ফিলিস্তিনিদের গল্প – ২

সব মিলিয়ে দু’ঘণ্টার মত ঘুমিয়েছি কিনা সন্দেহ। আসলে গোটা ট্রিপটাতেই ঘুম এলোমেলো হয়ে গেছে। একে নিউ মেক্সিকোর সাথে নয় ঘণ্টা সময়ের পার্থক্য, তার উপর সকালে ঘুম ভাঙ্গার নেই কোন তাড়া। ফজরের আযানের সাথে ঘুম ভাঙ্গতে সিদ্ধান্ত নিলাম আজ আর ঘুমানোর চেষ্টা করবো না। হোটেলের দরজা খুলতেই ভুতের মত দাঁড়িয়ে থাকা সাদা কটা দেয়াল অভ্যর্থনা জানালো নিঃশব্দের পৃথিবীতে। হোটেল করিডোরে আধাভৌতিক একটা আবহ মনে করিয়ে দিল এখনো ঘুম ভাঙ্গেনি অনেকের। তাই সাবধানী পায়ে আলতো করে ঢুকে গেলাম অপেক্ষমান লিফটায়। এক তলায়ও একই অবস্থা। লবি খা খা করছে। কাউন্টারে কেউ আসেনি। কফি মেশিনটা তখনও চালু ছিল। কাগজের গ্লাসে কড়া এক গ্লাস কফি বানিয়ে ঘাপটি মেরে ফিরে গেলাম রুমে।

পর্দা সরিয়ে রুমের সবকটা জানালা খুলে দিলাম। বাইরের হাল্কা আলোতে জেরুজালেম নগরী আছড়ে পরলো জানালায়। গ্রাস করে নিল আমি ও আমার সত্ত্বা। যতদূর চোখ যায় ইটপাথরের বাড়িঘর। হবে হয়ত হাজার বছরের পুরানো। শহরের দেয়ালে কান পাতলে হয়ত এখনো শোনা যাবে রোমানদের, জর্ডানিয়ানদের, টার্কিস অথবা সাময়িক কালের ইস্রায়েলিদের পায়ের শব্দ। শহরের প্রতিটা কোনা স্বাক্ষী দেবে ইতিহাসের অমোঘ পরিণতির। প্রতিটা রাস্তা কথা বলবে শৌর্য্য, বীর্য, ঐতিহ্যের। বাইরের হাল্কা বাতাস চোখ মুখে শান্তির প্রলাপ এঁকে দেয়। অজান্তেই দৃশ্যপটে ভেসে উঠল এন্ডিসের বুক চিড়ে বলিভিয়া ভ্রমণের প্যানোরমা। পেরুর সীমান্ত শহর পুনের হোটেলে আটকে আছি। অপেক্ষা করছি লা পাসগামী বাসের। দেশটায় ধর্মঘট চলছে। সব ধরণের যানবাহন বন্ধ। অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আটকে আজকের মত সে রাতেও ঘুম আসেনি। খুব সকালে উঠে জানালার পর্দা সরাতেই চোখের সামনে আছড়ে পরেছিল গোটা এন্ডিস। এর বিস্ময়কর প্যানোরমা সহজেই ভুলিয়ে দিয়েছিল অপেক্ষার কষ্ট।

ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা বেরিয়ে আসছে রাতের আশ্রয় হতে। আলো ফুটতে শুরু করেছে শহরে। দূরে দামাস্ক গেইটের কাছে দু’একটা গাড়িও চলতে শুরু করেছে। রামাল্লায় শোনা ভবিষৎবাণী সত্য হলে আজ ওখানে কিছু একটা ঘটার কথা। ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদ করবে তাদের শতাধিক বাড়ি গুড়িয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে। আজকের প্রতিবাদ দীর্ঘমেয়াদী প্রতিবাদে রূপ নেয়ার সম্ভবনাও উড়িয়ে দেয়নি সদ্য পরিচয় হওয়া বেথেলহেমের এক ফিলিস্তিনি পরিবার। ওরা সবাই অপেক্ষায় আছে একটা স্ফুলিঙ্গের। বিভক্ত দেয়াল পেরিয়ে জেরুজালেমে প্রবেশের অনুমতি নেই অনেকের। স্বপ্নের শহর নিয়ে ওদের আক্ষেপের শেষ নেই। শেষ করে এ শহরকে দেখেছিল, কোথায় ঘুরেছিল, কি খেয়েছিল এ নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন ঘরে ঘরে। অথচ রামাল্লা, বেথেলহেম অথবা জেরিকো হতে জেরুজালেম চল্লিশ মিনিটের পথ। ছোট মিনিবাস ধরলে আরও আগে পৌঁছানো যায়।

সূর্য উঠার আগে আরও একবার ঢুঁ মারলাম হোটেল কাউন্টারে। আপাদমস্তক ঢাকা সাদা ধবধবে এক মহিলা বসে আছেন কাউন্টারে। সালাম দিয়ে নিজের অবস্থান পরিস্কার করলাম। খুব নীচু গলায় জবাব দিল। জানতে চাইলো এত সকালে এখানে আগমনের হেতু। হোটেলের মূল ফটকটা খুলে দেয়ার অনুরোধ করলাম। আমি বাইরে বের হবো। সকালের সব শহরের চেহারাই অন্যরকম হয়। থাকে ভাল লাগার একটা চিকন অথচ মসৃণ অনুভুতি। এমনকি মনুষ্যভারে ডুবন্ত ঢাকা শহরের সকালেও থাকে হাল্কা এক ধরণের ভাল লাগা। খুব কাছ হতে না দেখলে বুঝা যায়না। মহিলা একটু অবাক হলো। একটু হাসল এবং সাবধান করে খুলে দিল অটোমেটেড দরজা।

বাইরে বেরিয়ে লম্বা একটা শ্বাস নিলাম। মনে হলো বাতাসে অক্সিজেন এখন অনেক বেশী। মধ্যদুপুরের কোলাহলের লেশমাত্র নেই। Suq Khan El Zeit নামের কালো পাথরের রাস্তাটা এখন খাঁ খাঁ করছে। দুএকজন দোকানদার তাদের পণ্য নামাচ্ছে। একটু হেঁটে কাঁচা বাজারের কাছাকাছি আসতে দৃশ্যপট বদলে গেল। সব্জির বাজার রীতিমত জমজমাট। পাশের দুয়েকটা কসাইয়ের দোকানও খোলা। দোকানদারদের অনেকে ফিলিস্তিনি মহিলা। পুরুষদের ব্যস্ততা পণ্য পরিবহনে। আমি দেখছি আর কচ্ছপ গতিতে হাঁটছি। চোখের মত পায়েরও কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই।

ধাক্কাটা ভালভাবেই লাগলো। কালো পাথরের রাস্তাটা এমনিতেই ঢালু, তার উপর পণ্য সাজিয়ে দোকানদারের দল পানি ঢালছে পরিস্কার রাখার জন্যে। পিচ্ছিল পথে প্রায় ছিটকে পরেছিলাম। উঠে দাঁড়িয়ে চোখ ফেরালাম যে ধাক্কা মারল তার দিকে। ভারতীয়। দক্ষিন ভারতীয় ভাষায় কথা বলছে নিজেদের ভেতর। আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলা দেয়াটা যেন কোন ঘটনাই না। ক্ষমা চাওয়া দূরে থাক, চোখ ঘুরিয়ে একবারও দেখার চেষ্টা করল না কে আমি। পরিচয় পেয়ে আমিও অবাক হইনি এদের ব্যবহারে। অবাক হয়েছি এই ভেবে এর সকালে কি করছে এখানে। সেই তেল আবিব হতে দেখে আসছি ভারতীয়দের উপস্থিতি।

.
ফিলিস্তিনিদের গল্প … ১ম পর্ব
– চলবে

7 thoughts on “ফিলিস্তিনিদের গল্প – ২

  1. অসাধারণ পর্ব। মনে প্রাণে চাইবো যেন নিয়মিত হয়। অভিনন্দন মি. ওয়াচডগ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. বর্ননা পড়লাম দাদা। ছবি গুলো খুব সুন্দর এসেছে। প্রাচ্যের ঐতিহ্য ভীষণ ভাল লাগে। 

  3. সুন্দর লিখেছেন ছবিগুলো ও অনেক রঙ্গিন

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।