাওয়া জীবন। সে আর ভাবে না। মানুষ যেমন করে চায়, গাছের টুকরো করে। নির্দেশ অনুসারে সাজিয়ে রাখে। সন্ধেয় যখন মজুরি পায়, এত নগন্য, গাছ নয়, সারাদিন বোধকরি নিজেকে ফালা ফালা করে কেটেছে সে। পুলিশ মানুষ পয়সা নিয়ে কথা আর বাড়াবাড়ি করার ভরসা পায়নি। বলা যায় না, কোনো কেসে ঢুকিয়ে চালান করে দেয়। এই কারণে তো গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে হয়েছে।

সিরাজুদ্দিন জোর করে হারানো দিন ভুলে যেতে চায়। কী হবে ভেবে? সে ফিরে আসে বাস্তবে। সকাল সোনালি রোদে ঝলমল করছে। উজ্জ্বল আলো চারপাশে। তার সকাল হয় না…অন্ধকারে আলো জাগে না। সামনে বুড়ি বসে আছে। শকুনি লোভে চকচকে বড় চোখ এদিক-ওদিক কিছু খোঁজে। পান চিবোয়। চোয়াল হাপরের মতো ওঠে আর নামে। সিরাজের মনে হয়, প্রচণ্ড কালো কোনো গহ্বর গিলে খেতে এগিয়ে আসে…এগিয়ে আসছে। তার দৃষ্টি সেই অন্ধকার বিবরে হারিয়ে যেতে থাকে।
মধ্যরাতে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে সিরাজ। কার্তিকের হিমহিম বাতাস অথচ সে ঘেমে নেয়ে উঠে। অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন-বিমুঢ় জেগে থাকে। সে কি বেঁচে আছে না কি মরে গেছে? মাথা কাজ করে না। অনেকক্ষণপর আকস্মিক সম্বিত ফিরে পায়। অন্ধকার ছায়া ছায়া ফ্যাকাশে আলোয় পাশে তাকায়। মায়মুনা নিথর শুয়ে আছে। ছেঁড়া ব্লাউজের ফাঁকফোকর দিয়ে ফরসা বাহুমূল আর বুক অদমনীয় কামনা জাগায়। অদ্ভুত মায়ার খেলা। মায়মুনা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরেছে ছেলেকে। অষ্টমীর চাঁদ অনধিকারের মতো ঝুপড়ির ফুটো দিয়ে নেমে এসেছে তার চোখে-মুখে। সেই মুখছবি না বলা কত বেদনায় আশ্চর্য বিষাদ-করুণ। আলোছায়ায় জেগে থাকে আর সুনসান নীরবতা। সিরাজের দুর্ভাবনা-হতাশার কোনো ক্লান্তি নেই। সবসময় তাড়া করে। ঘুমের মধ্যেও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। প্রতিরাতে দুঃস্বপ্ন তাড়িত বারবার ঘুমের মধ্যে চমকে উঠে। তারপর ভয়ংকর জেগে উঠে রাত পাহারা দেয়। তার সামনে-পেছনে অন্ধকার…শুধুই অন্ধকার। তার আর ঘুম আসে না। আজ তার নিবিড় সজল দৃষ্টি আত্মজের উপর ছড়িয়ে পড়ে। তাকে কোলে তুলে নিতে সাধ হয়। আহা! যে বুকের ধন আগলে রেখে মানুষ করবে তাকেই কিনা অবলম্বন করতে হচ্ছে । সিরাজ বড় পাষণ্ড। এভাবেই নিজেকে তার করুণা করতে ইচ্ছে জাগে। চারিদিক ঝাপসা হয়ে যায়।

পিঠের ব্যথা কমেনি। ওষুধ কেনার টাকা নেই। হাসপাতালের ডাকতার বলেছে, এক্সরে করতে হবে। পেশাব পরীক্ষা করা দরকার। হাড়ে চির ধরেছে কি না? কিডনি সমস্যাতেও পিঠ-কোমর ব্যথা হতে পারে ইত্যাদি। সিরাজ তেমন কিছু বোঝে না। এটুকু শুধু ধরে নেয়, হাসপাতাল হলো শেষ ঠিকানা, ডাকতার মানে টাকা, টাকা খাওয়ার কসাই। হাজারো পরীক্ষা-নিরীক্ষার চিকিৎসা সিরাজের জন্য নয়। তার জীবনের মুল্য কয় পয়সা? অবশেষে ব্যথা কমাবার কয়েকটা ট্যাবলেট খেয়ে পেট পচিয়ে ফেলে। এখন পিঠ আর পেট দুটোতেই অসহনীয় ব্যথা। তবু তাকে সইতে হয়। হসাপাতাল আর যায়নি।
রাতে মায়মুনা খুব মমতায় অনেকক্ষণ ধরে পিঠে পোড়া মবিল মালিশ করে দেয়। এতে সাময়িক আরাম লাগে। কিন্তু আধঘণ্টা যেতে না যেতেই ব্যথা দ্বিগুন বাড়ে। বাড়তে থাকে। পিঠ আর পেটের ব্যথায় বেঁচে থাকা হয়ে ওঠে প্রচণ্ড ঘৃণার। সে কখনো চিত হয়, কখনো উপুড়, কখনোবা কাত; স্বস্তি বা শান্তি তবু আসে না। তখন মায়মুনার শরীর ঘেষে পড়ে থাকে। ঘুমকাতর বউ তার ডানহাত টেনে নিজের বুকের উপর চেপে রাখে। সিরাজ কোনো অলীক কল্পনায় ভেসে যেতে চায়। পারে না।
দুঃস্বপ্নের ছবিগুলো ভেসে আসে। মুখ ব্যাদান ভয়ংকর একেকটা চেহারা…মৃত্যুদূত। সিরাজ নিজের জন্য কোনো ভয় পায় না। সকল অস্থিরতা সন্তান আর মায়মুনাকে ঘিরে। বড় অসহায় তারা। বানের জলে কচুরিপানার মতো তার পাশে পাশে ভেসে চলেছে। এই তার অশান্তি…অস্থিরতা। সুখ-শান্তির সঙ্গে সঙ্গে কোনো নিরাপত্তাও নেই। তার মাঝে মৃত্যুদূত! কখনো প্রচণ্ড হাসি পায়। গরিবির চেয়ে ভয়ংকর কষ্ট মৃত্যু দ্বিতীয়টি আর নেই। তাকে অন্যকিছু আর কি ভয় দেখায়? দুঃস্বপ্ন? গরিবির বৃত্ত-ফাঁদ-আবদ্ধ জীবনে স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন সব অন্তঃসার।
তার আর ঘুম হয় না। কোনোদিনই আসে না। রাতের কোনো প্রহরে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর জোড়া লাগে না। সে শুয়ে শুয়ে ভাবে, কত ভাবনা, কত কষ্ট, কত সাধ; আর মায়মুনার কথা। সে কি ছেলেকে দেবে? তার অনেক কষ্ট হবে…তবে পারবে। মেয়েরা সব পারে। তারা এ সমাজ-সংসারে বুকে পাথর বেঁধেও হাসতে পারে। আড়ালে-অন্তরালে শত দুঃখ-বেদনা-চাপাকান্না লুকিয়ে রেখে কী করে যে মায়মুনা হাসে…বাঁচতে শিখেছে, সিরাজ কোনো কিনারা পায় না।
খোলা আকাশের ছায়াপথ আর চারপাশের আলো-অন্ধকার দেয়ালে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার পেছনে ফিরে যায় সিরাজ। গ্রামের সবুজ দৃশ্যাবলী। সবুজ গাছপালা-বাঁশবাগান-পুকুর আর দূর থেকে জেগে থাকা একলা তালগাছ…বৈকুণ্ঠপুর। তার শৈশব-কৈশোর আর যৌবন শুরুর দিনকাল কেটেছে সেখানে। দিনগুলো কি সুন্দর মায়াময় ছিল। সেখানের কত দৃশ্য, কত ছবি, কত কথা ভাবতে ভাবতে বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে দীর্ঘশ্বাস তৈরি হয়। দুঃখের দিনগুলোও মনে পড়ে। সেখানেও দুঃখ-শঠতা-অত্যাচার ছিল। এসবের মানচিত্র সবখানেই একরকম। মালিক আর শ্রমিকের সম্পর্কের মতো।
মাত্র দু-মণ ধান চুরির অপরাধে শিকদার সাহেব থানায় তুলে দিয়েছিল তাকে। বড়লোক মানুষ। সিরাজ কিছুতেই বোঝাতে পারেনি অপরাধ তার নয়। শিকদার বাড়ির বড়ছেলে মোজাম্মেলর হয়ে ধান বিক্রিতে সহায়তা করেছে মাত্র। মোজাম্মেল অস্বীকার করে। সিরাজ হয়ে যায় চোর। থানায় খুব খাতির হয় তার । সেই শিশুকাল থেকে বাপের হাত ধরে শিকদার বাড়ি যাওয়া। তার ছোট্ট হাতে শত শত কাজ, ফাই-ফরমাশ, নরম কচি মনে দিনে দিনে ভৃত্যের শেঁকলে বাঁধা আনুগত্য মজবুত হতে থাকে, আন্তরিক গভীরতা পায়, সে হলো দীর্ঘ এক মহাকাব্য; সেদিন ছাব্বিশ বছরে এসে পুরস্কৃত হয়। তাকে প্রায় উদোম করে নিমগাছে বাঁধা হলে সকালের উজ্জ্বল আলোয় শত শত মানুষের দৃষ্টিতে কৌতূহল জমে উঠে। সার্কাস খেলার বিশেষ আকর্ষণ। শিকদার থানার বারান্দায় হাতলঅলা চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে নাচাতে থাকে। তার দু-চোখে বিকট ভর্ৎসনা…কখনো বীভৎস রাগ খেলা করে। এই লোক বড় বেশি কথা বলে, চাকর মানুষ, মোজাম্মেল ডাইল খায় না কি খায়; এত বড় গলা তোর?
পুলিশের চাবুক চলে। সিরাজের চিৎকার-আর্তনাদ নিমগাছ থানা চত্বর আর দেয়াল পেরিয়ে উন্মুক্ত মাঠে ভেসে যায়। সেখান থেকে তেপান্তরের দিগপ্রাইলন্ত আকাশগঙ্গায়। জীবন রূপকথার মতো জিয়ন-মরণকাঠি নয়। সেখানে শুধু দৈত্য আর রাক্ষস। এখানে কাপুরুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকা হাজার মানুষ তাকিয়ে দেখে। চোর পেটানো চলে। সিরাজের বোধ নেই। কেউ চেতনাহীন কোনো সত্ত্বায় ভেবে যায়, কী অপরাধ তার? সে সত্য বলেছিল। মিথ্যের এই জগতে সত্য বড় বিকট বেমানান লাগে। অপরাধ: সে গরিব। তার উপর চাবুক চলে। গরিবের শরীর কেটে ছিটকে গড়িয়ে পড়ে সত্য বলার শাস্তি। রক্ত। নির্বুদ্ধিতার লালরং। সেই রক্তে কুকুরে জিহ্বা দেয়। সুখ করে চাটে। সিরাজ কী করে? তার দুই হাত উঁচু করে বাঁধা। শিশ্নের ডগায় আধ-ধারা বাটখারা দড়ি বাঁধা ঝোলে। সবকিছু টনটন যন্ত্রণায় অসাড়-অস্তিত্বহীন। কোত্থেকে কয়েকটি নীলমাছি উড়ে উড়ে রক্তের গন্ধে মাতোয়ারা হয়। এদিক-ওদিক অস্থির ভেসে ভেসে বুঝে নেয় রক্তের স্বাদ। জনগণ সার্কাস দেখে। একসময় সবকিছু ঝাপসা অন্ধকার, শুধু অন্ধকার কালো গহ্বর; স্যাঁতসেঁতে কাদামাটি দেয়ালের বিশাল বৃত্ত জেগে থাকে। সে ওই আকারবিহীন বিবরে বন্দি। তারপরও কোনো শকুনমুখি কুকুরের ছায়া, ভয়াল দাঁতাল, মুখ ব্যাদান হাসতে থাকে। সেই ছায়াকাঠামো কখনো কুকুর, কখনো শিকদার অথবা কখনো পুলিশের বলে ভ্রম হয়। এভাবেই সত্যি সত্যি অন্ধকার নেমে আসে।
সিরাজ পরদিন অজানা এক ডাকাতির মামলায় সদরে চালান হয়ে যায়। তার ঘরে বিয়ে করা নতুন বউ। সে মায়মুনাকে সাবধান করে দিতে পারে না। বলে যেতে পারে না, ‘বউ তুই শিকদারের মিলে যাস না।’
মায়মুনা সাবধানী মেয়ে। সে আর কাজে যায়নি। কেউ কেউ শঠতার পৃথিবীতে ঠকতে ঠকতে নিজে থেকে সবকিছু শিখে নেয়। মায়মুনা তেমন। সিরাজ যখন থানা চত্বরে আর্তনাদে ভেসে গেছে, মায়মুনা বসে থাকেনি। শহরে গিয়ে ধর্মবাপ উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করে। অবশেষে সিরাজ পনের দিন জেল খেটে ছাড়া পায়। মায়মুনাকে তাই কিছু বলতে পারে না সিরাজ। সে তার অর্ধেক জীবন। আদরের বউ। আজ সেই প্রিয় মানুষকে কষ্ট দিতে নিজেরও খুব কষ্ট হয়। অন্য আর কোনো উপায় নেই? নেই। সিরাজ কী করে? দুনিয়াতে ক্ষুধার চেয়ে বড় কষ্ট আর কী আছে? সে অসহায়ের মতো আলোছায়া আকাশে একটু আলো খোঁজে, কোনো সকাল; কিন্তু অন্ধকার। অক্ষমতার কষ্টের চেয়ে আরও ভারী, আরও যন্ত্রণাদায়ক শুধু অন্ধকার।

মায়মুনা আগাম পঁচিশ টাকা পেয়েছে। সেই টাকা এখন সিরাজের হাতে। সে চুপ করে আছে। মায়মুনা বারবার বুড়িকে সতর্ক করে। বাচ্চার মাথায় আঁচল দিয়ে রাখতে হবে, রোদ লাগানো চলবে না, কত কি! একটু আগে দুধ খাইয়েছে। চোখে টেনেছে কাজলরেখা। কপালের কোণায় বড় এক টিপ। বুড়ি বলে, –
‘ন্যাও বা হে, ব্যাটা তোমহার সিনামা দেখিবার যাছে না। যতই সাজে দিবু ততই অসুবিধা। মানুষ আউলা হইলে ভিক্ষা বেশি পাওয়া যায়।’
‘ভিক্ষা তো তুই করিবু চাচি, মোর ব্যাটা নাহায়। রাস্তাঘাটোত্ যাবু, মাইনষের নজর খারাপ; নজর লাগে যদু। দুফর রোইদের বাও-বাতাস আছে না?’
‘মুইহো ভিক্ষা করিম তোমহার ব্যাটাও করিবে। একজন আঁও কাড়িবে আর একজন…।’
সিরাজুদ্দিন কাছেই বসে আছে। সে এবার চমকে বুড়িকে চোখ টেপে। বেশি কথা বলা যাবে না। ধূর্ত বুড়ি সুর পালটে ফেলে একেবারে।
‘দ্যাও মা, ভাল্ করি সাজে দাও। আহা রে যাদু…!’
‘সাঁঝ লাগিবার আগোতে সুলেমানোক দিয়া যাবু চাচি। দিনকাল ভাল্ নাহায়, কি কয় বলে, বাচ্চা খুবে হারাছে।’
‘মোক তরা অবিশ্বাস করেন বা হে?’
সিরাজ আর কথা বাড়ায় না। এসব কথায় মায়মুনা হঠাৎ বিগড়ে যেতে পারে। সেও বাচ্চাকাচ্চা হারানোর কথা শুনেছে। কেউ বলে নতুন ব্রিজে মানুষের রক্ত দিতে হয়। কেউ বলে ডাকতারেরা মানুষ কেটে কি কি সব নেয়। মানুষ বলতে বাচ্চা, আর বাচ্চা বলতে গরিবের বাচ্চা; যাদের খোঁজখবর নেয়ার মতো দরদি কেউ নেই। সে বুড়িকে চেনে। বেশিদিনের পরিচয় অবশ্য নয়। মানুষ খারাপ না। আর…সে-সকল দুর্বভাবনার ইতি টেনে নেয়। হয়তো জোর করেই।
মায়মুনা ছেলেকে বুড়ির কোলে তুলে দেয়। সিরাজ খুব বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এ ছাড়া আর কী করে? মায়মুনার মেঘজলভার দৃষ্টি, অব্যক্ত গম্ভীর মুখছবি; সিরাজ একপলক তাকিয়ে চোখ মাটিতে নামিয়ে রাখে। মাটির মতো সহনশীল হতে আকাঙ্ক্ষা করে। ডানহাতে সযত্নে চেপে রাখা তিনটি নোট অসম্ভব ভারী লাগে। সুলেমান তো তারও সন্তান…কলিজার টুকরা। সে ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে তাকিয়ে থাকে। রেললাইন অনেক দূর পুব-দিগেন্ত মিশে গেছে। কেউ একজন বুকের মধ্যে বিড়বিড় সান্ত্বনা হাতড়ায়। ‘বউ দুইটা দিন, পিঠের ব্যথা সারি গেইলে ফের মুই জোন দিম, রেকশা চালাম, ভ্যান চালাম।’
সিরাজের দৃষ্টি বোবা। মায়মুনার বামদিকের দুগ্ধভার পুরুষ্ট স্তন ছেড়া-বোতাম ব্লাউজের নিচে বেরিয়ে আছে। বৃন্ত বেয়ে বুকে-পেটে নেমে গেছে দুধ। সেখানে অদ্ভুত আলপনা-রেখা। অমৃতধারার কোন্ বিক্ষোভ? সেই একজন বুকের মধ্যে ডুকরে কেঁদে উঠতে চায়। কেঁদে কেঁদে অক্ষম প্রতিবাদ করে, আমি এ জনম চাইনি খোদা… এ জনম চাইনি।

আর ওইদিন থেকে এক ভিক্ষুকের জন্ম হয় এই অদ্ভুত স্বপ্নমাখা আলোকিত পৃথিবীতে। *

সিঁড়ি

এখন কীভাবে নিজেকে সেখানে নিয়ে যায়, থই পায় না সখি। দিশেহারা ভাবনা খেই। প্রচণ্ড ভিড়। পিঁপড়ে কিলবিল। তারা এগিয়ে যায়। ছুটোছুটি-হুড়োহুড়ি। কে কাকে ঠেলে ফেলে দেয়, কে পড়ে যায়, কার বুকে কার পা ওঠে; কারও নজর নেই। অনেক ভিড় দেখেছে সখি। কোটি মানুষের ভিড়ে মানুষ একলা পথিক। সখি আজ আবার পথে নেমেছে। পথের মানুষ পথে। আজ ফেরার পথ।
সখি একলা। একদিন শূন্যহাতে এখানে এসেছিল। সন্ধের ট্রেন যাত্রা। তখন ঈশাণ কোণ-ঘেষে একলা চাঁদ। চারিদিক হিম-কুয়াশা ঘোলা আলো। মায়ের জন্য মন কেমন করে। ফিরে যাবে? সে যায়নি। এরপর কেটে গেছে একশ পঁচাশি দিন। আজ ফিরে যেতে এসেছে। একটিবার দেখা। ট্রেনে উঠবে। এখন বেলা তিনটে। আজ আকাশে চাঁদ নেই। সন্ধেয় উঠবে কি না কে জানে, মানুষ চাঁদের খোঁজে চোখ রাখবে; এদিক-ওদিক খুঁজবে। চাঁদ দেখা দিতে পারে অথবা…। সন্ধে ছয়টা তেতাল্লিশে ইফতার। উনত্রিশ রমযান। সখি এখনো উঠতে পারল না। পারবে কি না জানে না। মাথায় পোকা কামড়ায়। অস্থির মন। কত সময় আছে?
মানুষ আর মানুষ। একদিন মানুষের ভিড়ে এসেছিল। ইট-পাথরের শহর। কেউ কারও দিকে তাকায় না। এখানে চেনা মানুষও অচেনা। ট্রেন চলে। ঝিকঝিক উথাল-পাতাল ভাবনা। তার উপায় নেই। পারা যায় না আর। সেই রাতে কোন্ ভাবনায় অবশেষে বলে ফেলে। মা বিশ্বাস করে না। এমন আবার হয়! এত বড় পাপ! অথচ তেমনই হয়। সখির অসহ্য লাগে। সে পারে না। কী করতে পারে সে? শেষ-পর্যন্ত পরম নির্ভরতার আশ্রয়…বলে ফেলে। কিন্তু পাথর চেহারায় অবিশ্বাস। দোলাচল খেলা। চোখের দৃষ্টিতে ঝাপসা বৃষ্টি। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। আর কিছু নেই। রাত নামে। নেমে আসে অন্ধকার। সখি কুণ্ডলিত কুকুরের মতো শুয়ে থাকে। ঘরের পশ্চিম কোণায় চৌকির উপর দু-জন মানুষ ঘুমোয়। গভীর নিশ্বাসে দেয়াল কাঁপে। সখির বুক। এই বুঝি কোনো লোমশ হাত এগিয়ে আসে। তাকে চেপে ধরে। সেই মানুষ তার বাবা। বড় ভরসায় বাবা ডাকে।

‘কি গো বেটি উঠতে পারো নাই?’
‘না গো চাচা। কেমনে উঠুম!’
‘যাবা কই?’
‘দিনাজপুর।’
‘টিকিট নিছো?’
সখি সামনে তাকায়। একজন মানুষ এক মেয়েকে জানালা দিয়ে ভেতরে নিতে ব্যস্ত। এত মানুষ কেমন করে যায়? ট্রেন থেমে আছে। মানুষের ভিড়। ভেতরে যেতে মরিয়া। কেউ ছাদে ওঠে। সখি কি ছাদে উঠবে? সে পাশে তাকায়। লোভে চকচক করে শেষ-দুপুরের দৃষ্টি।
‘তুমি ছাদে যাও। উঠবা?’
‘কেমনে উঠুম? অনেক উঁচা গো চাচা।’
‘এই যে মই আছে। বোঝলা মই না, সিঁড়ি; এডা দিয়া চাঁন্দেও উঠা যায়। স্বর্গেও। তুমি আহো।’
‘আজ চাঁদ উঠব?’
‘উঠবার পারে, না হলে শনিবার ঈদ হইবই। তুমি যাইবা না? আহো ছাদে তুইল্যা দিই। দশ ট্যাহা।’
‘দশ ট্যাহা?’
‘হ স্বর্গের সিঁড়ি দশ ট্যাহা। উঠবা?’
সখির দশ টাকা খরচ করতে অসুবিধে নেই। দশ কেন, কুড়ি পঞ্চশ একশ। মায়ের জন্য মন টানে। কেমন আছে মা? আহা কতদিন মাকে দেখে না! সেই আনন্দময়ী মা বোবা হয়ে গেল। সেই রাতে একটি মানুষ সারাজীবন বিছানায় শুয়ে শুয়ে অবশেষে পালঙ্কে ওঠে। মানুষের কাঁধে হেঁটে যায়। অনেক দূরের দেশ। মুখে কথা নেই। নতুন পোশাকে আতর-লোবান বাতাসে ভেসে যায়। মা কাঁদে। আকাশ-দিগন্তে অদ্ভুত বিষাদ। সোনালি-লাল আলোয় ধূসর অন্ধকার নামে। মানুষেরা বাবাকে নিয়ে যায়। ঝোপজঙ্গল পেরিয়ে বাঁশবাগান। সেখানে হাজার জোনাকি। রাত পাহারায় জেগে থাকে।
‘মা বাবারে কই নিয়া যাইতাছে?’
‘তোর বাবা যে স্বর্গে যায় গো বেটি। জাদু রে…।’
আকাশের দেয়ালে কান্নার প্রলম্বিত সুর। সখির অবুঝ মায়া চোখ ভাসে। সেও যাবে। বাবার কষ্ট। বাবা কত কথা বলে। সখি শোনে। সখি বলে। বাবার মুখের হাসি। কখনো বিষাদ। কোনো কথা বলে না। চোখের দৃষ্টি কথা কয়। বিছানায় শুয়ে কেটে যায় দিনরাত।
‘ওগুলা কিসের আলো গো মা?’
‘স্বর্গের বাতি মা। মা রে এ্যাহন কি করি?’
‘আমি বাবার কাছে যামু।’
সখি কাঁদে। বাবাকে কোথায় রেখে এলো মানুষেরা? সখি কাঁদে শুধু কাঁদে। তারপর সেই বাড়িঘর-আঙিনা বদলে যায়। মায়ের সঙ্গে হেঁটে এলো দূরের পথ। নতুন ঘরদোর। একজন গাট্টাগোট্টা মানুষ মিটমিট তাকায়। চোয়ালে ঝুলে থাকে অচেনা হাসি। মানুষ কোলে তুলে নেয়।
‘এই হলো তোর বাবা। এ্যাহন থাইক্যা বাবা ডাকবি।’
‘না এ মানুষ আমার বাবা না। আমার বাবা মইরা গেছে।’
‘যে গেছে…গেছে গ্যা। এ্যাহন এই তোর বাপ।’
সখি বাবা ডাকে। এই বাবা হাসে না। চেহারায় কী খেলা করে বোঝে না সখি। তার কেমন লাগে। শিরশির ভয়। মনে হয় একটা সাপ হিম-শীতল ছুঁয়ে রাখে। গালে চুমু দেয়। ঠোঁটে চুমু খায়। সেই মুখ সেই ঠোঁট ধীরে ধীরে নেমে যায়। বুকের কাছে। আরও নিচে। সখির খারাপ লাগে। কখনো ঘুম পায়। অন্ধকার রাত। সে হারিয়ে যায়।
সখি স্কুলে ভর্তি হয়। এলোমেলো পথ ধরে হেঁটে যায়। রোদছায়ায় ক্লান্তি। মাথা আউলায়। মানুষের জীবন জটিল। মা বলে, –
‘চুপ থাক। কাউরে কবি না।’
‘মানুষডা ভালা না। আমি বাবা ডাকি। কিন্তু…।’
‘চুপ যা মা। এগুলা মুখে আনা পাপ।’
সখি বলে না। সে ভাবে। পাপ-পুণ্য কী? একদিন পথে নেমে যায়। ট্রেনে বসে। কেউ জানে না। সে থাকবে না। পালিয়ে যাবে। তখন সন্ধেরাত। পুবকোণায় চাঁদ ওঠে। আজও চাঁদ উঠবে অথবা কাল। মানুষ আকাশে চাঁদ হাতড়ায়। সে ফিরে চলে। মাকে দেখতে মন টানে। কেমন আছে মা? সখি এখনো ট্রেনে উঠতে পারেনি। নিজেকে কেমন করে ভেতরে নেয়? ছাদের ওপর? অবশেষে ছাদেই উঠতে হবে। সেই মানুষ অস্থির। এদিক-ওদিক তাকায়। হাতে মই। সিঁড়ি। কেউ সিঁড়ি দিয়ে ছাদে ওঠে। সখি অস্থির চঞ্চল। কাল ঈদ। একবার সেই বাঁশবাগানে যেতে সাধ জাগে। সেখানে বাবা শুয়ে থাকে। সখি কয়েকটি মালা নিয়েছে। বুকল ফুলের মালা। এসব ভাবতে ভাবতে পাজামার ফাঁসে হাত রাখে। একটি লালরং নোট।
‘চাচা আমারে উঠায়া দাও।’
‘আইস আইস…সমায় কম গো বেটি।’
মানুষ ছোটে। সখি পেছন পেছন। ব্যস্ত ভিড়। সে যেতে পারে…পারে না। তার হাতে পুটলি। সেখানে বুকলের মালা। তাজা ফুলের মালা। কয়েকটি শুকিয়ে গেছে। ফুলের তবু সুবাস মরে না। সখির মন মরে গেছে। সে বাঁচতে এসেছিল। ইট-পাথরের শহর। এখানে মানুষ বেঁচে থাকে। মানুষ মরে যায়। বকুলের গন্ধ তবু বাঁচে। মাকে মনে পড়ে। মায়ের জন্য মন টানে। বাবার জন্য। বাবা জোনাকি আলোর নিচে ঘুমোয়। বাবার বুকে বকুল ছুঁয়ে দেবে। রেখে আসবে। বাবা খুব ভালবাসত। সখির বুক জুড়ে সুখ। সেই সুখ হারিয়ে গেল। একদিন পালিয়ে আসে। ইট-পাথরের শহর। পথে ঘুরতে ঘুরতে কত কাজ। মানুষ ভালো মানুষ খারাপ। সখি কাজ ছেড়ে দেয়। তারপর পার্কের খোলা বাতাস। সে গাছের নিচে শুয়ে থাকে। সারারাত বকুল ফোটে। তারার আলো। সকালে ফুলের বিছানা। সখি মালা গাঁথে। মন ভাবনা। একটি মানুষ মালা নিয়ে আসে। মা খোঁপায় পরে। মুখে হাসি। সেই মানুষ এখন জোনাকির আলোয় শুয়ে থাকে। মা কেন ভুলে গেল তাকে? মা তুমি কেমন করে বাবাকে ভুলে গেলে? কেন ভুলে গেলে?
অবশেষে উঠতে পেরেছে সখি। সিঁড়ি সরে যায়। যেতে হবে। কাল ঈদ। আনন্দ উৎসব। সখি বসে থাকে। নিচে মানুষজনের ছুটোছুটি। একটি হুইসিল। ট্রেন এগিয়ে যায়। সখির মাথা ঘোরে। অদ্ভুত ঘোর ঘোর দৃষ্টি। আকস্মিক কি হয়? কয়েকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। হইহই চিৎকার। সখির মন উন্মন। মায়ের কথা মনে পড়ে। বাবাকে দেখতে সাধ। সে ভিড়ের মধ্যে উঠে দাঁড়ায়। একটি মেয়ে শুয়ে থাকে। হাতে বকুলের মালা। সে রাস্তায় রাস্তায় মালা বিক্রি করে। সুগন্ধ বিলোয়। সে এখন শুয়ে আছে। ওঠে না। তার মুখ থেকে রক্ত কালো রং মাটিতে নেমে যায়। সখি সিঁড়িতে পা রাখে। আলো ঝলমল বহুবর্ণ ধাপ। অনেক উপরে বসে আছে কেউ। সে তার বাবা। সখি ওপরে ওঠে। উঠে যায়।

স্বর্গের সিঁড়ি।
_

(গল্পটি সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৪ জুলাই ২০১৮ ইস্যুতে প্রকাশিত। বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যে পোস্ট করা হলো।)

বংশীবাদক ও আকাশপরি উপাখ্যান (শেষ পর্ব)

মলি সংক্রান্ত গুজব ঘটনার শেষ-সময়ে, মামাবাড়ি থেকে ফিরে আসার পর; সত্যিকারার্থে ফয়জুলের সেদিকে দৃষ্টি পড়ল। মলি অসুন্দর কোথায়? গরিবের ঘরে আকাশের চাঁদ। আলোয় আলোয় চারিদিক ছড়িয়ে পড়েছে। কৈশোর পেরোতে না পেরোতে একেবারে গৃহিণী রূপ। শোনা যায়, সে-সময় বিয়ের কথাবার্তা চালাচালি হচ্ছে। পাত্রপক্ষ পছন্দ করে, কিন্তু যার পেছনে গুজব, রটনার ঘটনা…ঘটনার রটনা; তার শুভকাজ হয় না। মলির বাবা রায়হান মিয়ার দোকানে অনেকেই চা-সিগারেট খেতে আসে। দোকানের হুডের সঙ্গে মালভোগ আর সাগর কলা ঝুলে থাকে। কেউ কেউ বেছে বেছে টেনে ছিঁড়ে ছিলে মুখে নেয়। কারও কারও কৌতূহল কলার মোচার মতো ঝুলঝুল দোল খায়।
‘তারপর রায়হান, বেটির বিয়ের খবর কী?’
‘চেষ্টা চলছে ভাইজান। এই হচ্ছে-হচ্ছে করে, কী আর বলবেন; অনেক টাকা দরকার।’
মানুষজন নির্বিকার থাকে। মনের মধ্যে কৌতুক-সুখ। মলির বাড়ি পালিয়ে যাওয়া ঘটনা তা হলে সত্য। এমন মেয়েকে বিয়ে করবে কে? যার সারা গায়ে কালো দাগ। কলঙ্ক চিহ্ন। মেয়েদের ললাটে একবার লেগে গেলে আগুন-টিপের মতো জ্বলজ্বল করে। মন জ্বলে-পুড়ে খাক। মলির আর বিয়ে হচ্ছে না। পুরুষ মানুষ কাড়া-না-কাড়া হাজারটা কু-কাজ করলেও কোনো দাগ নেই। সেই দাগ ওয়াশেবল। ধোপার কাছে সাদা-ময়লা কাপড় দাও, চায়ের দাগ-পান-খয়ের, যা হোক; সাবান-সোডা ঘষে ঘসে লেবু দিয়ে পরিষ্কার করা যায়। কোনো দাগ-স্পট নেই। একেবারে আনকোরা নতুন-ফ্রেশ। কিন্তু মেয়েমানুষের কলঙ্ক সারাজীবনের পাপচিহ্ন। মানুষের কেউ কেউ মনে মনে কত কী ভাবে। ভাবনার কি শেষ আছে? এদের অলস সময় পরের গু ঘাটতে ঘাটতেই শেষ। নিজের শরীর-মন দেখার ফুরসত নেই। ফয়জুল আড়ালে-আবডালে এসব শোনে। সেও কত কি ভাবে। কখনো পাপ-কল্পনায় ভেসে যায়। কখনো মলির উপর মনের কোণায় মায়া জেগে ওঠে। আহা দেখতে এত সুন্দর মেয়ে! কোনোসময় বুশরার জায়গায় তাকে বসিয়ে কল্পনায় ভাসে। জীবনে একটি পুণ্য কাজ করতে তো পারে। ‘তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার।’ বিয়ে? সে করা যায়। মন শুধু মন ছুঁয়েছে। কোনো আপত্তি নেই। কবুল-কবুল-তিন কবুল। কিন্তু খাওয়াবে কী? নিজেই বাপের হোটেলে চলে-ফিরে। পকেটে পাঁচটি টাকা থাকে না যে, কাউকে নিয়ে জলযোগে বসে শিঙাড়া-কচুরি খায়। বুশরা আর কতদিন বিল মেটায়? নিজেকে তখন মাটিতে মিশিয়ে ফেলে ফয়জুল। এসব আজগুবি মহৎ ভাবনা ছেড়ে মনের লাগাম টেনে ধরা ভালো। কি-সব যাচ্ছেতাই ভাবনায় ভেসে যাওয়া? সামনে ডিগ্রি পরীক্ষা। পাশ কোর্সের মেয়াদ দু-বছর, অথচ তিন পেরিয়ে যায় যায়। ইংরেজি-বাংলায় তেমন সমস্যা মনে হয় না, কিন্তু ভূগোল বড্ড জ্বালায়। কিছুতেই বাগে আসে না। অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ কর্কটক্রান্তি-মকরক্রান্তি, কখনো আহ্নিক আর বার্ষিকগতির চক্রে পড়ে মন গতিহারা দিশেহারা। বুশরা কিংবা মলি…মলি কিংবা বুশরা, সব শালা আওরাত; আওরাত কা মক্কর দুনিয়াকা চক্কর, যে শালা বোঝেনি সে খায় ঠক্কর। সেই তুলনায় বাঁশি বাজানো ভালো। গভীর রাতের নিরিবিলিতে গোরস্তানে ধ্যান করা যায়। কে জানে যদি কোনোদিন আকাশ থেকে এক পরি নেমে আসে, কিংবা জলের তলা থেকে ভেসে ওঠে জলপরি; কপাল খুলে গেল। জীবনে আর কি চাই? ফয়জুল বাঁশি বাজায়। সুরে-বেসুরে নিঃসীম বাতাসে মনে মনে আবেগ-দোলা।

মলি মাঝে মধ্যে বাবার সঙ্গে দোকানে বসে। কোনোদিন একলা। প্রায়শ নির্জন দুপুর কিংবা বিকেলের সূচনা। ওর বাবা সে-সময়ে বাড়িতে বিশ্রাম নেয়। ফয়জুল তখন চা খেতে কত বাহানা করে। বুকের কোণায় দূরাগত বাতাস ভেসে ভেসে মন রাঙায়। মলি চা তৈরি করে। দুই ফ্লাক্সে কম করেও আট-দশ কাপ লালচে-খয়েরি লিকার। মানুষ র-চা পছন্দ করে। এই চা খেলে নাকি চেহারায় জেল্লা খোলে। কে জানে মলি এই চা খায় কি না। ফয়জুলের ভালো লাগে। কখনো কখনো চোখ ফেরাতে পারে না। নিষ্পলক কবিতা লেখা হয়। ইদানীং এই রোগ ধরেছে। রাত জেগে জেগে লাইনের পর লাইন মিলিয়ে কথা সাজানো। সে-সব হয় কি না কে জানে, মনে আহলাদ আসে; সাধ জাগে একদিন বুশরাকে পড়ে শোনাবে। তাকে নিয়েই তো স্বপ্ন-কল্পনা-মায়াজাল। তারপর মলি আবার ব্যস্ত। কারও জন্য দুধ-চা, কনডেন্সড মিল্ক মেশাতে থাকে, টুং টুং শব্দ ঝংকার, কারও জন্য পেঁয়াজি-বড়া কিংবা টোস্ট-বিস্কুট এগিয়ে দেয়। কখনো শরীর বাঁকিয়ে কলা ছেঁড়ে। বুকের ওড়না সরে যায়। মানুষের চোখে পাপ। চোখের দেখায় সুখ হাতড়ায়। ফয়জুল চা খায়। সিগারেটে টান দেয়। সবদিকে নজর। কেউ কেউ চা খেতে খেতে মলির সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। এসবও দেখা হয়। চোখ এড়িয়ে যায় না। বাতাস ঠেলে অনেক কথা কানে এসে ধাক্কা মারে। বুকে বজ্রপাত। মনের কোণায় অদ্ভুত জ্বালা। সহ্য হয় না। নিজেকে কষ্ট শাসনে সামলায়। মলি তার কে? না বান্ধবী না পেয়ারের মানুষ। একই গলির দু-চারটি বাড়ি পেরিয়ে একেবারে শেষপ্রান্তের প্রতিবেশি। ইদানীং মলি তেমন করে আর বসে না। রায়হান মিয়া কনডেন্সড মিল্ক মিশিয়ে গ্রাহকের দিকে চা তুলে ধরে। ফয়জুল খেয়ে দেখেছে। তেমন স্বাদ নেই। মলি যে চা তৈরি করে চমৎকার স্বাদ। আসলে মলির হাতের স্পর্শে জাদু আছে। কার না ম্যাজিক দেখতে ভালো লাগে। ফয়জুল ম্যাজিকের ভক্ত।

একদিন সন্ধের আগে আগে রাস্তায় দেখা হয়। প্রায়শ হয়, কিন্তু তেমন একলা নয়; অথবা অন্যকিছু আবেগ সময়। ফয়জুল সাইকেল থেকে নেমে মুখে হাসি তুলে ধরে। চোখে চোখে কত কথা। কত তাল-লয়-সুর-গান কে জানে।
‘ওই চা বিবি, একদিন বাড়িতে দাওয়াত করে চা খাওয়াবি না?’
‘কেন বে বাপের কাছে খাবি।’
‘ওই বুড়ার থেকে বুড়ার মেয়ের হাতে খাওয়ার মজাই আলাদা রে।…তো বল কবে যাব?’
‘আজ আয় এশার নামাজের পর।’
মলি হিসহিস সুরে কানের কাছে বলে উঠে। হাসির ঝংকার বাতাসে কাঁপে। ফয়জুল তো সে-রকমই চায়। যেমন বেণি তেমনই রবে, চুল ভেজাব না…না না না চুল ভেজাব না। মনে সাহস বাড়ে। গলির ধারে অযত্নে বেড়ে ওঠা শজনের এক ডাল থেকে দুটো শালিক লাফিয়ে অন্য জায়গায় বসে। দুই শাখাতেই দোল দোল দোলা। ফয়জুল একবার ডানে আরেকবার বাঁয়ে তাকিয়ে অস্ফুট খই ভাজে।
‘সেদিন দুপুরে তোর ওখানে গেলাম। তুই ছিলি না। তোর বাপ হুংকার দিয়ে বলে…কে? বাপ রে বাপ! কোথায় গিয়েছিলি?’
‘কোন্ দিন? আমি তো বাজার যাই। কখনো সওদাপাতি করতে হয়।’
‘তুই বাজার যাস? বুড়া কী করে?’
‘দূর বে! ওভাবে বলিস কেন?…তো কি জন্য গিয়েছিলি বল।’
‘কেন যে গেলাম! মনে নাই। হে হে হে!’
‘শালা, সবসময় ঝাড়ি! ভেবেছিস মা-মরা মেয়ে একলা আছে, ফুর্তি করে আসি…না?’
‘আ রে না না…বিয়ের প্রস্তাব দিতে গিয়েছিলাম।’
‘যা বে ভাগ, বাপের হোটেলে খাস; আর বিয়া করার শখ।’
‘তুই এমনই বলবি। মাই সুইট হার্ট। আমাকে বিয়ে করবি না? তোর বাপের দোকানে বড়া ভাজব নাহয়। ঘরজামাই।’
‘দূর শালা!…যা ভাগ।’
‘হা হা হা!’
তারপর গলিতে কেউ হেঁটে আসে। অচেনা মানুষ। ফয়জুল ভদ্র মানুষের মতো সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এই যখন-তখন ভালোমানুষ সেজে নেয়ার কায়দা বেশ রপ্ত হয়েছে। মানুষটি এগিয়ে তাদের ক্রস করে সামনে এগোয়। উত্তরে গোরস্তানের মধ্য দিয়ে সরু রাস্তা। শাল-সেগুনের শুকনো পাতা ছড়িয়ে আছে। মানুষের হেঁটে চলার খস খস…মচ মচ শব্দ মিলিয়ে যায়। ফয়জুলের মনে হয়, সেও এবার যেতে পারে। এইসব খুনসুটি বুকে শুধু থিরথির কাঁপন ধরায়। ভালোই লাগে। মজা আর মজা। তারপর দু-পা এগোতে পেছন থেকে বলে উঠে মলি, –
‘কি রে আসবি তো?’
‘আসব না মানে! আবশ্যই আসব। আই লাভ ইউ ডার্লিং।’
‘শালা-আ!’

ফয়জুলের বুকে কাঁপন দোলা। সকাল থেকে জমে থাকা অকারণ রাগ সকারণ ক্লেদ মুছে যেতে শুরু করে, অথবা করে না, সবকিছু মিলেমিশে অন্যরকম ভালোলাগা ছড়িয়ে যায়। অনেক দূর হেঁটে আসতে হয়েছে। রাস্তার ধারে ফুটপাতে দু-একজন মেকানিক বসে। তারা কাঠের বাক্সে বিবিধ যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করে। একটি পাম্পার, তেল-মবিল প্যাঁচপেঁচে, এককোণায় দাঁড়িয়ে থাকে। ফয়জুল কোনো কোনোদিন এগিয়ে যায়।
‘মামা পাম্পারটা নিলাম।’
সালাম মিয়ার কথা বলার সময় আর ধৈর্য নেই। রিকশার পেছন চাকা খুলে-টুলে পেরেশান একশা। পানখাওয়া কালো-লাল ঠোঁট ঝুলে আরও মোটা বেঢপ। সে একপলক তাকিয়ে চিনে রাখে শুধু। ফয়জুল হেহ্ হেহ্ শব্দে বুকের শ্বাস ঠেলে ঠেলে চাকায় বাতাস ভরে। কাজ শেষে একটি সিঁকি এগিয়ে দেয়। আজ ঘটনা অন্য। মনমেজাজ রেগেমেগে চড়চড়ি। কোন্ শালা যে সাইকেলের চাকায় আলপিন ফুটিয়েছে, একবার দেখা পেলে হয়; ট্রিপল এইচ ঘুসি বরাদ্দ। তাকে কি পাওয়া যায়? হারামজাদা জারুয়ার পয়দা। অবশেষে সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে আসতে হয় অনেক দূর। অবশ্য আজ চৌরঙ্গির এককোণায় চুপচাপ বিড়ি টানছিল সালাম মিয়া। সেই লিক খুঁজে পেতে আর সারাতে সারাতে এক-দেড় ঘণ্টা। তারপর সাইকেলে উঠে সব মনে পড়ে যায়। পকেটে তেমন টাকা-পয়সা নেই। বাবা টাকা-পয়সা খুব একটা দেয় না। কারণ ছেলে বিড়ি-সিগারেট ফুকবে। কোথাও তিনপাত্তি খেলবে। মেলায় গিয়ে হাউজিতে টাকা খোয়াবে। বাবার এই অবিশ্বাসের কারণ মাতৃকুল। মায়ের একমাত্র ভাই, উচ্ছন্নে যাওয়া মানুষ; সেভাবেই নাকি পৈতৃক সম্পত্তি শেষ করেছে। ইয়ার বন্ধু-বান্ধব, আনন্দ ফুর্তি, বেয়াড়া অভ্যেস; ইত্যাদি। কিসের মধ্যে কি…পান্তাভাতে ঘি। মামার সঙ্গে তার তুলনা! ফয়জুলের দোষ কোথায়? ছেলেমেয়ে বড় হলে তার অনেককিছু লাগে, হাতখরচা বা পকেটমানি; কিন্তু বাবা দেন না। অনেক আবেদনের পর যা জোটে তার পরিমাণ অল্প। নিজের দু-এক প্যাকেট বগুলা সিগারেট আর টুকিটাকি ব্যয়ে ঘাটতি বাজেট। সবচেয়ে বড় কথা যার সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন অথবা কখনো কখনো প্রতীক্ষার দেখা হয়, তাকে নিয়ে কোনো ক্যাফেতে বসে, একটি মিমি বা আইসক্রিম কিনে দেয়ার সাধ্য হয় না। এসব ভাবনার মধ্যে এই যে কিছুক্ষণ আগে যে রাগ দেখিয়ে এলো, অশ্রাব্য গালিগালাজ আর বাক্যধারা বর্ষণ; সমুদয় বিষয় বড় বিব্রত করে তোলে। আলম মামা কী ভেবে বসল কে জানে। তার বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে অজানা অপরাধীকে যা-তা, যা বলা ঠিক নয়। ফয়জুলের মুখ খারাপ। সার্ভিস ল্যাট্রিনের মাটির চাড়ি কিংবা টিন, মানুষের গুয়ে ভরতি হয়; সে সব উগড়ে দেয়। নিজের গায়ে ছড়িয়ে যায়। কেন এমন করল আজ? সে তো সহজে রাগে না। অনেক শান্ত স্থির মানুষ। ধৈর্যশীল। আজ কোন্ লঘুগুরু কারণে মাথা আউলা? কোনো উত্তর নেই। মানুষের মন বড় বিচিত্র। রংধনুর মতো রং পালটায়।

শেষ ফাল্গুনের দিন। সারারাত কাছে কোথাও বৃষ্টি ঝরেছে। সকাল থেকে হিম হিম বাতাস। ফয়জুল কলেজে দুপুর পর্যন্ত এদিক-ওদিক পায়চারি করে। অনেকে দলবেঁধে আড্ডায় গল্পগুজব করে। বাতাসে কথার কলরোল হাসির ফোয়ারা। তার তেমন বন্ধু নেই। যে কজনের সঙ্গে কমবেশি সখ্যতা, তারা আসেনি; কিংবা এসে চলে গেছে। কোনো ক্লাস হবে না। কলেজ ছাত্র পরিষদের কি কি দাবি আদায়ে ক্লাস বয়কটের ডাক। আজকাল এসবই হয়। গণতন্ত্র। তন্ত্র…মন্ত্র…গণতন্ত্র। সব ভুয়া। মূর্খের শাসন। তার ভালো লাগে না। অবশেষে সাইকেল স্ট্যান্ড গিয়ে মুখ আরও কালো। কেউ ঝামা ঘষে দিয়েছে যেমন জ্বলুনি হতে থাকে। কোন্ যে বেজন্মার কাজ…তাকে যুতমতো গাল পাড়ে। তার বাবা-মা, জন্ম সঠিক কি না, কোন্ পদ্ধতি বা আসনের প্রজনন কিছুই ছাড়ে না। কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে রোদ-ছায়ায় শরীর তাপায় আলম মামা। কলেজ পিওন। বুড়ো মানুষ। তার ঠোঁট দু-কান অবধি নড়ে উঠে। সেখান থেকেই কৌতুক জিজ্ঞাসা ছুড়ে দেয়।
‘কী হইল্ ব্যাটা ফয়জুল? কী ব্যাপার?’
‘মামা আপনি সারাদিন গার্ড থাকেন, কোন্ শালা কী করে দেখেন না? দেখতে পারেন না?’
‘কাক কাক দেখে রাখিম মামা? সবাই তো তোর মতো ছাত্র। কিন্তু ঘটনাখান কী কও তো?’
‘ঘটনা আবার কি? কোন্ মাদারচোদ্ সামনের চাকায় আলপিন মেরেছে। এখন বলেন তো দেড়-দুই মাইল রাস্তা কীভাবে যাই?’
‘এগুলা কুকুরচোদা মা-বাপের সন্তান বাপ…সামনের দোকান থাকি লিক সারাই নে।’
‘টাকা তো নাই মামা।’
‘চার টাকার ব্যাপার।’

সেই চারটি টাকা পকেটে নেই। শেষে বাধ্য হয়ে মামার কাছে হাত পাততে হয়। তারপর সাইকেল টেনে টেনে চৌরঙ্গি মোড় পর্যন্ত হেঁটে যেতে কত বিরক্তি! এমনিতেই সকাল থেকে বুকে তুষের আগুন জ্বলছে। একটি ভালো প্যান্ট-সার্ট নেই। সেই তিন বছর আগের পাজামা পরে এসেছে। সাদা রং জ্বলে-পুড়ে ঘোলা। পাঞ্জাবি নেই। একটি হাফহাতা সার্ট। সেও নীল-লাল-সাদা-কালো রঙের স্ট্রাইপ চেক। নিজেকে সারাক্ষণ ক্লাউনের মতো লাগে। এসবের মধ্যে অভাবিত এই ঘটনা। দুর্ঘটনা। অগত্যা সাইকেল হাতে ধরে এগোতেই মনে হলো, এ-ও সকলেই তার দিকে তাকিয়ে হাসছে; ভারি কৌতুক মজা! ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল। তার চোখ-মুখ সামনের চুপসানো চাকার মতো ফ্যাকাশে মলিন। এ ছাড়া আর কী করতে পারে? নিজেকে সামলানো বড় মুশকিল। কোথায় তুলে রাখে রাগ? চোখ আচমকা গরম হয়। বত্রিশ দাঁত কিড়মিড় করে। মাথায় আগুন জ্বলে ধিকধিক। অবশেষে গলির মুখে এসে মলির সঙ্গে দেখা। মন উন্মন। সব রাগ-বিরক্তি-হতাশা আগুনে জল পড়ে মুছে যায়। দুর্বল মানুষ রাগ করে, সে তেমন নয়, কখনো হবে না; এসব ভাবতে বেশ ভালো লাগে। সে কথা শেষে মলির দিকে পেছন ফিরে তাকালে, আশ্চর্য সেও তার চোখে চোখ রেখে হেসে ওঠে। মিঠেল দুষ্টুমি হাসি। একটু আশকারা। একেই বোধকরি বলে মনের টান নাকি কোইন্সিডেন্স? মলি আসলেই সুন্দর। মানুষজন শুধু শুধু হিংসেয় জ্বলে।

আজ পূর্ণিমা তিথি। নীল জোছনা। সিনেমা হল থেকে বেরিয়েই আকাশে উজ্জ্বল ঘনঘটা দেখে অভিভূত ফয়জুল। বিশেষ একটি রাত। শোনা যায় চাঁদের এমন বাহারি জোছনা নাকি এগারো বছরে একবার আসে। কোনো বিশেষ কারণ নিশ্চয়ই আছে। আজ রাতে বাঁশির সুরে সুরে অনেক আবাহন দূর আকাশে ছড়িয়ে দিতে মন চায়। সে চোকির নিচ ওলটপালট করে ফেলে আর কি! অবশেষে বাঁশি। মুড়ির টিন সরাতে আলগোছে গড়িয়ে পেছনে নেমে যায়। তখন অনেক রাত। পশ্চিম-দক্ষিণ আকাশে চাঁদ জেগে আছে। ফয়জুল প্রাচীর টপকে রাস্তায় নামে। দরজায় তালা। বাতাসে বাতাবি লেবু আর গন্ধরাজের মিলিত মাতাল সুবাস। মন’র ঢেউয়ে ভাঁজে ভাঁজে কোন্ অচেনার ডাক দেয়। কখনো শিহরন কখনো মন কেমন কেমন শূন্য হাহাকার। মন কি তবে মলির ডাকে সাড়া দিতে চায়? অথবা সেই ডুমুর গাছের ছায়া ছায়া অন্ধকার? দৃষ্টি সম্মুখে মরে যাওয়া ডোবা। সে বলে পদ্মপুকুর। এখনো আধমরা শুয়ে থাকে একাকী। একলা প্রহর। বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্ম, তারপর বর্ষার জলে টইটম্বুর হয়। ফ্যাকাশে-ম্লান শাপলা নতুন জীবনের আস্বাদনে জেগে ওঠে তখন। মানুষের জীবনও তো এমন। একসময় উদাসী ফাল্গুনে মন রঙে রঙে সাজে, গ্রীষ্মে মন পুড়ে যায়, অবশেষে বর্ষার জলে সবুজে সবুজে ময়ূরী নৃত্য। তার হলো কি? কোনোকিছু ঠিক করতে পারে না। গলির শেষপ্রান্ত পেরিয়ে গোরস্তানের ডুমুর গাছের নিচে বসে, অথচ কথা ছিল; কী কথা তাহার সাথে? ঝোপঝাড়ের জোনাকিরা ক্লান্ত ফিকে। ছায়াপথ একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে নক্ষত্রের বিনেসুতোর মালা গেঁথে রেখেছে। আলোর প্রভায় সব ভেসে যায়। কোথাও ছায়া ছায়া রহস্য ফিসফিস ডাকে। ফয়জুল বাঁশি বাজায়। আজ রাতে মন কোনো পরির ঘুম ভাঙাবে বলে। মলির কথা মনে নেই। বুশরার? সুরের মায়াজাল জোছনার পরতে পরতে কোন্ বেভুল ঠিকানা খুঁজে নিতে চায়। কোনো দিশা নেই। মন দিশেহারা মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে আপনার মাঝে বিলীন। কতক্ষণ? অনেকক্ষণ কি? সে জানে না, কোনো বোধ নেই; তারপর সহসা মনে হয়, কে যেন আলোর মৃদু ঝলকানি তুলে পদ্মপুকুরের ওপাশে নেমে এলো। অথবা সবকিছু মায়া-বিভ্রম। ব্যাখ্যাতীত কোনো জাদু, কিংবা কল্পনা; হ্যালুসিনেশন। কেউ তার ধ্যানভঙ্গ করতে চায়। এমনই নাকি হয়। যখন কেউ এক মাত্রা থেকে অন্য মাত্রায় যেতে চায়, প্রবেশপথ উন্মুক্ত হতে থাকে, নতুন ভুবনে আসতে চায়; তেমনই তো হয়। সে বাঁশি বাজায়। বাঁশি আপনমনে বেজে চলে। একসময় মনে হয়, তার কথায় বাঁশি বাজে না, বাঁশির মায়াটানে ভেসে যায় সে। কোথায় কোন্ জগতে কে জানে। সে জানে না।
তারপর সেই ছায়া সামনে এগিয়ে আসে। চাঁদের আলো ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। এখন শুধু রাত, নীল জোছনা, একটি ছায়া, আকাশ পরি আর সে। এমনই তো চেয়েছে। অনেক সাধনা করে তবে কারও ভাগ্যে মেলে। কারও সাধনায় জীবন পাতন। বাঁশির সুরে সুরে কত ভাবনা। মন-উন্মন স্বপ্ন ভেলা ভেসে যায়। ফয়জুল কি মোহাচ্ছন্ন হয়ে গেল? এই যে বসে আছে, অথবা বসেছিল, ডুমুর গাছের নিচে, চোখের সামনে পাণ্ডুর শাপলা-পদ্ম ছায়া ছায়া দৃশ্য অবয়ব, বাতাসে বাতাবি লেবু আর গন্ধরাজের সৌরভ, মাদক মৌতাত রাত; আকস্মিক একটি ডাকে ভেঙে যায়।
‘এই তোর কথা বে? তোর জন্যে বসে আছি, আর কৃষ্ণ সেজে বাঁশি বাজাস?’
‘কে কে তুমি? পরি? আকাশ থেকে নেমে এলে কখন?’
‘আ বে আমি, আমি রাধা…রাধা।’
ফয়জুলের মাথায় টোকা পড়ে। নেশা নেশা ঘুম ঘুম সম্মোহন সময়। সবকিছু বুঝে নিতে একটু তো দেরি হয়। বাঁশি থেমে গেছে। চারিদিক নিজ্ঝুম নিস্তব্ধ। কোথাও কোনো শব্দ নেই। উচ্চিংড়ে-ঘুগরে কিংবা রাতচরা পাখি কেউ কোনো আওয়াজ তোলে না। এবার…এবার বুঝতে পারে সে। মলির সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। সে যেতে পারেনি। এগারো বছর পর নীল জোছনা। এমন নিশুতি রাতে তো মলি নয়, কোনো পরি নেমে আসার কথা; আকাশপরি। সে ভালো করে চোখ রগড়ে নেয়। অস্বচ্ছ কুয়াশা রাতে ঘোর কি কাটে? পরি অথবা মলি…নাকি মলির ছদ্মবেশে কোনো পরি? সে যেই হোক, গোরস্তানের ভয় এড়িয়ে যে আসতে পারে, সে পরি; আকাশপরি। পরি তাকে বর দেবে। জীবনের ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়া সাধ-আহলাদ-সুখ কোনোকিছুই আর অপূরণীয় থাকবে না। তার মনের কোণায় বাঁশির সুর ঢেউদোলা তোলে। তারপর হাতে হাত। মধুর স্পর্শ। আহা কি কোমল! একটু কি ভেজা ভেজা লাগে? অদ্ভুত সুবাস আর নিশ্বাসের থিরথির কম্পন? এই রাতে ঠিক যেমন বয়ে যায় বসন্ত বাতাস।
তারপর দু-জন মানুষের ছায়া গলির শেষপ্রান্তে একটি ছাপরা ঘরে এসে দাঁড়ায়। কী কথা হয় তাদের মধ্যে কে জানে। রাতের মতো রহস্যময় ফিসফিস। তারা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে থাকে। জন্ম জন্মান্তরের সঙ্গী। তখন কেউ একজন একটু দূরে দু-চোখের বাতি জ্বালিয়ে অন্ধকার দেখে যায়। নীল জোছনার চাঁদ অনেক নিচে নেমে গেছে। অস্বচ্ছ ছায়া ছায়া আবছায়া রাত। একটি রাত ভোরকে ডাকে। সকালকে আহবান। তার চোখ কোনো সকাল দেখতে থাকে। যেভাবে ফয়জুল কোন্ মায়ায় সম্মোহিত অথবা জেনেবুঝে এগিয়ে যায়। এগিয়ে যায়।

রায়হান মিয়া ঠিক সে-সময়ে আলগোছে দরজার বাইরে শিকল তুলে দেয়।

আগের পর্ব পড়ূন

জীবনের যত জঞ্জাল ৪

বাবার স্মৃতিভ্রংশ। কাউকে চিনতে পারে, কারও দিকে ফ্যাল ফ্যাল উদাস দৃষ্টি। সেই চোখ কী বলে অথবা বলতে চায় সবটুকু হোক বা না হোক কিছু তার বোঝা যায়, বোঝা যায় না; কে জানে বুঝতে চায় না শ্যামল। কবিরাজের কাছে যায়। অনেক আশা-প্রত্যাশা। আবার যদি উঠে দাঁড়ায় বাবা।

‘আমাদের ওষুধে চিনি-গুড়-মধু, তোমার বাপের চলবে না। সদরে হাসপাতাল নিয়া যাও। ডাকতার দেখুক। মধুমেহ। হিসাব করি খাওয়া-দাওয়া, যত্ন-আত্তি দরকার। তারপর সব উপরঅলার ইচ্ছা।’
‘দেখেন কাকা দেখেন। মানুষটা উঠি দাঁড়াক। বাঁচি থাকুক।’
‘পরে কিছু কইতে পারবা না আবার, যে কবিরাজ অসুখ বাড়াই দিছে। একটা প্রলেপ দি। এইটা বাঁ-হাত কবজি থাকি গোড়া, বাঁ-পা উরু পর্যন্ত ল্যাপ দিবা। সারাদিন রাখবা। সকালে আবার ল্যাপ। আকন্দপাতার সেক। গরম পাইলে রগ ছাড়ি দিবে। তোমার বাপের বয়াস কত?’
‘কত আর…চল্লিশ-পঞ্চাশ।’
‘দুর ব্যাটা! সত্তর-বাহাত্তর মনে হয়। এখন তো যাওয়ার সময়। মন শক্ত করি রাখো।’

শ্যামল মুখের উপর থেকে গামছা সরিয়ে নিলে উজ্জ্বল-উদোম আকাশ দৃষ্টিতে হামলে পড়ে। আজকেও তেমন তাপদাহ। ধাঁ-ধাঁ চোখ ঝলসানো রোদ। তীব্র আলোর ঝলকানিতে কত কথা মনে পড়ে যায়। পশ্চিম আকাশের দূর কোণায় স্বপ্ন-মায়া-মরীচিকা। হালকা সাদা মেঘ ফুলরেণুর মতো জমা হয়। বৃষ্টি হবে কি হবে না কে জানে। আকাশ জীবন দেখে যায়…জীবন ডাকে।

‘কতদূর এয়েচি গো মোজাফর ভাই?’
‘এই তো মাঝাডাঙ্গা হাট পেরিয়ে এলাম।’
‘টের পানু না।’
‘তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে।’
‘হাট-বাজারের শোরে তো…।’
‘আজ হাটবার নয়।’
‘ও মঙ্গলবার তো হাট বসে না।’

টাঙা চলে। নেমে আসে সময়ের প্রান্তসীমা। শ্যামলের দিনকাল ছায়াছবি। সকালে বাবাকে নিমগাছের ছায়ায় রেখে এসেছে। লক্ষ্মী পোয়াতি মানুষ। ভারী পেট ঝুলে পড়েছে প্রায়। ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। সেও খাটে হাত দেয়। সেখানেই শুয়ে থাকে বাবা। তাকে পরিষ্কার করা, কাপড় ঠিক করে দেয়া, মুখে তুলে খাওয়ানো; লক্ষ্মী ধীরলয়ে সবটুকু করে। আজ নিমছায়ায় কাত হয়ে অদ্ভুত হাসে বাবা। নিশ্চুপ রহস্যময়। শ্যামল অনেকদিন পর তেমন মুখছবি দেখে। অথবা কে জানে চোয়ালভাঙা বাঁকামুখ মানুষ আনন্দ ধরে আনতে পারে কি না। তবু ভালো লাগে। বাবা আনন্দে থাক। মানুষ আপনমনে কত কথা বলে যায়, কেউ বোঝে কেউ বোঝে না; কেউ বলে বদ্ধ- পাগল। উন্মাদ। আপনমনে হাসে, কখনো কাঁদে; কখনো অন্যজগতের মানুষ। বাবা কোন্ পৃথিবীতে থাকে? তার স্মরণশক্তি নেই। আনন্দময় কথকথার মানুষ নিশ্চুপ নীরব আজ। প্রসারিত সম্মুখে ভাষাহীন চোখ ছড়িয়ে কী কথা যে বলতে চায় বোঝা যায় না। অথবা জেনে নিতে কাঙাল। শ্যামল কী বলে? বাবার স্মৃতিতে নির্জন-নিস্তব্ধ দুপুরে জল গড়িয়ে চলার শব্দ। বাতাসের কানে কানে ধানশিষের গান। বাবা সহজে খুঁজে পায়। শ্যামল কোনোদিন শোনেনি। কান পেতেও না।

সেই কথা দেড়-দুই মাস পর না বললে কি এমন ক্ষতি হতো কিংবা লাভ কী, কেউ ভেবে দেখে না; অন্তত লক্ষ্মী জানে না। বোঝার মতো মন নেই। আনমনা। অগ্রহায়ণের দিনশেষে সন্ধের আলোয় হিমবাতাসের নিশ্চুপ দোলা। তখনো পশ্চিম আকাশে গোধূলির রক্তিম আভা। শ্যামল চোখ তুলে তাকায়। মন হতচকিত-বিহ্বল। আকস্মিক নিষ্কম্প স্থির। লক্ষ্মী আবার বলে, –

‘বাপু দ মেনখান এনহিলোক কাথায় রড়লেদা। পুসটাউতেঞ আমজমকেদা।’
(বাপু কিন্তুক সেদিন কথা কয়ে উঠেছিল। মুই পষ্ট শুনিছু।)
‘চেত্! বার সেরমা অকয় হড় গুংড়া লেকায় তাহেকেনা, উনি দ চেকাতে কাথায় রড়া?’
(দূর! দু-বছর যে মানুষ বোবা হয়ে রইল, তার মুখে ক্যাংকরি কথা আসে?)
‘পুসটাউতেঞ আনজমা আকাদা। মেনখান আম দ বাঞ লাই আকাও আতমেয়া।’
(মুই পষ্ট শুনিছু। তুমাক কই নাই।)

শ্যামল তাকিয়ে থাকে। সম্মুখ দৃশ্যপট নাকি কোনো সুদূর অতীত থমকে দাঁড়ায়, রাতের ছায়া ধীরে ধীরে নেমে আসে; আঙিনায় জবাঝাড়ে মিইয়ে পড়ে দু-চারটি ফুল। এ কেমন কথা? পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় কথা কয় মানুষ? তখন দমকা বাতাসে কেঁপে ওঠে খড়ের গাদা শিখরদেশ। স্তূপ থেকে গড়িয়ে নেমে যায় দু-একটি ঝাড়ু।

‘লাহাতে দ বাঞ লাইয়াতমেয়া।’
(আগোত কইন্নাই তো।)
‘চমকাওলেন তাঁহেঁয়াঞ। পাতি আউগে বাং হেচলেনা। বাপু দ আর হোয়ে মেনকাদা। নংকাগে মিত্ধাও…বারধাও। ইনকাতে…।’
(মুই চমকি উঠিছিনু। বিশ্বাস হয় নাই। বাপু ফির কইলে। একবার…দুইবার। তারপর…।)

লক্ষ্মীর চোখ ছায়াম্লান। শ্যামল আলোছায়ায় তাকিয়ে অলৌকিক কোনো হদিশ হাতড়ায়। শেষযাত্রার সময় কথা বলে উঠেছিল বাবা। কী কথা? সেদিন টাঙা বিকেলের প্রান্তসীমায় বাঁশঝাড় পেরিয়ে আঙিনায় আসতে না আসতে দেখে মানুষজনের ভিড়। বাতাসে ভেসে থাকে চরম সত্য। পরম পূজ্য পিতা কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। কেউ মুখে জল দেয়ার সময় ধারেকাছে ছিল না। সেই কাহিনি জেগে থাকে। চোখে ভাসে। ভেসে ভেসে আবছা করে রাখে দৃষ্টি।
সেদিন নিমগাছের ছায়া-অন্ধকারে পড়ে থাকল খাট। কাঁথা-বালিশ। পুকুরপাড়ে কদমগাছের নিচে মানুষটিকে শোয়ানো হলো। পৃথিবীর সকল কাজ-কমর্, আনন্দ-বেদনা-হাসিকান্না, মান-অভিমান, অভিযোগ-দুর্যোগ সব জল ঢেলে ঢেলে ধুয়ে দিল কেউ। শ্যামল কী করে? মন হত-বিহ্বল বিবশ। বাবা তো মরেই গিয়েছিল। যে অশত্থ ছায়া তবু মাথার উপর, আলগোছে নির্মম সরে যায়। মধ্যরাতের আগে আগুন দেয়া হলো। এই তো জীবন। তারপর বেঁচে থাকা দিনকাল, অস্তিত্বের খেয়াপার; পুরোনো সবকিছু ফিকে হয়ে যায়। ফ্যাকাশে হতে থাকে। জীবনের একমাত্রা থেকে অন্যমাত্রায় যাত্রা করে। পথে নেমে যায়। তাই সেদিন যে কথা না উঠলেও কোনো ক্ষতি হতো না, কিংবা কী লাভ; কৌতূহল চমকে অপলক জেগে থাকে সে।

‘বাপু চেত্ কাথায় রড়লেত্ তাহেয়া লক্ষ্মী?’
(বাপু কী কথা কয়েছিল লক্ষ্মী?)
‘অহঞ মেনকায়া। বাঞ দিশায়েদা।’
(জানি না। মনে নাই কো।)
‘আম দ বাম লাই আ।’
(তুই আর কবিনে।)
‘রাংগাক্ আম নাহাক। নোয়া ঘাটা নিনদা নোয়াকো কাথা দ তাহে আচোয়ান। গাপা সেতাক্ ইঞ মেনা।’
(তুমি রাগ করবা। ভরা সন্ধ্যায় ইসব থাক। কাল বিহানে কবো।)
‘চেদাক্ ভূতকো সাসাপ আ? ইঞ কানগেচুঞ মিত্চেন লাটু ভূত দ।’
(ক্যান ভূত ধরবি? মুই তো বড় একখান ভূত!)
‘আম দ ভূত দ বাং, রাক্ষস কানাম। ইঞেম জমেঞা আম দ। হি হি হি!’
(তুমি ভূত না, রাক্ষস। মোক মারি কাটি খাবি। হি হি হি!)

শ্যামল হাসতে পারে না। লক্ষ্মীর আর দেরি নাই। এই মাসের কয়েকটি দিন, পেরিয়ে যাবে কি যাবে না; এসে পড়বে সে। লক্ষ্মী কোনো কোনো রাত আচমকা ঘুম থেকে উঠে বসে। দু-হাতে আগলে রাখে পেট। শ্যামলের ঘুমঘোর, ডানহাত এগিয়ে দেয়; আগত শিশুকে স্পর্শে হাতড়ায়। লক্ষ্মী দু-হাতে সরিয়ে দেয় তাকে। একরকম ছুঁড়ে দেয় সকল আকাঙ্ক্ষা মনোযোগ। শ্যামল ক্লান্ত-বিবশ। সারাদিন হাট-বাজার। শহরের রাস্তা-অলিগলি-বাসাবাড়ি হাঁকডাক চিৎকার। সন্ধেরাতে ফিরে আসে। লক্ষ্মীকে দেখে বড় মায়া হয়। এমন ভারী শরীরে কীভাবে কাজ করে যায়? শ্যামল কিছু করতে পারে না। মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকে? শ্যামলের দু-চোখে ঘুম নেই। ঘরের অন্ধকারে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। ব্যস্তত্রস্ত উদ্ভ্রান্ত।

‘চেত্ চেকায়দা? দারগিন ইঞ হহওয়া আ?’
(কী হইছে? দাই ডাকাম?)
‘বাঞ বাডায়া। আডি হাসো কানা। বাপু লেকা।’
(জানি না কো। বড্ড জ্বালায়। তুমার বাপুর মতো।)
‘বাপুগে চং-এ হিসুক্কানয়া। আহ্ ইঞরেন বাপু…বাপু।’
(বাপুই তো আসছে গো। আহ্ মোর বাপু…বাপু!)

শ্যামল উঠে বসে উদ্বাহু ডানা মেলে দেয়। লক্ষ্মীকে একবার জড়িয়ে ধরার অনন্ত সাধ। তার অনেক আদরের বউ। ভালবাসা জীবন। মায়াডোর বাঁধা স্বর্ণলতা-অস্তিত্ব। আদর করতে ইচ্ছে জাগে।

‘অচগক্ মেসে। বাঞ সাহেত দাড়ে আক্কানা।’
(সরি যাও তো…দম বন্ধ হই আসে।)
‘দারগিন বুডহিঞ হহ আয়া বাংখান।’
(দাইমাক ডাক দাও না হয়।)
‘আমরেন বাপু নিত দ বায় হিজুক্ আয়া।’
(তুমার বাপু এ্যালায় আসিবার নহায় গো।)

তখন সন্ধের কথা মনে আসে। আলাপ-প্রলাপ। ঘরের উপরচালা দিয়ে ভোরের আলো হাত-পা ছড়িয়ে নেমে আসে। এখন…ঠিক এখন বলা যায়। যায় কি? মন যে বড়ই উন্মন। কী কথা বলেছিল বাবা?

‘বাপু চেত্ কাথায় মেনলেদা?’
(বাপু কী কথা কয়েছিল?)
‘অক কাথা? তিনরে?’
(কোন্ কথা? কখন?’)
‘হলা আয়ুপ্এম মেন্লেত্। বাপু চালাক্ অক্তে চেত্ বাং-এ মেন্লেত্।’
(কাইল সাঁঝোত্ যে কলু, বাপু চলি যাবার সমায় কী বা কথা কয়েছিল।)
‘ও।’
(ও।)

ঘরের আলোছায়া দেয়ালে চকচকে দুটো চোখ। সেই দৃষ্টি কার? লক্ষ্মী নাকি বাবার? শ্যামলের মন-উন্মন বিভোল। আকস্মিক সকল স্মৃতি দিনকাল মন-ভাবনায় উদ্ভ্রান্ত-উদ্বেল জেগে ওঠে। লক্ষ্মী কথা বলে না কেন? কোনো গুপ্তধনের কথা বলে যায়নি তো বাবা? সেই যে বাবা প্রায়শ গল্প করে। আঙিনায় বসে, কদমতলায় পুকুরের পাড়; ফিসফিস কাহিনি। স্বপ্নকথন। এক বিঘত সোনার পুতুল বারান্দায় হেঁটে যায়। চমকে থমকে পেছনে দৃষ্টি রেখে ইশারায় ডাকে। তারপর আঙিনা জবাঝাড় পেরিয়ে কোথায় কোনখানে অদৃশ্য হতে থাকে। বাবা স্বপ্ন দেখে। ঘুমঘোরে হেঁটে চলে। পুতুল ডাকে। ডেকে যায়। বাবা দু-ধাপ এগিয়ে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে ধরবে। স্পর্শ লাগে। ধরতে ধরতে ধরা হয় না। স্বপ্ন ভেঙে যায়। যদি একবার হাতের মুঠোয় ধরা দেয়, অনেক অনেক ভুঁই হতো; হিমশীতল জলের পদ্মদিঘি। সেখানে স্বচ্ছ জলে মাছ সাঁতার কাটে। জলের ভাঁজে ভাঁজে সূর্যের আলোকচ্ছটা। মানুষের কল্পনা জীবনের স্বপ্ন। একটিই তো জীবন। এই সীমিত সময়ের কাহিনিতে কত আশা-আকাক্সক্ষা। সুখশান্তি। দুঃখ-বেদনা-অপমান। কেউ ভোলে কেউ ভোলে না। বুকের পাঁজরে গেঁথে নিয়ে বেঁচে থাকে। অস্তিত্বের সকল দায় কষ্ট শেষ হয় নদীর ঘাটে। কারও মুক্তি মেলে কারও মেলে না। বাতাসের ভাঁজে ভাঁজে শোনা যায় কত কথা। কত কান্না দীর্ঘশ্বাস। বাবা কী বলেছিল? লক্ষ্মী এবার বলুক। মানুষ মৃত্যুর আগে আগে যা বলে যায়, সবটুকু তার সত্য; কখনো অবাস্তব কল্পনা নয়।

‘লক্ষ্মী বাপু চেত্-এ মেনলেদা?’
(লক্ষ্মী কী কয়েছিল বাপু?)

সময় নিশ্চুপ স্তব্ধ। অপেক্ষার নদী কুলকুল বয়ে চলে। জল গড়িয়ে যায়। শ্যামলের দৃষ্টি আকুল। বাবা…বাবা সারাজীবন অপমান সইলে, কষ্ট করলে; সেই দায়ভার দিয়ে গেলে আমাকেও।

‘বাপু দ বাড়গে রেড়াক্-এ মেনলেদা। ইঞাক্ বাড়গে…ইঞাক্ হাসা। ইনা তায়োসে জাপিত্কেদা। মেত্দাক্ জরয়েনতায়া। মোচারেঞ দাক্ আদেয়া। মেনখান বায় নু লেদা…একালতেসে বাং।’
(বাপু ভুঁইয়ের কথা কয়েছিল। মোর ভুঁই…মোর ভুঁই। তারপর দু-চোখ বুজল। চোখের কোণা দিয়ে জল গড়িয়ে গেল। মুই মুখোত জল দিলাম। নিলনি…একফোঁটা নিলনি।)

শ্যামল বজ্রাহত বসে থাকে। একদা তাদের একখণ্ড জমি ছিল। বাবা লাঙল দেয়। জমি চাষে। সারাদিন ধুলো-জল-কাদা মেখে ঝকঝকে করে রাখে সীমা-পরিসীমা। ধানের চারাগাছ মাথা উঁচু চোখ মেলে বাতাসে দোল খায়। বাবার মুখছবিতে আনন্দঢেউ। বাতাসে কানপেতে শোনে ধানশিষের নবান গান। বড় ভালো লাগে। তারপর হায়! কেন এমন হলো? কোন্ নষ্ট মানুষেরা দখল করে নেয় সুখশান্তি-আনন্দ-বেঁচে থাকার সকল অস্তিত্ব? এই জঞ্জাল সরাবে কী করে?

দিনের আলো ফুটতে ফুটতে আইলের সরুপথে হেঁটে যায় শ্যামল। চেনা পথ বড় অচেনা লাগে। অথবা অচেনা রাস্তা চেনা হয়ে যায়। অনেক সহজ কিংবা দুর্মর কঠিন। চারিদিকে নতুন ধানের মউ মউ সুঘ্রাণ। বাতাসে স্বপ্নদোলা নবান্ন সংগীত। সে এবার বোধহয় কোনো সুর শোনে। নিজের জমি। বাপ-দাদার সম্পদ। সে ধীরে ধীরে সেখানে উঠে আসে। আইলের কোণায় কাঁধের গামছা রেখে হাতে নেয় কাস্তে। সোনালি ধান। রোদের আলোয় ঝিকমিক। গামছার লালরং থেকে উঁকি মারে দা’এর প্রান্তসীমা ক্ষুরধার। রোদের আলো থমকে দাঁড়ায়।
শ্যামল ধান কাটে। জমে উঠে ফসলের স্তূপ। দুপুরে আচমকা মেঘ-গর্জন হুংকার। মটরসাইকেল দূরে রেখে ছুটে আসে মাওলানা আজিজার। জাকির মাস্টার। আর কে কে? বন্যমোষের ছায়া। ধূসর-কালো অন্ধকার মেঘ। শ্যামল চমকে ওঠে। হাত থমকে যায়। একমুহূর্ত। কী ভেবে আবার সচল। সে থেমে থাকে না। আপনমনে ধান কাটে। অদ্ভুত মায়ার বর্ণিল নেশা। কোথাও কোনো দৃষ্টি নেই। আকস্মিক কী হয়, বুঝতে পারে না; শ্যামল দূরে ছিটকে পড়ে। কে যে কখন পেছন থেকে ধাক্কা দেয়, নাকি রোদপোড়া শক্ত বাঁশের আঘাত; দু-চোখে অন্ধকার পরদা নেমে আসে। কতক্ষণ? একটু সময়-মুহূর্তকাল অথবা যুগের পর যুগ অনন্তকাল। শ্যামলের তন্দ্রাঘোর। আচ্ছন্ন টলায়মান পদক্ষেপ। সে কিছু দেখতে পায় না। ধূসর-কালো মেঘের পটভূমিকায় এক বন্যমোষ গর্জন করে। বাতাসে থরথর করে অদ্ভুত নিনাদ। তারপর কি হলো? আকাশ দেখে। মানুষ দেখে। সেই গর্জন থেমে গেছে। স্তম্ভিত বাতাস। শ্যামলের দা থেকে চুইয়ে পড়ে রক্ত। মাওলানার কালো বুনোমোষ শরীর বেয়ে রক্ত-হলাহল নেমে যায়। জমির বুকে। পাতালের গভীরে। রক্ত…রক্তের রং লাল। সেখানে কোনো জাতপাত বোঝা যায় না।
স্টেশন পুলিশ ফাঁড়ি থেকে গাড়ি আসে। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। গ্রামের বাতাসে ঘটনা-দুর্ঘটনা খবর দুর্গন্ধের মতো ছড়িয়ে যায়। লক্ষ্মী আসতে পারেনি। পারে না। আঙিনায় ছুটে এসেছিল। কিন্তু যে জগতে আসে, আসছে; থামিয়ে রাখে। ধুলো-মাটিতে গড়াগড়ি। জবাঝাড়ে উজ্জ্বল বর্ণের ফুল ফুটেছে। কোত্থেকে দুটো চড়ুই এসে ডালে নাচতে থাকে। শ্যামল সড়কের উপর ধীরলয়ে হেঁটে যায়। অগ্রহায়ণের বাতাস বড় বর্ণচোরা। মৃদুমন্দ বয়ে চলে। কোথাও হয়তো বৃষ্টি হয়। কখনো হিম-হিম বাতাস স্পর্শ আবার তপ্তঢেউ। শ্যামল হেঁটে যায়। হাঁটতে থাকে। বটতলি মোড়ে পুলিশের গাড়ি। প্রগাঢ় নীলরং কালো দেখায়। লক্ষ্মী দূর থেকে তেমন দেখতে পায় কি না পায়, তার মাথা ঘোরে; দৃষ্টি ছলছল হত-বিহ্বল উদাস। পরনের শাড়ি-পেটিকোটে রক্তের ছোপ ছোপ লাল-কালশিটে দাগ। জীবন মানচিত্র ইতিহাস। অস্তিত্বের অধিকার। তার কোলে শিশু। সদ্যকাটা নাড়ি থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ে। তার দু-চোখ আজব এই পৃথিবীকে অসীম কৌতূহলে চিনে নিতে চায়। বোধোদয়ের অনন্ত জিগীষা। এদিক-ওদিক ধ্যানগম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ। তারপর সহসা আকাশ বিদীর্ণ করে চিৎকার ছুড়ে দেয়।

সেই মেঘ-গর্জন আকাশ দিগন্তরেখায় প্রতিধ্বনি স্ফুলিঙ্গ তুলতে থাকে।

(সমাপ্ত)

জীবনের যত জঞ্জাল ৩