আগন্তুক: ধারাবাহিক উপন্যাস// পর্ব-৯

FB_IMG_1487255081432
চিন্তা-ভাবনায় বিভোর মৌণ সময় কখন নিজেই যে ক্লান্ত হয়ে মহাকালের কোলে আশ্রয় নেয়, সময় নিজেও জানে কি? রাহেলা নামের মেয়েটি বাসের দুরন্ত গতির সাথে তাল মিলিয়ে ভাবনা-চিন্তার অলস মুহুর্তগুলিকে পাশ কাটিয়ে কখন যেন নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। বাসটা থেমে যেতে এবং ওর পাশের সিটের সহযাত্রীর ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। কক্সবাজার এসে গেছে। সদ্য ঘুম ভাঙ্গা বিবশ মনের এলোমেলো মুহুর্তগুলি কাটে কয়েক পলক। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে পাশের যাত্রিটি নেমে গেলে রাহেলা খেয়াল করে সে একা-ই রয়ে গেছে।

নিজের যৎসামান্য মালামাল হাতে নিয়ে নামার জন্য সিট সংলগ্ন করিডোরে পা রাখে। লাগেজ বাসের বক্সে রয়েছে। সেটার ট্যাগ পার্স থেকে বের করে হাতে নেয়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। এখান থেকে রিক্সা বা টমটমে করে ওর ‘বুক’ করা হোটেলে যেতে হবে। কি যেন নামটা হোটেলের?

নামটা মনে আসার আগেই জানালা দিয়ে আরো একবার তাকাতে-ই হোটেলটাকেই দেখতে পায়। চমৎকার সোনালী হরফগুলি মেটাল পালিশের কল্যাণে ঝকঝক করছে। সকালের সোনারোদ পড়ে সেটা আরো ঝলমলে লাগল ওর চোখে। কিন্তু বাস তো সরাসরি ওর-ই রিজার্ভ করা হোটেলের সামনে আসার কথা না।
বাবা! বাবার অপচ্ছায়া আবারো অনুভব করলো সে। এই লোকটি সব সময়ে-ই ওর আশেপাশে আছেন।

‘এটা-ই কি থাকার কথা নয়?’- নিজের প্রশ্নে একটু কি সংকুচিত হয়?

কিন্তু পরক্ষণেই অনেক আগে দেখা একটা ছবি ভেসে ওঠে মনে। নিজের জননীর মৃতদেশের পাশে বসে থাকা বাবা। বীভৎস মায়ের চেহারাটা আজো ওর মনে ভাসে। চোখ ঠিকরে বের হয়ে আছে… গলার কাছটায় কালচে-নীল দাগ… বাবার বেডরুমে ওনারা দু’জন-ই ছিলেন। তখন রাহেলার কত-ই বা বয়স। তবে মনে রাখার মত একদম কমও ছিল না। আসাদ তখন কোলের শিশু।
মা হারা দু’সন্তানের জন্য বাবার স্নেহ-ভালোবাসার কমতি কখনো অনুভব করে নাই ওরা দু’ভাইবোন। কিন্তু মনের ভেতরের মনের আরশিতে নিজের জননীর মৃত চেহারাটা রাতের পর রাত ভেসেছে… বাবা মাকে মেরেছেন… এমন অনুভূতির চেয়ে ‘কেন’ এই প্রশ্নটা-ই বার বার জেগেছে। কিন্তু না পেরেছে বাবাকে জিজ্ঞেস করতে, না পেরেছে ভুলে যেতে। এমন চরম মানসিক সংকট নিয়ে নিজের ভূবনে ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে ওরা দু’জন বেড়ে উঠেছে। প্রচণ্ড প্রাচুর্য্যের ভেতরে থেকেছে… ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও ওদের দুই ভাই-বোনের ভেতরে ছিল একদম সাদাসিদা মনোভাব। মায়ের মত এক সরল জীবনের প্রত্যাশায় ভেতরের মানুষ দু’জনের হৃদয় চাতকের মত তৃষ্ণার্ত ছিল। এখনো আছে। তবে রাহেলার অনুভূতির সমস্যার শুরুটা ওর সেই ছেলেবেলায় দেখা ঐ দৃশ্যটির পর থেকেই। ধীরে ধীরে যা বেড়েছে… বাবা দেশের বাইরের সব নামকরা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে দেখিয়েছেন। কোনও লাভ হয় নাই। কারণ মনের আসল কথাটা-ই রাহেলা কখনো-ই কাউকে জানায় নাই। জানতেও দেয় নাই। নিজের অবচেতন মনের চেতন অংশকেও বুঝতে দেয় নাই সে কি ভাবছে।

সেই বাবার থেকে দূরে দূরে যতই থাকতে চেয়েছে, ক্ষমতাধর মানুষটার ক্ষমতার হাত ক্রমশঃ ওর দিকেই এসেছে কেবল। ছোট ভাই আসাদ যদিও এক বছর হলো ওকে আর বাবাকে ছেড়ে চলে গেছে। নিজের মত করে জীবনকে দেখবে বলে নিজের আলাদা ভূবনের বাসিন্দা হয়েছে সে। বাবাও অমত করেন নাই। আর আসাদের এই চলে যাবার পেছনে রাহেলার এক অসতর্ক মুহুর্তের কথোপকথনই দায়ী। কিভাবে যেন মায়ের মৃত্যুর পেছনে বাবার হাত রয়েছে কথাটা ওর মুখ দিয়ে বের হয়ে এসেছিল। ওটাই ছিল চলে যাবার মূল ইস্যু। কিন্তু বাবার ন্যাওটা ছেলেটি সম্পুর্ণ ভিন্ন কারণ দেখিয়ে প্রিয় মানুষটির থেকে দূরে সরে গেলো।

‘আপনার লাগেজ ট্যাগ টা কি দিবেন?’- বাসের সুপারভাইজারের কথায় বাস্তবে ফিরে আসে রাহেলা। চোখের ওপরে কয়েকগাছি চুল এসে পড়েছে, সেগুলি ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে জায়গামত ফেরত পাঠিয়ে সুপারভাইজারের দিকে তাকায়। কয়েকমুহুর্ত চুপ থেকে বলে,
– বাস তো এখানে থামার কথা নয়। এই হোটেলেই কি সব সময় বাস থামান আপনারা?’

চৌকশ সুপারভাইজার উত্তর দেয়,
‘আসলে আমাদের একজন গুরুত্বপুর্ণ যাত্রী এই হোটেলে উঠবেন, তিনি এখানে নতুন এসেছেন বিধায় আমাদের ম্যানেজারের ফোনেই তাকে এখানে নামিয়ে দেয়া।‘
– ও, আচ্ছা। বেশ ভালো সার্ভিস আপনাদের।

সুপারভাইজার হেসে নিজের প্রত্যুৎপন্নমতির গর্বটুকু বেশ উপভোগ করে মনে মনে। কিন্তু রাহেলার পরবর্তী কথায় ওর মনের হাসিটুকু নিভে যায়,
– এই নিন ট্যাগ। … আর শুনুন, মিথ্যা কথা আমি একদম পছন্দ করি না। তাছাড়া মিথ্যা বলাটাও একধরণের আর্ট। এই আর্ট বা শিল্পকলা আপনার ভেতরে একদম-ই নেই। তাই অহেতুক মিথ্যে বলার চেষ্টা করবেন না।

সুপারভাইজার বিব্রত বোধ করে। কিন্তু সামনে এগিয়ে হেল্পারের হাতে লাগেজ ট্যাগ দিয়ে বাস থেকে নেমে যেতে উদ্যত হয়। পরক্ষণেই কাঁচ ভাঙ্গার শব্দে হেল্পার, ড্রাইভার এবং সুপারভাইজার শব্দের উৎসমুখে তাকায়।

রাহেলা নিজের পায়ের হিল খুলে বাম পাশের একটা জানালার কাঁচ ভেঙ্গে দিয়েছে। জুতো পায়ে দিয়ে বেশ সপ্রতিভ ভাবে বাস থেকে নেমে যেতে যেতে সুপারভাইজারের উদ্দেশ্যে বলে,
– আপনাদের আতিথেয়তার জবাব এটা। পুরষ্কারও বলতে পারেন। আপনাদের সেই গুরুত্বপুর্ণ যাত্রীটির পেছনের মহাগুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তির কাছ থেকে এর ক্ষতিপূরণ নেবেন? না আমি-ই দিয়ে যাব?

রাহেলার প্রশ্নে অবাক সুপারভাইজার এবং ড্রাইভার একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুপারভাইজার জানায়,
‘জি না, তার দরকার পড়বে না। আপনি যেতে পারেন।‘
– ধন্যবাদ আপনাকে।

নেমে যেতে উদ্যত হতেই অচেনা পুরুষটি যে সিটে বসেছিল, সেখানটা পার হবার সময় অতি পরিচিত এক সৌরভে উদ্দীপ্ত হয় রাহেলা! প্রিয় একজনের স্মৃতিতে উদ্বেলিত এক যুবতী কিছুটা অনুভবে প্রগলভ হয়ে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবে, ‘নাহ! এটা মনের কল্পনা ছাড়া আর কি? সে এখানে!! কিভাবে?’

নিচে নেমে হেল্পারের হাত থেকে নিজের লাগেজটি নিয়ে হোটেলের মেইন গেটের দিকে এগিয়ে যায় রাহেলা।

হেল্পার ওপরে উঠে নিশ্চুপ সুপারভাইজার এবং ড্রাইভারকে দেখতে পায়। সুপারভাইজার ড্রাইভারকে বলে,
‘ দেখলেন ওস্তাদ, ব্যাপারটা কেমন হইলো? সব কিভাবে বুঝে ফেললো!!’
– হ্যা, দেখলাম। কঠিন মাইয়ামানুষ।
‘ হুম… কঠিন কঠিন মানুষেরা কিভাবে এর ব্যাপারে বার বার বলে দিছে, খেয়াল করেন নাই? হাইওয়ে ইনে চারজন এলো। আমাকে ডেকে কি করতে হবে সব বুঝিয়ে দিলো।‘
– বাসের ভেতরেও একজন ছিল। সিগ্রেট টানার সময় আমারে বললো যে, এই মেয়ের মাথায় গন্ডগোল আছে, একটু ভালোভাবে খেয়াল রাখতে।

ভাঙ্গা জানালার কাঁচের এক অংশ দিয়ে বাইরের মানুষ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে সুপারভাইজারের স্বগতোক্তি,
‘ মাথা খারাপ না হলে কে এমন কাজ করে!’

(ক্রমশ)

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

12 thoughts on “আগন্তুক: ধারাবাহিক উপন্যাস// পর্ব-৯

  1. দারুণ লিখেছেন মিতা। মনে হলো একপলক দেখেছি অস্পষ্ট সুন্দর তাই ভালভাবে দেখার জন্য মনটা উদগ্রীব! যে কারণে অপেক্ষা করতে হচ্ছে পরবর্তী পর্বের। শুভ রাত্রি।

    1. আপনার সুন্দর অনুভূতি জেনে অনেক ভালো লাগলো।

      কাল সারাদিন বইমেলায় থাকবো। এলে ভালো লাগবে।

      জলছবি বাতায়ন স্টল নং ৬ এ থাকবো লিটল ম্যাগ চত্তরে।

      শুভ রাত্রি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  2. প্রিয় মামুন ভাই সালাম জানবেন। নানারকম মানসিক অস্থিরজার জন্যে নিয়মিত হতে পারছি না। শুধু দয়া করবেন।

    1. সালামের উত্তর জানবেন প্রিয় খালিদ ভাই। আপনার সকল অস্থিরতা কেটে যাক। দোয়া করছি। ভালো থাকুন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

  3. আজ মনে হলো রাহেলা এপিসোড। :)
    ধন্যবাদ মি. মামুন। উপন্যাসটিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। পাঠক হয়ে আছি।

    1. সাথে থাকার অনেক শুভেচ্ছা ভাইয়া।

      ধন্যবাদ আপনার অনুভূতি জানানোর জন্য।

      শুভেচ্ছা
      ভালোবাসা
      নিরন্তর…।। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  4. পড়তে পারছি না মানসিক অস্থিরতার জন্য। তবে আশা করছি খুব শিঘ্রই পুরোটা পড়ে নেব।

    চলুক।

    1. জেনে অনেক ভালো লাগলো স্যার।
      জি, পড়ুন।

      শুভেচ্ছা
      ভালোবাসা
      নিরন্তর।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।