সোহাগী বাস কাউন্টার, ফকিরাপুল। ‘সোহাগী’ – কক্সবাজার রুটের নতুন বাস। মাত্র দুই সপ্তাহ হলো ঢাকা কক্সবাজার রুটে তাদের নতুন সার্ভিস শুরু করেছে। একদম ঝকঝকে তকতকে সব নতুন ছত্রিশ সিটের ভলবো বাস। রেহানরা আজ দলবেঁধে কক্সবাজার যাবে। আটটা ফ্যামিলির মেম্বাররা মিলিয়ে তেত্রিশ জন, তাই ছত্রিশ সিটের বাস পুরোটাই রেহানরা রিজার্ভ করে নিয়েছে।
রেহান টিম লিডার, তাই সে তার ফ্যামিলি নিয়ে বাস কাউন্টারে চলে এসেছে রাত সাড়ে নয়টার মধ্যে। বাকিরা আসা শুরু করেছে পৌনে দশটা থেকে, শেষ ফ্যামিলি এসে পৌঁছিয়েছে রাত প্রায় সাড়ে দশটায়। রিজার্ভ বাস হওয়ায় কাউন্টারে সময় নিয়ে একটু গাইগুই করলেও শেষ পর্যন্ত সব ম্যানেজ করে বাস ছাড়তে ছাড়তে রাত প্রায় পৌনে এগারোটা। এই সময় অনেকগুলো বাস চিটাগাং অভিমুখে রওয়ানা করে তাই যাত্রাবাড়ী থেকে নিয়ে কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত জ্যাম ঠেলতে হয়েছে ভালোই। কাঁচপুর ব্রিজ পার হতে হতে প্রায় রাত একটা। ড্রাইভার সাহেব রাগে গজগজ করছিলো, বার বার বলছিলো রাত দশটার মধ্যে বের হয়ে যেতে পারলে এই ঝামেলা হতো না।
কাঁচপুর ব্রিজ পার হয়ে রাস্তা একটু খালি পেতেই ড্রাইভার সাহেব যেন তার দেরি পুষিয়ে নিতে চাইছিলো, বাস চলছিলো ঝড়ের গতিতে, একের পর এক বাস লড়ি ট্রাক ওভারটেক করে যাচ্ছিলো। বাচ্চারা আনন্দে হৈ চৈ করে গান গাইছিলো, ভাবিরাও তাদের সাথে সাথে তাল দিচ্ছিলো। রেহান ও তার বন্ধু রতন সামনের সিটে। শফিকের মন যেন কেমন কু ডাক দিচ্ছিলো, বার বার ড্রাইভার সাহেবকে অনুরোধ করছিলো একটু আস্তে চালাতে। ড্রাইভার কান দিচ্ছিলো না, সে ঝড়ের বেগে চালিয়েই রাত তিনটায় চৌদ্দগ্রাম হাইওয়ে ইন এ পৌঁছে গেলো। এ পর্যন্ত বাসের কেও ঘুমায় নি, হৈ চৈ, গান কৌতুকে বাসের বাকি সবার সময় কোনদিক দিয়ে কেটে গেছে কেও বলতেই পারবে না। হাইওয়ে ইন এ চল্লিশ মিনিট বিরতি, বাস থেকে নামার সময় ড্রাইভার পই পই করে বলে দিলো যেন চল্লিশ মিনিটের বেশী এক মিনিট দেরি না হয়। সবাই হৈ চৈ করে নেমে গেলো বাস থেকে, প্রথমেই ছুটলো বাথরুমে। যার যার কাজ শেষ করে খাবার টেবিলে বসে এক একজন এক এক মেন্যু অর্ডার দিলো, তারা আছে ছুটির আমেজে, তাই সময় জ্ঞান হারিয়েছে সবাই। এদিকে চল্লিশ মিনিট এক ঘণ্টা হয়ে গেছে খেয়াল নাই। বাসের গাইড আমাদের খুঁজতে চলে এসেছে রেস্টুরেন্টে, তাড়া দিয়ে সবাইকে ওঠাতে আরো মিনিট দশেক, এর মধ্যে আরেক গ্রুপের বাথরুমে যাওয়ার দরকার পড়ে গেলো; চলে গেলো আরো মিনিট পনেরো। চল্লিশ মিনিটের ব্রেক প্রায় দেড় ঘণ্টায় শেষ করে আমরা সবাই বাসে। ড্রাইভার সাহেব রেগে আগুন। বলতে লাগলেন এইজন্যই রিজার্ভ ট্রিপে আসতে চাই না; এদের সময়ের কোন মা বাপ থাকে না।
যাই হোক ভোর সাড়ে চারটার দিকে রেহানরা আবার যাত্রা শুরু করলো কক্সবাজার অভিমুখে। এবার বাসের সবাই ঝিমিয়ে পড়েছে, সারারাত হৈ হুল্লোড়ের পর পেটে খাবার পড়তেই যেন সবার চোখে ঘুম এসে বাসা বেঁধেছে। পুরো বাসে রেহান একা জেগে, ড্রাইভার সাহেব যেন তার সমস্ত রাগ বাসের এক্সিলেটরের উপর চাপিয়ে দিয়েছে, সাঁ সাঁ করে একের পর এক বাস, ট্রাক, গাড়ি ওভারটেক করে যাচ্ছে। রেহান বারবার অনুরোধেও কান দেয় নি। কিছুক্ষণ বাস চলার পর রেহানেরও চোখ লেগে এসেছে। তারপর খুব হঠাৎ ধারাম করে যেন বোমা ফাটলো। রেহান ছিটকে গিয়ে উইন্ডশিল্ডের ওপরে পড়তেই ওর চোখের ভেতর যেন সূর্যটা ঢুকে গেলো, তারপর সব অন্ধকার।
জ্ঞান ফিরতেই রেহান নিজেকে এক অচেনা জায়গায় আবিষ্কার করলো। কোথায় যেন টানা হর্ন বাজছে, কোথায় যেন এম্বুল্যান্সের প্যাঁ পু শব্দ, কোথায় যেন হাজারো মানুষের কোলাহল, কোথা থেকে জানি কান্না ভেসে আসছে, কে কে জানি চিৎকার করে কাকে ডাকছে। অচেনা সে জায়গায় রেহান যেন আধো আলো আধো অন্ধকারে উঠে বসেছে। তার মাথা কাজ করছিলো না, কোথায় জানি যাওয়ার কথা ছিলো? ভুলে গেছে। শত কোলাহলের শব্দ তো শুনছে কিন্তু কোথাও কাওকেও দেখছে না। অগত্য দিক হারা হয়ে সে একা একাই মাথা নিচু করে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো। তার কি খিধে পেয়েছে, তৃষ্ণা হচ্ছে কি একটু? ঐ দূরে অনেক দূরে যেন টিমটিম করে কিছু আলো জ্বলছে; ওটা কি বাজার? ওখানে কি পানি পাওয়া যাবে? খাবার? অতীত বর্তমান কিছুই তার মাথায় নেই, আছে শুধু ঐ দূরের টিমটিমে কিছু আলো, রেহান সম্মোহিতের মত মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকে বাজারের দিকে।
বাজারে পৌঁছে দেখে ওখানে কোন মানুষ নেই অথচ সব দোকান খোলা। দোকান গুলোয় কোন বাতি নেই, তবে প্রতিটা দোকানেই একটা করে কাঁচের আলমারি আর আলমারির ভেতর থেকেই কেমন যেন একটা অন্যরকম অদ্ভুত আলোতে দোকানগুলোর ভেতরটা আলোকিত, অথচ বাইরে গাঢ় অন্ধকার। তৃষ্ণার্ত রেহান পানির খোঁজ করে, প্রতিটি দোকানেই পানির একটা করে সাদা কাঁচের বোতল সাজানো আছে কিন্তু বোতলে পানির বদলে রক্ত। দোকানে কোন খাবার নেই অথচ একটা বিশাল প্লেটে সাজানো একটা করে মানুষের কাটা মাথা, কলিজা আর হৃদপিণ্ড। দোকানের ভেতরে এক অদ্ভুত কোলাহল কিন্তু কোথাও কেও নেই, আর দোকানের বাইরে সুনসান নিস্তব্ধতার হাহাকার শফিকের পুরো স্বত্বাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিলো। সে ভেবে পাচ্ছিলো না, এ কোন অদ্ভুত নগরীতে চলে এসেছে। এই প্রথমবার তাকে এক আতংক গ্রাস করছে, স্বত্বাকে নাড়িয়ে দেয়া এক অবর্ণনীয় আতংক। দোকানগুলোর থেকে সে ছুটে বের হয়ে যেতে চাচ্ছে, কিন্তু দোকানগুলো যেন তাকে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে আছে।
হঠাৎ করেই সে দেখলো অন্ধকারে ভোজবাজির মত তার সামনে এক নতুন দোকানের ঝাঁপ খুলে গেলো। নতুন দোকানের ঝাঁপ’টা খুলতেই পুরনো দোকানগুলোর থেকে গায়ে কাঁটা দেয়া অন্যরকম এক হো হো হাসির শব্দ ভেসে আসতে লাগলো, রেহান নিজের অজান্তেই নতুন দোকানটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। দোকানের ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পায় বিশাল প্লেটে সাজানো রেহানের মাথা, তার কলিজা, তার হৃদপিণ্ড; আর সাদা কাঁচের বোতলে তারই রক্ত। ভয়ে রেহানের হাতপা পেটের ভেতর ঢুকে যেতে থাকে, ঢুকতে ঢুকতে একসময় পুরো শরীরটা কুঁকড়ে ঢুকে যায় দোকানের ভেতরের কাঁচের আলমিরাতে। পাশের দোকানগুলো থেকে একসাথে করতালি ভেসে আসে। একে একে বাকি দোকানগুলোর ঝাঁপ বন্ধ হতে থাকে, তারপর আবার সুনসান নীরবতা চারিদিকে। সব শেষে কোথা থেকে জানি কোদালে কোদালে মাটি পড়ে ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায় রেহানের দোকানের। কবরের নিস্তব্ধতায় রেহান শুয়ে থাকে কবরে। সমাপ্ত হয় রেহানের পৃথিবী ভ্রমণ।
২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
#গল্প
পৃথিবী ভ্রমণ
– যাযাবর জীবন
ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত, এডিট করা।
গল্পটি পড়ে অদ্ভুত এক ঘোরলাগা অনুভূতি লক্ষ্য করলাম নিজের মধ্যে। শেষ অংশে এসে নিজেকে ব্যবচ্ছেদ করতে লাগলাম বারবার। কারণ আছে। আজ থেকে প্রায় ২৬ বছর আগে ঠিক এমনি এক দূর্ঘটনার স্বাক্ষী আমি আজও বেঁচে আছি। মনের মধ্যে সেই সময়টি যেন ফিরে এলো। আহা কত শত স্মৃতি। হারানোর বেদনা।
অনেকদিন পর শব্দনীড়ে আপনার পদচারণায় ভালো লাগলো। পাশে থাকুন মি. যাযাবর।
রেহানের পৃথিবী ভ্রমণ কাহিনী পড়ে চোখে জল এসে গেলো। এভাবে না হোক, আর অন্যভাবেই হোক, হঠাৎ করে চিরনিদ্রায় শায়িত হবো আমরা সবাই। বেঁচে থাকবে শুধু কথা আর কাহিনী। তৈরি হবে এক ইতিহাস।
তবে আমাদের একটু সাবধানে চলা উচিৎ বলে আমি মনে করি।
সবার জন্য শুভকামনা কামনা থাকলো।
সুখ দুঃখের সহজ সরল পুথি
গল্প হলেও কষ্ট পেলাম কবি যাযাবর জীবন বাবু।