ট্যাগ আর্কাইভঃ মোকসেদুলের ছোটগল্প

আত্মদহন (ছোটগল্প)

ঝুম তালে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে আজ মেঘ যেন নতুন মিতালী করেছে মাটির সাথে। তাই বন্ধুত্বের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাকে মনের মতো করে ভিজিয়ে দিচ্ছে। এই নিয়ে পুরো তিন দিন হবে বৃষ্টির বয়স। গত শনিবার ভোর রাতে যখন নাছোড়বান্দা এই বৃষ্টির জন্ম হয় তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রেললাইনের বস্তিবাসী। যদিও আষাঢ় আসতে এখনও দশ-পনের দিন দেরী। এসব দিন, মাসের হিসেব নিয়ে কখনো মাথা ঘামায় না ত্রিশষোর্ধ রফিক কিন্তু তার বউ সুমি আবার এসবে ওস্তাদ। মঙ্গল- অমঙ্গল, শুভ-অশুভ এসব বিষয়গুলো বেশ ভাল করেই মেনে চলে ও। বউয়ের চাপে মাঝে মধ্যে সেও এসব নিয়মকানুন মানতে বাধ্য হয়। আকাশের অবস্থা ভালই দেখেই তারা ঘুমিয়েছিল। মন খারাপের কোন চিহ্ন দেখতে না পেয়ে নিশ্চিন্তে সেরাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল দুজন আর তাদের আদরের একমাত্র মেয়ে রাফিয়া। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি শেষে রাতের বেলার টুকটাক ছোটখাট শব্দে এমন মানুষগুলোর ঘুম না ভাঙ্গারই কথা। আর তাই বৃষ্টির শব্দে তাদের ঘুম না ভাঙ্গলেও বৃষ্টির পানি যখন তাদের শরীরে এসে লাগে তখন তারা সবাই জেগে ওঠে। কেননা বস্তিঘরটার চালে বেশ কিছু জায়গায় ফুটো থাকায় খুব সহজেই ঘরের ভেতর পানি ঢুকে পড়ে। বৃষ্টি শুরু হলেই বিছানা-পত্র ভাঁজ করে ঘরের এককোণায় জড়ো করে এই পরিবারের তিনটি মানুষ গুটিঁসুটি মেরে বসে থাকে কখন বৃষ্টি থামবে সেই আশায়। আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর সময় কিংবা যখন আকাশ ফেটে বজ্রের হুংকারের ন্যায় বাজ পড়তে শুরু করে তখন মেয়েটি মায়ের বুকের মুখ গুঁজে সজোরে চিৎকার করে ওঠে। সেই সময় বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় রফিক যখন সুমির মুখের দিকে তাকায় তখন তাঁর কাছে মনে হয় ও যেন হাজারো প্রশ্ন করছে তাকে। মেয়ের ভয়ার্ত গলার চিৎকার, বউয়ের প্রশ্নবিদ্ধ মুখ আর মেঘের গুরুগম্ভির ডাক সব মিলে তখন একটা অন্য রকম পরিবেশের সৃষ্টি হয় তার এই ছোট ঘরটিকে ঘিরে। সেটা ভয়, আতঙ্ক নাকি শঙ্কার রফিক ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। অসহায় পুরুষের মতো তখন সে ভাঙ্গা চালের ফুটো দিয়ে আকাশের বিচিত্র কারুকাজ দেখতে থাকে।

রাত দশটা। রফিক দাঁড়িয়ে আছে শহরের ব্যস্ততম এলাকা এয়ারপোর্ট মোড়ের একটা চায়ের দোকানে। সে যে কারবার করে চা দোকানে সাধারণত তার বসে থাকার কথা না। তারপরেও সে আজ বসেছে। বৃষ্টির কারণে দোকানের বেঞ্চিগুলো আগেই পরিপূর্ন হয়ে গেছে। কোন রকম ভিতরে মাথাটি ঢুকিয়ে বহু কসরৎ করে দাঁড়িয়ে যায় । বাইরে বৃষ্টি তখনও ঝিরঝির করে পড়ছেই। শহরের পিচঢালা পথে যখন ফোঁটাগুলো পড়তে থাকে তখন রাস্তার লাইটের আলোর সাথে তাদের মধ্যে একধরনের ছন্দবদ্ধ খেলার সূচনা হয়। বর্ষার দিনে যখন কেউ কেউ এভাবে আটকে থাকে এবং চিন্তা করার কোন উপায় খুঁজে পায় না তখন অনেকেই বৃষ্টি আর আলোর মধ্যকার এই ছন্দবদ্ধ খেলা উপভোগ করে।
কতই না বিচিত্র মানুষের জীবন। রফিক এই বিষয় নিয়ে যতই ভেবেছে ততই আশ্চর্য হয়ে গেছে। বৃষ্টির এই সময়টিতে চায়ের দোকানে কেউ কাউকে না চিনলেও এখন চায়ের কাপে রীতিমত ঝড় উঠেছে। রাজনীতি, পরিবেশ, সমাজ জীবন, প্রেম, মানুষ সব ধরনের আলাপ জমে উঠে এই সময়। এসব কথার শব্দে মাঝে মধ্যে ঝুম বর্ষার শব্দও অনেকটা ম্লান হয়ে যায়। এইসব মানুষকে নিয়েই রফিকের কারবার। চলার পথে তাদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়ে বাঁচে আরও তিনটা জীবন। সেও মাঝে মধ্যে ভেবেছে এসব থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার। কিন্তু পারেনি। কি এক অজানা কারণে সে বার বার এপথেই ফিরে এসেছে। তিনদিন ধরে তুমুল বৃষ্টির কারণে তিনটা জীবন এখন প্রচন্ড রকমের কষ্টে আছে। বর্ষার সময় লোকজন সাধারণত বাইরে বের হতে চায় আর বের হলেও গাড়ি কিংবা রিক্সা নিয়েই বের হয়ে। আর তখন ইনকামও কমে যায় তার। যদিও বৃষ্টি কখনও তাঁর কোন কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে নি। শুধু গরীব বলে নয় যখন কারো ক্ষুধা লাগে তখন সে অন্ধ হয়ে যায়। সামনে যা পায় তাই খেতে ইচ্ছে করে। তাই গরীরের কাছে বৃষ্টি কখনও কোন সমস্যা তৈরি করতে পারে না। শুধু সাময়িক কষ্ট হয় এই যা। তারপরেও সে বৃষ্টি ভালোবাসে। ভালোবাসে বর্ষায় গুনগুন করে গান গাইতে। রফিক হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত নটা। কিন্তু আকাশ মেঘলা হওয়ায় বাইরে তাকালে মনে হয যেন এগারটাও পার হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে বৃষ্টির রাগ কমতে থাকলে চায়ের দোকানও ফাঁকা হতে থাকে। এবার বেঞ্চিতে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে চায়ের অর্ডার দিয়ে বসে পড়ে ও। তার পাশেই যে ভদ্রলোকটি এই মুহূর্তে বসে সিগারেট ফুঁকছে তাঁর দিকে আড়চোখে দেখে নেয়। সে তৎক্ষনাৎ বুঝে নেয় মাঝবয়সী এই মানুষটি শহরে নতুন। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি প্রমাণ করে তাঁর চোখে ক্লান্তির ছাপ। যেন একটা বিছানা পেলেই ঘুমিয়ে পড়ছে মিনিটের মধ্যেই। বেঞ্চিতে বসার সময় প্যান্টের সাইট পকেটে হাতের ছোঁয়া লেগে যাওয়ায় রফিক আরও বুঝতে পারে লোকটি টাকাওয়ালা মানুষও বটে। মানুষকে ঠকিয়ে যে খায়, চলে সে খুব সহজেই এসব ধরতে পারে। অপরিচিত লোকটির সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে রফিক।

– ভাই আগুনটা একটু দেয়া যাবে? বলেই পকেট থেকে একটা স্টার সিগারেট বের করে। লোকটি কোন কথা না বলে এগিয়ে দেয় নিজের সিগারেটটি।
– ভাই কি এখানেই থাকেন নাকি? প্রায়ই আপনাকে এই দোকানে দেখি। এবার সরাসরি মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন করে রফিক। অথচ সে নিজেই জীবনে কখনো এই এলাকায় এসেছিল কিনা মনে করতে পারে না।
– না ভাই, ঢাকায় এই প্রথম আসলাম। বাড়ী শেরপুর।
– ও আচ্ছা, চেনা চেনা লাগছিল তো তাই বললাম।
– আল্লাহর দুনিয়ার মানুষের মতো কি আর মানুষ নাই।
রফিক বুঝতে পারে শিকার অন্যদিকে মোড় নিেেচ্ছ। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, যাবেন কোথায় আপনি?
– যাবো শাহবাগ, ঢাকা মেডিক্যালে। বলেই লোকটি উঠে দাঁড়ায়। রফিকও সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে। বলে ’আমিও তো যাবে ঐদিকে। চলেন এক সঙ্গেই যাওয়া যাক’ বলেই একপ্রকার জোর করেই লোকটির চা-বিস্কুট এর দাম দিয়ে দেয়। বৃষ্টি তখনও পড়েছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যেই চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ে দু’জন।

বাসের মাঝামাঝি গিয়ে দুইটা সিটে পাশাপাশি বসে পড়ে দুজন। চায়ের দোকান থেকে বের হবার পথে ইতিমধ্যে নামটিও জেনে নিয়েছে সে। আশরাফ। বয়স পঁয়তাল্লিশ কিংবা সাতচল্লিশের কাছাকাছি। চুলগুলোয় সবে পাক ধরেছে। টেনশনে দাড়ি কাটেনি বলে মুখে খোঁচা খোঁচা অসংখ্য দাড়ির জন্ম হয়েছে। হাতে ছোট একটি ট্রাভেল ব্যাগ। যাচ্ছে নিজের মেয়ের কাছে। বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ্য বলে ওকে ডাক্তারের পরামর্শে ঢাকা মেডিক্যালে আনা হয়েছে। বাস দশ মিনিট চলতে না চলতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় আশরাফ। কেউ দেখে ফেলার আগেই খুব দ্রুত হাতের কাজ সেরে নেয় রফিক। একাজে সে পাকা ওস্তাদ। পকেট থেকে টাকার বান্ডিল ও মোবাইলটা নিজের পকেটে ঢুকায়। ইতিমধ্যেই বাস এসে পৌঁছে যায় মহাখালিতে। বাস থামানোর আগেই লাফ মেরে নেমে যায় ও। কিছু দূর যাওয়ার পর মনের অজান্তেই মায়া হয় তার। আশরাফ বলেছিল, ঢাকা মেডিক্যালে যাবে, মেয়ে অসুস্থ্য। কিন্তু এসব ব্যাপারে কোন মায়া দেখালে চলবে না। বরং নিজেরেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। রাফিয়া! তার মেয়ে এখন কেমন আছে কে জানে। সেই সাত সকালে বাসা থেকে বের হয়েছে। বের হবার সময় বারবার করে বলে দিয়েছে ওর জন্য কাঠিওয়ালা লজেন্স নিয়ে যেতে। ফুটপাতে উঠে এক প্যাকেট লজেন্স কিনে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয় রফিক।

(২)

রোববার। অফিসের প্রথম দিন। রফিক দাঁড়িয়ে আছে শহরের ব্যস্ততম মোড় কাওরান বাজারে। বাঁ হাতে ধরে রেখেছে একটা পেপসি সদৃশ্য বোতল। সারাদেশে তুমুল অস্থিরতা চলছে। রাজনৈতিক গোলযোগে ইতিমধ্যে অনেক মানুষ মারা গিয়েছে। মঙ্গলবার বিরোধীদল হরতাল ডেকেছে। আর সেই হরতাল সফল করার জন্যই সে দাঁড়িয়েছে এখানে। যদিও রাজনীতি সম্পর্কে তার নূন্যতম জ্ঞানও নেই। তার কাছে হাসিনা যা, খালেদাও তাই আর এরশাদ সাহেব তো ধরাছোঁয়ার বাইরে। যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন বস্তিবাসীর ভাগ্যে যে কোনরূপ পরিবর্তন হবে না এ বিষয়ে সে নিশ্চিত হয়েছে প্রায় দশ বছর আগেই। অথচ প্রতিবারেই নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে তাদের বস্তিটাও জমজমাট হয়ে উঠে। বিভিন্ন স্তরের নেতা আর পাতি নেতার পদচারণায় ভরে যায় বস্তির ছোট ছোট চায়ের দোকানগুলো। দেখা হলে ভাই বলে সম্বোধন, সালাম-কালাম দেয়ার একপ্রকার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। সে বেশ খেয়াল করে দেখেছে এই একটা সময়েই দেশের মাথাওয়ালারা তাদের খোঁজ খবর রাখে। মাঝে মধ্যে এসব রাঘববোয়ালরা বস্তির ছোট্ট দরজায় মাথা ঢুকিয়ে বলে- কি খালা, চাচীরা সবাই ভাল আছেন তো? তখন রফিক ভাবে আহ্ দেশটা যদি সত্যিই এমন হতো। তখন হয়তো বস্তির চেহারাটাও পাল্টে যেতো। এমন সময় তুমুল হট্টগোলের শব্দ শুনে ভাবনায় ছেদ পড়ে তাঁর। চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখে রাস্তার ঐ পারে এক লোককে গণপিটুনি দিচ্ছে সবাই। মানুষটাকে চিনতে অসুবিধা হয় না । আনছার আলী। চরম ধুরন্ধর। কিন্তু কি কারণে এই দিন দুপুরে ধরা খেল বুঝে উঠতে পারে না। যার কাজ সে সে করবে ভেবে নিজের কাজে মন দেয়। বাঁ হাতে রাখা বোতলটার দিকে আড়চোখে তাকায়। বোতলটির মুখের দিকে একটুকরা লাল কাপড় তখনও ঝুলছে। বা হাতের বুড়ো আঙুলটা লাল বাটনের ওপর রাখা। এখন শুধু মাত্র একটা চাপ দেয়ার অপেক্ষা। বাটনে চাপ পড়লেই স্পার্ক শুরু হলে কাপড়ে আগুন দিয়ে সেটা ছুঁড়ে মারতে হবে বাসের ভেতর। বিনিময়ে সে পাবে এক হাজার টাকা। এমনই নির্দেশনা পেয়েছে সে। তার কাছে এখন টাকাটাই মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘরে তার ক্ষুধার্ত বউ, অসুস্থ্য মেয়ে। এই টাকা পেলেই সে চাল-ডাল কেনার পাশাপাশি মেয়ের জন্য ওষুধও কিনবে। বস্তির বড় ভাই জয়নালের কাছ থেকে গতরাতেই সে এই কাজটির অর্ডার পেয়েছে। বাংলামোটর মোড় থেকে একটা বাস আসছে দেখে প্রস্তুত হতে থাকে। কিন্তু বাসটি কাছে আসা মাত্রই ও দেখে একটি ছোট মেয়ে মায়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে অবিকল রাফিয়ার মতোই, ওর মতোই বয়স হবে মেয়েটির। বাসটি চোখের সামনে দিয়ে কাওরান বাজার মোড় পেরিয়ে ফার্মগেটের দিকে চলে যায়। নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে রফিক। এভাবে আরও আট-দশটি বাস চলে যাওয়ার পর সে সিদ্ধান্ত নেয় আর নয়, মিরপুর দশ নম্বরের দিকে রওয়ানা হয়েছে যে বাসটি সেটিকেই টার্গেট করে ও। কাছে আসা মাত্র বাঁ হাতে রাখা বোতলটি ডান হাতে নেয়। বোতলটি ছুঁড়ে মারার ঠিক আগ মূহুর্তেই প্যান্টের বাঁ পকেটে রাখা মুঠোফোনটি বিশ্রি সুরে ডেকে ওঠায় বাঁ হাতদিয়ে যন্ত্রটি বের করে দেখে সুমির ফোন। রিসিভ বাটনে চাপ দিয়ে ’হ্যালো’ বলা মাত্রই চুপসে যায় রফিক। ফর্সা মুখটা মূহুর্তে লাল হয়ে উঠে। বোতলের রেড বাটনে আর চাপ দেয়া হয়না। তার মেয়ে রাফিয়াকে ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়েছে। শরীরের প্রায় ৩০ শতাংশই পুড়ে গেছে। মুঠোফোনটিকে কানে ধরেই শাহবাগের দিকে দৌড়াতে থাকে। ঘটনাটি ঘটেছে সকালেই। মেয়েকে ডাক্তার দেখানোর জন্য সঙ্গে নিয়ে বের হয়েছিল সুমি। তখনই পেট্রল বোমায় ঝলসে যায় রাফিয়ার শরীর।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ। বার্ন ইউনিটের সামনে অনেক লোকের ভীড়। সবার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। ভেতর থেকে ভেসে আসছে চিৎকার-চেঁচামেচি। ভীড় ঠেলে কর্তব্যরত ডাক্তারকে অনুনয় বিনয় করে ভেতর গিয়ে দেখে তার আদরের মেয়ে শুধু বাবা গো মাগো বলে চিৎকার করছে। কাছে গিয়ে আর নিজেকে সংবরণ করতে পারে না। সেও কেঁদে ওঠে। রফিকের মনে হতে থাকে সবকিছু যেন অনবরত দুলছে। চোখে আবছা দেখতে থাকে। তার মেয়ে যেন বলছে- তুমি আমার বাবা নও, তুমিও হত্যাকারী, মানুষকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছো। রফিকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা জ্বলন্ত বাস। যে বাসটিতে সে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মেরেছে। ভেতর থেকে ভেসে আসছে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের চিৎকার চেঁচামেচি আর দেখতে পায় পুড়ে যাওয়া দেহ। প্রতিটি ছেলে মেয়েকেই মনে হতে থাকে রাফিয়া। তাদের চিৎকারে যেন ভারি হয়ে উঠছে রাজপথের পরিবেশ। রফিক যেখানে বসে ছিল তাঁর তিনটা বেড পরেই একসঙ্গে তিন-চারটা মানুষের কান্না শুনে সে দিকে তাকিয়ে দেখে তার রক্ত আবারও হিম হয়ে যায়। দেখে পরশু রাতের বাসের সেই ভদ্রলোকটি। আশরাফ সাহেব। তিনিও কেঁদে চলেছেন। পাশ থেকে কেউ একজন বলল – আহ বেচারা। গতপরশুই চিকিৎসার বিশ হাজার টাকা হারিয়ে এমনিতেই দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, আজ আবার মেয়েটিকেও হারালো। রফিক আর নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। সে পাগলের মতো নিজের মেয়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে -মাগো, আমি তো পা দুইড়া ধইরা শপথ করতাছি আর কুনো দিন আমি খারাপ পথে যামু না। তোরে দেইখা আমি যে আর ঠিক থাকবার পারছি না মা। সে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে সেই ভদ্রলোকের এগিয়ে যেতে থাকে। চোখে চোখ পড়া মাত্রই ধপাস করে মেঝেতে পড়ে যায় রফিক।

যে বৃষ্টি কোন আনন্দের সংবাদ দেয় না

ঘুমের ঘোরে নাক ডাকার শব্দ অসহ্য লাগে রুনার। ছোটবেলা থেকেই এ-ব্যাপারে সে বেশ খুঁতখুঁতে স্বভাবের ছিল। আর তার কপালেই কি না এমন স্বামী মিললো, যে কিনা নাক ডাকা ছাড়া ঘুমাতেই পারে না। অথচ স্বামীর এই ডাকা স্বভাবটি তার অসহ্য লাগলেও মাঝে মধ্যে যখন হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে ঊঠে যখন, স্বামীর নাক ডাকার শব্দ শুনতে না পেলে মনের অজান্তেই চুপসে যায় রুনা। মনে করে স্বামীর কিছু হলো না তো আবার! ভয়ে ভয়ে স্বামীর বুকের ওপর মাথা এলিয়ে দিয়ে হৃদস্পন্দন শুনতে চেষ্টা করে। আর যাই হোক, মানুষটাকে আসলে জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে সে। এমন সহজ-সরল মানুষ খুঁজে পাওয়া সত্যিই বড় কঠিন। ছোট সংসার। দু’জন মানুষ। পৃথিবীতে আরেকজন মানুষ আনার চেষ্টা করছে তারা। ঢাকা শহরের ছোট একটা টিনশেড ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে দু’জন। সংসারে কোন অভাব নেই। বেশ স্বচ্ছন্দেই কাটছে তাদের দিনগুলো। কাটছিলো।
বলছিলাম রফিকের কথা। রফিক! বয়স ত্রিশের মতো হবে। অল্প লেখাপড়া জানা মানুষ, তবে বেশ সামর্থবান সুপুরুষ। দিনে আনে দিনে খায়। পেশা রিক্সা চালানো। সারাদিন রিক্সা চালিয়েও যখন সে রাতে ঘরে ফেরে, তখনও সে বেশ সতেজ। ফুরেফুরে মেজাজে গান গাইতে গাইতে রুমের ভিতরে ঢুকেই ব্যাগের ভেতর থেকে ছোট্ট একটা পোটলা বের করে বৌয়ের হাতে তুলে দেয়। রুনাও একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে পোটলা খুলে ভেতর থেকে একটা সিংগাড়া বের করে মুখে দেয়। এই জিনিসটা তার খুবই প্রিয় বলে প্রতিদিনই রফিক ঘরে ফেরার সময় কিনে নিয়ে আসে। খাওয়া শেষে যখন তারা রাতে ঘুমাতে যায়, তখন রাজ্যের গল্প এসে ভিড় করে দু’জনার মাথায়। যে মানুষটি আসতে চাচ্ছে তার জন্য কল্পনার বীজ বুনতে থাকে তারা। রফিকের ইচ্ছা, তার প্রথম সন্তান মেয়ে হোক। যার নাম রাখবে সে পূর্বাশা। বেশ সুন্দর নাম। আর রুনার চাওয়া তার একটা ছেলে হোক। আবার তারা দু’জনেই মাঝে মাঝে বলে, ‘ছেলে হোক আর মেয়ে হোক কোন সমস্যা নাই। তাকে লেখাপড়া করে মানুষ করাটাই বড় কথা।’
সত্যিই তো এমন দুর্দিনে ছেলেমেয়েকে মানুষের মত মানুষ করে তোলাটা খুব কষ্টের কাজ। যখন কিনা সন্তানের সামনে মাদক, অস্ত্র আর নানা অসামাজিক কাজের অপার হাতছানি। মাঝেমাঝেই তারা ভাবে, কেন তারা শহরে আসলো। গ্রামে থাকলেই মনে হয় ভাল হতো তাদের।

আর বেশিদিন নেই। রুণার পেট ধীরে ধীরে আগের চেয়ে আরও বড় হতে থাকে। শাড়ি আঁচল দিয়ে পেট ঢেকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে। সেটা দেখে রফিক হেসে হেসে একদিন বলে— ‘আরে ঢেকে রাখ কেন? দেখতে দাও, দেখতে দাও। যে বাবুটি আসছে সে মোটা হবে না চিকন হবে আগে থেকেই দেখে নিই।’ প্রায়ই এমন করে লোকটি। আর একদিন রাতে রুনার পেটের মধ্যে কান পেতে দিয়ে রফিক বলে— ‘দেখছো, বাবুটা আমাকে বাবা, বাবা বলে কেমন করে ডাকছে? অথচ সে মা, মা বলে একবারও ডাকছে না। একেই বলে বাপকা বেটা।’ বলেই হো হো হো করে হাসতে থাকে । তার হাসির শব্দে এক অদ্ভুত ভাললাগা কাজ করে রুনার দেহ-মনে। এমন পাগলামি এখন রফিক প্রায়ই করে থাকে। এমনও হয়েছে যে কোনদিন হয়তো সে রিক্সা বেরই হয় না। রুনা বুঝতে পারে রফিক এখন আগের তুলনায় তাকে আরও বেশি ভালোবাসে। প্রায় রাতেই তারা স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে। সে জাল বড় হতে হতে আকাশ ছুঁতে চায়। তারপরেও তাদের স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয় না।
এমন সুখের সংসারে একদিন রুনার জীবনে হঠাৎ করে ছন্দপতন ঘটে । সেদিন সন্ধ্যার পর থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলো। আকাশ কালো করে নামছিলো বৃষ্টি। যে মানুষটা রাত আটটার মধ্যেই ঘরে ফেরে সে মানুষটা রাত দশটা পর্যন্ত ঘরে না ফেরায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে সে। রাত বারটার দিকে রিক্সা নিয়ে ভিজেই ঘরে ফেরে রফিক। আজ তার সেই ফুরফুরে মেজাজ নেই, মুখে গান নেই। আজ আর আদরের বউয়ের জন্য সে ব্যাগ থেকে কোন পোটলাও বের করে না। ঘরে ঢুকেই ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে। রুনা দ্রুত কপালে হাত দিতে গিয়ে কটু গন্ধে পেয়ে সরে আসে। তার স্বামীর মুখ থেকে তীব্র গন্ধ বের হচ্ছে। বুঝতে পারে কেউ তাকে কিছু খাইয়েছে। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটিকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে আবারও বিছানায় পা মেলে বসে স্বামীর মাথাটি উরুর উপরে নিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে রুণা। যে মানুষটি বিড়ি-সিগারেট তো দূরের কথা পান পর্যন্ত খায় না সে কিনা আজ মরণ নেশা করেছে।
বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর আস্তে আস্তে চোখ খুলে বিড়বিড় করতে থাকে রফিক। রুনা শুনতে পায়, সে বলছে, ওরা আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে বউ। আমারে জোর করে কি সব ছাইপাশ খাওয়া দিছে। তুমি আমাকে বাঁচাও। ওরা বলতে রফিকের বন্ধু, যারা তার সঙ্গেই ঘোরে, এক সঙ্গে রিক্সা চালায়। সেদিন বৃষ্টি হওয়ায় দেরি হচ্ছিল দেখে রফিককে একপ্রকার জোর করে তারা সবাই একটা ছোট্ট ঘুপরি ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে আরও কিছু লোকের দেখা মেলে। তার স্পষ্ট মনে আছে জব্বার তাকে একদিন এখানকার কথাই বলেছিল। কিন্তু সেই জব্বার একরাতে এখান থেকে গিয়ে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পরের দিন সকালেই মারা যায়। জব্বারের কথা মনে হতেই সে ঘর থেকে বের হতে চাইলে তারা জোর করে তাকে বসিয়ে দেয়।
ঘোরের মাঝে সে কতক্ষণ ছিল বুঝতে পারে না। যখন বাইরে আসে দেখে রাস্তায় কেউ নেই। শুধু কয়েকটা দুরপাল্লায় বাস শোঁ শোঁ আওয়াজ তুলে চলে যাচ্ছে।

রুনা কাউকে যে ডাকতে যাবে তারও উপায় নেই। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি আর প্রচণ্ড বাতাস বইছে। এদিকে পেটের ব্যথাও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে তার। উপায় না পেয়ে ঘরের ভেতর যতটুকু পানি ছিল সবগুলো পানিই স্বামীর মাথায় ঢালতে থাকে।
ভোর রাতের দিকে ধীরে ধীরে বৃষ্টির পরিমাণ কমতে থাকে আর এদিকে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হতে থাকে রফিকের দেহ। সকালে রুনার হাউমাউ কান্না শুনে প্রতিবেশীরা এগিয়ে এসে দেখে বিছানার ওপর শুয়ে আছে রফিক। পা দু’টো তখনও তার নিচের দিকে ঝুলানো। আর ঘরের মাঝখানে পেটের তীব্র ব্যথায় গড়াগড়ি খাচ্ছে রুনা। একটু পরেই রুনার কান্নার সঙ্গে আরেকটা সদ্যজাত বাচ্চার টোঁয়া টোঁয়া কান্নার আওয়াজ যোগ হয়। কিন্তু সে কান্নার আওয়াজ কানে যায় না রফিকের।
আকাশ এখনও তার গুমোট ভাবটি ধরে রেখেছে। যেকোন মূহুর্তে আবারও তুমুল বৃষ্টি এসে ধুয়ে নিয়ে যাবে শহরের সকল আবর্জনা। কিন্তু পচে গিয়ে দূগর্ন্ধ বের হওয়া যেসব আবর্জনার কারণে রুনার জীবনের এই পরিণতি তারা কি চিরকালই এই বৃষ্টিতে ভিজে আরও তরতাজা হবে? বৃষ্টি কি তাদের ধুয়ে-মুছে নিয়ে এই শহরটাকে পবিত্র করবে না কোনদিন? এই প্রশ্নটিই ঘুরে ফিরে আসতে থাকে রুনার মনে। আশায়, নিরাশায়, রুনা দুলতে থাকে।

যতীনের হালখাতা

হালখাতার চিঠিটা দ্বিতীয়বারের মতো খুলে বউয়ের চোখের সামনে মেলে ধরে যতীন। তখন রাত্রি দ্বিপ্রহর। নিশ্চুপ পৃথিবীতে দোচালা টিনের ঘরে তখনও দুটি মাত্র প্রাণী জেগে আছে। হিসেব কষছে আগামী পৃথিবীর। অভাবের সংসারে প্রায়ই প্রতিরাতে জেগে থেকে তারা পরের দিনের হিসেব কষে। আর রাতের দেখা স্বপ্নগুলো সকালবেলা ঘুম থেকে জাগতে না জাগতেই কাঁচের টুকরার মতো ভেঙ্গে গেলেও তারা কখনও হতাশ হয় না। পরের রাতে আবারও নবউদ্দামে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। গরীবের দুয়ারে যখন কোন স্বপ্ন এসে হানা দেয় তখন স্বভাবতই আনন্দের সাগরে ভেসে যায় তারা । হোক না সে স্বপ্নটি যতো ছোটই। তবে আজকের জেগে থাকাটা তাদের জন্য একটু ব্যতিক্রম এবং দুঃচিন্তারও বটে। দুঃশ্চিন্তাটা এ কারণেই যে আজ সে একটা হালখাতার চিঠি হাতে পেয়েছে এবং বকেয়া টাকাগুলোও শোধ করতে হবে দ্রুতই। হঠাৎ শাঁ করে একটা দমকা হাওয়া বয়ে যাওয়ায় চমকে ওঠে যতীন। ভয় কি জিনিস যদিও সে আজ পর্যন্ত জানে না। ভুত-প্রেত ওসবে তার বিশ্বাস নেই। কিন্তু কেন যেন হালখাতার চিঠিটা পাওয়ার পর থেকেই এক অজানা আতঙ্ক বাসা বাঁধছে তাঁর মনে ভেতর। বেশ সুন্দর রঙিন খামের ভেতর চিঠিটা খুলে উল্টে-পাল্টে দেখতে থাকে কিন্তু পড়তে পারে না বলে আফসোস হয় তার। এমন নিশুতি রাতে যদি একটা বাক্যও আজ পড়ে সে তাঁর বউকে শোনাতে পারতো তবে কতই না মজার হতো। চিঠিটা ‘হালখাতা’র এই বিষয়টি মনে হওয়ায় ভাবনাগুলো আর বেশিদূর ডালপালা মেলতে পারে না। রসুল খাঁ যখন তাঁর হাতে চিঠি দিয়ে বলেছিল – নেও মিয়া, হালখাতার চিডি, এবার কিন্তু তোমারে আইতেই অইবো।” তখনই তাঁর বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠেছিল। এতো টাকা সে জোগাড় করবে কিভাবে। হাতের পাঁচ আঙুলের উপর নির্ভর করে চলে যার সংসার সে কিছুটা হলেও গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। অনেকের কাছেই হয়তো মনে হতে পারে এ আর এমন কি! সামান্য কয়টি টাকা। কিন্তু যতীনের কাছে এটা রীতিমত প্রায় বিশ দিনের কামলার দাম। প্রথমবার যখন সে বাড়িতে এসে চিঠিটা খুলছিল তখন মনের অজান্তেই তার একটি কোণা ছিঁড়ে যায়। বিষয়টা খেয়াল হয় তাঁর তিন ক্লাশ পড়–য়া ছেলে শৈলেনের কথায়।

-বাবা, তুমি চিডিটা ছিঁইড়া ফ্যাললা?
– হ বাপ, খেয়ালই করবার পাম নাই। টান দেওনের সময় ছিঁইড়া গেল। ছেঁড়া চিঠিটা টান দিয়ে বের করে তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু অশিক্ষিত যতীন কোন অর্থই উদ্ধার করতে না পেরে ছেলের দিকে বাড়িয়ে দেয়। তার কাছ থেকেই জানতে পারে দোকানে মোট বাঁকী পড়েছে দশ হাজার টাকা। গেল সোমবার। হাটের দিন। সারাদিন রইসউদ্দিন ব্যাপারী বাড়ীতে কামলা খেটে যখন বাড়িতে আসে তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। গোসল সেরে হাটের দিকে রওনা দিতে দিতে মাগরীবের আজান দেয়া শুরু হয়। একটু জোরেই পা চালায় যতীন। ব্যাপারীর কাছ থেকে কামলার টাকা নিয়ে তবেই বাজার-সদাই করতে হবে। বাজারে গেলেও সে সবসময় দক্ষিণ দিকের ‘রসুল বস্ত্রালয়’ দোকানটিকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু ব্যাপারী আজ সে দিকটায় অবস্থান করায় বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে। বিশেষ কায়দা করে দোকানটা পাড় হতে গিয়েও সুবিধা করতে পারেনা যতীন। রসুল খাঁ ঠিকই তাকে ধরে ফেলে। গেল বছরের বাঁকীটা যেন এবার ঠিক ঠিক শোধ করে দিয়ে যায় তাঁর ব্যবস্থা করতেই হাতে এই হালখাতার চিঠিটা ধরিয়ে দেয়। যতীন লোকটি এমনিতেই নির্ঝঞ্ঝাট, সহজ সরল মানুষ। তারঁ মতো গরীবের এসব বাঁকী নেয়া শোভা না পেলোও মাঝে মধ্যে এমন পরিস্থির সৃষ্টি হয় যে, বাঁকী না নিয়ে আর উপায় থাকে না। গেল বছর তার বড় মেয়ের বিয়ে দেয়ার সময় জামাই ও মেয়ের কাপড়-চোপড় কিনতে গিয়েই বাঁকী পড়েছিল। কিন্তু অভাবের সংসারে আর বাঁকীটা পরিশোধ করা হয়নি। ‘কি উপায়ে টাকাগুলো পরিশোধ করা যায়’ তাই নিয়েই এই মধ্যরাতে স্বামী-স্ত্রী আলাপ করছিল। বিন্দুমাত্র লেখাপড়া না জানলেও সে বুঝতে পারে এবার টাকাগুলো শোধ করতে না পারলে মান-সম্মান নিয়ে আর হাটে যেতে পারবে না। কারণ গরীবের মান একবার গেলে আর ফেরত আসে না।

শুক্রবার। ছুটির দিন। সবাই এই দিনে কিছুটা আরাম আয়েশে কাটাতে পারলেও যতীনের পক্ষে কখনো এটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বরং সব দিনই সমান। তার জীবনে স্পেশাল বলে কিছুই নেই। গরীবের মাথায় একবার টাকার ভাবনা ঢুকে পড়লে আর বের হতে চায় না। গত তিনদিন ধরে হালখাতার পোকাটি মাথায় ঢোকার পর থেকে সে আর ভাল নেই। পোকাটি বারবার শুধু কামড়াচ্ছে মাথায় তা টাক মাথায়। মুক্তির জন্য সে ছটফট করলেও টাকা জোগাড় করতে না পারায় এ যাত্রায় তার মুক্তি মেলেনি। হালখাতার পোকাটির হাত থেকে মুক্তি পেতেই শুক্রবার এই সাতসকালে সে হাজির হয়েছে রইসউদ্দিন ব্যাপারীর বাড়িতে। গতকাল বিকালে কাজ শেষ করে যাওয়ার সময় বিষয়টি নিযে ব্যাপারীর সাথে তার খোলাখুলি আলাপ হয়েছিল। তিনিও আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। বিনিমযে শুধু বাজার দরের চেয়ে তিন মণ ধান বেশি দিতে হবে আসছে ইরির সিজনে। কোন উপায় না পেযে নিরুপায় যতীন তাতেই রাজী হয়ে যায়। ব্যাপারী তখন সবেমাত্র নামাজ শেষ করে বৈঠকখানায় বসেছে। যতীন তাকে সালাম ঠুকেই বলে উঠে – ব্যাপারী সাব ভালা আছেন?
-হ, ভালা আছি। তোমার দিনকাল কেমন চলছে মিয়া?
-গরীবের আবার দিনকাল কি সাব। আছি কোন রকমে।
– না মিয়া, তুমি তো ভালা মানুষ না। য্যামনেই থাক, শোকর গুজার করতে হয়, বুঝছো।
-জি। বেশি কথা বলতে পারে না যতীন।
-ট্যাহার জন্য আসছো তো নাকি? বলেই পাঞ্জাবীর পকেট থেকে কড়কড়ে নতুন পাঁচ শ টাকার বিশটা নোট যতীনের হাতে তুলে দ্যায়। নতুন টাকার গন্ধ পেয়ে তার ভেতরটা কেমন যেন আনচান করে উঠে। টাকাগুলো নিয়ে সে যখন রাস্তায় বের হয় এই গরমেও সে ঠান্ডা অনুভব করে।

শিশুপুত্র শৈলেন কে সঙ্গে নিয়ে হাটের দিকে রওনা দেয় যতীন। তখনও ঠিক মতো সন্ধ্যাটা ঘনিয়ে আসেনি। সূর্য তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে মাত্র। সন্তানকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য সেও কিছু ভাল মন্দ খেয়ে নিক। রসুল খাঁর দোকানের সামনে গিয়ে অবাক হয়ে যায় যতীন। রং বেরংয়ের বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে দোকান। দেখলেই ধাঁধাঁ লেগে যায় চোখে। দোকানে যাওয়া মাত্রই তাকে হাসি মুখে বসতে দ্যায় রসুল খা। কুশলাদি জিজ্ঞেস করে। দোকানের বাকী পরিশোধ করার সময় সে খেয়াল করে দোকানের ক্যাশ বাক্সটি মনে হয় নতুন কেনা হয়েছে। তার ওপর আবার লাল শালুক কাপড় বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। রসুল খাঁ ও আজ সাদা ধবধবে একটা পাঞ্জাবী পড়েছে। বেশ লাগছে তাকে। টাকা পরিশোধ হয়ে গেলে দোকানের কর্মচারী তাকে একটা সুন্দর গোছানো ঘরে নিয়ে গিয়ে বসতে দেয়। সেখানে টেবিলের ওপর বিভিন্ন খাবার দেখে জিভে জল আসে তার। মানুষের টাকা আদায়ের কতনা বিচিত্র ফন্দি। বাপ-বেটা পেট পুরে খেয়ে যখন বাড়ির দিকে রওনা দেয় তখন রীতিমত রাত হয়ে গেছে। সারাটা পথ বাবার হাত ধরে হাটতে থাকে শৈলেন। আর যতীন হেটে হেঁটেই স্বপ্ন দেখে তার ছেলেও একদিন বড় হয়ে এমন মস্ত বড় একটা দোকানে দেবে হাটে। আর সে ক্যাশ বাক্সে বসে থেকে শুধু টাকা গুনবে। এই মুহূর্তে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সূখী ব্যক্তি। ভুলে যায় ব্যাপারী কাছ থেকে আনা ঋণের টাকার কথা।

বাড়িতে প্রবেশ করেই আচমকা একটা ধাক্কা খায় যতীন। একি! তার বড় মেয়ে এই অসমযে বাড়িতে, কোনরূপ পূর্ব সংবাদ ছাড়াই হাজির। জামাইকে দেখার আশায় ডানে-বামে চোখ ফেরায়। তার ছেলে কখন যে হাত ছেড়ে বোনের কাছে চলে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি।
-কিরে মা, কেমন আছোস, জামাই কোনডে? কিন্তু কথা শেষ করতে পারেনা যতীন তার আগেই বুকের ওপর আছড়ে পড়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেয় মেয়েটি। কাঁদতে কাঁদতে যা বলে শুনে যতীনের মুখ শুকিয়ে পাংশুটে হয়ে যায়। জামাই নাকি বলে দিয়েছে সাতদিনের মধ্যে যৌতুকের বাকীঁ দশ হাজার টাকা দিতে না পারলে মেয়েকে কোনদিন বউ হিসেবে মেনে নেবে না। কথাটি শুনে বাড়ির উঠোনেই মাথায় হাত দিয়ে বসে যায় যতীন। মাথার ভেতরের পোকাগুলো আবারও কিলবিল করতে থাকে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রইস ব্যাপারী, রসুল খাঁর দোকান আর হরেক রকমের মিষ্টি। কিন্তু একি! মিষ্টি ভেতর এতো পোকা কেন? মিষ্টিগুলোর ভেতর থেকে তাঁর জামাইয়ের মুখটাই বা কেন দেখা যাচ্ছে? খেটে খাওয়া যতীন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। সেই মুখের ওপর সে সজোড়ে একদলা থুথু নিক্ষেপ করে।