যুগে যুগে মহান আল্লাহর নিকট থেকে আসা প্রতিটি ধর্মই ছিল পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। সার্বিক জীবন কীভাবে পরিচালিত হবে তার পথনির্দেশই ছিল ধর্ম। প্রতিটি ধর্মেই আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতিসহ যাবতীয় বিষয়ের নির্দেশনা ছিল। প্রতিটি ধর্মের নামও ছিল ইসলাম (শান্তি) আর ফলও ছিল শান্তি। প্রতিটি ধর্মের ভিত্তি ছিল তওহীদ (আল্লাহ ছাড়া হুকুমদাতা নেই)। এই শেষ ইসলামের সাথে অন্যগুলোর পর্থক্য হলো এই যে, অন্য ধর্মগুলো ছিল একটি নির্দিষ্ট এলাকা ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রযোজ্য আর শেষ ইসলাম হলো কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য।
.
বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মভিত্তিক জাতি হলো খ্রিষ্টান। এই খ্রিষ্টধর্ম কীভাবে সৃষ্টি হলো সে সম্পর্কে দুটি কথা এখানে বলে নিতে চাই-
—-
ইহুদি আলেমরা (রাব্বাই, সাদ্দুসাইরা) মুসা (আ.) এর ধর্মগ্রন্থ তৌরাত এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে তা প্রয়োগ করত এবং এই ক্ষেত্রে তারা অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করত। তৌরাতের বিধি-বিধান, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি ইত্যাদি তখনকার সময়ের প্রেক্ষাপটে ইহুদি জাতির জন্য প্রযোজ্য ছিল কিন্তু তা নিয়ে বাড়াবাড়ি ও অতি বিশ্লেষণের ফলে সেই ধর্ম মানুষকে শান্তির পরিবর্তে চরম অশান্তিতে ফেলেছিল। তখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল রাব্বাই, সাদ্দুসাইদের বাড়াবাড়ি ও অতিবিশ্লেষণের হাত থেকে ধর্মকে তার সরলরূপে ফিরিয়ে আনা, তবেই কেবল সমাজে শান্তি আসবে। তখন মহান আল্লাহ ইহুদি জাতির জন্য পাঠালেন নবী ঈসাকে (আ.)।
.
ঈসা (আ.) এসে ঘোষণা দিলেন, “আমি বনী-ইসরাইলের পথভ্রষ্ট মেষগুলোকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য আমি এসেছি।” যেহেতু তখনও ইহুদিদের দীন (জীবনব্যবস্থা) অবিকৃতই ছিল তাই তিনি নতুন কোনো দীন (জীবনব্যবস্থা) নিয়ে আসলেন না। তিনি কেবল কিছু উপদেশ নিয়ে আসলেন যেন মানুষ সেগুলো অনুসরণ করে সৎচরিত্রবাণ হতে পারে এবং ধর্মের সঠিক উদ্দেশ্য বুঝতে পারে। ইহুদিরা যদি ঈসা (আ.) এর ঐ উপদেশগুলো গ্রহণ করত তবে ইহুদি ধর্ম পূর্ণাঙ্গতা পেত, তৌরাত ও ঈসা (আ.) এর উপদেশগুলো একত্র হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ দীন তৈরি হতো।
.
কিন্তু ইহুদিরা ঈসা (আ.) এর উপদেশ গ্রহণ করার পরিবর্তে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করল। ঈসা (আ.) এর অন্তর্ধানের পর ‘পল’ নামে একজন লোক ঈসা (আ.) এর আদর্শের প্রতি ঈমান আনল এবং ঈসা (আ.) এর কয়েকজন শিষ্যকে নিয়ে ইউরোপে এই ধর্ম প্রচার শুরু করল যদিও ইহুদিদের বাইরে এই আদর্শ প্রচার করা ঈসা (আ.) এর কঠোর নিষেধ ছিল। ঈসা (আ.) এর উপদেশগুলো তখনকার সময়ের জন্য অত্যন্ত সময়োপযোগী ও হৃদয়গ্রাহী ছিল কিন্তু তা মোটেও পূর্ণাঙ্গ দীন (জীবনব্যবস্থা) ছিল না, সেগুলো ছিল কেবল চরিত্র সৃষ্টির প্রেরণা ও উপাসনাসর্বস্ব। এই ধর্ম ইউরোপে ব্যাপকভাবে গৃহীত হলো ঠিকই কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল যখন এই ধর্ম দিয়ে সমাজ পরিচালনা করতে যাওয়া হলো। যেহেতু সমাজ পরিচালনার নীতিমালা এই উপদেশগুলোর মধ্যে ছিল না তাই ধর্মযাজকরা বাধ্য হয়ে নিজেদের মনগড়া ফতোয়া (বিধি-বিধান) দিয়ে সমাজ পরিচালনা করতে লাগল। সমাজে নেমে আসল অন্যায়-অবিচার।
.
এর ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগে এসে ইউরোপ এমন বর্ববর হলো যে, ধর্মের নামে মানুষকে পুড়িয়ে মারা, ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে মধ্যে ফেলে দেওয়া, মৃত পশুর পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে, হিংস্র জন্তু দিয়ে খাওয়ানোসহ বহু অমানবিক কর্মকাণ্ড প্রতিষ্ঠিত হলো। একদিকে রাজা ও সামন্ত প্রভুদের অত্যাচার অন্যদিকে ধর্মযাজকদের নির্যাতনে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হলো। তখন কিছু চিন্তাশীল মানুষ সিদ্ধান্ত নিল যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মকে আর ব্যবহৃত হতে দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে সেটার সিদ্ধান্ত নেবে মানুষ আর ধর্ম কেবল ব্যক্তিগতভাবে পালন করা যাবে।
.
১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ৮ম হেনরির রাজত্বকালে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। জন্ম হলো ধর্মনিরোপেক্ষতাবাদের। ধর্মের নামে স্থবিরতা, অন্ধত্ব, কূপমণ্ডূকতা অনেকাংশেই দূর হতে থাকল। এটিই ছিল ইউরোপে রেনেসার মূল ভিত্তি। ধর্মের নামে বহু মিথ্যা খ্রিষ্ট ধর্মের মধ্যে প্রচলিত হয়েছিল, কিন্তু মানুষ ধর্মের সেই মিথ্যার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারত না ধর্মযাজকদের ভয়ে। ধর্মের সাথে বৈপরিত্ব আছে এমন বৈজ্ঞানিক সত্য প্রকাশ করার কারণে বহু বৈজ্ঞানিককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার ফলে মানুষের উপর থেকে ধর্মের আইনী বিধিনিষেধ লোপ পেল এবং সমাজে প্রচলিত অনেক মিথ্যার বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হলো, বৈজ্ঞানিক সত্য উদ্ঘাটনের সুযোগ সৃষ্টি হলো, মানুষের প্রতিভা বিকশিত হবার পরিবেশ তৈরি হলো। শুরু হলো নব নব আবিষ্কার, সূচনা হলো নতুন যুগের। এই পরিবর্তনের হাওয়া লাগল সমগ্র পাশ্চাত্য দুনিয়াই। মানুষ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে আকৃষ্ট হতে লাগল ধর্মনিরোপেক্ষতার প্রতি।
.
এখানে মনে রাখতে হবে ধর্মনিরোপেক্ষতার জন্ম হয়েছে খ্রিষ্টধর্মের সেই সমস্ত মিথ্যা ও জবরদস্তিমূলক নীতির বিরুদ্ধে যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা কোনো নীতি নয়, বরং খ্রিষ্টান পোপদের তৈরি বানোয়াট ফতোয়া। আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা নীতি যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয় তবে কখনোই তা মানুষের অশান্তির কারণ হবে না, সেখানে জবরদস্তি থাকবে না। ইউরোপে যখন মধ্যযুগের বর্ববরতা চলছে মুসলিম দুনিয়ায় তখন শান্তির সুশীতল বাতাস বইছে। মুসলমানরা সম্পদের প্রাচুর্যে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিল্প-সংস্কৃতিতে, চরিত্রিক গুণাবলিতে, সামরিক শক্তিতে এক কথায় সমস্ত দিক দিয়ে তখন উন্নতির চরম শিখরে উঠেছে। পৃথিবীর শিক্ষকের জাতি, অনুকরণীয় জাতি, অনুসরণীয় জাতি তখন মুসলিমরা। আর এর মূল ভিত্তি ছিল ত্রুটিহীন পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা ‘ইসলাম’।
.
কাজেই ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার নীতি তথা ধর্মনিরোপেক্ষতা খ্রিষ্টধর্মের জন্য প্রযোজ্য হলেও ইসলাম নামক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার জন্য প্রযোজ্য নয়। কেবল ব্যক্তিজীবনকেন্দ্রিক উপসনা সর্বস্ব ধর্মের যে রূপটি আমরা দেখতে পাই তা ধর্মনিরোপেক্ষতার জন্মের পর থেকেই প্রচলিত হয়েছে এবং এটা মূলত খ্রিষ্টধর্মের জন্যই প্রযোজ্য। ইসলাম, সনাতন, ইহুদি ইত্যাদি ধর্মের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়।
4 thoughts on “উপাসনাসর্বস্ব ব্যক্তিজীবনকেন্দ্রিক ধর্মের যে রূপটি বর্তমানে দাঁড়িয়েছে তা কোথা থেকে আসলো?”
মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।
খুব ভালো বিশ্লেষন ধর্মী লিখা
আসলে ধর্ম এক , ধর্মাচার অনেক।
ধার্মীক সব সময় মিল খোঁজে আর ধর্মান্ধরা খোজে অমিল।
আপনার সু

ন্দর মতামতের জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল …
ত্রুটিহীন পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা ‘ইসলাম’।
ইসলাম এমন এক ধর্মীয় অনুশাসন যা মানুষের কল্যাণের জন্যই পৃথিবীতে এসেছে।
ধর্ম ব্যবসায়ীরা ধর্মের নামে মানুষের মধ্যে অতি-ভয় ছড়িয়ে ফায়দা লুটছেন। ষ্টপ দিজ।
সহমত ….. শ্রদ্ধা জানবেন শ্রদ্ধেয় !