শিবলিঙ্গ নিয়ে ভুল ধারনা দূর হোক


দূর হোক শিবলিঙ্গ নিয়ে মানুষের ভুল ধারনা।

আমরা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী বলে বর্তমানে এই উপমহাদেশে আমারা ‘হিন্দু’ নামে পরিচিত। তাই এদেশের কিছুকিছু মানুষ যখন-তখন বলে ফেলেন, চাড়াল, মালাউন, ডেডাইয়া, বিধর্মী। তার মানে হলো, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একরকম ঘৃণার চোখেই দেখা। দৈনন্দিন জীবন চলার মাঝে মুসলমান বন্ধুরাও অনেকসময় অনেক প্রশ্ন করে বসে থাকেন। কেউ কেউ প্রশ্ন করে সনাতন ধর্মের মানুষের মৃত্যু হলে পোড়ায় কেন? বারোমাসে তেরো পূজার নাম কী? ৩৩কোটি দেবতার নাম জানা আছে? লিঙ্গপূজা করা হয় কেন এবং কী কারণে করা হয়? এতো টাকাপয়সা খরচ করে মাটি দিয়ে মূর্তি বানিয়ে পূজা করে আবার ফেলে দেওয়া হয় কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার অনেকেই মনে করে থাকেন, হিন্দু ধর্ম হচ্ছে শুধু মূর্তিপূজা এবং হরিনাম সংকীর্তন করাই হিন্দু ধর্মের মূলমন্ত্র। যা নিত্যান্তই একটি ভুল ধারণা।

তবে এই সনাতন (পুরাতন বা প্রাচীন) ধর্মের ভিত্তি বৈদিক শাস্ত্রের কোথায়ও ‘হিন্দু’ শব্দটির উল্লেখ নেই। এই হিন্দু শব্দটি আধুনিক কালে (ঊনবিংশ শতাব্দীতে) সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হয়। বা কালক্রমে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সনাতন ধর্মকে ‘হিন্দু ধর্মে’ পরিণত করা হয়েছে বলে ধারনা করা হয়। ‘হিন্দু’ একটি নির্দিষ্ট জাতি! ‘হিন্দু ধর্ম’ বলতে বোঝায়, হিন্দু জাতির ধর্ম!

জানা যায় ‘হিন্দু’ শব্দের উৎপত্তি প্যারসিক শব্দ থেকে। প্রাচীন কালে নাকি প্যারসিক বলা হত ইরানিদের। হিনস্‌র ভাষায় ‘হিন্দু’ শব্দের অর্থ হল যিনি হিংসা করে না। অতএব যিনি হিংসা করে, তিনি হিন্দু হতে পারে না। অথচ এই হিংসা আর অহংকারে আজ সনাতন ধর্ম তথা হিন্দু ধর্মের অস্তিত্ব দাঁড়িয়েছে শূন্যের কোঠায়। হিংসা আর অহংকার করে বড়বড় পণ্ডিতরাও মানুষকে সঠিক তথ্য দেয় না। মন্দিরে থাকা পুরোহিতের কাছে কেউ ধর্ম বিষয়ে বুঝতে চাইলেও বোঝায় না। আবার নামকরা গুরুদেবরা থাকে শুধু মানুষকে মন্ত্র দিয়ে শিষ্য বানানোর ধান্ধায়ই থাকে ব্যস্ত। যত শিষ্য তত সুনাম, তত তার বাৎসরিক মুনাফা। অথচ ধর্ম বিষয়ে কেউ কিছু জানতে চাইলে গুরু, মহাগুরু, পুরোহিত আর পণ্ডিতেরা বলেন, “এখনো বোঝার জ্ঞান হয় নাই! গুরুর নাম নিতে হবে, তা হলেই আস্তে আস্তে বুঝতে পারবে।”

গুরু মহাগুরুদের এসব কথায় উপর বিশ্বাসী হয়ে সাধারণ মানুষ আর বিশেষ কোনও তথ্য ঘাঁটতে চায় না। গুরুদেবের কথার মাঝেই থেকে যায়। অজানা থেকে যায় ধর্মের তথ্য। তথ্য বা এর মূল ব্যাখ্যা না জানার করণে, আজ বেশিরভাগ মানুষই ‘হিন্দু ধর্ম’ বিষয়ে রয়ে গেছে অজ্ঞ। বৈদিক শাস্ত্রের কোথায়ও কোন জাতি, গোষ্ঠী, বর্ণ বা সমাজের ধর্ম হিসেবে সনাতন ধর্মকে অভিহিত করা হয়নি। অভিহিত করা হয়েছে মানব জাতির বা জৈব ধর্ম (জীবের ধর্ম) বা আর্য ধর্ম হিসেবে। আর এই ‘হিন্দু’ নামের কোনও শব্দ কোনও শাস্ত্রগ্রন্থে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাহলে এই হিন্দু শব্দটা আসলো কোথা থেকে? মূলত ‘আর্য’ ধর্মের পরিবর্তিত নাম হল ‘হিন্দু’ ধর্ম।

আর্য হিন্দুদের আদি-নিবাস ছিল, ইরানের ইউরাল পর্বতের পাদদেশের দক্ষিণে তৃণভূমি অঞ্চলের কিরঘিজিস্তান নামক স্থানে। কোনও একসময় আর্য জনগোষ্ঠী কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ/ ভূমিকম্প অথবা অন্য গোত্রদের আক্রমণের কারণে ইরান থেকে বিতাড়িত হয়। এরপর আর্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে অগ্রসর হয় এবংবর্তমান ভারতর্ষে বসতি স্থাপন করেন। আশ্রয় নেয় সিন্ধু নদীর পাড়ে, তখন তাদের পরিচয় ছিলো ‘সিন্ধু’ নামে। কিন্তু তখনকার সমর অনেকেই সিন্ধু শব্দ উচ্চারণ করতে পারতো না। উচ্চারণ হতো ‘স’ এর পরিবর্তে ‘হ’। তাই সিন্দুর বদলে বলতো হিন্দু। সে থেকেই আজ অবধি এই ‘হিন্দু’ নামেই বিশ্বের কাছে পরিচিত। তাই সেই প্রাচীনকাল থেকে আমরা বর্তমান হিন্দু ধর্মাবলম্বী সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। সে সাথে মূর্তিপূজা ও বিভিন্ন দেবদেবীর পূজার্চনায়ও বিশ্বাসী। আর প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা ৩৩কোটি দেবতাকেই আমরা কেউ-না-কেউ স্মরণ করে থাকি। তবে সংস্কৃতে কোটি শব্দের দুটি অর্থ, একটি হল ‘সর্বোচ্চ’ এবং অপরটি হল ‘কোটি’ (Crore)। বেদে তেত্রিশ কোটি (সংস্কৃত: ত্রয়স্তিমাশতি কোটি) দেবতা বলতে বেদে তেত্রিশ রকমের দেবতার কথা বলা হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য গ্রন্থে এটি পরিষ্কার ভাবে ব্যখ্যা করা হয়েছে। অথর্ব বেদের দশম অধ্যায় সপ্তম সুক্তের ত্রয়োদশ শ্লোকে বলা হয়েছে-
যস্য ত্রয়স্ত্রিংশদ্ দেবা অঙ্গে সর্বে সমাহিতাঃ।
স্কম্মং তং ব্রুহি কতমঃ স্বিদেব সঃ।।

অর্থাৎ, পরম ঈশ্বরের প্রভাবে এই তেত্রিশ জন দেবতা বিশ্বকে বজায় রেখেছে।

শুরুতে ঋক্ বেদে তিন (৩) রকমের দেবতার কথা বলা হয়েছিল। এনারা ছিলেন- অগ্নি, বায়ু এবং সূর্য্য। ঋক্ বেদে পরবর্তী অধ্যায়ে সেই দেবতার সংখ্যা বেড়ে তেত্রিশ (৩৩) রকমের হয়। এনাদের মধ্যে এগারো জন পৃথিবীতে, এগারো জন বায়ুতে এবং বাকি এগারো জন মহাকাশ বা অন্তরিক্ষে অবস্থান করছেন।

এই সনাতন ধর্মের প্রকৃত রূপ উন্মোচনের জন্য আমাদের কতকগুলি ধর্মগ্রন্থ আছে। যে ধর্মগ্রন্থগুলি পাঠ করা প্রত্যেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য আবশ্যক। ধর্মগ্রন্থগুলি হলো– ১। বেদ-৪টি (ঋকবেদ, সামবেদ, যর্জুবেদ, অথর্ববেদ) ২। উপনিষদ-১০৮টি ৩। গীতা-১টি (৭০০শ্লোক) ৪। ভাগবত-১টি (১৮,০০০শ্লোক) ৫। মহাভারত-১টি (৬০,০০০শ্লোক) ৬। পুরাণ-১৮টি ৭। রামায়ণ-১টি
৮। চৈতন্য চরিতামৃত-১টি
এই গ্রন্থগুলোর পাঠ করলে জানা যাবে সনাতন ধর্মের কলেবর কতো বিশাল আর জ্ঞানগভীর। তবে রামায়ন আর মহাভারতে বৈদিক যুগের ইতিহাস লিপিবদ্ধ। ধর্মের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পেতে আমাদের আশ্রয় নিতে হবে ভাগবতের। তবে উল্লেখিত প্রতিটি গ্রন্থই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয়ও বটে। তবে আমি আর্য/হিন্দু ধর্ম নিয়ে কোনও আলোচনা করছি না। আমি শুধু শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গ পূজা নিয়ে কিছু আলোচনা করতে চাই।

কথিত আছে আমাদের চারপাশ ঘিরে আছে তেত্রিশ কোটি দেবতা। আসলে কিন্তু ৩৩কোটি নয়, ৩৩ রকমের দেবতা। জানা নেই, ৩৩ রকমের দেবতার পূজার বিধানও। শুধু হাতেগোনা কিছুসংখ্যক দেবদেবীর পূজার্চনাই আমরা করে থাকি। এক কথায় যাকে বলে বারমাসে তেরো পূজা। তারমধ্যে একটি আলোচিত পূজার নাম হলো ‘লিঙ্গ’ পূজা। যে পূজা শুদ্ধভাবে বলা হয় ‘শিবলিঙ্গ’ পূজা বা শিবরাত্রি। আর ‘লিঙ্গ’ পূজা নামে যেই শব্দটি প্রচলিত, তা আসলে বিকৃত শব্দ। এই পূজাটি বছরে ১৬টি সোমবারে অনেকেই করে থাকে। তবে শিবের নামে যেই পূজাগুলো হয়ে থাকে, তা হলো ‘শিব পূজা’, শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গ পূজা।

শিবরাত্রি:
সব ব্রতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল এই মহাশিবরাত্রি। এই মহাশিবরাত্রি ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথিতে পালিত হয়। মহাশিবরাত্রি হল হিন্দুধর্মের সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবাদিদেব মহাদেব শিবের মহারাত্রি। ব্রত/পূজার আগের দিন ভক্তগণ নিরামিষ আহার করে। রাতে বিছানায় না শুয়ে মাটিতে শোয়া হয়। ব্রতের দিন তারা উপবাসী থাকে। তারপর রাত্রিবেলা চার প্রহরে শিবলিঙ্গকে দুধ, দই, ঘৃত, মধু ও গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করানো হয়। তারপর বেলপাতা, নীলকন্ঠ ফুল, ধুতুরা, আকন্দ, অপরাজিতা প্রভৃতি ফুল দিয়ে পূজা করা হয়। আর ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ নমঃ, এই মহামন্ত্র জপ করা হয়। ছোটবেলায় আমার মা-বোনদেরও এই শিবরাত্রি ব্রত করতে দেখেছি। শিবরাত্রি সবচেয়ে বেশি জাঁকজমকভাবে শিবরাত্রি উদযাপন করা হয়, হিন্দু রাষ্ট্র নেপালে।

এই নিয়ে দৈনন্দিন জীবন চলার মাঝে অনেক মুসলিম বন্ধুদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তারা অনেকে একে পুরুষাঙ্গের পূজা হিসেবে ব্যাখ্যা করে অশ্লীলতা বলে মনে করেন। তা একেবারেই ভুল ধারণা আর এটা একরকম তাদের মনগড়া কথাই বলা চলে। অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও এর মূল তথ্য জানে না। না জানার করণেই, প্রশ্নকারীর প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে না। তখন প্রশ্নকারী নিজেই এর ভুল ব্যাখ্যা দিতে থাকেন। আর উত্তরদাতা উত্তর না দিতে পেরে লজ্জায় বরফ হয়ে যায়। আসলে এখানে কোনও অশ্লীলতার ছোঁয়া নেই, লজ্জার কোনও ব্যাপারও নেই। আছে শুধু অনেককিছু দেখার ও বোঝার। হিন্দু ধর্মে শিবকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বলে মনে করা হয়। কাজেই তার শিবলিঙ্গ যে দেবতা শিবের প্রতীকী পূজা, তা বোঝা প্রয়োজন।

শিবলিঙ্গ:
শিব কথার অর্থ, সত্য, সুন্দর ও মঙ্গল। আর লিঙ্গ কথার অর্থ, প্রতীক। এ হলো হিন্দুদের দেবতা শিবের একটি সত্যে ও মঙ্গলের প্রতীক চিহ্ন। শিবকে এই প্রতীকের সাহায্যেই প্রকাশ করা হয়। শিব থাকেন ব্রহ্মের ধ্যানে লীন, আর সব মানুষকেও ব্রহ্মের প্রতি ধ্যানমগ্ন হতে উপদেশ দেন। শিব লিঙ্গের উপরে ৩টি সাদা দাগ থাকে যা শিবের কপালে থাকে। তাই শিবলিঙ্গ যদি কোন যৌনইন্দ্রিয় বুঝাত, তা হলে শিবলিঙ্গের উপরে ঐ ৩টি সাদা তিলক রেখা থাকত না। এখানেও অনেকের অনেককিছু বোঝাবার প্রয়োজন বলে মনে করি।

শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গের পূজা হিন্দুদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। যেসব শিব মন্দিরে শিবলিঙ্গের মূর্তি তৈরি করা আছে, সেসব মন্দিরে পূজা হয়। এই পূজাটির প্রচলন বহু প্রাচীন যুগ থেকেই ভারত-সহ বাংলাদেশেও প্রচলিত রয়েছে। আর এই শিবলিঙ্গ পূজার রীতি সম্পর্কেও রয়েছে অনেক ভুল ধারণা। অনেক মানুষ সোজা কথায় বলে ফেলে লিঙ্গ পুজা। আসলে এটি লিঙ্গ পূজা নয়, এটি দেবতা শিবের প্রতীকী পূজা বা শিবরাত্রি পূজা। এই শিবরাত্রিতে শিবলিঙ্গে জল, দুধ, ঢালা হয় বলে অনেকে ভুল বুজে নানা কুৎসা রটায়।

গুণীজনরা শিবলিঙ্গকে মোট তিনভাগে ভাগ করে এর আলাদা আলাদা নামও দিয়েছে।
১। সবচেয়ে নীচের চারমুখী অংশটি থাকে মাটির নীচে।
২। মাঝখানের অংশটি আটমুখী, যা বেদীমূল হিসেবে কাজ করে।
৩। উপরের অর্ধবৃত্তাকার অংশটি পূজিত হয়।

এই তিনটি অংশের সবচেয়ে নীচের অংশটি ব্রহ্মা, তার উপরের অংশটি বিষ্ণু ও একেবারে উপরের অংশটি শিবের প্রতীকী চিহ্ন। বেদীমূলে একটি লম্বাকৃতি অংশ রাখা হয়, যা শিবলিঙ্গের মাথায় ঢালা জল বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে। এই অংশের নাম গৌরীপট্ট, যা মূলত যোনিপ্রতীক। যেই পথ অনুসরণ করে পৃথিবীতে আসেছি আমরা সবাই। আসেছে মুনি মহামুনিগণ, আসেছে রাজা বাদশা আর ফকির সাধু গুরু মহাগুরুও। শিবলিঙ্গ পূজার মধ্যে কোনও অশ্লীলতা নেই। শিবলিঙ্গ একই সঙ্গে শিবের সৃজনাত্মক ও ধ্বংসাত্মক রূপের প্রতীক। শিবলিঙ্গ ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক আর সত্যের প্রতীক। শিবলিঙ্গ যেহেতু ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক, সেহেতু ‘লিঙ্গ’ শব্দটির অর্থ কিন্তু পুরুষাঙ্গ নয়, বরং একটা প্রতীকী চিহ্ন মাত্র।

সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা প্রচলিত বিশ্বাস হল এই যে, এই শিব লিঙ্গ পূজা শুধু অবিবাহিত মেয়েরাই করে থাকে। কিন্তু না, অবিবাহিত আর বিবাহিত মেয়েরা শিবলিঙ্গের কাছে যাওয়াও অনুচিত। কারণ, মেয়েদের শরীর সবসময় পবিত্র থাকে না, তাই। আবার নারীই পুরুষের ধ্যানভঙ্গের প্রধান কারণ বলে বিবেচিত। কুমারী নারীর সান্নিধ্যে পুরুষের চিত্তবিচলন ঘটার সম্ভাবনা আরও বেশি। সেই পুরুষ সাধু হলেও নিয়ম অন্যরকম নয়। কাজেই শিবের কাছাকাছি যাওয়ার ব্যাপারে কুমারী মেয়েদের কিছু বিধিনিষেধ আছে।

আর যেসব জায়গায় বসে দেবতা শিব ধ্যান জপতেন, সেই জায়গাগুলি ছিল অত্যন্ত পবিত্র। শিবের ধ্যানক্ষেত্রের আশেপাশে স্বয়ং দেবতাদেরও প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কারণ, সকলকেই খেয়াল রাখতে হত, শিবের ধ্যানে যাতে কোনওভাবে বিঘ্ন না ঘটে। শিবের ধ্যানে কোনওরকম বাধা পড়লেই শিব অসন্তুষ্ট হবেন। আর শিব একবার অসন্তুষ্ট হলে মহাবিপদ। এমনিতেই শিব হলেন, ধ্বংসলীলার দেবতা, তিনি অসন্তুষ্ট হলে মুহূর্তেই ধ্বংসলীলায় পতিত হবে পৃথিবী।

তাই বলে কি মেয়েদের শিব পূজায় কোনও নিষেধাজ্ঞা আছে? না। এখনো ভারতসহ বাংলাদেশের বহু কু‌মারী মেয়েরা দেবতা শিবের পূজা করে। তারা শিবরাত্রি/শিবলিঙ্গকে অনুস্মরণ করে ১৬টি সোমবারে ব্রত করে থাকেন। ফাল্গুন মাসের শিবরাত্রি ছাড়াও এই শিবের পূজা মেয়েরা বারোমাসই করে। শিবের ব্রত করার সময় মেয়েরা উপবাস রাখেন। পণ্ডিতরা বলেছেন, শ্রাবণ মাসে এই ব্রত রাখলে নাকি বিশেষ উপকার পাওয়া যায়। বিবাহিত মেয়েরা শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গ পূজা করে স্বামীর সুখ আর আয়ু বৃদ্ধির জন্য। আর অবিবাহিত মেয়েরা পূজা করে তার জীবনে একটা শক্তিমান ও আদর্শবান পুরুষ আসার কামনায়। পৃথিবীর সব ধর্মের অবিবাহিত মেয়েরাই চায়, তার জীবনে একজন সৎ এবং আদর্শবান পুরুষ আসুক। তাই সারা দুনিয়ার হিন্দু ধর্মের অবিবাহিত মেয়েরা শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গ ব্রত/পূজা করে। আগে এবং বর্তমানেও শিবলিঙ্গের পূজা সারা ভারত-সহ বাংলাদেশেও জনপ্রিয়। শুদ্ধ পঞ্জিকা মতে প্রতিবছর নির্ধারিত দিনে শিবরাত্রি / শিবলিঙ্গের পূজা করা হয়।

আমি ১৪০০ বাংলা সনের প্রথম দিকে একবার ভারতে গিয়েছিলাম। সেখানে অবস্থান করেছিলাম প্রায় বছর দেড়েকেরও বেশি। সেখানে থাকা অবস্থায় দেখেছি সেখানকার শিবরাত্রি উদযাপনের দৃশ্য। সেখানকার মানুষের মুখে শুনেছি, দিল্লি, চেন্নাই, হরিয়ানায় খুবই জাঁকজমকভাবে এই দিবসটি পালিত হয়। শিবের পূজার দিনে মেয়েরা পু‌রুষদের সাহায্যকারী হিসেবেও কাজ করেন‌। যেমন, ধোয়ামোছা, শঙ্খ বাজানো, উলুধ্বনি দেওয়া।
আবার আমাদের দেশেও দেখা যায়, মেয়েরা স্নানের পর, শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢেলে ভক্তি দেয়। মেয়েদের শিবভক্তির নানা উল্লেখ রয়েছে শিব পুরাণেও। শিবকে সন্তুষ্ট করতে পারলে নাকি মেয়েরা শিবের মতোই শক্তিমান ও আদর্শবান স্বামী লাভ করেন।

পরিশেষে:
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে হাতে-হাতে মোবাইল ফোন। থাকে ইন্টারনেট সংযোগের সুবিধা। আর ইন্টারনেট মানে হলো সারা দুনিয়া ভ্রমণ করা। ইন্টারনেট মানে হলো তথ্যের ভাণ্ডার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। তথ্য সংগ্রহ করা মানে না জানা অনেককিছু জানা। এই ইন্টারনেট গুগল-এ অথবা ইয়াহুতে সার্চ করলেই পৃথিবীর সবকিছুই সহজে জানা যায়, দেখা যায়। তবু আমরা সঠিক তথ্যের দিকে না তাকিয়ে মনগড়া কথা বলে বিভ্রান্তি ছড়াই। সৃষ্টি করে তুলি দাঙ্গাহাঙ্গামা, ছোট করি একে অপরের ধর্মকে। তাই সবশেষে আবারও বলছি, হুন্দু ধর্মে বা আর্য ধর্মে একক শব্দ ‘লিঙ্গ’ পূজার কোনও অস্তিত্ব নেই। আছে ‘শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গ’ ব্রত/পূজা।

অথচ এমন একটা সত্যকে আড়ালে রেখে, কিছু মানুষ এই পূজাকে নানাভাবে কলঙ্কিত করছে। দিচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন বানোয়াট তথ্য, রটাচ্ছে অকথ্য কথ।বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলে সার্চ করলেই দেখা যায়, এই পূজা বিষয়ে নানাধরনের কথা। দেখা যায় বর্তমান যুগের স্বাদের ফেসবুক পেইজেও। যাই হোক কেউ জেনেও নিন্দা করে, আবার কেউ না জেনে না শুনেও নিন্দায়। আসল ঘটনায় খুব কম মানুষেই তাকায়। আশা করি মহান সৃষ্টিকর্তা সবাইকে বোঝবার শক্তি দান করবেন। তার দয়ায় দূর হবে শিবলিঙ্গ নিয়ে মানুষের ভুল ধারনা। সবাই বুঝবে যেখানে সত্য, সেখানেই শিব। যেখানে শিব, সেখানেই সুন্দর। যেখানে সত্যের প্রতীক, সেখানেই ‘শিবলিঙ্গ’।
সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্

লেখার বিস্তারিত হিন্দু ধর্মবিষয়ক তথ্য বিভিন্ন অনলাইন সাইট এবং শিব পুরাণ থেকে সংগৃহীত।
ছবি ইন্টারনেট থেকে।

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

12 thoughts on “শিবলিঙ্গ নিয়ে ভুল ধারনা দূর হোক

  1. আমার ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন বলা ঠিক হবে না, ঝাপসা ঝাপসা কিছু অনুমান ছিলো যা  আপনার আজকের আলোচ্য নিবন্ধের বিষয়। আলোচনাটি এতোটাই বিশদ এসেছে যে, গুগলে গিয়ে বিভ্রান্ত হবার চাইতে এখানে নিজেকে নিরাপদ মনে করলাম। আমিও আপনার কণ্ঠের সাথে স্বকণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই … সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্। :)

    1. শ্রদ্ধেয় কবি দাদা, এসব বিষয় নিয়ে সনাতন ধর্মের অনেক মানুষকেই প্রতিনিয়ত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় বলেই, স্বনামধন্য বাংলাব্লগ শব্দনীড়ে আমার আজকের এই আয়োজন। আশা শিবলিঙ্গ নিয়ে অনেকের মন থেকে ভুল ধারনাটা ক্লিয়ার ক্লিয়ার হয়ে, সঠিক ধারনাটা হৃদয়ে ভর করবে। সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্।

  2. বিশদ ভাবে লেখাটির প্রতি মনযোগ দিয়ে পাঠকের সাথে সদাচরণ করেছেন নিতাই দা। আপনাকে তো ধন্যবাদ জানাবই; তারচেয়ে বেশী দেবো শব্দনীড়কে।

    শব্দনীড় লেখাটিকে বিশেষ নির্বাচন করেছে। সকল ধর্মের প্রতি তাদের উদারতা আমার ভাল লাগে। সঠিক মডারেটরদের জানাই আমাদের শ্রদ্ধা। দীর্ঘায়ূ হোক শব্দনীড়। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    1. শ্রদ্ধেয় রিয়া দিদি আমিও আপনার সাথে স্ব-কণ্ঠ মিলিয়ে এই স্বনামধন্য বাংলাব্লগ শব্দনীড়ের দীর্ঘায়ু কামনা করছি। সাথে আপনি সহ ব্লগের সমস্ত লেখক/লেখিকা ও আমার প্রিয় পাঠকদের মঙ্গল কামনা করছি। আশা করি মানুষের মন থেকে শিবলিঙ্গ বিষয়ে ভুল ধারনা দূর হবে। সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্

  3. চমৎকার উপস্থাপন নিতাই দা। আপনার জন্য শুভকামনা।

    1. আপনার জন্যও শুভকামনা সারাক্ষণ শ্রদ্ধেয় সৌমিত্র দাদা। আশা করি ভালো থাকবেন।

  4. ধন্যবাদ নিতাই'দা। বিষয়টি আমার কাছেও স্পষ্ট ছিলনা। আজ সম্পূর্ণভাবে জানলাম। নিতাই'দার কাছে অনুরোধ এভাবে অনেকের কাছে যা অস্পস্ট সেসব বিষয় তুলে ধরবেন। এতে করে ভ্রান্তি দূর হবে।   

    1. সুন্দর মন্তব্যের জন্য শ্রদ্ধেয় খালিদ দাদাকে আমার পক্ষ থেকে জানাই সহস্র কোটি নমস্কার। আশা করি এই স্বনামধন্য বাংলাব্লগ শব্দনীড়ে আরও বেশি করে হিন্দু ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতে পারবো । সেইজন্য চাই আপনাদের আন্তরিক আন্তরিকতা আর গ্রহণযোগ্যতা। 

      ব্লগের সমস্ত লেখক/লেখিকা সহ সম্মানিত পাঠকবৃন্দ যদি আমার লেখা স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করে, তো আমি অধম যথাযথ চেষ্টা করে যাবো । আপনার জন্য শুভকামনা রইল শ্রদ্ধেয় খালিদ দাদা। আশা করি ভালো থাকবেন।

  5. সিন্ধ সভ্যতা আমার কাছে এক অপার বিস্ময়! যতোটা অবশিষ্ট আছে সেগুলির কিছুটা আমি প্রত্যক্ষ করে অভিভূত হয়েছি। অনেক কিছু কেবলি ইতিহাস; কিন্তু জানলে অবাক হতে হয়। আপনার লেখা থেকেও কিছুটা জানলাম এবং অভিভূত হলাম।

    আপনার লেখার মূল বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়ে অধিকাংশ লোকের ধারণা পরিষ্কার নয়।লেখাটা পাঠককে তথ্য সমৃদ্ধ করবে।   

    1. আপনার মতো আমিও সেই আশাই করছি শ্রদ্ধেয় ডেজারট দাদা। আশা করি আমার এই নগণ্য লেখা পড়ে অনেকের মন থেকে শিবলিঙ্গ বিষয়ে ভুল ধারনা দূর হবে। সেইসাথে আপনার জন্য রইল শুভকামনা সারাক্ষণ ।

  6. * দূর হোক ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক মনোভাব …

    শুভ কামনা লেখকের জন্য।

    1. শুভকামনা রইল শ্রদ্ধেয় দিলওয়ার দাদা। আশা করি মানুষের মন থেকে শিবলিঙ্গ নিয়ে ভুল ধারনা দূর হবে। সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্। জয় হোক মানবতার।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।