স্মৃতির পাতায় বিদেশ

স্মৃতির পাতায় বিদেশ…

গেল শতাব্দীর ৭০’এর দশক। প্রবাসে এসেছি কেবল। আপনজনদের ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে নতুন জীবন শুরু করার চেষ্টা করছি। অবশ্য এ চেষ্টা আমার একা ছিলনা, সাথে ছিল আরও ১৫ জন। থাকি ইউক্রেইনের ছোট একটা শিল্প শহরে। এক বছর থাকবো আমরা। একটা স্কুলে রুশ ভাষা শিখছি। তারুণ্যের জোয়ার সবার চোখেমুখে। প্রতিদিন প্রতি-মিনিট নতুন কিছু দেখছি, আবিষ্কার করছি এবং শিখছি। প্রথম তুষারপাত, প্রথম প্রেম, প্রথম সেক্স, ১৮-১৯ বছরের একজন যুবকের চাওয়া-পাওয়ার সবকিছু ছিল এখানে। আমরাও নিয়েছে দু’হাত ভরে।

অনেক স্মৃতিই ফিকে হয়ে যায়, কিন্তু দু’একটা থেকে যায়, যা মুছে যায়না। কবর পর্যন্ত সাথে থাকে। প্রবাসের প্রথম ঈদ ছিল তেমনি একটা স্মৃতি। কুরবানির ঈদ। ঘুম হতে উঠতেই সবার মন খারাপ। আজ ঈদ অথচ মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ কাছে নেই। যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। চিঠি আসতে সময় নেয় একমাস। সবচাইতে কষ্টের জিনিস, আজও ক্লাসে যেতে হবে। এদেশে ধর্মচর্চা অফিসিয়ালি নিষিদ্ধ। তাই ঈদের নাম দিয়ে ছুটি নেয়ার সুযোগ ছিলনা। আমাদের একজনের মাথা হতে দুরূহ একটা পরিকল্পনা বের হওয়ায় ছুটিটা পাওয়া গেল।

হোস্টেলের কমনরুমে দরজা লাগিয়ে নামাজ পড়ছি। গলার স্বর খুবই নিচু। সুরা ও মোনাজাতের ভাষাও ছিল সংক্ষিপ্ত। আমাদের মাঝেই নামাজ পড়াতে জানে এমন একজনকে পাওয়া গেল ইমামের ভূমিকা পালনের জন্যে। তার পেছনে একজন বাদে বাকি সবাই কাতার করে দাঁড়িয়ে গেলাম। বাকি একজন ছিল অন্য ধর্মের। হিন্দু।

নামাজের মাঝখানে বিকট আওয়াজে খুলে গেল দরজাটা। চিন্ময়! হাসছে সে! নামাজ নিয়ে বিদ্রূপ করছ। সাথে রুশ ভাষায় অকথ্য গালি। আমরা সবাই অবাক হলাম। সরকার আমদের বিদেশ পাঠিয়েছে মেধার ভিত্তিতে। সে ভিত্তির সাথে চিন্ময়ের এহেন আচরণ খাপ খায়না। কেউ একজন তাকে অনুরোধ করল এমনটা না করতে। এত রুষ্ট হয়ে আরও একধাপ এগিয়ে গেল সে। হাতে থাকা বড় একটা শুকরের হাড্ডি ছুড়ে মারল সামনের কাতারে।

৬ বছর পরের ঘটনা।
ভাষা-কোর্স শেষ হওয়ার পর ছোট ছোট গ্রুপ করে আমাদের চলে যেতে হয় বিভিন্ন শহরে। সেদিনের সে ঘটনা কেউ মনে রাখেনি। অনেকের মত চিন্ময়ও হয়ে যায় আমাদের আজীবনের বন্ধু। তো সবার কোর্স শেষ। আমরা সবাই ইঞ্জিনিয়ার বনে গেছি। এবার দেশে ফেরার পালা। বাংলাদেশ সরকারের সাথে এমনটাই ছিল আমাদের চুক্তি। মস্কোর একটা হোস্টেলে আবার জড়ো হচ্ছি আমরা। এবং তা শেষবারের মত। আমি নিজেও ছিলাম উত্তেজিত। অনেকদিন পর একত্র হব সবাই।

মস্কো শেরমেতভো এয়ারপোর্ট হতে ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলাম নির্ধারিত ঠিকানায়। সূর্য তখন উঠি উঠি করছে কেবল। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখি সবাই সজাগ। চেহারায় রাত জাগার ছাপ। আমি ঢুকতেই একজন আমাকে তার রুমে নিয়ে গেল। দরজা লক করে পাশে বসাল। আমি অবাক হলাম, নিশ্চয় রাতে কিছু একটা ঘটেছে।

চিন্ময়কে গতরাতে সবাই মিলে পিটিয়েছে! আমি আকাশ হতে পরলাম। পাঁচ বছর পর সবাই এক হয়েছি, আর তার পরিণাম কিনা মারামারি! আমার আওয়াজ পেয়ে আরও অনেকে রুমে ঢুকলও। আমি রাগে ফেটে পরলাম। একে একে সবাই কথা বলতে শুরু করল। সেই পাঁচ বছর আগের রাগ দু’একজন ভুলতে পারেনি। সাথে যোগ হয়েছে আগের রাতের ঘটনা।

বিদায় উপলক্ষে রুশ ট্র্যাডিশন অনুযায়ী পানের ব্যবস্থা ছিল। সবাই পান করেছে। রাত গড়ানোর সাথে সাথে চিন্ময় শুরু করে তার পুরানো কাজ, মুসলমান ধর্ম নিয়ে কুৎসিত গালি! এ যাত্রায় তাকে আর রেহাই দেয়নি কেউ।

তার রুমে তাকে দেখতে গেলাম। জামাকাপড় ছেড়া। শরীরে অনেক অংশ ফোলা। উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। ডাক দিতেই আমার দিকে তাকাল। সবার হয়ে ক্ষমা চাইলাম। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। চিন্ময় একজন প্রতিভাবান ছাত্র। ভাল গান করে, কবিতা লেখে, হাতের লেখা মুক্তার মত। কিন্তু মুসলমান ধর্মের নাম শুনলেই কেন জানি উন্মাদ হয়ে উঠত। ততদিনে আমাদের অনেকের ভেতর নাস্তিকতা বাসা বেধে ফেলেছে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন ধর্মের বিরুদ্ধে সীমাহীন বিদ্বেষের কোন কারণই বাসা বাঁধতে পারেনি। চিন্ময়ই ছিল তার ব্যতিক্রম।

8 thoughts on “স্মৃতির পাতায় বিদেশ

  1. আপনার স্মৃতিকথায় অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা হলো আমাদের মি. ওয়াচডগ।

  2. জীবনের কথামালা পড়লাম ওয়াচডগ ভাই। বুকভরা ভালোবাসা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  3. যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন,সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন। 

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।