ট্যাগ আর্কাইভঃ লোকমান হেকিম

ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-৫ শেষ পর্ব

গল্পের চতুর্থ পর্ব এখানে:
ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-৪

গল্পের চতুর্থ পর্বের শেষাংশ:
মুহূর্তেই কোঁয়া কোঁয়া এক সাপের রূপধারণ করে ফেললো। জাহাজের নিচতলা থেকে লোকমান হেকিম দেখছে, জাহাজের জানালা বেয়ে এক বিশাল সাপ কুলসুম দরিয়ায় নামছে।

কোঁয়া কোঁয়া সাপের রূপধারণ করে কুলসুম দরিয়ায় যখন নামছে, তখনই লোকমান হেকিম তাঁর সাথে নেওয়া ঔষধের শিশিগুলো রেডি করে ফেললো। যাতে তাড়াতাড়ি তাঁর করণীয় কাজ সেরে নেওয়া যায়। লোকমান হেকিমের বাম হাত রাখল জানালার বাইরে। যাতে সাপের লেজটা খুব সহজে ধরতে পারে। লোকমান হেকিম ভয়কে উপেক্ষা করে সময়মতো সাপের লেজটা ধরে ফেললো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সাপের লেজ নাড়াচাড়া করতে শুরু করলো। এমন সময় লোকমান হেকিম সাথে নেওয়া এক শিশি ঔষধ সাপের লেজের মাঝা-মাঝি পানিতে ঢেলে দিলো। সাথে সাথে অনেকখানি জায়গা নিয়ে সাপের লেজের চারিদিকের পানি পাথরের মতো হয়ে গেল। পরপর আরও কয়েকটা শিশি ঢেলে দিলো। মুহূর্তেই বিশাল জায়গা জুড়ে পাথর হয়ে গেল। সেই সাথে রাক্ষসী কোঁয়া কোঁয়াও সেই পাথরের নিচেই আটকা পড়ে গেল। এরপর লোকমান হেকিম আর সময়ের অপচয় করলেন না।

তিনি বাদশার মুলুক থেকে জাহাজে উঠার সময় সাথে একটা ব্যাগ নিয়েছিল। সেই ব্যাগের ভেতরে কী ছিল তা আর কেউ জানতো না। সেসময় বাদশা তো কোঁয়া কোঁয়ার সাথে জাহাজের উপরেই বসা ছিল। আর অপেক্ষায় ছিল লোকমান হেকিমের। লোকমান হেকিম সাথে কী এনেছিল, সেইদিকে বাদশা আর নজর রাখেনি। সেই ব্যাগে করে লোকমান হেকিম নিয়েছিল পিতলের দু’টি হাত। সেই হাত দুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি পাথর হয়ে যাওয়া জায়গায় নামলেন। এরপর লোকমান হেকিমের নিজস্ব কারিগরিতে সেখানে সুন্দরভাবে হাত দু’টি স্থাপন করলেন। এরকম পরিকল্পনা মাথায় নিয়েই লোকমান হেকিম তাঁর বন্ধু বাদশাকে সাগর ভ্রমণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাই তিনি সাথে করে নিজেও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়েছিলেন।

সেখানে লোকমান হেকিমের পিতলের হাত দু’টি স্থাপনের উদ্দেশ্য হলো, এই কোঁয়া কোঁয়া রাক্ষসী কোনো এক সময় মোড়ামুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙে উপরে উঠে যেতে পারে। যদি পাথর ভেঙে উপরে উঠে যায়, তাহলে কোঁয়া কোঁয়া দুনিয়ার সবকিছু তচনচ করে ফেলবে। পুরোপুরিভাবে উঠতে না পারলেও, তাঁর লেজটা পাথরে আটকা থাকা অবস্থায়ও সাগরে চলাচলকারী নৌযান-সহ জাহাজের নাবিকদের আক্রমণ করতে পারে। তাই লোকমান হেকিম এই নির্দিষ্ট জায়গায় পিতলের হাত দুটি স্থাপন করে দেয়। যাতে এই ভয়ংকর জায়গার আশে-পাশে কোনও জাহাজ না আসে। তিনি এমনভাবে হাত দু’টি স্থাপন করেছিলেন, যেন দুটি হাতই না না করে সংকেত দিচ্ছে। স্থাপন করা হাত দুটি যেন সবার উদ্দেশ্যে বলছে, ‘তোমরা কেউ এদিকে আর এসো না, এদিকে আর এসো না।’

লোকমান হেকিমের এরকমই দুঃসাহসিক কাজ মাঝি-মাল্লারা সবাই চেয়ে চেয়ে দেখলো। কিন্তু লোকমান হেকিমের প্রাণপ্রিয় বন্ধু বাদশার কোনও খবর কেউ রাখল না। বাদশা তখনো অজ্ঞান হয়ে জাহাজের দোতলায় বিছানায় পড়ে আছে। লোকমান হেকিম করণীয় কাজ সম্পন্ন করে জাহাজের উপরে তাকিয়ে দেখল, তাঁর বন্ধু বাদশা নেই। মাঝিদের জিজ্ঞেস করলো, ‘আমার বন্ধু বাদশা কোথায়?’ একজন মাঝি দৌড়ে জাহাজের দোতলায় গিয়ে দেখে বাদশা অজ্ঞান হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। উপর থেকেই মাঝি লোকমান হেকিমকে বললো, ‘হুজুর আপনার বন্ধু বাদশাজি অজ্ঞান হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। আপনি তাড়াতাড়ি করে উপরে আসেন।’ লোকমান হেকিম তাড়াতাড়ি জাহাজের উপরে গেলেন। দেখলেন বাদশা ঠিকই অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে। বাদশাকে ঔষধ সেবন করালেন পরপর অনেকবার। কিন্তু বাদশার জ্ঞান ফিরছে না।

এখন বাদশাকে নিয়ে লোকমান হেকিম পড়ে গেলেন দুশ্চিন্তায়! যেই ঔষধ পানিতে ঢেলে দেওয়ার পর পানি পাথর হয়ে যায়, সেই ঔষধের মত ঔষধও বাদশাকে সেবন করানো হয়েছে। তাতেও বাদশা জ্ঞান ফিরছে না। তাই লোকমান হেকিম এখন ভিন্ন রকমের ঔষধ সেবন করাতে চাচ্ছে। কিন্তু তাঁর কাছে আর জ্ঞান ফিরানোর অন্য কোনও ঔষধ ছিল না।আর মাঝ দরিয়ায় তো আর ঔষধি গাছ নে-ই। ঔষধি গাছ সংগ্রহ করতে হলে লোকমান হেকিমকে যেতে হবে বনে জঙ্গলে। তাই তিনি জাহাজের মাঝি-মাল্লাদের হুকুম দিলেন, তাড়াতাড়ি দরিয়ার পাড়ে জাহাজ ভেড়াতে। লোকমান হেকিমের কথামতো মাঝিরা জাহাজ পাড়ে ভেড়াতে করছে প্রাণপণ চেষ্টা, আর লোকমান হেকিম প্রিয় বন্ধু বাদশার পাশে বসে করছে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ।

লোকমান হেকিমের ফরিয়াদ হলো, “হে আল্লাহ! তুমি দয়ার সাগর। তুমি জীবের হায়াতের মালিক। তুমি দয়াল আমার কোল থেকে আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে কেড়ে নিও না। তুমি আমাকে যে কবিরাজি ক্ষমতা দিয়েছ, সেই ক্ষমতার কলঙ্ক করো না। যদি আমার কোলে আমার বন্ধুর মৃত্যু হয়, তাহলে আমি যে হেকিমের বাদশা লোকমান হেকিম, এই নামের আর ইজ্জত থাকবে না, দয়াল। তুমি রহম করো, ইজ্জত রক্ষা করো।”

কিন্তু না, সেদিন লোকমান হেকিমের কোনও ফরিয়াদ মহান সৃষ্টিকর্তা শুনেনি। কারণ, সেদিনই ছিল বাদশার শেষ দিন শেষ সময়। হায়াতের খাতায় বাদশার জন্য আর বিন্দুমাত্র সময় অবশিষ্ট ছিল না। মানে বাদশার হায়াত বা আয়ু শেষ। জীবের আয়ু শেষ তো জীবের মৃত্যু! তা সে হোক বাদশা। হোক সম্রাট। হোক সে রাস্তার ফকির। আয়ু শেষ তো জীবন শেষ! তাই লোকমান হেকিমের কোলেই বাদশা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। কিন্তু লোকমান হেকিম তা আর মেনে নিতে পারছিলেন না। মহান সৃষ্টিকর্তার উপর রাগে গোস্বায় একাকার। লোকমান হেকিম বলতে লাগলো, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার বন্ধুকে আমার কোলেই মৃত্যু দিলে? তাহলে তুমিও শুনে রাখ, হে আল্লাহ! আমি লোকমান হেকিম এমন ঔষধ বানাবো, সেই ঔষধ কেউ সেবন করলে তাঁর আর মৃত্য হবে না। এমনকি সেই ঔষধ মৃত: মানুষের মুখে দিলে মৃতব্যক্তিও জিন্দা হয়ে যাবে। এর জন্য শুধু আমাকে একটু সময় তুমি দাও! যাতে আমি আমার শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারি।’

মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পাক তাঁর আরশে বসে হেসে বলে, ‘না, লোকমান হেকিম। তা তুমি কখনোই পারবে না। সেই সুযোগও আমি তোমাকে দিবো না। এর আগেই সৃষ্টির নিয়ম অনুযায়ী তোমারও মৃত্যু হবে। কারণ, সেই পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই তোমার হায়াত শেষ হয়ে যাচ্ছে। যা আমি আল্লাহ তোমার আয়ুর হিসাবের খাতায় দেখতে পাচ্ছি। তোমার সময় শেষ হতে আর মাত্র এক ঘণ্টা বাকি! এরমধ্যেই তুমি যা খুশি করতে পারবে।’

এই সময়ের মধ্যেই মাঝি-মাল্লাদের আপ্রাণ চেষ্টায় জাহাজ দরিয়ার পাড়ে ভিড়ল। লোকমান হেকিম তাঁর প্রাণের বন্ধুকে জাহাজ থেকে নামালেন। সাগর পাড়ে জঙ্গলের ভেতরে বাদশাকে কবর দিলেন। এরপর জাহাজের মাঝিদের বললেন, ‘তোমরা তোমাদের মুল্লুকে ফিরে যাও! এখানে আমার কিছু করণীয় কাজ আছে। আমি আমার কাজ সমাধা করেই আস্তে-ধীরে মুল্লুকে ফিরবো, যদি হায়াত থাকে।’ জাহাজের মাঝি-মাল্লা লোকমান হেকিমের কথামতো চলে গেলেন। লোকমান হেকিম দৌড় দিলেন জঙ্গলের দিকে। তাঁর চিকিৎসা শাস্ত্র মতে অমরত্ব ঔষধ তৈরি করতে ১০৮ প্রকারের গাছ-গাছালির প্রয়োজন। লোকমান হেকিম জঙ্গলে ঢুকে সেসব গাছ সংগ্রহের কাজে লেগে গেলেন। এক এক করে ঔষধি গাছ সংগ্রহ করতে করতে প্রায় ৫০ প্রকারের গাছ সংগ্রহ করে ফেলে। আর বাকি থাকে ৫৮টি গাছ। এদিকে লোকমান হেকিমের আয়ুর অবশিষ্ট সময়ও দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। তা তো আর লোকমান হেকিম জানতেন না। তা জানতেন যমদূত নামে খ্যাত আজরাইল(আঃ)। একদিকে লোকমান হেকিম জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ঔষধি গাছ খুঁজছে।আরেকদিকে আজরাইল(আঃ) লোকমান হেকিমকে খুঁজছে। কারণ আজরাইল(আঃ)-এর কাছে থাকা মৃত্যু তালিকায় লোকমান হেকিমের নাম লেখা রয়েছে।

এমন সময় লোকমান হেকিমও তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞান দ্বারা টের পেয়ে গেলেন, যে আজকেই তাঁর শেষ সময়। তিনি লোকমান হেকিম বুঝতে পেরেছেন পিছনে পিছনে কে যেন তাড়া করছে। তখন তিনি শুধু তিনিতে নেই। তিনি হয়ে গেলেন ৫০জন লোকমান হেকিম। ৫০ জন লোকমান হেকিম একসাথে জঙ্গলের ভেতরে কী যেন খুঁজছে। আজরাইল(আঃ) তা দেখে অবাক হয়ে গেলেন! তখন আজরাইল(আঃ) মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ করে বললো, ‘হে আল্লাহ! আমার হাতে যেই মৃত্যু তালিকা আছে, সেই তালিকায় লোকমান হেকিমের নাম দেখতে পাচ্ছি। লোকমান হেকিম যে এই জঙ্গলে আছে তাও আমি জানি। কিন্তু হে, বারে এলাহি! আমি এখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। আমি এখন ৫০ জন লোকমান হেকিমকে এখনে দেখতে পাচ্ছি। এখন আসল লোকমান হেকিম কে, তা আমি বুঝতে পারছি না। হে বারে এলাহি! আপনি আমাকে সাহায্য করুন!’

আজরাইল(আঃ) এর ফরিয়াদে মহান সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে গায়েবি আওয়াজ এলো, ‘তুমি এক এক করে সব-কয়টা লোকমান হেকিমের বুকে হাত দিয়ে দেখ কার বুকখানি থরথর করে কাঁপছে। যার বুক কাঁপছে, সে-ই হবে আসল লোকমান হেকিম। তুমি তাঁর জানই কবজ করবে। আর কাউকে তোমার খোঁজার প্রয়োজন নেই।’ আজরাইল (আঃ) এবং মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে গায়েবি বার্তা আদান-প্রদানের সময়টুকুতে হয়ে গেল ১০০ লোকমান হেকিম। এখন আজরাইল(আঃ) যেদিকে তাকায় শুধু লোকমান হেকিমকেই দেখতে পায়। তারপরও আজরাইল(আঃ)-এর চলছে একেক জনের বুকে হাত দিয়ে চেক করা। এদিকে লোকমান হেকিমের মৃত্যুর সময় আছে আর মাত্র মিনিট পাঁচেক বাকি। আজরাইল(আঃ)ও খুব দ্রুত চেক করে যাচ্ছে।

শেষতক একজনের বুকে হাত দিতেই তাঁর বুকটা থরথর করে কেঁপে উঠলো। আজরাইল(আঃ)ও সাথে সাথে তাকে খপ করে ধরে ফেললো। যখন আজরাইল (আঃ)-এর হাতে ধরা পড়লো লোকমান হেকিম। তখন লোকমান হেকিম আজরাইল(আঃ)-এর কাছে একটু সময় চেয়ে বললো, ‘আজরাইল(আঃ), তুমি আমাকে আর ৯টি গাছ সংগ্রহ করার সুযোগ দাও! আমি ১০৮প্রকারের গাছের মধ্যে ৯৯প্রকার গাছ সংগ্রহ করে ফেলেছি। আর ৯টি গাছ আমি সংগ্রহ করতে পারলে এই দুনিয়ায় মানুষের জন্য অমরত্ব ঔষধ বানিয়ে যেতে পারবো। সেই ঔষধ সেবন করলে কেউ আর এই পৃথিবীতে মৃত্যুবরণ করবে না। কারোর মৃত্যুও হবে না। এমনকি কোনও মৃতব্যক্তিকে সেই ঔষধ সেবন করিয়ে দিলে সেই মৃতব্যক্তিও জিন্দা হয়ে যাবে। তাহলে তোমাকেও জীবের মৃত্যু তালিকা নিয়ে আর দুনিয়াতে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না। তুমি আমাকে এই সময়টুকু দাও।’

লোকমান হেকিমের কথা শুনে আজরাইল(আঃ) হেসে বললো, ‘আমি আজরাইল(আঃ) মহান সৃষ্টিকর্তার গোলাম! তাঁর হুকুমের হেরফের আমি করতে পারি না। আমার হাতে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল জীবের মৃত্যু তালিকা থাকে। কার কখন মৃত্যু হবে, কার জান কবজ করতে হবে আমি তা নিয়েই ব্যস্ত থাকি। তোমার মৃত্যুর সময়ও হয়ে গেছে। মৃত্যু তালিকায় তোমার নাম উঠে গেছে। কাজেই আমি এখনই তোমার জান কবজ করবো।’ আজরাইল(আঃ)-এর কথা শুনে লোকমান হেকিম বলতে লাগলো, ‘আমি যদি জানতাম তুমি আমাকে ধরে ফেলবে। তাহলে আমি আগে থেকে গাছের ভেতরে লুকিয়ে থাকতাম।’ আজরাইল(আঃ) হেসে বললো, ‘তোমার সময় যখন শেষ হয়ে গেছে, তখন তুমি যদি সাগরের তলদেশে গিয়ে কোনো এক পাথরের ভেতরেও লুকিয়ে থাকতে, সেখান থেকেও আমি তোমাকে খুঁজে বের করে তোমার জান কবজ করতাম।’ এই বলেই আজরাইল(আঃ) লোকমান হেকিমের দেহ থেকে প্রাণ কেড়ে নিয়ে উধাও হয়ে গেল। লোকমান হেকিমের দেহ পড়ে রইল জঙ্গলের ভেতরে। এভাবেই এখানেই ক্যাম্বাচারদের বলা লোকমান হেকিমের গল্প শেষ হয়ে গেল। কিন্তু বলা হয়নি লোকমান হেকিমের করব কোথায় এবং কীভাবে দেওয়া হয়েছিল।

লেখকের নিজস্ব মতামত প্রকাশ:
গল্পের শুরুতেই বলা হয়েছিল, এই গল্পের সাথে আমি কোথাও কোনও মিল খুঁজে পাইনি। সত্য আর মিথ্যা, তা বিবেচনায় নিবে আমার পাঠক ও সহ-লেখকবৃন্দ। তারপরও এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলে গল্পের পুরো কাহিনী বিফল হয়ে যাচ্ছে। তাই কিছু শোনা কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। শোনা কথা হলো, কোনো এক সাগরের মাঝে দু’টি হাত নিয়ে কথা। যা ছোটবেলা থেকেই আমরা সকলে শুনে আসছি। কিন্তু এর সত্যতা সবার কাছে আজও কেমন যেন অজানাই রয়ে গেল। বর্তমান বিশ্বের নামীদামি কোনও বিজ্ঞানীর কাছ থেকেও এর সত্যতা মেলেনি। কিন্তু কোনো এক সাগরের মাঝখানে যে দু’টি হাত ছিল এবং এক হাতে ডাকে আর এক হাতে না না করে; একথা আজও অনেক মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। এই কথা আর এই কাহিনী অনেকে বিশ্বাসও করে।

এখনো মাঝে মাঝে ৮০ থেকে ৯০ বছরের বুড়ো বুড়িরা বলে, ‘কোনো এক সময় নাকি ব্রিটিশ সরকার ঐ হাত দুটিতে গোলাবর্ষণ করে। কামানের গোলাবর্ষণে একটি হাত বিধ্বস্ত হয়ে নিচের দিকে হেলে পড়ে। এরপর থেকে নাকি হেলে পড়া হাতটি যেন ডাকে, আর ঠিক থাকা হাতটি না না করে।’ তাঁদের মতো আমরাও এমন কথাই ছোটবেলা থেকে শুনছি কোনো এক সাগরে মাঝে এক হাতে ডাকে, আর এক হাতে না করে। আসলে মনে হয় একসময় দুই হাতেই না না করেছিল। যাতে কেউ সেখানে না যায়। কিন্তু হাত দু’টো কে স্থাপন করেছিল তা কারোর মুখে শোনা যায় না। তবে নিজে থেকে একরকম ধারণা করা যায় যে, লোকমান হেকিমের স্থাপন করা হাত দু’টি বর্তমানে না থাকলেও, সেই জায়গাটা ঠিকই আছে বলে মনে হয়। সেই ভয়ংকর জায়গাটা হতে পারে বর্তমান গোল্ডেন ট্রাঙ্গল। যেখানে আজ পর্যন্ত কোনও জাহাজ যেতে পারেনি। যদিও কেউ ভুলবশত সেখানে গিয়েছে তো বিপদ হয়েছেই। এমনও হয়েছে কেউ আর ফিরে আসতে পারেনি। তাহলে এখানে কী বোঝা যাচ্ছে? যা-ই বোঝা যাক বা না যাক, আর গল্পের কাহিনী যা-ই থাকুক না কেন, এখানেই থেকে যাচ্ছে সেসব শোনা কথার অজানা রহস্য।

ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-১

ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-৪

গল্পের তৃতীয় পর্ব এখানে:
ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-৩

গল্পের তৃতীয় পর্বের শেষাংশ:
কুলসুম দরিয়ার মাঝে পৌঁছতে আর অল্প ক’দিনের পথ বাকি। এরপরই শুরু হবে কোঁয়া কোঁয়া আর লোকমান হেকিমের কেরামতি।

কোঁয়া কোঁয়ার সাথে সেদিন লোকমান হেকিমের কথা-বার্তা এ-ই পর্যন্তই শেষ। মানে পাকাপাকি কথা। কোঁয়া কোঁয়া আর লোকমান হেকিমের কথা-বার্তার সময় বাদশা যে জ্ঞানহারা হয়ে পড়েছে, তা ছিল বন্ধু লোকমান হেকিমের অজানা। বাদশার সাথে কথা হয় সাগর ভ্রমণের যাত্রাপথে ক’দিন আগে। শেষ বিরতির সময়। বাদশার মুল্লুক থেকে জাহাজ ছেড়ে আসার পর থেকে লোকমান হেকিমের সাক্ষাৎ হয়েছিল দুই-তিন বার। তাও সাগর পথে জায়গায় জায়গায় বিরতির এক ফাঁকে দেখা করতেন। আলাপও সারতেন গোপনে। এছাড়া লোকমান হেকিম এই যাত্রাপথে কোনও সময় জাহাজের উপরে উঠে বাদশার সাথে দেখা করতে পারেনি, দেখা করে-ও-নি।এভাবেই যাচ্ছে দিন, গড়াচ্ছে মাস। এভাবেই চলছে জাহাজ। পাড়ি দিচ্ছে সাগরের পর সাগর। এভাবে আর দুইএক দিন চললেই পৌঁছে যাবে কুলসুম দরিয়ার মাঝে। কিন্তু বাদশার কোনও সাড়াশব্দ নেই।

বাদশার সাড়াশব্দ না পেয়ে লোকমান হেকিম নিজে থেকেই কোঁয়া কোঁয়াকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাবীসাহেবা, আমার বন্ধুর তো কোনও সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। উনি কি ঘুমাচ্ছে?’ কোঁয়া কোঁয়া বললো, ‘চিন্তার কোনও কারণ নেই, ‘উনি ঘুমাচ্ছে।’ আসলে কিন্তু বাদশা জ্ঞানহারা হয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে। কোঁয়া কোঁয়া মিথ্যের বলার কারণ হলো, লোকমান হেকিমকে শুধু শান্তনা দেওয়া। যদি বলে বাদশা জ্ঞানহারা, তাহলে লোকমান হেকিম সোজা উপরে চলে আসবে। লোকমান হেকিম যেন উপরে না আসে, তাই মিথ্যে কথা বলা। এরপর অবশ্য বাদশার জ্ঞান আপনা-আপনি ঠিকই ফিরেছে। বাদশার জ্ঞান ফেরার পর কোঁয়া কোঁয়াকে দেখেই বাদশা আবার ভয়ে কেঁপে উঠলো।

বাদশার এই অবস্থা দেখে কোঁয়া কোঁয়া বাদশার সামনে গিয়ে আস্তে আস্তে বললো, ‘আপনি ভয় পাবেন না। আমি আপনার কোনও ক্ষতি করবো না। আপনি আমাকে জঙ্গল থেকে টেনে নিয়ে আপনার মহলে ঠাঁই দিয়েছেন। তা আমি ভুলে যেতে পারি না। যদিও আমি মানুষ নই, তবুও আমি আপনার ক্ষতি করবো না। যদি আপনার ক্ষতি করার ইচ্ছে আমার থাকতো, তাহলে তো আমি আপনার মহলে বসেই ক্ষতি করতে পারতাম। আপনি যখন সোনা বনে হরিণ শিকারে গেলেন, তখনও আমি ক্ষতি করতে পারতাম। কিন্তু আপনার ক্ষতি আমি করিনি। শুধু আশ্রয় নিয়েছি আমার মনোমত আহার সংগ্রহের জন্য।

‘আমি ছোটবেলা থেকে সোনা বনে ঘুরেফিরে বড় হয়েছি। বাবাকে দেখিনি। মায়ের মুখে শুনেছি আপনার মতো এক রাজা হরিণ শিকারে এসে বাবাকে তীর মেরে মেরে ফেলেছে। আমার মাকে মরেছিল একজন হেকিম। ওই হেকিম প্রায়ই সোনা বনের গহীনে গিয়ে ঔষধি গাছগাছালি সংগ্রহ করতো। একসময় বনের গহীনে আমার মায়ের গন্ধ উনার নাকে লাগলো। আমার মা-ও হেকিমের সামনা-সামনি হয়ে গেল। ওমনি হেকিম উনার বানানো ঔষধ আমার মায়ের উপর নিক্ষেপ করে। এরপর মায়ের মৃত্যু হয়েছে মনে করে হেকিম তাড়াতাড়ি সোনা বন থেকে চলে যায়। মা বনের গহীনে পড়ে ছটফট করছিল। তখন আমি ছিলাম খুবই ছোট। সেদিন আমি ছিলাম এক বড় গাছের গর্তের ভেতরে। যেখানে মা আমাকে রেখে আহারের সন্ধানে বেরিয়েছিল। আমি গর্তের ভেতরে ঘুমিয়ে ছিলাম। চিৎকার শুনে দৌড়ে মায়ের সামনে আসি। মা আমাকে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে গিয়েছিল, একজন মনুষ্য হেকিম মায়ে শরীরে কি যেন নিক্ষেপ করেছিল। এরপরই মায়ের মৃত্য হয়।

‘মায়ের মৃত্যুর পর আমি একা হয়ে গেলাম। সোনা বনে পশুপাখি ধরে ধরে খেতাম। খেতে খেতে সব পশুপাখি শেষ করে ফেললাম। আমার ভয়ে সোনা বনে পশু তো আসতোই না, একটা পাখিও উড়ে আসতো না। যখন আর আহার সংগ্রহ করতে পারছিলাম না, তখন ভিন্ন বেশে রাতের অন্ধকারে সোনা বনের আশপাশের গ্রামে ঢুকতাম। মানুষের গরুছাগল হাঁস মুরগী ধরে ধরে খেতেম। এমনকি ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে সময় সময় মানুষও ধরে খেয়ে ফেলতাম। ভোর না হতেই আবার সোনা বনের গহীনে চলে আসতাম। এভাবে চলতে চলতে সোনা বনের আশপাশের গ্রামের মানুষজন আমাকে বধ করার জন্য উঠেপড়ে গেলে যায়। আমিও ছিলাম মনুষ্য ভয়ে। কারণ আমার বেশ ধরার কেরামতি আর শারীরিক শক্তি যতই থাকুক-না-কেন, মানুষের বুদ্ধির কাছে আমি সবসময়ই শূন্য। আমি বুদ্ধিহীন শক্তিহীন কেবল মানুষের কাছেই। তাই আমি মানুষকে খুবই ভয় পাই না। মানুষের ভয়ে ভয়ে থাকতে থাকতে এমন সময় আপনার দেখা পেলাম। মানুষ বেশে আমার সামনে এলাম। আপনি আমাকে পরিধান করার মত বস্ত্র দিলেন। আদর করে বুকে টেনে নিলেন। আপনার স্ত্রীর মর্যাদা দিলেন। আমিও আশ্রয় পেলাম। আপনার মুল্লুক হলো আমার নতুন মুল্লুক। আপনার মুল্লুকের মানুষের কাছে আমি ছিলাম অজানা। তাই ক’দিন রাতের অন্ধকারে মনের আনন্দে আহার করেছিলাম। মনে করেছিলাম সারাজীবন এভাবে থেকে মনের আনন্দে ঘুরাঘুরি করবো। কিন্তু তা বুঝি আর হলো না। আমি যে মানষ নই, তা টের পেয়ে গেল আপনার বন্ধু লোকমান হেকিম।

‘আমি এখন বুঝতে পেরেছি আমার মাকে কে মেরেছিল। আমি নিশ্চিত, আমার মাকে আপনার এই বন্ধু লোকমান হেকিমই মেরেছিল। এখন আবার উনারই একটা পরীক্ষার মধ্যেও আমি পড়ে গেলাম। যা কিনা কুলসুম দরিয়ার তালা আছে কি নেই, সেই পরীক্ষা। আমি তা প্রমাণ অবশ্যই দেখাবো। এরপর হবে লোকমান হেকিমের সাথে আমার বোঝাপড়া। আপনি নির্ভয়ে থাকুন!’

কোঁয়া কোঁয়ার জীবন কাহিনী শুনে বাদশা আবারও হার্টফেল করলো। তখন কোঁয়া কোঁয়া জ্ঞানহারা বাদশাকে বিছানায় শোয়াইয়া দিলেন। বাদশা নীরবে নিঃশব্দে ঘুমাচ্ছেন। জাহাজ চলছে শোঁ শোঁ করে। সগরের ঢেউয়ের শব্দে উপর থেকে কোঁয়া কোঁয়ার কথার আওয়াজ নিচে আসেনি। তাই আর লোকমান হেকিম তাঁদের কথা কিছুই শুনেনি। লোকমান হেকিম শুধু কুলসুম দরিয়ায় পৌঁছানোর অপেক্ষায় থাকলো।

একসময় বেতের জাহাজ কুলসুম দরিয়ার মাঝে পৌঁছাল। লোকমান হেকিম মাঝি-মাল্লাদের থামতে বললেন। মাঝিরা জাহাজের বৈঠা টানা বন্ধ করলেন। জাহাজ থামলো। লোকমান হেকিম কোঁয়া কোঁয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘ভাবীসাহেবা, ‘আপনি কি সজাগ? আমরা কিন্তু কুলসুম দরিয়ার মাঝখানে আছি। এখানে শুধু পানি আর পানি। নিচে কোনও তলা নেই।’ কোঁয়া কোঁয়া আবারও হেসে বললো, ‘আপনি একজন মস্তবড় হেকিম হয়ে আহাম্মকের মতো কথা বলছে কেন? সব দরিয়ার তলা আছে। তলদেশ আছে। সাগরের তলাই যদি না থেকে তো সাগরের পানি থাকছে কিসের উপরে? এই দরিয়ারও তালা আছে। তা আমি অবশ্যই প্রমাণ দেখাবো।’ লোকমান হেকিম বললেন, ‘এটা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না ভাবীসাহেবা। আপনার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে আপনাকে অবশ্যই এর প্রমাণ দেখাতে হবে। আর আপনি আগেও বলেছেন কুলসুম দরিয়ার যে তলা আছে, তা আপনি প্রমাণ করে দেখাবেন। আমি ভাবীসাহেবা আপনার প্রমাণ দেখার অপেক্ষায় আছি। দেরি না করে আপনি আপনার কেরামতি শুরু করুন! আমি উপর থেকে তা পর্যবেক্ষক করতে থাকি।’ কোঁয়া কোঁয়া বললো, ‘ঠিক আছে, আমি এক্ষুনি সাপের রূপধারণ করে দরিয়ার নিচে যাচ্ছি। দরিয়ার তলায় গিয়ে আমি আমার লেজ নাড়াচাড়া করলেই, বুঝে নিবেন আমি কুলসুম দরিয়ার তলার মাটি স্পর্শ করেছি।’ এছাড়াও আমি ফিরে আসার সময় আমার মুখে করে কুলসুম দরিয়ার নিচের মাটি নিয়ে আসবো।’

লোকমান হেকিম বললো, ‘ঠিক আছে ভাবীসাহেবা, আপনি যেকোনো রূপধারণ করে কুলসুম দরিয়ার নিচে যেতে পারেন। আমি উপর থেকে তা দেখছি।’ মুহূর্তেই কোঁয়া কোঁয়া এক সাপের রূপধারণ করে ফেললো। জাহাজের নিচতলা থেকে লোকমান হেকিম দেখছে, জাহাজের জানালা বেয়ে এক বিশাল সাপ কুলসুম দরিয়ায় নামছে।

চলবে…

ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-৫ শেষ পর্ব!

ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-৩

গল্পের দ্বিতীয় পর্ব এখানে:
ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-২

আগের পর্বের শেষাংশ:
নিরুপায় বাদশা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে থাকা খাটের এক কোণে বসে বসে ভাবতে লাগলেন, আজ হয়তো আমার নির্ঘাত মৃত্যু-ই হবে।

বাদশা এমন দুশ্চিন্তা নিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লেও, সেই রাতে বাদশার তেমন ঘুম হয়নি! মৃত্যুও হয়নি। ভোর হতে-না-হতেই বাদশা আবার ছুটে গেলেন বন্ধু লোকমান হেকিমের বাড়ি। বাদশার এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না। খাওয়া নেই। নাওয়া নেই। ঘুম নেই। বাদশা এখন শারীরিক দিক দিয়েও ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। বাদশাকে দেখে লোকমান হেকিম জিজ্ঞেস করলো, ‘বন্ধু, বেতের নৌকার খবর কী’? আর আমি তোমাকে বলেছি বেতের নৌকা। তা আসলে কিন্তু ছোট্ট একটা নৌকা নয়! হতে হবে বিশালাকৃতির এক জাহাজের মতো। যেহেতু আমরা সাগরে যাবো, সেহেতু আমাদের নৌযান হতে তার উপযোগী। সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ অতিক্রম করে আমাদের সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। কাজেই আমাদের নৌযানও থাকতে হবে ঐরকমই। আর মাঝিমাল্লাও থাকতে হবে পর্যাপ্ত। বেতের জাহাজ চলবে দিনরাত। মাঝিরা কেউ কাজ করবে, কেউবা বিশ্রামে থাকবে। তুমি সেইভাবেই জাহাজটা তৈরি করবে, বন্ধু।’

বাদশা বললো, ‘আমি জানি সাগরে চলার জন্য কোন ধরনের নৌযান উপযোগী। তোমার এব্যাপারে বলার আগেই আমি ইতোমধ্যে বেতের জাহাজ তৈরি করার জন্য শ’খানেক লোক লাগিয়ে দিয়েছি। তাও হবে দোতলা জাহাজ। জাহাজে থাকবে শখানেক মাঝিমাল্লা। থাকবে দীর্ঘদিনের খাবার সামগ্রী। আমার উজির সাহেব বললেন, খুব শীঘ্রই জাহাজ তৈরির কাজ শেষ হয়ে যাবে।’

লোকমান হেকিম বললো, ‘ঠিক আছে বন্ধু। তা-ই যেন হয়! আর তোমার কোঁয়া কোঁয়াকে সাগর ভ্রমণের ব্যাপারে কিছু বলেছ’? উত্তরে বাদশা বললো, ‘না বন্ধু! তা আর বলা হয়নি। তবে আজকেই রাক্ষসী কোঁয়া কোঁয়াকে বলবো’। লোকমান হেকিম বললো, ‘তাহলে এখন তুমি তোমার মহলে গিয়ে বিশ্রাম করো। আর বেতের জাহাজ তৈরির কাজে তদারকি করো। যাতে অতি তাড়াতাড়ি জাহাজ তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়। আর তোমার কোঁয়া কোঁয়াকে ম্যানেজ করো’। এই বলেই লোকমান হেকিম বাদশাকে তাঁর মহলে জোর করে পাঠিয়ে দিলেন। বাদশা আগের মতোই ভয়ে ভয়ে মহলের দিকে রওনা দিলো।

বাদশা মহলে গিয়ে কোঁয়া কোঁয়াকে বললো, ‘ক’দিন পর আমরা সাগর ভ্রমণে বের হবো। নতুন বিবাহ করেছি তো, তাই তোমাকে নিয়ে হানিমুনে যাবো। কী বলো, কোঁয়া কোঁয়া?’ উত্তরে কোঁয়া কোঁয়া জবাব দিলো, ‘এসব আমার কিছুই ভালো লাগে না জাঁহাপনা। আপনি বরং নিজেই সাগর ভ্রমণে যান। আমি মহলেই থাকি। এতদিন বন জঙ্গলে ছিলাম। ভাগ্যক্রমে আপনার দেখা পেলাম। আপনাকে স্বামী হিসেবেও পেলাম। এখন আপনার মুল্লুক ছেড়ে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।’ বাদশা বললো, ‘না কোঁয়া কোঁয়া, তা হয় না। তোমাকে আমার সাথে যেতেই হবে। না গেলে আর হচ্ছে না।’ বাদশার অনুরোধে শেষতক কোঁয়া কোঁয়া রাজি হলো। বেতের জাহাজ তৈরি করা সম্পন্ন হলো। জাহাজের ভেতরে মাসেক ছ’মাসের খাদ্যসামগ্রী তোলা হলো। সাগর ভ্রমণে যাবার দিনতারিখ ঠিক হলো। যাবার আগের দিন লোকমান হেকিমকে জানানো হলো। সঠিক সময়ে বাদশা কোঁয়া কোঁয়াকে নিয়ে বেতের জাহাজের দোতলায় গিয়ে উঠলো। মাঝিরাও জাহাজ ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে। অপেক্ষা শুধু লোকমান হেকিমের জন্য। কিন্তু বাদশার বন্ধু লোকমান হেকিম আসতে দেরি হচ্ছে। দেরি হবার কারণ হলো লোকমান হেকিম সাথে করে যেসব প্রয়োজনীয় কিছু ঔষধপত্র সাথে নিবেন, সেগুলো গোছাতেই হলো দেরি।

জাহাজের দোতলায় বাদশার সাথে বসে আছে রূপসী কোঁয়া কোঁয়া। কোঁয়া কোঁয়া বাদশাকে বলছে, ‘কী ব্যাপার জাঁহাপনা, জাহাজ ছাড়ছে না কেন?’ জবাবে বাদশা বললো, ‘মাঝিরা আমার বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছে। আমার বন্ধু আসলেই জাহাজ ছেড়ে দিবে।’ কোঁয়া কোঁয়া বললো, ‘এটা আপনার কোন বন্ধু, জাঁহাপনা? ঐযে, সেদিন আপনার সাথে যাকে দেখলাম, তিনি?’ বাদশা মাথা নেড়ে জবাব দিলো, ‘হ্যাঁ কোঁয়া কোঁয়া। এই বন্ধুটি ছাড়া আমি একদম চলতে পারি না। আমার যেখানেই যাওয়া হয়, আমি আমার বন্ধুকে নিয়ে সেখানে যাই।’ কোঁয়া কোঁয়া এবার খুব রাগ হয়ে বাদশাকে জিজ্ঞেস করলো, জানতে পারি, আপনার বন্ধু কী করে?’ বাদশা নির্ভয়ে মনে আনন্দ নিয়ে জবাব দিলেন, ‘আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু হলেন হেকিম। তাঁর নাম লোকমান হেকিম। তিনি গাছেদের সাথেও কথা বলতে পারেন।’ লোকমান হেকিমের কথা শুনেই কোঁয়া কোঁয়া রেগেমেগে অস্থির হয়ে বললো, ‘আমি সাগর ভ্রমণে যাবো না। আপনি আপনার বন্ধুটিকে সাথে নিয়ে ঘুরে আসুন!’ বাদশাও এবার একরকম রাগের মাথায় ধমক দিয়ে বললেন, ‘আমার বন্ধু আমার সাথে যাবে, তাতে তোমার সমস্যা কী? আমিতো তোমার কোনও সমস্যা দেখছি না! প্রয়োজনে আমার বন্ধু জাহাজের নিচতলায়ই থাকবে। তবুও আমার প্রিয় বন্ধু সাথে যাবে।’

বাদশার এমন রাগ দেখে কোঁয়া কোঁয়া একটু নরম হলেন। চুপ করে বসে বসে কী যেন ভাবলেন। এরপর নিজে থেকেই বলে ফেললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে জাঁহাপনা। উনি আসুক! নিচতলায় যখন থাকবে, তো আমার কোনও সমস্যা নেই! তবে হ্যাঁ, উনি যেন কোনও অবস্থাতেই উপর তলায় না উঠে। কারণ, আমি পরপুরুষের ছায়া দেখি না।’ কোঁয়া কোঁয়ার কথায় বাদশা মাথা নেড়ে সায় দিলেন। এমন সময় লোকমান হেকিম তাঁর প্রয়োজনীয় ঔষধাদি সাথে নিয়ে জাহাজের সামনে হাজির হলেন। জাহাজে উঠে নিচতলায় গিয়ে বসলেন। মাঝিদের জাহাজ ছাড়ার জন্য বললেন। মাঝিরা জাহাজ ছাড়লেন। জাহাজ চলছে অজানার উদ্দেশে। কোথায় যাবে, কোনদিকে যাবে তার নির্দেশনা দিচ্ছেন, লোকমান হেকিম নিজেই। এভাবে চলতে চলতে দুই মাস পার হলে গেল। তবুও চলছে বেতের জাহাজ। এরমধ্যে কোথাও কোথাও বিরতিও চলছে। বিরতির সময় জাগায় জাগায় নেমে সবাই এদিক সেদিক ঘোরাফেরাও করছে। আবার চলছে জাহাজ অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে।

একসময় কোঁয়া কোঁয়া বিরক্ত হয়ে বাদশাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘জাঁহাপনা, আপনার ভ্রমণের গন্তব্যস্থান কোন সাগর পাড়ে? যেখানে যাবেন, সেখানকার নামটা জানতে পারি?’ কোঁয়া কোঁয়ার কথা শুনে বাদশা রীতিমতো থ বনে গেল! কোঁয়া কোঁয়ার কথার জবাব না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ তুলতেই, নিচ থেকে লোকমান হেকিম বললো, ‘বন্ধু তোমার স্ত্রীকে বলো, আমরা ঠিক কুলসুম দরিয়ার কাছাকাছিই যাবো।’ লোকমান হেকিমের কথা শুনে কোঁয়া কোঁয়া হাসতে লাগলো। কোঁয়া কোঁয়ার হাসির শব্দ লোকমান হেকিমের কানে এলে, লোকমান হেকিম নিচ থেকে জানতে চাইলেন, ‘হাসির রহস্য কী?’ লোকমান হেকিমের জিজ্ঞাসার জবাবে কোঁয়া কোঁয়া বললো, ‘কুলসুম দরিয়া আমার খুবই পছন্দের।’ কোঁয়া কোঁয়ার মুখে এই কথা শুনে বাদশা ভয়ে থরথর! তারপরও তেমন ভয় পাচ্ছে না, কারণ বন্ধু লোকমান হেকিম সাথে আছে বলে।

কুলসুম দরিয়া কোঁয়া কোঁয়ার কাছে খুবই পছন্দের! এমন কথা শোনার পর লোকমান হেকিম বললেন, ‘বাহ্, বেশ তো! তাহলে তো অচেনা অজানা জায়গা নিয়ে আমাদের আর কোনও চিন্তাই নেই। এমনিতেই কুলসুম দরিয়ার পানিতে আঁশ নেই। যাকে বলে দো-আঁশ পানি। শুনেছি এই দরিয়ার পানিতে কোনকিছু ভেসে থাকে না। এ-ও শুনেছি যে, এই দরিয়ার নাকি কোনও তলাও নেই। শুধু পানি আর পানি। তা কী ঠিক, ভাবীসাহেবা? আমি কি তা ভুল শুনেছি?’ লোকমান হেকিমের কথার জবাবে কোঁয়া কোঁয়া বললেন, ‘যতসব আহাম্মকের মতো কথাবার্তা! দরিয়ার যদি তলাই না থাকে, তো এতো পানি আছে কিসের উপর? অবশ্যই পানিগুলো একটা পাত্রের উপরেই আছে! শুধু কুলসুম দরিয়া কেন, দুনিয়ায় সব নদীনালা, সাগর মহাসাগরেরও তলা আছে।’

এবার লোকমান হেকিম হেসে বললেন, ‘আমার বিশ্বাস হয় না যে কুলসুম দরিয়ার তলা আছে। আর যদি থেকেই থাকে, তো আপনাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে। কুলসুম দরিয়ার তলা আছে তা কি আপনি প্রমাণ করতে পারবেন, ভাবীসাহেবা?’ কোঁয়া কোঁয়া রাগে গোস্বায় বললো, ‘অবশ্যই প্রমাণ দেখাতে পারবো।’ লোকমান হেকিম বললেন, ‘তা কীভাবে আপনি প্রমাণ দেখাবেন যে কুলসুম দরিয়ার তলা আছে?’ কোঁয়া কোঁয়া বললো, কুলসুম দরিয়ার মাঝখানে যাওয়ার পর আমি একটা সাপ হয়ে পানির নিচে যাবো। আমার লেজটা থাকবে আপনার হাতে। আমি কুলসুম দরিয়ার তলদেশে গিয়ে লেজ নাড়াচাড়া করলেই বুঝতে হবে আমি কুলসুম দরিয়ার তলদেশে পৌঁছেছি। আর নাহয় কুলসুম দরিয়ার তলদেশ থেকে আমি আমার মুখে করে মাটি নিয়ে আসবো। তাহলেই তো প্রমাণ হয়ে গেল যে কুলসুম দরিয়ার তলা আছে!’ এখন আপনি কোনটাতে রাজি?’

লোকমান হেকিম বললেন, ‘আপনাকে কষ্ট করে এতো নিচ থেকে মাটি কামড়ে আনতে হবে না, ভাবীসাহেবা। আপনার লেজটা যদি আমার হাতেই থাকে, নিচে গিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলেই প্রমাণ হয়ে যাবে কুলসুম দরিয়ার তলা আছে।’ কোঁয়া কোঁয়া তাতেই রাজি হয়ে বললো, ‘ঠিক আছে হেকিম সাহেব তা-ই হবে।’ কোঁয়া কোঁয়ার মুখে এমন কথা শোনার পরই বাদশা জ্ঞানহারা হয়ে গেলেন। বাদশার আর কোনও হুশ নেই, জ্ঞানও নেই। বাদশা একটা মরা লাশের মতো শুইয়ে আছে। বেতের জাহাজও চলছে জোরেসোরে। কুলসুম দরিয়ার মাঝে পৌঁছতে আর অল্প ক’দিনের পথ বাকি। এরপরই শুরু হবে কোঁয়া কোঁয়া আর লোকমান হেকিমের কেরামতি।

চলবে…

ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-৪