মানুষ ভয়হীন, অশান্তিহীন, নিরাপদ সমাজে বাস করতে চায়। আসলে চূড়ান্ত সুখ-শান্তি (Ultimate happiness and peace) এখানে সম্ভব নয়। পরিপূর্ণ সুখ হলো জান্নাতে। এখানে অর্থাৎ পৃথিবী হলো মর্যাদা অর্জনের প্রতিযোগিতার স্থান, পরীক্ষাস্থল। মর্যাদা কীসে?
.
মর্যাদা হলো আত্মার সংর্ঘষে। আপনি যত বেশি সংর্ঘষে লিপ্ত হবেন তত বেশি মর্যাদাবান হবেন। যত বেশি নির্বিবাদী জীবনযাপন করবেন তত কম মর্যাদাবান হবেন।
.
এটা দু’রকমের হতে পারে। একটা হলো ইচ্ছা করে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হওয়া, এটার আমি বিরোধিতা করি। ইচ্ছা করে আত্মাকে সংর্ঘষে নেয়ার দরকার নেই। ইচ্ছা করে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া নিষেধ, আল্লাহর নীতিমালা পরিপন্থী। বরং কোরআনে আল্লাহ পরীক্ষা থেকে পানাহ চাওয়ার, ক্ষমা চাওয়ার দোয়া দিয়েছেন।
.
আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে- জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহের মাঝেই যে পর্বগুলো আসে সেগুলোকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি করা। এটাই যথেষ্ট আপনার মর্যাদা অর্জনের জন্য। টেনে টেনে বিপদ ডেকে আনার দরকার নাই।
.
প্রশ্ন হলো- সমস্যা নিবেন কি নিবেন না, মোকাবিলা করবেন কি করবেন না। প্রকৃতপক্ষে মোকাবেলা আপনাকে করতেই হবে। কারণ সময় এবং ঘটনা দুইটা একসঙ্গে লাগানো। সময় এবং ঘটনা দু’টি নিয়েই সৃষ্টি। সময় অতিবাহিত হচ্ছে মানেই ঘটনা ঘটবে। কারো জীবনই সরলরেখায় পথ চলবে না।
.
জীবনে উত্থান-পতন থাকবেই। তিতা-মিঠা, রাত-দিন, আলো-আধাঁর, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সব মিলিয়েই জীবন। এর মাঝে থেকে সে আত্মাই বেশি মর্যাদাবান হবে যে আত্মা ক্রমাগতভাবে আসা সংঘাতগুলোকে সবরের সাথে মোকাবেলা করেছে। সংঘাতে না জড়ানো পর্যন্ত আত্মা মর্যাদা লাভ করবে না। পরীক্ষাটা হলো এখানেই। পরীক্ষা দিবেন কি না দিবেন সে ব্যাপারে জোরাজুরি নেই, আপনি স্বাধীন। কিন্তু পরীক্ষা না দিয়ে মর্যাদা লাভ হবে না।
.
যেই না আপনার সামনে কোনো সংকট আসলো সংকটের মোকাবেলা করলে আপনি মর্যাদাবান হবেন। সময় ও ঘটনা স্বাভাবিক গতিতেই চলতে থাকবে। অতিক্রান্ত সময় ও অতিক্রান্ত ঘটনা শত চেষ্টা করলেও আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। এটা একেবারে নির্ধারিত, হবেই হবে, এরই নাম ‘কদর’। সূর্য উঠছে, ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে, ১টা, ২টা, ৩টা আর থামবেনা চলবেই। ঘটনাও ঘটবেই।
.
কাজেই যে কোনো ঘটনাতেই হইচই করার বা হতাশ হবার কারণ নেই। আল্লাহর নির্দেশনা মতো সবর করেন, আপনি মর্যাদাবান হবেন। আর যে ব্যক্তি সবর করতে পারে নি, সে মর্যাদাও লাভ করতে পারে নি। এক সময় হয়তো দেখা গেল যে, ঘটনাও নেই, সময়ও নেই, মর্যাদাবান হবার সুযোগও নেই। অর্থাৎ প্রত্যেক ঘটনা, প্রত্যেক সময় প্রত্যেক মো’মেন বান্দার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সুযোগ।
.
এই হলো মানুষের মর্যাদার সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। সে দৃষ্টিতে মো’মেনদের কোনো ঘটনাই হতাশার নয়, দুঃখের নয়, কষ্টের নয়। যদিও আপনার দুই হাতের কামাই আর কদর, দুটো মিলিয়ে ঘটনা ঘটছে। কিন্তু আপনার এ কামাইটাকে আপনি পরবর্তীতে সুখময় করতে পারবেন এখনকার সবরের কারণে।
.
হেযবুত তওহীদের পথ চলায় বহু ঘটনা ঘটছে এবং একইসাথে সময়ও চলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে কেউ মর্যাদায় উপরে উঠে যাচ্ছে, কেউ নিচে নেমে যাচ্ছে। এই যে সময়টা, এটা কিন্তু প্রত্যেকেই ব্যয় করছে। কেউ সেটাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারছে কেউ পারছে না।
.
যারা এ সময়ের প্রত্যেকটি ঘটনাকে মোকাবেলা করে চলেছে, সংঘাত থেকে পলায়ন করে নি, তারা ক্রমাগত মর্যাদার সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। আর যারা সংঘাত থেকে পলায়নপর হয়েছে তারা মানব ইতিহাসের অনেক বড় সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করেছে।
.
সুতরাং বোঝা গেল, মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় সংঘাতে। ভাল-মন্দের সংঘাত, ন্যায়-অন্যায়ের সংঘাত, গ্রহণ-বর্জনের সংঘাত। কাজেই সংঘাতপূর্ণ কাজ, অপ্রত্যাশিত কাজ, কষ্টের কাজ মো’মেনের জন্য দুঃখের নয়, এটা মর্যাদা বৃদ্ধির একটা উপায়।
.
সংঘাত কীভাবে মর্যাদা বৃদ্ধি করে? একটি উদাহরণ দেই। একজন দাবি করল- সে লোভী নয়। অর্থ-সম্পদের উপর তার কোনো লোভ নেই। এখন তার নির্লোভিতার কোনো পরীক্ষা না দিয়েই কি সে মর্যাদাবান হতে পারবে? না, পরীক্ষা তাকে দিতেই হবে। কারণ তার আত্মা তখনও সংঘাতে জড়ায় নি। যত ভালো ছাত্রই হোক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে সার্টিফিকেট পায় না।
.
ধরা যাক, জনগণের এক লক্ষ টাকা ওই নির্লোভ ব্যক্তির কাছে আমানত রাখা হলো। শুরু হলো তার সংঘাতের পালা, অর্থাৎ পরীক্ষা। এখন বোঝা যাবে সে লোভী না নির্লোভ। আবার যদি সে জনগণের ওই টাকা আমানত হিসেবে রাখতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে তার মানে সে মুত্তাকী বটে, কিন্তু আল্লাহ সংঘাত বা পরীক্ষা থেকে পলায়নমুখী মুত্তাকীকে পছন্দ করেন না।
.
আর যদি সে অন্তরের লোভকে দমন করে শেষ পর্যন্ত যথাযথভাবে সেই আমানত রক্ষা করতে পারে তাহলে ওই এক লক্ষ টাকা তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিল। সে ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠিতে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো। সময়ের নিরন্তর প্রবাহে একটি ঘটনাকে সে তার মর্যাদা বৃদ্ধির সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারল। কিন্তু যদি সে এই ঘটনা থেকে পলায়ন করত, তাতে তার মর্যাদা বাড়ত না, আর যদি পরীক্ষায় ব্যর্থ হতো তাহলে মর্যাদাহানি ঘটত।
.
সংঘর্ষ থেকে পলায়নমুখী সবসময় কাপুরুষ। তার দ্বারা না নিজের উপকার হবে, না মানবজাতির উপকার হবে। যারা বলে বেশি সম্পত্তির দরকার নাই, বেশি সম্পত্তি হলে বিপদ, সংঘাত, পরীক্ষা; সে হলো কাপুরুষ। অবশ্যই সম্পদ দরকার আছে। নিজের জন্য দরকার নেই তো কী হয়েছে, মানবতার কল্যাণের জন্য সম্পদ দরকার আছে।
.
সুতরাং মানুষের জীবন প্রবাহ যে কত মূল্যবান, কত অর্থবহ, তা কল্পনাও করা যায় না। এ জীবনপ্রবাহ পাওয়া বিশাল এক ভাগ্যের ব্যাপার। কোটি কোটি টাকার বিনিময়েও এ জীবনপ্রবাহ পাওয়া যাবে না। এ জীবনকে কি আপনি অভিশাপ হিসেবে নিয়েছেন? মরে গেলে ভাল হতো এমন ভাবছেন? তাহলে আপনি জীবনের অর্থই বুঝেন নি।
.
জীবনের বিশাল অর্থ। হাশরের দিন দেখবেন কত মর্যাদা। প্রকৃত মো’মেনরা সংঘাত দেখলে পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। কারণ ওখানেই মরতবা, মর্যাদা। যারা আধ্যাত্মিক সাধনা করে, হুজরা খানকার বাইরে বের হয় না, তার চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থাকে, পৃথিবীর যাবতীয় সংঘাত, সংঘর্ষ থেকে গা বাঁচিয়ে থাকে তাদের তো আত্মাই নাই। তাদের আত্মা মরে গেছে।
.
যে আত্মা ক্রমাগত ন্যায়-অন্যায়ের সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে আসছে এবং তার মোকাবেলা করছে সে আত্মাই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মা। মাহাত্মটাই হলো সংঘাতমুখী, জীবনটা নির্ধারিত হয়েছে সংঘাতের দিকে, মর্যাদা নির্ধারিত সংঘাতের মধ্যে, অথচ তারা সেখানে যায়ই নি। যত বেশি ছাত্র তত বেশি প্রতিযোগিতা। সেখানে ভাল করলে মর্যাদাও বেশি। যে ক্লাসে একজন মাত্র ছাত্র পড়ে, তাতে রোল নং এক হওয়ায় কোনো মর্যাদা আছে কি?
.
প্রতিযোগিতা যত কঠিন হবে ততই আপনার মর্যাদা বাড়বে। পৃথিবীতে যত বিকৃত সুফীবাদ আছে কখনই তা প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা নয়। প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা হলো মো’মেনদের জীবনে যেটা ঘটে। দুনিয়াতে লোভ, কাম, ক্রোধ, ঈর্ষা, অহংকার যা আছে এগুলোর কেন্দ্রে দু’টি বিষয়। জান ও মাল এ দু’টোই যখন মো’মেনরা আল্লাহর রাস্তায় অর্থাৎ মানবতার কল্যাণে অন্য মানুষের শান্তির জন্য বিলিয়ে দেবে তখন তার মর্যাদা কত উপরে উঠে যাবে কল্পনাও করা যায় না।
.
আমাদের পারিবারিক সংকট আসলে, ব্যক্তিগত সংকট আসলে আমরা মুষড়ে পড়ি। এটা ঠিক না। সংকট আসলো মানে মর্যাদা বাড়ার একটা সুযোগ তৈরি হলো। এটা বিরাট একটা সুযোগ। এগুলো মোকাবেলা করব সব আল্লাহর হুকুম মোতাবেক। এই মাপকাঠি (standard) নির্দিষ্ট করে দেয়ার জন্যই নবী-রসুলগণের আগমন ঘটেছিল। কারণ মাপকাঠি লাগবে। কতটুকু পর্যন্ত কাজ করবে, কতটুকু পর্যন্ত যাওয়া যাবে, এগুলোর মাপকাঠি।
সালজার রহমান সাবু এর সকল পোস্ট
কোর’আনের একটি অলৌকিক বৈশিষ্ট্য
ইসলামবিদ্বেষীরা ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করতে গিয়ে বলে থাকেন যে, “কোর’আন আল্লাহর রচনা নয়, আল্লাহ বলে কেউ নেই। এটি মোহাম্মদ (সা.) রচনা। তিনি একজন সাংঘাতিক চতুর ও প্রতিভাবান লোক ছিলেন। তিনি নিজে এটি লিখে আল্লাহর কেতাব বলে প্রচার করেছেন যেন মানুষ তাঁকে রসুল হিসাবে মেনে নেয়, তাঁর অনুসারী হয় (নাউযুবিল্লাহ)।” আমরা যারা আল্লাহ, তাঁর রসুল এবং আল্লাহর কেতাব আল কোর’আনের উপর পূর্ণ ঈমান এনেছি, আমাদের ঈমানী কর্তব্য হলো এই ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগের জবাব দেওয়া।
তাদের এই অভিযোগের জবাবে আমাদের বক্তব্য হলো, আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য মানুষকে যুক্তি ও বুদ্ধিকে ব্যবহার করা ছাড়া উপায় নেই। কারণ আল্লাহ কখনোই আমাদের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য সামনে এসে দাঁড়াবেন না। তাঁকে বিশ্বাস করতে হবে তাঁর নিদর্শন (আয়াত) থেকে। একইভাবে নবী রসুলগণ যে সত্যিই আল্লাহর প্রেরিত তার প্রমাণস্বরূপ আল্লাহ তাঁদেরকে কিছু মো’জেজা বা অলৌকিকত্ব দান করেছেন যেন সেগুলো দেখে মানুষ তাদেরকে বিশ্বাস করে। সকল নবীর মতো শেষ নবীর (সা.) বেলাতেও প্রশ্ন উঠল, ইনি যে সত্যই নবী, আল্লাহর প্রেরিত তার প্রমাণ কী, চিহ্ন কী? কেউ এ প্রশ্ন করলে তিনি জবাব দিতেন- আমার মো’জেজা কোর’আন। যদিও কোর’আন তার (দ.) একমাত্র মো’জেজা নয়। কিন্তু সত্যই তাঁর সর্ব প্রধান মো’জেজা কোর’আন।
কোর’আনে আগামী সমস্ত সময়ের জন্য মানুষের যা কিছু প্রয়োজন হবে সবই দেয়া আছে। মানুষের জ্ঞান ধীরে ধীরে যতই বাড়তে থাকবে ততই কোর’আনের আয়াতগুলির অর্থ বোঝা যেতে থাকবে। সম্পূর্ণ কোর’আন যে আজ বোঝা যেতে পারে না, কারণ অনাগত ভবিষ্যতের মানুষের জন্য অনেক তথ্য আল্লাহ এর মধ্যে দিয়ে দিয়েছেন, এই সত্যটি আমাদের পণ্ডিতরা, মুফাস্সিররা উপলব্ধি করতে পারেন নি। ফলে তারা এর প্রতিটি আয়াতের তফসীর অর্থাৎ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন মুফাস্সির বিভিন্ন অর্থ, ব্যাখ্যা করেছেন, ফলে নানা মত-অভিমত সৃষ্টি হয়ে জাতির ঐক্য নষ্ট হয়ে গেছে এবং কোন কোন ব্যাখ্যা অদ্ভুত ও অগ্রহণযোগ্য হয়ে গেছে।
স্রষ্টা আল্লাহ তার বাণী, আয়াতগুলি যখন তার সর্বশেষ, সর্বশ্রেষ্ঠ দূতের (দ.) উপর অবতীর্ণ করতে আরম্ভ করলেন তখন প্রথম দিকেই মুদাস্সার অধ্যায়ে (সুরা) মানব জাতিকে সাবধান করে দিলেন যে, তারা যেন একে মানুষের রচনা বলে মনে না করে। বললেন- “যারা এই আয়াত সমষ্টি অর্থাৎ কোর’আনকে অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করবে, এর প্রতি ভ্রু কুঞ্চিত করে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে এবং বলবে এসব পুরনো যাদু এবং মানুষের তৈরি রচনা- তাদের আমি এমন আগুনে নিক্ষেপ করব, যে আগুন তাদের না ছাড়বে, না এতটুকু রেহাই দেবে (সুরা আল মুদাস্সির-২১-২৮)।
এটুকু বুঝলাম, না বোঝার কিছু নেই। যখন কোর’আন অবতীর্ণ হয়েছিল তখন যারা ছিলেন তারাও বুঝেছেন। কিন্তু ঠিক তার পরের আয়াতটিতে বলেছেন- “এর উপর উনিশ” (সুরা আল মুদাস্সির ৩০)। এ কী কথা? আগের কথার সাথে, আগের আয়াতগুলির অর্থের সাথে মিল, সামঞ্জস্য কিচ্ছু নেই, হঠাৎ বলছেন, “এর উপর উনিশ”। কিসের উনিশ, কার উপর উনিশ? গত চৌদ্দশ বছর যারা কোর’আন পড়েছেন তারা এই আয়াতে এসে থমকে দাঁড়িয়েছেন। এ আবার কি? আপাতদৃষ্টিতে বেখাপ্পা এই আয়াতকে কোর’আন থেকে বাদও দেয়া যায় নি। কারণ স্বয়ং আল্লাহ এর রক্ষক, হেফাযতকারী। অন্য সব আয়াতের মত মুফাস্ফিররা এরও ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছেন, কারণ তারা এটা উপলব্ধি করেন নি যে ঐ আয়াত চৌদ্দশ’ বছর পরের মানুষের জন্য আল্লাহ দিয়েছেন, যখন মানুষ কম্পিউটার নামে এক যন্ত্র তৈরি করবে। তার আগে ঐ আয়াতের অর্থ বোঝা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এই সত্য না বোঝার ফলে মুফাস্সিররা এর ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছেন এবং স্বভাবতই এক একজন এক এক রকম ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন দোযখের উনিশ জন মালায়েক আছে ইত্যাদি। জাহান্নামে মাত্র উনিশ জন মালায়েক? ওখানে কোটি কোটিরও বেশি মালায়েক। মহানবীকে (দ.) ঐ আয়াতের অর্থ জিজ্ঞেস করা হয়ছিল কিনা জানিনা, হাদীসে পাইনি। জিজ্ঞেস করা হলেও তিনি তার জবাব দিতেন না বোধহয়, কারণ ঐ আয়াত তদানীন্তন মানুষের জন্য ছিল না, ছিল কম্পিউটারের যুগের মানুষের জন্য, যেমন আরও বহু আয়াত আছে যেগুলো আজ থেকেও ভবিষ্যতের মানুষের জন্য এবং যেগুলোর অর্থ আমরা আমাদের বর্তমানের জ্ঞান দিয়ে হাজার চেষ্টা করলেও বুঝবনা।
কিছুদিন আগে আরেক গবেষক মহাপণ্ডিত ড. রাশাদ খলিফা এই আয়াতের উপর গবেষণা আরম্ভ করলেন আমেরিকায়। আগের মুফাস্সিরদের গবেষণার সঙ্গে এর গবেষণার একটা বড় তফাৎ রইল। সেটা হল ড. খলিফা বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার কম্পিউটারকে কাজে লাগালেন। কম্পিউটারের মাধ্যমে নানা রকম হিসাব করে ড. খলিফা এক আশ্চর্য আবিষ্কার করলেন। তিনি যা আবিষ্কার করলেন তা অতি সংক্ষেপে হল এই- সমস্ত কোর’আন এই উনিশ সংখ্যার একটা আশ্চর্য হিসাবে বাঁধা। কোর’আনের প্রধান প্রধান তো বটেই এমনকি অনেক ছোট খাট বিষয়গুলি পর্যন্ত এই উনিশ সংখ্যার হিসাবে বাধা। ওগুলো সব উনিশ সংখ্যা দিয়ে বিভাজ্য।
প্রথমে ধরুন কোর’আন যে বাক্যটি দিয়ে আরম্ভ হয়েছে অর্থাৎ ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম’ এতে উনিশটি অক্ষর আছে। এই বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম বাক্যটি কোর’আনে ১১৪ বার আছে, প্রত্যেক সুরার আরম্ভে এবং সুরা নামলের মধ্যে। এই ১১৪ সংখ্যা উনিশ দিয়ে বিভাজ্য। (১৯ X ৬) = ১১৪। সম্পূর্ণ কোর’আন কেমন করে এই উনিশ সংখ্যার হিসাবে বাধা, এমন কি এর কতকগুলি অধ্যায়ের (সুরার) আরম্ভে যে মুকাত্তায়াত অর্থাৎ অক্ষরগুলি আছে সেগুলির হিসাবও এই উনিশ সংখ্যার হিসাবে বাধা তা সবিস্তারে এখানে লেখা সম্ভব নয়। এজন্য ড. রাশেদ খলিফার The Perpetual Miracle of Muhammad বইটি পড়লে হিসাবটির পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যাবে।
প্রশ্ন হচ্ছে প্রায় সাড়ে ছিয়াশি হাজার শব্দের একটি বই তেইশ বছর ধরে যদি কোন মানুষ রচনা করেন তবে তার মধ্যে নিজের বক্তব্য, ভাষার সৌন্দর্য্য ইত্যাদি ঠিক রেখে সমস্ত বক্তব্যের মধ্যে কোথাও অমিল, বিরোধিতা না থাকে সেদিকে লক্ষ রেখে সেই সঙ্গে এই বিরাট বইটিতে উনিশ সংখ্যার একটা আশ্চর্য বাঁধনে বেধে দেয়া কোন মানুষের পক্ষে কি সম্ভব? বিশেষ করে ঐ মানুষটি যদি ইতিহাসের ব্যস্ততম মানুষ হন যিনি নিরবচ্ছিন্ন প্রবল প্রতিরোধের মুখে একটি সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলে নতুন সমাজ, নতুন জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, মানব জাতির ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করেছিলেন, দশ বছরে আটাত্তরটি যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন, ২৭ টিতে নিজে অংশ গ্রহণ করেছিলেন, বিশেষ করে ঐ মানুষটি যদি নিরক্ষর হন?
যদি সম্ভব না হয় তবে দু’টি মাত্র সম্ভাবনা থাকে। সেই বিশ্ব সৃষ্টির প্রশ্নের মত অর্থাৎ এই হিসাবটা আকস্মিকভাবে (Accidentally) হয়ে গেছে, আর যদি তা না হয়ে থাকে তবে অবশ্যই এই কোর’আনের রচয়িতা হলেন স্বয়ং আল্লাহ। এই প্রশ্ন সমাধানে ড. রাশেদ খলিফা এ যুগের বিস্ময় কম্পিউটারের সাহায্য নিয়েছেন, যে যন্ত্রের হিসাবের উপর নির্ভর করে আজকের যান্ত্রিক সভ্যতা চলছে, যে যন্ত্রের হিসাবের উপর নির্ভর করে মানুষ চাঁদে গেছে, মঙ্গল গ্রহে, শনি গ্রহে এবং মহাকাশে রকেট পাঠিয়েছে। তিনি এই সমস্ত তথ্য কম্পিউটারে প্রবিষ্ট করিয়ে প্রশ্ন রাখলেন সমস্ত বইটাতে ওমুক ওমুক ভাবে উনিশ সংখ্যার হিসাবে বেধে যাওয়াটা আকস্মিকভাবে (Accidentally) হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? কম্পিউটার হিসাব করে জবাব দিল ৬২৬০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০ এর মধ্যে ১, অর্থাৎ ৬২৬ লিখে তারপর চব্বিশটা শূণ্য যোগ করলে যে সংখ্যা হয় ততবারের মধ্যে মাত্র এক। এক কথায় অমনটি আকস্মিকভাবে হওয়াটা অসম্ভব। বাকি রইল এই হিসাবে সমস্ত কোর’আনকে বেঁধে দেয়ার কাজটা করেছেন হয় রসুলাল্লাহ (দ.) আর না হয় আল্লাহ। পেছনে দেখিয়ে এসেছি এটা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, কাজেই একমাত্র সিদ্ধান্ত হল এটা করেছেন স্বয়ং স্রষ্টা। এবং তাই এত বড় প্রমাণ সত্ত্বেও যারা একে আল্লাহর মুখের কথা বলে বিশ্বাস করবে না তাদের জন্য বলেছেন- তাদের আমি এমন আগুনে নিক্ষেপ করব যে আগুন তাদেরকে না ছাড়বে, না এতটুকু রেহাই দেবে (সুরা আল মুদাস্সির ২৮)।
মগজের জট খুলি: মনু ও নূহ (আ.)
মহাভারত ও মৎস্যপুরাণে বৈবস্বত মনু নামে একজন মহর্ষীর উল্লেখ রয়েছে। বাংলা মনুষ্য শব্দটির উৎপত্তি এই মনু শব্দ থেকেই। কেন তা বলছি। বিষ্ণুর দশজন অবতারের মধ্যে মৎস্য অবতার অন্যতম। তিনি মলায়চলের একদেশে গিয়ে বিপুল তপস্যা করেন।
বহু বর্ষ অতীত হলে ব্রহ্মা তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে বর প্রদান করতে চাইলেন। প্রণিপাত করে মনু বললেন, ‘হে পিতামহ! আমি আপনার নিকট একটিমাত্র বর ইচ্ছা করি। যখন প্রলয়কাল উপস্থিত হবে, তখন আমি যেন জীবসকলসহ সমগ্র জগতের রক্ষা করতে সমর্থ হই।’ ব্রহ্মা ‘তথাস্তু’ বলে অদৃশ্য হলেন।
কিছুদিন পর ভগবান বিষ্ণু মাছের রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়ে বলেন ‘হে নিষ্পাপ! শুনুন, এখন একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটার সময় উপস্থিত। পাহাড়, বনসহ সমস্ত পৃথিবী অচিরেই জলমগ্ন হবে। আপনি সুদৃঢ় একখানি নৌকা নির্মাণ করাবেন আর সপ্তর্ষীগণসহ যাবতীয় জীবের বীজ নিয়ে ঐ নৌকায় আরোহণ করে আমার জন্য প্রতীক্ষা করবেন।”
এরপর শুরু হোল শতবর্ষব্যাপী প্রবল খরা। দারুণ দাবদাহে পৃথিবী ছাইবর্ণ হয়ে গেল। কোথাও এক ফোটা পানি নেই। এরপর এলো সেই প্রচণ্ড ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাতসহ মহাপ্লাবন। বিশ্বচরাচর প্লাবিত হয়ে এক মহাসমুদ্রের রূপ নিল।
শিংবিশিষ্ট মৎস্যরূপে ভগবান বিষ্ণু আসলেন। মনু তাঁর শৃঙ্গে রজ্জু বন্ধন করলেন। তিনি তখন মহাবেগে নৌকাকে টেনে নিয়ে সমুদ্রে বিচরণ করতে লাগলেন। মহাপ্লাবনে সকল মানুষে বিলীন হোয়ে গেল, কেবল সপ্তর্ষিগণ, মনু ও মৎস্যই দৃশ্যমান থাকলেন।
মৎস্য এইভাবে অনেক বৎসর সাগরসলিলে নৌকাসহ বিচরণ করতে লাগলেন। অতঃপর একটি পর্বতের চূড়া দৃশ্যমান হলে মৎস্য সেদিকে নৌকা নিয়ে চললেন। সেখানে নৌকা বাঁধা হল।
.
এরপর মৎস্য নৌকারোহীদের বললেন, ‘হে মহর্ষিগণ! আমি মৎস্যরূপ নিয়ে এই বিপদ থেকে তোমাদেরকে উদ্ধার করলাম। এখন এই বৈবস্বত মনু সকল প্রকার জীবজন্তু ও মানুষ সৃষ্টি করবেন।’ বন্যার পানি কমতে লাগলো। পৃথিবী পুনর্ণিমাণের জন্য মনু ও তাঁর পরিবার পাহাড় থেকে ভূমিতে নেমে এলেন এবং পুনরায় পৃথিবীতে বংশবিস্তারের মাধ্যমে মানব প্রজাতি টিকিয়ে রাখলেন।
নূহ (আ.) এর জীবনের সঙ্গে মৎস্যপুরাণের এই ঘটনাটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাম্য দেখা যায়। যেমন:
১। স্রষ্টার নির্দেশে বিরাট নৌকা নির্মাণ।
২। স্রষ্টার পূর্বঘোষিত মহাপ্লাবনে ও বারিবর্ষণে সমগ্র পৃথিবী প্লাবিত হওয়া।
৩। নৌকায় চোড়ে স্রষ্টার সহায়তায় মনু ও ঋষিদের উদ্ধার পাওয়া। উদ্ধারপ্রাপ্তদের সংখ্যা ছিল অতি অল্প।
৪। সকল প্রাণীর প্রজাতি (বীজ) নৌকায় তোলা ও বন্যার পরে আবার সেসব প্রজাতির বিস্তার ঘটানো।
৫। সকল মানুষ ধ্বংস হওয়ার পর কয়েকজন থেকে আবার মানবজাতির বংশবিস্তার ঘটানো।
প্রশ্ন হলো, অধিকাংশ মুসলিম মনে করেন হিন্দু ধর্ম কাল্পনিক। তাহলে কোর’আনের হাজার হাজার বছর আগের এই পুরাণে প্রায় হুবহু ঘটনার বিবরণ কীভাবে ঠাঁই পেল? এই বৈবস্বত মনু আসলে কে?
কেন মুসলিমরা জাহান্নামের জ্বালানী হবে?
একটি হাদীস শেষের অংশ থেকে শুরু করি। রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন, যারা এই ঐক্যবন্ধনী থেকে এক বিঘত পরিমাণও দূরে সরে যাবে, তাদের গলদেশ থেকে ইসলামের বন্ধন খুলে যাবে যদি না সে তওবা করে ফিরে আসে। আর যে জাহেলিয়াতের কোনো কিছুর দিকে আহ্বান করে সে জাহান্নামের জ্বালানি পাথরে পরিণত হবে, যদিও সে নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এমন কি নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাসও করে [হারিস আল আশয়ারী (রা.) থেকে আহমদ, তিরমিজি, বাব-উল-ইমারত, মেশকাত]।
এই যে ভয়ঙ্কর কথাটি রসুলাল্লাহ বললেন, “নামাজ রোজা করলেও, মুসলিম বলে মনে করলেও জাহান্নামের জ্বালানি পাথর হবে” – কেন?
প্রথমেই ঐক্য। তারপরে শৃঙ্খলা। তারপর আনুগত্য। তারপর হিজরত (যাবতীয় অন্যায়, অসত্য, শেরক, কুফরকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান)। তারপর জেহাদ (ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা)।
এখন ১৫০ কোটি মুসলমান নামক এই জাতির ঐক্যের কী পরিস্থিতি সেটা আশা করি সবাই দেখতে পাচ্ছেন। শৃঙ্খলা তো প্রশ্নই আসে না, কোথাও নেই। আর আনুগত্য? কার আনুগত্য করবে? জাতির নেতা কে? গত কয়েক শতাব্দী থেকে কি জাতির নেতা আছে কোন? যে যার মতো ফতোয়া দিচ্ছে, যার ইচ্ছা মানছে যার ইচ্ছা নাই মানছে না, ভিন্ন ফতোয়া বের করছে, জাতির কোনো লক্ষ্য নাই, উদ্দেশ্য নাই। আর অন্যায়ের থেকে হিজরত? প্রশ্নই আসে না। দুনিয়ার সমস্ত পাপাচার, অন্যায়, অবিচার, শিরক, কুফরকে আলিঙ্গন করে নিয়েছে নামধারী মুসলিম জাতি।
সুদ, ঘুষ, সন্ত্রাস ইত্যাদির কথা বাদ দিলাম, সামান্য ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে কথা বললাম তাতেই জবাই করে দেওয়া হচ্ছে। কাজেই যাবতীয় অন্যায়কে এরা আলিঙ্গন করে নিয়েছে বহু শতাব্দী আগে থেকেই।
জেহাদ তো বাদ দিয়েছে ১৩০০ বছর আগেই। তারপর থেকে তথাকথিত সুলতানরা সাম্রাজ্যবিস্তারের যুদ্ধ করেছে, লুটপাট চালিয়েছে এবং সেটাকেই জেহাদের নামে চালিয়ে দিয়েছে। আর বর্তমানে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দাজ্জালীয় শক্তির ক্রীড়নক হিসাবে কিছু লোক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে আর সেটাকে জেহাদ নাম দিয়ে ইসলামকে কলঙ্কিত করছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য মানবতার কল্যাণে নিঃস্বার্থ নির্মোহ সংগ্রাম হারিয়ে গেছে বহু আগেই। মুসলিম এখন মরা, নির্জীব, নিবীর্য হয়ে সবার মার খাচ্ছে। তার দুনিয়ার জীবনটাই তো জাহান্নাম। তারা আখেরাতে জাহান্নামের জ্বালানী হবে না তো কী হবে?
দেহ-আত্মা
দেহ-আত্মার সমষ্টি মানুষ। তাই নিছক দৈহিক চাহিদা পূরণ করা গেল মানেই জীবন সুন্দর ও সার্থক হয়ে গেল এমনটা ভাবলে হিসাবে ভুল হবে। আত্মাকে বাইরে রেখে জীবনের সমীকরণ মিলবে না।
গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন- পিপাসার সমান কোনো নদী নেই। আসলে দৈহিক চাহিদার কোনো শেষ নেই। দেহকে যত দেওয়া হবে তার চাহিদা তত বাড়বে। একটা মানুষ যদি সম্পূর্ণ দেহসর্বস্ব বস্তুবাদী জীবে পরিণত হয় একটা আস্ত পৃথিবী দিয়ে দিলেও তার চাহিদায় ভাটা পড়বে না। এই সীমাহীন চাহিদা পূরণের সাধ্য কারও নেই। এ কারণেই প্রকৃতি দেহকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আত্মার ব্যবস্থা রেখেছে। দেহ নামক রথের সারথী হচ্ছে আত্মা।
দেহ চায় ভোগ-বিলাস, আত্মা চায় সংযম। দেহ চায় কেবলই ইন্দ্রীয়সুখ, আত্মা চায় পরম কল্যাণ। দেহ চায় ব্যক্তিস্বার্থ, আত্মা চায় আত্মত্যাগ। দেহ আদর্শহীন, লক্ষ্যহীন, গন্তব্যহীন। আত্মা ন্যায় ও সত্যের প্রতিভূ, তার লক্ষ্য আছে, গন্তব্য আছে। দেহ নশ্বর, সে ভাবে মরে গেলেই সব শেষ, যা ভোগ করার এখনই করতে হবে। অন্যদিকে আত্মা অবিনশ্বর। সে জানে পৃথিবী তার আসল ঠিকানা নয়। সে পরমাত্মার অংশ। যেখান থেকে সে এসেছে সেখানে ফিরে যাওয়াই তার লক্ষ্য। সেই পরমাত্মায় লীন হবার পথ ভোগে নেই, সে পথ নিহিত ত্যাগে। এ কারণে দেহ সুখ পায় ভোগে, আত্মা সুখ পায় ত্যাগে। দেহের সুখ ক্ষণস্থায়ী ও অপ্রাকৃতিক, আত্মার সুখ চিরস্থায়ী ও প্রাকৃতিক।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে আমি দেহকে মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছি না। আসলে তা নয়। দেহ ছাড়া আত্মা অচল। আত্মা চায় পরমাত্মায় বিলিন হতে। আত্মা থেকে পরমাত্মা পর্যন্ত পৌঁছতে যে পথ, সে পথের বাহন হচ্ছে দেহ। দেহের কারণে আত্মার অপমৃত্যু ঘটে এটা যেমন সত্য, একইভাবে এটাও সত্য যে, দেহ ছাড়া আত্মার উন্নতি সম্ভব নয়। কীভাবে ও কোন পথে দেহ নামক রথকে পরিচালিত করলে আত্মা পরমাত্মার সন্ধান পাবে তারই বিধিবদ্ধ সিস্টেম হচ্ছে ধর্ম।
ধর্মে দেহ ও আত্মার সমান গুরুত্ব। কারণ দেহ যিনি সৃষ্টি করেছেন, আত্মা যিনি সৃষ্টি করেছেন, ধর্ম সেই পরমাত্মারই সৃষ্টি। তিনি জানেন দেহ কী চায়, একইসাথে জানেন কীভাবে সেই চাওয়াকে প্রশমিত করা সম্ভব। তিনি জানেন দেহ কেন অন্যায় করে, অমঙ্গল করে, একই সাথে এও জানেন- কীভাবে সেই অন্যায় ও অমঙ্গল থেকে তাকে ফেরানো সম্ভব। দেহকে ন্যায় ও সত্যের উপর অটল রাখার জন্য আত্মাকে কী ভূমিকা পালন করতে হবে সেটাই ধর্মের মূল বিষয়বস্তু। ধর্ম আর কিছু নয়, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার পার্থক্যটা জানিয়ে দেয়।
আত্মা যদি তার নিজ ক্ষমতাবলে দেহকে সত্য ও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখে তাহলে ভয় নেই। সে সফল হবে। আর যদি দৈহিক ইন্দ্রীয়সুখের কাছে ন্যায় ও সত্য পরাজিত হয়, তবে আত্মা তার শক্তি হারায়। যত সময় যায় দেহ ততই আত্মার আকর্ষণী বলয়ের বাইরে চলে যায়। এক সময় আত্মার মৃত্যু ঘটে। দেহের চাহিদা পূরণই মানুষের জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, একটা আস্ত পৃথিবীও যে চাহিদা পূরণ হবার জন্য যথেষ্ট নয়।
সামানান কালীলা
পবিত্র কোর’আনে আল্লাহর বাণীকে, সত্যকে গোপন (conceal) করার ক্ষেত্রে আল্লাহ ব্যবহার করেছেন ‘তাক্তুমু, ইয়াকতুমুনা’ এই শব্দগুচ্ছ। আর ধর্মের কাজ করে মানুষের কাছ থেকে তার বিনিময়ে তুচ্ছ পার্থিব মূল্য, বৈষয়িক স্বার্থ small price, a gain) হাসিল করার ক্ষেত্রে আল্লাহ ব্যবহার করেছেন ‘সামানান কালিলান’। এই শব্দ দুটো কোর’আনে বার বার এসেছে। এ কাজটি যে কেবল হারামই নয়, এটা যে কুফর, যারা এ কাজ করবে তারা যে আগুন খাচ্ছে, পরকালেও তারা যে জাহান্নামে যাবে, তারা যে আলেম নয় পথভ্রষ্ট, পবিত্র কোর’আনের সুরা বাকারার ১৭৪-১৭৫ নম্বর আয়াতে এই সবগুলো কথা আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ও সরল ভাষায় উল্লেখ করেছেন যা বোঝার জন্য কোনো তাফসির বা ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না, সরল অনুবাদই যথেষ্ট। এ আয়াতে আল্লাহ বলেন,“বস্তুত, যারা আল্লাহ কেতাবে যা অবতীর্ণ করেছেন তা গোপন করে এবং এর বিনিময়ে পার্থিব তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, তারা তাদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই ঢুকায় না। এবং আল্লাহ হাশরের দিন তাদের সঙ্গে কথাও বলবেন না, তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না। এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব। এরাই হচ্ছে সেই সমস্ত মানুষ যারা সঠিক পথের (হেদায়াহ) পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা (দালালাহ) এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করে নিয়েছে। আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল।”
এই দীনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নীতি এই আয়াতে ঘোষিত হয়েছে। যারা আল্লাহর অবতীর্ণ কেতাবের বিধিবিধান ও শিক্ষাকে গোপন করে এবং দীনের বিনিময়ে অর্থ বা স্বার্থ হাসিল করে তারা-
১। “আগুন ছাড়া কিছুই খায় না।” অর্থাৎ তারা যা কিছু খায় তা সমস্তই জাহান্নামের আগুন। তাদের এই অপকর্ম, গর্হিত কাজ তাদের ভক্ষিত সকল হালাল বস্তুকেও হারামে পরিণত করে, যেভাবে আগুন সব কিছুকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।
২। “হাশরের দিন আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথাও বলবেন না”। এ থেকে বোঝা যায় আল্লাহ তাদের উপর কতটা ক্রোধান্বিত। আল্লাহ যার সাথে কথাও বলবেন না তার সেই মহাবিপদের দিন কী দুর্দশা হবে কল্পনা করা যায়?
৩। “তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না।” মানুষ মাত্রই পাপী, আল্লাহর ক্ষমার সরোবরে স্নান করেই মানুষ পাপমুক্ত হয়ে জান্নাতে যেতে পারে। আল্লাহর এই ক্ষমার হকদার হচ্ছে মো’মেনগণ। কিন্তু যারা ধর্মব্যবসায়ী তারা গাফুরুর রহিম, আফওয়ান গফুর, গাফুরুন ওয়াদুদ, সেই অসীম প্রেমময় ক্ষমাশীল আল্লাহর ক্ষমা থেকেও বঞ্চিত হবে। আল্লাহ তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না।
৪। “তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব”। এ হচ্ছে চূড়ান্ত কথা যা সব অস্পষ্টতাকে নস্যাৎ করে দেয়। ধর্মের কাজ করে স্বার্থহাসিলকারীরা জাহান্নামী এ নিয়ে আর কোনো সন্দেহের বা দ্বিমত পোষণের অবকাশ থাকে না।
৫। “তারা হেদায়াতের বিনিময়ে পথভ্রষ্টতা ক্রয় করেছে”। খুবই দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য। আমরা আলেম সমাজের কাছে কেন যাই, কেন তাদের ওয়াজ, খোতবা নসিহত শ্রবণ করি? নিশ্চয়ই পরকালীন মুক্তির পথ জানার জন্য? হেদায়াহ শব্দের মানেই হচ্ছে সঠিক পথনির্দেশ। আল্লাহ বলেই দিচ্ছেন, যারা ধর্মের কাজের বিনিময় গ্রহণ করে তারা নিজেরাই পথভ্রষ্ট।
একজন পথভ্রষ্ট মানুষ কী করে আরেক ব্যক্তিকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে? এ কি সম্ভব?
চিন্তা, মতামত, যুক্তি, পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত প্রয়োগের প্রতিফল বা পরিণতি!!!
মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই স্বাধীন, গতিশীল ও সৃষ্টিশীল জীব। পরিবর্তন তার স্বভাবজাত ধর্ম। সে স্থবির, অচল, অসার হয়ে বসে থাকতে পারে না। সে চিন্তা করবে, মতামত দিবে, যুক্তি উত্থাপন করবে, যুক্তি খণ্ডণ করবে, পর্যবেক্ষণ করবে, ভুল সংশোধন করবে, সিদ্ধান্ত নিবে। এই সিদ্ধান্তের উপর আবার জোর চলবে না। যে যেমন সিদ্ধান্ত নিবে সে তেমন প্রতিফল বা পরিণতি লাভ করবে। কিন্তু অন্ধ অনুকরণ মানুষের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কেড়ে নেয়। মানুষের যুক্তিবোধ নষ্ট করে দেয়, গতিশীলতার রাশ টেনে ধরে, পরিবর্তনকে ভয় পেতে শেখায়। ফলে মানুষ জীবনধর্ম হারিয়ে মৃতপ্রায় প্রাণীতে পরিণত হয়। মানবসভ্যতা থমকে দাঁড়ায়।
পৃথিবীর ইতিহাস বলছে- যখনই মানুষ তার জীবনধর্ম হারিয়েছে, নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক ও যুক্তিবোধকে কাজে না লাগিয়ে অন্যের হাতে বন্ধক রেখেছে, অনুকরণকেই নিজের ধর্ম সাব্যস্ত করে নিয়েছে তখনই স্রষ্টা মানবজাতিকে উদ্ধারহেতু কোনো না কোনো মহামানব পাঠিয়েছেন। এই মহামানবরা মানুষের বানানো শৃঙ্খল ভেঙ্গে পরাধীন মানুষকে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করিয়েছেন। যুগের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। মানুষকে শিখিয়েছেন কীভাবে চিন্তা করতে হয়, কীভাবে যুক্তির প্রয়োগ ঘটাতে হয়, কীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং কীভাবে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে হয়।
যেহেতু সকল ধর্ম এক উৎস থেকে এসেছে সুতরাং সকল ধর্মমতেই অন্ধ অনুকরণ করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। মানুষ ও স্রষ্টার মধ্যে কোনো মধ্যসত্তভোগী শ্রেণির অস্তিত্ব ধর্ম স্বীকার করে না। এর প্রয়োজন নেই। যা প্রয়োজন তা হচ্ছে দৃষ্টি। ধর্মের উদ্দেশ্য মানুষকে দৃষ্টি দান করা। যাতে করে সে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, ধর্ম-অধর্ম পার্থক্য করতে পারবে। সঠিক দৃষ্টি পেলে মানুষ নিজেই বুঝতে সক্ষম হবে কোন পথে তার কল্যাণ, কোন পথে অকল্যাণ। তারপর সে কোন পথ বেছে নেয় তা একান্তই তার নিজের সিদ্ধান্ত। যে বীজ সে বপন করবে সেই গাছেরই চারা গজাবে। এক সময় সে চারা ডাল-পালা গজিয়ে বিরাট মহীরূহে পরিণত হবে। ফল ধরবে। সেই ফলের নামই জান্নাত ও জাহান্নাম।
যুগসন্ধিক্ষণের কথা
পুরাতন ব্যবস্থা ভেংগে পরবে আর নতুন ব্যবস্থার জন্ম হবে ? আবার সেই হাজার বছরে সভ্যতা নতুন রুপ নিয়ে প্রতিভাবিত হবে? যে প্রকার বর্ষা ঋতুর পূর্বে মেঘে আচ্ছন্ন আকাশ ময়লা দেখায় আর ধুলায় ঢাকা মাটি ময়লা দেখায় সেই প্রকার স্থিতি আজ।
আর বৃষ্টির পড়ে আকাশ আর পৃথিবী ধুয়ে স্বচ্ছ হয়ে যায় ঠিক এই রুপ এই বিধ্বংসের পরে বিষাক্ত সভ্যতা ধুয়ে স্বচ্ছ হয়ে যাবে তবে ভয় কিসের আমাদের ? এই নতুন সভ্যতা নির্মাণের কারণে আমাদের কে মোহ ত্যাগ করতে হবে ?
সমগ্র পৃথিবীর কল্যাণের চিন্তা করতে হবে? এর পড়ের আমরা কি বসে থাকতে পারি না পারি না? হয়ত এর অর্থ আমাদের হৃদয় পর্যন্ত যাচ্ছে না? কারণ আমাদের এই মন মোহ দ্বারা ঘিরে আছে?
প্রশ্ন থেকে যায় আমাদের যে কি জানতে পারলে আমাদের এই মোহ বা দুর্বলতা ত্যাগ করতে পারব ? তাহলে জানতে হবে আমাদের জীবনের রহস্যকে, জানতে হবে সংসারের বাস্তবিক রূপকে অনুধাবন করতে হবে? নদীর প্রবাহকে যেমন মুষ্টিবদ্ধ করে গ্রহন করলে কিছুই পাওয়া যায়না কিন্তু সেই হাতকে অঞ্জলী করে নদীর প্রবাহে নিমজ্জিত করলে নদীর পানি মুখ পর্যন্ত পৌছাতে পারে?
আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে অহংকারে মুষ্টিবদ্ধ করছি না সমর্পণের অঞ্জলী বানিয়েছি আমরা? আসলে আমরা কি এই জ্ঞানকে গ্রহন করতে পারবো?
প্রসঙ্গঃ ধর্ষক, লম্পট ও পায়ুকামী মোল্লা
ইদানীং দেখা যাচ্ছে ধর্ষক, লম্পট, পায়ুকামী কোনো মোল্ল অপকর্মে লিপ্ত হলে তাদেরকে বলা হচ্ছে তারা আলেম নয়। তারা আলেম বেশে মসজিদ মাদ্রাসায় প্রবেশ করে অপকর্ম করে ইসলামের বদনাম করছে। অথচ কিছুদিন আগেও বলা হতো, আলেমদের অপরাধ গোপন করতে। এগুলো ফেসবুকে প্রকাশ না করতে। এ জন্য তারা হাদিসের অপব্যবহার পর্যন্ত করেছে। তারা বলেছে, এক মুসলিমের অপরাধ গোপন করলে নাকি পরকালে আল্লাহ তার অপরাধ গোপন করবেন। এটা ঠিক ঐরকম ধর্ষকদের ট্রিক্স এর মতোই মনে হয় যারা ধর্ষণ বলাৎকার করার সময় ভিক্টিমের প্রতি পরকাল ও আল্লাহর ভয়কে কাজে লাগাত। অর্থাৎ ওস্তাদের কথা না শুনলে পরকালে জাহান্নামের আগুনের ভয় দেখানো আর ওস্তাদদের পাপ গোপন করার নীতি একই সূত্রে গাঁথা।
ধর্ষকরা আলেম নয়- এবার এ বিষয়ে আসি। দশ বছর, বিশ বছর একজন ব্যক্তি মসজিদে খতিবগিরী করলো, মাদ্রাসায় মুহতামিমের পদে থেকে ছাত্রছাত্রীদের কোরান শিক্ষা দিল, নুরানী চেহারা নিয়ে পরের বাড়ি খেলো, ঘাড় মোটা করলো- সে ব্যক্তি আলেম না হলে তবে আলেম কোন বেটা? এতদিন আলেমদের পাপ গোপন করার কথা বলে এসে এখন যদি বলেন তারা আদৌ আলেম নয় তবে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ালো? এভাবে আর কত পিছলাবেন ভাই?
ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত আপনিই তাকে আলেম মনে করে আপনার বাবা মায়ের জানাজা পড়িয়েছেন, বিয়ে করেছেন তাদের মাধ্যমে, সন্তানের নাম রেখেছেন তাদের কাছ থেকে। আকিকাতে খাসি জবাই করে মাথা খাইয়েছেন ঐ আলেমকেই। আর আজ সে আলেম থেকে বাতিল হয়ে গেল? ভবিষ্যতের নন আলেম (ধর্ষক, বলাৎকারকারী) যে এখন আপনার কাছে আলেম হিসেবে গৃহিত হচ্ছে না, আপনার বাড়ি যে ভালো ভালো খাচ্ছে না তার নিশ্চয়তা কি? সারাজীবন সম্মান করে এসে দেখলেন আসলে বেটা একটা ধর্ষক, লম্পট, বলাতকারকারী কওমে লুতের সদস্য- তখন ব্যাপারটা কি রকম দাঁড়াবে?
আপনি বলতে পারেন আলেমরাও মানুষ। তারাও অপরাধ করতে পারে। কিন্তু আমি বলি, আসলে তারা আলেমও না, মানুষও না। ওরা অবিশ্বাসী। না হলে প্রতিদিন কোরান পাঠ করে, পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ে কীভাবে বাচ্চা বলাৎকার করে? ওরা জানে না এটা কত বড় পাপ? ওরা জানে না এই অপরাধে কওমে লুত নামে একটা পুরো কওমকে আল্লাহ জমিন উল্টিয়ে ধ্বংস করেছেন? সে ঘটনা জেনে কেবল অবিশ্বাসী হলেই একই অপরাধ দিনের পর দিন করে যাওয়া সম্ভব।
আরও একটা কারণ আছে। ওরা অপ্রাকৃতিক জীবন বেছে নিয়েছে। খ্রিষ্টানদেরকে যেমন আল্লাহ সংসার ত্যাগী হওয়ার আদেশ দেননি, কিন্তু তারা সেই বৈরাগ্যই গ্রহণ করে তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা সোজা কথা নারে ভাই। কত ঋষি-মুনি বনে জঙ্গলে গিয়ে বৈরাগ্য নিয়ে কামনার যন্ত্রনায় ছটফট করেছে, কামনা রোধ করতে কত সাধনা করেও ব্যর্থ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আর তুমি বেটা কোন শালা? আল্লাহর নিয়মকে লঙ্ঘন করে ওরা যেমন পারেনি, তেমনি তথাকথিত ধার্মিক শ্রেণি নারী সংসর্গ বাদ দিয়ে অপ্রাকৃতিক জীবন গ্রহণ করে নিয়েছে তারাও পারছে না, পারবেও না। উলটো তাদের মনে বিকৃত যৌনতা প্রবেশ করেছে। নদীকে বাঁধ দিলে যেমন তা লোকালয় উপচে পড়ে, এদের ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। অপ্রাকৃতিক জীবনধারা তাদেরকে যৌনকামনায় সর্বদা তিরতির করে কাঁপতে থাকা অসুস্থ মানুষে পরিণত করেছে। যৌন চিন্তা এদেরকে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে। মেয়েদের দেখলে এরা যে মন্তব্য করে বা মেয়েদের নিয়ে এদের চিন্তা যে লেভেলের তা যদি কোনো প্রকারে ভিজ্যুয়াল করা যেত তবে দেখা যেত চারপাশ কমনার লালায় পিচ্ছিল হয়ে গেছে। এরা এমনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় কওমে লুতের অপরাধ মসজিদ মাদ্রাসার মতো পবিত্র স্থানে বসে করে যাচ্ছে। এদেরকে সুস্থ দাবি করার মানুষ কেবল তারাই, যারা তাদের মতো অসুস্থ।
শিরোনাম হীন লেখা
বাঙালি সুস্থ চিন্তা ভুলে যাচ্ছে। সব সময় খোঁজে আছে খারাপ কিছুর। এরা পদ্মাসেতুতে মাথা লাগে এইটাতে বিশ্বাস করেছে। ছেলেধরা সন্দেহ করে মানুষকে সাপের মতো পিটিয়ে মেরেছে। আহত করেছে অনেককে। কিন্তু প্রকৃত ছেলেধরার সাথে একটি ঘটনারও সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তবে এই যে এতগুলো মানুষের প্রাণ গেল, এতগুলো মানুষ আহত হলেন তাদের কি হবে?
সবসময় মানুষের রক্ত টগবগ করছে। এরা গরম গরম কিছু চাচ্ছে অনবরত। স্বাভাবিকতা, সুস্থতা তারা গ্রহণ করতে পারছে না। চরম কিছু চায় এরা। ধুমধাম না হলে এদের গা ম্যাজম্যাজ করে। গা ম্যাজম্যাজ থেকেই অপরকে পিটিয়ে এরা চরমানন্দ খুঁজছে। এরা ভালো জিনিস মানতে পারছে না।
ইউএনও’র ফোন পানিতে পড়ে গেছে। এক ছাগল মার্কা সাংবাদিক সেটাকে রসিয়ে বসিয়ে ইউএনও’র স্ত্রীর সাধের মোবাইল ফোন বলে রিপোর্ট করলো। ক্ষমতা দেখিয়ে বউয়ের ঐ সাধের মোবাইলখানি ফায়ার সারভিসের লোক দিয়ে উঠানো হয়েছে বলেও খবর করা হলো। পাবলিক সেটাই খেয়ে নিল। ভাইরাল হলো। কিন্তু দেখা গেল ঘটনা খুব সাধারণ। ফোনটা মোটেও ঐ সরকারি কর্মকর্র্তার স্ত্রীর ফোন নয়।
ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় নির্বাচক সুজন বিদেশে গিয়ে ক্যাসিনো খেলেছেন কি খেলেননি, ছবি তুলে প্রচার করে দেওয়া হলো। আসলে মানুষ তক্কে তক্কে আছে এমন খারাপ কিছু গ্রহণের জন্য। অর্থাৎ এগুলোই এখন স্বাভাবিক ঘটনা। কাউকে বিশ্বাস নেই।
ভিআইপি আসবেন বলে ফেরি বন্ধ করে রাখা হলো। ওদিকে অসুস্থ এক কিশোরের এ্যাম্বুলেন্স আটকে থাকল। সে অবস্থায়ই প্রাণ গেল তার। খবর হলো। পাবলিক সেটা খেলো। এখন পর্যন্ত খবর হচ্ছে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। অর্থাৎ সেদিন আদৌ কোনো ভিআইপি সেই ফেরি পার হয়নি।
দোষটা আসলে কাদের? দোষটা সার্বিক পচন ধরা সমাজের। অসুস্থ হিট সিকার কিছু সাংবাদিক পিলে চমকানো শিরোনাম খুঁজছেন, পিলে চমকানো ঘটনা তৈরি করছেন। ক্রমাগত দুর্নীতিতে ছেয়ে যাওয়া সমাজের মানুষ বেড়ে যাওয়ার কারণে যে কারো নামে যে কোনো কিছু বললেই মানুষ সেটাকে প্রশ্ন ছাড়াই বিশ্বাস করে নিচ্ছে। বিশ্বাস করবেই না কেন? নিজের উপর বিশ্বাস না থাকলে অন্যের উপর কি বিশ্বাস রাখা যায়? আর পুরো সমাজটাতো এমনই হয়ে গেছে। মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। ঠকলে কার বিশ্বাস ঠিক থাকে।
এই অবিশ্বাসে ভরা সমাজের এখন ধ্বংসের পালা। সামান্য ঘটনা থেকে বড় বড় কাণ্ড ঘটতে থাকবে এখন। অসুস্থ খানা খেয়ে হজম করা মানুষের উপর এসব বিষের ক্রিয়া তো কোনো না কোনোভাবে হবেই। ইমান-বিশ্বাস গেছে, মানবতা অনেক আগেই বিদেয় নিয়েছে। এখন মানুষ শুধুমাত্র একটা জীব হিসেবে টিকে আছে। ভয়ানক ক্ষমতাসম্পন্ন এত জীব- জানোয়ার সুস্থভাবে টিকতে পারে না। এরা কামড়াকামড়ি করবেই। এটাই স্বাভাবিক।
অসুস্থ এক সমাজে আমাদের বসবাস
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে গত কাল সারাদেশে ২৭টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরে গণপিটুনিতে মারা গেছে ৪৩ জন। গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়নি এমন ঘটনা হয়ত আরও অনেক।
মানুষ নিজের বাচ্চা নিয়ে বাইরে বের হতেও ভায় পাচ্ছে কারণ বাচ্চাটা যদি কান্নাকাটি শুরু করে তাহলেই বিপদ। অতি উৎসাহী জনতা যদি সন্দেহ করে বসে যে আপনি ছেলে ধরা বা গলাকাটা ওয়ালা তাহলেই শুরু হয়ে যাবে গণপিটুনি।
কাঁধে একটা বস্তা, বস্তাটা একটু ফুলে আছে। ব্যাস, আপনি ছেলে ধরা। শুরু হবে গণপিটুনি।
আপনার কথাবার্তা অসংলগ্ন, সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করছেন, ব্যাস আপনি ছেলে ধরা।
কোনো একটা বাচ্চাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছেন- বাবু, তোমার নাম কী? কোন ক্লাসে পড়ো, বিস্কিট খাবা? আপনি আর ওখান থেকে ফিরে আসতে পারবেন না।
এক কথায় চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে মানুষের মনে। সুন্দরবনে গেলেও মানুষের মনে এত ভয় তৈরি হবে না যতটা ভয় জনারণ্যে তৈরি হচ্ছে। কারণ মানুষগুলো পশুর চেয়ে হিংস্র আর নির্বোধ হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- কেন এমন হচ্ছে?
হুজুগ এবং গুজবের পেছনে প্রধান কারণ হলো সাধারণ মানুষের সীমাহীন অজ্ঞতা, যুক্তিহীন মনোভাব, চরম অন্ধত্ব। এগুলোর সাথে যখন হিংস্রতার যোগ হয়েছে তখন ঘটনা ঘটছে গণপিটুনির, এমনকি বহু মানুষ মারাও যাচ্ছে গণপিটুনিতে।
মানুষের মধ্যে এগুলো একদিনে তৈরি হয় না। যখন কেউ জন্মগ্রহণ করে তখন কিন্তু সে পশুর মতোই একটা সাধারণ প্রাণী হিসাবে জন্মগ্রহণ করে। তাকে মানুষ বানানোর জন্য কিছু শিক্ষা দিতে হয়। শিক্ষার মধ্যে ত্রুটি থাকলে সে পরিপূর্ণ মানুষ হবে না, মানুষের সকল গুণ সে পাবে না।
একটা উদাহরণ দিই-
১দিন বয়সের একটা বাঘের বাচ্চা আপনাকে আক্রমণ করবে না, আপনাকে হত্যা করতে পারবে না। এই বাচ্চাটাকে যদি তার বাবা-মা শিক্ষা দেয় তাহলে সে কিছুদিন বাদে হিংস্র হয়ে উঠবে এবং আপনাকে এক মিনিটেই হত্যা করতে পারবে। আবার ঠিক ঐ বাঘের বাচ্চাটাকেই যদি আপনি বাড়িতে এনে ফিডারে দুধ খাইয়ে, নিজ হাতে বিভিন্ন খাবার খাইয়ে বড় করতেন, শিকার ধরার শিক্ষা না দিয়ে আপনার সাথে খেলা করার শিক্ষা দিতেন তাহলে কিন্তু সে বন্য বাঘের মতো হিংস হতো না।— এই যে পার্থক্য, এটা আসলে শিক্ষার পার্থক্য।
মানুষ শিক্ষা পায় কোথা থেকে?
পরিবার থেকে, খেলার সাথীদের কাছ থেকে, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে, সমাজ থেকে, শিক্ষকদের কাছ থেকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে, টেলিভিশন ও পত্রিকা থেকে, জুম’আর খুতবা থেকে, ওয়াজ-মাহফিল থেকে, সমাজে প্রচলিত সংস্কৃতি থেকে ইত্যাদি উৎস থেকে সমাজের মানুষগুলো শিক্ষা নিয়ে থাকে। যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করে না তারাও কিন্তু উপরে বর্ণিত বিভিন্ন মাধ্যম থেকে শিক্ষা নিচ্ছে। মানুষগুলো যে সকল উৎস থেকে শিক্ষা নিচ্ছে সেখানে কতটুকু যুক্তিবোধ, চিন্তাশীলতা, সচেতনতা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে। ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না, নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না, শৃঙ্খলা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না, আনুগত্য শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না, মানুষের প্রতি সহনুভূতিশীল হতে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না, নারীদের প্রতি সম্মানবোধ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না।
একজন চিন্তাশীল, যুক্তিবোধসম্পন্ন মানুষকে যদি বলা যায় যে, পদ্মা সেতুর জন্য সরকার মাথা সংগ্রহ করছে তাহলে সে কি সেটা বিশ্বাস করবে? নাকি প্রশ্ন করবে- মাথা দিয়ে কী হবে? নিজের বিবেকই তাকে উত্তর দিবে- এসব ফালতু কথা। যখন দেশের বিরাট একটা শ্রেণি এমন বাজে একটা গুজব বিশ্বাস করে ফেলে, যখন চাঁদে কাউকে দেখা যাচ্ছে- এমন গুজব বিশ্বাস করে ফেলে, যখন সাধারণ একটা নারীকে কেবলই সন্দেহের বশে পিটিয়ে হত্যা করে ফেলে তখন বুঝতে হবে বেশিরভাগ মানুষকে আমরা সঠিক শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছি।
আমার চিন্তা ভাবনা- ০৩
যখন টাইটানিক ডুবছিল তখন কাছাকাছি তিনটে জাহাজ ছিল। একটির নাম ছিল “স্যাম্পসন”। মাত্র সাত মাইল দুরে ছিল সেই জাহাজ। ওরা দেখতে পেয়েছিল টাইটানিকের বিপদ সংকেত, কিন্তু বেআইনি সীল মাছ ধরছিল তারা। পাছে ধরা পড়ে যায় তাই তারা উল্টোদিকে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে বহুদুরে চলে যায়। এই জাহাজটার কথা ভাবুন। দেখবেন আমাদের অনেকের সাথে মিল আছে এর। আমরা যাঁরা শুধু নিজেদের কথাই ভাবি। অন্যের জীবন কি এল কি গেল তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই আমাদের। তাঁরাই ছিলেন ঐ জাহাজটিতে।
দ্বিতীয় জাহাজটির নাম “ক্যালিফোর্নিয়ান”। মাত্র চোদ্দ মাইল দুরে ছিল টাইটানিকের থেকে সেই সময়। ঐ জাহাজের চারপাশে জমাট বরফ ছিল। ক্যাপ্টেন দেখেছিলেন টাইটানিকের বাঁচতে চাওয়ার আকুতি। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকুল ছিল না এবং ঘন অন্ধকার ছিল চারপাশ তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন ঘুমোতে যাবেন। সকালে দেখবেন কিছু করা যায় কিনা। জাহাজটির অন্য সব ক্রিউএরা নিজেদের মনকে প্রবোধ দিয়েছিল এই বলে যে ব্যাপারটা এত গুরুতর নয়। এই জাহাজটাও আমাদের অনেকের মনের কথা বলে। আমাদের মধ্যে যারা মনে করেন একটা ঘটনার পর, যে ঠিক সেই মুহুর্তে আমাদের কিছুই করার নেই। পরিস্থিতি অনুকুল হলে ঝাঁপিয়ে পড়বো।
শেষ জাহাজটির নাম ছিল “কারপাথিয়ান্স”। এই জাহাজটি আসলে যাচ্ছিল উল্টোদিকে। ছিল প্রায় আটান্ন মাইল দুরে যখন ওরা রেডিওতে শুনতে পায় টাইটানিকের যাত্রীদের আর্ত চিৎকার। জাহাজের ক্যাপ্টেন হাঁটুমুড়ে বসে পড়েন ডেকের ওপর। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন যাতে তিনি সঠিক পথ দেখান তাঁদের। তারপর পুর্ণশক্তিতে বরফ ভেঙ্গে এগিয়ে চলেন টাইটানিকের দিকে। ঠিক এই জাহাজটির এই সিদ্ধান্তের জন্যেই টাইটানিকের সাতশো পাঁচজন যাত্রী প্রাণে বেঁচে যান।
মনে রাখা ভাল এক হাজার কারণ থাকবে আপনার কাছে দায়িত্ব এড়াবার কিন্তু তাঁরাই মানুষের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেবেন যাঁরা অন্যের বিপদের সময় কিছু না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন। ইতিহাস হয়তো মনে রাখবেনা তাঁদের কিন্তু মানুষের মুখে মুখে গাওয়া “লোকগাথা”য় বন্দিত হবেন তাঁরাই যুগে যুগে।
দেশ যখন ডুবছে তখন ষোল কোটি মানুষ ঘুমোচ্ছে কার ভরসায়?
আমার ভাবনা – ০৩
বর্ণ প্রথা বলে ধর্মগ্রন্থ সমূহে কোন শব্দ বা টার্ম নেই। তবে কেন সেটাকে আমি স্বীকার করবো ?
উচ্চ বর্ণ ও নিন্ম বর্ণ নিয়ে পৌত্তলিক ধর্মে যে ভেদাভেদ রয়েছে আমি সেটাকে স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর মনগড়া কেচ্ছা ছাড়া কিছুই বলে মনে করি না।
বর্ণ প্রথা বলে ধর্মগ্রন্থ সমূহে কোন শব্দ বা টার্ম নেই। আছে ‘বর্ণাশ্রম’। শাব্দিক অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ‘বর্ণ’ শব্দটি এসেছে ‘Vrn’ থেকে; যার অর্থ ‘to choose’ বা পছন্দ করা অর্থাৎ পছন্দ অনুযায়ী আশ্রম বা পেশা নির্ধারণ করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের সমাজে এখন তা জন্মসূত্রে বিবেচনা করা হয়।
আমার ভাবনা – ০২
মানুষকে মারতে নয়, মানুষকে বাঁচাতে ধর্ম এসেছে। বিভেদ নয়, ঐক্য সৃষ্টি করতে ধর্ম এসেছে। ঘৃণা নয়, ভালোবাসা শেখাতে ধর্ম এসেছে। যুক্তিহীন কুসংস্কার ছড়াতে নয়, এগুলি দূর করে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে ধর্ম এসেছে। আজ আমরা কোন ধর্মকে আকড়ে ধরে আছি অবশ্যই ভাবতে হবে।
এত ধর্ম-কর্ম! তবু কেন অশান্তিতে সমাজ?
এ বিষয়টি বুঝতে পণ্ডিত হবার দরকার নেই যে, রাষ্ট্র অরাজক হলে অশান্তি পোহাতে হয় জনগণকে। তাই সবার আগে রাষ্ট্রকে ন্যায়ের দণ্ড ধারণ করতে হয়, তবেই জনগণ শান্তিপূর্ণ সমাজ পায়। কোনো আদর্শ যদি এমন হয় যে, তাতে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপরিচালক নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই, তাহলে ঐ আদর্শ আর যাই হোক সমাজে শান্তি আনার জন্য যথেষ্ট নয়। ঐ আদর্শ পূর্ণাঙ্গ আদর্শ নয়। এজন্য গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি সমস্ত মতাদর্শই কিন্তু রাষ্ট্রকে নিয়ে কথা বলে, রাষ্ট্রকে একটি নির্দিষ্ট সিস্টেমের মধ্যে ফেলে সমাজে শান্তি আনয়নের চেষ্টা করে। কোনো মতাদর্শই রাষ্ট্রকে এড়িয়ে সমাজে শান্তি আনার অলীক কল্পনা করে না।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র না হয়ে যখনই ইসলামের প্রসঙ্গ আসে, আমাদের মধ্যে একটি শ্রেণি সেই অযৌক্তিক কল্পনাটিই করে থাকেন। তারা চান ইসলাম মানুষকে শান্তি এনে দিক, সমাজে ন্যায়, সাম্য প্রতিষ্ঠা করুক, কিন্তু রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে কোনো কথা না বলুক। এই স্ববিরোধী ও অযৌক্তিক দাবি তারা কীভাবে করেন? আজ যদি কোনো সমাজতন্ত্রীকে নসিহত করা হয়, ভাই, তোমরা আর্তপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করছো কর, কেবল একটাই অনুরোধ- রাষ্ট্র নিয়ে, রাষ্ট্রের অর্থব্যবস্থা নিয়ে কোনো কথা বল না, এ বাদে অন্য যে কোনো বিষয়ে বলতে পারো আপত্তি নাই। তাহলে ঐ সমাজতন্ত্রী কি তা মেনে নিবেন? যদি কোনো গণতান্ত্রিক মতাদর্শীকে নসিহত করা হয়, তোমরা সমাজ, পরিবার, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি সকল বিষয়ে কথা বলো, শুধু রাষ্ট্র নিয়ে কোনো কথা বলো না, তাহলে কথাটি কেমন শোনাবে?
শিকারীকে বাঘ শিকার করতে হয় বনে গিয়ে। যদি আপনি তাকে বনেই যেতে না দেন, বনে না গিয়ে অন্য যে কোনো স্থান থেকে বাঘ শিকার করে আনতে বলেন সেটা শিকারীর পক্ষে সম্ভব হবে কি? জেলে কি পারবেন জলাধারে না গিয়ে মাছ ধরে আনতে? না। কিন্তু আমরা ওটাই চাচ্ছি ইসলামের বেলায়। তারপর যখন সমাজে খুব ধর্মকর্ম থাকার পরও, লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা থাকার পরও, লক্ষ মানুষের ইজতেমা হবার পরও, লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর হজ্ব করতে যাওয়ার পরও এবং রমজান মাসে ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে রোজা পালনের পরও সমাজ অন্যায়, অবিচার, খুনোখুনি, ধর্ষণ, রক্তারক্তি, দুর্নীতি ইত্যাদিতে ভরপুর হয়ে থাকে, তখন তাচ্ছিল্যের সুরে বলা হয়- এই কি তবে ইসলামের শান্তির নমুনা? কী হাস্যকর মূল্যায়ন!
আমাদের কথা হচ্ছে, তারা যদি সত্যিকার অর্থেই ইসলামের শান্তির নমুনা দেখতে চান তবে বলতে হয়, সে সময় এখনও আসে নি। যে এখনও পরীক্ষাতেই বসল না, তার পাস বা ফেল হবার প্রসঙ্গ আসে কি? তাকে আগে পরীক্ষায় বসতে দিন, জেলেকে জলাধারে যেতে দিন, শিকারীকে বনে যেতে দিন, তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার সময় আসবে। আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলামকে সর্বপ্রথম একটি জনগোষ্ঠী তাদের সামষ্টিক জীবনে গ্রহণ ও কার্যকর করেছিল। ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজজীবন নয় কেবল, ঐ ইসলামকে অধিকার দেওয়া হয়েছিল তাদের জাতীয় জীবন নিয়ে কথা বলার, পরিবর্তন ও সংস্কারসাধন করার। তবেই পৃথিবীর ইতিহাসের সবচাইতে বড় রেনেসাঁটি সংঘটিত হয়েছিল।
যদি আরবরা আল্লাহর রসুলকে শর্ত জুড়ে দিতেন যে, ‘আপনি আমাদের ব্যক্তি ও সমাজজীবন নিয়ে কথা বলুন, কীভাবে ভালো হয়ে চলা যায়, কীভাবে সত্য কথা বলা যায়, কীভাবে হালাল কাজ করা যায়- এসব বলুন, কিন্তু আমাদের জাতীয় জীবন নিয়ে কোনো কথা বলবেন না। ওটা আমরা যেভাবে রেখেছি সেভাবেই থাকবে। জাতীয় জীবনে আমাদের গোত্রপতিরা যা বলবেন আমরা তাই করব, তবে চিন্তা করবেন না, ব্যক্তিজীবনে আমরা খুব ভালো মুসলিম হব, আপনার আনিত ইসলামের সমস্ত হুকুম আহকাম মেনে চলব।’ এই শর্ত মেনে সেই ইসলাম কি পারত আরবদের দাঙ্গা-হাঙ্গামাপূর্ণ অনিরাপদ সমাজকে পাল্টিয়ে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার ও নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে?