ছোটদের গল্প
কুইন অ্যান এবং লাভা-র ভূত
পেছনে তাকিও না
বেশি সাধতে হল না, ঘড়িকাকু নিজের হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে শুরু করলেন:
গত বছর এই রকম ভরা শ্রাবণে আমি কালিম্পংয়ের পাহাড়ে বেড়াতে গেলাম। তুমুল বৃষ্টি আর রাস্তার ধস মাথায় ক’রে ট্রেকারে চেপে এক শেষ-দুপুরে পৌঁছোলাম লাভা-তে। বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া যে-হোটেলে ছাতামুড়ি দিয়ে এসে ঢুকেছি, তার একমাত্র বোর্ডার আমিই। জানলা দিয়ে তাকালে চারদিকে কুয়াশার দুধ-সাদা দেয়াল, ক্কচিৎ দু’একটা জিপ ফগলাইট জ্বালিয়ে ওঠানামা করছে। পোশাক পালটে আমার দোতলার রুম থেকে নেমে এলাম। হোটেলটা চালান জিনিয়া রাই নামে এক টুকটুকে সুন্দরী বৃদ্ধা আর তার পরিবারের সদস্যরা। রিসেপশানের বাঁপাশের হলঘরটা রেস্তোঁরা; এই অবেলায় দুপুরের খাবার মিলবে না বুঝে এক কাপ কফি আর পকোড়ার অর্ডার দিয়ে চেয়ার টেনে বসতে গেছি, দেখি উল্টোদিকের দেয়াল জুড়ে এক সুপ্রাচীন ওয়াল-ক্লক। এবং সেটা নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু!
এ-হল আমার যাকে বলে বার্নট ফোরহেড, বুঝলে তানিয়া মা? ঘড়িকাকু আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালেন: যেখানেই যাই, অচল ঘড়ি ঠিক আমার পিছু নেবে। অথবা, আগে থেকেই সেখানে পৌঁছে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকবে আমার অপেক্ষায়। আরেকটা ঝামেলার ব্যাপার হল, প্রত্যেক বন্ধ ঘড়ির মুখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি তারা আমাকে মুচকি হেসে চ্যালেঞ্জ করছে, পারো তো সারাও দেখি! কাজেই, অন্তত বেড়াতে গিয়ে আমি তাদের দেখি না। এবারও চট করে চোখ সরিয়ে মোবাইল হাতে নিলাম — বাড়িতে একবার জানানো দরকার আমি আস্ত শরীরে লাভায় পৌঁছেছি। কিন্তু সিগন্যাল নেই। ফর্সা, ছিপছিপে যে কিশোরী খাবার সার্ভ করছিল, বলল: এত বৃষ্টিতে মোবাইল টাওয়ারগুলো হয়তো কাজ করছে না। আপনি বৌদ্ধ গুম্ফার চত্বরে গিয়ে চেষ্টা করুন, ওখান থেকে লাইন পাওয়া সহজ।
বেরিয়ে এসে দেখি বৃষ্টি থেমেছে, আকাশও কিছুটা ভদ্রলোকের মতো। হোটেলের ঠিক সামনে একটা রাস্তা ডানদিকের উৎরাই ধরে চলল গোরুবাথানের দিকে, আলগা নুড়িপাথর আর পিচের গুঁড়োয় তার অবস্থা মোটেই সুবিধের নয়। তবু ওর মধ্যেই কয়েকটা খুদে বাচ্চা দিব্যি ছুটোছুটি করছে সোয়েটার জিনসের প্যান্ট চাপিয়ে। আর নজরে পড়ল এক বৃদ্ধ পাহাড়ি মানুষ — পুরনো আমলের ঢংয়ে কেতাদুরস্ত থ্রিপিস স্যুট, মাথায় কানাতওলা টুপি, হাতে ছড়ি নিয়ে টুকটুক করে নামছেন আমার পেছনে। যা হোক, বৌদ্ধ মন্দিরের ফটকে পৌঁছে দেখি নোটিশ ঝুলন্ত — সাড়ে পাঁচটার পরে ভেতরে ঢোকা যাবে না। এদিকে আমার হাতঘড়ির বক্তব্য: এখন সাড়ে ছ’টা। কী করি! হঠাৎ পেছন থেকে এসে দুজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ঢুকলেন গেট ঠেলে, আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশারায় জিগ্যেস করলেন: ফোন করতে চান তো? ভেতরে আসুন।
বৌদ্ধ মন্দিরের পাঁচিল-ঘেরা চত্বরে ঢুকতেই মালুম হল, ভিউ পয়েন্ট হিসেবে জায়গাটা দুর্দান্ত! নিচের খাদ থেকে বিশাল চেহারার কত যে ঝাউগাছ উঠে এসেছে, তাদের মাথায় সাদা ফিতের মতো জড়ানো কুয়াশা। বাড়িতে ফোন সেরে আবার উৎরাই বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম, আলো থাকতে থাকতে আজকের মতো যতটুকু দেখে নেওয়া যায়! এখন রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই-ই, দোকানগুলো ঝাঁপ ফেলছে এক এক করে। পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেলাম শুধু সেই বৃদ্ধকে, আস্তে আস্তে ছড়ি হাতে নামছেন। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন উনি!
এখানে রাস্তা অনেকখানি সমতল পেয়ে দু’একটা বড় দোকানকে তার গা ঘেঁষে জায়গা দিয়েছে। ডানদিকে তাকালে অস্পষ্ট উঁচুনিচু ঢেউয়ের মধ্যে একটা বিশেষ পাহাড় অনেক আলোয় সাজানো। আকাশ থেকে তারাগুলো খসে যেন পাথরের খাঁজে খাঁজে আটকে গেছে। “ওটা কালিম্পং” — চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি যে ভদ্রলোককে এখুনি তার মোটর গ্যারাজে তালা লাগাতে দেখলাম, কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
“এই বৃষ্টিতে পাহাড়ে বেড়াতে এলেন! কলকাতার লোক মনে হচ্ছে?” ঘাড় নাড়িয়ে তাকে হ্যাঁ বলতে গিয়ে আবার চোখে পড়ল সেই বৃদ্ধ মানুষটি পথের শেষ উৎরাইটুকু ভেঙে এদিকেই এগিয়ে আসছেন। সামনের দিকে হাত তুলে গ্যারাজ মালিককে শুধোলাম: কোথায় গেছে এই রাস্তা?
— বস্তির দিকে। তবে একা একা অন্ধকারের মধ্যে ভেতরে ঢুকবেন না। ফরেস্ট এলাকা, জানেন তো?
— হ্যাঁ, নেওড়া ভ্যালি। জীবজন্তু বেরোতে পারে বলছেন?
— ভালুক বা লেপার্ড কখনও সখনও নিচে নেমে আসে। দিনের বেলা তেমন হলে গ্রামের লোকই আপনাকে সাবধান করে দিত। কিং কোবরা, পাইথন — কয়েক রকম সরীসৃপেরও বাস এই জঙ্গলে। তারপর ধরুন…জানোয়ার ছাড়া আরও কতকিছু আছে!
গুড নাইট বলে ভদ্রলোক বিদায় নিলেন। ওমনি আমার খেয়াল হল অনেক রাত নেমে গেছে চারপাশে। রাস্তাটা যেন হঠাৎ ক’রে ঘুরঘুট্টি, কোথা থেকে একটা বড় লোমওলা কুকুর উদয় হয়ে আমার প্যান্ট শুঁকতে লেগেছে। দেরি না করে পা চালিয়ে দিলাম ফিরতি পথে।
তুমি তো জানো সিদ্ধার্থ, ঘড়িকাকু মুখ তুলে বাবার দিকে তাকালেন, সহজে ঘাবড়ে যাওয়ার পাত্র আমি নই। ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি শুরু হতে বুঝলাম গাঢ় রাত নেমে যাওয়ার রহস্য। সন্ধের আকাশে মেঘ জমে আসা আর দুম করে লোডশেডিং — কোনওটাই আমি আসলে লক্ষ করিনি। সে যা হোক, কিছুটা ওঠার পর শরীরের মধ্যে এক রকম ছমছমে অস্বস্তি টের পেতে লাগলাম। মন বলল, আমার পেছনে এমন একটা কিছু ঘটছে যা দেখা একেবারেই উচিত হবে না। অথচ, তাকাবো না তাকাবো না করেও পেছনবাগে ঘুরে গেল মাথাটা। আর যা দেখলাম তাতে কোনও যুক্তিবুদ্ধিই আমাকে ভয়ে শিউরে ওঠা থেকে বাঁচাতে পারল না। সেই বৃদ্ধ! একইভাবে মাথা রাস্তার ওপর ঝুঁকিয়ে হেঁটে আসছেন আমার পিছু পিছু। কিন্তু এবার অবিশ্বাস্য জোরে হাঁটছেন, ঘাড়ের ওপর এসে পড়লেন আর কি!
ভয়ের স্বপ্নে যেমন হয়, ছুটতে চাইলেও কিছুতেই পাদুটো নড়বে না মাটি থেকে, তেমনি স্ট্যাচু অবস্থায় কতক্ষণ কেটেছে জানি না, হঠাৎ নিচু গলার কথা আর চপ্পলের ফটফট শব্দে সম্বিত পেয়ে দেখি, ডানদিকের গলি দিয়ে পাঁচছ’জন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হেঁটে আসছেন, গায়ে লাল-মেরুন কাপড়; তাদের মধ্যে আছেন আমার বিকেলবেলার দুই মুখচেনাও। “হোয়াট হ্যাপেনড! গট ফোন লাইন?” — মাথা কাত করে আমি পা চালিয়ে মুহূর্তে মিশে গেলাম সেই দলে। ওরা জানতেও পারলেন না, কত বড় বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন আমাকে!
(কাল আসছি… )
গল্পটির প্রথম খণ্ড এবং দ্বিতীয় খণ্ড একই পাতায় অবস্থান করার কারণে পাঠক এখন দুটি পর্বই দেখতে পাচ্ছেন। কি জানেন চন্দন দা … পোস্টে মন্তব্য না থাকলেও আমি নিরাশ হই না। আমি দেখি লিখাটি কতবার পড়া হয়েছে। ব্যাস তাতেই আমার শান্তি এবং শান্তনা।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষা মাত্র।