মাহবুব আলী এর সকল পোস্ট

মাহবুব আলী সম্পর্কে

মাহবুব আলী দিনাজপুর, বাংলাদেশ। প্রভাষক। প্রকাশিত বই: ১. অস্তিত্বের পলায়ন (গল্প) ১৯৯২ ২. ছোটগল্পের নির্মাণশৈলী (সাহিত্য ও সাংবাদিকতা) ২০১৮ ৩. অস্তিত্বের পলায়ন (গল্প) (রিভাইজড ভার্সন) ২০১৮ ৪. ভয় (গল্প) ২০১৮ ৫. পিঙ্গল বিকেলের আয়নায় (গল্প) ২০১৮ ৬. অযোগ্যতার সংজ্ঞা (গল্প) ২০১৮ ৭. রাত পাহারা চোখ (গল্প) ২০১৮ ৮. গোপনীয়তার অলিগলি (বড়গল্প) ২০১৮

মুনিয়া এবং কাহিনি একাত্তর ২

উত্তাল উনসত্তর। বছরের শুরুতে আগড়তলা মামলায় বন্দি নেতা শেখ মুজিবর রহমান এবং সহযোগিদের মুক্তি আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। বাংলার মানুষের স্বাধীনতার রূপরেখা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনসহ ছয়দফা আর ছাত্র সংগ্রাম কমিটির কয়েকটি দাবি যোগ হয়ে এগারো দফা আদায়ের আন্দোলন জোরদার। সেই আন্দোলনে পরবর্তীতে যোগ দিল আরও কিছু সংগঠন। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল। এখানে-ওখানে আলোচনা। উদ্দীপ্ত শপথ উচ্চারণ। উত্তপ্ত বক্তৃতা। সরকার সান্ধ্য আইন জারি করল। সড়কে জোরদার টহল। অস্থির বাতাসে কী হয় কী হয় ফিসফাস আলাপ। চব্বিশে জানুয়ারি, শুক্রবার আইয়ুব শাসনের উৎখাত আর নেতাদের মুক্তি দাবিতে মানুষজন সান্ধ্য-আইন উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে পড়ল। শ্লোগানমুখর সময়। শাসকের পেটোয়াবাহিনি বসে রইল না। যতরকম পদ্ধতি সবগুলোর প্রয়োগ শুরু হয়ে গেল। রাইফেল গর্জে উঠল। ক্লাস নাইনের ছাত্র মতিউর গুলিতে আর একজন রুস্তম ছুরিকাঘাতে নিহত হলে সরকারের অবস্থা টালমাটাল। দেন-দরবার আলোচনা ব্যর্থ হলো। অবশেষে পঁচিশে মার্চ, মঙ্গলবার, লৌহমানব প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান রেডিও-টেলিভিশনে ভাষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনি প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে রাস্ট্রক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। ইয়াহিয়া খান ওইদিন দুপুরে সংবিধান স’গিত রেখে নিজেকে প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে ঘোষণা করলেন। রাতে আরেক ভাষণ। বাংলার মানুষ শুনল নির্বাচনের আশ্বাস।
আমরা কাঠের গ্রিনরুম কাম রেস্টহাউসের ঘরে-বারান্দায় গল্প করি। গল্প শুনি। এ হলো নন-ফিকশন গল্প। আলোচনা চলে…গভীর রাত আরও নিবিড় হতে থাকে। পুনর্ভবা নদীর স্রোতের মতো এক সূত্র থেকে অন্য সূত্রে ঢেউ বয়ে যায়। আমার ক্লাসমেট বাচ্চু। সে বোঝে। আমি রাফিদুলের মতো হাঁ হয়ে শুনি। ইয়াহিয়া খান ছাত্রছাত্রিদের আইডেন্টিটি কার্ড সিস্টেম প্রবর্তন করেছেন। অনেক সুবিধে। ট্রেন-বাসের ভাড়া অর্ধেক। সিনেমার টিকিট প্রায় ফ্রি। আমরা কোনোদিন দল বেঁধে ম্যাটিনি শো দেখেছি। দিলীপ সোমের সাত ভাই চম্পা-য় খান আতার ‘হক মওলা’ কারও মুদ্রাদোষ হয়ে গেল। রহিম নেওয়াজের সুয়োরানি দুয়োরানি-র নায়ক-নায়িকা প্রেমের দশকলা শেখায়। কাজী জহিরের ময়না মতি। মানুষ আপনমনে গুনগুন গায় ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়’। আমি ভুলে যাই, মানুষ এই তো সেদিন চাঁদ জয় করেছে।

রাত সম্ভবত সাড়ে বারো। রাফিদুল-শহিদ-মনোয়ার প্রথমে লক্ষ্য করে ছায়া। সেই বিরান পাথার, যেখানে শিয়াদের দলবেঁধে আস্তানা ছিল, এখন কেউ নেই, জায়গাটা ভুতুড়ে আবাস, অশরীরী অস্ফুট দীর্ঘশ্বাস বাতাস ভারী করে রাখে সকাল-দুপুর-সন্ধে আর রাত, সেখানে কেউ একজন বা কিছু একটা নড়ে ওঠে। কে সে? কোনো মানুষ অথবা গরু-ছাগল? শহরে এখন কোথাও কোথাও গরু-ছাগল ইতস্তত চরে বেড়ায়। মালিক নেই। কারও কারও ঘরবাড়ি নেই। কারও ঘরবাড়ি আছে মানুষ নেই। চারিদিক শূন্য খাঁ-খাঁ অসি’র সময়ের ক্ষণ-অনুক্ষণ বয়ে যায়। মধ্যরাতের নিশ্চুপ প্রহর। কখনো আচমকা রাইফেল ফায়ার হয়। পাটাশ! কখনো কুকুরের উল্লাসী অথবা অসহায় ক্রন্দন বাতাস থমথমে করে রাখে। আমাদের ঘুম নয়, তন্দ্রাঘোর, সেও বোধকরি ঠিক নয়, চোখদুটো খোলা রেখে রাত পাহারা; তাই সতর্ক ফিসফাসে জেগে উঠি। এ তো জেগে ওঠা নয়, দৃষ্টির সকল কেন্দ্র দূরে একটু দূরে আছড়ে পড়ে। আজ রাত তেমন আবছায়া নয়। আকাশে নক্ষত্রমালা-ছায়াপথ যতটুকু মৃদু আলো ছড়িয়ে রাখে, আমরা দেখি গরু-ছাগল কিংবা রাতে দুড়দাড় দাপটি শূকর নয়; একজন ছায়ামুর্তি। মানুষ। বোধকরি মেয়েমানুষ। রাফিদুল আর শহিদ আস্তে আস্তে নিজেদের আড়াল করে এগিয়ে ধরে ফেলে তাকে। আমরা কাঠঘর বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি একজন মানুষ ঝুপ করে নিচে আছড়ে পড়ল। এরপর শহিদ যখন টর্চের সতর্ক আলো চোখে-মুখে ছড়িয়ে দেয়, আর কেউ না হোক আমি চিনতে পারি। মুনিয়া।
সেন্ট যোসেফস্স্কুলের পশ্চিমে রাস্তা। সেটি পেরিয়ে একসঙ্গে পর পর চারটি দোকান। জান মহম্মদের বেকারি। বেকারির ভাঁজকরা সবুজ রং কাঠদরজা। সেখানের কোনো ফাঁকফোকর গলিয়ে দুপুরের বাতাসে তন্দুরে সেকা বিস্কুট-পাউরুটির সুবাস ছড়িয়ে যায়। দক্ষিণের তিনটি দোকান মাটি থেকে তিন ফুট উঁচু। প্রথমে মিজানুর বা লুডু মিয়ার মুদি দোকান। সবশেষে মটরসাইকেল আর সিঙ্গার সেলাই মেশিনের ওয়ার্কশপ। মালিকের মুখে সবসময় পান। আশপাশে জরদার মাতাল গন্ধ। আহমদ হাসান মধ্যখানের দোকানে কাজ করেন। আমি তাকে চাচা ডাকি। দোকানের সামনে চার-পাঁচ ফুট প্রশস্ত বারান্দা। এককোনায় একটি বেঞ্চ। বই বাঁধাইয়ের কাজ হয়। তিনি কখনো বারান্দায় বসেন। কতগুলো বই রোদে শুকোয়। সব ধরনের বই অদ্ভুতরকম সেলাই হয়। আমার স্কুল মর্নিং। কোনোদিন স্কুল শেষে বাসায় ফিরে ব্যাগ রেখে সেই বেঞ্চে বসি। পকেটে মাউথঅর্গান। কখনো গানের সুর তোলার হাজার চেষ্টা। ‘হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা, না জানে কিস্পে আয়েগা।’ বাবাকে খুব মানে আহমদ চাচা। তার আইনের বই ফরমাশ মতো বাঁধাই হয়। আমি কাজ দেখি। লম্বা হাতলঅলা খুন্তির মতো হাতিয়ার, নিচে অর্ধবৃত্তাকার ব্লেড, শিলপাথরে ঘষে ঘষে আরও ধারালো হয়, তবেই মোটা মোটা বইয়ের প্রান্তদেশ মসৃণ কেটে ফেলা। মুনিয়া কাপড়ের পোটলায় খাবার নিয়ে আসে। বাবার হাতে দিয়ে সামনের টিউবওয়েল থেকে জগে পানি ভরে। তারপর বেঞ্চের একপ্রান্তে বসে গান শোনার আবদার।
‘ভাইয়া…ভাইয়া ওই গানটা বাজা না?’
‘কোনটা?’
‘ওই যে কুছ লোগ রুঠ কারভি লাগতে হ্যাঁয় কিতনে পেয়ারে। হি হি হি!’
‘দূর আমি পারি না।’
‘ভাইয়া হবে হবে তুম বাজাও না?’
আমি পকেট থেকে মাউথঅর্গান বের করি। অনেকদিন ধরে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে কেনা। চায়নার তৈরী চৌষষ্টি ঘরের সুর মায়াজাল ভিক্টরি। মুনিয়াকে পরিস্তানের পরি মনে হয়। সোনালি-কালো ঝাঁকড়া চুলের ছায়ায় অসম্ভব উজ্জ্বল ফরসা মুখছবি। গোলাপি রং লিপিস্টিক চিকন ঠোঁটে কিংবা আলতা আবীর। নীল চোখের দিকে তাকাতে তাকাতে কেমন শিহরন লাগে। আমার সুর তোলা হয় না। ‘হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা, না জানে কিস্পে আয়েগা।’ হয় না। মাউথঅর্গান শুধু পোঁ-পোঁ করে। আহমদ চাচা অজু করে এসেছেন। কোরআন শরীফ সেলাই করতে হবে। আমি লক্ষ্য রাখি। কেমন করে জুস সেলাই হয়। মুনিয়া আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পারি। তার সারা মুখে অদ্ভুত আলো। আহমদ চাচা হাসতে হাসতে বলেন, –
‘কি রে বেটা পেঁ-পোঁ বাঁশি বাজাচ্ছিস? মেট্রিক ইমতেহান সামনে। প্রিপারেশন কেমুন? উকিলের ছেলে ব্যারিস্টারি পড়তে হবে। বাপ্কা নাম রওশন করনে হোগা।’
‘স্কুল তো ছুটি চাচা। আব্বা বইয়ের খোঁজ নিতে বলেছে।’
‘উকিল সাব কো বলবে কাল এতোয়ার কা দিন হ্যায়, ইখানে যেনো আসেন।’
‘আচ্ছা।’
মুনিয়া বাসনপত্র গুছিয়ে ব্যস্ত হয়। ফিরে যেতে হবে। গণেশতলা মসজিদের গলি হয়ে অনেক পেছনে ভাড়া বাড়ি। আমি সেখানে কয়েকবার গিয়েছি। মুনিয়া মাসুমার ক্লাসমেট। একই স্কুলে পড়ে। সই পাতিয়েছে। ওদের দু-জনের বন্ধুত্বে দুই পরিবারে মেলবন্ধন। মুনিয়ার বড়ভাই সুইহারিতে মটর গ্যারেজে কাজ করে। একদিন তার সঙ্গে দেখা হয়। সেদিনও মাসুমার আবদারে যাওয়া। আমার হাতে ক্যামেরা। বাচ্চুর কাছে থেকে ধার নিয়েছি, কিন্তু মনের আড়ালে লুকোচুরি ভাব অন্যরকম, যেন জিনিসটা আমার। সকালে নতুন ফিলম লোড করা হয়েছে। মাসুমা বান্ধবীর সঙ্গে ছবি তুলবে। আমি দক্ষ ক্যামেরাম্যান। তখন আখলাকের সঙ্গে দেখা। গোলাপি উজ্জ্বল ফরসা, নাকের নিচে লালচে-কালো গোঁফ, সাদা পাজামার সঙ্গে ঘি-রং ঝুল পাঞ্জাবি, সেখান থেকে অচেনা কোনো আতরের সুবাস ভেসে বেড়ায়। সাইকেল নিয়ে বেরোবে। আঙিনা থেকে চেঁচিয়ে বলে, –
‘আম্মি ম্যায় যা রাহা হু, লওটনে সে দের হোগা। আস্সালামু আলায়কুম।’
‘ওয়ালাইকুম আস্সালাম। আল্লা হাফিজ বেটা।’
‘আল্লা হাফিজ।’
তারপর আমাদের দেখে একগাল মৃদু হেসে বলে উঠে, –
‘মুনিয়া দেখ্দেখ্কে এসেছে। মাসুমার বড়াভাই ভি আয়া।…আউর ছোটেভাই হামার একটা ফটো তুলবে না? হা হা হা!’
‘হা হা জরুর ভাইজান।’
‘না রে ইয়ার্কি করছি। বহুত কাম আছে। আভি যেতে হবে। অন্যদিন বাতচিত করব কেমুন। আল্লা হাফিজ।’
(চলমান)
আগের পর্ব পড়ুন মুনিয়া এবং কাহিনি একাত্তর

মুনিয়া এবং কাহিনি একাত্তর

মেয়েটিকে নিয়ে এখন কী করা যায়?
মধ্যরাত শেষের অস্থিরতায় এই প্রশ্ন বড় জোরালো হয়ে ওঠে। গোর-এ-শহিদ ময়দানের বিস্তৃত ফুটবল গ্রাউন্ড। পশ্চিম প্রান্ত ঘেঁষে চিকন রাস্তা উত্তর-দক্ষিণ চলে গেছে। ডিসি সাহেবের বাসভবন। সার্কিট হাউস। আরও সামনে…সে যা হোক, ফুটবল মাঠের পশ্চিমে রাস্তা, তার পুবে জল নিষ্কাশনের সরু খাল ছেড়ে কাঠের কয়েকটি ঘর নিয়ে গ্রিনরুম কাম রেস্টহাউস। মেকআপ আর বিশ্রামাগার। মার্চ শেষে এপ্রিলের পাতাঝরা তপ্ত দিনকাল। কখনো বাতাসে গুমোট তাল-লয়ে বারুদের হালকা স্পর্শ লেগে থাকে। সেই গন্ধে জড়িয়ে থাকে শুকনো রক্তের বীভৎস দাগ। রাস্তার গোপন কোঠরে এবং প্রকাশ্যে ছড়িয়ে থাকা লাশের ব্যাদান চোখ-মুখ। কখনো শকুন আর কুকুরে খুবলে তুলছে মৃত মানুষের শরীর। শহরের রাস্তায় মহল্লার অলিগলিতে মানুষ মানুষের মুখের দিকে তাকাতে পারে না। চোখে-মুখে ভয়-ভক্তি-আশঙ্কা লেপটে থাকে। ভক্তির উৎস অন্য কোথাও, সেটি অন্ধ মোহ কিংবা স্বার্থবুদ্ধির কূটজাল কে জানে। মানুষ আপাতত বিচ্ছিন্ন আবার সংঘবদ্ধ হয়ে সকল দূরত্ব হ্রাসে কাজ করে যায়। কেউ কেউ নিজেদের ঘরদোর পাহারা দিয়ে রাখে। রাত পাহারা চোখ অন্ধকারের প্রহর গুনে গুনে সতর্ক সাবধান। এর মধ্যে মেয়েটি।
আমরা জেগে থাকি। টিমের নয়জন তিনভাগে দুই-তিন প্রহরের দেখাশোনা। কোথায় কী হয়? কী হতে পারে? কী হচ্ছে বা হতে চলেছে? এইসব অস্থির ভাবনার মধ্যে দায়িত্বের অংশ হিসেবে অন্ধকারের রাস্তা-অলিগলি আর পাড়াগুলোর আশপাশ মহল্লার চারিদিকে তাকাতে হয়। পশ্চিমে রাস্তা পেরিয়ে মিশনরোড। কাঁচাপাকা খড় ছাউনির ঘর, টিন ছাপরা আর দু-চারটি সাদা বিল্ডিং। পনেরো-কুড়ি পরিবারের সত্তর-আশিজন মানুষ। কয়েকদিন আগেও এই ঘরগুলোয় বুড়োবুড়ি আর জেদি মানুষজন ছাড়া কেউ ছিল না। ওদিকে কয়েকটি বিশাল দেবদারু আমগাছের উন্মুক্ত ছায়ায় ছোট ছোট টোপর-ঘর, ঘরের সারি, বিস্রস্ত আসবাব-তৈজস, এখানে-ওখানে বেঁধে রাখা বা মুক্ত ছাগল-দুম্বা; এসবের মধ্যে বসবাস শিয়া সম্প্রদায়ের একদল মানুষ। মানুষজন ইরানি নামে চেনে। তাদের এখন কেউ বেঁচে নেই। এই যে কোথায় কী যেন নেই, ছিল কিংবা আছে অথবা এখন নেই…তার নাম ভয়। স্বস্তি উধাও হয়ে গেছে। আমরা রাত নয় কিংবা দশের দিকে এখানে আসি। একটি রং চটা ক্যারামবোর্ড মেঝেতে সাজানো, ক্রাইস্টাইল স্বচ্ছ প্লাস্টিকের উনিশটি গুটি আর স্ট্রাইকার বরিক পাউডারের মধ্যে এলোমেলো ছড়িয়ে থাকে, যেন আমার দেশ আর মানুষজন অস্থির এদিক-ওদিক ভাবনা-দুর্ভাবনায় বিশুষ্ক আর কোনো স্বপ্ন দেখে যায়। প্রায়শ বিনোদনের এসবে কোনো মনোযোগ নেই আমাদের। আমরা অন্ধকার রাতের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভোরের প্রতীক্ষায় থাকি। ভোর মানে সকাল। একটি সকাল আমাদের বড় আকাঙ্ক্ষার। আমাদের নেতা সাতই মার্চ, রবিবার, আগুনঝরা ভাষণ দিলেন। ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা-আল্লাহ্।’
আমরা কখনো সকালে এসে বসি। সারাদিন কেটে যায়। বাচ্চুর পকেটে কিংস্টোর্ক সিগারেট থাকে। কখনো স্টার…ফিল্টার উইলস্। মোরগ বা ট্যাক্সি মার্কা দেশলাই। আমি জানি রাফিদুলের কাছে পেট্রল লাইটার আছে। তেমন একটি জিনিস কেনার জন্য কয়েকদিন জেলরোড-লিলিমোড়ের দোকানে ঘুরেছি। অবশেষে সেই তিন-চার টাকা ক্রিসেন্ট বুক স্টলে মাসুদরানা সিরিজের বই কিনে শেষ। সিরিজের পাঁচ নম্বর বই। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা। আমরা এখন সেই পাঞ্জা লড়ে যাওয়ার প্রস’তি নিই সকাল-দুপুর-বিকেল। একাডেমি স্কুলের মাঠে যখন আতা আর বেলগাছের পাতাগুলো ঝিরিঝির ঝরে পড়ে, পড়তে থাকে, কেউ কেউ রাইট টার্ন-কুইকমার্চ আর রাইফেল চালনা শেখে। আমার শেখা হলো না। বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ অফিস। গণেশতলা সেন্ট যোসেফস্স্কুল রাস্তার অপরদিকে গোডাউনের মতো বিশাল ঘর সকাল-বিকেল-রাত গমগম করে। আলাপ-আলোচনা অনেককিছু চলে। কোনোদিন উঁকি মেরে আলোচনা শুনি। একদিন মোতালেব ভাই বের হয়ে জিজ্ঞেস করেন,-
‘পড়াশোনা কেমন? দেশের জন্য এবার কাজ করো। আমাদের সাথে এসো। মাও সেতুং-কার্ল মার্ক্স-লেলিনের নাম জানো?’
‘শুনেছি। মাও সেতুং-এর বইগুলো যেন লাল কভার ডায়রি। বেশ সুন্দর দেখতে।’
‘পড়েছ?’
‘বুঝতে পারি না।’
‘একদিন বিকেলে আসবে, গল্প করব। আগামিকাল নেতার ভাষণ…শুনবে কেমন।’
আমার যাওয়া হয় না। সাতই মার্চের ভাষণ ওইদিন রেডিওতে প্রচার হলো না। বাবা পরদিন সকালে ফুল ভলিউমে ভাষণ শুনছেন। মারফি ডিলাক্স রেডিওর সাউন্ড গলির মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। উত্তরপার্শ্বের বাড়ি থেকে নন-বেঙ্গলি আহমেদ রফিক ছুটে এলেন। চুল-দাড়িতে মেহেদি রং।
‘ক্যায়া বাত উকিল সাব? শাদি লাগগিয়া ক্যায়া?’
বাবা কিছু বললেন না। ভলিউম কমিয়ে দিলেন। আমার শ্রুতিতে বেজে চলে, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা-আল্লাহ্।’ আনন্দ-খুশির নেশায় রক্ত টগবগ করে নাচে। এই তো এক বছর আট মাস আগে মানুষ চাঁদের মাটিতে পা রেখেছে। উনসত্তর সালের কুড়ি জুলাই, রবিবার Neil Armstrong চাঁদের বুকে পা রেখে ইথারে জলধগম্ভীর ঘোষণা ছড়িয়ে দিলেন `That’s one small step for man, one giant leap for mankind.’ আমার সপ্তর্ষি-সন্ধ্যাতারা-ধ্রুবতারা-লুব্ধক সন্ধানী মন নেচে নেচে রাস্তা, স্কুল এবং তারপর গোর-এ-শহিদ ময়দানের আড্ডায় ছুটে এলো। Willy Ley-র The Conquest of Space বই হাতে। মনের আকাশে ফ্লাইং সসার আর গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে এ্যলিয়েন অনুসন্ধান। মন আমার কোথায় হারিয়ে যায়! অলীক কল্পনা? (চলমান)

সততা যার যার

গতকাল সকালে চার্জার রিকশায় এক জায়গায় যাচ্ছি। দিনাজপুর শহরের সড়কে যাতায়াত করলে উন্নয়নের রোল মডেল প্রত্যক্ষ করা যায়। মোটরসাইকেল, চার্জার রিকশা কিংবা বাইসাইকেলে বেশ উপলব্ধি হয়। একে আমরা বলি উন্নয়নের ঝাঁকুনি। যা হোক এটা সেই গল্প নয়, যা বলতে শুরু করেছি। পথে যেতে যেতে পুবে তাকিয়ে দেখি, দোকানের বারান্দায় টেবিল পেতে যে ম্যাকানিক ছেলেটি, সে অপলক তাকিয়ে আছে। আমি দূর থেকেই জিজ্ঞেস করলাম, –
‘ভালো আছো রাজু?’
সে মাথা নেড়ে জানাল, ভালো আছে। ছেলেটি আমার কলেজ সহপাঠির একমাত্র পুত্র। আমার কলেজ বন্ধু ইন্টারে পাস করতে না পেরে রেডিও মেকানিকের কাজ শিখে নেয়। ভালো ইনকাম করে। ইলেকট্রিনক্সের উপর দুর্দান্ত আগ্রহ আমার। বাজারে নতুন মডেলের ক্যাসেট রেকর্ডার এলে পুরোনোটা পানির দরে বিক্রি করে নতুন কিনতাম। সেই নেশা অবশ্য এখন নেই। এখন হাতের মোবাইলে দু-তিন হাজার গান। তবে যখন ঢাউস সাইজ ডিলাক্স মডেলের ক্যাসেট রেকর্ডার ছিল, সিডি প্লেয়ার, রেডিও ইত্যাদি সব আমার বন্ধু সার্ভিসিং করে দিত। আমি যথাসম্ভব সম্মানী দিতাম। বন্ধু বলে কথা। তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে সুখ-দুঃখের গল্পও হতো। সামনের চা স্টল থেকে চা-সামুচা নিয়ে আসতাম। ইত্যাদি। এখন সে খুব কম বসে। তার ছেলেই কাজ করে। সারাদিনে ভালো ইনকাম হয়। সেই ছেলেও বেশিদূর পড়ালেখা করতে পারেনি অথবা করেনি। বাবার কাছে থেকে ইলেকট্রনিক্স মেকানিক বিদ্যা ভালোই রপ্ত করে নিয়েছে। কখনো তার কাছে বিবিধ সামগ্রী সার্ভিসিং করাতে যাই। কোনো দরদাম করা যায় না। মানসম্মানের ব্যাপার। সে কাজ করে দেয়। আমি তার হাতে টাকা দিই। বন্ধু কোনোদিন দূর থেকে এসে জিজ্ঞেস করে, –
‘কী সমস্যা হলো?’
‘এই চার্জারটা জ্বলছে না, জ্বললেও একমিনিসট পর নিভে যাচ্ছে।’
‘ওর ব্যাটারি গেছে।’
এভাবেই মাঝেমধ্যে টুক-টাক কাজ করিয়ে নিই। দিন কয়েক আগে একটি হেডফোন দিয়েছিলাম। রাজুর সময় হয় না। বড় ব্যস্ত। অবশেষে একসময় বললাম, ‘অবসরে করে ঠিক করে দিয়ো।’ হেডফোনের সমস্যা সামান্য। সম্ভবত রাইট সাইট স্পিকারের কানেকশন লুস বা কেটে গেছে। তিনদিনের মাথায় এক সকালে হেডফোন পেলাম। বাড়ি এসে দেখি চলছে। তবে ভলিউম কন্ট্রোল আগের মতো স্মুথ নয়। সেটা পালটে গেছে। তবু যা হোক চালিয়ে নেওয়া যায়। তিনদিনের মাথায় আবার আগের ডিস্টার্ব। মোবাইল করে বললাম সমস্যার কথা। রাজু জবাব দিল।
‘সময়ের বড় অভাব আঙ্কেল।’
‘তুমি কেমন কাজ করে দিলে, দু-তিনদিনে নষ্ট হয়ে গেল। আরও একবার দেখ, চার্জ যা হয় দেওয়া যাবে।’
‘সেটা বড় কথা নয় আঙ্কেল।…আচ্ছা দিয়ে যাইয়েন।’
একদিন পুনরায় দিয়ে আসলাম। রাজু কাজ ধরে না। আমি আশপাশের কম্পিউটার দোকানে মনোমতো হেডফোন খুঁজে পেলাম না। অনলাইনে হেডফোন পাচ্ছি তো অর্ডার করতে গিয়ে দেখি ‘আউট অব স্টক’। কী আর করা। রাজুকে রিকোয়েস্ট করলাম আরও কয়েকবার।
‘আচ্ছা আঙ্কেল, আগামিকাল সকালে দেখব। আপনার কাজ দিয়েই দিন শুরু করব।’
‘ভেরি গুড।’
পরদিন সকাল প্রায় দশটায় ফোন দিল রাজু। ভাবলাম কাজ হয়ে গেছে। আসলে কিছু হয়নি। সে জানাল, রাইট সাইডের স্পিকার কেটে গেছে। আমি নাকি খুব জোরে বাজাতে গিয়ে নষ্ট করে ফেলেছি। তাকে বললাম, –
‘আমি তো কম্পিউটারে গান শুনি। কারও বিরক্তি যাতে না হয়। তা যা হোক, ঠিক করা যাবে?’
‘স্পিকার পালটাতে হবে।’
‘খরচ কেমন পড়বে বলো।’
‘স্পিকার মনে করেন সাড়ে তিন শত টাকা।’
আমি অবাক। একটি সাধারণ হেডফোন। কিনেছিলাম সাড়ে সাত শ টাকায়। কানেকশন মেরামত বাবদ দুই শত খরচ হলো। এখন স্পিকার পালটাতে সাড়ে তিন শত। মেকানিক চার্জ কম করেও একশ। অর্থাৎ মোট খরচ দাঁড়ায় সাড়ে ছয় শত। মোবাইলে জানালাম আমি যাচ্ছি।
তার কাছে গিয়ে স্পিকার দেখি। একটি বিবর্ণ পুরোনো জিনিস। এটা কখনোই এই হেডফোনের নয়। রাজু আমাকে ভালো মক্কেল পেয়েছে। তাকে বললাম, –
‘ঠিক করার আর দরকার নেই। একটি নতুন কিনে নেব।’
‘এই মডেল তো পাবেন না।’
রাজু বিরস বদনে জবাব দিল। আমি হেডফোন খোলা অবস্থায় ফেরত নিয়ে আসলাম। বাসায় পরিত্যক্ত সামানের মধ্যে রেখে দিলাম। বিদায় বন্ধু। অনেকদিন কানে লাগিয়ে কত না গান শুনেছি। মন আকাশে ভেসে গেছে কত বার আবেগের মোহনায়। আজ তাকে বিদায় জানতে হলো। একদিন সকলকেই বিদায় জানাতে হয়।
গতকালকের একজন তরুনের নিষ্পলক দৃষ্টিতে কী খুঁজে পেয়েছি জানি। আমরা এ কোন সমাজ রেখে যাচ্ছি? কীভাবে মানুষ এমন হয়ে যায়? আমি সব সহ্য করে গেলাম। কখনো মন বলে, কলেজের সহপাঠি বন্ধুকে বলি, ছেলেকে কেন সৎ করে গড়ে তুলতে পারলে না? কখনো ভেবে নিই, কী দরকার, মানুষ তো এমনিই। সততা যার যার জীবন তার তার। মন খুব খারাপ হয়ে গেল।

বৃত্ত-আবদ্ধ জনম

তেরো মাসের শিশু; মায়মুনার মন কিছুতেই সায় দেয় না। সে তো মা। সে কি করে পারবে অমন কাজ? দুধের বাচ্চা, ওকে না দেখে মরে যাবে যে! না না কিছুতেই পারবে না।
সিরাজুদ্দিন প্রথমে মাথায় হাত বুলোয়। মিষ্টি করে দুটো কথা বলে। তারপর খুব দ্রুত আর গভীরভাবে বউয়ের গালে চুমু খায়। তির্যক তাকায় শিশুপুত্রের দিকে। দুপুরের ঝাঁজালো রোদ ঝুপড়ির ভেতর কেমন শীতল আর ম্লান হয়ে গেছে। সেই আলোতে দেখে, সুলেমান ছোট্ট হাতদুটো দিয়ে মায়মুনাকে জড়িয়ে ধরে আছে। ঠোঁট দিয়ে টেনে নিচ্ছে অমৃতধারা। মায়মুনার ফরসা স্তনের চারপাশ ঘিরে থাকা শিরার নীলচে রেখাগুলো এই জীবন আর বেঁচে থাকার অনন্য এক শিল্প। মা ও শিশুর এই মায়াময় দৃশ্য সিরাজের বুক ঠেলে ভারী দীর্ঘশ্বাস বের করে দেয়। আর উপায় নেই, তাদের বাঁচতে হবে।
সিরাজ বেঁচে থাকার অনেক মূল্য দিয়েছে। অবশেষে একান্ত বাধ্য হয়ে অসহায়ের মতো মায়মুনাকে বলে রুবির মায়ের কথা শুনতে। ছেলেকে তো একেবারে দিয়ে দিতে হচ্ছে না। বিকেলে বা সন্ধেয় ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। আর এই সামান্য কয়েক ঘণ্টার জন্য রুবির মা কুড়ি-পঁচিশ টাকা হাতে দেবে। হতভাগা সংসারে কার‌ও ঠিকমতো খাওয়া জোটে না। একটু তো সুদিন আসবে। স্থিতি আসবে। সুলেমানকে সুজি বার্লি কিংবা কৌটার খাবার, কি বলে সেরেলাক কিনে দেবে।

দিন কয়েক আগে থেকেই কথা হচ্ছিল। রুবির মা বসে বসে পান চিবোয়। সিরাজের পেছনে বসেছিল মায়মুনা। সে তাদের সব কথা শুনে রেগে যায়। কি বাচ্চা ভাড়া! কোন্ মায়ে তার বুকের ধন ভাড়া দেয়? রুবির মা, বিগত যৌবন চেহারায় রাজ্যের ছেনালি এনে হি হি করে হেসে উঠে। ঝুপড়ির দেয়াল ঘেসে অনাদরে গজিয়ে ওঠা টমেটো গাছের পাতায় পচাৎ করে পানের পিক ফেলে। সবুজ সুন্দর চারাগাছ আপনিই কোনোদিন মুখ উঁচিয়ে সূর্য দেখতে শুরু করেছে কে জানে! তখন আধবুড়ি খ্যাসখ্যাসে গলায় মায়মুনার উদ্দেশ্যে বলে, –
‘ছইল নিয়া কি হাওয়া হইম বা হে! মোর উবি যদু বাঁচি থাকিল হয়, ওরে বেটাবেটিনি কাজোত গেনু হয়। আর মাগনা তো তোর ছইল নিগাম না…ট্যাকা দিম।’
সিরাজের সবকিছুতে অতি আগ্রহ। সেই ধরে এনেছে বুড়িকে। কোত্থেকে কি খবর কেমন করে যে পায় কে জানে! সে দু-চোখে চকচকে লোভ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, –
‘কত্ ট্যাকা দিবু?’
‘তা কামাই ভাল্ হইলে বিশ পঁচিশ দিম।’
‘আর যদু তেমন ওজগার না হয়?’
‘ওজগার ক্যান হবি না!’
বুড়ি আচমকা সিরাজুদ্দিনের উপর ধমকে উঠে। প্রত্যুত্তরে সে মিন মিন করে থেমে যায়। বুড়িকে ক্ষ্যাপানো যাবে না। সে মায়মুনার দিকে দৃষ্টি দেয়। তাকে বোঝা যায় না। গতরাতেই আভাস দিয়েছিল। রুবির মা সকালে আসবে। কিন্তু মায়মুনা ভোর থেকেই ছেলেকে একেবারে বুকের ভেতর নিয়ে বসে থাকে। ঝুপড়ির ভেতর শুইয়ে রাখেনি। সিরাজ আবার ছোট একদীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয় মায়ের বুকের ওমে নিরাপদ নিশ্চেন্তে বাচ্চা হয়তো কোনো পরির দেশের স্বপ্ন দেখতে থাকে। সেখানে ক্ষুধা নেই বেঁচে থাকার যন্ত্রণা নেই। স্বপ্ন দেখে আর ফিক ফিক করে হাসে। সিরাজ আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজেকে তার পাষাণ সীমারের মতো মনে হয়। কিন্তু উপায় আর কি আছে? তার দিনকাল খুবই খারাপ যাচ্ছে। গেল সপ্তাহে ভ্যান টানতে গিয়ে পিঠের উপর রগ উঠে গেছে। নিজের ক্ষতি তো শুধু নয় ভ্যানটাও শেষ। সেটার ফ্রেম কয়েক টুকরোয় ভেঙে পড়ে। ভ্যানের মালিক পৌরসভার কমিশনার, খবর পেয়ে রিকশায় পায়ের উপর পা তুলে ছুটে আসে । এসেই দুর্দান্ত গালাগাল।
‘চুতমারানির বাচ্চা, ওভারলোডিং করছিস ক্যা? এইডা কি লোহার গাড়ি যে তোর মায়ে-বাপে চোদ্দো গুষ্টি রে উঠাবি? শালা বানচোত।’
‘আপনারে তো অনেকবার কইছি মহাজন, ওল্ডিং ফেরেম বেশি দিন যাবা ন। দুইটা বস্তা উঠাইতে এই অবস্থা।’
‘শালা পলিয়া ধুর, খালি মুখে-মুখে তক্কো করসি, যা তোরে আর ভ্যান চালাইতে হবে না। ভাগ এইখান থিক্যা।’
‘কিছু ট্যাকা দেন অষুধপত্তর কিনিবা লাগিবে।’
কমিশনার তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। হাঁটুর নিচে পেছন দিকে কেটেছে। রক্ত চুইয়ে পড়ে জমাট বেঁধেছে। কয়েকটা মাছি রক্তের স্বাদে ভনভন করছে সেখানে। কমিশনারের মন কি ভেবে আদ্র হয়। দশ টাকার একটা নোট এগিয়ে ধরে।
‘মহাজন পঞ্চাশ টাকা দেন, বাড়িতে চাল-ডাল কিছু নাই।’
‘ভাগ শালা, গাড়ি ভাঙলি আবার টাকা।’
‘দেন মহাজন দেন। পিঠের বেদনাটা সারি গেইলে ফির কাম করি শোধ দেমো।’
‘তোকে আর গাড়ি দেব না। পলিয়া চাষা, পথঘাট বুঝিস না, ট্রাফিক মানিস না। যা আর এই পাঁচ টাকা নিয়া দূর হ।’

সিরাজুদ্দিন মালিকের মন গলাতে পারেনি। ভাঙাচুরা ভ্যানগাড়ি মেরামত কারখানায় পৌঁছে দিয়ে হাসপাতাল যায়। ডাকতারের লিখে দেয়া স্লিপের কয়টা ট্যাবলেট নিতে ওয়ার্ডবয়কে পাঁচ টাকা ঘুষ সাধে। তারপর দশ টাকা দিতে হয়। সেই অষুধে কাজ হয়নি। পিঠের ব্যথায় সুড়সুড়ি লাগে মাত্র। মায়মুনা পয়মন্ত বউ। একটু একটু করে সঞ্চয়ের যে কয়েকটি টাকা হাতে রেখেছিল, ওই দিয়ে আরও ট্যাবলেট কেনে। এক-দেড় কিলো চাল, আড়াই শ মসুর ডাল। পাঁচ টাকা অ্যারারুট বার্লি। জীবন আর বেঁচে থাকায় কত কি লাগে! সব জোগাড় করা যায় না। সেই টাকাও ফুরিয়ে গেল। গত দু-দিন আশেপাশের সক্ষম পরিবারগুলোর কাছে থেকে এটা-ওটা ধার করে লবণে ফুটিয়ে চলছে। এখন কেউ আর কিছু দেয় না। ধারবাকি নেই। পাওয়া যাচ্ছে না। সকলের এককথা, আশ্বিন-কার্তিক মাস…মঙ্গার দিনকাল। অনেকের কাজ নেই। ষষ্টিতলা আর ঘুগড়াতলি গিয়ে বসে থাকে। কেউ কাজের জন্য ডেকে নেয় না। সিরাজও কয়েকদিন বসে ছিল। কাজ করতে পারবে কি না কে জানে, তবু আশায় আশায় সময় গোনে; আশাই তো জীবন। কিন্তু কেউ ডাকে না। সে বুঝে ফেলে, যার কিছু নেই, কোনো দাম নেই। জগৎ তেলা মাথায় তেল ঢালার। যারা শূন্য তারা শূন্য…মূল্যহীন। তাদের জীবন কষ্টের বৃত্তে আবদ্ধ। তারা সেখানেই ঘুরপাক খেতে থাকে।

গত পরশু ভোরবেলা আবার ষষ্টিতলার মোড়ে বসে থাকে। অনেকেই আসে। কারও হাতে টুকরি কোদাল, কেউ দা-কুড়াল নিয়ে অস্থির বসে বা দাঁড়িয়ে থাকে। এদিক-ওদিক হেঁটে বেড়ায়। বিষাদ দৃষ্টিতে অচেনা প্রত্যাশার রংধনু খেলা। সবাই মজুর। এই দুনিয়া হুজুর আর মজুরের। ঈশ্বর আর বান্দার। সে হতভাগা বান্দা। বটগাছের নিচে বিমর্ষ চেহারা শুকনো দৃষ্টি বসে থাকে। তার হাতে দা-কুড়াল-টুকরি-কোদাল কিছু নেই। মাথায় জড়ানো ময়লাটে লাল-গামছা পরিচয় বহন করে। সে শ্রমিক। মজুর মানুষ। কাজ জোটে না। একনাগাড়ে বসে থাকায় পিঠের শিরা পেশি আরও টানটান হয়ে যায়। ব্যথা বাড়ে। সে অসহায়ের মতো এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে, কিছু খুঁজতে খুঁজতে একবার খুব অসহায় কষ্টে ভাবে, ঝুপড়িতে ফিরে যাওয়াই ভালো; একটু শুয়ে থাকতে মন চায়। উপায় কি আছে? সে ওঠে না। অপেক্ষা যদি কোনো কাজ পাওয়া যায়। আশায় আশায় সকাল গড়িয়ে চলে। তারপর আকস্মিক এক পুলিশ এসে ডেকে নেয়। তার বাসায় গিয়ে কচি এক জলপাই গাছ টুকরো টুকরো কাটে। পুলিশের ছেলেমেয়েরা অপরিপুষ্ট জলপাই কুড়োতে হইচই লাগিয়ে দেয়। সিরাজের মন বড় বিষণ্ন। আহা এত সুন্দর গাছ! সবুজে সবুজে ভরে ছিল। নতুন ফলের অদ্ভুত সুবাস। গাছের প্রতি অনেক দরদ। বাসাবাড়ি থাকলে অনেক অনেক ফলের গাছ থাকত তার। কিন্তু উপায় কি? তার তো কোনো জায়গা-জমি নেই। এত বড় পৃথিবীতে এক-দুই আঙুল জায়গাও না। রেললাইনের ধারে পাথর-সুরকি-আবর্জনার পাশে ছোট ঝুপড়ি তুলেছে। তারই অন্ধকার স্যাঁতসেতে মাটিতে শুয়ে থাকে। মায়মুনা আছে। আদরের বউ। এখন সুলেমান। তার আত্মজ। নিজের জন্য নয়ই, তাদের জন্যও কোনো সুখ-শান্তি এনে দিতে পারে না সে। এভাবেই সংসার-জীবন আর বেঁচে থাকা…সেভাবেই কোনো একদিন টুপ করে মরে যাওয়া। অর্থহীন আসা-যাওয়া জীবন। সে আর ভাবে না। মানুষ যেমন করে চায়, গাছের টুকরো করে। নির্দেশ অনুসারে সাজিয়ে রাখে। সন্ধেয় যখন মজুরি পায়, এত নগন্য, গাছ নয়, সারাদিন বোধকরি নিজেকে ফালা ফালা করে কেটেছে সে। পুলিশ মানুষ পয়সা নিয়ে কথা আর বাড়াবাড়ি করার ভরসা পায়নি। বলা যায় না, কোনো কেসে ঢুকিয়ে চালান করে দেয়। এই কারণে তো গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে হয়েছে।

সিরাজুদ্দিন জোর করে হারানো দিন ভুলে যেতে চায়। কী হবে ভেবে? সে ফিরে আসে বাস্তবে। সকাল সোনালি রোদে ঝলমল করছে। উজ্জ্বল আলো চারপাশে। তার সকাল হয় না…অন্ধকারে আলো জাগে না। সামনে বুড়ি বসে আছে। শকুনি লোভে চকচকে বড় চোখ এদিক-ওদিক কিছু খোঁজে। পান চিবোয়। চোয়াল হাপরের মতো ওঠে আর নামে। সিরাজের মনে হয়, প্রচণ্ড কালো কোনো গহ্বর গিলে খেতে এগিয়ে আসে…এগিয়ে আসছে। তার দৃষ্টি সেই অন্ধকার বিবরে হারিয়ে যেতে থাকে।
মধ্যরাতে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে সিরাজ। কার্তিকের হিমহিম বাতাস অথচ সে ঘেমে নেয়ে উঠে। অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন-বিমুঢ় জেগে থাকে। সে কি বেঁচে আছে না কি মরে গেছে? মাথা কাজ করে না। অনেকক্ষণপর আকস্মিক সম্বিত ফিরে পায়। অন্ধকার ছায়া ছায়া ফ্যাকাশে আলোয় পাশে তাকায়। মায়মুনা নিথর শুয়ে আছে। ছেঁড়া ব্লাউজের ফাঁকফোকর দিয়ে ফরসা বাহুমূল আর বুক অদমনীয় কামনা জাগায়। অদ্ভুত মায়ার খেলা। মায়মুনা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরেছে ছেলেকে। অষ্টমীর চাঁদ অনধিকারের মতো ঝুপড়ির ফুটো দিয়ে নেমে এসেছে তার চোখে-মুখে। সেই মুখছবি না বলা কত বেদনায় আশ্চর্য বিষাদ-করুণ। আলোছায়ায় জেগে থাকে আর সুনসান নীরবতা। সিরাজের দুর্ভাবনা-হতাশার কোনো ক্লান্তি নেই। সবসময় তাড়া করে। ঘুমের মধ্যেও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। প্রতিরাতে দুঃস্বপ্ন তাড়িত বারবার ঘুমের মধ্যে চমকে উঠে। তারপর ভয়ংকর জেগে উঠে রাত পাহারা দেয়। তার সামনে-পেছনে অন্ধকার…শুধুই অন্ধকার। তার আর ঘুম আসে না। আজ তার নিবিড় সজল দৃষ্টি আত্মজের উপর ছড়িয়ে পড়ে। তাকে কোলে তুলে নিতে সাধ হয়। আহা! যে বুকের ধন আগলে রেখে মানুষ করবে তাকেই কিনা অবলম্বন করতে হচ্ছে । সিরাজ বড় পাষণ্ড। এভাবেই নিজেকে তার করুণা করতে ইচ্ছে জাগে। চারিদিক ঝাপসা হয়ে যায়।

পিঠের ব্যথা কমেনি। ওষুধ কেনার টাকা নেই। হাসপাতালের ডাকতার বলেছে, এক্সরে করতে হবে। পেশাব পরীক্ষা করা দরকার। হাড়ে চির ধরেছে কি না? কিডনি সমস্যাতেও পিঠ-কোমর ব্যথা হতে পারে ইত্যাদি। সিরাজ তেমন কিছু বোঝে না। এটুকু শুধু ধরে নেয়, হাসপাতাল হলো শেষ ঠিকানা, ডাকতার মানে টাকা, টাকা খাওয়ার কসাই। হাজারো পরীক্ষা-নিরীক্ষার চিকিৎসা সিরাজের জন্য নয়। তার জীবনের মুল্য কয় পয়সা? অবশেষে ব্যথা কমাবার কয়েকটা ট্যাবলেট খেয়ে পেট পচিয়ে ফেলে। এখন পিঠ আর পেট দুটোতেই অসহনীয় ব্যথা। তবু তাকে সইতে হয়। হসাপাতাল আর যায়নি।
রাতে মায়মুনা খুব মমতায় অনেকক্ষণ ধরে পিঠে পোড়া মবিল মালিশ করে দেয়। এতে সাময়িক আরাম লাগে। কিন্তু আধঘণ্টা যেতে না যেতেই ব্যথা দ্বিগুন বাড়ে। বাড়তে থাকে। পিঠ আর পেটের ব্যথায় বেঁচে থাকা হয়ে ওঠে প্রচণ্ড ঘৃণার। সে কখনো চিত হয়, কখনো উপুড়, কখনোবা কাত; স্বস্তি বা শান্তি তবু আসে না। তখন মায়মুনার শরীর ঘেষে পড়ে থাকে। ঘুমকাতর বউ তার ডানহাত টেনে নিজের বুকের উপর চেপে রাখে। সিরাজ কোনো অলীক কল্পনায় ভেসে যেতে চায়। পারে না।
দুঃস্বপ্নের ছবিগুলো ভেসে আসে। মুখ ব্যাদান ভয়ংকর একেকটা চেহারা…মৃত্যুদূত। সিরাজ নিজের জন্য কোনো ভয় পায় না। সকল অস্থিরতা সন্তান আর মায়মুনাকে ঘিরে। বড় অসহায় তারা। বানের জলে কচুরিপানার মতো তার পাশে পাশে ভেসে চলেছে। এই তার অশান্তি…অস্থিরতা। সুখ-শান্তির সঙ্গে সঙ্গে কোনো নিরাপত্তাও নেই। তার মাঝে মৃত্যুদূত! কখনো প্রচণ্ড হাসি পায়। গরিবির চেয়ে ভয়ংকর কষ্ট মৃত্যু দ্বিতীয়টি আর নেই। তাকে অন্যকিছু আর কি ভয় দেখায়? দুঃস্বপ্ন? গরিবির বৃত্ত-ফাঁদ-আবদ্ধ জীবনে স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন সব অন্তঃসার।
তার আর ঘুম হয় না। কোনোদিনই আসে না। রাতের কোনো প্রহরে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর জোড়া লাগে না। সে শুয়ে শুয়ে ভাবে, কত ভাবনা, কত কষ্ট, কত সাধ; আর মায়মুনার কথা। সে কি ছেলেকে দেবে? তার অনেক কষ্ট হবে…তবে পারবে। মেয়েরা সব পারে। তারা এ সমাজ-সংসারে বুকে পাথর বেঁধেও হাসতে পারে। আড়ালে-অন্তরালে শত দুঃখ-বেদনা-চাপাকান্না লুকিয়ে রেখে কী করে যে মায়মুনা হাসে…বাঁচতে শিখেছে, সিরাজ কোনো কিনারা পায় না।
খোলা আকাশের ছায়াপথ আর চারপাশের আলো-অন্ধকার দেয়ালে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার পেছনে ফিরে যায় সিরাজ। গ্রামের সবুজ দৃশ্যাবলী। সবুজ গাছপালা-বাঁশবাগান-পুকুর আর দূর থেকে জেগে থাকা একলা তালগাছ…বৈকুণ্ঠপুর। তার শৈশব-কৈশোর আর যৌবন শুরুর দিনকাল কেটেছে সেখানে। দিনগুলো কি সুন্দর মায়াময় ছিল। সেখানের কত দৃশ্য, কত ছবি, কত কথা ভাবতে ভাবতে বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে দীর্ঘশ্বাস তৈরি হয়। দুঃখের দিনগুলোও মনে পড়ে। সেখানেও দুঃখ-শঠতা-অত্যাচার ছিল। এসবের মানচিত্র সবখানেই একরকম। মালিক আর শ্রমিকের সম্পর্কের মতো।
মাত্র দু-মণ ধান চুরির অপরাধে শিকদার সাহেব থানায় তুলে দিয়েছিল তাকে। বড়লোক মানুষ। সিরাজ কিছুতেই বোঝাতে পারেনি অপরাধ তার নয়। শিকদার বাড়ির বড়ছেলে মোজাম্মেলর হয়ে ধান বিক্রিতে সহায়তা করেছে মাত্র। মোজাম্মেল অস্বীকার করে। সিরাজ হয়ে যায় চোর। থানায় খুব খাতির হয় তার । সেই শিশুকাল থেকে বাপের হাত ধরে শিকদার বাড়ি যাওয়া। তার ছোট্ট হাতে শত শত কাজ, ফাই-ফরমাশ, নরম কচি মনে দিনে দিনে ভৃত্যের শেঁকলে বাঁধা আনুগত্য মজবুত হতে থাকে, আন্তরিক গভীরতা পায়, সে হলো দীর্ঘ এক মহাকাব্য; সেদিন ছাব্বিশ বছরে এসে পুরস্কৃত হয়। তাকে প্রায় উদোম করে নিমগাছে বাঁধা হলে সকালের উজ্জ্বল আলোয় শত শত মানুষের দৃষ্টিতে কৌতূহল জমে উঠে। সার্কাস খেলার বিশেষ আকর্ষণ। শিকদার থানার বারান্দায় হাতলঅলা চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে নাচাতে থাকে। তার দু-চোখে বিকট ভর্ৎসনা…কখনো বীভৎস রাগ খেলা করে। এই লোক বড় বেশি কথা বলে, চাকর মানুষ, মোজাম্মেল ডাইল খায় না কি খায়; এত বড় গলা তোর?
পুলিশের চাবুক চলে। সিরাজের চিৎকার-আর্তনাদ নিমগাছ থানা চত্বর আর দেয়াল পেরিয়ে উন্মুক্ত মাঠে ভেসে যায়। সেখান থেকে তেপান্তরের দিগপ্রাইলন্ত আকাশগঙ্গায়। জীবন রূপকথার মতো জিয়ন-মরণকাঠি নয়। সেখানে শুধু দৈত্য আর রাক্ষস। এখানে কাপুরুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকা হাজার মানুষ তাকিয়ে দেখে। চোর পেটানো চলে। সিরাজের বোধ নেই। কেউ চেতনাহীন কোনো সত্ত্বায় ভেবে যায়, কী অপরাধ তার? সে সত্য বলেছিল। মিথ্যের এই জগতে সত্য বড় বিকট বেমানান লাগে। অপরাধ: সে গরিব। তার উপর চাবুক চলে। গরিবের শরীর কেটে ছিটকে গড়িয়ে পড়ে সত্য বলার শাস্তি। রক্ত। নির্বুদ্ধিতার লালরং। সেই রক্তে কুকুরে জিহ্বা দেয়। সুখ করে চাটে। সিরাজ কী করে? তার দুই হাত উঁচু করে বাঁধা। শিশ্নের ডগায় আধ-ধারা বাটখারা দড়ি বাঁধা ঝোলে। সবকিছু টনটন যন্ত্রণায় অসাড়-অস্তিত্বহীন। কোত্থেকে কয়েকটি নীলমাছি উড়ে উড়ে রক্তের গন্ধে মাতোয়ারা হয়। এদিক-ওদিক অস্থির ভেসে ভেসে বুঝে নেয় রক্তের স্বাদ। জনগণ সার্কাস দেখে। একসময় সবকিছু ঝাপসা অন্ধকার, শুধু অন্ধকার কালো গহ্বর; স্যাঁতসেঁতে কাদামাটি দেয়ালের বিশাল বৃত্ত জেগে থাকে। সে ওই আকারবিহীন বিবরে বন্দি। তারপরও কোনো শকুনমুখি কুকুরের ছায়া, ভয়াল দাঁতাল, মুখ ব্যাদান হাসতে থাকে। সেই ছায়াকাঠামো কখনো কুকুর, কখনো শিকদার অথবা কখনো পুলিশের বলে ভ্রম হয়। এভাবেই সত্যি সত্যি অন্ধকার নেমে আসে।
সিরাজ পরদিন অজানা এক ডাকাতির মামলায় সদরে চালান হয়ে যায়। তার ঘরে বিয়ে করা নতুন বউ। সে মায়মুনাকে সাবধান করে দিতে পারে না। বলে যেতে পারে না, ‘বউ তুই শিকদারের মিলে যাস না।’
মায়মুনা সাবধানী মেয়ে। সে আর কাজে যায়নি। কেউ কেউ শঠতার পৃথিবীতে ঠকতে ঠকতে নিজে থেকে সবকিছু শিখে নেয়। মায়মুনা তেমন। সিরাজ যখন থানা চত্বরে আর্তনাদে ভেসে গেছে, মায়মুনা বসে থাকেনি। শহরে গিয়ে ধর্মবাপ উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করে। অবশেষে সিরাজ পনের দিন জেল খেটে ছাড়া পায়। মায়মুনাকে তাই কিছু বলতে পারে না সিরাজ। সে তার অর্ধেক জীবন। আদরের বউ। আজ সেই প্রিয় মানুষকে কষ্ট দিতে নিজেরও খুব কষ্ট হয়। অন্য আর কোনো উপায় নেই? নেই। সিরাজ কী করে? দুনিয়াতে ক্ষুধার চেয়ে বড় কষ্ট আর কী আছে? সে অসহায়ের মতো আলোছায়া আকাশে একটু আলো খোঁজে, কোনো সকাল; কিন্তু অন্ধকার। অক্ষমতার কষ্টের চেয়ে আরও ভারী, আরও যন্ত্রণাদায়ক শুধু অন্ধকার।

মায়মুনা আগাম পঁচিশ টাকা পেয়েছে। সেই টাকা এখন সিরাজের হাতে। সে চুপ করে আছে। মায়মুনা বারবার বুড়িকে সতর্ক করে। বাচ্চার মাথায় আঁচল দিয়ে রাখতে হবে, রোদ লাগানো চলবে না, কত কি! একটু আগে দুধ খাইয়েছে। চোখে টেনেছে কাজলরেখা। কপালের কোণায় বড় এক টিপ। বুড়ি বলে, –
‘ন্যাও বা হে, ব্যাটা তোমহার সিনামা দেখিবার যাছে না। যতই সাজে দিবু ততই অসুবিধা। মানুষ আউলা হইলে ভিক্ষা বেশি পাওয়া যায়।’
‘ভিক্ষা তো তুই করিবু চাচি, মোর ব্যাটা নাহায়। রাস্তাঘাটোত্ যাবু, মাইনষের নজর খারাপ; নজর লাগে যদু। দুফর রোইদের বাও-বাতাস আছে না?’
‘মুইহো ভিক্ষা করিম তোমহার ব্যাটাও করিবে। একজন আঁও কাড়িবে আর একজন…।’
সিরাজুদ্দিন কাছেই বসে আছে। সে এবার চমকে বুড়িকে চোখ টেপে। বেশি কথা বলা যাবে না। ধূর্ত বুড়ি সুর পালটে ফেলে একেবারে।
‘দ্যাও মা, ভাল্ করি সাজে দাও। আহা রে যাদু…!’
‘সাঁঝ লাগিবার আগোতে সুলেমানোক দিয়া যাবু চাচি। দিনকাল ভাল্ নাহায়, কি কয় বলে, বাচ্চা খুবে হারাছে।’
‘মোক তরা অবিশ্বাস করেন বা হে?’
সিরাজ আর কথা বাড়ায় না। এসব কথায় মায়মুনা হঠাৎ বিগড়ে যেতে পারে। সেও বাচ্চাকাচ্চা হারানোর কথা শুনেছে। কেউ বলে নতুন ব্রিজে মানুষের রক্ত দিতে হয়। কেউ বলে ডাকতারেরা মানুষ কেটে কি কি সব নেয়। মানুষ বলতে বাচ্চা, আর বাচ্চা বলতে গরিবের বাচ্চা; যাদের খোঁজখবর নেয়ার মতো দরদি কেউ নেই। সে বুড়িকে চেনে। বেশিদিনের পরিচয় অবশ্য নয়। মানুষ খারাপ না। আর…সে-সকল দুর্বভাবনার ইতি টেনে নেয়। হয়তো জোর করেই।
মায়মুনা ছেলেকে বুড়ির কোলে তুলে দেয়। সিরাজ খুব বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এ ছাড়া আর কী করে? মায়মুনার মেঘজলভার দৃষ্টি, অব্যক্ত গম্ভীর মুখছবি; সিরাজ একপলক তাকিয়ে চোখ মাটিতে নামিয়ে রাখে। মাটির মতো সহনশীল হতে আকাঙ্ক্ষা করে। ডানহাতে সযত্নে চেপে রাখা তিনটি নোট অসম্ভব ভারী লাগে। সুলেমান তো তারও সন্তান…কলিজার টুকরা। সে ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে তাকিয়ে থাকে। রেললাইন অনেক দূর পুব-দিগেন্ত মিশে গেছে। কেউ একজন বুকের মধ্যে বিড়বিড় সান্ত্বনা হাতড়ায়। ‘বউ দুইটা দিন, পিঠের ব্যথা সারি গেইলে ফের মুই জোন দিম, রেকশা চালাম, ভ্যান চালাম।’
সিরাজের দৃষ্টি বোবা। মায়মুনার বামদিকের দুগ্ধভার পুরুষ্ট স্তন ছেড়া-বোতাম ব্লাউজের নিচে বেরিয়ে আছে। বৃন্ত বেয়ে বুকে-পেটে নেমে গেছে দুধ। সেখানে অদ্ভুত আলপনা-রেখা। অমৃতধারার কোন্ বিক্ষোভ? সেই একজন বুকের মধ্যে ডুকরে কেঁদে উঠতে চায়। কেঁদে কেঁদে অক্ষম প্রতিবাদ করে, আমি এ জনম চাইনি খোদা… এ জনম চাইনি।

আর ওইদিন থেকে এক ভিক্ষুকের জন্ম হয় এই অদ্ভুত স্বপ্নমাখা আলোকিত পৃথিবীতে। *

সিঁড়ি

এখন কীভাবে নিজেকে সেখানে নিয়ে যায়, থই পায় না সখি। দিশেহারা ভাবনা খেই। প্রচণ্ড ভিড়। পিঁপড়ে কিলবিল। তারা এগিয়ে যায়। ছুটোছুটি-হুড়োহুড়ি। কে কাকে ঠেলে ফেলে দেয়, কে পড়ে যায়, কার বুকে কার পা ওঠে; কারও নজর নেই। অনেক ভিড় দেখেছে সখি। কোটি মানুষের ভিড়ে মানুষ একলা পথিক। সখি আজ আবার পথে নেমেছে। পথের মানুষ পথে। আজ ফেরার পথ।
সখি একলা। একদিন শূন্যহাতে এখানে এসেছিল। সন্ধের ট্রেন যাত্রা। তখন ঈশাণ কোণ-ঘেষে একলা চাঁদ। চারিদিক হিম-কুয়াশা ঘোলা আলো। মায়ের জন্য মন কেমন করে। ফিরে যাবে? সে যায়নি। এরপর কেটে গেছে একশ পঁচাশি দিন। আজ ফিরে যেতে এসেছে। একটিবার দেখা। ট্রেনে উঠবে। এখন বেলা তিনটে। আজ আকাশে চাঁদ নেই। সন্ধেয় উঠবে কি না কে জানে, মানুষ চাঁদের খোঁজে চোখ রাখবে; এদিক-ওদিক খুঁজবে। চাঁদ দেখা দিতে পারে অথবা…। সন্ধে ছয়টা তেতাল্লিশে ইফতার। উনত্রিশ রমযান। সখি এখনো উঠতে পারল না। পারবে কি না জানে না। মাথায় পোকা কামড়ায়। অস্থির মন। কত সময় আছে?
মানুষ আর মানুষ। একদিন মানুষের ভিড়ে এসেছিল। ইট-পাথরের শহর। কেউ কারও দিকে তাকায় না। এখানে চেনা মানুষও অচেনা। ট্রেন চলে। ঝিকঝিক উথাল-পাতাল ভাবনা। তার উপায় নেই। পারা যায় না আর। সেই রাতে কোন্ ভাবনায় অবশেষে বলে ফেলে। মা বিশ্বাস করে না। এমন আবার হয়! এত বড় পাপ! অথচ তেমনই হয়। সখির অসহ্য লাগে। সে পারে না। কী করতে পারে সে? শেষ-পর্যন্ত পরম নির্ভরতার আশ্রয়…বলে ফেলে। কিন্তু পাথর চেহারায় অবিশ্বাস। দোলাচল খেলা। চোখের দৃষ্টিতে ঝাপসা বৃষ্টি। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। আর কিছু নেই। রাত নামে। নেমে আসে অন্ধকার। সখি কুণ্ডলিত কুকুরের মতো শুয়ে থাকে। ঘরের পশ্চিম কোণায় চৌকির উপর দু-জন মানুষ ঘুমোয়। গভীর নিশ্বাসে দেয়াল কাঁপে। সখির বুক। এই বুঝি কোনো লোমশ হাত এগিয়ে আসে। তাকে চেপে ধরে। সেই মানুষ তার বাবা। বড় ভরসায় বাবা ডাকে।

‘কি গো বেটি উঠতে পারো নাই?’
‘না গো চাচা। কেমনে উঠুম!’
‘যাবা কই?’
‘দিনাজপুর।’
‘টিকিট নিছো?’
সখি সামনে তাকায়। একজন মানুষ এক মেয়েকে জানালা দিয়ে ভেতরে নিতে ব্যস্ত। এত মানুষ কেমন করে যায়? ট্রেন থেমে আছে। মানুষের ভিড়। ভেতরে যেতে মরিয়া। কেউ ছাদে ওঠে। সখি কি ছাদে উঠবে? সে পাশে তাকায়। লোভে চকচক করে শেষ-দুপুরের দৃষ্টি।
‘তুমি ছাদে যাও। উঠবা?’
‘কেমনে উঠুম? অনেক উঁচা গো চাচা।’
‘এই যে মই আছে। বোঝলা মই না, সিঁড়ি; এডা দিয়া চাঁন্দেও উঠা যায়। স্বর্গেও। তুমি আহো।’
‘আজ চাঁদ উঠব?’
‘উঠবার পারে, না হলে শনিবার ঈদ হইবই। তুমি যাইবা না? আহো ছাদে তুইল্যা দিই। দশ ট্যাহা।’
‘দশ ট্যাহা?’
‘হ স্বর্গের সিঁড়ি দশ ট্যাহা। উঠবা?’
সখির দশ টাকা খরচ করতে অসুবিধে নেই। দশ কেন, কুড়ি পঞ্চশ একশ। মায়ের জন্য মন টানে। কেমন আছে মা? আহা কতদিন মাকে দেখে না! সেই আনন্দময়ী মা বোবা হয়ে গেল। সেই রাতে একটি মানুষ সারাজীবন বিছানায় শুয়ে শুয়ে অবশেষে পালঙ্কে ওঠে। মানুষের কাঁধে হেঁটে যায়। অনেক দূরের দেশ। মুখে কথা নেই। নতুন পোশাকে আতর-লোবান বাতাসে ভেসে যায়। মা কাঁদে। আকাশ-দিগন্তে অদ্ভুত বিষাদ। সোনালি-লাল আলোয় ধূসর অন্ধকার নামে। মানুষেরা বাবাকে নিয়ে যায়। ঝোপজঙ্গল পেরিয়ে বাঁশবাগান। সেখানে হাজার জোনাকি। রাত পাহারায় জেগে থাকে।
‘মা বাবারে কই নিয়া যাইতাছে?’
‘তোর বাবা যে স্বর্গে যায় গো বেটি। জাদু রে…।’
আকাশের দেয়ালে কান্নার প্রলম্বিত সুর। সখির অবুঝ মায়া চোখ ভাসে। সেও যাবে। বাবার কষ্ট। বাবা কত কথা বলে। সখি শোনে। সখি বলে। বাবার মুখের হাসি। কখনো বিষাদ। কোনো কথা বলে না। চোখের দৃষ্টি কথা কয়। বিছানায় শুয়ে কেটে যায় দিনরাত।
‘ওগুলা কিসের আলো গো মা?’
‘স্বর্গের বাতি মা। মা রে এ্যাহন কি করি?’
‘আমি বাবার কাছে যামু।’
সখি কাঁদে। বাবাকে কোথায় রেখে এলো মানুষেরা? সখি কাঁদে শুধু কাঁদে। তারপর সেই বাড়িঘর-আঙিনা বদলে যায়। মায়ের সঙ্গে হেঁটে এলো দূরের পথ। নতুন ঘরদোর। একজন গাট্টাগোট্টা মানুষ মিটমিট তাকায়। চোয়ালে ঝুলে থাকে অচেনা হাসি। মানুষ কোলে তুলে নেয়।
‘এই হলো তোর বাবা। এ্যাহন থাইক্যা বাবা ডাকবি।’
‘না এ মানুষ আমার বাবা না। আমার বাবা মইরা গেছে।’
‘যে গেছে…গেছে গ্যা। এ্যাহন এই তোর বাপ।’
সখি বাবা ডাকে। এই বাবা হাসে না। চেহারায় কী খেলা করে বোঝে না সখি। তার কেমন লাগে। শিরশির ভয়। মনে হয় একটা সাপ হিম-শীতল ছুঁয়ে রাখে। গালে চুমু দেয়। ঠোঁটে চুমু খায়। সেই মুখ সেই ঠোঁট ধীরে ধীরে নেমে যায়। বুকের কাছে। আরও নিচে। সখির খারাপ লাগে। কখনো ঘুম পায়। অন্ধকার রাত। সে হারিয়ে যায়।
সখি স্কুলে ভর্তি হয়। এলোমেলো পথ ধরে হেঁটে যায়। রোদছায়ায় ক্লান্তি। মাথা আউলায়। মানুষের জীবন জটিল। মা বলে, –
‘চুপ থাক। কাউরে কবি না।’
‘মানুষডা ভালা না। আমি বাবা ডাকি। কিন্তু…।’
‘চুপ যা মা। এগুলা মুখে আনা পাপ।’
সখি বলে না। সে ভাবে। পাপ-পুণ্য কী? একদিন পথে নেমে যায়। ট্রেনে বসে। কেউ জানে না। সে থাকবে না। পালিয়ে যাবে। তখন সন্ধেরাত। পুবকোণায় চাঁদ ওঠে। আজও চাঁদ উঠবে অথবা কাল। মানুষ আকাশে চাঁদ হাতড়ায়। সে ফিরে চলে। মাকে দেখতে মন টানে। কেমন আছে মা? সখি এখনো ট্রেনে উঠতে পারেনি। নিজেকে কেমন করে ভেতরে নেয়? ছাদের ওপর? অবশেষে ছাদেই উঠতে হবে। সেই মানুষ অস্থির। এদিক-ওদিক তাকায়। হাতে মই। সিঁড়ি। কেউ সিঁড়ি দিয়ে ছাদে ওঠে। সখি অস্থির চঞ্চল। কাল ঈদ। একবার সেই বাঁশবাগানে যেতে সাধ জাগে। সেখানে বাবা শুয়ে থাকে। সখি কয়েকটি মালা নিয়েছে। বুকল ফুলের মালা। এসব ভাবতে ভাবতে পাজামার ফাঁসে হাত রাখে। একটি লালরং নোট।
‘চাচা আমারে উঠায়া দাও।’
‘আইস আইস…সমায় কম গো বেটি।’
মানুষ ছোটে। সখি পেছন পেছন। ব্যস্ত ভিড়। সে যেতে পারে…পারে না। তার হাতে পুটলি। সেখানে বুকলের মালা। তাজা ফুলের মালা। কয়েকটি শুকিয়ে গেছে। ফুলের তবু সুবাস মরে না। সখির মন মরে গেছে। সে বাঁচতে এসেছিল। ইট-পাথরের শহর। এখানে মানুষ বেঁচে থাকে। মানুষ মরে যায়। বকুলের গন্ধ তবু বাঁচে। মাকে মনে পড়ে। মায়ের জন্য মন টানে। বাবার জন্য। বাবা জোনাকি আলোর নিচে ঘুমোয়। বাবার বুকে বকুল ছুঁয়ে দেবে। রেখে আসবে। বাবা খুব ভালবাসত। সখির বুক জুড়ে সুখ। সেই সুখ হারিয়ে গেল। একদিন পালিয়ে আসে। ইট-পাথরের শহর। পথে ঘুরতে ঘুরতে কত কাজ। মানুষ ভালো মানুষ খারাপ। সখি কাজ ছেড়ে দেয়। তারপর পার্কের খোলা বাতাস। সে গাছের নিচে শুয়ে থাকে। সারারাত বকুল ফোটে। তারার আলো। সকালে ফুলের বিছানা। সখি মালা গাঁথে। মন ভাবনা। একটি মানুষ মালা নিয়ে আসে। মা খোঁপায় পরে। মুখে হাসি। সেই মানুষ এখন জোনাকির আলোয় শুয়ে থাকে। মা কেন ভুলে গেল তাকে? মা তুমি কেমন করে বাবাকে ভুলে গেলে? কেন ভুলে গেলে?
অবশেষে উঠতে পেরেছে সখি। সিঁড়ি সরে যায়। যেতে হবে। কাল ঈদ। আনন্দ উৎসব। সখি বসে থাকে। নিচে মানুষজনের ছুটোছুটি। একটি হুইসিল। ট্রেন এগিয়ে যায়। সখির মাথা ঘোরে। অদ্ভুত ঘোর ঘোর দৃষ্টি। আকস্মিক কি হয়? কয়েকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। হইহই চিৎকার। সখির মন উন্মন। মায়ের কথা মনে পড়ে। বাবাকে দেখতে সাধ। সে ভিড়ের মধ্যে উঠে দাঁড়ায়। একটি মেয়ে শুয়ে থাকে। হাতে বকুলের মালা। সে রাস্তায় রাস্তায় মালা বিক্রি করে। সুগন্ধ বিলোয়। সে এখন শুয়ে আছে। ওঠে না। তার মুখ থেকে রক্ত কালো রং মাটিতে নেমে যায়। সখি সিঁড়িতে পা রাখে। আলো ঝলমল বহুবর্ণ ধাপ। অনেক উপরে বসে আছে কেউ। সে তার বাবা। সখি ওপরে ওঠে। উঠে যায়।

স্বর্গের সিঁড়ি।
_

(গল্পটি সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৪ জুলাই ২০১৮ ইস্যুতে প্রকাশিত। বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যে পোস্ট করা হলো।)

বংশীবাদক ও আকাশপরি উপাখ্যান (শেষ পর্ব)

মলি সংক্রান্ত গুজব ঘটনার শেষ-সময়ে, মামাবাড়ি থেকে ফিরে আসার পর; সত্যিকারার্থে ফয়জুলের সেদিকে দৃষ্টি পড়ল। মলি অসুন্দর কোথায়? গরিবের ঘরে আকাশের চাঁদ। আলোয় আলোয় চারিদিক ছড়িয়ে পড়েছে। কৈশোর পেরোতে না পেরোতে একেবারে গৃহিণী রূপ। শোনা যায়, সে-সময় বিয়ের কথাবার্তা চালাচালি হচ্ছে। পাত্রপক্ষ পছন্দ করে, কিন্তু যার পেছনে গুজব, রটনার ঘটনা…ঘটনার রটনা; তার শুভকাজ হয় না। মলির বাবা রায়হান মিয়ার দোকানে অনেকেই চা-সিগারেট খেতে আসে। দোকানের হুডের সঙ্গে মালভোগ আর সাগর কলা ঝুলে থাকে। কেউ কেউ বেছে বেছে টেনে ছিঁড়ে ছিলে মুখে নেয়। কারও কারও কৌতূহল কলার মোচার মতো ঝুলঝুল দোল খায়।
‘তারপর রায়হান, বেটির বিয়ের খবর কী?’
‘চেষ্টা চলছে ভাইজান। এই হচ্ছে-হচ্ছে করে, কী আর বলবেন; অনেক টাকা দরকার।’
মানুষজন নির্বিকার থাকে। মনের মধ্যে কৌতুক-সুখ। মলির বাড়ি পালিয়ে যাওয়া ঘটনা তা হলে সত্য। এমন মেয়েকে বিয়ে করবে কে? যার সারা গায়ে কালো দাগ। কলঙ্ক চিহ্ন। মেয়েদের ললাটে একবার লেগে গেলে আগুন-টিপের মতো জ্বলজ্বল করে। মন জ্বলে-পুড়ে খাক। মলির আর বিয়ে হচ্ছে না। পুরুষ মানুষ কাড়া-না-কাড়া হাজারটা কু-কাজ করলেও কোনো দাগ নেই। সেই দাগ ওয়াশেবল। ধোপার কাছে সাদা-ময়লা কাপড় দাও, চায়ের দাগ-পান-খয়ের, যা হোক; সাবান-সোডা ঘষে ঘসে লেবু দিয়ে পরিষ্কার করা যায়। কোনো দাগ-স্পট নেই। একেবারে আনকোরা নতুন-ফ্রেশ। কিন্তু মেয়েমানুষের কলঙ্ক সারাজীবনের পাপচিহ্ন। মানুষের কেউ কেউ মনে মনে কত কী ভাবে। ভাবনার কি শেষ আছে? এদের অলস সময় পরের গু ঘাটতে ঘাটতেই শেষ। নিজের শরীর-মন দেখার ফুরসত নেই। ফয়জুল আড়ালে-আবডালে এসব শোনে। সেও কত কি ভাবে। কখনো পাপ-কল্পনায় ভেসে যায়। কখনো মলির উপর মনের কোণায় মায়া জেগে ওঠে। আহা দেখতে এত সুন্দর মেয়ে! কোনোসময় বুশরার জায়গায় তাকে বসিয়ে কল্পনায় ভাসে। জীবনে একটি পুণ্য কাজ করতে তো পারে। ‘তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার।’ বিয়ে? সে করা যায়। মন শুধু মন ছুঁয়েছে। কোনো আপত্তি নেই। কবুল-কবুল-তিন কবুল। কিন্তু খাওয়াবে কী? নিজেই বাপের হোটেলে চলে-ফিরে। পকেটে পাঁচটি টাকা থাকে না যে, কাউকে নিয়ে জলযোগে বসে শিঙাড়া-কচুরি খায়। বুশরা আর কতদিন বিল মেটায়? নিজেকে তখন মাটিতে মিশিয়ে ফেলে ফয়জুল। এসব আজগুবি মহৎ ভাবনা ছেড়ে মনের লাগাম টেনে ধরা ভালো। কি-সব যাচ্ছেতাই ভাবনায় ভেসে যাওয়া? সামনে ডিগ্রি পরীক্ষা। পাশ কোর্সের মেয়াদ দু-বছর, অথচ তিন পেরিয়ে যায় যায়। ইংরেজি-বাংলায় তেমন সমস্যা মনে হয় না, কিন্তু ভূগোল বড্ড জ্বালায়। কিছুতেই বাগে আসে না। অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ কর্কটক্রান্তি-মকরক্রান্তি, কখনো আহ্নিক আর বার্ষিকগতির চক্রে পড়ে মন গতিহারা দিশেহারা। বুশরা কিংবা মলি…মলি কিংবা বুশরা, সব শালা আওরাত; আওরাত কা মক্কর দুনিয়াকা চক্কর, যে শালা বোঝেনি সে খায় ঠক্কর। সেই তুলনায় বাঁশি বাজানো ভালো। গভীর রাতের নিরিবিলিতে গোরস্তানে ধ্যান করা যায়। কে জানে যদি কোনোদিন আকাশ থেকে এক পরি নেমে আসে, কিংবা জলের তলা থেকে ভেসে ওঠে জলপরি; কপাল খুলে গেল। জীবনে আর কি চাই? ফয়জুল বাঁশি বাজায়। সুরে-বেসুরে নিঃসীম বাতাসে মনে মনে আবেগ-দোলা।

মলি মাঝে মধ্যে বাবার সঙ্গে দোকানে বসে। কোনোদিন একলা। প্রায়শ নির্জন দুপুর কিংবা বিকেলের সূচনা। ওর বাবা সে-সময়ে বাড়িতে বিশ্রাম নেয়। ফয়জুল তখন চা খেতে কত বাহানা করে। বুকের কোণায় দূরাগত বাতাস ভেসে ভেসে মন রাঙায়। মলি চা তৈরি করে। দুই ফ্লাক্সে কম করেও আট-দশ কাপ লালচে-খয়েরি লিকার। মানুষ র-চা পছন্দ করে। এই চা খেলে নাকি চেহারায় জেল্লা খোলে। কে জানে মলি এই চা খায় কি না। ফয়জুলের ভালো লাগে। কখনো কখনো চোখ ফেরাতে পারে না। নিষ্পলক কবিতা লেখা হয়। ইদানীং এই রোগ ধরেছে। রাত জেগে জেগে লাইনের পর লাইন মিলিয়ে কথা সাজানো। সে-সব হয় কি না কে জানে, মনে আহলাদ আসে; সাধ জাগে একদিন বুশরাকে পড়ে শোনাবে। তাকে নিয়েই তো স্বপ্ন-কল্পনা-মায়াজাল। তারপর মলি আবার ব্যস্ত। কারও জন্য দুধ-চা, কনডেন্সড মিল্ক মেশাতে থাকে, টুং টুং শব্দ ঝংকার, কারও জন্য পেঁয়াজি-বড়া কিংবা টোস্ট-বিস্কুট এগিয়ে দেয়। কখনো শরীর বাঁকিয়ে কলা ছেঁড়ে। বুকের ওড়না সরে যায়। মানুষের চোখে পাপ। চোখের দেখায় সুখ হাতড়ায়। ফয়জুল চা খায়। সিগারেটে টান দেয়। সবদিকে নজর। কেউ কেউ চা খেতে খেতে মলির সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। এসবও দেখা হয়। চোখ এড়িয়ে যায় না। বাতাস ঠেলে অনেক কথা কানে এসে ধাক্কা মারে। বুকে বজ্রপাত। মনের কোণায় অদ্ভুত জ্বালা। সহ্য হয় না। নিজেকে কষ্ট শাসনে সামলায়। মলি তার কে? না বান্ধবী না পেয়ারের মানুষ। একই গলির দু-চারটি বাড়ি পেরিয়ে একেবারে শেষপ্রান্তের প্রতিবেশি। ইদানীং মলি তেমন করে আর বসে না। রায়হান মিয়া কনডেন্সড মিল্ক মিশিয়ে গ্রাহকের দিকে চা তুলে ধরে। ফয়জুল খেয়ে দেখেছে। তেমন স্বাদ নেই। মলি যে চা তৈরি করে চমৎকার স্বাদ। আসলে মলির হাতের স্পর্শে জাদু আছে। কার না ম্যাজিক দেখতে ভালো লাগে। ফয়জুল ম্যাজিকের ভক্ত।

একদিন সন্ধের আগে আগে রাস্তায় দেখা হয়। প্রায়শ হয়, কিন্তু তেমন একলা নয়; অথবা অন্যকিছু আবেগ সময়। ফয়জুল সাইকেল থেকে নেমে মুখে হাসি তুলে ধরে। চোখে চোখে কত কথা। কত তাল-লয়-সুর-গান কে জানে।
‘ওই চা বিবি, একদিন বাড়িতে দাওয়াত করে চা খাওয়াবি না?’
‘কেন বে বাপের কাছে খাবি।’
‘ওই বুড়ার থেকে বুড়ার মেয়ের হাতে খাওয়ার মজাই আলাদা রে।…তো বল কবে যাব?’
‘আজ আয় এশার নামাজের পর।’
মলি হিসহিস সুরে কানের কাছে বলে উঠে। হাসির ঝংকার বাতাসে কাঁপে। ফয়জুল তো সে-রকমই চায়। যেমন বেণি তেমনই রবে, চুল ভেজাব না…না না না চুল ভেজাব না। মনে সাহস বাড়ে। গলির ধারে অযত্নে বেড়ে ওঠা শজনের এক ডাল থেকে দুটো শালিক লাফিয়ে অন্য জায়গায় বসে। দুই শাখাতেই দোল দোল দোলা। ফয়জুল একবার ডানে আরেকবার বাঁয়ে তাকিয়ে অস্ফুট খই ভাজে।
‘সেদিন দুপুরে তোর ওখানে গেলাম। তুই ছিলি না। তোর বাপ হুংকার দিয়ে বলে…কে? বাপ রে বাপ! কোথায় গিয়েছিলি?’
‘কোন্ দিন? আমি তো বাজার যাই। কখনো সওদাপাতি করতে হয়।’
‘তুই বাজার যাস? বুড়া কী করে?’
‘দূর বে! ওভাবে বলিস কেন?…তো কি জন্য গিয়েছিলি বল।’
‘কেন যে গেলাম! মনে নাই। হে হে হে!’
‘শালা, সবসময় ঝাড়ি! ভেবেছিস মা-মরা মেয়ে একলা আছে, ফুর্তি করে আসি…না?’
‘আ রে না না…বিয়ের প্রস্তাব দিতে গিয়েছিলাম।’
‘যা বে ভাগ, বাপের হোটেলে খাস; আর বিয়া করার শখ।’
‘তুই এমনই বলবি। মাই সুইট হার্ট। আমাকে বিয়ে করবি না? তোর বাপের দোকানে বড়া ভাজব নাহয়। ঘরজামাই।’
‘দূর শালা!…যা ভাগ।’
‘হা হা হা!’
তারপর গলিতে কেউ হেঁটে আসে। অচেনা মানুষ। ফয়জুল ভদ্র মানুষের মতো সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এই যখন-তখন ভালোমানুষ সেজে নেয়ার কায়দা বেশ রপ্ত হয়েছে। মানুষটি এগিয়ে তাদের ক্রস করে সামনে এগোয়। উত্তরে গোরস্তানের মধ্য দিয়ে সরু রাস্তা। শাল-সেগুনের শুকনো পাতা ছড়িয়ে আছে। মানুষের হেঁটে চলার খস খস…মচ মচ শব্দ মিলিয়ে যায়। ফয়জুলের মনে হয়, সেও এবার যেতে পারে। এইসব খুনসুটি বুকে শুধু থিরথির কাঁপন ধরায়। ভালোই লাগে। মজা আর মজা। তারপর দু-পা এগোতে পেছন থেকে বলে উঠে মলি, –
‘কি রে আসবি তো?’
‘আসব না মানে! আবশ্যই আসব। আই লাভ ইউ ডার্লিং।’
‘শালা-আ!’

ফয়জুলের বুকে কাঁপন দোলা। সকাল থেকে জমে থাকা অকারণ রাগ সকারণ ক্লেদ মুছে যেতে শুরু করে, অথবা করে না, সবকিছু মিলেমিশে অন্যরকম ভালোলাগা ছড়িয়ে যায়। অনেক দূর হেঁটে আসতে হয়েছে। রাস্তার ধারে ফুটপাতে দু-একজন মেকানিক বসে। তারা কাঠের বাক্সে বিবিধ যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করে। একটি পাম্পার, তেল-মবিল প্যাঁচপেঁচে, এককোণায় দাঁড়িয়ে থাকে। ফয়জুল কোনো কোনোদিন এগিয়ে যায়।
‘মামা পাম্পারটা নিলাম।’
সালাম মিয়ার কথা বলার সময় আর ধৈর্য নেই। রিকশার পেছন চাকা খুলে-টুলে পেরেশান একশা। পানখাওয়া কালো-লাল ঠোঁট ঝুলে আরও মোটা বেঢপ। সে একপলক তাকিয়ে চিনে রাখে শুধু। ফয়জুল হেহ্ হেহ্ শব্দে বুকের শ্বাস ঠেলে ঠেলে চাকায় বাতাস ভরে। কাজ শেষে একটি সিঁকি এগিয়ে দেয়। আজ ঘটনা অন্য। মনমেজাজ রেগেমেগে চড়চড়ি। কোন্ শালা যে সাইকেলের চাকায় আলপিন ফুটিয়েছে, একবার দেখা পেলে হয়; ট্রিপল এইচ ঘুসি বরাদ্দ। তাকে কি পাওয়া যায়? হারামজাদা জারুয়ার পয়দা। অবশেষে সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে আসতে হয় অনেক দূর। অবশ্য আজ চৌরঙ্গির এককোণায় চুপচাপ বিড়ি টানছিল সালাম মিয়া। সেই লিক খুঁজে পেতে আর সারাতে সারাতে এক-দেড় ঘণ্টা। তারপর সাইকেলে উঠে সব মনে পড়ে যায়। পকেটে তেমন টাকা-পয়সা নেই। বাবা টাকা-পয়সা খুব একটা দেয় না। কারণ ছেলে বিড়ি-সিগারেট ফুকবে। কোথাও তিনপাত্তি খেলবে। মেলায় গিয়ে হাউজিতে টাকা খোয়াবে। বাবার এই অবিশ্বাসের কারণ মাতৃকুল। মায়ের একমাত্র ভাই, উচ্ছন্নে যাওয়া মানুষ; সেভাবেই নাকি পৈতৃক সম্পত্তি শেষ করেছে। ইয়ার বন্ধু-বান্ধব, আনন্দ ফুর্তি, বেয়াড়া অভ্যেস; ইত্যাদি। কিসের মধ্যে কি…পান্তাভাতে ঘি। মামার সঙ্গে তার তুলনা! ফয়জুলের দোষ কোথায়? ছেলেমেয়ে বড় হলে তার অনেককিছু লাগে, হাতখরচা বা পকেটমানি; কিন্তু বাবা দেন না। অনেক আবেদনের পর যা জোটে তার পরিমাণ অল্প। নিজের দু-এক প্যাকেট বগুলা সিগারেট আর টুকিটাকি ব্যয়ে ঘাটতি বাজেট। সবচেয়ে বড় কথা যার সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন অথবা কখনো কখনো প্রতীক্ষার দেখা হয়, তাকে নিয়ে কোনো ক্যাফেতে বসে, একটি মিমি বা আইসক্রিম কিনে দেয়ার সাধ্য হয় না। এসব ভাবনার মধ্যে এই যে কিছুক্ষণ আগে যে রাগ দেখিয়ে এলো, অশ্রাব্য গালিগালাজ আর বাক্যধারা বর্ষণ; সমুদয় বিষয় বড় বিব্রত করে তোলে। আলম মামা কী ভেবে বসল কে জানে। তার বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে অজানা অপরাধীকে যা-তা, যা বলা ঠিক নয়। ফয়জুলের মুখ খারাপ। সার্ভিস ল্যাট্রিনের মাটির চাড়ি কিংবা টিন, মানুষের গুয়ে ভরতি হয়; সে সব উগড়ে দেয়। নিজের গায়ে ছড়িয়ে যায়। কেন এমন করল আজ? সে তো সহজে রাগে না। অনেক শান্ত স্থির মানুষ। ধৈর্যশীল। আজ কোন্ লঘুগুরু কারণে মাথা আউলা? কোনো উত্তর নেই। মানুষের মন বড় বিচিত্র। রংধনুর মতো রং পালটায়।

শেষ ফাল্গুনের দিন। সারারাত কাছে কোথাও বৃষ্টি ঝরেছে। সকাল থেকে হিম হিম বাতাস। ফয়জুল কলেজে দুপুর পর্যন্ত এদিক-ওদিক পায়চারি করে। অনেকে দলবেঁধে আড্ডায় গল্পগুজব করে। বাতাসে কথার কলরোল হাসির ফোয়ারা। তার তেমন বন্ধু নেই। যে কজনের সঙ্গে কমবেশি সখ্যতা, তারা আসেনি; কিংবা এসে চলে গেছে। কোনো ক্লাস হবে না। কলেজ ছাত্র পরিষদের কি কি দাবি আদায়ে ক্লাস বয়কটের ডাক। আজকাল এসবই হয়। গণতন্ত্র। তন্ত্র…মন্ত্র…গণতন্ত্র। সব ভুয়া। মূর্খের শাসন। তার ভালো লাগে না। অবশেষে সাইকেল স্ট্যান্ড গিয়ে মুখ আরও কালো। কেউ ঝামা ঘষে দিয়েছে যেমন জ্বলুনি হতে থাকে। কোন্ যে বেজন্মার কাজ…তাকে যুতমতো গাল পাড়ে। তার বাবা-মা, জন্ম সঠিক কি না, কোন্ পদ্ধতি বা আসনের প্রজনন কিছুই ছাড়ে না। কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে রোদ-ছায়ায় শরীর তাপায় আলম মামা। কলেজ পিওন। বুড়ো মানুষ। তার ঠোঁট দু-কান অবধি নড়ে উঠে। সেখান থেকেই কৌতুক জিজ্ঞাসা ছুড়ে দেয়।
‘কী হইল্ ব্যাটা ফয়জুল? কী ব্যাপার?’
‘মামা আপনি সারাদিন গার্ড থাকেন, কোন্ শালা কী করে দেখেন না? দেখতে পারেন না?’
‘কাক কাক দেখে রাখিম মামা? সবাই তো তোর মতো ছাত্র। কিন্তু ঘটনাখান কী কও তো?’
‘ঘটনা আবার কি? কোন্ মাদারচোদ্ সামনের চাকায় আলপিন মেরেছে। এখন বলেন তো দেড়-দুই মাইল রাস্তা কীভাবে যাই?’
‘এগুলা কুকুরচোদা মা-বাপের সন্তান বাপ…সামনের দোকান থাকি লিক সারাই নে।’
‘টাকা তো নাই মামা।’
‘চার টাকার ব্যাপার।’

সেই চারটি টাকা পকেটে নেই। শেষে বাধ্য হয়ে মামার কাছে হাত পাততে হয়। তারপর সাইকেল টেনে টেনে চৌরঙ্গি মোড় পর্যন্ত হেঁটে যেতে কত বিরক্তি! এমনিতেই সকাল থেকে বুকে তুষের আগুন জ্বলছে। একটি ভালো প্যান্ট-সার্ট নেই। সেই তিন বছর আগের পাজামা পরে এসেছে। সাদা রং জ্বলে-পুড়ে ঘোলা। পাঞ্জাবি নেই। একটি হাফহাতা সার্ট। সেও নীল-লাল-সাদা-কালো রঙের স্ট্রাইপ চেক। নিজেকে সারাক্ষণ ক্লাউনের মতো লাগে। এসবের মধ্যে অভাবিত এই ঘটনা। দুর্ঘটনা। অগত্যা সাইকেল হাতে ধরে এগোতেই মনে হলো, এ-ও সকলেই তার দিকে তাকিয়ে হাসছে; ভারি কৌতুক মজা! ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল। তার চোখ-মুখ সামনের চুপসানো চাকার মতো ফ্যাকাশে মলিন। এ ছাড়া আর কী করতে পারে? নিজেকে সামলানো বড় মুশকিল। কোথায় তুলে রাখে রাগ? চোখ আচমকা গরম হয়। বত্রিশ দাঁত কিড়মিড় করে। মাথায় আগুন জ্বলে ধিকধিক। অবশেষে গলির মুখে এসে মলির সঙ্গে দেখা। মন উন্মন। সব রাগ-বিরক্তি-হতাশা আগুনে জল পড়ে মুছে যায়। দুর্বল মানুষ রাগ করে, সে তেমন নয়, কখনো হবে না; এসব ভাবতে বেশ ভালো লাগে। সে কথা শেষে মলির দিকে পেছন ফিরে তাকালে, আশ্চর্য সেও তার চোখে চোখ রেখে হেসে ওঠে। মিঠেল দুষ্টুমি হাসি। একটু আশকারা। একেই বোধকরি বলে মনের টান নাকি কোইন্সিডেন্স? মলি আসলেই সুন্দর। মানুষজন শুধু শুধু হিংসেয় জ্বলে।

আজ পূর্ণিমা তিথি। নীল জোছনা। সিনেমা হল থেকে বেরিয়েই আকাশে উজ্জ্বল ঘনঘটা দেখে অভিভূত ফয়জুল। বিশেষ একটি রাত। শোনা যায় চাঁদের এমন বাহারি জোছনা নাকি এগারো বছরে একবার আসে। কোনো বিশেষ কারণ নিশ্চয়ই আছে। আজ রাতে বাঁশির সুরে সুরে অনেক আবাহন দূর আকাশে ছড়িয়ে দিতে মন চায়। সে চোকির নিচ ওলটপালট করে ফেলে আর কি! অবশেষে বাঁশি। মুড়ির টিন সরাতে আলগোছে গড়িয়ে পেছনে নেমে যায়। তখন অনেক রাত। পশ্চিম-দক্ষিণ আকাশে চাঁদ জেগে আছে। ফয়জুল প্রাচীর টপকে রাস্তায় নামে। দরজায় তালা। বাতাসে বাতাবি লেবু আর গন্ধরাজের মিলিত মাতাল সুবাস। মন’র ঢেউয়ে ভাঁজে ভাঁজে কোন্ অচেনার ডাক দেয়। কখনো শিহরন কখনো মন কেমন কেমন শূন্য হাহাকার। মন কি তবে মলির ডাকে সাড়া দিতে চায়? অথবা সেই ডুমুর গাছের ছায়া ছায়া অন্ধকার? দৃষ্টি সম্মুখে মরে যাওয়া ডোবা। সে বলে পদ্মপুকুর। এখনো আধমরা শুয়ে থাকে একাকী। একলা প্রহর। বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্ম, তারপর বর্ষার জলে টইটম্বুর হয়। ফ্যাকাশে-ম্লান শাপলা নতুন জীবনের আস্বাদনে জেগে ওঠে তখন। মানুষের জীবনও তো এমন। একসময় উদাসী ফাল্গুনে মন রঙে রঙে সাজে, গ্রীষ্মে মন পুড়ে যায়, অবশেষে বর্ষার জলে সবুজে সবুজে ময়ূরী নৃত্য। তার হলো কি? কোনোকিছু ঠিক করতে পারে না। গলির শেষপ্রান্ত পেরিয়ে গোরস্তানের ডুমুর গাছের নিচে বসে, অথচ কথা ছিল; কী কথা তাহার সাথে? ঝোপঝাড়ের জোনাকিরা ক্লান্ত ফিকে। ছায়াপথ একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে নক্ষত্রের বিনেসুতোর মালা গেঁথে রেখেছে। আলোর প্রভায় সব ভেসে যায়। কোথাও ছায়া ছায়া রহস্য ফিসফিস ডাকে। ফয়জুল বাঁশি বাজায়। আজ রাতে মন কোনো পরির ঘুম ভাঙাবে বলে। মলির কথা মনে নেই। বুশরার? সুরের মায়াজাল জোছনার পরতে পরতে কোন্ বেভুল ঠিকানা খুঁজে নিতে চায়। কোনো দিশা নেই। মন দিশেহারা মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে আপনার মাঝে বিলীন। কতক্ষণ? অনেকক্ষণ কি? সে জানে না, কোনো বোধ নেই; তারপর সহসা মনে হয়, কে যেন আলোর মৃদু ঝলকানি তুলে পদ্মপুকুরের ওপাশে নেমে এলো। অথবা সবকিছু মায়া-বিভ্রম। ব্যাখ্যাতীত কোনো জাদু, কিংবা কল্পনা; হ্যালুসিনেশন। কেউ তার ধ্যানভঙ্গ করতে চায়। এমনই নাকি হয়। যখন কেউ এক মাত্রা থেকে অন্য মাত্রায় যেতে চায়, প্রবেশপথ উন্মুক্ত হতে থাকে, নতুন ভুবনে আসতে চায়; তেমনই তো হয়। সে বাঁশি বাজায়। বাঁশি আপনমনে বেজে চলে। একসময় মনে হয়, তার কথায় বাঁশি বাজে না, বাঁশির মায়াটানে ভেসে যায় সে। কোথায় কোন্ জগতে কে জানে। সে জানে না।
তারপর সেই ছায়া সামনে এগিয়ে আসে। চাঁদের আলো ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। এখন শুধু রাত, নীল জোছনা, একটি ছায়া, আকাশ পরি আর সে। এমনই তো চেয়েছে। অনেক সাধনা করে তবে কারও ভাগ্যে মেলে। কারও সাধনায় জীবন পাতন। বাঁশির সুরে সুরে কত ভাবনা। মন-উন্মন স্বপ্ন ভেলা ভেসে যায়। ফয়জুল কি মোহাচ্ছন্ন হয়ে গেল? এই যে বসে আছে, অথবা বসেছিল, ডুমুর গাছের নিচে, চোখের সামনে পাণ্ডুর শাপলা-পদ্ম ছায়া ছায়া দৃশ্য অবয়ব, বাতাসে বাতাবি লেবু আর গন্ধরাজের সৌরভ, মাদক মৌতাত রাত; আকস্মিক একটি ডাকে ভেঙে যায়।
‘এই তোর কথা বে? তোর জন্যে বসে আছি, আর কৃষ্ণ সেজে বাঁশি বাজাস?’
‘কে কে তুমি? পরি? আকাশ থেকে নেমে এলে কখন?’
‘আ বে আমি, আমি রাধা…রাধা।’
ফয়জুলের মাথায় টোকা পড়ে। নেশা নেশা ঘুম ঘুম সম্মোহন সময়। সবকিছু বুঝে নিতে একটু তো দেরি হয়। বাঁশি থেমে গেছে। চারিদিক নিজ্ঝুম নিস্তব্ধ। কোথাও কোনো শব্দ নেই। উচ্চিংড়ে-ঘুগরে কিংবা রাতচরা পাখি কেউ কোনো আওয়াজ তোলে না। এবার…এবার বুঝতে পারে সে। মলির সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। সে যেতে পারেনি। এগারো বছর পর নীল জোছনা। এমন নিশুতি রাতে তো মলি নয়, কোনো পরি নেমে আসার কথা; আকাশপরি। সে ভালো করে চোখ রগড়ে নেয়। অস্বচ্ছ কুয়াশা রাতে ঘোর কি কাটে? পরি অথবা মলি…নাকি মলির ছদ্মবেশে কোনো পরি? সে যেই হোক, গোরস্তানের ভয় এড়িয়ে যে আসতে পারে, সে পরি; আকাশপরি। পরি তাকে বর দেবে। জীবনের ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়া সাধ-আহলাদ-সুখ কোনোকিছুই আর অপূরণীয় থাকবে না। তার মনের কোণায় বাঁশির সুর ঢেউদোলা তোলে। তারপর হাতে হাত। মধুর স্পর্শ। আহা কি কোমল! একটু কি ভেজা ভেজা লাগে? অদ্ভুত সুবাস আর নিশ্বাসের থিরথির কম্পন? এই রাতে ঠিক যেমন বয়ে যায় বসন্ত বাতাস।
তারপর দু-জন মানুষের ছায়া গলির শেষপ্রান্তে একটি ছাপরা ঘরে এসে দাঁড়ায়। কী কথা হয় তাদের মধ্যে কে জানে। রাতের মতো রহস্যময় ফিসফিস। তারা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে থাকে। জন্ম জন্মান্তরের সঙ্গী। তখন কেউ একজন একটু দূরে দু-চোখের বাতি জ্বালিয়ে অন্ধকার দেখে যায়। নীল জোছনার চাঁদ অনেক নিচে নেমে গেছে। অস্বচ্ছ ছায়া ছায়া আবছায়া রাত। একটি রাত ভোরকে ডাকে। সকালকে আহবান। তার চোখ কোনো সকাল দেখতে থাকে। যেভাবে ফয়জুল কোন্ মায়ায় সম্মোহিত অথবা জেনেবুঝে এগিয়ে যায়। এগিয়ে যায়।

রায়হান মিয়া ঠিক সে-সময়ে আলগোছে দরজার বাইরে শিকল তুলে দেয়।

আগের পর্ব পড়ূন

জীবনের যত জঞ্জাল ৪

বাবার স্মৃতিভ্রংশ। কাউকে চিনতে পারে, কারও দিকে ফ্যাল ফ্যাল উদাস দৃষ্টি। সেই চোখ কী বলে অথবা বলতে চায় সবটুকু হোক বা না হোক কিছু তার বোঝা যায়, বোঝা যায় না; কে জানে বুঝতে চায় না শ্যামল। কবিরাজের কাছে যায়। অনেক আশা-প্রত্যাশা। আবার যদি উঠে দাঁড়ায় বাবা।

‘আমাদের ওষুধে চিনি-গুড়-মধু, তোমার বাপের চলবে না। সদরে হাসপাতাল নিয়া যাও। ডাকতার দেখুক। মধুমেহ। হিসাব করি খাওয়া-দাওয়া, যত্ন-আত্তি দরকার। তারপর সব উপরঅলার ইচ্ছা।’
‘দেখেন কাকা দেখেন। মানুষটা উঠি দাঁড়াক। বাঁচি থাকুক।’
‘পরে কিছু কইতে পারবা না আবার, যে কবিরাজ অসুখ বাড়াই দিছে। একটা প্রলেপ দি। এইটা বাঁ-হাত কবজি থাকি গোড়া, বাঁ-পা উরু পর্যন্ত ল্যাপ দিবা। সারাদিন রাখবা। সকালে আবার ল্যাপ। আকন্দপাতার সেক। গরম পাইলে রগ ছাড়ি দিবে। তোমার বাপের বয়াস কত?’
‘কত আর…চল্লিশ-পঞ্চাশ।’
‘দুর ব্যাটা! সত্তর-বাহাত্তর মনে হয়। এখন তো যাওয়ার সময়। মন শক্ত করি রাখো।’

শ্যামল মুখের উপর থেকে গামছা সরিয়ে নিলে উজ্জ্বল-উদোম আকাশ দৃষ্টিতে হামলে পড়ে। আজকেও তেমন তাপদাহ। ধাঁ-ধাঁ চোখ ঝলসানো রোদ। তীব্র আলোর ঝলকানিতে কত কথা মনে পড়ে যায়। পশ্চিম আকাশের দূর কোণায় স্বপ্ন-মায়া-মরীচিকা। হালকা সাদা মেঘ ফুলরেণুর মতো জমা হয়। বৃষ্টি হবে কি হবে না কে জানে। আকাশ জীবন দেখে যায়…জীবন ডাকে।

‘কতদূর এয়েচি গো মোজাফর ভাই?’
‘এই তো মাঝাডাঙ্গা হাট পেরিয়ে এলাম।’
‘টের পানু না।’
‘তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে।’
‘হাট-বাজারের শোরে তো…।’
‘আজ হাটবার নয়।’
‘ও মঙ্গলবার তো হাট বসে না।’

টাঙা চলে। নেমে আসে সময়ের প্রান্তসীমা। শ্যামলের দিনকাল ছায়াছবি। সকালে বাবাকে নিমগাছের ছায়ায় রেখে এসেছে। লক্ষ্মী পোয়াতি মানুষ। ভারী পেট ঝুলে পড়েছে প্রায়। ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। সেও খাটে হাত দেয়। সেখানেই শুয়ে থাকে বাবা। তাকে পরিষ্কার করা, কাপড় ঠিক করে দেয়া, মুখে তুলে খাওয়ানো; লক্ষ্মী ধীরলয়ে সবটুকু করে। আজ নিমছায়ায় কাত হয়ে অদ্ভুত হাসে বাবা। নিশ্চুপ রহস্যময়। শ্যামল অনেকদিন পর তেমন মুখছবি দেখে। অথবা কে জানে চোয়ালভাঙা বাঁকামুখ মানুষ আনন্দ ধরে আনতে পারে কি না। তবু ভালো লাগে। বাবা আনন্দে থাক। মানুষ আপনমনে কত কথা বলে যায়, কেউ বোঝে কেউ বোঝে না; কেউ বলে বদ্ধ- পাগল। উন্মাদ। আপনমনে হাসে, কখনো কাঁদে; কখনো অন্যজগতের মানুষ। বাবা কোন্ পৃথিবীতে থাকে? তার স্মরণশক্তি নেই। আনন্দময় কথকথার মানুষ নিশ্চুপ নীরব আজ। প্রসারিত সম্মুখে ভাষাহীন চোখ ছড়িয়ে কী কথা যে বলতে চায় বোঝা যায় না। অথবা জেনে নিতে কাঙাল। শ্যামল কী বলে? বাবার স্মৃতিতে নির্জন-নিস্তব্ধ দুপুরে জল গড়িয়ে চলার শব্দ। বাতাসের কানে কানে ধানশিষের গান। বাবা সহজে খুঁজে পায়। শ্যামল কোনোদিন শোনেনি। কান পেতেও না।

সেই কথা দেড়-দুই মাস পর না বললে কি এমন ক্ষতি হতো কিংবা লাভ কী, কেউ ভেবে দেখে না; অন্তত লক্ষ্মী জানে না। বোঝার মতো মন নেই। আনমনা। অগ্রহায়ণের দিনশেষে সন্ধের আলোয় হিমবাতাসের নিশ্চুপ দোলা। তখনো পশ্চিম আকাশে গোধূলির রক্তিম আভা। শ্যামল চোখ তুলে তাকায়। মন হতচকিত-বিহ্বল। আকস্মিক নিষ্কম্প স্থির। লক্ষ্মী আবার বলে, –

‘বাপু দ মেনখান এনহিলোক কাথায় রড়লেদা। পুসটাউতেঞ আমজমকেদা।’
(বাপু কিন্তুক সেদিন কথা কয়ে উঠেছিল। মুই পষ্ট শুনিছু।)
‘চেত্! বার সেরমা অকয় হড় গুংড়া লেকায় তাহেকেনা, উনি দ চেকাতে কাথায় রড়া?’
(দূর! দু-বছর যে মানুষ বোবা হয়ে রইল, তার মুখে ক্যাংকরি কথা আসে?)
‘পুসটাউতেঞ আনজমা আকাদা। মেনখান আম দ বাঞ লাই আকাও আতমেয়া।’
(মুই পষ্ট শুনিছু। তুমাক কই নাই।)

শ্যামল তাকিয়ে থাকে। সম্মুখ দৃশ্যপট নাকি কোনো সুদূর অতীত থমকে দাঁড়ায়, রাতের ছায়া ধীরে ধীরে নেমে আসে; আঙিনায় জবাঝাড়ে মিইয়ে পড়ে দু-চারটি ফুল। এ কেমন কথা? পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় কথা কয় মানুষ? তখন দমকা বাতাসে কেঁপে ওঠে খড়ের গাদা শিখরদেশ। স্তূপ থেকে গড়িয়ে নেমে যায় দু-একটি ঝাড়ু।

‘লাহাতে দ বাঞ লাইয়াতমেয়া।’
(আগোত কইন্নাই তো।)
‘চমকাওলেন তাঁহেঁয়াঞ। পাতি আউগে বাং হেচলেনা। বাপু দ আর হোয়ে মেনকাদা। নংকাগে মিত্ধাও…বারধাও। ইনকাতে…।’
(মুই চমকি উঠিছিনু। বিশ্বাস হয় নাই। বাপু ফির কইলে। একবার…দুইবার। তারপর…।)

লক্ষ্মীর চোখ ছায়াম্লান। শ্যামল আলোছায়ায় তাকিয়ে অলৌকিক কোনো হদিশ হাতড়ায়। শেষযাত্রার সময় কথা বলে উঠেছিল বাবা। কী কথা? সেদিন টাঙা বিকেলের প্রান্তসীমায় বাঁশঝাড় পেরিয়ে আঙিনায় আসতে না আসতে দেখে মানুষজনের ভিড়। বাতাসে ভেসে থাকে চরম সত্য। পরম পূজ্য পিতা কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। কেউ মুখে জল দেয়ার সময় ধারেকাছে ছিল না। সেই কাহিনি জেগে থাকে। চোখে ভাসে। ভেসে ভেসে আবছা করে রাখে দৃষ্টি।
সেদিন নিমগাছের ছায়া-অন্ধকারে পড়ে থাকল খাট। কাঁথা-বালিশ। পুকুরপাড়ে কদমগাছের নিচে মানুষটিকে শোয়ানো হলো। পৃথিবীর সকল কাজ-কমর্, আনন্দ-বেদনা-হাসিকান্না, মান-অভিমান, অভিযোগ-দুর্যোগ সব জল ঢেলে ঢেলে ধুয়ে দিল কেউ। শ্যামল কী করে? মন হত-বিহ্বল বিবশ। বাবা তো মরেই গিয়েছিল। যে অশত্থ ছায়া তবু মাথার উপর, আলগোছে নির্মম সরে যায়। মধ্যরাতের আগে আগুন দেয়া হলো। এই তো জীবন। তারপর বেঁচে থাকা দিনকাল, অস্তিত্বের খেয়াপার; পুরোনো সবকিছু ফিকে হয়ে যায়। ফ্যাকাশে হতে থাকে। জীবনের একমাত্রা থেকে অন্যমাত্রায় যাত্রা করে। পথে নেমে যায়। তাই সেদিন যে কথা না উঠলেও কোনো ক্ষতি হতো না, কিংবা কী লাভ; কৌতূহল চমকে অপলক জেগে থাকে সে।

‘বাপু চেত্ কাথায় রড়লেত্ তাহেয়া লক্ষ্মী?’
(বাপু কী কথা কয়েছিল লক্ষ্মী?)
‘অহঞ মেনকায়া। বাঞ দিশায়েদা।’
(জানি না। মনে নাই কো।)
‘আম দ বাম লাই আ।’
(তুই আর কবিনে।)
‘রাংগাক্ আম নাহাক। নোয়া ঘাটা নিনদা নোয়াকো কাথা দ তাহে আচোয়ান। গাপা সেতাক্ ইঞ মেনা।’
(তুমি রাগ করবা। ভরা সন্ধ্যায় ইসব থাক। কাল বিহানে কবো।)
‘চেদাক্ ভূতকো সাসাপ আ? ইঞ কানগেচুঞ মিত্চেন লাটু ভূত দ।’
(ক্যান ভূত ধরবি? মুই তো বড় একখান ভূত!)
‘আম দ ভূত দ বাং, রাক্ষস কানাম। ইঞেম জমেঞা আম দ। হি হি হি!’
(তুমি ভূত না, রাক্ষস। মোক মারি কাটি খাবি। হি হি হি!)

শ্যামল হাসতে পারে না। লক্ষ্মীর আর দেরি নাই। এই মাসের কয়েকটি দিন, পেরিয়ে যাবে কি যাবে না; এসে পড়বে সে। লক্ষ্মী কোনো কোনো রাত আচমকা ঘুম থেকে উঠে বসে। দু-হাতে আগলে রাখে পেট। শ্যামলের ঘুমঘোর, ডানহাত এগিয়ে দেয়; আগত শিশুকে স্পর্শে হাতড়ায়। লক্ষ্মী দু-হাতে সরিয়ে দেয় তাকে। একরকম ছুঁড়ে দেয় সকল আকাঙ্ক্ষা মনোযোগ। শ্যামল ক্লান্ত-বিবশ। সারাদিন হাট-বাজার। শহরের রাস্তা-অলিগলি-বাসাবাড়ি হাঁকডাক চিৎকার। সন্ধেরাতে ফিরে আসে। লক্ষ্মীকে দেখে বড় মায়া হয়। এমন ভারী শরীরে কীভাবে কাজ করে যায়? শ্যামল কিছু করতে পারে না। মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকে? শ্যামলের দু-চোখে ঘুম নেই। ঘরের অন্ধকারে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। ব্যস্তত্রস্ত উদ্ভ্রান্ত।

‘চেত্ চেকায়দা? দারগিন ইঞ হহওয়া আ?’
(কী হইছে? দাই ডাকাম?)
‘বাঞ বাডায়া। আডি হাসো কানা। বাপু লেকা।’
(জানি না কো। বড্ড জ্বালায়। তুমার বাপুর মতো।)
‘বাপুগে চং-এ হিসুক্কানয়া। আহ্ ইঞরেন বাপু…বাপু।’
(বাপুই তো আসছে গো। আহ্ মোর বাপু…বাপু!)

শ্যামল উঠে বসে উদ্বাহু ডানা মেলে দেয়। লক্ষ্মীকে একবার জড়িয়ে ধরার অনন্ত সাধ। তার অনেক আদরের বউ। ভালবাসা জীবন। মায়াডোর বাঁধা স্বর্ণলতা-অস্তিত্ব। আদর করতে ইচ্ছে জাগে।

‘অচগক্ মেসে। বাঞ সাহেত দাড়ে আক্কানা।’
(সরি যাও তো…দম বন্ধ হই আসে।)
‘দারগিন বুডহিঞ হহ আয়া বাংখান।’
(দাইমাক ডাক দাও না হয়।)
‘আমরেন বাপু নিত দ বায় হিজুক্ আয়া।’
(তুমার বাপু এ্যালায় আসিবার নহায় গো।)

তখন সন্ধের কথা মনে আসে। আলাপ-প্রলাপ। ঘরের উপরচালা দিয়ে ভোরের আলো হাত-পা ছড়িয়ে নেমে আসে। এখন…ঠিক এখন বলা যায়। যায় কি? মন যে বড়ই উন্মন। কী কথা বলেছিল বাবা?

‘বাপু চেত্ কাথায় মেনলেদা?’
(বাপু কী কথা কয়েছিল?)
‘অক কাথা? তিনরে?’
(কোন্ কথা? কখন?’)
‘হলা আয়ুপ্এম মেন্লেত্। বাপু চালাক্ অক্তে চেত্ বাং-এ মেন্লেত্।’
(কাইল সাঁঝোত্ যে কলু, বাপু চলি যাবার সমায় কী বা কথা কয়েছিল।)
‘ও।’
(ও।)

ঘরের আলোছায়া দেয়ালে চকচকে দুটো চোখ। সেই দৃষ্টি কার? লক্ষ্মী নাকি বাবার? শ্যামলের মন-উন্মন বিভোল। আকস্মিক সকল স্মৃতি দিনকাল মন-ভাবনায় উদ্ভ্রান্ত-উদ্বেল জেগে ওঠে। লক্ষ্মী কথা বলে না কেন? কোনো গুপ্তধনের কথা বলে যায়নি তো বাবা? সেই যে বাবা প্রায়শ গল্প করে। আঙিনায় বসে, কদমতলায় পুকুরের পাড়; ফিসফিস কাহিনি। স্বপ্নকথন। এক বিঘত সোনার পুতুল বারান্দায় হেঁটে যায়। চমকে থমকে পেছনে দৃষ্টি রেখে ইশারায় ডাকে। তারপর আঙিনা জবাঝাড় পেরিয়ে কোথায় কোনখানে অদৃশ্য হতে থাকে। বাবা স্বপ্ন দেখে। ঘুমঘোরে হেঁটে চলে। পুতুল ডাকে। ডেকে যায়। বাবা দু-ধাপ এগিয়ে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে ধরবে। স্পর্শ লাগে। ধরতে ধরতে ধরা হয় না। স্বপ্ন ভেঙে যায়। যদি একবার হাতের মুঠোয় ধরা দেয়, অনেক অনেক ভুঁই হতো; হিমশীতল জলের পদ্মদিঘি। সেখানে স্বচ্ছ জলে মাছ সাঁতার কাটে। জলের ভাঁজে ভাঁজে সূর্যের আলোকচ্ছটা। মানুষের কল্পনা জীবনের স্বপ্ন। একটিই তো জীবন। এই সীমিত সময়ের কাহিনিতে কত আশা-আকাক্সক্ষা। সুখশান্তি। দুঃখ-বেদনা-অপমান। কেউ ভোলে কেউ ভোলে না। বুকের পাঁজরে গেঁথে নিয়ে বেঁচে থাকে। অস্তিত্বের সকল দায় কষ্ট শেষ হয় নদীর ঘাটে। কারও মুক্তি মেলে কারও মেলে না। বাতাসের ভাঁজে ভাঁজে শোনা যায় কত কথা। কত কান্না দীর্ঘশ্বাস। বাবা কী বলেছিল? লক্ষ্মী এবার বলুক। মানুষ মৃত্যুর আগে আগে যা বলে যায়, সবটুকু তার সত্য; কখনো অবাস্তব কল্পনা নয়।

‘লক্ষ্মী বাপু চেত্-এ মেনলেদা?’
(লক্ষ্মী কী কয়েছিল বাপু?)

সময় নিশ্চুপ স্তব্ধ। অপেক্ষার নদী কুলকুল বয়ে চলে। জল গড়িয়ে যায়। শ্যামলের দৃষ্টি আকুল। বাবা…বাবা সারাজীবন অপমান সইলে, কষ্ট করলে; সেই দায়ভার দিয়ে গেলে আমাকেও।

‘বাপু দ বাড়গে রেড়াক্-এ মেনলেদা। ইঞাক্ বাড়গে…ইঞাক্ হাসা। ইনা তায়োসে জাপিত্কেদা। মেত্দাক্ জরয়েনতায়া। মোচারেঞ দাক্ আদেয়া। মেনখান বায় নু লেদা…একালতেসে বাং।’
(বাপু ভুঁইয়ের কথা কয়েছিল। মোর ভুঁই…মোর ভুঁই। তারপর দু-চোখ বুজল। চোখের কোণা দিয়ে জল গড়িয়ে গেল। মুই মুখোত জল দিলাম। নিলনি…একফোঁটা নিলনি।)

শ্যামল বজ্রাহত বসে থাকে। একদা তাদের একখণ্ড জমি ছিল। বাবা লাঙল দেয়। জমি চাষে। সারাদিন ধুলো-জল-কাদা মেখে ঝকঝকে করে রাখে সীমা-পরিসীমা। ধানের চারাগাছ মাথা উঁচু চোখ মেলে বাতাসে দোল খায়। বাবার মুখছবিতে আনন্দঢেউ। বাতাসে কানপেতে শোনে ধানশিষের নবান গান। বড় ভালো লাগে। তারপর হায়! কেন এমন হলো? কোন্ নষ্ট মানুষেরা দখল করে নেয় সুখশান্তি-আনন্দ-বেঁচে থাকার সকল অস্তিত্ব? এই জঞ্জাল সরাবে কী করে?

দিনের আলো ফুটতে ফুটতে আইলের সরুপথে হেঁটে যায় শ্যামল। চেনা পথ বড় অচেনা লাগে। অথবা অচেনা রাস্তা চেনা হয়ে যায়। অনেক সহজ কিংবা দুর্মর কঠিন। চারিদিকে নতুন ধানের মউ মউ সুঘ্রাণ। বাতাসে স্বপ্নদোলা নবান্ন সংগীত। সে এবার বোধহয় কোনো সুর শোনে। নিজের জমি। বাপ-দাদার সম্পদ। সে ধীরে ধীরে সেখানে উঠে আসে। আইলের কোণায় কাঁধের গামছা রেখে হাতে নেয় কাস্তে। সোনালি ধান। রোদের আলোয় ঝিকমিক। গামছার লালরং থেকে উঁকি মারে দা’এর প্রান্তসীমা ক্ষুরধার। রোদের আলো থমকে দাঁড়ায়।
শ্যামল ধান কাটে। জমে উঠে ফসলের স্তূপ। দুপুরে আচমকা মেঘ-গর্জন হুংকার। মটরসাইকেল দূরে রেখে ছুটে আসে মাওলানা আজিজার। জাকির মাস্টার। আর কে কে? বন্যমোষের ছায়া। ধূসর-কালো অন্ধকার মেঘ। শ্যামল চমকে ওঠে। হাত থমকে যায়। একমুহূর্ত। কী ভেবে আবার সচল। সে থেমে থাকে না। আপনমনে ধান কাটে। অদ্ভুত মায়ার বর্ণিল নেশা। কোথাও কোনো দৃষ্টি নেই। আকস্মিক কী হয়, বুঝতে পারে না; শ্যামল দূরে ছিটকে পড়ে। কে যে কখন পেছন থেকে ধাক্কা দেয়, নাকি রোদপোড়া শক্ত বাঁশের আঘাত; দু-চোখে অন্ধকার পরদা নেমে আসে। কতক্ষণ? একটু সময়-মুহূর্তকাল অথবা যুগের পর যুগ অনন্তকাল। শ্যামলের তন্দ্রাঘোর। আচ্ছন্ন টলায়মান পদক্ষেপ। সে কিছু দেখতে পায় না। ধূসর-কালো মেঘের পটভূমিকায় এক বন্যমোষ গর্জন করে। বাতাসে থরথর করে অদ্ভুত নিনাদ। তারপর কি হলো? আকাশ দেখে। মানুষ দেখে। সেই গর্জন থেমে গেছে। স্তম্ভিত বাতাস। শ্যামলের দা থেকে চুইয়ে পড়ে রক্ত। মাওলানার কালো বুনোমোষ শরীর বেয়ে রক্ত-হলাহল নেমে যায়। জমির বুকে। পাতালের গভীরে। রক্ত…রক্তের রং লাল। সেখানে কোনো জাতপাত বোঝা যায় না।
স্টেশন পুলিশ ফাঁড়ি থেকে গাড়ি আসে। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। গ্রামের বাতাসে ঘটনা-দুর্ঘটনা খবর দুর্গন্ধের মতো ছড়িয়ে যায়। লক্ষ্মী আসতে পারেনি। পারে না। আঙিনায় ছুটে এসেছিল। কিন্তু যে জগতে আসে, আসছে; থামিয়ে রাখে। ধুলো-মাটিতে গড়াগড়ি। জবাঝাড়ে উজ্জ্বল বর্ণের ফুল ফুটেছে। কোত্থেকে দুটো চড়ুই এসে ডালে নাচতে থাকে। শ্যামল সড়কের উপর ধীরলয়ে হেঁটে যায়। অগ্রহায়ণের বাতাস বড় বর্ণচোরা। মৃদুমন্দ বয়ে চলে। কোথাও হয়তো বৃষ্টি হয়। কখনো হিম-হিম বাতাস স্পর্শ আবার তপ্তঢেউ। শ্যামল হেঁটে যায়। হাঁটতে থাকে। বটতলি মোড়ে পুলিশের গাড়ি। প্রগাঢ় নীলরং কালো দেখায়। লক্ষ্মী দূর থেকে তেমন দেখতে পায় কি না পায়, তার মাথা ঘোরে; দৃষ্টি ছলছল হত-বিহ্বল উদাস। পরনের শাড়ি-পেটিকোটে রক্তের ছোপ ছোপ লাল-কালশিটে দাগ। জীবন মানচিত্র ইতিহাস। অস্তিত্বের অধিকার। তার কোলে শিশু। সদ্যকাটা নাড়ি থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ে। তার দু-চোখ আজব এই পৃথিবীকে অসীম কৌতূহলে চিনে নিতে চায়। বোধোদয়ের অনন্ত জিগীষা। এদিক-ওদিক ধ্যানগম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ। তারপর সহসা আকাশ বিদীর্ণ করে চিৎকার ছুড়ে দেয়।

সেই মেঘ-গর্জন আকাশ দিগন্তরেখায় প্রতিধ্বনি স্ফুলিঙ্গ তুলতে থাকে।

(সমাপ্ত)

জীবনের যত জঞ্জাল ৩

জীবনের যত জঞ্জাল ৩

শ্যামল দেখে, বাবা অন্ধকার কোনো কোণায় হাতজোড় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আচমকা মাওলানার পায়ে হাত দিয়ে ফেলে। জোব্বা ছায়া দ্রুত সরে যায়। তারা ছোটজাত। কুলীন মানুষের পায়ে স্পর্শ রাখা গর্হিত অপরাধ। এরপর কখন কীভাবে কী হয়ে যায়, শ্যামল বুঝতে না বুঝতে দেখে; বাবা কুণ্ডলিত কোনো প্রাণির মতো নিচে বসে আছে। তার দু-চোখে অশ্রুধারা দিঘি অথবা রক্তজবা আগুনের হলকা। মটরসাইকেল আবার ভূমিকম্প তোলে। অন্ধকার থেকে অন্ধকারে বেরিয়ে যায়। শ্যামল কোনো ধুলোরেখা দেখতে পায় না। দেখা যায় না। তার শেখা প্রথম অপমান। বুকে দাগ কেটে জেগে ওঠা আগুনের শিখা। আগুন জ্বলে। অহর্নিশ জ্বালায়। জ্বলতে থাকে। কিছুতেই নেভে না। তারপর থেকে থেকে জানান দেয়, সে আছে, চলে যায়নি; একদিন বেরিয়ে পড়বে। দা’এর চকচকে ক্ষুরধার কোণায় কোণায় প্রতিফলিত প্রতিটি দিন এবং রাত নিশ্চুপ মহাকাব্যের বিষাদ শ্লোকগাঁথা। বাবার জন্য মন পোড়ে। সেই মানুষ সারাদিন সারারাত ঘরের কোণায়, আঙিনায় নিম বা মেহগনি ছায়ার নিচে পড়ে থাকে। ছানিঘোলা দৃষ্টিতে কাউকে চিনে নেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা। নাকি কোনো অভিযোগ বা বিচারহীনতার বিশুষ্ক অপমান প্রতিবাদ অবগাহন কে জানে। শ্যামলের দু-চোখ ভিজে আসে।
কোমরের সঙ্গে বেঁধে রাখা পুটলি। শ্যামলের অস্তিত্ব মূলধন। লক্ষ্মী বার বার সতর্ক করে দেয়, দেখেশুনে যেও। পথঘাট ভালো নয়। কেউ কিছু খেতে দিলে খেও না। শ্যামল কথা রেখেছে। কথা রাখে। রাস্তায় নেমে টাঙায় বসে কতবার সকলের অলক্ষ্যে টাকার স্পর্শ মনে নেই। এবার লুঙ্গির বাঁধন আলগা করে পুটলি খোলে। কাগজের কতগুলো নোট। তেল চিটচিটে ঘামে ভেজা স্যাঁতসেতে নোটের মধ্যে দু-একটি চকচকে রং ঝিলিক মারে। চোখে উৎকট লাগে। টাকা তবু টাকা। মন ভালো করে দেয়। মন ভালো হয়ে যায়। এই পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে কিছু কিছু মানুষের বিত্ত-বৈভব-ঐশ্বর্যের ঝকঝকে জীবনযাপন যেমন, ভালো লাগে, দু-চোখে মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকতে সাধ হয়; শ্যামলের ঘামভেজা ভাঙাচুরা বেঁচে থাকা ময়লা-আবর্জনা। সে চকচকে টাকা নয়। টাকার মূল্য আছে। তার নেই। টাকা হলো ঈশ্বর। তিনি এই বিশাল পৃথিবী চালান। ভালো-মন্দ ন্যায়-অন্যায় সকল কাজ সকল বিচার তার হাতে।
শ্যামল টাকা গোনে। এক-দুই-তিন। তাক ধিনা ধিন ধিন। মানুষ নাচে। টাকা নাচায়। টাকায় সুখ…মানুষের মুখ। সেই চেহারায় থাকে আনন্দ-হাসি। বেঁচে থাকা স্বর্গসুখ। শ্যামল নরকের কীট। অস্তিত্বের শবাধারে মৃত জঞ্জাল। তার দৃষ্টি বিষণ্ন-উদাস। সে টাকা মানুষের হাতে তুলে দেয়। বুড়োর দু-হাতের মুঠোয় সুখ-আনন্দ। শ্যামলের হাতে কী? উলুফুলের ঝাড়। কাশখড়ের আঁটি। সে শুকনো গাদা টাঙায় তোলে। তাকে যেতে হবে সাত ক্রোশ পথ। দূরের রাস্তা…ধুলোওড়া বালুরাঙা শূন্য তেপান্তর। মাথার উপর রোদ। গনগনে আগুন। সূর্য যেতে যেতে ডুবতে শুরু করে। আগুন নিভে যায়। ফেলে রাখে কাঠ-কয়লা-ছাই জীবন। শ্যামলের মনে আগুন নেভে না। কোনোদিন উসকে ওঠে। কত ছবি ভেসে যায়। আঙিনার উত্তর কোণায় নিমগাছের ছায়ায় শুয়ে থাকে বাবা। মেহগনির দু-একটি বৃন্তচ্যুত পাতা দড়ির খাটে সঙ্গে শুয়ে থাকে। অনেক দূরে শ্যালো-মেশিনের ধুক ধুক শব্দঢেউ। কারও ক্ষেতে নেমে যায় শীতল জলরাশি। বাবা কি ছানিঘোলা বোবা দৃষ্টি তুলে দেখে যায়? জলঢেউয়ের গান শুনে হারানো দিনের কোনো ছবি আঁকে? শ্যামল পারল না। সে পারে না। সেই দৃশ্যছবির মধ্যে অসহায় কোনো কান্না বাতাসের শব্দে মিশে যেতে যেতে দীর্ঘশ্বাস হয়। মনের দেয়ালে আছড়ে পড়ে। সে পালিয়ে আসে। তখন লক্ষ্মী উনুনের ধূসর ছাইয়ে তাকিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখে যায়। তাদের আগামী দিন। শ্যামলের দৃষ্টিতে কোনো আলোছায়া দৃশ্যছবি উঁকি মারে। একটি শিশু আঙিনায় হেঁটে বেড়ায়। তার কোমরের ডোরে সাতফোঁটা পাথরের মাদুলি রোদে ঝিলিক দেয়। শ্যামলের চোখে-মুখে। তার মন-উন্মন অস্থির। লক্ষ্মীর বেশি দেরি নেই।

‘চাচা এই দিনু। এর বেশি দিতে পারমু না বাপ। বেচাবিক্রি নাই।’
‘কি যে বুলছিস ব্যাটা। একেকটা ঝাড়ুর দাম আট-দশ ট্যাকা। তুর ট্যাকা হবে না ক্যানে?’
‘না গো চাচা ব্যবসাপাতি নাই। মানুষজন তো পিত্তিক হাটে ইসব কেনে না। জিলিপি-বুন্দিয়ার দোকান? চায়ের দোকান দিলি পরে কিছু ট্যাকা হয় বটে।’
‘তা তুই দিবার পারিস ভাতিজা। একটো দোকান দিয়ে ফ্যাল্।’
‘ছোটজাত গো। এই হাতে জল খাবি মানুষ? ওমহরা মোর ঝাড়ু কিনবি। বাখ্যান করবি। সেই ঝাড়ু দিয়া জঞ্জাল সরাবি।’

বুড়োর নিষ্পলক দৃষ্টি কি কেঁপে ওঠে? শ্যামল বুঝতে না বুঝতেই আচমকা দমকা বাতাস। আগুনতাপ ঢেউ। মাঠের ঘাস পোড়ে। ক্ষেতের পানি সরসর করে নিচে নেমে যায়। বাতাসের সঙ্গে উড়ে উড়ে মেঘে মেশে। কাদামাটি ফেটে ফেটে নিষ্প্রাণ চৌচির। ক্ষেতের বুকজমিনে কোনো ক্ষত অভিমান। মানুষের চেহারায় তেমন প্রত্নতাত্ত্বিক চিত্রপট। জাতপাতের কুলীন সীমারেখা। আগুন তাকে পোড়াতে পারে না। শ্যামল ঝাড়ুর কারিগর। একসময় ঘরামির কাজ ভালো শিখেছিল। পাঁচ আঙুলের ডগায় নতুন খড়ের আঁটি ধরে ধরে সুতলিতে বেঁধে গেছে মনোরম ছাউনি। সেই ছায়ায় মানুষ শুয়ে থাকে। আরামে ঘুমোয়। কারও জীবনের সকল দিনরাত সুখ-আদরে কেটে যায়। তখন কোনো জাত বিচার থাকে না। শ্যামল জমিতে ধানচারা রোপণ করে। নিড়ানি দেয়। আগাছা উপড়ে ফেলে। শক্তিশালী নষ্ট মানুষের দাপট উপড়ে ফেলতে পারল না। অবশেষে জমি ছেড়ে দিনমজুরের রাতদিন। ঘরামির কাজ। এখন সে ঝাড়ু তৈরি করে। সারাদিন একা একা উলুফুল আর কাশখড়ের নকশি গাঁথে। সুতলিতে চেপে চেপে বেঁধে দেয় মজবুত গিঁট। লক্ষ্মী কখনো সঙ্গ দেয়। সারাদিন খেটে খেটে তৈরী হয় ঝাড়ুর স্তূপ। তারপর হাট-বাজার, রাস্তায় রাস্তায় ফেরি; শহরের দোকানে দোকানে দেয়া। অলিগলি বাড়ি বাড়ি হাঁকডাক। মানুষ কেনে। তারা ঘরদোর আঙিনা পরিষ্কার রাখে। পরিচ্ছন্ন সুখী জীবন। শ্যামল সকল জঞ্জাল সরিয়ে ধরে রাখে নিজের জীবন কাহিনি। জীবনের যত জঞ্জাল। অভিমান চোখের ম্লানরেখায় সভ্যতার আদিগন্ত ভেদাভেদ, দুঃখ-কথা; প্রবঞ্চনা ইতিহাস।
তখন টাঙা ছুটে চলে। প্রলম্বিত দীর্ঘ পথ। কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? আকাশ দিগন্ত প্রান্ত-সীমানায়। দূর-অতিদূর তপ্ত বাতাসের দিশেহারা মায়াঘোর ছায়া। চোখ ঝিলমিল করে। অনেক উঁচু শূন্যে দু-একটি চিল ভেসে ভেসে ঘুরপাক খেতে থাকে। শ্যামল নিজেকে খড়ের স্তূপে এলিয়ে দেয়। কাঁধ থেকে গামছা টেনে চোখে-মুখে ছড়িয়ে রাখে।
শ্যাওড়াতলা তালদিঘির জলে ঝপাত করে নেমে পড়ে কেউ। চারপাশে ছলকে উঠে জলতরঙ্গ রংধনু। শ্যামল চমকে ওঠে। নিশ্চয়ই বড় কোনো রুই-কাতলা অথবা আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো গাছের ডালাপালা। সে হত-বিহ্বল স্তম্ভিত। মা-বাপের বারণ, দুপুর রোদে তালদিঘি ঘোরা যাবে না। সেখানের বাতাস ভালো নয়। বাতাসের ঢেউয়ে অপচ্ছায়া বিড়বিড় গুঞ্জন। শ্যামল কোনোদিন শোনেনি। সেদিন কি হলো? ভয় পেয়েছে? বাঁশঝাড়ের গহিন ছায়ায় সবে ফাঁদ পেতে রাখল। যদি একটি বালিহাঁস কিংবা বনবিড়াল ধরা দেয়। শ্যাওড়ার শাখায় শাখায় পাতার ফাঁকে প্রগাঢ় অন্ধকার। কেউ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। বাতাসের ঢেউয়ে অশরীরি ফিসফিস কী কথা বলে যায়। সে সত্যি চমকে ওঠে। দিঘির জলে নেচে চলে সূর্যের সাতরং। ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে চোখধাঁধানো স্ফুলিঙ্গ। নিজের মধ্যে মগ্ন আনমনা এক জলপরি জলের বুকে সাঁতার কাটে। কি মসৃণ কেটে যায় জলের পাতলা শাড়ি। কে…কে সেই মায়াবিনী? শ্যামলের ভয় ভয় দৃষ্টিতে কৌতূহল নেচে যায়। ফ্যাকাশে বিবর্ণ চেহারায় উৎসুক জিজ্ঞাসা। একটু হেঁটে এসে খুঁজে ফেরে জলের কিনার। জলঢেউ রেখা। কেউ তো নেই। তখনো বাতাস ধরে রাখে চঞ্চল জলের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। ঢেউয়ের বৃত্তাকার রেখায় প্রতিবিম্ব কারও। ক্রমশ সকল মায়াভ্রম ভেবে ঘুরে দাঁড়াতে যাবে, আড়ালের ছায়া থেকে কথা বলে ওঠে কেউ। সেই কি একজন, যে মানুষ কিংবা সে জানে না, কে সে; চকিতে ধরা দেয় দৃষ্টিরেখায়।

‘জাহানাক্ এম নামকেদায়া সেয়ান হড়?’
(কিছু পেলে গো সেয়ানা মানুষ?)
‘ওকোয়? ওকোয় রড়েদা?’
(কে? কে কথা কয়?)
‘ইঞকান গিয়াঞ য়া।’
(মুই গো মুই।)
‘ওকোয়? লক্ষ্মী! আম ননডে দ চেদাক্?’
(কে? লক্ষ্মী! তুই এখেনে ক্যানে?)
‘ননডেনাক দাক্ দ আডি রেয়াড়গেয়া।’
(এখেনের জল বড়ই শীতল।)
‘আমাক্ হড়ম রেয়াক্ সেংগেল দ আড়িচ্এনা?’
(তো শরীরের আগুন নিবেছে?)
‘মেন! আম দ চালাকমেয়া…বাবাহড়কো তাহেন খান চেকাতেঞ উমোক্ আ?’
(হুঁ! তুমি যাও গো…পুরুষমানুষ থাকলে নাইতে পারি?)
‘তালেপুখরি দ মেনখান ভাগে জায়গা দ বাংকানা।’
(তালপুকুর কিন্তুক জায়গা ভালো লয়।)
‘চেদাক্ ভূতকো সাসাপ আ?’
(ক্যান্ ভূতে ধরবি?)
‘ইঞগেঞ সাপ্মেয়া। অকয় হো বানুক্কোয়া।’
(মুই ধরিম। কাঁহো কুথি নাই কো।)
‘হি হি হি বদমাশ কানাম…শয়তান দ! চালাক্মে অকাতেম চালাক্আ।’
(হি হি হি বদমাশ…শয়তান! যাও য্যাঠে যাবার যাও।)
‘নক্অয়ইঞ দনকেদা! হু য়া ও!’
(এই দিনু ঝাপ। হু য়া ও!)
‘আম দ একাল বাম বুজহাউআ চালাক্মে দো আমাক্ কামিতে।’
(এই যা যা তুর কাজে চলি যা।)
‘নাসোয়াক্ ওনডংলেনমে নেলালমগেঞ।’
(একটু বেইরা না ক্যানে, তোক দ্যাঁখো।)
‘ছি ছি ছি চালাক্মেয়া সেয়ান হড় কানাম।’
(ছি ছি ছি তুমি যাও গো সেয়ানা মানুষ।)
‘মিতুম বাম নামলেদা? তালারে মিত্-বার চানদো মেনাক। ইনা তায়োম আঘন।’
(তুই নাম নিতি পারলিনি? মধ্যত্ দু-একটা মাস। তারপর আঘন।)
‘আয়মা মাহা মেনাক্আ য়া।’
(ম্যালা দিন পইড়ে রইচে গো।)
‘ওনাগেঞ মেনা…লক্ষ্মী ও লক্ষ্মী…।’
(তাই তো কই…লক্ষ্মী ও লক্ষ্মী…।)

দিঘির পাড়ে জল-নতমুখি ঝোপ কেঁপে ওঠে। কপট হাসির আশকারা ঝংকার। গামছা-লাল কোনো জলঢেউ অপাঙ্গে ঝিলিক মারে। শ্যামলের প্রবল ইচ্ছে, নির্জন-নিরিবিলি দুপুরের প্রান্তে জাপটে ধরে মৎস্যকন্যা। দিঘির মধ্যখানে, যেখানে ওই পাড়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের শিখরছায়া কেঁপে কেঁপে নেমে গেছে; তাকে টেনে যায়। সে পারে না। তার বুক কাঁপে। গলা শুকিয়ে যায়। আকাশের তপ্ত রোদে চোখে জ্বালা ধরে। দিঘির হিমশীতল স্পর্শ বাতাসে দোলা ছড়ায়। সে নিজেকে অথবা তাকে কম্পনের ভগ্নাংশ হতে বাঁচাতে রাস্তায় নেমে পড়ে। দূরে ইটভাটা। কালো চিমনি দিয়ে ধূসর-সাদা ধোঁয়া বেরোয়। নীল আকাশের বুকে ভেসে ভেসে দিগন্তে মেশে। সে পুবে ক্ষেতের সামনে গিয়ে কী ভেবে পেছন ফিরে তাকায়। নিষ্পলক খোঁজে কাউকে। আহা এক জলপরি কত অবলীলায় জলে মেতে উঠেছে। বাতাসে ভেসে আসে জলখেলার শব্দঢেউ।
এমন সেই আবেগ-ভালবাসার দিনক্ষণ কত সহজে ফুরিয়ে যায়। তখন লক্ষ্মী ঘরে এসেছে। কত রাত মৌন-মুখর-শব্দমালায় কেটে গেল। নিরিবিলি নির্ঘুম শব্দকথন। জোছনারাতে কত সময় এসে দাঁড়িয়েছে কদমের ছায়ায়। সে হলো তেপান্তর জাদু-কাহিনি। জীবনকে নতুন করে দেখা। নতুন আলোয় পাওয়া। একজন আর একজনকে বুঝে নেয়ার সময়কাল। লক্ষ্মীর মা-বাবা সকলে রাজশাহি চলে গেছে। শ্যামলের মা নেই। বাবা একলা মানুষ খুব দ্রুত বুড়ো হয়ে গেল। সারাদিন কোথায় থাকে, কোথায় যায়, কোথায় ঘোরে; শ্যামল জানে অথবা জানে না। সে কী করে? দু-দণ্ড সময় নিজের জন্য নেই। কাকভোরে চলে যায়। মানুষের কাজ করে। ফিরে আসতে আসতে সন্ধেরাত। তারপর খুঁজে ফেরা। বাপ গেল কই? কোনোদিন নদীর পাড়, বাঁশঝাড়ের অন্ধকার ছায়ায়; অথবা সেখানে যেখানে মানুষ ফিরে ফিরে আসে। বাবাকে কোন্ মায়া টানে! কেন? এত মায়া বাড়িয়ে লাভ কি? যা চলে যায়, চলে যেতে দাও; কোনোকিছুই তো ধরে রাখা যায় না। সে আলগোছে বাবার কাঁধে হাত রাখে। মানুষ উদাস-বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ায়। শ্যামল দেখে, একখণ্ড জমি, শস্যক্ষেত; একদিন তাদের ছিল। সেই বাবা আকস্মিক বিছানায় পড়ে গেছে। সেদিন রাতদুপুরে চিৎকার আর্তনাদ। শ্যামল ছুটে গিয়ে দেখে, বাবা মেঝেতে পড়ে অস্থির লুটোয়। মেঝেয় জলকাদা শুকিয়ে গেছে প্রায়। আবদ্ধ হালকা ঝাঁজগন্ধ। অন্ধকার ছায়ায় তার বাঁ-চোয়াল ঝুলে গিয়ে মুখ-চোখ বাঁকা অদ্ভুত লাগে। দরজায় দাঁড়িয়ে অবাক-বিষ্মিত লক্ষ্মী। ভয়ার্ত নিশ্চুপ।
(চলমান)

আগের পর্ব

জীবনের যত জঞ্জাল ২

নদী। গ্রীষ্মের দিনকালে শুকিয়ে যাওয়া নালা। বর্ষায় জলের স্রোত। প্রমত্তা ঢেউ। নীল আকাশে তুষার মেঘের আনাগোনায় দু-পাড়ে লম্বা ঘাস জেগে ওঠে। বিস্তীর্ণ কাশবনে নতুন জীবনের দৃশ্যছবি। কখনো হালকা মৃদু বাতাসে রেণু রেণু স্বপ্ন-ফোয়ারা দোল খায়। সেই শুভ্র কাশবন ছায়ায় নিজেকে সঁপে দিতে কত না মন-উন্মন আবেশ। সেখান থেকে খানিক দূর উঁচুতে উলুফুলের সারি। মানুষজন তুলে আনে। ঝাড়ু তৈরি করে। ময়লা-ধুলো সব পরিষ্কার। শ্যামল কত দিন তুলে এনেছে। মা অবসরে বসে সুতলিতে বাঁধে। ঘরদোর ঝাড়ু হয়। ঝকঝক করে ওঠে গোবর-জলে নিকোনো আঙিনা। শ্যামল তখন শিখে নেয় এই কাজ। আজ সেই নদী তেমন নেই। আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টি-বন্যায় দু-কুল ছাপিয়ে বিশাল জলরাশি ক্ষেতের ফসল-পুকুরের মাছ ভাসিয়ে দেয়া নদী হারিয়ে গেছে। এখন সীমানার ওই পাড়ে বিশাল বাঁধ। জল বেঁধে রাখা। এ প্রান্তের নদী শুকিয়ে নিশ্চিহ্ন প্রায়। হারিয়ে গেছে কাশবন। ঘাস আর উলুবনের শীতল মেঘ মেঘ ছায়া। এখানে রুক্ষ বালিয়াড়ি। নীল-ধূসর প্রান্তর। কখনো মাথা উঁচু জেগে থাকে শুকনো শ্যাওলা-সোলাকাঠি। নদীর উঁচু পাড়। দু-চার কদম হেঁটে এলে চৌচির ক্ষেত। চেনা-অচেনা গাছগাছালি পাড়ের জঙ্গলে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো বাতাসে দোল খায়। তার ফাঁকে ফাঁকে শিমুল-ডুমুরের শাখায় বিষণ্ন-নিস্তব্ধ মাছরাঙা। নদীতে জল নেই। মাছ উধাও। রোদ্রতপ্ত দিনকাল। ভিনদেশি বাঁধ মানব সভ্যতার দগদগে ক্ষত হয়ে মনের কোণায় জেগে থাকে। মানুষ ভুলে যায় হারানো সময়ের গ্রামছবি। শ্যামল ভুলে যায়নি। ভুলে যায় না। অনেক কথা অনেক দিনক্ষণ মনের কোণায় জ্বলজ্বল করে। কখনো মন বিষাদ। কখনো…না সময়ে অনেককিছু বদলে যায়। সেও তো অনেক বদলে গেল।
কোনো এক পুর্ণিমা তিথিতে জীবনে লক্ষ্মী এলো। সেই স্বপ্নের আঙিনায় বিনিদ্র জোছনা রাত। মন তবু বিষাদ হাতড়ে আনে। প্রায় বছর গড়িয়ে গেল মা নেই। অনেক সাধ ছিল। শ্যামলের বউকে নিজ হাতে সাজাবে। ঝাঁকড়া চুলে ছড়িয়ে দেবে সুবাসিত বনজ তেল। বুকে জড়িয়ে আদর। লক্ষ্মী দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মা কোনো কোনোদিন হাত টেনে ঘরে নিয়ে আসে। পাশাপাশি দুটো বাড়ির আঙিনা। এ-প্রান্তে ফুল ফুটলে বাতাস ধেয়ে সৌরভ ও-প্রান্তে ভেসে বেড়ায়। মানুষজন আপন হতে দেরি হয় না। মা হাসিখুশি। লক্ষ্মীর মুখছবিতে সলাজ কৌতুক। চোখের পাতায় থিরথির খুশির কাঁপন। শ্যামল অপাঙ্গে তাকায়। তার চোখে-মুখেও যে শেষ-বিকেলের অনুরাগ। স্বপ্নের মায়াখেলা। দু-জন মানুষ কত সহজে খুব কাছের হয়ে যায়। একজন আরেকজনকে নিজের করে নিতে জানে। তেমনভাবে মনের আড়ালে ছোট ছোট স্বপ্ন ফুল হয়ে ফোটে। বাতাসে দোল খায়। নিজের সঙ্গে কথা বলে। স্বপ্নকথন। এভাবেই সবকিছু পাকাপোক্ত করার সময় এসে দাঁড়ায়। সে-সময় আকস্মিক হাত থেকে খসে পড়ে সুবর্ণ সন্ধে। মা চলে গেল।
সেদিন সন্ধেবেলা স্নান সেরে জ্বরে পড়ে মা। সংসারের কত শত কাজ। ভোর-সকাল থেকে শুরু হয়ে চলতে থাকে সারাদিন। দিনক্ষণ-সময়-মুহূর্ত কাজ আর কাজ। বাতাসের বেগে ছুটে চলা। তখন কার্তিকের শেষ। ঘরে ঘরে অভাব-অভিযোগ যাই-যাই করে যেতে চায় না। শ্যামলের কানামাছি আলোছায়া আঙিনা-ঘরে কি মজা পেয়েছে, পাহাড়ের মতো হাতি বসে থাকে; নড়ে না। সে বাবার সঙ্গে কাকভোরে বেরিয়ে যায়। মানুষজন ঘুগরাতলি বটগাছের নিচে বসে থাকে। তাদের বিস্তীর্ণ অপেক্ষা। তীর্থের কাক। যদি কেউ একজন ডেকে নেয়। কাজ জোটে। কাজ পাওয়া যায় না। সেদিন জীবনের প্রয়োজনে কাজের সন্ধানে আলাদা হয়। বাবা পথে নেমে পেছন ফিরে বলে, –

‘কামিম ঞাম বাম ঞাম ওড়াক্গে চালাক্মে বা। ইঞ দ নাহুমমিঞ রুয়াড়া’
(তুই তালি কাজ পাই-না-পাই ঘরোত্ চলি যাবু বা। মুই সাঁঝোত চলি আসিম।)
‘চালাক্মে বাপু ঞিত্ দ। সনতরাকায় তাহেনমে।’
(হয় বাপু তুই চলি যা হেনে। দেখিশুনি থাকিবু।)
‘আর আঞ্জামমে বা, চালাওকাতে জমমে। আম গগো তাংঘিয়েম।’
(হয় হয়…আর শোনেক বা, তুই খায়া নিবু। তোর মাওক দেখিস।)

শ্যামল মাথা নাড়ে। এরপর গামছায় জড়ানো দা বের করে দেখে নেয়। ঘরামির কাজ মোটামুটি জানা হয়ে গেছে। আজকাল কামকাজ নাই। নিস্তব্ধ অবসর। অলস দিনকাল মন্থর হাতির মতো এগোয় কি না এগোয় না বড় অধৈর্য অসহায়। সে অপসৃয়মান মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে। কত দ্রুত বুড়ো হয়ে গেছে বাবা। কত কষ্ট জমা হলে মানুষের দৃষ্টি হলুদ-ফ্যাকাশে হয়ে যায়? শ্যামলের পরিমাপ করার ক্ষমতা নেই। বিবিধ অসুখে ক্লান্ত-ন্যুব্জ সৈনিক। তবু কোনোদিন সামান্য কোনো কষ্টের কথা উচ্চারণ করে না। শ্যামল শোনেনি। সে তবু দেখে। ওই দু-চোখের গভীরে কত নোনাজল ঢেউ হয়ে শুকিয়ে গেছে বুঝে নেয়। শুকনো মরানদী। সেদিন মাওলানার আঙিনা থেকে ব্যর্থ ফিরে আসে। রাত অন্ধকার। জীবন আর অস্তিত্ব নেমে যায় কোনো অচেনা নিকষ অন্ধকার সুড়ঙ্গে। সেখানে কোনো আলো নেই। শ্যামল রাতের দেয়ালে তাকিয়ে থাকে। এভাবে কতক্ষণ অপলক। কোথাও ডুবে যায়। তখন দূরাগত সংগীতের মতো ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমির কথোপকথন ভেসে আসে। বাতাসে অস্ফুট কেঁপে বেড়ায়। কোন্ রূপকথার দেশ, স্বপ্নের ভুবন থেকে কারা বলে যায় কোন্ গল্প-কাহিনি? শ্যামলের ঘরে আবছায়া রাতের দেয়াল। তন্দ্রাঘোর ভাসাভাসা বিষণ্ন কোনো গুনগুন স্তব। প্রলম্বিত মহাকাব্য উপলব্ধ হতে থাকে। মন-উন্মন-বিভোল।

‘শ্যামলা আচ গগো ইঞ্চাক দ থোরা হামাতিঞ। বাবা-গড়ম বাবা তাকোকো এর ইরকেদা। ইঞ হোঞ ওনকায়েদা। ওকাখোন চেত্ চেকায়না। ওনা হাসা বাংমা ইঞাক আর বাংকানা। কেত্ ইঞ চেকায়া। বোহক্গে বায় কামিয়েদা।’
(শ্যামলার মা, মোর একখান ভুঁই। বাপ-দাদো আবাদ করিছে। মুই করো। কুসথাকি কি হয়া গেইল, এ্যালা ওই ভুঁই নাকি মোর নাহায়। মুই কী করো! মোর মাথা কাজ করে না।)
‘মেম্বার আর অকোয়কো ঠেনেম চালাও বাড়ালেনা। চেতকো মেনকেদা?’
(কদিন যে মেম্বার আর কার কার গোড়ত্ ছুটি গেইলেন। ওমহরা কী কছে?)
‘জরিপ অকতে নিতুন বাং রাকাপ অকানা।’
(জরিপের সমায় নাম উঠে নাই।)
‘কাগাদ বাম উদুক্ আত্কোয়া?’
(কাগজপত্র দেখাইলেন না?)
‘অনাকো দ মেনাক্ নাঁহি। লাড়হাই সেরমা অকায়েন বাং চেকাবোন মেনকেয়া।’
(ওইলা ফির আছে নাকি! যুদ্ধত্ কুঠি চলি গেইছে কাঁয় জানে।)
‘এনডেখান হাসা দ আর বামা ঞামা?’
(তাইলে এ্যালায় ভুঁই পাইমেন না?)
‘চেত্গে বাঞ বাডায়া…বাঞ বাডায়া।’
(মুই কিচ্ছু জানো না…জানো না।)

জানা-অজানার রহস্যঘেরা জিজ্ঞাসা কিংবা হতাশ যবনিকা সীমাহীন রাতে দোল খায়। রাত-অন্ধকার দেয়ালে ফেনিল ঢেউ তুলে তুলে দিগন্তে মিশতে থাকে। শ্যামলের দু-চোখ ভারী। তার কিশোর হাতে কোনো শক্তি নেই। কোনো জাদুমন্ত্র? রূপকথার বিষণ্ন স্তবগাঁথা শুনতে শুনতে কল্পনার দেয়াল ধ্বসে পড়ে। সে কি উঠে দাঁড়ায়? সেই ছায়ান্ধকার নিশ্চুপ কোণায় ছুটে চলে? শান দিয়ে রাখা দা’এর কোপে নামিয়ে ফেলে বিশাল কোনো মুণ্ডু? চুল-দাড়ি-পাগড়ির তলায় ঘিনঘিন করে ওঠে পান-জরদার মাখামাখি বিকট গন্ধ? সে সকল ছিল অসীম কল্পনার অভীপ্সা। দুর্দান্ত মোহমায়া। তার ঘুম মিলিয়ে যায়। আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে আঙিনায় নেমে আসে।
হিম-কুয়াশা রাতে শিশির পড়ে কি পড়ে না, মধ্য-আকাশে অস্বচ্ছ-ঘোলা চাঁদ, তেমন কোনো তারা নেই; দেখা যায় না। দেয়ালের ওপাশে সারারাত জেগে থাকা নিশিপুষ্পাদল সুবাস জুড়িয়ে ঘুমোতে তোড়জোর ব্যস্ত। আঙিনার পুবপ্রান্তে দরজার হুড়কো খোলা। শ্যামল রাস্তায় বেরিয়ে আসে। বাবা আবার সেখানে গিয়েছে। মৃত্তিকার বড় মায়া। দূরে-বহুদূরে কোনো ছায়া আবছায়া লাগে। ওখানে একখণ্ড জমি ছিল তাদের। এখন নেই। কে দাঁড়িয়ে থাকে তার প্রান্তসীমায়? রহস্যময় ভূত-প্রেতের ছায়ামূর্তি। প্রাগৈতিহাসিক প্রচ্ছায়া। শ্যামলের স্বপ্ন-ঘুমঘোর। পায়ে পায়ে এগোয়। কয়েকটি বাঁক পেরিয়ে নাতিদীর্ঘ পথ। সেই ছায়া নড়ে না। নিথর নিশ্চুপ কোনো বৃক্ষ দাঁড়িয়ে থাকে। সে কিছু দেখে। দেখে যায় আকাশ। কোথায় ঈশ্বর অথবা তার দুনিয়া? সতর্ক শ্রুতিতে কোনোকিছু অনুধাবনের চেষ্টা। স্পর্শ ব্যাকুল। আচমকা দমকা বাতাসে কেঁপে ওঠে ছায়া চাদর।

‘বাপু ননডে রাবাংরে চেত্এম চেকায়দা? দেলা, ওড়াক দেলা।’
(বাপু তুই এ্যাঠে জাড়োত্ কী করোছি? চল ঘরোত্ চল।)
‘থিরক্মে শ্যামলা। আনজমিদাঞ, হোড়ো গেলেরএ লবান রেয়াক সেরেঞ।’
(চুপ কর শ্যামলা। শোনা পাছি, ধানের শিষে নবানের গান।)
‘ইঞ দ কেত্গে বাঞ আনজমেদা। মেদেলা রাবাংমেয়া।’
(মুই কিছু শোনা পাও না। চলেক, জাড় লাগিবি।)
‘লুতুর কিড়বিত্কাতে আনজম হোয়েক আ বা। হয়রেগে সেরেঞ দ আনজমক্ আ।’
(কান পাতি শোনা লাগে বা। বাতাসের ঢেউ। ঢেউয়ের মুখোত ঝিরঝির গান।)
‘আবো দ চেত্ রেয়াক লবান তাবো। মেদেলা ওড়াক মেদেলা।’
(হামাগের নবান নাই বাপু। ঘরোত্ চল…চলেক।)
‘হায়রে বাড়গে তিঞ…দায়াগে হাসা তিঞ।’
(মোর ভুঁই বা…মোর মাটি।)

শ্যামল কী বলে? একসময় এই জমি তাদের ছিল। বাপ-ব্যাটা দু-জনে হাল জুড়েছে। তরতর করে বেড়ে উঠেছে ধান। কার্তিকের শেষে আনন্দ বুকে নিয়ে ঘরে তুলেছে শস্য। এখন কিছু নেই। প্রিয় কিছু হারিয়ে যাওয়ার বেদনা বড় নিশ্চুপ। অনেক গভীর। বুকের গহিনে তোলপাড় তোলে। তাকে মানিয়ে নিতে হয়। অস্তিত্বের প্রয়োজনে ভুলে যেতে হয়। এই হলো যুদ্ধ। সে মানুষটির হাত ধরে টেনে টেনে ফিরে যায়। ফিরে আসে। পড়ে থাকে কিছু শুকনো আবেগ…অশ্রুভেজা ভালবাসা ছলছল দৃষ্টির দৃশ্যছবি। সেই জমি ফিরে পাওয়া গেল না।
এক সন্ধেয় গোঁ-গোঁ ভূমিকম্প নিনাদ তুলে, আকাশে ধুলো উড়িয়ে কোনো অন্ধকার ছায়া এসে দাঁড়ায়। পুব-আকাশে জেগে উঠেছে দু-একটি তারা। অনেক দূর থেকে মিটমিট হাসে। তারা চমকে ওঠে জলদগম্ভীর হুংকারে।

‘নীলকান্ত…ও বাহে নীলকান্ত, বাড়িত আছি?’

শ্যামল ধড়পড় করে বেরোয়। বাবা দাঁড়িয়ে আছে। মাওলানা আজিজার মণ্ডলের জোব্বা পোশাক। বোবায় ধরা মানুষের মতো অসহায় বাবার পাশে দানব মনে হয়। জবাঝাড়ের একপাশে মটরসাইকেল স্ট্যান্ড করে রাখা। একজন মানুষ নিশ্চুপ মূর্তির মতো নিশ্চল তাকিয়ে থাকে। শান্ত-গভীর দু-চোখ অন্ধকারে চকচক ঝলসে ওঠে। জাকির মাস্টার। শ্যামল চেনে।

‘বাহে নীলকান্ত, একখান কথা কবার তনে আসিবা হইল। কথা হইল্ কি…।’
‘হয় বাবু।’
‘তুই জাকির মাস্টারের জমিত যায় কী করিস? তোক নিড়ানি দিবার কাঁয় কইছে? যাঁয় আবাদ করোছে তাঁয় দেখিবি। তোর মাথাব্যথা ক্যানে?’
‘ভুঁইখান তো…।’
‘তুই কি এ্যালাও জমির মালিক আছি? জাকির মাস্টার আবাদ করে। তোর ফলনা চুলকায় ক্যান আঁ?’
‘ওই ভুঁইকোনা মোর বাপ-দাদো দিয়া গেইছে বাবু। তোমহরা ক্যাংকরি কি করিছেন, এ্যালায় কছেন ভুঁই মোর নাহায়।’
‘তুই যি মেম্বার-চেয়ারম্যানের গোড়ত্ দৌড়াদৌড়ি করলু, তো ওরা কী কইল? ফলনা-টেসকু দিল্ তো? শোনেক ওই জমি হইল খাস। তোর দাদো নিয়া খাছিল। ম্যালা বছরের খাজনা-ট্যাক্স বাকি। সরকার সেখন নিজের ঘরোত্ নিছে। মুই নিলাম ডাক দিয়া জমি বন্দোবস্ত নিছু। তুই জমির শোক ভুলিবার পারেছু না? শোনেক মুই তোক সাবধান করি দেছি, আর ককখনো জমির ধারেকাছোত যেন না দেখঁ; নাইলে মোর থাকি খারাপ কাঁহো হবি না। বুঝিলু?’
‘মোর জমি মোর ভুঁই। বাবু তোমহরা ফেরত দেন। ক্যাংকাবা করি নিছেন। মুই গরিব মানুষ ভুঁইকোনা ফেরত দিলি বাঁচি থাকনু হয়।’
‘শালা কয় কি রে!’

(চলমান)

জীবনের যত জঞ্জাল

বুড়ো মানুষ এত মতলববাজ! শ্যামলের জানা ছিল না। তার বয়স আঠাশ। দুনিয়াদারির অনেককিছু দেখার-জানার বাকি। সে দু-চোখের পাতা ছোট করে সামনে পিটপিট দৃষ্টি রাখে। রোদের তাপ বাড়ছে। তীব্র আলোয় সবকিছু কেমন বিদগ্ধ…ঝাঁ-ঝাঁ। এসবের মধ্যে জব্বার মিয়ার অনেক ধৈর্য। মানুষটি একটুও ঘামে না। শীতল মেজাজে জাল বোনে। বাঁশের খুঁটির উপর থেকে ঝুলে আছে বর্ণিল সুতোর কারুকাজ। নকশি জাল। তার মনে কোন্ কল্পনার বুনন কে জানে। শ্যামলের স্বপ্ন বোনা। অনেক আশা নিয়ে এসেছে। বরষার আগে আগে সব কাজ গুছিয়ে নিতে পারলে একটু নিশ্চিত হতে পারে। হাতে দুটো পয়সা থাকে। এদিকে লক্ষ্মীর সময় নেই। কোন্দিন যে ব্যথা ওঠে। আধো ঘুম-জাগরণে স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন ভাবনা-চিন্তায় কেটে যায় রাত।
রাস্তার ওপারে স’ মিল। অনেকদিন ধরে মেশিন বন্ধ। পরিত্যক্ত। চালু আছে জ্বালানি খড়ির দোকান। চারপাশে খড়ির স্তূপ। বাতাসে কাঁচা আমকাঠের শুকনো গন্ধ। কয়েকটি কাঠের গুঁড়ি এলোমেলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। সে-সবের পেছনে চা-বিস্কুটের টং-দোকান। মুড়ি-ঘুগনিও পাওয়া যায়। দোকানের কোনো ফাঁকফোকর গলিয়ে আসা পানি ভেসে ভেসে কাদাজল। কচুর দু-একটি লতা গজিয়ে উঠেছে। কখনো বাতাসে দোল খায়। আরও দক্ষিণে দেয়ালঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ইপিল-ইপিল গাছের ছায়া। তীব্র রোদে ম্লান। সেখানে একপাশে দু-একটি টাঙা। ঘোড়াদুটোকে বড় অসহায় লাগে। চোখে চামড়ার মোটা ঠুলি অন্ধপ্রায়। অন্যের বোঝা টানাই জীবনের ভাগ্যলিপি। এই বেঁচে থাকা। শ্যামলের দু-চোখ কখনো ঝাপসা। সেও সারাজীবন জীবনের বোঝা টেনে বেড়ায়। শান্তি পেল না। এদিক-ওদিক ছুটোছুটি ব্যস্ততা অস্থির পথরেখা ধরে হেঁটে যায়। দু-দ- বিশ্রাম নেই। এখন বসে আছে বুড়োর দোকানে। কেনাবেচা দরদাম শেষে যা হয় এক সমাধান হলে স্বস্তি আসে। গুমট গরমে ভালো লাগে না।

‘না ভাতিজা, ছেইদিন আর লাইখো। নদি শুকায়ে ছিল তখুন পেতি। এখুন বান-বন্যা সব ভেইসে লিয়েছে। যাওবা পাওয়া যায়, ছালার সাপখোপ-কাঁকড়া-বিছে কি কুন্ঠে ঘাপটি মেইরে আছে; বিপদ মানে মহাবিপদ। তার উপহ্র আবার শেয়াল-কুকুর হেইগে…কি বুলব? দুর্গন্ধ-দুর্গন্ধ। ওয়াক্ থুহ্! কি বলে কাপুড়ে গায়ে মাখামাখি। না না দুইশর কমে পারব লাখো।’
‘বড় বিপদ হলি গো চাচা। বাজার মন্দা। হাতে তেমন ট্যাকাও নাই।’
‘পরে দিবি। এখুন না থাকলে পরে দিবি। এক সপ্তাহ দু-সপ্তাহ। আমি কি ধারবাকি দিই না?…তো কী কহছিস, মাল টানমো?

বুড়ো কাঁচাপাকা-ধূসর-ঝাঁকড়া চুলে হাত বুলোয়। অন্য জেলার মানুষ। কথায় অদ্ভুত টান। শ্যামলের বুঝতে অসুবিধা হয় না। সাড়ে ছয়-সাত ক্রোশ রাস্তা পেরিয়ে এখানে আসে। প্রয়োজনীয় মালামাল কেনে। তারপর ফিরে যায়। এই কয়েক মাসে একটু ঘনিষ্ঠতাও হয়ে গেছে। সে অপলক তাকায়। বুড়ো মাথা ডানে-বামে দুলিয়ে নেতিবাচক মুখখানায় হাসি তোলে। শ্যামলের একচিলতে নীরব হাসি। তার ঠোঁটে সবসময় আনন্দ। জীবনের সকল হাসিখুশি ধরে রাখতে চায়। সেই আনন্দ কতটুকু সত্য কিংবা মিথ্যের জগাখিচুরি জানে না। বুঝতে পারে না। মনকে যে সবসময় বোঝানো যায় না। মন বড় উন্মন। নির্বোধ-দুর্বোধ্য। কারও কথা শোনে না। নিজের কথাও। সে বিড়িতে শেষ-সুখটান মেরে বুড়োর হাতে গুঁজে দেয়। দু-জনে মুখোমুখি বসে থাকে। আকাশে চনচনে রোদ। রাস্তায় তীব্র আলো। এখানে একচালার নিচে হালকা রোদছায়া। পশ্চিমে আশপাশ জুড়ে বনপাকুড়-শ্যাওড়া আর অচেনা গাছগাছালির ঘন জঙ্গল। কখনো ফ্যাকাশে ছায়া প্রগাঢ় অন্ধকার লাগে। চোখে-মুখে এনে দেয় হিম হিম তৃষ্ণা। তারপর আচমকা গরম বাতাসের উৎকট ঢেউ। তপ্ত ভাপ। বুড়ো দু-তিন ফুট উঁচু মাঁচায় বসে থাকে। শ্যামল নিচে পা ছড়িয়ে দড়ির পিঁড়িতে। নিঃশ্বাসে শুকনো মাটির আঁশটে গন্ধ।
ঘোড়াদুটো খয়েরি-কালো আর ধূসর-সাদা। নিস্তব্ধ দুপুরের মতো একমনে ঘাস চিবোয়। উজ্জ্বল রোদে নেপিয়ার ঘাসে সবুজ ঝিকমিক প্রভা। ঘোড়া ধীরস্থির মুখে টেনে নেয়। প্রগাঢ় শ্বাসে নিশ্চুপ ভোজন। ঠোঁটের কষ বেয়ে সাদা ফেনা নামে। কখনো থমকে নিঃসাড়। সহসা সামনে দৃষ্টি ছুড়ে দেয়। চোখের উপর ঠুলির শক্ত দেয়াল। কিঞ্চিৎ ফাঁক দিয়ে সামনের অংশ দেখা। পেছনে তাকাতে পারে কি? পারে না। পেছন বা অতীত বলে কোনোকিছু নেই। তেমনকিছু মনে পড়ে কি না…দৃশ্যছবি? কে জানে। শ্যামলের অনেক কথা অনেক ছবি দোলা দেয়। মন-ভাবনার নদীতে ঢেউ জাগে। অস্থির তরঙ্গ…প্রবাহ খেলা। তার দু-চোখে অতীতের সুখস্বপ্ন ঠুলি। সামনের দিনকাল তেমন স্বচ্ছ কোথায়? গোলকধাঁধা সুড়ঙ্গ মায়াঘোর। তেমন করে দেখতে পায় না অথবা কী এমন দেখে যায়, দেখার মতো দেখা হয়, হয় না; সব দেখা দেখা নয়। দুনিয়ার অনেককিছু দেখা হলো না। কিছু তার দেখা। যতটুকু হলো সবটুকু কেমন জানে অথবা জানে না। জানা যায় না। বোঝা যায় না। এ হলো জানা-অজানা জীবন-সংসার কাহিনি। দেখা হয়-দেখা হয় না, জানা-অজানা থেকে যায়; শত মানুষের বর্ণিল চেহারা। বুকের আড়ালে সেঁটে থাকা হাজার বিবিধ মুখছবি। মুখোশ।
জীবন আর জীবিকা নিয়েও কতটুকু ধারণা তার? যতটুকু জানা হলো বা বোঝার, সে শুধু বিমূর্ত জলছবি। দুপুরের রোদ-আকাশে স্বপ্নদোলার মতো দু-একটি মেঘ ভেসে যায়। উড়ে যায় দূর দিগন্তে। মানুষ-সমাজ থেকে অনেক দূর। দূর…বহুদূর। গন্তব্যহীন পথ চলা। ভেসে বেড়ানো জীবন। অথবা কোনোকিছু নয়। জীবনপ্রবাহে সততার কোনো কমতি নেই শ্যামলের। কারও মন্দ চিন্তা কেন, কোনো মনোযোগ নেই; সে থাকে নিজের মধ্যে। একলা ভুবন। একা একা অনবদ্য বেঁচে থাকা। প্রবীণ মানুষের কথা। পুঁথিপাঠ নিয়মনীতি গুরুজনের উপদেশ পরামর্শ পাথেয়। অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণের চেষ্টা। কাউকে ঠকিয়ে দু-আনা বেশি উপার্জন করে, এমন কাজে নেই। তাই বুড়োর দু-চোখে জলতরঙ্গ মতলব দেখে মন-ভাবনায় উন্মন-উদ্ভ্রান্ত আজ। শ্যামল অনেকক্ষণ অপলক-নিষ্পলক। বুঝতে পারে কি পারে না, কোনো গুমট তন্দ্রাঘোর দুপুরের মধ্য দিয়ে ভেসে যায়। তারপর সহসা চমকে দু-চোখ সরিয়ে রাখে। রাস্তা ছাড়িয়ে আকাশের নিঃসীম দিগন্তে দৃষ্টি চলে যায়। মানুষ কত মতলববাজ! এসবের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে তাকে। এগিয়ে যেতে হয়। বেঁচে থাকতে হয়। এরই নাম বেঁচে থাকা। অস্তিত্ব জীবন।

মানুষের সঙ্গে পেরে ওঠা বড় শক্ত। এই তো সেদিনের কথা। বাবার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যায় শ্যামল। আজিজার ম-লের আঙিনা অনেক দিঘল। তখনো সন্ধের আলোছায়া নিশ্চুপ বসে আছে। অন্ধকার গাঢ় হয়নি। দু-চারজন মানুষ বেঞ্চের উপর। দক্ষিণে দুটো আমগাছ। আম্রপালি। বড় বড় আমের ভারে নুয়ে পড়েছে। ম-ল ফাযিল মাদরাসার প্রভাষক। আরবি পড়ায়। হাদিস-তাফসিরের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ফারায়েজের কঠিন-জটিল অঙ্ক। শ্যামলের এসব জানার কথা নয়। লোকমুখে শোনা। সে সদ্য-কৈশোর উতরানো তরুণ। চোখে-মুখে নিষ্পাপ স্বপ্নমায়া। গোধুলির লালিমা আর রাতের ঘুমে শুধু লক্ষ্মীর মুখছবি। পাশের বাড়ির কিশোরী-তন্বী। শ্যামলের নিজ দেয়ালের ও-পাশে অন্য বাড়ির ঘর। কখনো রাতের স্থির-নিশ্চুপ প্রহরে কানপেতে শোনে নিঃশ্বাসের ঢেউ। তার উঠে দাঁড়ানো। চৌকিতে এপাশ-ওপাশ। কয়েক বছর হলো এখানে বসত গেড়েছে ওরা। পশ্চিমে পুবমুখি দুটো ঘর। পুবের দেয়াল ঘেষে হেঁসেল। তার পেছনে পুকুরপাড়ের কোণায় বিশাল কদম গাছ। বর্ষায় আকাশ আলো করে রাখে। নীল কিংবা ধূসর-সাদা পটভূমিকায় অদ্ভুত মায়া-জলছবি। কোনো কোনো দিন দুপুর-শেষ বিকেলে লক্ষ্মী এসে দাঁড়ায়। ছোটভাই সঙ্গে। কিছুক্ষণ স্থির-নীরব দূরের দৃশ্যে তাকিয়ে থাকে। কখনো খুনসুটি দৌড়োদৌড়ি। তখন দুটো কথা হয়। বাবা-মা দুই ভাইবোন। আঙিনার শেষে দেয়াল। ও-প্রান্তে যেমন লতিয়ে ওঠা দু-একটি জবা এ-প্রান্তের সীমানার বাতাসে দোল খায়, খেতে থাকে, তার দু-চোখে স্বপ্ন-আবাহন। শ্যামলের বুকে অচেনা ডাক…বিমূর্ত আহ্বান। লক্ষ্মী…লক্ষ্মী। মন হারালো…হারালো। একদিন ঘর আলো করে বুকে স্থায়ী ঠাঁই। শ্যামলের মায়াবী জীবন-সংসার। লক্ষ্মী মা হতে চলেছে। প্রথমবার। তাই শ্যামলের বুকে অস্থির উত্তেজনা। থিরথির অস্থির কাঁপন।
সেদিনের কথা মনে পড়ে। অনেকক্ষণ পর অন্দর থেকে বের হয় আজিজার ম-ল। ঘি-হলুদ রং পাঞ্জাবি। বাতাসে ছড়িয়ে যায় অচেনা আতরের সুবাস। মন হালকা লাগে। কোনো স্বপ্নঘোর মায়াজাল। বেঞ্চের উপর বসে থাকা মানুষজন উঠে দাঁড়ায়। তারা কী-সব কথা বলে বোঝা যায়…বোঝা যায় না। শোনা না শোনা ফিসফাস। এভাবে অন্ধকার ধীরে ধীরে হাত-পা ছড়িয়ে নেমে আসে। আসতে থাকে। টিউবওয়েলের ওদিকে লেবুতলায় ঘোর আঁধার। তারা সেখানের কোনো এক দূর কোণায় বসে থাকে। ছোট জাত। বেঞ্চে বসার অনুমতি নেই। মানুষজন চলে গেলে সময় হয় তাদের।

‘তো বাহে নীলকান্ত, কি তনে আইছি?’
‘বাবু ওই ভুঁইকোনা…।’
‘ওইটা তো জাকির নিছে। এই বছর তো হইল না, সামনের বছর নিবু।’
‘বাবু ভুঁইকোনা মোর বাপ দিয়া গেইছে। ম্ইু কিছু জাননু না…দেখনু না মাঁইষে হাল দিলি। আইজ রোপা গাঁড়োছে। কেমন কাথা?’
‘দুর ব্যাটা! তোর আর জমি আছে? খাস ভুঁই। তিন-চার মাস ধরি জরিপ হইল। তখন কুনঠে ছিলু? খাজনা নাই…খারিজ নাই…মালিক নাই। ওই জমি মোক দিছে সরকার। মোর জমি। এ্যালা তোর কেমন করি হইল? যা এই বছর জাকির আবাদ করুক। সামনের বছর তুই করিবু। তিন ফসলি জমি। বছরে ত্রিশ হাজার দিবু।’
‘মোর জমি…ফির ট্যাকা ক্যানে?’
‘আচ্ছা পাগল তো তুই নীলকান্ত। তুই এক কাম কর। সাদেক মেম্বারের ঠে যায়া ভালো করি শোনেক। জমিজমার হিসাব-কিতাব তো বুঝিবু না।’
‘এইটা ক্যাংকরি হইল বাবু? মোর জমি। বাপের আমল থাকি হাল-আবাদ করো। কাঁহো কিছু কইল্ না। এ্যালা মুই হাল জুড়িম। যায়া দেঁখ তোমার লোকজন হাল দিছে। মোরে জমি কিন্তু মুই ফিরি আনু। কেমন কাথা?’
‘ম্যালা কাথা কই না নীলকান্ত। ওই জমিত হাল জুড়িছে জাকির মাস্টার। মোর জমি, যাক খুশি তাক দিবার পাঁরো। যাঁয় টাকা দিবি, আবাদ করিবি। তুই দিবু আবাদ করিবু। যা হউক, তোর মনোত্ সন্দেহ থাকিলে মেম্বার-চেয়ারম্যানের ঠে যা। ওমাক ক। কোট-কাচারি আছে। মামলা করিবার পারিস। এইলা খাস জমি, সরকার নতুন করি দেছে। এ্যালা মুই মালিক। ভাল্ করি খবর নি। যাউক কাথা কওয়ার সমায় নাই। এ্যালা তোমরা যাও। নামাজের অক্ত চলি যাছে।’

শ্যামল ফিরে আসে। বাবার সঙ্গে হেঁটে যায়। বাইরে আলো-অন্ধকার ছায়া। রাস্তার ধারে মাটির তলায় ঝোপঝাড়ে উচ্চিংড়ে-ঘুগরের চিৎকার ঘনঘটা। মাথা ঝিমঝিম বিবশ প্রায়। রাস্তার পাশে পাশে ডিপ-টিউবওয়েলের নালায় সেচ পানির গতিপথ। চাঁদের আলোয় ঝকঝকে কুলুকুলু শব্দঢেউ। শ্যামলের বুকে অবরুদ্ধ চিৎকার। আর্তনাদ। বাবার পরাজিত অসহায় মুখছবি বার বার বাতাস ঝাপটার মতো জেগে ওঠে। কি করবে সে? কি করতে পারে? মনের কোণায় ফুঁসে ওঠা আগুনের দপদপ শিখা কান্না হয়ে যায়। মন পোড়ে। বিষাদ বেদনায় বাতাস ফিসফিস কথা কয়। কী বলে? সে জানে না। তার দৃষ্টি ঝাপসা হতে হতে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। দৃষ্টির সামনে পড়ে থাকে সেই জমি। শুক্লা নবমীর মৃদু আলোয় ধীর বাতাসে ধানের চারাগাছ দোল খায়।

আজ মন দোলায়মান। কয়েকদিন ধরে দোলাচল ঢেউ। কেন এমন হলো? কেন এমন হয়? এসব কাজ ভালো লাগে না। আগে যেমন ক্ষেতের জলে পা ভিজিয়ে ধানচারা রোপণ করে, রোদছায়া বিকেলে গাছের ডগায় আলোর নৃত্য দোলা; মন ফিরে পেতে ব্যাকুল। ক্ষেতের টলটলে জলের মধ্যে সাঁতার কাটে পোনামাছ, ছোট ছোট ঠোঁট খুলে বাতাসের বুদবুদ ঢেউ; খুব মনে পড়ে যায়। কোনোদিন পদ্মদিঘির পুবালি জঙ্গলে অনেক উঁচু গাছের শিখরদেশ দৃষ্টির গভীরে রহস্য তুলে ধরে। বাঁশবনের অচেনা কোনো গোপন খোপ থেকে দু-চারটি কানিবকের ছা টেনে নামায়। সন্ধের টিপটিপ আঁধারে ঝোপের ছায়ায় দিঘির পাড়ে বড়শি গেঁথে রাখে। তখনো সাঁতার কেটে চলে পুঁটি-সাঁটি কিংবা কই। তারপর রাত পাহারা চোখে অপেক্ষার ভোর হামলে পড়ে। ভাগ্য ভালো হলে শোল-রুই-কালবাউশ জুটে যায়। জঙ্গলের প্রগাঢ় অন্ধকারে পেতে রাখা ফাঁদেও জড়িয়ে যায় দু-একটি বনবেড়াল বা ধেড়ে ইঁদুর। আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো রাতচরা পাখি। কি তার ওজন! কি আনন্দ মনে! উচ্ছল সেইসব দিন ঢেউ জাগায়। এখন কী করে সে? পানসে নিরানন্দ পা-ুর ঘর-সংসার। কষ্টের মধ্যে বেঁচে থাকা।
যেদিন কোনো বড় শিকার হাতে এসে পড়ে, তার মতো বাবার দু-চোখেও আনন্দ ঝলমল খুশি। মা আঙিনার উনুনে দুপুর রোদে রাঁধতে বসে। বাতাসে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যায় স্বাদু গন্ধের ঘ্রাণ। বাবা একচালার ছায়ায় বসে ভাত খায়। শ্যামল তার পাশে। চৈতালি বাতাসে কোনোদিন দূর মাঠে রাস্তায় আচমকা ধুলো ওড়ে। তাদের চালাঘরের পেছনে বড় দিঘিতে ছেলেমেয়েরা ধুপধাপ ঝাঁপায়। বাবার মুখে কুরকুরে শব্দ। শ্যামলের চোখে-মুখে উদার-তৃপ্তি। হাসি মুখছবি।

‘সুমতি আডি সেবেলাকানা য়া…আর মিত্ কুটি ইমাঞমে।’
(সুমতি বড় স্বাদ হয়েছে রে…আরেকটা টুকরা দে।)
‘হাপোই এমামকানাঞ।’
(হাঁ হাঁ দিই দিই।)
‘শ্যামলা এমায়মে…হোপনিঞ আডিতেত্ এ কামিয়া। আম লাগিত দোহোজংমে। মেনাক্গেয়া থ?’
(শ্যামলাকে দে…ব্যাটা আমার কাজ করে খুব। তোর জন্য রাখিস। আছে তো?)
‘মেনাক্ গেয়া।’
(আছে… আছে।)

বাবার সুখ-তৃপ্তি বুকে আনন্দ ঢেউ তোলে তার। মা-বাবা দু-জনের মধ্যে ভারি মিল। ভালবাসার এমন ছায়াছবি আর কোথায়? শ্যামল আবার ফাঁদ পেতে রাখে। ফাঁদের জীবন-সংসার। আজ সে নিজেই ফাঁদের মধ্যে ঘুরপাক খায়। সে এক বনবেড়াল কিংবা ধেড়ে ইঁদুর। দিঘির জলে ছায়া-অন্ধকারে পেতে রাখা আকশিতে তড়পানো ছোটমাছ। তার মন পোড়ে। মা চলে গেছে কত দিন। চোদ্দো বছরের শোককাল মিলিয়ে গেল…বিষণ্ন দৃষ্টি মুছে যায় না। সেই যুগকাল শেষ হয় না। এখন বাবার চলে যাওয়ার সময়। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি। অনন্ত প্রতীক্ষা। একচালার দূর ছায়ায় শোয়া-আধশোয়া নির্বাক মানুষটির দিকে তাকালে অচিন রূপকথা-কান্নাঢেউ বুকে আছড়ে পড়ে। ‘মা…মা তুই কেনে চলে গেলি? বাবার একলা থাকা সহ্য হয় না।’ মানুষ কেন চলে যায়? বাবার দু-চোখে তেমন জিজ্ঞাসা ঢেউ তোলে কি? কে জানে।
শ্যামল একলাফে সময়ের রোদে নেমে আসে। পশ্চিম আকাশে কয়েকটি চিল ওড়ে। শ্লথ-ক্লান্ত চক্রাকার ঘুরে ঘুরে দূর হাওয়ায় ভেসে যায়। আহা! এমন জীবন হয় না কেন তার? সে বুড়োর দিকে দৃষ্টি রেখে হয়তো কিছু ভেবে নেয়। যেভাবে হোক কোনোমতো কেনাবেচা শেষে ফিরতে হবে। তারপর কাজ আর কাজ।
(চলমান)

বংশীবাদক ও আকাশপরি উপাখ্যান

অনেক রাতে যেখানে সেটি রাখে, হাতড়িয়ে দেখল; নাই। ওই-সময় কাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে? মন মুহূর্তে খারাপ হয়ে গেল। সে ঘুলঘুলি জানালা দিয়ে আলোছায়া অন্ধকারে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে কিছুক্ষণ। গোরস্তানের বুকে চঞ্চল হয়ে উঠেছে জোনাকিরা। ঝোপঝাড়ের মধ্যখানে ডোবায় দু-চারটি শাপলা গোলাপি-লাল বা শ্বেতশুভ্র জেগে থাকে অথবা ক্লান্ত ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ পূর্ণিমা। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় ঝকঝক বাঁধানো কয়েকটি সাদা কবর। কোনো নামফলক বা এপিটাফ ছায়া ছায়া আবছা দেখা যায়। অর্থশালী সক্ষম মানুষেরা মৃত শরীরের জন্য জায়গাটুকু কিনে নিতে পারে, গরিব মানুষ অসহায়; শেষ শয়ানেও করুণা কাঙাল। এদিক-ওদিক পরিত্যক্ত কোনো কোণায় আশ্রয় নেয়। সে গরিব। একদিন তারও মৃত্যু হবে। অবধারিত সত্য। পালানোর পথ নেই। সুতরাং সেও একদিন ভঙুর মাটির তলায় চলে যাবে। অপর জগতের জন্য কারও দু-চারটি দোয়া-দরূদ। বুকের উপর কয়েকটি খেঁজুর কাটা। শেয়াল-কুকুরে যাতে তুলে ফেলে খুবলে নিতে না পারে। তারপর একদিন মাটির স্তরের পর স্তর জমে উঠবে। সে ধীরে ধীরে আরও নিচে নেমে যাবে। কবরের দৃশ্যমান উপরে কোনো ইট-বাঁধানো নামফলক কিংবা এপিটাফ থাকবে না। সে অবশ্য অনেক পরের কথা। আয়ু গড়পরতা ষাট বছর হলে এখনো সাঁইত্রিশ বছর দেরি। জীবনের এই সময়ে বিষাদ ঘেটে মন খারাপ করতে চায় না, কিন’ মন খারাপ হয়ে গেছে; কী করে ভালো হবে? বিছানায় তোষকের নিচে যা রেখেছিল, যত্নে তুলে রাখে; আতিপাতি খুঁজে পাওয়া গেল না। নাই। একেবারে গায়েব। এখন কী করে? তবে কি চোকির নিচে পড়ে গেছে?
সে শুয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবনায় ডুবে যেতে যেতে কী ভেবে একবার নেমে আসে। মেঝের উপর দাঁড়িয়ে দূর ভাবনায় ভেসে যায়। আরও একবার দেখা দরকার। কোথাও গড়িয়ে গেছে কি না? দিয়াশলাই জ্বালিয়ে বেশ ধীরস্থির চোকির নিচে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেখতে থাকে। ডেকচি-হাঁড়ি-পাতিল-দুটো টিনের বাক্স আর বিবিধ জঞ্জালের ভেতর জমাট অন্ধকার। এরমধ্যে কোথায় তার তেল চকচকে বাঁশের বাঁশি? নিশ্চয় কেউ সরিয়েছে। কে হতে পারে? বাবা…অবশ্যই বাবা। বুড়ো বাঁশি বাজাতে দেয় না। সেদিন মা বেশ আদুরে গলায় আবারও আপত্তি তোলে, –
‘ফয়জুল এইলা ছাড়ি দি বা।’
‘কী ছাড়ি দিম?’
সে মনে মনে চমকে ওঠে। ইদানীং সিগারেট বেশি হয়ে যাচ্ছে। শফিক-বাবুলের পাল্লায় পড়ে কলকিতেও দু-চারবার টান দেয়া হলো। এসব আর করা যাবে না। মায়ের নাকে নিশ্চয় ভুরভুর গন্ধ পৌঁছে গেছে। তখন প্রায় মধ্যরাত। সাড়ে বারো পৌনে এক। সেকেন্ড শো সিনেমা দেখে ঘরে ফেরা। রাত নটায় আঙিনার পুবে ইট-প্রাচীরের দেয়ালের মধ্যখানে টিনের দরজা বন্ধ। বাবা চারিদিক দেখেশুনে তালা মেরে দেয়। তারপর শুয়ে পড়ে। সেই রাতে খোলা ছিল। মা জেগে অপেক্ষায়। তার সাড়া পেয়ে আলগোছে দরজা খুলে দেয়। তার মা, আদরের মা; জগতের সেরা বন্ধু। মা ফিসফিস করে কী বলে ঠিকমতো শুনতে না পেলেও সব বুঝে নেয়। মনজুড়ে ফুরফুরে ফুর্তি। চোখের মণিতে দোল দোল নাচের দৃশ্য। নিষিদ্ধ দোল। সে চমকে-থমকে ইশারা বুঝে নিজের ঘরে খেতে বসে। মা তরকারি গরম করে দেয়, কিন্তু ভাত ঠান্ডা হয়ে গেছে; তপ্ত ঝোল প্লেটে পড়ে চর্বি হয়ে নেতিয়ে পড়ে। গরুর মাংস হয়তো দু-দিন আগের। বাসি। বাবা সহজ-সরল মানুষ। বাজারে প্রায়শ ঠকে আসে। তাকে বাজার করতে দেয় না। আসলে বিশ্বাস করে না। বাজারে দু-চার টাকা এদিক-ওদিক হলে সে তো নিজের ছেলেই নেবে নাকি? অথচ মোক্ষম যুক্তি সিগারেট খাওয়ার টাকা দিতে রাজী নয়। সে নাহয় না দিক, কিন’ সামান্য শখ, মনের আনন্দ, একটু বাঁশির সুর তোলা; সেও বন্ধ করতে হবে? সে তা পারবে না। আঙুলের ফাঁকে কমলা রং চর্বি জমে গেছে। দুপুরের লালশাক ঘাসের মতো লাগে। উপায় নেই। সে খেতে থাকে। কি যে ভেবে চলে, নাকি সে-সব দৃশ্যছবি; আকস্মিক নির্দেশে চমকে ওঠে। দু-চোখে প্রশ্ন।
‘ওই বাঁশি। তোর বাপ পছন্দ করে না।’
‘বুড়ার সামনে তো বাজাই না।’
‘হ্যাঁ রে বাপকে বুড়া কয় কেউ? কষ্ট পাইবে না?…তুই বাজাবু, শাখের জিনিস, মোর আপত্তি নাই; কিন্তুক বাপের সামনে নাহায়। গোরস্তানত্ যায়া ন। কত বাও-বাতাস, ভূত-প্রেত-অপদেবতা ঘুরি বেড়ায়।’
‘পরিও তো থাকে। ডুমুর গাছোত বসি বাঁশি শোনে।’
‘হুহ্ পরি নামিবি! তোক বিয়া করিবি। বায়ও!’
‘ক্যান একটা পরি যদু তোর বউ হয়া আইসে, মন্দ কি! ধন-দৌলত উথিলি পড়িবি না? হারার কুনো কষ্ট থাকিবি না।’
‘স্বপন দেখেছু ন?’
মা হাসে। সেই হাসি ভারি অদ্ভুত মায়াময়। মা খুব ভালবাসে তাকে। রাত জেগে সামলায়। আঙিনা পেরিয়ে শজনে গাছের বাঁ-ধারে টিনের দরজা। সেখানে কাঠের রড লাগানো হয়। একটি তালা। বাবার রোজকার কাজ। ফয়জুল যেদিন রাতে দেরি করে ফেলে, দেরি হয়; তালা লাগানোর ডিউটি মায়ের। পৃথিবীর সকল মা বুঝি এরকম। চকিতে কত ভাবনা-দৃশ্যছবি ভেসে যায়। সে বিয়ে করেছে। অত্যন্ত সুন্দর চেহারার এক মেয়ে, তার বউ, মায়ের কাছে বসে থাকে। সেবা যত্ন করে। অলস দুপুরে দু-জনের গল্প-আলাপ-হাসি-আনন্দ বাতাসে ধীরলয়ে ভেসে যায়। সেই মুহূর্তে ছায়াছবিতে দেখা পরির মুখছবি ভেসে উঠে। তার উজ্জ্বল সফেদ দুটো পালক ডানা। আলো ঝলমল বর্ণিল পোশাক। সোনালি রং জাদুর কাঠি হাতে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। চোখের দৃষ্টিতে সলাজ আহবান। ফয়জুল কি করে! সেই পরির চেহারা কখনো তীব্র স্ফুলিঙ্গ-আলো কখনো অস্বচ্ছ প্রচ্ছায়া। সে ধাঁধায় পড়ে যায়। কে সেই পরি? পাশের বাড়ির বুশরা নাকি সত্যি সত্যি সেলুলয়েডের ফিতেয় জমে থাকা রূপসী? সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। শ্রুতিতে কখনো বেজে ওঠে গানের কলি। নদীতে পালতোলা নৌকোয় নায়িকার আদুরে ঢং-এ শরীর হেলিয়ে গান গাওয়া। ঠোঁটের আলতো প্রসারে রহস্যময় হাসি। এসবের কোনোকিছুই কপালে নেই তার। গরিব মানুষের দুঃসাধ্য স্বপ্ন। অলীক এসব দৃশ্যছবি কল্পনায় বেঁচে থাকা। সে এমন স্বপ্নবিলাসী থাকতে চায় না। পরি নামাতে হবে। গোরস্তানে জ্বিন-ভূত-পরি সব আছে। বাঁশির সুরে সুরে তাদের টেনে এনে চেয়ে নেবে কোনো বর। সে চাইবে টাকা। টাকাই একমাত্র ঈশ্বর। অশেষ ক্ষমতা। টাকা দিয়ে সাজিয়ে নেবে জীবন…বেঁচে থাকা। পূরণ করবে সকল স্বপ্নসাধ। মায়ের মুখে হাসি। বাবার বিষণ্ন মুখ মুছে দেবে। কিন্তু পরি নামছে কই? আর বাঁশি…সেটি গেল কোথায়?
শেষ দুটো কাঠি জ্বালিয়ে খুঁজতে শুরু করে পুনরায়। এবার মনোযোগি দৃষ্টি খুব ধীরস্থির রাখার চেষ্টা নেয়। একপাশ থেকে অন্যপাশে স্ক্যানিং চলে। কিন’…না নেই। কে করল নিষ্ঠুর এই কাজ? বাবা নয়…অন্য কেউ। কে কে? সে মনে করার চেষ্টা করে। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত কে কে তার ঘরে এসেছে? ঘর তো নয়, বৈঠকখানা, যে কেউ এলে এখানে বসে; তাকে সরে যেতে হয়। রাস্তায় নেমে দাঁড়িয়ে থাকে। গলির মাথায় পান-সিগারেট আর পটেটো চিপস দোকান। কয়েকজন মানুষ বসে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকে। ইদানীং রায়হান মিয়া ফ্লাক্সে চা বসিয়েছে। সেই চা তৈরি করে মলি। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ার পর সমুদয় পাঠ শেষ। কলেজের কোন্ ছোকরার হাত ধরে নাকি পালিয়ে থেকেছিল প্রায় এক মাস। পাড়ায় দু-এক সপ্তাহ জোর ফিসফাস চলে। তারপর সব শেষ। সব মিথ্যে রটনা। মলি আসলে মামার বাড়িতে ছিল। সেখানে তো যেতেই পারে নাকি? ফয়জুলের এসব বিষয়-ঘটনাপ্রবাহ মনে কোনো ঢেউ তোলে না। সে আপনমনে নিজের পৃথিবীতে ঘুরপাক খায়। তবে তখন থেকে বেশ চেনা হয় মলিকে। চোখের দেখায় মন্দ লাগে না। ফরসা মুখছবি, টিকালো নাক, তার ডান অথবা বাঁ-পাশে সাদা পাথরের বড় নাকফুল, কখনো রোদের আলোয় ঝলমল করে। মাথায় একরাশ চুল। চোখের দৃষ্টিতে কোনো রহস্যময় হাসি অথবা কৌতুক। সেই তুলনায় অনেক শান্ত-নির্জীব বুশরা। কখনো দশটি বাক্যের বিপরীতে একটি একমাত্রার জবাব। তবে তার কোনো রটনা নেই। কোনো ঘটনা নেই। সুন্দর ধৈর্যশীল দৃঢ় সংযম। আনটাচ্ড। কে না চায় অনাঘ্রাত পুষ্প শুকে নিতে। মলি? কে জানে কি? তবে যতটুকু রটনা কিছু তো ঘটনা বটে। কে জানে কোথায় কোন্ জায়গায় কী করেছে। তাকে নিয়ে প্রেম প্রেম গেম চলে জীবন-পাথার যাত্রা চলে না। এসব অবশ্য তেমন ভাবনার নয়। অলস দুপুরে ঘুম ঘুম অবসরে দু-একটি মাছির সুড়সুড়ি বিরক্তি মাত্র। এলোমেলো নিষ্পাপ ভাবনা অথবা নিষিদ্ধ লুকোচুরি খেলা। ফয়জুলের কিছু হলো না। একজন বান্ধবী, যার সঙ্গে কলেজ কিংবা ক্যাফেটারিয়ার নিরিবিলি ছায়ান্ধকার কোণায় আইসক্রিমে চুমুক দেয়। পার্কের জেসমিন ঝাড়ের নির্জন লাজুক সময়ে কোনো অচেনা চুম্বন। দিন যায় একা একা ছায়াছবির দৃশ্যছবি কল্পনায়। ববিতার নাটুকে সংলাপ। শাবানার স্বামীভক্তির শক্তি দেখে। আহা বুশরা কবে যে তোমায় একবার জড়িয়ে ধরতে পারব! অথচ সেদিন বিকেলে কলাভবনের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়ার নিচে কত কথা বলে যায় বুশরা। কোনো অস্থির চাপল্য নয়। যেনবা শাসন। কেন এমন করে বলে সে? নির্মোহ আবেগহীন বৈষয়িক। কে জানে তার মনে কোনো ভালবাসা বা প্রেম আছে কি না, অথবা সবকিছুই একতরফা ফয়জুলের? বিকেল কেমন অদ্ভুত অসহনীয় আর লাজুক-মূঢ় হয়ে ওঠে। ফয়জুল কথামতো ঠিক ঠিক আগামী একমাস বুশরার সঙ্গে দেখা করবে না। সে পরীক্ষা দিক। ভালোভাবে পাশ করুক। ফয়জুল তার সবকথা মেনে নেবে। কে জানে একদিন ধাক্কা মেরে ছ্যাঁকা দিলেও কিছু মনে করবে না। তার মনের দরজা খোলা…উন্মুক্ত রেখে দেবে। সে যে গোলাপ, সুগন্ধি বিলিয়েই সার্থক জীবন; তার মন খারাপ হয়ে যায়। সন্ধের সময় এদিক-ওদিক সাইকেল চালিয়ে অকারণ ঘোরে। গোপালগঞ্জ বাজারে মানুষের হই-হুল্লোড় আর চেঁচামেচি শোনে। রাত নেমে আসে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি। কোন্ফাঁকে বাঁশের একটি বাঁশি কিনে নেয়। এই তো সেদিনের কথা। এবার বাঁশি বাজিয়ে সময় পার।
(চলমান)
(গল্পটি ‘শব্দঘর’ এপ্রিল ২০১৯ ইস্যুতে প্রকাশিত।)

যে মানুষটি এই পৃথিবীর নয়

যে মানুষটি দেখ বাহাদুর বাজারের নোংরা রাস্তায় হেঁটে যায়
তার কণ্ঠে থাকে কোনো আকুল আবেদন…কান্নাভেজা গলি,
সে এই পৃথিবীর নয়
সে এই সমাজের কেউ নয়
এমনকি আমাদেরিএত সব মানুষজন, কারও কেউ নয়।

তুমি শুনেছ হয়তো তার ফরিয়াদ
সে শুধু কৈফিয়ত বা আহাজারি নয় স্বগতোক্তি কাব্য
সে যে গরিব একজন…চরম গরিব
এমনকি ভাত বা রুটি কেনার সংস্থান নেই
সে এই মানুষের পৃথিবীর কেউ নয়।

তবু সে মানুষের কাছে এসে দাঁড়ায়
তাদের কাছে আকুল কণ্ঠে কথা বলে ফেলে ধীরলয়ে
প্রলম্বিত কান্নার মতো সেই ধ্বনি তেপান্তর পেরিয়ে যায়
সে এই পৃথিবীর কেউ নয় পৃথিবী কি জানে
তবু সে মানুষের দিনকালে রোদের মতো হেঁটে যায়।

তার পায়ের নিচে নোংরা কাদা ময়লাটে কালো
তার পেছনে, না না তার হাত ধরে থাকে একটি মেয়েটি
সে এগিয়ে নেয় তাকে যে এই পৃথিবীর কোনো মানুষ নয়
তার ছোট ছোট দুটো গোলাপি পা কালো ময়লায় হেঁটে চলে
আর দেখ অদ্ভুত ফুলের বাগান তৈরি হতে থাকে।

যে মানুষটি অন্ধ দু-চোখে পৃথিবী দেখার সাধ রাখে না
মানুষের বুকে বুকে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক স্তব তোলে না
মানুষের কাছে মানুষের কথা বলার কোনো অর্থ বোঝে না
আর এরমধ্যেই মেয়েটি মানুষের ছুড়ে দেয়া একটি দুটি কয়েন
হাতে তুলে নেয় আর শুকনো চোখে মানুষ দেখে
দেখতে দেখতে তুলে দেয় সেই মানুষের হাতে
যে মানুষটি এই পৃথিবীর নয় অথবা কোনো সময়ের নয়
তবু সেই এই পৃথিবীর পথে সময়ের স্রোতে হেঁটে যায়
একদা মানুষের ঈশ্বর ছিল বলে।

অচেনা গানের স্বরলিপি

বইমেলার কাপড় ঘেরা স্টলের এককোণায়
অনাথ শিশুর মতো পড়ে আছে তোমার বই
কত আবেগ কত ভালবাসা
কত রাত জেগে জেগে কত কথকতা,
এখন হাফপ্যান্ট পরে থাকা নিশ্চুপ বালক যেন।

ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে বসে থাকো তুমি
জানালার ওপাশে মেঘের ভাঁজে ভাঁজে অপলক দৃষ্টি
আকাশপ্রান্তে কোথাও পাঠিয়ে দাও…
কেন?
কোনো কোনো রাত দূরাগত বাঁশি শুনতে শুনতে
একলা চুপি চুপি কাঁদো
ভালবাসা অপমান মেখে কত না বিকেল গড়িয়ে গেল
এই প্রাপ্য ভেবে ভেবে হয়ে গেলে ভাঙাচুরা মারবেল
শিখে নিলে একলা পৃথিবীর একলা জীবন।
আজও তেমন একলা পথিক হেঁটে যাও অচেনা পথে একা একা
কখনো কি ভেবে নাও অচেনা কাব্যকথা কিংবা
কোন্ স্বপ্ন ভরসায় তুলে নিলে সুর একদিন?
সেই সরগম তো কোনো অ্যাকোর্ডিয়ান নয় আজ
তুমি রইলে একা বইমেলার এককোণায় নিশ্চুপ বোবা চোখ
দেখে গেলে মানুষের ভিড় হাসি আনন্দ কলরোল আর
বৃষ্টির ঝিম ঝিম পদরেখায় ফাগুনের আলপনা
অচেনা গানের স্বরলিপি বুকে বেজে হলে খান খান।

(একই শিরোনামে একটি গল্প লিখেছিলাম বছর কয়েক আগে। এই নামে মোট আটটি গল্প নিয়ে একটি বই হতে পারে।

লাশের যোগবিয়োগ

শেখ রহিম বারান্দার এককোণায় বসে থাকেন। গদি-আঁটা চেয়ার। আয়েশ করে বসেন। রাস্তার পাশে বাড়ি। অগ্নিকোণ-মুখি বারান্দা। সারাদিন বাস-রিকশা-অটো কত যানবাহন চলছে। তিনি কখনো মনোযোগে কখনো আনমনে দেখেন। মানুষজনের যাওয়া-আসা, ব্যস্ততা আর চেহারা দেখেন। মানুষের মুখ ভারি অদ্ভুত! একজনের সঙ্গে অন্যজনের কোনো মিল নেই। কারও চেহারা-ছবি অচেনা-অজানা। কাউকে দেখায় একরকম…আসলে সে অন্য। তিনি কেমন? তার চেহারায় কী আসল ভাব ফুটে ওঠে? তিনি জানেন কিংবা জানেন না। তিনি শুধু চেয়ারে বসে মানুষ দেখেন। কারও চেহারা হয়তো দেখেন না। কেননা এখন তিনি মাঝে মধ্যে নিজের চেহারা নিজের মধ্যে দেখতে পান।
কেউ কেউ তাকে দেখে। তার চেহারায় কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। তিনি নির্বিকার ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থাকেন। নাকি পেছনে ফিরে তাকান? দিনে দিনে অনেকদিন পেরিয়ে গেল। এখন শুধু অপেক্ষা। অপেক্ষা লাশ হওয়ার। একদিন তিনি লাশ হবেন। তারপর…তখন তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, যাদের নিয়ে তিনি ব্যবসা করেছেন, রাজনীতির কৌটিল্য চাল চেলেছেন; তারা তার সঙ্গে কী করবে? চিমটি কাটবে? কামড়াবে? তখন তার কোনো শরীর থাকলে তো! তিনি নিশ্চিত কেউ কামড়াতে পারবে না। কেননা তিনি সেখানেও দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করবেন। যারা ইহকালে দাপট দেখাতে পারে, পরকালেও দক্ষ আর ডাকসাইটে। এটিই পুণ্য। এটিই কাজ। এটিই সফলতা। তিনি একজন সফল মানুষ।
আজ তার মন কেন জানি বিক্ষিপ্ত-বিচলিত। পরশুদিন সেই মানুষের সঙ্গে সরাসরি দৃষ্টি সংযোগ ঘটে গেছে। সেই চোখে কী ছিল, তিনি ভাষা বুঝতে পারেন নাই; কিংবা বুঝতে পেরে আত্মভর্ৎসনা দেখা দেয়। বিবেক বেলুনের মতো ফুলেফেঁপে জেগে উঠতে চায়। যে তিনি চিরকাল আত্মশ্লাঘার প্রসাদ গুনেছেন, তখন প্রশ্ন জেগে ওঠে; তিনি কী করেছেন জীবনে?
এখন এই মানুষকে প্রায়শ দেখেন। প্রায় প্রতিদিন সকালে সামনে দিয়ে অল্প বয়সে ন্যুব্জ বৃদ্ধের মতো হেঁটে চলে যায়। দু-এক বছর থেকে দেখছেন। সেই মানুষ কোনোদিন মাথা উঁচু বারান্দার দিকে তাকায় না। তিনিও তেমন করে দেখেন না। কত মানুষ হেঁটে চলে যায়। তার দু-চোখের সামনে দিয়ে নিরিবিলি-নির্জন-নিশ্চুপ। কেউ শহরে আসে। কেউ শহর ছেড়ে বাইরে যায়। কে কার খোঁজ রাখে? আঠারো কোটি জনসংখ্যার দেশে গিজগিজ মানুষ। পোকার মতো কিলবিল করে। কে কোথায় হাসে, কে কোথায় কাঁদে; কে খবর রাখে? তিনি কারও কোনো খবর রাখেন না। কোনোদিন রাখেননি। যতদিন রেখেছিলেন, যতটুকু পেছনে; অন্যকোনো কারণ। সেটি রাজনীতি হতে পারে। মানসম্মান চরম স্বার্থ কিংবা…। রাজনীতি হল ক্ষমতা। স্বার্থ উদ্ধারের কৌশল মাত্র। তিনি কৌশলী মানুষ। তাই শহরের মধ্যখানে চমৎকার জেঁকে বসেছেন। তিল তিল শ্রম আর অধ্যবসায়ে বসতে পেরেছেন। সাদ্দাতের বেহেস্তের মতো রত্ন-পাথরের কারুকাজ অট্টালিকা সাজিয়েছেন। তার বিশাল বাড়ি এক প্রাসাদ ছাড়া কী?

সামনে বাসস্ট্যান্ড। পঁচিশ মিনিট পর পর বাস যাত্রা করে। কত মিনিট গ্যাপে আসে তার ঠিক নেই। তারপর চোখের সামনে কাহারোল-সেতাবগঞ্জের বাস আচমকা হুমড়ি খেয়ে থামে। বাসগুলো মানুষ নামায়, মানুষ ওঠায়; কনডাকটর-হেল্‌পারের হাঁকের মধ্য দিয়ে আবার ছুটে চলে যায়। ফেলে রাখে ডিজেল পোড়া একরাশ কালো ধোঁয়া। শেখ রহিম ভাবেন। পৃথিবী বাসস্ট্যান্ডের মতো। তিনি এক বাস। তার মাথার মধ্যে মনকির-নাকিরের মতো কনডাকটর-হেল্‌পার আছে। তিনি তার বাসের নিজে ড্রাইভার। তিনি বাস হয়ে কেমন চলেছেন কিংবা চলছেন? আর কত দূর যাবেন? ফিটনিস কেমন? সময় শেষ হয়ে আসছে বুঝতে পারেন। ইঞ্জিন কিছুদিন পর রিজেক্ট হয়ে যাবে। তখন একমুঠো ধোঁয়া ফেলে রেখে যাত্রার ইতি। সেই ধোঁয়া ধূসর-সাদা নাকি ডিজেল পোড়া গাঢ়-কালো? মানুষের কতটুকু যন্ত্রণা জাগায়? যতটুকু হোক সব তার স্মরণের শোকসভায় স্তুতিপাঠ আর মজাদার প্যাকেটে বাতাসে মিলিয়ে যাবে।
সেই মানুষের চেহারা আবার দু-চোখে ভেসে ওঠে। ভেসে উঠবার দরকার কি? কিছুক্ষণ পর তো চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে। তিনি তাকে চেনেন। একটু একটু মনে করতে পারেন। তখন যেমন দেখেছেন মানুষটি তারচেয়ে অনেক বুড়ো হয়ে গেছে। মানুষটির সঙ্গে লাশের এক গল্প আছে। রাজনীতির খেলা। রাজনীতি মানেই তো লাশ এবং ক্ষমতা। কেউ লাশ না হলে অন্যেরা ভালোভাবে খেতে-পরতে-আরাম করতে পারবে কেন? কীভাবে পথ বের করতে পারে? তিনি পথ খুঁজে খুঁজে রাজনীতি করেন। যখন যেমন তখন তেমন কৌশল ধরেন। লাশের রাজনীতি নিয়ে লাশ লাশ খেলেন। এই খেলা বেশ মজার। দাবার চৌষট্টি ঘর-ছকের মতো। সেখানে রাজা-মন্ত্রী-সৈন্য। যার যতটুকু ক্ষমতা। তিনি খেলায় পরিপক্ব। তেমন নেতিবাচক হিসেবে না দেখে বলা দরকার তিনি সময়-সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে কৌশলের সমন্বয় এবং প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এতে কাঁধের উপর কোন্‌ অশরীরি সত্ত্বা বসে বসে হিসাব লিখছে নাকি গালমন্দ করছে, দেখার বা শোনার কী আছে?
তিনি নিজেকে প্রবোধ দেন। সকাল সাড়ে নয় বেজে আসছে। মানুষটি এখনই মুখের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে। তার দু-চোখ সেই লাশের চোখের মতো। রাইফেলের গুলিতে অনেক রক্ত ঝরে ঝরে রক্তশূন্য। পাঁশুটে হলুদ। পাণ্ডুর বিষাদ। শঠতার এই সময়ে প্রতারিত মানুষের ক্লান্তির মতো। কখনো কখনো তিনি ভুল করে বসেন। আসলে সে কি জীবিত নাকি সেই লাশ যাকে তিনি দেখেছেন আর…। আহ্‌ আজ আবার সেই কথা কেন? সেই ঘটনা তো শেষ হয়ে গেছে। সেই লাশ ভূত হয়ে বায়ুমণ্ডল-নভোমণ্ডল ভেসে বেড়ায়। মানুষের পৃথিবীতে ফিরে আসার কোনো ক্ষমতা নেই তার। অবশ্য এটি এখন মানুষের কি না কে জানে। মাত্র কি একটি লাশ নাকি আর একটি, আরও একটি; আরও আরও…? তিনি হিসাব মেলাতে পারেন না। হিসাব করেই বা কী?

যখন এসআই স্বপন কুমার ভরদুপুরে আপত্তি-গুঞ্জন সত্ত্বেও মেয়েটির লাশ পরখ করেন, একে একে খুলে ফেলেন পরনের কাপড়; প্রায় ফেলেছেন আর জনতার কেউ কেউ মজা পেতে থাকে। আগ্রহ-কৌতূহলে চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসে। মেয়েমানুষের লাশ, যার দেখার মতো সবকিছু ভেতরে এবং সুড়সুড়ি মজা। বেআবরু করার মজাও আলাদা। সেটি লাশ কিংবা জীবিত মানুষ। মানুষজন বিড়বিড় করে। এই মেয়েটি পাশবিক নির্যাতনের শিকার। তিনি জানেন, এই অপরিপক্ব মৃত শরীর শহরের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। সাংবাদিকেরা ছবি তোলে। উত্তর-পূর্ব-পশ্চিম-দক্ষিণ বিবিধ অ্যাঙ্গেল থেকে ক্লিক ক্লিক। ফ্লাশের ঝলকানি। বিশাল আট কলাম খবর তৈরি হয়। খবর নিয়ে দরদাম চলে। আগুন চেপে রাখতে হবে। আগুন তো নয়, গোপন অপরাধ; অনেক মূল্য। তিনি সব দেখেছেন। হিসাব কষে মূল্য অনুমান। আর সত্যি সত্যি আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। কেননা তা না হলে রাজনীতির পাশা খেলা কী করে হবে? কোনো কোনো মৃত্যু দিয়েই তো দুর্যোধনের চাল চালতে হয়। সেখানে শকুনি থাকে। প্রমুখ সভাসদ। গোপন বৈঠক। পরামর্শ-পরিকল্পনা। উপরের নির্দেশ।
তাকে কোনো সলতেয় আগুন জ্বালাতে হয়নি। যারা জ্বালাবার, সময়মতো ঠিক কাজ করেছে। জ্বালিয়ে দিয়েছে আগুন। মল্লিকপুরের শুকনো মাঠ মানুষের রুদ্ররোষে ঘেমে ভিজে যায়। দাউদাউ আগুন জ্বলে ওঠে। তারপর শহরের রাস্তায় রাস্তায় মোড়ে মোড়ে গলিপথে ইটপাটকেল। জবাবে টিয়ার শেল। মানুষের চোখ-মুখ জ্বলে যায়। অবশেষে পাখি শিকারের গুলি। একটি লাশের জায়গায় আরও লাশ। মানুষ লাশ ছিনিয়ে নেয়। আকাশ-দিগন্তে প্রতিবাদ ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। লাশের মিছিল। কোনো কোনো লাশ বেমালুম গায়েব। মানুষটি তেমনই লুকোন এক লাশ বের করতে তার কাছে এসেছিল। তিনি মনে করতে পারেন না। কে সেই মানুষ? তার দু-চোখ রক্তজবার মতো লাল। পাণ্ডুর বিকেলের মতো ফ্যাকাশে উদাস। কে…কে? পরিশেষে চিনতে পারেন। সেদিন…যেদিন চোখের উপর চোখ পড়ে যায়, তিনি কি কেঁপে উঠেছিলেন? এই ভেবে যে ক্ষমতার লক্ষ্যে লাশ ফেলেছেন আর দেশে এসবই রাজনীতি, কখনো ভাবেননি, আশঙ্কা ছিল না; একদিন তিনিও লাশ হবেন। অবশ্য তেমন লাশের প্রকাশ্য বাহারি জানাজা হয়। অথচ কফিনে কোনো মানুষ থাকে না। কুকুর কিংবা বীভৎস খবিশ। তিনি তো সেদিন থেকে এক লাশ। প্রমাণ হয়ে গেছে।

মানুষটি দু-চোখের অশ্রু শুকিয়ে ফেলে। মরুভূমি বিশুষ্ক বাতাস। কেননা যা হওয়ার নয় তেমন কোনো ঘটনা মানুষের সবকিছুকে অলীক করে তোলে। অবিশ্বাস্য হয়ে যায় বেঁচে থাকা। সে বলে, –
‘আপনি আকাশ থেকে তারা খসে পড়ার ঘটনাকে কীভাবে দেখেন?’
‘মানে?’
‘আমার মা অর্থাৎ সেই লাশেরও মা বলতেন, আকাশ হতে তারা খসে পড়া খুব অশুভ। নিজেদের মধ্যে কেউ মারা যায়। আমি পীরগঞ্জে কাজ শেষে যখন ফিরে আসি, মধ্য-দুপুর, প্রচণ্ড রোদ; গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে ঘুরে অসম্ভব ক্লান্ত। অফিসে যেতে হবে। ফিল্ড রিপোর্ট লেখা দরকার। আমার সামনে ওই এলাকার ম্যানেজার। আমি দক্ষিণের আকাশে একটি উজ্জ্বল তারা খসে পড়তে দেখলাম।’
‘দিনের বেলা…দুপুরে? যতসব আজগুবি।’
‘তারাটি ছিল দিনের চেয়েও উজ্জ্বল। তীব্র আলোকচ্ছটা। সাধারণত এমন হয় না।’
‘তারপর?’
তিনি জিজ্ঞেস করেন। তবে বিন্দুমাত্র কৌতূহল ছিল না। সেই মহূর্তে তেমন রূপকথার গল্পইবা কেন? অসহায় বিভ্রান্ত সময়ে এমন কাহিনির পথরেখায় হেঁটে চলা মানুষ আরও নিঃসঙ্গ-দুর্বল-অবলম্বনহীন হতে থাকে। দীর্ঘশ্বাস-নিয়তির স্মরণ করে। আকাশের প্রান্তসীমায় কোণায় কোণায় আকুল দৃষ্টিতে খুঁজে নেয় কোনো ফরিয়াদ। অভিযোগের জলছবি আঁকে। আনুপূর্বিক ঘটনা সামান্য কৌতূহলজনক মনে হলেও মজা করতে ইচ্ছে জাগে না। কেননা এই মৃত্যুকে করুণায় ডোবাতে মন চায়। মানুষটি অস্থির-ব্যাকুল দু-একটি কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে। কাঁদতে থাকে। সেই নিশ্চুপ-নিথর প্রলম্বিত অশ্রুধারা নদীর মতো বয়ে চলে। সময় থমকে দাঁড়ায়। মনে হয় গাছের পাতা শুকিয়ে গেছে, আকাশপথে ভেসে বেড়ানো পাখি ভুলে গেছে গান; প্রাণ আকুল বজ্র-নিনাদ শোকধ্বনি বাতাসে ধীরলয় ঢেউ তুলে ভেসে ভেসে যায়। সময় ধারহীন ছুরির ফলায় খুঁচিয়ে তুলতে থাকে। মানুষটির মলিন মুখছবি। গাল টসকানো চোয়ালের উঁচুতে দু-চোখ টকটকে লাল। কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। একসময় স্তিমিত হয়ে অসম্ভব ক্লান্তির ছড় টেনে নেয়। অথবা বিরতি। তখন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার মতো আকুল আবেদন।
‘আমার ভায়ের লাশ বের করে দিন। দাফন করব। ভাইটা আমার না খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল।’
‘আচ্ছা তুমি ভোরবেলা লাশকাটা ঘরে আসো। আশা করি কার্ফুতে শহরের অবস্থা ঝিমিয়ে যাবে। পুলিশ লুকিয়ে রাখা লাশ বের করে দেবে। এরপর লাশের সুরতহাল। তারপর।’
মানুষটি তারপরও পায়ের কাছে কুকুরের মতো বসে থাকে। এদিক-ওদিক অর্থহীন ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি ফেলে যায়। সে আসলে কী দেখছিল? কোনো স্মৃতি? সুখ-দুঃখের ইতিকথা স্মরণ? অথবা অপরিণত বয়সে মৃত ছোটভাইয়ের লাশ। তার কাঁধে ভারী পাথর। ঘোরের মতো বসতে চায়। তিনি তখন সে-সব দেখে অন্যকিছু ভাবেন। আজও মনে আছে। আসলে সবকিছু ক্যারামবোর্ড খেলার নিয়ম-ছক বেঁধে চলে না। কাজ এগোয়। ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তনে অনেককিছু করতে হয়। এরজন্য দু-একটি লাশ পড়তেই পারে। কিন্তু এই লাশ…না না হিসাব মেলে না। লুকিয়ে থাকা মানুষের লাশ বের করে আনা অনেক শক্ত। তিনি নিজেও জানেন না আসলে সেটি হবে কি না, পারবেন কি না; জানা নেই।
পরদিন সেই মানুষ সূর্যের জন্য অপেক্ষা করতে করতে শেষে প্রায় বেভুল-দিশেহারা-অর্ধনগ্ন লাশকাটা ঘরে পৌঁছে যায়। না লাশকাটা ঘর মর্গ চেনা নাই। সে এসে পড়ে খালপাড়া-মেথরপট্টি। বিশুষ্ক মাঠে কয়েকটি শূকর ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। সেখানে হোলি উৎসব। মানুষ এত কান্নার মধ্যেও আনন্দে মেতে উঠতে পারে! সে হত-বিহ্বল। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। একমুহূর্ত নিশ্চল দাঁড়িয়ে সেখান থেকে দৌড়ে পালায়। এখানে-ওখানে। স্খলিত পদ শোকাকুল উন্মাদনায়। কোনো লাশ আসেনি। কোতয়ালির পরিত্যক্ত ল্যাট্রিনের অন্ধকার দেয়ালে দাঁড়িয়ে থাকা এক মৃতদেহ বাইরের ফাঁকফোকরে তাকিয়ে থাকে। বের হতে পারে না।

এর দু-দিনপর গভীর ভোররাত। শহর নিশ্চুপ-নিথর ঘুমিয়ে আছে। প্রতিবাদের দাউদাউ আগুন নিভে গেছে প্রায়। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ। শান্ত-স্বাভাবিক। তখন খুব গোপনে লাশ দাফন হয়ে গেল। পুলিশের গুলিতে প্রতিবাদী মানুষের মরে যাওয়া অনন্ত পাপ। সার্থক চতুর মানুষের কৌশল। লাশ লাশ খেলার রাজনীতি অনেক পবিত্র কর্ম। শেখ রহিম দুপুরে দেখেন, মানুষটি নতুন এক কবরের পাশে পাথর-মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। জনতার বিচ্ছিন্ন কথাবার্তা-চিৎকার-হুংকারের মধ্যে দু-চোখ অসম্ভব ঘোলাটে। পশ্চিম দিগন্তে নির্নিমেষ ধূসর দৃষ্টি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে সেঁটে আছে। সেখানে কি ঈশ্বর? তিনি দেখতে পান? কোন্‌ তামাশার নেশায় মানুষ সৃজন করেছেন? অথবা তিনি কোনো লাশ খুঁজে চলেন? কেননা তখন কয়েকটি জটলা গোরস্থানের ভেতরে এবং বাহিরে বড় অস্থির-বেপরোয়া। তারা কবরের ভেতরে আরও লাশ আছে অবিশ্বাস সন্দেহে খুঁড়ে দেখতে জোরজারি করে। সময় কেমন বদলে যায়, বদলে দেয় সবকিছু; কেননা তাদের আক্রোশ উলটোদিকে ঘুরে গেছে। সেই মানুষ গোররক্ষকের ভূমিকায় নিশ্চল অসহায়ের মতো লাশের ঘুম ভাঙাতে চাইছে না। শেখ রহিম রাস্তায়। টয়োটার হিম-শীতলে বসে থাকেন। অনেক হালকা সুরে রবি ঠাকুরের গান বাজে। তিনি ড্রাইভারকে ক্যাসেট বন্ধ করতে বলেন। জনরোষ সাংঘাতিক। কবর খুলে দেখানো হোক। তিনি সবকিছু দেখেন। এখানে থাকা নিরাপদ নয়। সহসা পাঞ্জাবির পকেট থেকে প্রচণ্ড সাদা রুমাল বের করে মুখ মুছে সরে গেলেন। এখন দাবার পরবর্তী চাল। নতুন হিসাবনিকাশ।

শেখ রহিম পরে এমপি হলেন। আইনসভায় বসে কত আইন তৈরি হল। টাকা-সম্মান-সমৃদ্ধি কামালেন। এখন আলিশান প্রাসাদে থাকেন। আরামের পালঙ্কে স্বর্গের ঘুম। সকাল-বিকাল নিয়মমতো বারান্দায় বসেন। গদি-আঁটা চেয়ার। অবসর জীবনে আনন্দ-ফুর্তির সঙ্গে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় মানুষ দেখেন। তিনি দেখেন মানুষ। তারা দেখে কৌশলী-সফল-সার্থক-সুখী এক মহামানুষ। নাকি তারা লাশ দেখে? তিনি যেমন ওই মানুষটিকে দেখেন, কখনো চিনে নেন; পোড়-খাওয়া ন্যুব্জ বৃদ্ধের মতো অসহায় ব্যক্তি, যার দু-চোখে মৃত মানুষের ফ্যাকাশে হলুদ।

সেও তো আসলে এক লাশ!

গল্প নয়, অভিজ্ঞতা…

শুক্রবারে ছুটি, কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারি সংস্থায় ছুটি থাকে না। ওই দিন হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিতে হয় না মাত্র। তাই সেদিন খুব সকালে বাজার সেরে অফিসে গিয়েছি। শনিবার রানিশংকৈল যেতে হবে। এম সেভেন ভিএইচএস ক্যামেরা ঠিক করছি, ব্যাটারির চার্জ, ভিডিও ক্যাসেট ইত্যাদি। এমন সময় সংস্থার নির্বাহী বললেন, –

‘‌কী করছেন? একটু হরিপুর যান তো, কেউ নেই যে পাঠাই। ম্যানেজারকে বলবেন দুই তিনটা গ্রুপ ঠিক করে রাখবে। নোভিব-নেদারল্যান্ড থেকে ভিজিটর আসছেন, তারা দেখবেন।’

অগত্যা কাজ ফেলে দৌড়তে হলো। রানিশংকৈল হয়ে হরিপুর। কাজ শেষে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে। হিমশীতল বাতাস। উত্তরের শীত অসহ্য। কিন্তু উপায় কি! অফিসে সকল প্রস্তুতির বার্তা দিয়ে বাসায় পৌছতে পৌছতে রাত আট-নয়টা। শরীর-মন ক্লান্ত-অবসন্ন। বিধ্বস্ত চেহারা দেখে মিলা জিজ্ঞেস করল, –

‘দুপুরে খেয়েছ?’

মনে পড়ল, আজ সকলে একসঙ্গে খাওয়ার কথা ছিল। আমরা অনেকদিন একসঙ্গে খেতে বসার সুযোগ পাই না। সে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানিয়ে দিল, অনেক অপেক্ষার প্রহর গুনেছে। জিজ্ঞেস করলাম, –
‘তুমি খাওনি না?’
‌’তুমি আসতে চাইলে…।’

মিলার দিকে সে-সময় আমার দৃষ্টি কেমন হয়েছিল, জানি না। সে সার্ট-প্যান্ট হ্যাঙ্গারে তুলে রাখতে রাখতে টুপ করে বলল, –
‘তোমাকে ছেড়ে আমি খেতে পারি!’

আহা সে-সময় আমার কোনো মোবাইল ছিল না। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। জীবনে এত সুখ আর হয় না।