আমাদের ঈদ উদযাপনের বাস্তবতা

আনন্দ ও বেদনা আত্মার ভেতর থেকে আসতে হয়, জোর করে এটি করা যায় না। একটা মানুষ আত্মা থেকে তখনই আনন্দ অনুভব করে যখন তার কোনো আকাক্ষা, স্বপ্ন পূরণ হয়, যেমন পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করা, চাকরিতে পদোন্নতি পাওয়া, যে কোনো প্রতিযোগিতায় ভাল করা ইত্যাদি। ঠিক একইভাবে একজন আত্মা থেকে বেদনা, কষ্ট অনুভব করে তখনই যখন সে তার কোন আকাক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। যদি কোনো ব্যক্তি সকল বিষয়ে সফল হতে থাকে তবে ছোট খাট ব্যর্থতা তাকে কষ্ট দিতে পারে না, একইভাবে আজন্ম ব্যর্থ ব্যক্তি দু’-একটা সফলতায় খুব বেশি আনন্দিত হতে পারে না। শোকে, কষ্টে তার চেহারা হয়ে যায় নিরানন্দ, করুণ, তার চেহারায় আনন্দ যেন বেমানান।

সে আনন্দ করলেও লোকে দেখে ঠাট্টা করবে, তাছাড়া ব্যর্থতার সমুদ্রে নাকানি-চুবানি খাওয়া অবস্থায় বিশেষ কোনো দিনে ঘটা করে মহা আনন্দিত হওয়া নিতান্তই বোকামী। এটা গেল ব্যক্তি পর্যায়ের আনন্দের ও বেদনার কথা কিন্তু একটা জাতি কখন আনন্দিত হতে পারে? এক্ষেত্রেও আনন্দিত ও বেদনার্ত হওয়ার সূত্র একই, অর্থাৎ কোনো জাতি যখন জাতিগতভাবে বিশেষ কিছু অর্জন করে, কোনো আকাক্ষা বা লক্ষ্য সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে পূরণ করে তখন ঐ জাতির প্রত্যেকেই অত্যন্ত আনন্দিত হয় এবং এর বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে উৎসবের আয়োজন করাও যুক্তিযুক্ত হবে।

কিন্তু কোনো জাতি যদি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পরাজিত, অপমানিত, লাঞ্ছিত, নিষ্পেষিত হতে থাকে অনবরত তবে সেই জাতির অন্তত জাতিগতভাবে লাঞ্ছনার জীবনের অবসান না হওয়া পর্যন্ত আনন্দ উৎসব করা যুক্তিযুক্ত হবে বলে আমি মনে করি না। যাদের বিন্দুমাত্র কোনো প্রাপ্তি নেই, জাতিগতভাবে অপমান আর লাঞ্ছনা যাদের নিত্যসঙ্গী তাদের আনন্দ উৎসব করার ইচ্ছা জাগে কী করে? অবশ্য যাদের অপমান বোধই নেই তাদের পক্ষে সবই সম্ভব। জাতির লক্ষ্য সম্পর্কেই যারা অজ্ঞাত তাদের আবার লক্ষ্য অর্জন করতে না পারার বেদনা কোথায়! যে পরীক্ষাই দেয় না তার তো অকৃতকার্য হবার কিছু নেই। যাই হোক, একটা জাতির মধ্যে অনেক ধরনের মানুষ থাকে সুতরাং আমি বিশ্বাস করি এই মুসলিম নামক জনসংখ্যার অতি অল্প সংখ্যক মানুষ হলেও আছে যারা এই জাতিকে নিয়ে ভাবে, তাই তাদের উদ্দেশ্যেই কিছু কথা বলা দরকার।

রসুলাল্লাহ মক্কার ১৩ বছরে ঈদ উদযাপন করেন নাই, তিনি সর্বপ্রথম ঈদ উদযাপন করেন দ্বিতীয় হেজরী অর্থাৎ সমাজে আল্লাহর হুকুমত, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পর। কারণ তখন মদীনায় ইসলামের বিজয়কেতন পতপত করে উড়ছে, ইসলামের যে লক্ষ্য, যে উদ্দেশ্য (সমস্ত পৃথিবীব্যাপী আল্লাহর সত্যদীন তথা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে শান্তি আনয়ন) তা বাস্তবায়িত হওয়া শুরু হয়েছিল এবং রসুলাল্লাহর ওফাতের পর ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। এরপর জাতি তার আকীদা, তার উদ্দেশ্য ভুলে গেল, তারা ভুলে গেল তাদের কেন সৃষ্টি করা হয়েছে কিন্তু ততোদিনে তারা অর্ধপৃথিবীর শাসনকর্তা, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, অর্থ-সম্পদে সকল দিক দিয়ে সর্বোচ্চ আসনে আসীন। শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে তারা পরবর্তী প্রায় সাত/আটশ’ বছর পর্যন্ত ছিল তবে বিভিন্ন দিক দিয়ে তাদের পরাজয়, অধঃপতন শুরু হয়ে গিয়েছিল। তখন পর্যন্তও তাদের জন্য ঈদ উদযাপন যুক্তিযুক্ত ছিল কিন্তু যখন থেকে তারা ইউরোপীয় শক্তির দাসে পরিণত হলো, জাতিগতভাবে পরাজয়, অপমান, লাঞ্ছনা যখন পিছু নিল তখন থেকে আর ঈদ উদযাপন যুক্তিযুক্ত রইল না।

আর বর্তমানের অবস্থা তো আরও ভয়ঙ্কর, পৃথিবীর অন্য সব জাতিগুলি এই জনসংখ্যাকে পৃথিবীর সর্বত্র ও সর্বক্ষেত্রে পরাজিত করছে, হত্যা করছে, অপমানিত করছে, লাঞ্ছিত করছে, তাদের মসজিদগুলি ভেংগে চুরমার করে দিচ্ছে অথবা সেগুলিকে অফিস বা ক্লাবে পরিণত করছে। এই জাতির মা-বোনদের তারা ধর্ষণ করে হত্যা করছে। কয়েক শতাব্দী আগে আল্লাহ ইউরোপের খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলিকে দিয়ে মুসলিম বলে পরিচিত এই জাতিটিকে সামরিকভাবে পরাজিত করে তাদের গোলাম, দাস বানিয়ে দিয়েছেন। এটা ছিল আল্লাহর শাস্তি।

আর বর্তমানেও পৃথিবীর কোথাও আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠিত নেই, অধিকাংশ জায়গাতে মুসলিম নামক এই জাতি অন্য জাতির হাতে মার খাচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে, পরাজিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে, একটার পর একটা ভূখ- ধ্বংস ও দখল করে নিচ্ছে অন্য জাতি, দুর্ভিক্ষে পতিত হয়ে মারা যাচ্ছে, সাড়ে ছয় কোটি মুসলমান উদ্বাস্তু। আবার এ জাতির সদস্যরা নিজেরা নিজেরাও শিয়া-সুন্নি, ফেরকা-মাজহাব, দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে মারামারি করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। জাতির মধ্যে কোনো ঐক্য চেতনা নেই। এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে তো জাতি একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কাজেই আমাদের উচিত হবে রসুলাল্লাহ (সা.) এর ঈদ উদযাপন ও এর লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সচেতন হওয়া ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া। এবারের ঈদ যেন আমাদের মধ্যে জাতিগত এই ঐক্যচেতনা সৃষ্টি করে, আমীন।

5 thoughts on “আমাদের ঈদ উদযাপনের বাস্তবতা

  1. আমাদের উচিত হবে রসুলাল্লাহ (সা.) এর ঈদ উদযাপন ও এর লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সচেতন হওয়া ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া। এবারের ঈদ যেন আমাদের মধ্যে জাতিগত এই ঐক্যচেতনা সৃষ্টি করে, আমীন।

  2. ভালো আলোচনা। সামাজিক বা সম্প্রদায়ের দূরত্ব ঘুচে যাক। ভালোবাসা ভালোবাসা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  3. আমাদের ঈদ উদযাপনের বাস্তবতা যাই হোক না, আমরা যেন সুখি হই। 

  4. জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে চাই শান্তি।

  5. আমরা শান্তি চাই শান্তিতে থাকতে চাই।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।