ইরেজারের ঘ্রাণ

মাঝদুপুর। অফিসে ব্যস্ততার মাঝে কিছুটা অলস সময়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র অফিসঘরে মাঘমাসকে ডেকে এনেছে। জানলার পর্দা সরাতেই একফালি রোদ ঢুকে পরলো। রোদের সাথে সাথে ঢুকে পরেছে ইশকুলে যাবার ছেলেবেলার ভোর।

এক আত্নভোলা শিশু ইশকুলে যাবে। মায়ের হাত ধরে। গুটিশুটি পায়ে। নীল-শাদা বরফিকাটা সোয়েটারে সঞ্চারিত ফুপুমার স্নেহের ওম। সে বুক ভরে শ্বাস নেয়। হাতে পাকা লেবু রঙা ঢেউঢেউ ইরেজার। অপার বিষ্ময়ে ইরেজারের সুঘ্রাণ নেয়- আহ কত মিষ্টি! ঘ্রাণ যেন হারিয়ে না যায়- শক্ত মুঠোর ভিতরে ইরেজার ধরে রাখে।

অলস দুপুরের একফালি কমলা রোদ বলে-

: যাবে না কি সেই ইরেজারের ঘ্রাণের দেশে?
: সেখানে যাওয়া যায় না কি!
: যাবেনা কেন! অবশ্যই যায়।
: যাবো, একটু দাঁড়াও, হাতের অল্প ক’টা কাজ ঝট করে শেষ করে নেই।
: হাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহা
: এতে হাসির কি হলো!
: ঘ্রাণের দেশে তোমার যাওয়া হবেনা কোনদিন হাহাহাহাহা।
: কেন?
: তোমার অল্প একটু কাজ থেকেই যাবে। সে কাজ শেষ করতে দেরী হয়ে যাবে। এদিকে একটু একটু করে ঘ্রাণের জগত অনেক দূরে সরে যাবে।

রোদের কথা শুনে বিষন্ন হই। বিরক্তও হই সামান্য। মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার কথা শুরু করি-
: তুমি ঠিকানা দিয়ে যাও- নিজেই খুঁজে নেবো ইরেজারের ঘ্রাণের জগত।
: তাহলে সোজা চলে যাও মনসুখিয়া।
: মনসুখিয়াই তাহলে ইরেজারের ঘ্রাণের জগত!
: না, মনসুখিয়া ইরেজারের ঘ্রাণের জগত নয়। মনসুখিয়ার রাজকন্যার চুলে ইরেজারের ঘ্রাণ আছে।
: রাজকন্যার চুলের ঘ্রাণ দিয়ে আমি কি করবো?
: আররে বোকা, রাজকন্যার চুলের ঘ্রাণে ইরেজারের দেশে পৌছানোর গোপন নকশা আছে।
: তাই না কি! রাজকন্যা কি আর আমাকে পাত্তা টাত্তা দিবে।
: দিবেনা কেন! সোনাকাঠি আর রূপোকাঠি আছে কি করতে!
: আমি গরীব অফিস মজুর। আমার কি আর সোনাকাঠি রূপোকাঠি আছে!
: সবার ভিতরেই একটা করে সোনাকাঠি আর রূপোকাঠি আছে। সবার ছায়াতেই একটা করে ডাইনিবুড়ি আছে। সে ডাইনিবুড়ি রাজকন্যাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।
: তাই না কি!
: হ্যা, ডাইনি বুড়ির প্রাণভোমরা থাকে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে চিনিফুলের বন পেরিয়ে সাতসমুদ্দুরের মাঝখানে এক পাথরের কৌটায়। সোনাকাঠি আর রূপোকাঠি দিয়ে রাজকন্যাকে জাগিয়ে ছুটতে হয় ডাইনিবুড়ির প্রাণভোমড়ার পাখা ভেঙে দিতে।
: তারপর?
: তারপর আর কি! রাজকন্যার চুলে শুকে নিবে ছেলেবেলার ইরেজারের ঘ্রাণ, ইশকুলের চারকোনা রোদমাখা মাঠ, নীলশাদা বরফিকাটা সোয়েটার। কে জানে- হয়তো রাজকন্যাই ইরেজারের ঘ্রাণের দেশ হয়ে যাবে তোমার স্পর্শে।
: হা: হা: হা: তুমি আমার মত বুড়োকে রূপকথা শোনাচ্ছো!

রোদ তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠে-
: রূপকথা শোনাবো কেন! আমার কি দায় পরেছে! একবার মনসুখিয়ায় ঘুরে এলেই পারো।

রোদ অভিমানে একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। পর্দা টেনে দিলে এখনি চলে যাবে। পর্দা না টেনে বসে থাকি, এই রোদ সামান্য নয়। ছেলেবেলার ঘুড়ি ওড়ানোর দুপুর থেকে পালিয়ে এসেছে আমাকে দেখবে বলে, মনসুখিয়ার রাজকন্যার চুলে ইরেজারের ঘ্রাণের দেশে পৌছানোর নকশা আছে জানাতে।

সবাই তো চলে যায়, রোদও যাবে, যাবার আগে ডুবে থাকি, নিজেকে ডুবিয়ে রাখি রোদের কণায় কণায় কিছুটা সময়।

20 thoughts on “ইরেজারের ঘ্রাণ

  1. আমার কেন জানি মনে হয় … (অন্তত আমার কাছে)
    আপনার লিখায় মোহন শক্তি রয়েছে। পাঠকের চোখ নিবিষ্ট হলে চোখ সরানো দায়। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

  2. লাল গোলাপ নিন।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    হাই হ্যালো।

    বহুদিন পর কোন লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে স্তম্ভিত হয়ে রইলাম।

    https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  3. আপনার অণুগল্পের জন্য আমি অপেক্ষায় থাকি। আপনি আমার প্রিয় ব্লগারদের একজন।

    শুভেচ্ছা রইল প্রিয় সাঈদ ভাই।

  4. কিছুক্ষণ সময় আপনার সু-লেখনীয় পোস্টের মাঝেই ঢুবে থাকলাম। বেশ ভালোই লাগছিল। 

    শুভেচ্ছা-সহ শুভকামনা আপনার জন্য।    

  5. দারুণ লাগলো জীবনের গল্প। এমনই আরো চাই।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।