মজার গল্প

আকিল আকতাব গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। কথা বলেন কম, তবে গুছিয়ে এবং মোটামুটি যুক্তি দিয়ে কথা বলেন। ইদানিং তার মাঝে পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। তিনি সবকিছুতেই মজা পান। কথা শুরু করেন ‘মজার একটা কথা শোনেন” বলে। গতকাল বিকেলে পাশে এসে বসলেন-
: ভাই, মজার একটা কথা শোনেন।
: বলেন।
: এমদাদিয়া হোটেলে লাঞ্চ করতে গেছি, মাছের তরকারীতে তিন তিনটা চুল, হা: হা: হা:
: এখানে মজা কোথায়?
: মজাটা ধরতে পারছেন না! বাবুর্চির চুল এভাবে ঝরলে তিন মাসে পুরো টাক। তারপর এমদাদিয়া হোটেলের তরকারীতে আর চুল পাওয়া যাবেনা হা: হা: হা:

তিন মাস আগের আকতাব সাহেবের সাথে এই আকতাব সাহেবের মিল খুঁজে পাইনা। আজ মুখে কষ্ট চেপে হাসি এনে বললেন-
: মজার কথা শোনেন, ব্যাথায় মাথা পুরো ছিড়ে যাচ্ছে।
: ওষুধ খান, মজার কথা পরে শোনান।
: আরে শোনেন না, ব্যাথা তো মাথাকে ছিড়ে ফেলতে চাইছে। কিন্তু গলা শক্ত দড়ির মত আটকে রেখেছে, যা ফাইটিং হচ্ছে পুরো একশন মুভি হা: হা: হা:

মন উসখুশ করে। সবকিছুতে মজা পাওয়া সুস্থতার লক্ষণ নয়। লোকটাকে খুব পছন্দ করি। অফিস ছুটির পরে তাকে পাকড়াও করে এক নিরিবিলি রেস্টুরেন্টে বসলাম:-
: আকতাব ভাই, বলেন তো আপনার সমস্যা কি?
: ধ্যাত, সমস্যা কোথায়! পুরোটাই সুবিধা হা: হা: হা:
: সুবিধাটাই বলেন- কোন কিছু না লুকিয়ে বলেন।

উনার মুখে এক মূর্হুতের জন্য বিষাদ খেলা করে। পরক্ষণেই হাসি মুখে হালিম আর নান খেতে খেতে বলতে শুরু করেন-
: আমার খুব বাজে ধরনের মাথাব্যাথা আছে, জানেন তো?
: হুম, মাইগ্রেনের ব্যাথা। ব্যাথা উঠলে আপনাকে চেনা যায়না।
: শাহেদ আর মুস্তফিজকে চেনেন তো! আমার বন্ধু।
: হ্যা, বেশ চিনি। খুব ভালো এবং দায়িত্বশীল ডাক্টার।
: কিছু শারিরীক সমস্যা দেখা দেয়ায় তাদের কথামত সব টেস্ট করিয়েছিলাম। কিছু টেস্ট তিনবার করালো।
: তারপর?
: মজার কথা শোনেন, শালারা টেস্ট শেষে জানালো নিয়ম কানুন মেনে চললে হাতে বড়জোড় দশবছর সময় আছে।
: মানে?
: মানে বাংলা ছবিতে নায়কদের যেমন ক্যান্সার হয়, তেমন। মজার ব্যাপার তাদের ক্যান্সার ধরা পরে ফাইনাল স্টেজে, আমারটা ধরা পরেছে আগে আগে হা: হা: হা:
: কি বলছেন? সত্যি?
: হ্যা, ভাই, সত্যি। এখন নিয়ম কানুন মেনে চলছি- ক্লাশের ফার্স্ট বয়ের মত।
: বাসায় জানে?
: বাসায় পরে জানানো যাবে। তারা সহজভাবে থাকতে পারবেনা। দশটা বছর ভুগবে। আমি চলে যাবার পরেও ভুগবে। ওদের এডভান্স ভোগানোর কি দরকার! হা: হা: হা:
: বাসায় জানানো দরকার!
: সময় হলে শাহেদ আর মুস্তাফিজই জানাবে।
: নিজের দু:খ আড়াল করতে মজা পাবার অভিনয় করেন কেন! সবাই ভুল বুঝে।

আকতাব সাহেব সশব্দে হেসে উঠে বলতে শুরু করলেন-
: ভাই, মজার কথা শোনেন, দশ বছর অনেক সময়। দশ বছরের পরের যাত্রার জন্য বাক্সপেটরা গোছানোর ঝামেলা নেই। তবে সংসারের কিছু জিনিস ঠিক ঠিক দ্রুত গুঁছিয়ে দিতে হবে- আমি না থাকলেও প্রিয়মানুষেরা যেন ডালভাত খেয়ে সম্মানের সাথে টিকে থাকতে পারে।
: এখন স্বাভাবিকভাবে কথা বলছেন- ভালো লাগছে। এটা তো আর মজার কথা না?
: মজার কথা নয় তো কি। দায়িত্ব আরো আছে, দশবছরের মধ্যে বিশটা কালজয়ী কবিতা লিখতে হবে। একজনকে নীরবে শর্তহীনভাবে ভালোবাসতে হবে- ভালোবাসা ছাড়া কবিতা লেখা যায় না কি! হা: হা: হা:
: বেশ, মজার কথা শুনে মজা পাচ্ছিনা-
: তবে সিরিয়াস কথা বলি, যাদের ভালোবাসি তাদের সবাইকে বলতে হবে – ‘আইলাভ্যু’ হা: হা: হা:। দশ বছর অনেক সময়, এই সময়ের মধ্যে কাজগুলো সারতে হবে।
: দশ বছর মোটেও বেশী সময় নয়।
: ভাই, ফর্মূলা জানলে দশ বছর অনেক সময়। মজার ফর্মূলাটা শুনবেন?
: বলেন, শুনি।
: দশ বছরকে বিশ বছর বানিয়ে ফেলেছি হা: হা: হা:
: অসম্ভব! কিভাবে?
: আগে রাতে ঘুমোতাম, এখন জেগে থাকি হা: হা: হা:। রাতগুলোকে দিন ধরে নিলে হিসাবে বিশ বছর হয়, তাই না!
: টেনশনে কি ঘুমান না?
: টেনশন নেই বলেই জেগে থাকি। তবে আসা-যাওয়ার পথে যানজটে বসে বসে ঘুমোই, রাতে একঘন্টা গাঢ় ঘুম দেই। ঘুম অভিমান করেছে, এখন আর আমার কাছে সহজে আসে না হা: হা: হা:

কথা খুঁজে পাই না। হালিম আর নান শেষ করে রেস্টুরেন্ট হতে বের হই। দিনের ব্যস্ত দিলখুশা এখন প্রায় নির্জন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাদের উপরে মস্ত চাঁদ উঠেছে। আগামীকাল পূর্ণিমা। কিছুটা হেটে রিকশায় উঠি, আকতাব সাহেব সাথে আসেন। কোথায় যাবো জিজ্ঞেস না করেই চালক রিকশা চালাতে শুরু করেন। চারদিকে এত মজা- তবু কেমন বিস্বাদ লাগে। আকতাব সাহেব চাঁদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন। জোছনায় বা অশ্রুতে তার চোখ চিকচিক করছে। হঠাৎ সমস্ত আবেগ দিয়ে গাইতে শুরু করেন-
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম।।

মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম।।

জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি,
তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি।

মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন
তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম।।

20 thoughts on “মজার গল্প

  1. আকিল আকতাব গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ হলেও একদা তাঁর সাথে আমার পরিচয় ছিলো।
    আকতাব সাহেবের মনো অনুভূতিতে আমারও মনটা বিষণ্ন হয়ে গেলো। :(

    1. স্বাভাবিক ধরে নিন মুরুব্বী আজাদ ভাই। :)

  2. হুমায়ুন আহমেদের লেখার মতো মনে হলো।

    এক কাজ করেন হিমুর সিরিজটা আবার লেখেন।

  3. খুব দরদ দিয়ে লিখেছেন। এই ধরনের দরদী লিখা আমার ভাল লাগে। হুমায়ুন আহমেদ এই রকম দরদ দিয়ে চরিত্র সৃষ্টি করতেন।

    1. ভালো লাগলে শুনে আনু আনোয়ার ভাই। :) ধন্যবাদ।

  4. আকতাব সাহেব চাঁদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন। জোছনায় বা অশ্রুতে তার চোখ চিকচিক করছে। হঠাৎ সমস্ত আবেগ দিয়ে গাইতে শুরু করেন-
    তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  5. আপনার অণুগল্প পড়তে ভীষণ ভাল লাগে দাদা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  6. আপনার অনুগল্প পড়ে যেমন পেয়েছি মজা। আবার খুব ভালোও লেগেছে দাদা। সত্যি চমৎকার! 

  7. মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন
    তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম।।

    চমৎকার …

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।