ট্যাগ আর্কাইভঃ হিন্দু ধর্ম

মহা শিবরাত্রি

ত্রিলোকের কর্তা তুমি
ভোলা মহেশ্বর,
তুমি আছো পৃথ্বী মাঝে
হয়ে যে ঈশ্বর।

ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব নিয়ে
ত্রিদেবতা জানি,
তুমি তো সবার গুরু
ইহলোকে মানি।

মরা গাছে ফুল ফোঁটে
তোমার নজরে,
জন্ম-মৃত্যু তব কর্ম
শংকর ভজরে।

শিব পুরানের মতে-
এই শিব রাত্রি,
প্রলয়ের নৃত্য আর
বিয়ে হর-গৌরী।

ইসলাম ধর্ম ও সনাতন (হিন্দু) ধর্ম – পর্ব শেষ

প্রথম পর্ব পড়ে না থাকলে এইখানে ক্লিক করুন, ২য় পর্ব পড়ে না থাকলে এইখানে ক্লিক করুন,

যে ধর্ম মানবসমাজে শান্তি দিতে পারে না, সেটা প্রকৃত ধর্ম নয়, সেটা ধর্মের লাশ। আজ সারা বিশ্বে যে ধর্মগুলি চালু আছে সেগুলোকে প্রাণহীন লাশ বানিয়ে রাখা হয়েছে এবং সেই লাশকে নিয়েই ব্যবসা করছেন কথিত আলেম ও পুরোহিত গোষ্ঠী। মানুষের পেটে যখন ভাত নেই, উপাসনালয় থেকেও যখন জুতা চুরি হয়, যেখানে চার বছরের শিশুও ধর্ষিত হয় তখন সেই অন্যায় অবিচার বন্ধ না করে, তার ন্যূনতম প্রতিবাদও না করে যারা মসজিদে-মক্কায় গিয়ে মনে করছেন আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট, মন্দিরে গিয়ে দুধ-কলা দিয়ে, গয়া-কাশিতে গিয়ে মনে করছেন দেবতা বুঝি স্বর্গ থেকে তাদের উপর পুষ্পবৃষ্টি করছেন, তারা ঘোর ভ্রান্তির মধ্যে আছেন। চলমান …

পর্ব তিন শুরু…

আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ, কোন মানুষের ঈমান সঠিক হতে পারবে না যতক্ষণ না সে সৎ ও বিশ্বাসী হয়। আমি তোমাদেরকে হেদায়েত করছি যে তোমরা কোন ব্যক্তির অধিক নামাজ ও অধিক রোজা দেখে ভুল করো না, বরং লক্ষ্য করো সে যখন কথা বলে সত্য বলে কি না, তার কাছে রাখা আমানত বিশ্বস্ততার সাথে ফিরিয়ে দেয় কিনা এবং নিজের পরিবার পরিজনের জন্য হালাল উপায়ে রোজগার করে কিনা।’ (সিরাত বিশ্বকোষ – ইসলামিক ফাউন্ডেশন)।

একই শিক্ষার প্রতিধ্বনী করে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “কেহ ধার্মিক কি অধার্মিক পরীক্ষা করিতে হইলে দেখিতে হইবে, সে ব্যক্তি কতদূর নিঃস্বার্থ। যে অধিক নিঃস্বার্থ সে অধিক ধার্মিক। সে পণ্ডিতই হউক, মূর্খই হউক, সে শিবের বিষয় জানুক বা না জানুক সে অপর ব্যক্তি অপেক্ষা শিবের অধিকতর নিকটবর্তী। আর যদি কেহ স্বার্থপর হয়, সে যদি পৃথিবীতে যত দেবমন্দির আছে, সব দেখিয়া থাকে, সব তীর্থ দর্শন করিয়া থকে, সে যদি চিতা বাঘের মতো সাজিয়া বসিয়া থাকে, তাহা হইলেও সে শিব হইতে অনেক দূরে অবস্থিত (রামেশ্বর-মন্দিরে প্রদত্ত বক্তৃতা)।

আমাদের এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বলতে কিছু ছিল না। ব্রিটিশদের শাসনযুগের আগে এখানে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা একটিও হয় নি। হ্যাঁ, রাজনৈতিক সংঘাত অনেক হয়েছে, তবে সাম্প্রদায়িক সংঘাত একটাও নয়। ব্রিটিশ বেনিয়ারা ভারত দখল করার পরই চালিয়ে দিল Divide and rule নীতি। তারা হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য আলাদা স্কুল-কলেজ বানালো, আলাদা রাজনৈতিক দল বানালো, আলাদা হোটেল বানালো, কলেজে আলাদা হোস্টেল বানালো। তারা হিন্দুদেরকে শেখালো মুসলিমরা বিদেশী আগ্রাসনকারী জাতি, তারা এ মাটির সন্তান নয়। এতদিন যে দেশে হিন্দু মুসলিম শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করেছে, একই বাজারে সদাই করেছে, একই পুকুরের পানি খেয়েছে, হিন্দু ডাক্তার মুসলমান রোগীর চিকিৎসা করেছে, মুসলমানদের চাষ করা ফসল হিন্দুরা খেয়েছে সেই দেশেই সৃষ্টি হলো জাতিগত দাঙ্গার। রায়টে লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমানের লাশ পড়ল, বাড়ি পুড়ল, উদ্বাস্তু হলো। শেষতক এক দেশে থাকাও তাদের পক্ষে সম্ভব হলো না, তারা দুই জাতির জন্য দেশ ভাগ করে ফেলল। এ সবই হলো ব্রিটিশদের কূটবুদ্ধির ফল। আজ হিন্দুদের উগ্রবাদী একটি গোষ্ঠী ইসলাম ধর্মের মহামানবদেরকে, কেতাবকে গালি দেয়, মুসলমানদের উগ্রবাদী ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী হিন্দুদের উপাস্যদেরকে, অবতারগণকে গালি দেয়। তাদের এই পারস্পরিক বিদ্বেষ সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষের মধ্যে ছড়ায়। তখন সৃষ্টি হয় দাঙ্গা। এই দাঙ্গার পরিণতি কী তা ভারতবাসী গত দেড়শ বছরে প্রত্যক্ষ করেছে, সেটা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। ব্রিটিশরা এভাবে দুই ভাইকে শত্রুতে পরিণত করে দিয়ে গেছে। এইসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে ধান্ধাবাজ রাজনৈতিক গোষ্ঠী কীভাবে কাজে লাগায় সে তথ্যও সকলের জানা।

কিন্তু এই শত্রুতা আর কতদিন? এখনও কি সময় হয় নি শত্রুতা ভুলে নিজেদের সত্যিকার পরিচয়কে স্বীকৃতি দিয়ে আবার ভাই ভাই হয়ে যাওয়ার? এটা করার জন্য প্রয়োজন কেবল মানসিকতার পরিবর্তনের, প্রয়োজন সত্য সম্পর্কে জানার। আমরা এই দুটো জাতির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছি, তাদের উভয়ের ধর্মের মূল সত্য যে এক সেটাকে উভয়ের ধর্মগ্রন্থ থেকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমরা বলছি, ধর্ম কোনো আচার অনুষ্ঠানের নাম নয়, ধর্ম হচ্ছে একটি বৈশিষ্ট যা কোনো বস্তু ধারণ করে। আগুনের ধর্ম হলো পোড়ানো, পানির ধর্ম ভেজানো, চুম্বকের ধর্ম আকর্ষণ করা। আগুন যদি না পোড়ায়, পানি যদি না ভেজায়, চুম্বক যদি না টানে তাহলে সে তার ধর্ম হারালো। তেমনি মানুষের প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে মানবতা। এই মানবতাবোধে মানুষকে জাগ্রত করার জন্যই নবী-রসুল-অবতারগণ যুগে যুগে আবির্ভূত হয়েছেন। তারা সত্য নিয়ে এসেছেন, যারা সেই সত্যকে ধারণ করেছেন তারাই হয়েছে ধার্মিক। যদি মানুষ সত্যকেই ধারণ না করে, মানবতাবোধে পূর্ণ না হয়, সে যতই উপাসনা করুক সে ধর্মহীন। ইসলামের একটি নাম হচ্ছে দীনুল হক যার অর্থ সত্য জীবনব্যবস্থা। যে জীবনব্যবস্থা মানবজাতিকে সত্যে পূর্ণ করবে সেটাই তো প্রকৃত ধর্ম। শেষ নবী আরবে এসেছেন, তাই কোর’আনও এসেছে আরবিতে। কিন্তু ভারতবর্ষের অবতারগণ কথা বলেছেন সংস্কৃতিতে বা এ অঞ্চলের কোনো ভাষায়। তাঁদের উপর যে শাস্ত্রবাণী এসেছে সেগুলো এ অঞ্চলের মানুষের ব্যবহৃত ভাষাতেই এসেছে। ভাষার পার্থক্য থাকলেও সত্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। খালের পানি, নদীর পানি, সাগরের পানি, বৃষ্টির পানি সব পানিরই আণবিক গঠন অভিন্ন।

মুসলমানেরা যদি মনে করে আরবভূমি তাদের, হিন্দুরা যদি মনে করে ভারত কেবল তাদের, খ্রিষ্টানরা যদি মনে করে ইউরোপ শুধু তাদের, ইহুদিরা যদি মনে করে ফিলিস্তিন কেবল তাদের, বৌদ্ধরা যদি মনে করে মিয়ানমার কেবল তাদের তাহলে সেটা হবে চরম মূর্খতা। কারণ পৃথিবী আল্লাহর, সমস্ত ভূমি আল্লাহর। মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, মাটিতেই আবার তাকে ফিরে যেতে হবে। তাই এই মাটির উপর অধিকার রয়েছে প্রত্যেক বনি আদমের। কোর’আন মোতাবেক মাটির মানুষের ভিতরে আল্লাহর রূহ রয়েছে (সুরা হিজর -৯)। সনাতন ধর্মমতে প্রতিটি মানুষের মধ্যেই পরমাত্মার অংশ রয়েছে। প্রতিটি মানুষ স্রষ্টার প্রতিভূ। সেই মানুষের অধিকারকে অস্বীকার করে কেউ আল্লাহর, পরমাত্মার, ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে পারবে না।

একই ভাবে খ্রিষ্টধর্ম, ইহুদিধর্ম, জরোথুস্ত্রীয় ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্মও একই স্রষ্টা থেকে আগত, যদিও তাদের ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাকে বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। এদের সকলকেই তাদের স্ব স্ব ধর্মগ্রন্থের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করে এক মহাজাতিতে পরিণত করা সম্ভব। সেটা কীভাবে তা পরবর্তী কোনো এক সময় আলোচনা করার ইচ্ছা রইল। তবে সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে একটা কথা উপলব্ধি করতে হবে যে, আল্লাহ, ঈশ্বর, গড, এলি, ভগবান, পরমব্রহ্ম চান মানবজাতির ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব। আর ইবলিস, শয়তান, এভিল স্পিরিট, ডেভিল, লুসিফার, আসুরিক শক্তি চায় মানুষে মানুষে অনৈক্য, শত্রুতা, বিদ্বেষ। প্রকৃত যারা ধার্মিক তারা বিশ্বাস করেন, আল্লাহর এই চাওয়াকে পূরণ করাই হলো ধর্ম।

এত কথা, এত লেখার উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য পরিষ্কার, তা হলো এই- এ অঞ্চলে অন্তত মধ্যপ্রাচ্যের মতো জঙ্গিবাদী তা-ব সেভাবে এখনও বিস্তার লাভ করে নি, তবে সেই ষড়যন্ত্র চলছে। আর এই তা-বকে রুখে দিতে হলে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে পরস্পরের দিকে ঐক্যের হাত প্রসারিত করতে হবে। কেবল ঈদের দিনে মুসলমানে মুসলমানে কোলাকুলি আর পূজার দিনে হিন্দুতে হিন্দুতে আলিঙ্গন করলে হবে না। তাদের উভয়ের সঙ্গে উভয়েরই কোলাকুলি ও আলিঙ্গন করতে হবে। এতে কারো জাত যাবে না। এজন্যই নজরুল লিখেছিলেন,

ছুঁলেই তোর জাত যাবে?
জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।

সমস্ত বনি আদমকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রাণের তাগিদে, সেই তীব্র আকুতি নিয়ে দেশজুড়ে সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি স্থাপনের লক্ষ্যে আমরা হাজার হাজার সভা-সমাবেশ, সেমিনার, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন, সর্বধর্মীয় সম্মেলন করেছি। ধর্মব্যবসায়ীদের ফতোয়াবাজি, নিন্দাবাদ, অপপ্রচার আর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, শত নির্যাতন সহ্য করে, নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে আমরা এই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। আমাকে এজন্য ভয়াবহ মাশুল দিয়ে হয়েছে। আমার নিজ বাড়িতে বহুবার হামলা চালানো হয়েছে, বাড়ি ঘর আগুনে ভস্মীভূত করে ফেলা হয়েছে, সবকিছু লুটপাট করা হয়েছে, আমাদের দুই ভাইকে গরু জবাই করা ছুরি দিয়ে জবাই করেছে ধর্মব্যবসায়ীদের অনুসারীরা। হামলা হয়েছে হেযবুত তওহীদের আরো বহু সদস্য-সদস্যার উপরও। জানি না কবে আমরা ধর্মের নামে দাঁড়িয়ে থাকা অধর্মের এই প্রাচীরকে ভাঙতে পারবো, তবে এটা জানি সত্যের মোহনায় একদিন সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণের মানুষ এসে মিলিত হবেই হবে ইনশাল্লাহ। সেদিন পরাজিত হবে ইবলিস শয়তান, সেদিন আল্লাহর বিজয় হবে। আল্লাহর বিজয় মানেই মানবতার বিজয়।

ইসলাম ধর্ম ও সনাতন (হিন্দু) ধর্ম – পর্ব এক

এ কথা সকল তথ্যাভিজ্ঞ মানুষই স্বীকার করবেন যে, বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখন ধর্ম এক নম্বর ইস্যু। পাঁচ শতাব্দী আগে ইউরোপে বস্তুবাদী ধর্মহীন একটি সভ্যতার উন্মেষ ঘটে এবং পরবর্তী সময়ে তারা যখন বিশ্বের নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয় তখন তাদের তৈরি ব্যবস্থাগুলোকে দুনিয়াজুড়ে পরীক্ষা করে দেখা হয়। বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে চর্চিত বস্তুবাদী ধর্মহীন পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা’র প্রভাবে পৃথিবীর মানুষ এখন এতটাই মানবতাবোধহীন, আত্মাহীন, জড়বাদী, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিকে পরিণত হয়েছে যে সকল চিন্তাশীল, সাহিত্যিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীই এখন একবাক্যে স্বীকার করছেন যে, যদিও ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি ও পৈশাচিকতা রুখতে ধর্মকে বাদ দিয়েই জাতীয় জীবন পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত ইউরোপে গৃহীত হয়েছিল কিন্তু সেটার ফল আশানুরূপ হয় নি, মানুষ শান্তি পায় নি। যেটা পেয়েছে সেটা হলো যান্ত্রিক প্রগতি (Technological advancement)। তারা দেখতে পাচ্ছেন যে, বাস্তবে কোথাও ধর্মকে বাদ দেওয়া সম্ভব হয় নি। শত সহস্র বছর থেকে মানুষের মনে লালিত ধর্মবিশ্বাস দূর করা যায় নি। এ কারণে তারা নীতি পাল্টিয়ে ধর্মকে ব্যক্তিগত উপাসনার সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ করে। কিন্তু একটা পর্যায়ে রাষ্ট্র যখন কল্যাণ রাষ্ট্র (Welfare state) উপাধি ধারণ করে ব্যাপকভাবে জনসম্পৃক্ত হওয়া শুরু করল, মানুষও রাষ্ট্রের নানা কাজে অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পেল, তখন সেই ধর্মবিশ্বাস আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে গণ্ডিবদ্ধ থাকে নি। নানা ইস্যুতে, নানা প্রেক্ষাপটে, ঘটনাপ্রবাহের নানা বাঁকে সেই ধর্মবিশ্বাস রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই ধর্মব্যবসায়ী একটি গোষ্ঠী নানা ইস্যুতে মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি সৃষ্টি করেছে। তখন রাষ্ট্রকে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। ধর্ম দিনশেষে ব্যক্তিগত গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে নি। এখন মধ্যপ্রাচ্যের দখলদারিত্ব নিয়ে এবং জঙ্গিবাদের উত্থানের ইস্যুকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে মানবজাতি। এ পরিস্থিতিতে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ধর্ম এখন বিশ্বরাজনীতির এক নম্বর ইস্যু। ইউরোপে ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সেখানকার সেক্যুলার দলগুলো রাজনীতির মাঠ দখল করেছিল সেই মাঠ এখন ডানপন্থী খ্রিস্টান প্রভাবাধীন দলগুলোর হাতে চলে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নী ইস্যুতে এবং জঙ্গিবাদ ইস্যুতে যুদ্ধ চলছে তো চলছেই। সেখানে বিশ্বের বড় বড় পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো জড়িত হয়ে গেছে। আর এই ভারত উপমহাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর ক্রমশ উত্থান কীভাবে রাজনীতির অঙ্গনে কলকাঠি নাড়ছে সেটা সবাই জানেন।

ঔপনিবেশিক যুগ থেকে ভারতবর্ষেও চেষ্টা করা হয়েছে ধর্মকে জাতীয় জীবন থেকে বাদ দিয়ে দেওয়ার। ব্রিটিশ যুগের পূর্বে এ অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমান এই দুটো ধর্মের অনুসারীই ছিল সংখ্যাগুরু। তার আগে বৌদ্ধরা ছিল বড় জনগোষ্ঠী। মুসলমানদের আগমনের পর কোটি কোটি ভারতবাসী ইসলামের শৃঙ্খলা, ন্যায়, সুবিচার, সাম্য ও উন্নত আদর্শের পরিচয় পেয়ে মুসলিম হয়। এখনও হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ এই পাক-ভারত উপমহাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বর্তমান বাস্তবতায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যগঠন করা, দীর্ঘদিন ধরে বিরাজিত তাদের পারস্পরিক মনোমালিন্য ও মানসিক দূরত্ব দূর করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতে ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা নির্যাতন চালিয়ে প্রায়ই নির্মমভাবে ধর্মীয় উগ্রতার প্রকাশ ঘটাচ্ছে। এখানে করা হচ্ছে হিন্দুদের উপর আর ভারতে করা হচ্ছে মুসলমানদের উপর।

এই দাঙ্গা, হামলার প্রেক্ষিতে উভয় ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে আরো সন্দেহ, আরো দূরত্ব, আরো বিদ্বেষ সৃষ্টি হচ্ছে। এই শত্রুতামূলক মনোবৃত্তি যতদিন তাদের মধ্যে বজায় রাখা যায় ততই সাম্রাজ্যবাদী, অস্ত্রব্যবসায়ী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর জন্য সুবিধা; তারা এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিল করতে পারবে। মধ্যপ্রাচ্যে তারা শিয়া সুন্নীর দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে তেলসম্পদসমৃদ্ধ দেশগুলো দখল করে নিচ্ছে। আমাদের এখানে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বটিকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। আমাদের বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, যদি আমরা সত্যিই আমাদের দেশটিকে ভালোবাসি, আমরা উপলব্ধি করি যে এ দেশের মাটিতে আমাদের পূর্বপুরুষের অস্থিমজ্জা মিশে আছে, এই মাটি দিয়ে হিন্দুরা মূর্তি বানিয়ে পূজা করে আর মুসলমানেরা এই মাটি দিয়েই ইটের মসজিদ গড়ে নামাজ পড়ে। এই মাটির ফল-ফসল খেয়েই হিন্দু – মুসলমান উভয় জাতির মানুষ পুষ্ট হয়। আমাদের এই অঞ্চলে হিন্দু মুসলমানের ভিতরে বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব এখন প্রবল যা অবিলম্বে দূর করা জরুরি। যখন কোনো লোকালয়ে অগ্নিকা- হয় তখন কারো ভবনই রক্ষা পায় না, দেবালয় মসজিদ কিছুই এড়ায় না। যখন ইরাক আক্রান্ত হলো তখন সিরিয়ার লোকজন বারে গিয়ে ফুর্তি করেছে। কিন্তু কয়দিন পরে দেখা গেল সেই আগুন সিরিয়াকেও ছাড়ল না, এখন সিরিয়ার মানুষ ইউরোপে ভিক্ষা করে।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করা সহজ কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন করা অত সহজ নয়। ওটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। সরকারগুলো চেষ্টা করে আইন দিয়ে, শক্তি দিয়ে, অর্থ দিয়ে কারণ সরকারের কাছে ওগুলোই আছে। সরকারের প্রতিনিধিরা আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ান, ক্রন্দনরত মানুষের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্ত¦না দেন, ভাঙা উপাসনালয় সংস্কার করে দেন, ভাঙা মূর্তি জোড়া লাগিয়ে দেন, আর্থিক ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মানুষের মন যখন ভেঙে যায় তখন সেটা জোড়া লাগানো সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না। সেজন্য এখন দুই সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। ধর্ম এক নম্বর ইস্যু, ধর্মকে ব্যবহার করে জাতিকে বিভক্ত করা হচ্ছে, বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই বিদ্বেষ বিভক্তি দূর করতে হলে উভয় সম্প্রদায়কে মুক্ত মন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এটা করার জন্য তাদের উভয়কেই বুঝতে হবে তাদের গোড়া কোথায়, তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি কিনা, তারা আদৌ ঐক্যবদ্ধ হতে চায় কিনা। ঐক্যবদ্ধ হতে হলে উভয়পক্ষকেই ছাড় দিতে হয়। তারা তাদের উভয়ের লালিত ধ্যানধারণা, সংস্কার থেকে কতটুকু ছাড় দিতে রাজি হবে। যেহেতু বিষয়টি ধর্মীয় তাই ধর্মবিশ্বাসের মধ্য থেকে কতটুকু তারা বিসর্জন দিতে পারবে, কতটুকু গ্রহণ করতে পারবে, ঐক্যের স্বার্থে তারা কতটুকু উদারতা নিজেদের মধ্যে আনয়ন করতে পারবে এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।

আমরা দেখব হিন্দু ও মুসলমানের বিশ্বাসগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে হাজার হাজার সম্ভাবনা রয়েছে। এই দুটো ধর্মদর্শনের মৌলিক বহু বিষয়ের গোড়া এক জায়গায়, দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে কেবল ডালপালা নিয়ে। এখন এই দুটো ধর্মের মধ্যে কী কী বিষয় সামঞ্জস্যপূর্ণ সেদিকে আলোকপাত করব।

একেশ্বরবাদ: ওয়াহদানিয়াত বা একত্ববাদ। ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা হিসাবে মানা, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা। সনাতন ধর্মেরও মর্মবাণী একমেবাদ্বীতিয়ম (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬:২:১), একমব্রহ্ম দ্বৈত্ব নাস্তি। যার অর্থ হচ্ছে প্রভু ব্রহ্ম একজন। তাঁর কোনো শরিক নাই।

এক বাবা-মা: এক পিতামাতা থেকে সমগ্র মানবজাতির উদ্ভব হয়েছে। এই বিশ্বাস সনাতন ও ইসলাম উভয় ধর্মের অনুসারীরাই লালন করেন। ইসলামে বলা হচ্ছে তাঁরা হচ্ছেন বাবা আদম ও মা হাওয়া। সনাতন ধর্মে তাঁদেরকে বলা হচ্ছে আদম ও হব্যবতী (ভবিষ্যপুরাণ)। চলমান … পর্ব দুই

শিবলিঙ্গ নিয়ে ভুল ধারনা দূর হোক


দূর হোক শিবলিঙ্গ নিয়ে মানুষের ভুল ধারনা।

আমরা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী বলে বর্তমানে এই উপমহাদেশে আমারা ‘হিন্দু’ নামে পরিচিত। তাই এদেশের কিছুকিছু মানুষ যখন-তখন বলে ফেলেন, চাড়াল, মালাউন, ডেডাইয়া, বিধর্মী। তার মানে হলো, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একরকম ঘৃণার চোখেই দেখা। দৈনন্দিন জীবন চলার মাঝে মুসলমান বন্ধুরাও অনেকসময় অনেক প্রশ্ন করে বসে থাকেন। কেউ কেউ প্রশ্ন করে সনাতন ধর্মের মানুষের মৃত্যু হলে পোড়ায় কেন? বারোমাসে তেরো পূজার নাম কী? ৩৩কোটি দেবতার নাম জানা আছে? লিঙ্গপূজা করা হয় কেন এবং কী কারণে করা হয়? এতো টাকাপয়সা খরচ করে মাটি দিয়ে মূর্তি বানিয়ে পূজা করে আবার ফেলে দেওয়া হয় কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার অনেকেই মনে করে থাকেন, হিন্দু ধর্ম হচ্ছে শুধু মূর্তিপূজা এবং হরিনাম সংকীর্তন করাই হিন্দু ধর্মের মূলমন্ত্র। যা নিত্যান্তই একটি ভুল ধারণা।

তবে এই সনাতন (পুরাতন বা প্রাচীন) ধর্মের ভিত্তি বৈদিক শাস্ত্রের কোথায়ও ‘হিন্দু’ শব্দটির উল্লেখ নেই। এই হিন্দু শব্দটি আধুনিক কালে (ঊনবিংশ শতাব্দীতে) সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হয়। বা কালক্রমে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সনাতন ধর্মকে ‘হিন্দু ধর্মে’ পরিণত করা হয়েছে বলে ধারনা করা হয়। ‘হিন্দু’ একটি নির্দিষ্ট জাতি! ‘হিন্দু ধর্ম’ বলতে বোঝায়, হিন্দু জাতির ধর্ম!

জানা যায় ‘হিন্দু’ শব্দের উৎপত্তি প্যারসিক শব্দ থেকে। প্রাচীন কালে নাকি প্যারসিক বলা হত ইরানিদের। হিনস্‌র ভাষায় ‘হিন্দু’ শব্দের অর্থ হল যিনি হিংসা করে না। অতএব যিনি হিংসা করে, তিনি হিন্দু হতে পারে না। অথচ এই হিংসা আর অহংকারে আজ সনাতন ধর্ম তথা হিন্দু ধর্মের অস্তিত্ব দাঁড়িয়েছে শূন্যের কোঠায়। হিংসা আর অহংকার করে বড়বড় পণ্ডিতরাও মানুষকে সঠিক তথ্য দেয় না। মন্দিরে থাকা পুরোহিতের কাছে কেউ ধর্ম বিষয়ে বুঝতে চাইলেও বোঝায় না। আবার নামকরা গুরুদেবরা থাকে শুধু মানুষকে মন্ত্র দিয়ে শিষ্য বানানোর ধান্ধায়ই থাকে ব্যস্ত। যত শিষ্য তত সুনাম, তত তার বাৎসরিক মুনাফা। অথচ ধর্ম বিষয়ে কেউ কিছু জানতে চাইলে গুরু, মহাগুরু, পুরোহিত আর পণ্ডিতেরা বলেন, “এখনো বোঝার জ্ঞান হয় নাই! গুরুর নাম নিতে হবে, তা হলেই আস্তে আস্তে বুঝতে পারবে।”

গুরু মহাগুরুদের এসব কথায় উপর বিশ্বাসী হয়ে সাধারণ মানুষ আর বিশেষ কোনও তথ্য ঘাঁটতে চায় না। গুরুদেবের কথার মাঝেই থেকে যায়। অজানা থেকে যায় ধর্মের তথ্য। তথ্য বা এর মূল ব্যাখ্যা না জানার করণে, আজ বেশিরভাগ মানুষই ‘হিন্দু ধর্ম’ বিষয়ে রয়ে গেছে অজ্ঞ। বৈদিক শাস্ত্রের কোথায়ও কোন জাতি, গোষ্ঠী, বর্ণ বা সমাজের ধর্ম হিসেবে সনাতন ধর্মকে অভিহিত করা হয়নি। অভিহিত করা হয়েছে মানব জাতির বা জৈব ধর্ম (জীবের ধর্ম) বা আর্য ধর্ম হিসেবে। আর এই ‘হিন্দু’ নামের কোনও শব্দ কোনও শাস্ত্রগ্রন্থে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাহলে এই হিন্দু শব্দটা আসলো কোথা থেকে? মূলত ‘আর্য’ ধর্মের পরিবর্তিত নাম হল ‘হিন্দু’ ধর্ম।

আর্য হিন্দুদের আদি-নিবাস ছিল, ইরানের ইউরাল পর্বতের পাদদেশের দক্ষিণে তৃণভূমি অঞ্চলের কিরঘিজিস্তান নামক স্থানে। কোনও একসময় আর্য জনগোষ্ঠী কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ/ ভূমিকম্প অথবা অন্য গোত্রদের আক্রমণের কারণে ইরান থেকে বিতাড়িত হয়। এরপর আর্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে অগ্রসর হয় এবংবর্তমান ভারতর্ষে বসতি স্থাপন করেন। আশ্রয় নেয় সিন্ধু নদীর পাড়ে, তখন তাদের পরিচয় ছিলো ‘সিন্ধু’ নামে। কিন্তু তখনকার সমর অনেকেই সিন্ধু শব্দ উচ্চারণ করতে পারতো না। উচ্চারণ হতো ‘স’ এর পরিবর্তে ‘হ’। তাই সিন্দুর বদলে বলতো হিন্দু। সে থেকেই আজ অবধি এই ‘হিন্দু’ নামেই বিশ্বের কাছে পরিচিত। তাই সেই প্রাচীনকাল থেকে আমরা বর্তমান হিন্দু ধর্মাবলম্বী সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। সে সাথে মূর্তিপূজা ও বিভিন্ন দেবদেবীর পূজার্চনায়ও বিশ্বাসী। আর প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা ৩৩কোটি দেবতাকেই আমরা কেউ-না-কেউ স্মরণ করে থাকি। তবে সংস্কৃতে কোটি শব্দের দুটি অর্থ, একটি হল ‘সর্বোচ্চ’ এবং অপরটি হল ‘কোটি’ (Crore)। বেদে তেত্রিশ কোটি (সংস্কৃত: ত্রয়স্তিমাশতি কোটি) দেবতা বলতে বেদে তেত্রিশ রকমের দেবতার কথা বলা হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য গ্রন্থে এটি পরিষ্কার ভাবে ব্যখ্যা করা হয়েছে। অথর্ব বেদের দশম অধ্যায় সপ্তম সুক্তের ত্রয়োদশ শ্লোকে বলা হয়েছে-
যস্য ত্রয়স্ত্রিংশদ্ দেবা অঙ্গে সর্বে সমাহিতাঃ।
স্কম্মং তং ব্রুহি কতমঃ স্বিদেব সঃ।।

অর্থাৎ, পরম ঈশ্বরের প্রভাবে এই তেত্রিশ জন দেবতা বিশ্বকে বজায় রেখেছে।

শুরুতে ঋক্ বেদে তিন (৩) রকমের দেবতার কথা বলা হয়েছিল। এনারা ছিলেন- অগ্নি, বায়ু এবং সূর্য্য। ঋক্ বেদে পরবর্তী অধ্যায়ে সেই দেবতার সংখ্যা বেড়ে তেত্রিশ (৩৩) রকমের হয়। এনাদের মধ্যে এগারো জন পৃথিবীতে, এগারো জন বায়ুতে এবং বাকি এগারো জন মহাকাশ বা অন্তরিক্ষে অবস্থান করছেন।

এই সনাতন ধর্মের প্রকৃত রূপ উন্মোচনের জন্য আমাদের কতকগুলি ধর্মগ্রন্থ আছে। যে ধর্মগ্রন্থগুলি পাঠ করা প্রত্যেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য আবশ্যক। ধর্মগ্রন্থগুলি হলো– ১। বেদ-৪টি (ঋকবেদ, সামবেদ, যর্জুবেদ, অথর্ববেদ) ২। উপনিষদ-১০৮টি ৩। গীতা-১টি (৭০০শ্লোক) ৪। ভাগবত-১টি (১৮,০০০শ্লোক) ৫। মহাভারত-১টি (৬০,০০০শ্লোক) ৬। পুরাণ-১৮টি ৭। রামায়ণ-১টি
৮। চৈতন্য চরিতামৃত-১টি
এই গ্রন্থগুলোর পাঠ করলে জানা যাবে সনাতন ধর্মের কলেবর কতো বিশাল আর জ্ঞানগভীর। তবে রামায়ন আর মহাভারতে বৈদিক যুগের ইতিহাস লিপিবদ্ধ। ধর্মের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পেতে আমাদের আশ্রয় নিতে হবে ভাগবতের। তবে উল্লেখিত প্রতিটি গ্রন্থই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয়ও বটে। তবে আমি আর্য/হিন্দু ধর্ম নিয়ে কোনও আলোচনা করছি না। আমি শুধু শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গ পূজা নিয়ে কিছু আলোচনা করতে চাই।

কথিত আছে আমাদের চারপাশ ঘিরে আছে তেত্রিশ কোটি দেবতা। আসলে কিন্তু ৩৩কোটি নয়, ৩৩ রকমের দেবতা। জানা নেই, ৩৩ রকমের দেবতার পূজার বিধানও। শুধু হাতেগোনা কিছুসংখ্যক দেবদেবীর পূজার্চনাই আমরা করে থাকি। এক কথায় যাকে বলে বারমাসে তেরো পূজা। তারমধ্যে একটি আলোচিত পূজার নাম হলো ‘লিঙ্গ’ পূজা। যে পূজা শুদ্ধভাবে বলা হয় ‘শিবলিঙ্গ’ পূজা বা শিবরাত্রি। আর ‘লিঙ্গ’ পূজা নামে যেই শব্দটি প্রচলিত, তা আসলে বিকৃত শব্দ। এই পূজাটি বছরে ১৬টি সোমবারে অনেকেই করে থাকে। তবে শিবের নামে যেই পূজাগুলো হয়ে থাকে, তা হলো ‘শিব পূজা’, শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গ পূজা।

শিবরাত্রি:
সব ব্রতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল এই মহাশিবরাত্রি। এই মহাশিবরাত্রি ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথিতে পালিত হয়। মহাশিবরাত্রি হল হিন্দুধর্মের সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবাদিদেব মহাদেব শিবের মহারাত্রি। ব্রত/পূজার আগের দিন ভক্তগণ নিরামিষ আহার করে। রাতে বিছানায় না শুয়ে মাটিতে শোয়া হয়। ব্রতের দিন তারা উপবাসী থাকে। তারপর রাত্রিবেলা চার প্রহরে শিবলিঙ্গকে দুধ, দই, ঘৃত, মধু ও গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করানো হয়। তারপর বেলপাতা, নীলকন্ঠ ফুল, ধুতুরা, আকন্দ, অপরাজিতা প্রভৃতি ফুল দিয়ে পূজা করা হয়। আর ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ নমঃ, এই মহামন্ত্র জপ করা হয়। ছোটবেলায় আমার মা-বোনদেরও এই শিবরাত্রি ব্রত করতে দেখেছি। শিবরাত্রি সবচেয়ে বেশি জাঁকজমকভাবে শিবরাত্রি উদযাপন করা হয়, হিন্দু রাষ্ট্র নেপালে।

এই নিয়ে দৈনন্দিন জীবন চলার মাঝে অনেক মুসলিম বন্ধুদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তারা অনেকে একে পুরুষাঙ্গের পূজা হিসেবে ব্যাখ্যা করে অশ্লীলতা বলে মনে করেন। তা একেবারেই ভুল ধারণা আর এটা একরকম তাদের মনগড়া কথাই বলা চলে। অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও এর মূল তথ্য জানে না। না জানার করণেই, প্রশ্নকারীর প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে না। তখন প্রশ্নকারী নিজেই এর ভুল ব্যাখ্যা দিতে থাকেন। আর উত্তরদাতা উত্তর না দিতে পেরে লজ্জায় বরফ হয়ে যায়। আসলে এখানে কোনও অশ্লীলতার ছোঁয়া নেই, লজ্জার কোনও ব্যাপারও নেই। আছে শুধু অনেককিছু দেখার ও বোঝার। হিন্দু ধর্মে শিবকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বলে মনে করা হয়। কাজেই তার শিবলিঙ্গ যে দেবতা শিবের প্রতীকী পূজা, তা বোঝা প্রয়োজন।

শিবলিঙ্গ:
শিব কথার অর্থ, সত্য, সুন্দর ও মঙ্গল। আর লিঙ্গ কথার অর্থ, প্রতীক। এ হলো হিন্দুদের দেবতা শিবের একটি সত্যে ও মঙ্গলের প্রতীক চিহ্ন। শিবকে এই প্রতীকের সাহায্যেই প্রকাশ করা হয়। শিব থাকেন ব্রহ্মের ধ্যানে লীন, আর সব মানুষকেও ব্রহ্মের প্রতি ধ্যানমগ্ন হতে উপদেশ দেন। শিব লিঙ্গের উপরে ৩টি সাদা দাগ থাকে যা শিবের কপালে থাকে। তাই শিবলিঙ্গ যদি কোন যৌনইন্দ্রিয় বুঝাত, তা হলে শিবলিঙ্গের উপরে ঐ ৩টি সাদা তিলক রেখা থাকত না। এখানেও অনেকের অনেককিছু বোঝাবার প্রয়োজন বলে মনে করি।

শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গের পূজা হিন্দুদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। যেসব শিব মন্দিরে শিবলিঙ্গের মূর্তি তৈরি করা আছে, সেসব মন্দিরে পূজা হয়। এই পূজাটির প্রচলন বহু প্রাচীন যুগ থেকেই ভারত-সহ বাংলাদেশেও প্রচলিত রয়েছে। আর এই শিবলিঙ্গ পূজার রীতি সম্পর্কেও রয়েছে অনেক ভুল ধারণা। অনেক মানুষ সোজা কথায় বলে ফেলে লিঙ্গ পুজা। আসলে এটি লিঙ্গ পূজা নয়, এটি দেবতা শিবের প্রতীকী পূজা বা শিবরাত্রি পূজা। এই শিবরাত্রিতে শিবলিঙ্গে জল, দুধ, ঢালা হয় বলে অনেকে ভুল বুজে নানা কুৎসা রটায়।

গুণীজনরা শিবলিঙ্গকে মোট তিনভাগে ভাগ করে এর আলাদা আলাদা নামও দিয়েছে।
১। সবচেয়ে নীচের চারমুখী অংশটি থাকে মাটির নীচে।
২। মাঝখানের অংশটি আটমুখী, যা বেদীমূল হিসেবে কাজ করে।
৩। উপরের অর্ধবৃত্তাকার অংশটি পূজিত হয়।

এই তিনটি অংশের সবচেয়ে নীচের অংশটি ব্রহ্মা, তার উপরের অংশটি বিষ্ণু ও একেবারে উপরের অংশটি শিবের প্রতীকী চিহ্ন। বেদীমূলে একটি লম্বাকৃতি অংশ রাখা হয়, যা শিবলিঙ্গের মাথায় ঢালা জল বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে। এই অংশের নাম গৌরীপট্ট, যা মূলত যোনিপ্রতীক। যেই পথ অনুসরণ করে পৃথিবীতে আসেছি আমরা সবাই। আসেছে মুনি মহামুনিগণ, আসেছে রাজা বাদশা আর ফকির সাধু গুরু মহাগুরুও। শিবলিঙ্গ পূজার মধ্যে কোনও অশ্লীলতা নেই। শিবলিঙ্গ একই সঙ্গে শিবের সৃজনাত্মক ও ধ্বংসাত্মক রূপের প্রতীক। শিবলিঙ্গ ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক আর সত্যের প্রতীক। শিবলিঙ্গ যেহেতু ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক, সেহেতু ‘লিঙ্গ’ শব্দটির অর্থ কিন্তু পুরুষাঙ্গ নয়, বরং একটা প্রতীকী চিহ্ন মাত্র।

সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা প্রচলিত বিশ্বাস হল এই যে, এই শিব লিঙ্গ পূজা শুধু অবিবাহিত মেয়েরাই করে থাকে। কিন্তু না, অবিবাহিত আর বিবাহিত মেয়েরা শিবলিঙ্গের কাছে যাওয়াও অনুচিত। কারণ, মেয়েদের শরীর সবসময় পবিত্র থাকে না, তাই। আবার নারীই পুরুষের ধ্যানভঙ্গের প্রধান কারণ বলে বিবেচিত। কুমারী নারীর সান্নিধ্যে পুরুষের চিত্তবিচলন ঘটার সম্ভাবনা আরও বেশি। সেই পুরুষ সাধু হলেও নিয়ম অন্যরকম নয়। কাজেই শিবের কাছাকাছি যাওয়ার ব্যাপারে কুমারী মেয়েদের কিছু বিধিনিষেধ আছে।

আর যেসব জায়গায় বসে দেবতা শিব ধ্যান জপতেন, সেই জায়গাগুলি ছিল অত্যন্ত পবিত্র। শিবের ধ্যানক্ষেত্রের আশেপাশে স্বয়ং দেবতাদেরও প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কারণ, সকলকেই খেয়াল রাখতে হত, শিবের ধ্যানে যাতে কোনওভাবে বিঘ্ন না ঘটে। শিবের ধ্যানে কোনওরকম বাধা পড়লেই শিব অসন্তুষ্ট হবেন। আর শিব একবার অসন্তুষ্ট হলে মহাবিপদ। এমনিতেই শিব হলেন, ধ্বংসলীলার দেবতা, তিনি অসন্তুষ্ট হলে মুহূর্তেই ধ্বংসলীলায় পতিত হবে পৃথিবী।

তাই বলে কি মেয়েদের শিব পূজায় কোনও নিষেধাজ্ঞা আছে? না। এখনো ভারতসহ বাংলাদেশের বহু কু‌মারী মেয়েরা দেবতা শিবের পূজা করে। তারা শিবরাত্রি/শিবলিঙ্গকে অনুস্মরণ করে ১৬টি সোমবারে ব্রত করে থাকেন। ফাল্গুন মাসের শিবরাত্রি ছাড়াও এই শিবের পূজা মেয়েরা বারোমাসই করে। শিবের ব্রত করার সময় মেয়েরা উপবাস রাখেন। পণ্ডিতরা বলেছেন, শ্রাবণ মাসে এই ব্রত রাখলে নাকি বিশেষ উপকার পাওয়া যায়। বিবাহিত মেয়েরা শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গ পূজা করে স্বামীর সুখ আর আয়ু বৃদ্ধির জন্য। আর অবিবাহিত মেয়েরা পূজা করে তার জীবনে একটা শক্তিমান ও আদর্শবান পুরুষ আসার কামনায়। পৃথিবীর সব ধর্মের অবিবাহিত মেয়েরাই চায়, তার জীবনে একজন সৎ এবং আদর্শবান পুরুষ আসুক। তাই সারা দুনিয়ার হিন্দু ধর্মের অবিবাহিত মেয়েরা শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গ ব্রত/পূজা করে। আগে এবং বর্তমানেও শিবলিঙ্গের পূজা সারা ভারত-সহ বাংলাদেশেও জনপ্রিয়। শুদ্ধ পঞ্জিকা মতে প্রতিবছর নির্ধারিত দিনে শিবরাত্রি / শিবলিঙ্গের পূজা করা হয়।

আমি ১৪০০ বাংলা সনের প্রথম দিকে একবার ভারতে গিয়েছিলাম। সেখানে অবস্থান করেছিলাম প্রায় বছর দেড়েকেরও বেশি। সেখানে থাকা অবস্থায় দেখেছি সেখানকার শিবরাত্রি উদযাপনের দৃশ্য। সেখানকার মানুষের মুখে শুনেছি, দিল্লি, চেন্নাই, হরিয়ানায় খুবই জাঁকজমকভাবে এই দিবসটি পালিত হয়। শিবের পূজার দিনে মেয়েরা পু‌রুষদের সাহায্যকারী হিসেবেও কাজ করেন‌। যেমন, ধোয়ামোছা, শঙ্খ বাজানো, উলুধ্বনি দেওয়া।
আবার আমাদের দেশেও দেখা যায়, মেয়েরা স্নানের পর, শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢেলে ভক্তি দেয়। মেয়েদের শিবভক্তির নানা উল্লেখ রয়েছে শিব পুরাণেও। শিবকে সন্তুষ্ট করতে পারলে নাকি মেয়েরা শিবের মতোই শক্তিমান ও আদর্শবান স্বামী লাভ করেন।

পরিশেষে:
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে হাতে-হাতে মোবাইল ফোন। থাকে ইন্টারনেট সংযোগের সুবিধা। আর ইন্টারনেট মানে হলো সারা দুনিয়া ভ্রমণ করা। ইন্টারনেট মানে হলো তথ্যের ভাণ্ডার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। তথ্য সংগ্রহ করা মানে না জানা অনেককিছু জানা। এই ইন্টারনেট গুগল-এ অথবা ইয়াহুতে সার্চ করলেই পৃথিবীর সবকিছুই সহজে জানা যায়, দেখা যায়। তবু আমরা সঠিক তথ্যের দিকে না তাকিয়ে মনগড়া কথা বলে বিভ্রান্তি ছড়াই। সৃষ্টি করে তুলি দাঙ্গাহাঙ্গামা, ছোট করি একে অপরের ধর্মকে। তাই সবশেষে আবারও বলছি, হুন্দু ধর্মে বা আর্য ধর্মে একক শব্দ ‘লিঙ্গ’ পূজার কোনও অস্তিত্ব নেই। আছে ‘শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গ’ ব্রত/পূজা।

অথচ এমন একটা সত্যকে আড়ালে রেখে, কিছু মানুষ এই পূজাকে নানাভাবে কলঙ্কিত করছে। দিচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন বানোয়াট তথ্য, রটাচ্ছে অকথ্য কথ।বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলে সার্চ করলেই দেখা যায়, এই পূজা বিষয়ে নানাধরনের কথা। দেখা যায় বর্তমান যুগের স্বাদের ফেসবুক পেইজেও। যাই হোক কেউ জেনেও নিন্দা করে, আবার কেউ না জেনে না শুনেও নিন্দায়। আসল ঘটনায় খুব কম মানুষেই তাকায়। আশা করি মহান সৃষ্টিকর্তা সবাইকে বোঝবার শক্তি দান করবেন। তার দয়ায় দূর হবে শিবলিঙ্গ নিয়ে মানুষের ভুল ধারনা। সবাই বুঝবে যেখানে সত্য, সেখানেই শিব। যেখানে শিব, সেখানেই সুন্দর। যেখানে সত্যের প্রতীক, সেখানেই ‘শিবলিঙ্গ’।
সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্

লেখার বিস্তারিত হিন্দু ধর্মবিষয়ক তথ্য বিভিন্ন অনলাইন সাইট এবং শিব পুরাণ থেকে সংগৃহীত।
ছবি ইন্টারনেট থেকে।