অফিসার্স ক্লাবটির পশ্চিম পাশে লন টেনিস খেলার গ্রাউন্ডটি পুরোটা নেট দিয়ে ঘেরা। নেটের ওপাশে গাছপালা কেমন জঙ্গলের মত হয়ে আছে। বেশীরভাগই কাঁঠাল গাছ। লন টেনিস মাঠ আর জঙ্গলটির মাঝ দিয়ে পায়ে চলা পথটি কিছুদূর গিয়ে ডানে বেঁকে গেছে। এরপর সোজা হয়ে বিরাট দীঘিটার পাশ দিয়ে পুরনো কলা ভবনের দিকে গিয়ে অন্য পথগুলোর সাথে মিশেছে।
.
আমাদেরকে অত দূর পর্যন্ত যেতে হবে না। সোজা পথটির মাঝামাঝি দীঘির পার ঘেসে শান বাঁধানো লম্বা এক সিমেন্টের বেদী। দর্শনার্থীদের বসার জন্য। ঠিক এর বিপরীতে কদম গাছটি। নিঃসঙ্গ থাকে সারা বছর। এর গোঁড়ায় রাতের বেলায় গঞ্জিকা সেবীদের আড্ডা বসে। তবে কদম গাছটির এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। এরা সবাই নেশায় বুঁদ হয়ে বিভিন্ন আলোচনা করে। রাজনীতির আলাপ… সমাজ পরিবর্তনের বড় বড় বুলি আওড়ানো আর নিজেদের ভিতরে ইচ্ছাকৃত খুনসুটি। হেঁড়ে গলায় কয়েকজন গান ধরে… ভরাট গলায় কোঁকড়া চুলের সুন্দর ছেলেটি যখন কবিতা আবৃত্তি শুরু করে, কদম গাছটির নিজেকে তখন ওদেরই মাঝে বসে থাকা একজন মনে হয়। এই গঞ্জিকাসেবীদের জন্যই ওর নিঃসঙ্গতা তেমন অনুভুত হয় না।
.
মেয়েটি একা একা সেই সিমেন্টের বেদীতে এসে বসে। কদম ফুলে গাছটি ছেয়ে আছে। খুব সুন্দর লাগছে! সবুজ পাতার সাথে হলুদ গোল বৃত্তগুলো সাদা রেণুতে ভর্তি। মনটা আপনিতেই ভালো হয়ে গেলো।কদম ফুল দেখে নয়। একজন ওর কাছে কদম চেয়েছিল! সেটা মনে পড়াতে। বুকের গভীরে আনন্দের একটা স্রোত বয়ে যায়। শরীরের স্নায়ুগুলো উত্তেজিত হয়ে ওঠে। দুটি কান এতোক্ষণে নিশ্চয়ই লাল হয়ে গেছে তাঁর!
.
ছোট ছোট কয়েকটি ছেলে দীঘির অল্প পানিতে জলকেলি করছে। ওদের একজনের হাতে রেণুহীন দু’টি কদম ফুল দেখতে পেলো। নিশ্চয়ই ওরা এই গাছ থেকে পেড়েছে। ওদের ভিতর অপেক্ষাকৃত বড় ছেলেটিকে ডেকে গাছ থেকে ওর জন্য দু’টি কদম ফুল ছিড়ে দিতে বলে। ছেলেটি একটু ইতস্তত করতেই পার্স থেকে টাকা বের করে দিতেই রাজী হয়। মেয়েটির চোখের সামনেই তরতর করে গাছে উঠে। অনেকগুলো কদম ফুল ডালসহ নিয়ে আসে। মেয়েটি মাত্র দুটি কদম রেখে বাকীগুলো ছেলেটিকে দিয়ে দেয়। ওরা পানিতে বসে সেগুলোর রেণু ছেড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে আবার।
.
বৃষ্টির ভিতর দিয়ে হাতে দু’টি কদম ফুল নিয়ে মেয়েটি একা একা লম্বা একটি পথ ধরে এক নির্দিষ্ট জায়গার উদ্দেশ্যে হেঁটে যায়। বৃষ্টি ওকে আপাদমস্তক ভিজিয়ে ওর সারা শরীরকে কাপড়ের সাথে লেপ্টে দিয়েছে। ঠান্ডায় হুহু করে কাঁপলেও ভিতরের অন্য এক উত্তেজনায় সে শীত অনুভব করে না। এরকম বৃষ্টি ভেজা হয়ে শরীরের লেপ্টানো বাঁকগুলোকে নিয়ে একজনের কাছে যাবে সে… হাতে থাকবে বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল! একজনকে কথা দিয়েছিল। আজ সে অপেক্ষা করবে ওর জন্য। সেদিকেই যাচ্ছে এখন।
.
নির্দিষ্ট জায়গার সেই যাত্রী ছাউনিতে গিয়ে যার কাছে সে এসেছে তাঁকে সামনে দেখেও চিনতে পারে না মেয়েটি। প্রচন্ড বৃষ্টি… ছাউনিতে দু’জন। মেয়েটি বাইরে… ওর যেখানে থাকার কথা সেখানে অন্য এক অচেনা মেয়ে! পরিচিত ছেলেটি ভীষণ অপরিচিত হয়ে সেই মেয়েটির খুব কাছে… দু’জনের নাকে নাক ছুঁয়ে আছে। আশপাশের কোনো কিছুই ছাউনির যুবক-যুবতীকে ওদের এই মোহাবিষ্ট অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে না। এমনই মগ্ন তারা।
.
মেয়েটি কদম দুটি পথের ওপর রেখে নিঃশব্দে ফিরে যায়। সে যে এসেছিল ওগুলো তারই প্রমাণ।
.
বিষন্ন হাসে মেয়েটি। এখন আর প্রমাণে কিছু যায় আসে না। বৃষ্টি ওর চোখের জল ধুয়ে দেয়। কিন্তু হৃদয়ের কান্না? আরো বেগে ঝাপিয়ে পড়ে জলধারা ওর ওপর। ওর সিক্ত বসনকে একেবারে পিষে ফেলতে চায়… পুরনো পথ ধরে ফিরে যেতে যেতে মেয়েটি ভাবে, বৃষ্টি তবুও তো ওকে ছুঁয়ে দিয়েছে… জোর করে প্রেষণ করছে… দলিত মথিত করছে! কিন্তু যার এগুলো করার কথা ছিল, সে কি করছে?
.
বৃষ্টি ভেজা এক নির্জন রাস্তায় হৃদয়ে ভাবাবেগের পাগলা দিনের বাদল হাওয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ করা অনুভুতি নিয়ে একটি মেয়ে হেঁটে চলে।।
2 thoughts on “অন্যের হয়ে গেলে খুব সহজেই : অণুগল্প-৪৩৩”
মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।
অসাধারণ। একটি অণুগল্পই যেন পূর্ণ গল্পের স্বাদ পাইয়ে দিলো। শুভ সকাল মি. মামুন।
প্যারা থাকা আর লেখার মধ্যে অযথা কঠিন শব্দ ব্যবহার না করা আপনার গল্পের অনন্য এক দৃষ্টান্ত। ভাল হয়েছে গল্প দা।