প্রথাগত কবিতাকে মুক্তি দিয়ে, কবিতার আধুনিকায়নের কারণেই কবিতাপ্রেমীদের কাছে তিরিশ দশকে বাংলা কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ খুব দ্রুত পরিচিতি লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ-মধুসূদনকে ছাড়া, বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশ, যিনি বিবর্তন-বিবর্ধন ঘটিয়েছেন বাংলা কবিতার। ২২ অক্টোবর আধুনিক বাংলা কাব্যের এই প্রাণপুরুষের মৃত্যুদিন।
জীবনানন্দ দাশের জন্ম বরিশাল শহরে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯। জীবনানন্দ দাশই লিখেছিলেন ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজতে যাই না আমি…।’ আজ থেকে বহু বছর আগে লিখেছেন কালজয়ী এবং সব সময়ের আধুনিক কবিতা ‘বনলতা সেন’। যা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক অন্যতম সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কবিতার জগৎকে যারা সমৃদ্ধ করে গেছেন জীবনানন্দ দাশ তাদের মধ্যে অন্যতম।
জীবনানন্দ দাশের পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল ঢাকার বিক্রমপুর পরগণার পদ্মাতীরবর্তী গুয়াপাড়ায়। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের ছোট সন্তান। তার ডাক নাম ছিল ‘মিলু’। ছোটবেলায় তিনি বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকতেন। তাকে চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য বাবা-মা নিয়ে যান লখনৌ, আগ্রা এবং গিরিধিতে। তার দাদা সর্বনান্দ দাশগুপ্ত বরিশালে বসতি স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন সে সময়ের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। ছিলেন ব্রহ্মসমাজের অনুসারী। তিনি তার নাম থেকে গুপ্ত উপাধি বাদ দেন। এর পর থেকে তার পরবর্তী বংশধররা দাশ উপাধি ব্যবহার করেন। জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যনানন্দ দাশ ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তিনি একজন ভালো প্রবন্ধকার এবং ‘ব্রহ্মবাদি’ সাময়িকীর প্রকাশক ছিলেন। মা কুসুম কুমারী দাশ কবিতা লিখতেন।
জীবনানন্দের বয়স যখন ৮ বছর তখন তাকে বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলে ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। ১৯১৫ সালে তিনি ওই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন প্রথম বিভাগ নিয়ে। এর পর কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৯ সালে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে তিনি অনার্স পাস করেন। ১৯২১ সালে এমএ পাস করেন দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে। একই সময় তিনি আইন পড়েন। ঠিক এ সময়ই তিনি কলিকাতা সিটি কলেজে কিছুদিন শিক্ষকতাও করেন। এর পর চলে আসেন বাগেরহাট পিসি কলেজে। সেখানে ভালো না লাগায় চলে যান দিল্লি। সেখানে যোগ দেন রামজোস কলেজে। সেখানে অধ্যাপনা করা অবস্থায় ছুটিতে বরিশাল আসেন। ১৯৩০ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন লাবণ্যপ্রভা গুপ্তের সঙ্গে। বিবাহের কারণে দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে দিল্লির ওই কলেজ থেকে তার চাকরি চলে যায়। এর পর তিনি যোগদান করেন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে। তার সময়ই ১৯৩৫ সালে ব্রজমোহন কলেজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফিলেশন লাভ করে। এ সময়ই তিনি তার বিখ্যাত সনেট কবিতা ‘বনলতা সেন’ রচনা করেন। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় নোয়াখালী এবং ত্রিপুরায় বহুলোক নিহত হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার পেশায় যোগ দেন। তিনি এ সময় রচনা করেন ‘হিন্দু-মুসলমান’ কবিতাটি। একই সময় তিনি ‘স্বরাজ’ নামের একটি পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।
জীবনানন্দ দাশের জীবদ্দশায় ২৬৯টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার প্রয়াণের পর আরো ১৬২টি কবিতা প্রকাশিত হয়। তিনি ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী। ভোরের নির্মল আকাশ, শিশির ভেজা ঘাস, ধানের ক্ষেতের উদ্দাম হাওয়ার মতন, নদীর চরের চিল ডাকা বিষণ্ন দুপুর- প্রকৃতির নানা বর্ণবৈচিত্র্য জীবনানন্দের কবিতায় ধরা দিত। ১৯৫৩ সালে তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৫৫-তে তার লেখা শ্রেষ্ঠ লেখা ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ মরণোত্তর আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়। ১৯৫৪ সালের ২০ অক্টোবর বিকেলে তিনি ট্রামের ধাক্কায় গুরুতরভাবে আহত হন এবং ২২ অক্টোবর তার মৃত্যু হয়।
জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ : ঝরা পালক (১৯২৭), ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২), মহান পৃথিবী (১৯৪৪), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪), রূপসী বংলা লেখা (১১৯৩৪-প্রকাশ ১৯৫৭)।, বেলা অবেলা (১৯৬১), সুদর্শনা (১৯৭৩), আলো পৃথিবী (১৯৮১), মনোবিহঙ্গ (১৯৭৯)।
উপন্যাস ও গল্প : পূর্ণিমা, কল্যাণী, চারজন, বিরাজ,সতীর্থ, বাঁশমতির উপাখ্যান, প্রীতিনিড়, কারু-বাসনা, মৃণাল। তার ছোটগল্প একান্ত কামনার বিলাস, সঙ্গ, নিসর্গ, রক্তমাংসহীন, জামরুলতলা, মেয়ে-মানুষ, পূর্ণিমা, নকলের খেলা, হাতের তাস, ছায়ানট, চাকরি নাই, উপেক্ষার শীত, বই, মহিষের শিং, বৃত্তের মত, সাধারণ মানুষ, পালিয়ে যেতে ইত্যাদি যথেষ্ট পাঠকপ্রিয়তা পায়। এছাড়াও জীবনানন্দ দাশ ইংরেজিতে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন।
বাংলা কবিতায় আগে বা পরেও আর কোনো কবিই জীবনানন্দের মতো এতটা প্রভাবসঞ্চারী হয়ে ওঠেননি। রবীন্দ্রনাথের কথা হয়তো অনেকেই বলবেন। সত্য বটে, রবীন্দ্রনাথ এককভাবে বাঙালির সংস্কৃতিকে যতটা প্রভাবিত করেছেন আর কোনো লেখকই তা করতে পারেননি। কিন্তু যদি কেবল কবিতার কথা ওঠে তাহলে রবীন্দ্রনাথ নন, বরং জীবনানন্দ দাশই সেই প্রবল ব্যক্তিত্ব যিনি কাব্যরুচির সম্মোহনী শক্তি দিয়ে আজকের প্রজন্মকেও মুগ্ধ করে রেখেছেন।
প্রথাগত কবিতাকে মুক্তি দিয়ে, কবিতার আধুনিকায়নের কারণেই কবিতাপ্রেমীদের কাছে তিরিশ দশকে বাংলা কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ। সুন্দর বলেছেন দিদি ভাই।
প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ এর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। কবি বেঁচে থাকুন হৃদয়ে।
জীবনানন্দ দাশ আমার প্রিয় কবি। সহস্র প্রণাম রাখি তাঁর জন্য।