দেশ – বৈদেশ

১০
অস্ট্রেলিয়া এখন মিশ্রকালচারের দেশে পরিণত হয়েছে। এত এত মাইগ্রেন্ট বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে এসেছে এবং আসছে যে আমার মনে হয় একসময় অরিজিনরা নিজেদের হারিয়ে ফেলবে তাদের মধ্যে। চাইনিজ মনে হয় প্রায় সবচাইতে বেশী মাইগ্রেন্ট হয়ে আসছে। সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে পাখির মতন কিচকিচ করে কথা বলে। তারা যেখানেই যায় সাথে করে ঘরে তৈরী খাবার নিয়ে যায়। অল্পবয়সী মেয়েগুলো খুব মিষ্টি দেখতে। ওদের মুখের স্কিন যেন লেমিনেটেড শীট। আমার হিংসেই হয়। এতো পলিশ কি করে থাকে এরা !! আমাদের নেভিটাসের ক্লাসে প্রায় চাইনিজ মেয়ে /মহিলা/পুরুষ সাথে করে এককাপ/গ্লাস লেবু স্লাইস মেশানো হালকা গরম পানি সাথে নিয়ে বসে। পুরো ক্লাসে একটু পরে পরে এই মিক্সড পানি পান করে।

আমরা নিজেদের ব্যপারে এতো কেয়ার করি না। অথচ ওরা সবসময় কেয়ারফুল। সম্ভবত এজন্য ওদের স্কিন সবসময় চকচকে, পলিশড। এখানে আমরা যেহেতু পি আর নিয়ে এসেছি তাই আমাদের চিকিৎসা ফ্রি। বাংগালী ফ্রী পেলে বিষও খায়। আমরাও বিষ খেতে দেরী করছিনা। সব ধরনের টেস্ট চিকিৎসা করিয়ে নিচ্ছি। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষায় দেখা গেলো আমার পেটে ব্যাক্টেরিয়া, শরীরে হিমোগ্লোবিন কম, আয়রন কম, এমনকি ক্যালসিয়াম ও ভীষন কম। ভাবছিলাম আমরা গরীব দেশের মানুষ বলে এই অবস্থা নাকি আমাদের খাবারের মধ্যে ভেজাল নাকি আমি নিজেই নিজের ব্যপারে সবসময় অসতর্ক। মেয়েরা তো বেসিকেলি এমনি হয়।

সেদিন ডাক্তারের অপেক্ষায় বসে আছি – অপেক্ষা বাংলাদেশের মত এখানেও করতে হয় – তবে পার্থক্য হলো এখানে ডাক্তার সাহেব নিজেই এসে রোগীকে ডাকেন। কোনো কম্পাউন্ডার নেই যে তার দাপটে রোগী হয়রান হবে। যাই হোক এখানে প্রচুর আরবী ভাষাভাষী মানুষও সিটিজেনশীপ নিয়ে বাস করছে। একজন আরব বিশেষ করে লেবানিজরা প্রায়ই চারটা বিয়ে করে। এরপর তাদের আরো সদস্যদের আনার ব্যবস্থা করে। এবং এই যে এতোগুলো বিয়ে করে ওদের স্ত্রীদের তাতে কোনো আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। এক বুড়োর চার স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী আমার আম্মার সমান, দ্বিতীয় স্ত্রী আমার বয়সী, তৃতীয় স্ত্রী আমার ছোটবোনের বয়েসী আর চতুর্থ স্ত্রী আমার মেয়ের বয়সী। এতে তাদের সমস্যা নেই। ওরা বান্ধবীর মতো চলাফেরা করে। কিন্তু দীর্ঘাঙ্গী মেয়েগুলো দেখতে অসম্ভব সুন্দর। এখানে ওরা সবাই একসাথে থাকে বলে ওদের ইনকাম প্রচুর। যেমন একজনের ঘরে সাত থেকে আটজনই যদি ইনকাম করে সে অবশ্যই ধনী /সম্পদশালী যাদের অনুপরিবার তাদের চাইতে। এখন এখানে তারা ব্যবসা করে চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত। অস্ট্রেলিয়ানদের চাইতেও সম্ভবত।

যাই হোক ডাক্তারের ডাকের অপেক্ষায় বসে আছি। এক আরবী মা তার তিন মেয়ে আর একজন সাথে গভর্নেস (সম্ভবত) নিয়ে এসেছে। এজন্যই মনে হলো গভর্নেসের গায়ের রঙ কালো আর ওদের গায়ের রঙ পশ্চিমাদের মতই। মেয়ে দুটোর বয়স হবে সাত বা আট। ওদের চুল বড়। এত বড় যে সুন্দর করে বেণী করে রেখেছে। আমি পিচ্চিটাকে ডেকে বললাম এসো তোমার ছবি তুলি। সে রাজী হলো। সুন্দর ছবি তুললো। কিন্তু ওদের গভর্নেস ডেকে ওকে বলে দিলো যে অপরিচিত কারোর কথায় ছবি তুলতে হয় না (যদিও তার কথা শোনা যায় নি কিন্তু ধরে নিলাম )। গভর্নেস মেয়েটা কালো মোটা আর ফ্লুয়েন্ট ইংলিশে কথা বলে। একটু অপমান লাগলো আমার। মেয়েটা হাসিখুশি ছিল খুব, দুই বোন চমৎকার খেলছিলো কিন্তু ওর কথায় সেও আপসেট হয়ে অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। আমি সামান্য হেসে চোখে চোখে অভয় দিলাম – আহা ব্যপার না তো !!

আরব শিশু –

সবগুলো মেয়ে বাচ্চার চুল সোনালী এবং কোমর অবধি – বিষয়টা ভাবার মতো

১১
আমার আম্মা বলতো আমি শুকনাতেও আছাড় খাই। আর আব্বা বলতো ‘তোর হাতে কি কোনো রগ নাই ? কিছু ধরলেই পড়ে যায় !! এসব শুনতে শুনতে অভ্যেস হয়ে গেছে বলে আর কেউ বললে পাত্তা দেই না। সেদিন আমাদের ক্লাসে সিদরা নামে পাকিস্তানী মেয়েটা বললো – জানো সেদিন তোমার ছেলে কি বললো ?
হাসতে হাসতে তার দিকে ফিরলাম – আচ্ছা বলতো কি বললো !
‘তোমার সাথে বেরোলে তোমাকে নাকি ওরা কিছুক্ষণ পরে খুঁজে পায় না। তুমি নাকি হারিয়ে যাও”।
সে আবার যোগ করলো – তুমি নাকি কবি মানুষ, তাই আনমনা – বলে সে আবার হাসতে হাসতে পড়ে যাচ্ছিলো।
আমি হাসলাম। এরকম ঘটনা যে প্রায়ই হয় সেটা ভেবে নিজেই হয়রান হলাম। আমার ছেলেমেয়েরাও যে এই বিষয় নিয়ে কিঞ্চিত চিন্তিত থাকে এতে আত্মপ্রসাদ নাকি আত্মতুষ্টি হয় সেটা বুঝতে পারছিলাম না। সে যাই হোক – নিজের ব্যপারে এমন একটু আধটু ধারণা আবার সত্যি প্রমাণিত হলো সেদিন সত্যি সত্যিই যখন ব্যাঙ্কসটাউনের শুকনা ঝকঝকে পোলিশ রাস্তায় আছাড় খেয়ে পা’য়ে ফ্র্যাকচারই করে ফেললাম। এর কি কোনো মানে আছে ?

ব্যাঙ্কসটাউন যে এরিয়াতে ইংলিশ ভাষা শিক্ষার ক্লাস হয় সে জায়গায় যেতে রেলস্টেশন থেকে একটা মার্কেট, মাঠ, ব্যাঙ্কস্টাউন লাইব্রেরী পার হয়ে যেতে হয়। এই লাইব্রেরী দেখে তো আমার মাথা খারাপ। এতো বড়, সুন্দর ঝকঝকে লাইব্রেরী যে মনই ভালো হয়ে যায়। লাইব্রেরীতে ঢোকার মুখে থিয়েটার, একটা টেকওয়ে ফুডশপ এরপর লাইব্রেরী। লাইব্রেরীর সামনে একপাশে আছে সুইমিং পুল। আপনি ইচ্ছে করলে সুইমিংপুল সামনে রেখেও বই পড়তে পারেন। অনেকে বাচ্চা নিয়ে যায়। তাদের বাচ্চাদের জন্য শোয়ার ব্যবস্থা আছে। শুয়ে বসে সব ভাবে পিনপতন নিরবতায় বই পড়তে পারবেন। ৫০০০ স্কয়ার মিটারের তিনটা ফ্লোরের এক সুবিশাল লাইব্রেরী। শুয়ে বসে রিলাস্কিং মুডেও বই পড়ার ব্যবস্থা আছে। কম্পিউটার ইউজিং ফ্রি ওয়াইফাই সহ। মন খারাপ হলে গাছের পাতাদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেও বই পড়তে পারবেন কেননা লাইব্রেরীর ভেতর থেকে কাচের জানালা দিয়ে দেখা যায় সুবিশাল মাঠ, বৃক্ষ, পাখির কোলাহল। কত হাজার ধরনের বই যে আছে – আছে পৃথিবীর সব বিখ্যাত বই।

আছে নানান ধরনের জার্নাল, ম্যাগাজিন। ভোগের মত ফ্যাশন ম্যাগাজিন ও আছে। তবু নিজের ভাষায় বই দেখলে অথবা পড়তে পেলে ভালো লাগে নিশ্চয়। ইংরেজী বই অনেকটা যেনো সব তরকারী রান্না হলেও লবন ছাড়া সব স্বাদ মাটি এরকম। সব আছে অথচ কিছুই নাই। একবার কলেজে (আমার জব করতাম যেখানে) একজন ইংলিশে বিজ্ঞাপন রেডি করছিলেন ছাত্র ভর্তির জন্য। আমি বলছিলাম নিজের ভাষা হলো এমন যে দেখা মাত্র হৃদয়ে গেঁথে যাবে কিন্তু পরের ভাষা আগে পড়বে তারপরে বুঝবে তারপর সে রেসপন্স করবে। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। নিজ দেশ ছেড়ে আসলে সেই অনুভবটা আরো তীব্র হয়।

কবি আবদুল হাকিম বলেছিলেন ‘দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়। নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।।” আমাদের তো দেশ ভালো লাগে, ভাষাকেও প্রাণের অধিক ভালোবাসি। তবু এই দেশ বিদেশ মানুষের আসা যাওয়া -এটা চলবেই – ক্রমশ এই পৃথিবী ছোট্ট গ্রামের মত হয়ে গেলে সব ভাষাই আমাদের ভাষা, সব দেশই আমাদের দেশ, পুরো পৃথিবীই একটা গ্রহ – এর বাইরে যেতে হলেও আমাদের এর মাটিতেই মিশতে হবে – আহা পৃথিবী ! আর কি অসম্ভব সুন্দর এই বেঁচে থাকা !!

ব্যাঙ্কস্টাউন লাইব্রেরীর অন্দর মহল

ব্যাঙ্কসটাউন লাইব্রেরী

লাইব্রেরীর সামনে রয়েছে মন উদাস করা পার্ক

11 thoughts on “দেশ – বৈদেশ

  1. দেশ বৈদেশ এর কথা গুলো পড়লে আমি আনমনা হয়ে যাই। আমি ভীষণ নস্টালজিক হয়ে পড়ি। গত পর্ব গুলোর মতো দারুণ উপভোগ্য হয়েছে এই পর্বও প্রিয় আপা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    1. ধন্যবাদ মুরুব্বী । নস্টালজিকতা একটা অসুখের নাম – https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_dance.gifহা হা 

      ভালো থাকবেন । 

  2. অস্ট্রেলিয় জীবনধারা এবং সহযোদ্ধাদের সমাজ সংস্কৃতি অসাধারণ ফুটে উঠেছে দিদি ভাই। প্রণাম জানবেন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  3. "তবু এই দেশ বিদেশ মানুষের আসা যাওয়া -এটা চলবেই – ক্রমশ এই পৃথিবী ছোট্ট গ্রামের মত হয়ে গেলে সব ভাষাই আমাদের ভাষা, সব দেশই আমাদের দেশ, পুরো পৃথিবীই একটা গ্রহ – এর বাইরে যেতে হলেও আমাদের এর মাটিতেই মিশতে হবে – আহা পৃথিবী ! আর কি অসম্ভব সুন্দর এই বেঁচে থাকা "!!

    -আসলেই;  "অসম্ভব সুন্দর এই বেঁচে থাকা"!

    দারুণ লিখেছেন!

     

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।