ট্যাগ আর্কাইভঃ সাইয়িদ রফিকুল হকের গল্প

গল্প: আত্মহত্যার আগে

কলেজের শুরুতে আসিফের দিনগুলো ভালোই কাটছিল। এখানে, সে বেশ কয়েকজন নতুন বন্ধুবান্ধব পেয়েছে। এটা ছেলে-মেয়েদের সহশিক্ষার কলেজ। সে সবার সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে দিনগুলো বেশ আনন্দে পার করছিল। হঠাৎ একদিন তার জীবনের মোড় ঘুরে গেল। তার স্বাভাবিক আনন্দময় জীবনে কেমন করে যে একটা ছন্দপতন ঘটে গেল! আর এইরকম একটি ঘটনার জন্য সে আগে থেকে কখনো প্রস্তুত ছিল না।

সময়টা তাদের কলেজের প্রথম বর্ষ সমাপনী পরীক্ষার কয়েকদিন আগে। একদিন শেরপুর থেকে একটি মেয়ে এলো তাদের কলেজে ভর্তি হতে। এতদিন সে শেরপুর কলেজে ছিল। কিন্তু তার পিতা হঠাৎ বদলি হওয়ায় নিতান্ত বাধ্য হয়ে তাদের এখানে আসতে হয়েছে।
ওর নাম অনামিকা। সবার পছন্দের একটি মেয়ে। কী যে হাসিখুশি সে!
অনামিকা এখানে ভর্তি হয়েই নিয়মিত ক্লাস করতে লাগলো। সে দেখতে খুব সুন্দর। প্রায় সব ছেলেই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়। সবাই তার সঙ্গলাভে খুব খুশি হয়। তবুও আসিফ ওর সঙ্গে মিশতে চায় না। প্রথম দেখাতেই অনামিকাকে তার বেশ ভালো লেগেছিল। তবুও সে তার কাছ থেকে সবসময় দূরে সরে থাকতে চাইতো। আর তখনও তাদের এত ভালোভাবে পরিচয় হয়নি। শুধু ক্লাসমেট হিসাবে ক্লাসে তাদের দেখাদেখি হয়েছে মাত্র।
কলেজের অনেক ছেলে যেখানে যেচে তার সঙ্গে কথা বলতে লাগলো—সেখানে সে একেবারে নীরব ও নিশ্চুপ। কেউ দেখলে ভাববে, তার সঙ্গে বুঝি অনামিকার ঝগড়া হয়েছে! অন্যরা এমনটি করলেও আসিফ কখনো যেচে কিংবা এমনিতে তার সঙ্গে কথা বলতে যায়নি। সে মন দিয়ে পড়ালেখার চেষ্টাই করছিল। তার পিতার একটি বড় স্বপ্ন রয়েছে: ছেলে বড় হয়ে এলাকার ম্যাজিস্ট্রেট হবে। আসিফও নিজেকে সেভাবে তৈরি করছিল। পড়ালেখার দিক দিয়ে এই কলেজে আসিফের স্থান প্রায় সবার কাছে ঈর্ষণীয়।
শুধু আসিফ কথা না বললে কী হবে? দিন-দিন কলেজে অনামিকার জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগলো। তার আশেপাশে সহপাঠী ও সহপাঠিনীরা সবসময় ভিড় করে থাকে। তবে সহপাঠিনীদের চেয়ে সহপাঠীদের সংখ্যাটাই সর্বাধিক। ছেলেরা খুব আগ্রহভরে একদিন তাকে কলেজের ডিবেট-সোসাইটির আহ্বায়ক করে বসলো। তবুও সেখানে আসিফের দেখা নাই!

মাত্র কয়েকদিনে অনামিকা যেন পুরা কলেজটা জয় করে ফেললো। তা সত্ত্বেও, আসিফ এসব থেকে কয়েকদিন একটু দূরেই ছিল। হঠাৎ একদিন অনামিকা ওর পাশে এসে বসলো। সেই থেকে ওদের প্রথম বন্ধুত্ব। তারপর ক্লাসের ফাঁকে-ফাঁকে ওদের আলাপচারিতায় কেমন করে যেন ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। অনেকে বুঝতে পারলো, ওদের সম্পর্ক বুঝি বন্ধুত্বের সীমানা পেরিয়ে অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। নিয়তি কী চাইছিল আসিফ তা জানে না। তবে প্রথম বর্ষ সমাপনী পরীক্ষার পরে সে অনামিকার প্রেমে পড়ে গেল। এটা তার বন্ধুরাও সময়মতো ঠিক জেনে গেল। জমে উঠলো তাদের প্রেম। আসিফ কিছুতেই বুঝতে পারে না যে, কীভাবে কী হয়ে গেল! তবে সে এটা বুঝতে পারে যে, সে এখন মজনু।
অনামিকাও তাকে বেশ প্রশ্রয় দিচ্ছিলো। দুজনে ক্লাসের ফাঁকে-ফাঁকে ক্যান্টিনে বসে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা আড্ডা দিতো। গল্প করতো। চা, সিঙ্গারা আর সমুচা খেত। তবে তাদের মধ্যে মাঝে-মাঝে পড়ালেখার বিষয় নিয়েও কথাবার্তা হতো। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হলো গভীর প্রেমের সম্পর্ক। এসব দেখেশুনে অন্যরা বলাবলি করতো, ওরা যেন নয়া-জামানার লাইলি-মজনু! এসব দেখে আড়ালে-আবডালে তাদের নিয়ে দুই-একজন হাসি-ঠাট্টা করলেও বাকীরা তাদের ভালোবাসতে লাগলো।

প্রেম কখনও গোপন থাকে না। কলেজে তাদের প্রেমের কথা বাতাসে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। এ-খবর অনামিকার বাবার কানেও গেল। তিনি স্থানীয় থানার দারোগা। প্রথমে তিনি তো রেগে একেবারে আগুন। কিন্তু পরক্ষণে যখন জানলেন, ছেলেটা স্থানীয়, এবং তার বাবা উপজেলার চেয়ারম্যান। তখন দারোগাসাহেব শান্ত হলেন। আর খুব শান্ত হয়েই রইলেন। তবে তার ভিতরটা বুঝা গেল না।
দারোগাসাহেব মনখারাপ করে সারাদিন গুম হয়ে বাসায় বসে রইলেন। তিনি কারও সঙ্গে তেমন-একটা কথাও বললেন না। এমনকি মেয়ের সঙ্গে বিন্দুমাত্র রাগারাগিও করলেন না। খুব নীরবে সারাটা দিন শুয়ে-বসে কাটালেন। অফিসে গেলেন একেবারে সন্ধ্যার পরে। তার হাবভাব দেখে মনে হলো, তিনি যেন আজ থেকে অন্য মানুষ। তবে তার মনে যে রাগ নাই—তা বলা যাবে না। মানুষের ভিতরটা পড়তে পারলে তো দুনিয়ায় এত আজাব, গজব, শয়তানী, ভণ্ডামি, নষ্টামি, কষ্ট ও বিপত্তি দেখা দিতো না। আসলে, এটা হলো বড়সড় ঝড়ের আগে একটা গুমোটভাব। তাই, দারোগাসাহেবের মনোভাব কিছুই বুঝা যাচ্ছে না।

অনামিকা পর-পর সাতদিন কলেজে এলো না। সবাই ভাবলো, হয়তো তার কোনো অসুখ হয়েছে। আসিফের বন্ধুরা বললো, “তোর একবার ওর খোঁজ নেওয়া উচিত। ওর কী হয়েছে তা জানা দরকার। মেয়েটি তোকে অনেক ভালোবাসে।”
আসিফ তেমন-একটা গা না করে বললো, “হয়তো আজকালের মধ্যে সে এসে পড়বে।”
এরপর সে কিছুটা চিন্তিতমুখে বললো, “তবে ওর মোবাইল-ফোনটাও বন্ধ পাচ্ছি আজ সাতদিন যাবৎ।”
সব শুনে সবার মনে কেমন যেন একটা সন্দেহের কালোমেঘ ঘনিয়ে আসতে শুরু করে। ওরা বিরাট ভাবনায় পড়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ করে ওদের বাসায় যাওয়াটাও ঠিক মনে করলো না। মানুষের মনে অনেক সন্দেহ, সংশয় ও অবিশ্বাস সবসময় খেলা করে। তাই, মানুষ অনেক সময় সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না।

পরদিন বিকালে আসিফ সকল প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে থানার কাছে অনামিকাদের বাসায় গেল। সেখানে একজন কনস্টেবল ওদের বললেন, “স্যার তো এখানে থাকেন না। তিনি তো গতকাল রাতেই সপরিবারে ঈশ্বরদী না পীরগঞ্জ থানায় বদলি হয়ে চলে গিয়েছেন। তবে ঠিক কোথায় গিয়েছেন তা আমরা জানি না। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে তার বদলির স্থান আমাদের কাছে গোপন করে রেখেছেন। আপনারা কারও কাছে খোঁজ নিয়েও তা হয়তো জানতে পারবেন না। পুলিশ-লাইনের বড় অফিসাররা শুধু তা জানেন।”
খবরটা শোনামাত্র আসিফের আনন্দময় জীবনে আঁধার ঘনিয়ে আসতে থাকে। হতাশায় তার বুকটা একনিমিষে ভরে যায়। তার বুকটা ভেঙে যায় নদীর পাড় ভাঙার মতো করে বারবার। আর তা বারবার ভাঙতেই থাকে। একসময় সে ভীষণভাবে মুষড়ে পড়ে।
তার টালমাটাল অবস্থা দেখে বন্ধুরা তাকে ধরাধরি করে বাসায় নিয়ে এলো। তারপর তাকে শুইয়ে দিলো বিছানায়। সবাই বুঝলো, ওর এখন পরিপূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন। তবে দুই-একজন বন্ধু সেদিনের মতো তার কাছে রয়ে গেল।
জীবনসম্পর্কে আসিফের খুব একটা বড়সড় বা বেশি কোনো ধারণা ছিল না। সে একজনের সঙ্গে সুন্দর একটা যৌথজীবন চেয়েছিল। অনামিকাকে খুঁজে পেয়ে তার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পথেই ছিল। কিন্তু হঠাৎ এই বিনা মেঘে বজ্রপাতে সে যারপরনাই মুষড়ে পড়েছে। সে নিজেকে কোনোভাবেই স্থির রাখতে পারছে না।

আসিফ কয়েকদিন কলেজে এলো না। বন্ধুরা ভাবলো, হয়তো সে দুঃখভারাক্রান্ত হয়েছে বলে বাসায় শুয়ে-বসে নিজেকে স্বাভাবিক করার কাজে নিয়োজিত। তাই, কেউ তার বাসায় যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো না। বন্ধুরা মনে করলো, একা থাকলে সে আরও ভালো থাকবে। ক্যাম্পাসে বসে সবাই তার মঙ্গল কামনা করতে লাগলো।

আটদিন পরে আসিফ কলেজে এলো। সঙ্গে তার প্রতিদিনের প্রিয় সেই ব্যাগটিও ছিল। বন্ধুরা তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগলো। কিন্তু সে কারও কোনো কথায় কর্ণপাত না করে সোজা সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে থাকে। তার এই হতাশাগ্রস্ত মনোভাব লক্ষ্য করে একজন তাকে জাপটে ধরে পথ আগলে তাকে আটকাতে চেয়েছিল। এসময় সে কোথায় গিয়ে কী করে তার কোনো ঠিকঠিকানা নাই। কিন্তু এই বন্ধুটির চেষ্টাও সে দুহাতে দূরে ঠেলে বিমর্ষচিত্তে উপরে উঠতে লাগলো।। একসময় সে বন্ধুদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কলেজের আটতলার ছাদে উঠে আসে। তারপর নিচে অবস্থানরত তার বন্ধুদের দিকে চেয়ে বলতে লাগলো, “শোনো বন্ধুরা, এ-জীবন আমার কাছে এখন দুর্বিষহ। অনামিকার সঙ্গলাভ ব্যতীত আমার মনের দুঃখ কখনও ঘুচবে না। তাই, আমি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমি আজ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো। কেউ আমাকে ঠেকাতে পারবে না। আমার এই জীবনের কোনো প্রয়োজন নাই। আমি এখন সর্বস্বান্ত একজন মানুষ। আমার বেঁচে থেকে কোনো লাভ নাই। আমি চললাম বন্ধুরা। বিদায় ক্যাম্পাস। বিদায় পৃথিবী। বিদায় বন্ধুরা।”
তার কথা শুনে পুরা কলেজ হায়-হায় করে উঠলো। কেউবা তাকে নিষেধ করতে থাকে। আবার কেউবা কান্না জুড়ে দিলো। আবার বুদ্ধিমানদের মধ্যে দুই-একজন কোত্থেকে একখানা চাদর এনে কয়েক বন্ধুর সঙ্গে মিলে নিচে মেলে ধরলো। যাতে সে লাফ দিলেও তাকে বাঁচানো যায়। হায় রে মানুষের প্রচেষ্টা! আত্মহননকারীকে বাঁচাতে চায় ছোট্ট একটা চাদর মেলে! যার বুকের ভিতরে মরে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন বাসা বেঁধেছে তাকে কখনো ছোট্ট চাদর দিয়ে বাঁচানো যায়? ওর প্রয়োজন পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্নেহ, মমতা ও প্রেম। শুধু ভালোবাসা দিয়ে এবং নতুন স্বপ্ন ওর মনে জাগিয়ে আজ ও-কে বাঁচাতে হবে। কিন্তু সেই কাজটি করবে কে?

পুরা কলেজের ছেলে-মেয়ে নিচে জমায়েত হয়েছে। এমন সময় ভিড় ঠেলে ভবনের সামনে এসে দাঁড়ালেন কলেজের বাংলার সহকারী অধ্যাপক জামালউদ্দিন সাহেব ওরফে জামাল-স্যার। তিনি আসিফের দিকে তাকিয়ে একটা প্রচণ্ড হুংকারে বলে উঠলেন, “তুমি আত্মহত্যা করবে ভালো কথা। কিন্তু তার আগে তুমি আমার একটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাও। একজন শিক্ষক হিসাবে এটি তোমার কাছে আমার শেষ-অনুরোধ।”

আসিফ এখন মরণমুখী। সে কিছুটা চেঁচিয়ে বললো, “বলুন স্যার, আপনার কী প্রশ্ন?”
জামাল-স্যার বললেন, “তোমাকে নিচে এসে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।”
জামাল-স্যারের সঙ্গে আসিফের কথোপকথন চলছে|
ততক্ষণে কয়েকজন পিছনের সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে দিয়েছে।
আসিফ বললো, “আপনি প্রশ্ন বলুন স্যার। আমি এখান থেকেই উত্তর দিবো।”
জামাল-স্যার তার চশমাটা খুলে বললেন, “আসিফ, তুমি আমার প্রিয় ছাত্রদের একজন। তুমি কারও সঙ্গে কখনো বেআদবি করোনি। আমাকেও তুমি সদাসর্বদা ভক্তিশ্রদ্ধা করো। আজ তোমার জীবনের শেষদিনে তুমি আমাকে এতগুলো ছেলেমেয়ের সামনে অবজ্ঞা করবে? বাবা, আমি তোমাকে কোনো ধোঁকা দিচ্ছি না। তুমি একবার নিচে নেমে আসো। আর আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তারপর না হয় আত্মহত্যা করবে। কিন্তু আমার প্রশ্নটা তো গোপনীয়। আমি কথা দিচ্ছি এরপর তোমাকে আর বাধা দিবো না।”
আসিফ কী যেন ভাবতে থাকে। এমন সময় পিছন থেকে তাকে জাপটে ধরে ফেলে তার বন্ধুরা। সবাই মিলে তাকে পাঁজাকোলা করে নিচে নামিয়ে আনলো। আসিফ নিচে এসেও বন্ধুদের সঙ্গে কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করে শেষে জামাল-স্যারকে দেখে মাথানিচু করে তার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। তাকে এখন একজন বড়সড় অপরাধীর মতো লাগছে।
জামাল-স্যার কোনোপ্রকার ভনিতা না করে সরাসরি তাকে বললেন, “এই জীবনটা কি তোমার?”
আসিফ সাধারণ এই প্রশ্নটা শুনে থতমত খেয়ে কিছুক্ষণ নীরব থাকে। শেষে বোকার মতো বলে বসলো, “জ্বি স্যার, এটা আমার জীবন।”
জামাল-স্যার বললেন, “তুমি মিথ্যা বলছো। তোমার এই জীবনের মালিক আল্লাহ। আর তোমার এই জীবনের ওপর সবচেয়ে বড় অধিকার রয়েছে মহান আল্লাহর, এবং তোমার জন্মদাতা ও জন্মদাত্রী পিতামাতার। তুমি আল্লাহর হক আদায় করোনি। আবার তোমার পিতামাতার আশা-ভরসা বিনাশ করে স্বার্থপরের মতো তুমি আত্মহত্যা করতে চলেছো! এই জীবন তোমার নয়। তাই, তুমি এ-কে হত্যা করতে পারো না। তুমি কখনও আত্মহত্যা করতে পারো না। তোমার আত্মহত্যা করার কোনো অধিকার নাই। আজ আত্মহত্যার আগে তুমি ভাবো—তোমার আত্মহত্যা করার কোনো অধিকার আছে কিনা? আর এই জীবন শুধু তোমার কিনা?”
তারপর জামাল-স্যার একটুখানি থেমে আবার বলতে লাগলেন, “আর সামান্য একটা মেয়ের জন্য কেউ কখনও এতবড় একটা জীবন বিনাশ করে! এই জীবনের কত মূল্য! এ-তো মহাজীবন। আর পরকালে এর মূল্য অপরিমেয়। তা তুমি জানো না। তুমি তোমার ভবিষ্যৎ না জেনেই মনগড়াভাবে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছো। অথচ, তোমার ভবিষ্যৎ তোমার মনোবাসনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণও হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে—তোমার সঙ্গে কোনো একদিন অনামিকার দেখা হবে। তোমাদের বিয়েও হতে পারে। কিন্তু তাই বলে ঝোঁকের বশে এভাবে আত্মহত্যা করাটা অনৈতিক ও বোকামি। এখন তুমিই ভেবে দেখো, তোমার কী করা উচিত। আর আমার শেষকথা: জীবনের পরিণতিসম্পর্কে আরও বেশি করে ভাবো। এতো তুচ্ছ বিষয়ের জন্য এই মহাজীবনকে এভাবে শেষ করার কথা কখনও ভেবো না। জীবনসম্পর্কে অত্যুচ্চ ধারণা পোষণ কর। আমাদের জীবনের পরিণতি যেন সৎভাবে, সত্য, সুন্দর ও মহাজীবনের পথে ধাবিত হয়—তা-ই আমাদের সবসময় ভাবতে হবে। আত্মহত্যার মতো পাপের পথ থেকে ফিরে আসো, যুবক। আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র মালিক মহান আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা ও ভরসা রাখো। আর আল্লাহর রহমত থেকে কখনও দূরে সরে যেয়ো না। আল্লাহর রহমত থেকে কখনো তোমার মুখটি ফিরায়ে নিয়ো না। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা তোমার।”
জামাল-স্যার চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ আসিফ বলে উঠলো, “স্যার, এছাড়া আমার আর-কিছু করার নাই।”
স্যার এবার যেন বাঘের মতো গর্জে উঠলেন। আর বললেন, “তোমার স্পর্ধা কত! তুমি আত্মহত্যা করতে চাও! তুমি তো স্বার্থপর বেঈমান। শুধু নিজের স্বার্থে আত্মহত্যা করে সুখ পেতে চাও। আর সংগ্রামমুখর জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চাও। কিন্তু যে পিতামাতা তোমাকে অনেক সুখের জন্য লালনপালন করেছেন, তোমাকে বড় মানুষরূপে খুব দেখতে চান, তুমি তাদের কথা একবারও ভাবছো না।! কতটা নরাধম তুমি হয়েছো! আরে, সামান্য একটা মেয়ের জন্য কেউ আত্মহত্যা করে নাকি? তুমি জীবন দিবে ভালো কথা। তবে দেশের জন্য জীবন দাও। জাতির পক্ষে জীবনবাজি রাখো। আর মানুষ ও মানবতার স্বার্থে তোমার এই অমূল্য জীবনকে বিসর্জন দাও। কিন্তু তাই বলে একটা মেয়ের জন্য এভাবে কেউ কখনো জীবন দিতে পারে? এগুলো গাধাদের কাজ। তুমি তো ভালো ছাত্র। তোমার জীবন কেন এভাবে নিঃশেষিত হবে? এই মহাজীবনের মূল্য উপলব্ধি করতে শেখো। আগে নিজেকে ভালোবাসতে শেখো। তারপর অন্যকে ভালোবাসবে। আর যে নিজেকে ভালোবাসতে পারে না—সে কখনো কাউকে ভালোবাসতে জানে না। তোমার আবেগ ও যাবতীয় প্রাক্ষোভিক চেতনা এখনই নিয়ন্ত্রণ করো। এই জীবন বড় মধুর ও সুন্দর। তুমি বেঁচে থাকলে একদিন-না-একদিন তোমার অনামিকার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু এভাবে মূর্খের মতো জীবনবিসর্জন দিলে তাতে তোমার বা অনামিকার কী লাভ বলো? আর অনামিকা যদি তোমাকে ভালোবাসে সেও তোমার এই আত্মহননকে একদিন ঘৃণা করবে। সে তো তোমাকে পেতে চাইবে। কিছু আবেগ, কিছু জেদ আর কিছু তুচ্ছবিষয়ে দুঃখের বশবর্তী হয়ে এই মহাজীবনকে নরকযন্ত্রণার পথে ধাবিত কোরো না। ভালো থেকো বাবা। বেঁচে থাকো দীর্ঘকাল। চেয়ে দেখো, পৃথিবী এখনও কত সুন্দর! তুমি কি জানো না—আর ক’দিন পরেই ফুটবে ভালোবাসার কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া। আরও কত নাম-না-জানা ফুল। ফাল্গুন আসছে পৃথিবীতে। আর তুমি চলে যাবে সব ফেলে? পৃথিবীর এত-এত শোভা রেখে তুমি কেন মরবে যুবক? ভুল করে তুমি কেন মরবে যুবক?”

কথাগুলো শেষ করে জামাল-স্যার বীরদর্পে বেরিয়ে গেলেন ভিড় ঠেলে। তিনি কোনোদিকে না তাকিয়ে শুধু সামনের দিকে হাঁটতে লাগলেন।
সবার মনে হলো: তিনি যেন একজন ফেরেশতা! তাইতো আসিফকে দেখিয়ে গেলেন মহাজীবনের পথ।

পুরা কলেজ আসিফের চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর সে মাথানিচু করে কী যেন ভাবছে। আত্মহত্যা করার আগে তাকে আরও ভাবতে হবে। নাকি সেও ভাবছে মহাজীবনের কথা?

পুনশ্চ: জীবনের মানে কী—তা আসিফ আজও ভালোভাবে জানে না। তবে সে এসব এখন জানার চেষ্টা করছে। অনামিকার কথা সে এখন একটু কম ভাবে। আর সে-সব ভাবতে গেলে তার মাথাটা সবসময় ঝিমঝিম করে। তাই, সে দিনের বেশিরভাগ সময় বাসার বারান্দায় বসে বই পড়ে কাটায়। বই পড়তে তার এখন খুব ভালো লাগে। জামাল-স্যারের সংস্পর্শে থেকে সে দিনে-দিনে সাহিত্যবিষয়ক বই পড়তে শিখেছে। সাহিত্যের প্রিয় বইগুলো তার কাছে জামাল-স্যারের মতো মনে হয়। একটা বই পড়া শেষ হতে-না-হতেই সে জামাল-স্যারের কাছে গিয়ে আরেকটি নতুন বইয়ের নাম জেনে তা কিনে তবেই বাসায় ফেরে।
সে কৃতিত্বের সঙ্গে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে। পছন্দমতো একটা বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হওয়ার জন্য সে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবখানে তার অভিভাবক হয়ে কাজ করছেন জামাল-স্যার। তাঁর নির্দেশনায় আসিফ ঢাকা-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে একজন মানুষের মতো মানুষ হতে চায়।
যদি কারও হাতে কখনো একটুখানি সময় হয়—তবে সে যেন যায় মির্জাপুরে আব্দুল জলিল মির্জার বাড়িতে। গিয়ে দেখবে, সেখানে খুব সুন্দর একটা দ্বিতল-ভবনের বারান্দায় বসে সকাল-বিকাল একাগ্রচিত্তে বই পড়ছে মির্জা মোহাম্মদ আসিফউদ্দিন বাহার আসিফ। তার মনে এখন…। থাক, আর লিখে কাজ কী?

© সাইয়িদ রফিকুল হক
০৬/১১/২০১৮

ছোটগল্প: আফসারের চোখে জল

আফসার বাসস্ট্যান্ডে এসে আজ বড় ভাবনায় পড়ে গেল।
বাসে আজ খুব ভিড়। তার কাছে রাস্তায় আজ লোকজনের উপস্থিতি একটু যেন বেশি মনে হচ্ছে।
এদিকে অফিস-টাইম প্রায় হয়ে গেছে। আর-একটু দেরি করলে আজ তাকে নির্ঘাত বসের কড়াধমক কিংবা নিদেনপক্ষে কটুকথা শুনতে হবে।
সে দেখলো, একটা মিনিবাস আসছে। সে যেন চোখের সামনে হঠাৎই আশার আলো দেখতে পায়। বাসটা কাছে আসতেই সে তাতে ওঠার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। লোকজনের ঠেলায় তার গোরস্থানে কিংবা শ্মশানে যাওয়ার অবস্থা।
সে বুঝলো, আজকাল বাসে চড়তে হলেও একজন মল্লযোদ্ধা হতে হবে। আর নয়তো একজন সাধারণ কুস্তিগীর হওয়া চাই। নইলে, এই ঢাকা-শহরের বাসে চড়া ভয়ানক কষ্টের ব্যাপার।
এরপর এলো একটা সিটিংচিটিং-বাস। এখানেও মারাত্মক ভিড়। তাই, সে আগে থেকে অন্য গাড়ির তুলনায় এখানকার জন্য বেশি টাকা দিয়ে একখানা টিকিট কিনে ফেললো। তারপর সে নেমে পড়লো বাসে চড়ার প্রতিযোগিতায়।
টিকিট কেটেও আজকাল লোকজনের কোনো স্বস্তি নাই। সবখানে এখন কেবল ফাঁকি, অনিয়ম আর দুর্নীতি। ঢাকা-শহরের সিটিংচিটিং-বাসগুলো দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রতারক। এদের কোনো চরিত্র নাই—মনুষ্যত্ব নাই। এমনকি ধর্মও নাই। এরা জানোয়ার। তাই, এরা শুধু অর্থই চেনে। লোকজনের সঙ্গে আফসারও বাসে ওঠার চেষ্টা করছে। মানুষজন বাসে উঠছে। তারপরও এরা ঠিকভাবে যাত্রী না উঠিয়ে গাড়ি টানতে থাকে। প্রতিনিয়ত ইচ্ছাকৃতভাবে এরা যেন মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। আর সকালবেলার গাড়িগুলোতে এরা বেশি লোক নেওয়ার জন্য কৃত্রিমভাবে বাস-সংকটসৃষ্টি করে। এসবকিছু দেখেশুনে তাই আফসারের মনে হলো—দেশের পরিবহণ-সেক্টর এখন পশুদের হাতে।

সে লোকের ভিড় ঠেলে কোনোরকমে এই বাসটার গেটের কাছে একটু দাঁড়ানোর জায়গা পেলো। কিন্তু আর ভিতরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। তবে এটুকুতেই এখনকার মতো খুশি হয়েছে আফসার। সে সবসময় অল্পে তুষ্ট।
সে দেখলো, বাসের ভিতরে এখনও কিছু জায়গা আছে। কিন্তু গেটের একটু উপরে একটা জায়গায় দুনিয়ার লোকের ভিড় যেন! এই জায়গাটাতে এতো ভিড় কেন? সে কোনোরকমে ফাঁকফোঁকড় গলিয়ে আরও দেখলো, এখানে একটা সিটে বসা নিয়ে কয়েকটা লোকের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে। আর কে কার আগে বসবে—তারই দুর্বিনীত আয়োজন। একজন বয়স্কলোক কতিপয় জওয়ানের মারমুখীভাব দেখে পিছু হটতে লাগলেন।
আফসারের তখন মনে হলো: আহারে! এই লোকটাতো একজন মুক্তিযোদ্ধাও হতে পারে! আমরা কি তার কথাটা একটু ভাবতে পারি না?
কিন্তু এখন কে ভাবে কার কথা? গায়ের জোরে একটা ছোকরাবয়সী ছেলে সবাইকে প্রায় ঠেলেঠুলে নিজের দখল করা সিটটাতে বসে পড়লো। আর তার মুখে সে কী বিজয়ের হাসি! তার হাবভাব দেখে মনে হলো—সে যেন এইমুহূর্তে ভারতবর্ষ-জয় করেছে!

আফসার এসব দেখে ভিতরে-ভিতরে যেন লজ্জায় মরে যাচ্ছিলো। সে এতোক্ষণ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে এসব তামাশাই দেখছিলো। আর ভাবছিলো—মাত্র কিছুদিন আগে—১৯৭১ সালে, এই দেশটার জন্য ৩০লক্ষ মানুষ অকাতরচিত্তে জীবন দিয়েছেন। তাঁদের আত্মত্যাগের কথা ভাবলে আনন্দে আফসারের চোখে জল আসে। তাঁরা কী নিঃস্বার্থ আর কী মানবদরদী ছিলেন! কী পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী মহামানব ছিলেন আমাদের চিরগর্বের একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা! আর আজ আমরা সামান্য একটা বাসের সিটের জন্য সকলপ্রকার নীতিনৈতিকতা হারিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করে চলেছি। এটা তো মানুষ আর মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আর মারাত্মক সীমালংঘন! এই জাতি এই দেশ কীভাবে বড় হবে?
লোকজনের মধ্যে এখন ত্যাগের মহিমা কমে যাচ্ছে। সামান্য একটা বাসের সিটের জন্য, আর বাসের সিটে কে কার আগে বসবে—কিছুলোক তা-ই ভাবছে! এরা কতটা নির্লজ্জ আর কী ভয়ংকর অসভ্য হয়ে উঠছে—তা হয়তো এরা এখনও বুঝতে পারছে না। সামান্য একটা বাসের সিটের জন্য এরা আজ নিজেদের মনুষ্যত্ব পর্যন্ত বিসর্জন দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করছে না। এরা, একটা বাসে চড়া নারী, শিশু, বৃদ্ধ, পঙ্গু ও মুক্তিযোদ্ধাদের কথা তো কেউ ভাবছে না! সবাই শুধু এখন ঠেলাঠেলিতে ব্যস্ত! এই কি স্বাধীনদেশে আমাদের মনুষ্যত্ব?
ভাবতে-ভাবতে আফসারের যেন চোখ ফেটে জল আসবে! এমনই একটা অবস্থা তার। সে মানুষের অধঃপতন দেখলে শিউরে ওঠে। মানুষের প্রতি দানবীয় আচরণ দেখে সে শিহরিত হয়। আর তার চোখে জল চলে আসে। সে মানবাত্মার পরাজয় দেখতে পারে না। সহ্য করতে পারে না। মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে তার চোখে জল আসে।

সে ড্রাইভারের পিছনে বাসের ডানদিকে পর-পর তিনটি আসনজুড়ে লালকালিতে লেখা দেখলো—এই নয়টি সিট—মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত! কিন্তু সেখানেও বসে আছে একশ্রেণীর বেশরম, অসভ্য ও দাঁতাল পুরুষ। এদের, মেয়েদের সিট ছেড়ে উঠতে বললেও এরা ওঠে না। বরং এরা আরও নির্লজ্জ হয়ে গায়ের জোরে নানারকম কুৎসিত যুক্তিপ্রয়োগ করার অপচেষ্টা করে থাকে।
এসব দেখে-দেখে আর ভেবে-ভেবে আফসারের চোখে সত্যি-সত্যি একসময় জল এসে গেল। তার বুকটা ফেটে যেন অমনি একটা দীর্ঘঃশ্বাস বেরিয়ে এলো—আজও আমরা মানুষের মতো মানুষ হতে পারলাম না। শুধু একেকটা পোশাকি মানুষ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি! এখানে, মানুষ কোথায়? আর আজ আমাদের মনুষ্যত্বই বা কোথায়?
সে যখন আপনমনে এসব ভাবছিলো, তখনও বুঝতে পারেনি, সামনে তার জন্য এরচেয়ে বড় ঘটনা ও চমক অপেক্ষা করছে।

বাসে ওঠা ও নামার সময় চাপাচাপিটা একটু বেশি হয়। এইসময় চরদখলকারীদের মতো বাসের সিটদখলকারীরা খুব বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
একটা লোক কলাবাগানের কাছে নামবেন। সেজন্য তিনি আগেভাগে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাসে ওঠার মতো নামার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিরাট ঝক্কিঝামেলা। লোকটা উঠে সামান্য দাঁড়ালেন। এমন সময় তার সিটটা দখল করার জন্য কয়েকটা লোক মল্লযুদ্ধে নেমে পড়লো। এদের হাবভাব দেখে আফসারের মনে হলো—এইমাত্র যেন পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল!
সে কারণটা বুঝলো আর-একটু পরে। এখানে, পাশাপাশি দুজন রমণী বসে রয়েছেন। তাদের পাশের এই সিটটা দখল করার জন্যই একদল অমানুষ তার চোখের সামনেই মল্লযুদ্ধ শুরু করে দিলো। সে দেখলো, এখানেও কয়েকজন বয়স্কলোককে পাশ কাটিয়ে তাদের ঠেলেঠুলে কোণঠাসা করে এক কর্পোরেট অফিসের হোমরাচোমরাগোছের একটা সেখানে বসে পড়লো।
তার বুকটা আবার ভরে উঠলো হতাশায়।
সে গেটের কাছের বাসের হ্যান্ডেলটা ধরে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে—এই লোকগুলো মানুষ হয়েই আজ এতো হিংস্র আর আগ্রাসী! এরা যদি নামকাওয়াস্তে মানুষ না হয়ে বনের হিংস্র নেকড়ে কিংবা হায়েনা হতো—তাইলে এদের নৃশংসতায় পৃথিবীতে বুঝি কোনো প্রাণিই বাঁচতে পারতো না।

আফসার ধীরে ধীরে বাসের মাঝামাঝি একটা জায়গায় ঠাঁই পেলো। এখনও বাসে অনেক ভিড়। তবুও এখানে দাঁড়িয়ে তার এখন কিছুটা ভালো লাগছে।
সায়েন্স-ল্যাবের কাছে এসে কয়েকজন যাত্রী নামলো। আর উঠলোও আরও কয়েকজন।
এক মহিলাযাত্রী বাসে উঠেই তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সিটগুলোতে বসে থাকা পুরুষদের দিকে চেয়ে ভদ্রভাবে বললেন, “ভাই, এগুলোতো লেডিস-সিট। দয়া করে সিট ছেড়ে দিন।”
মহিলাসিটে বসা লোকগুলো তার কথা শুনে পরস্পর মুখচাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। যেন কেউ তার ভাষা বুঝতে পারছে না। তারা একেবারে ভাবলেশহীন। আর কেউ সিট ছাড়ার নাম করে না। একটা লোক সিটে এমনভাবে বসে রইলো যে, সে যেন বিবাহের যৌতুক হিসাবে শ্বশুরবাড়ি থেকে এটি পেয়েছে!
এসব দেখে অনেকের মাথা ঠিক থাকে না। দুই-চারজন প্রতিবাদী সবজায়গায় দাঁড়িয়ে যায়।
আফসারের পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক এই অবস্থাটা দেখে মহিলাসিটে বসা লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে একটু জোরের সঙ্গে বললেন, “ভাই, আপনারা মহিলাসিটগুলো ছাড়েন না কেন? আপনারা কি সোজা কথাটাও বুঝতে পারেন না?”
কথাটা শোনার পর কারও কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। হঠাৎ আফসারের সামনের সিটে বসা মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান এক লোক বলে উঠলো, “কীসের সিট ছাড়বে? বাসের সিটে যে যেমন বসতে পারে। মহিলারা যখন আমাদের সিটে বসে থাকে তখন কিছু হয় না! কিছু লোকজন না বুঝেই আজকাল মহিলাদের পক্ষে দালালি করে।”
কথাটা ভয়ানক অশ্লীল এবং সামাজিক পরিবেশে শিষ্টাচারবহির্ভূত।
আফসার বুঝলো, বাসে এখন শূয়রও চড়ে! তার ইচ্ছে করছিলো, এই লোকটাকে এখানে, এইমুহূর্তে জুতাপেটা করতে। কিন্তু বাসের পরিবেশবিনষ্ট হতে পারে ভেবে সে নিজের ক্রোধসংবরণ করলো।
মহিলাদের পক্ষে কথা বলা সেই ভদ্রলোক এতে মনে খারাপ না করে তার কথার জবাবে অশ্লীলকথা বলা সেই লোকটিকে খুব আস্তে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কী করেন?”
লোকটি তখন খেঁকিয়ে উঠলো, “কী করি মানে? আমি বিদেশে থাকি।”
ভদ্রলোক বললেন, “কোন দেশে?”
সেই খেঁকিয়ে ওঠা আবার বললো, “মিডল ঈস্টে!”
তখন সেই প্রতিবাদকারী ভদ্রলোক আফসারের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, “বুঝলাম। এগুলো মিডল ঈস্টের পশু! এখনও মানুষ হয়নি।”
আফসার এইসময় ভদ্রলোককে সমবেদনা জানানোর জন্য বললো, “এরা মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করতে গিয়ে শুধু পয়সাটাই চিনেছে। মুনষ্যত্ব চেনেনি। আর আরবদেশে নারীদের সম্মান করাটা ওদের সিস্টেমের বাইরে! এজন্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা লোকগুলো এরকম চাঁছাছোলা ও অভদ্র হয়ে থাকে।”
বাসে আরও কিছুসংখ্যক লোক মানবিক কারণে মহিলাদের সিটগুলো ছেড়ে দেওয়ার জন্য ওই বসা লোকগুলোকে অনুরোধ করলো। কিন্তু মহিলাদের সিটগুলো জবরদখলকারীদের মনে এতে কোনো প্রতিক্রিয়াসৃষ্টি হলো না। এদের কেউই দখলকৃত সিটগুলো ছেড়ে উঠলো না। মধ্যপ্রাচ্যের ওই শ্রমিকের মতো আরও কিছু লোক এদের সমর্থনও করলো!
আফসার ক্ষুব্ধমনে ভাবলো, এই শূয়রগুলোকে বাসে ওঠার পারমিশন দিয়েছে কে?

অনেক যুদ্ধের পর আফসার ঠিকসময়েই অফিসে পৌঁছুতে পারলো।
সে অফিসে ঢুকে দেখলো, তার পাশের টেবিলে তারচেয়ে বয়সে অনেক সিনিয়র গুলজারসাহেব এখনও আসেননি। তার জন্য আফসারের খুব মায়া হলো। আর তার মনটা কেমন যেন করতে লাগলো।
লোকটা তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। হয়তো বাসের জন্য তিনি এখনও রাস্তায় যুদ্ধ করছেন।

আফসার যখন গুলজারসাহেবের কথা ভাবছিলো—তখন তিনি এসে অফিসে ঢুকলেন। এতে আফসারের মনটা আনন্দে ভরে উঠলো।
সে ভাবলো, যাক, ভদ্রলোক হয়তো আজ বেঁচে যাবেন। মাত্র দশ মিনিট লেট হয়েছে তার।

আফসার অফিসের কাজ শুরু করার আগে লক্ষ্য করলো, তাদের সিনিয়র-অফিসার তরুণী-সুন্দরী মাহজাবিন রশিদ এখনও অফিসে এসে পৌঁছায়নি। ইদানীং সে নিয়মিত দেরি করে অফিসে আসে। কিন্তু এতে তার অফিসিয়ালি কোনো সমস্যা হয় না। সমস্যা যতো তাদের। তারা দিনরাত খেটে মরলেও তাদের দোষ। আর তাদের কাজেকর্মে একটু পান থেকে চুন খসলে অমনি বসদের নানারকম নীতিকথা শুরু হয়ে যায়। দেশটা যে রসাতলে যেতে বসেছে তাতে আফসারের মনে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু তার খুব দুঃখ হয়—এটা যে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ! এতো মানুষের আত্মত্যাগ কখনও বৃথা যেতে পারে না। কবে ঘুরে দাঁড়াবে তার স্বপ্নের সোনার বাংলা?
মাহজাবিন এখনও আসেনি। আফসার আজ এটা খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করতে থাকে। চল্লিশ মিনিট পার হওয়ার পরও সে এলো না।
আফসার এবার নিজের কাজে মন দিলো। সে কাজের মাঝে ডুবে যেতে চাইলো। কিন্তু বাসের লোকগুলোর কথা মনে পড়তেই তার মনটা কেমন যেন তিতা হয়ে গেল! তবুও সে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজে মন বসালো।

আফসার নিজের কাজ করছিলো। এমন সময় সে দেখলো, এমডি’র খাসপিয়ন এসে গুলজারসাহেবের কাছে খুব আস্তে কী যেন বললো। আর অমনি গুলজারসাহেব উঠে তার পিছনে বেরিয়ে গেলেন।

ঘণ্টাখানেক পরে মাহজাবিন খুব স্টাইল করে কড়া পারফিউম ছড়িয়ে অফিসে এসে ঢুকলো। এইসময় প্রায় সবাই তাকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। মেয়েটির যৌবন ভূমিকম্পের মতো! যেন সে এখনই একটিমাত্র কম্পনে দুনিয়ার সবকিছু লণ্ডভণ্ড ও তছনছ করে দিবে!
আফসার বুঝতে পারলো, অফিসে কারও-কারও কাছে তার কেন এতো কদর!
সে আবার কাজে মন বসালো। মাহজাবিনের যৌবন তার হৃদয়ে ভূমিকম্পের সৃষ্টি করতে পারেনি। এজন্য সে নিজেকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালো। তারপর আফসার তার ডানপাশে চেয়ে দেখলো, গুলজারসাহেব এখনও আসেননি। সে কিছুটা ভাবনায় পড়ে গেল। হঠাৎ তিনি গেলেন কোথায়?

একটু পরে খুব মনমরা হয়ে গুলজারসাহেব প্রায় ছলছল চোখে তার পাশে এসে বসলেন।
আফসার সঙ্গে-সঙ্গে হাতের কাজ ফেলে উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো, “কোথায় গিয়েছিলেন? আর কী হয়েছে আপনার?”
গুলজারসাহেব বাঁহাতে চোখদুটো মুছে বললেন, “আজ অফিসে আসতে একটু লেট হয়েছে। বস আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন। আর তার রুমে ডেকে খুব খারাপ ভাষায় আমাকে ধমকালেন।”
তারপর তিনি আরও মনখারাপ করে আফসারের দিকে চেয়ে বললেন, “আমি কি রোজ-রোজ দেরি করে আসি! আপনিই বলুন তো!”
কথাটা বলে তিনি শিশুর মতো কেঁদে ফেললেন।
আফসার নিজেও ছলছল চোখে তাকে সান্ত্বনা জানালো।
আজ সে আরেকবার বিধ্বস্ত হলো। এবার সে যেন ভেঙে পড়লো। সে ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে থাকে। মানবতা ও ন্যায়বিচার কি দেশ থেকে উঠে যাচ্ছে নাকি? আফসারের মনটা একসময় বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এইমুহূর্তে দুনিয়ার সমস্ত অনিয়ম ও ভণ্ডামি তার ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো।

একটু পরে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় আফসার দেখলো, মাহজাবিন রশিদ তাদের বসের কাচের দেওয়ালঘেরা রুমের মধ্যে বসে বসের সঙ্গে কী-সব আলাপ করছে, কথা বলছে, আর খুব হাসছে! আর সে কেবলই হাসতে-হাসতে একেবারে লুটিয়ে পড়ছে। আর তার সামনে রয়েছে ধূমায়িত কফির মগ! দুজনে একসঙ্গে কফি-মগে চুমুক দিয়ে কী অপূর্ব স্বাদ অনুভব করছে!

মাহজাবিনের যৌবন তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তার যৌবনঝড়ে লণ্ডভণ্ড তার বড়কর্তা।

আর এপাশে একজন সৎ, বিশ্বস্ত ও আদর্শবান অধস্তন কর্মচারী আজ একটু বিলম্বে অফিসে এসেছে বলে তাকে জঘন্য ভাষায় তিরস্কার করেছে তারই ছেলের বয়সী, ছোকরাবয়সী একটা এমডি। তিনি মনঃকষ্টে শিশুর মতো কেঁদেছেন। হয়তো ভিতরে-ভিতরে এখনও গুমরে-গুমরে মরছেন!

আফসারের দিনভর কেবলই মনে হলো—গুলজারসাহেব এই ছোকরা-বসের পিতার বয়সী একজন মানুষ। তবুও তাকে লাঞ্ছিত করতে তার বুকে বাধলো না! সমাজটা এখন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে!
একসময় আফসারের চোখ ফেটে যেন জল এলো।
হ্যাঁ, আফসার এখন কাঁদছে। তার চোখে জল।

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
১৯/১২/২০১৭